নাবিক-বধূ/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
মস্তকে গুরুতর আঘাত পাইয়া ডড্লে ‘ধাও’র ডেকের উপর মূর্চ্ছিত হইবার পর দীর্ঘকাল পর্য্যন্ত তাঁহার চেতনা-সঞ্চার হইল না। সংজ্ঞালাভ করিয়া তিনি সর্ব্বাঙ্গে অসহ্য বেদনা অনুভব করিলেন। তিনি উঠিয়া বসিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু উঠিতে পারিলেন না, দেখিলেন, তাঁহার হস্তপদ দৃঢ়রূপে বন্ধুবদ্ধ। উঠিয়া বসা দূরের কথা, তাঁহার নড়িবার পর্য্যন্ত সামর্থ্য নাই। তখন মধ্যাহ্নকাল অতীতপ্রায়, সূর্য্যকিরণ তাঁহার মুখের উপর পড়িতেছিল। প্রখর রৌদ্রসম্পাতে তিনি চক্ষুতে অসহ্য জ্বালা অনুভব করিলেন। সর্ব্বাঙ্গ যেন পুড়িয়া যাইতেছিল। তাঁহার জিহ্বা ফুলিয়া আড়ষ্ট হইয়া গিয়াছিল। তিনি মাথা তুলিবার চেষ্টা করিয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। তিনি বুঝিতে পারিলেন, তিনি ছদ্মবেশে যে ‘ধাও’র উপর ছিলেন, তাহা হইতে তাঁহাকে স্থানান্তরিত করিয়া একখানি ক্ষুদ্র নৌকায় স্থাপন পূর্ব্বক নৌকাখানি সমুদ্রে ভাসাইয়া দেওয়া হইয়াছে।—নৌকায় মাঝি-মাল্লা কেহই নাই, অকূল সমুদ্রে নৌকাখানি ভাসিয়া চলিয়াছে।—তিনি বুঝিলেন, ইহা আমেদ বেন্-হাসেনেরই কার্য্য। সে কোনরূপে তাঁহার গুপ্ত অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া বৈরনির্য্যাতনের জন্য এই পন্থা অবলম্বন কবিয়াছে।—কিন্তু সে তাঁহাকে সেই স্থানে হত্যা করিল না কেন? তাহা হইলে ত মুহূর্ত্তে সকল যন্ত্রণার অবসান হইত। বোধ হয় এই ভাবে যন্ত্রণা দিয়া হত্যা করাই তাহার অভিপ্রেত। হঠাৎ তাঁহার মনে পডিল, মোজাম্বিকে কন্সলের গৃহে যে দিন রাত্রিকালে অজ্ঞাতনামা আততায়ী কর্ত্তৃক আক্রান্ত হন—সেই রাত্রে তিনি যে দুঃস্বপ্ন দেখিয়াছিলেন, সেই স্বপ্ন আজ সফল, হইয়াছে। তিনি স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন, তাঁহার মৃতদেহ একখানি খোলা নৌকায়, অকুল সমুদ্রে ভাসিয়া যাইতেছে—এখন পর্য্যন্ত তাঁহার মৃত্যু হয় নাই বটে, কিন্তু তাহার যে আর অধিক বিলম্ব নাই—ইহা অনুমান করা কঠিন হইল না। মিঃ ডড্লে কাতরস্বরে বলিলেন, “হে পরমেশ্বর, আর আমাকে যন্ত্রণা দিও না, দয়া করিয়া এই মুহূর্ত্তেই আমার জীবনান্ত কর। আর ত এ কষ্ট সহ্য হয় না।”
কিন্তু ইচ্ছা করিলেই ইহজীবনের অবসান হয় না, পরমেশ্বর তাঁহার প্রার্থনা পূর্ণ করিলেন না। তিনি যন্ত্রণায় ছট্-ফট্ করিতে লাগিলেন। সহসা নৌকার খোলের ভিতর হইতে কে যেন অস্ফুটস্বরে আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিল। সেই আর্ত্তনাদ তাঁহার শ্রবণবিবরে প্রবেশ করিবামাত্র তিনি সেই শব্দ লক্ষ্য করিয়া কাণ পাতিয়া রহিলেন। তাঁহার মনে হইল, এই স্বর তাঁহার পরিচিত। কিন্তু সেই আর্তস্বর তিনি আর শুনিতে পাইলেন না, তখন ক্ষীণকণ্ঠে বলিলেন, “সামওয়েলি, তুমি কি আমার মত এই নৌকায় বাঁধা আছ?—সামওয়েলি।”
ডড্লের কণ্ঠস্বর সামওয়েলির কর্ণে প্রবেশ করিল, কিন্তু তাহার অবস্থা অধিকতর শোচনীয় হইয়াছিল, সে কোন কথাই বলিতে পারিল না, একবার গোঁঙাইয়া সাড়া দিল মাত্র।—ইহাতেই তিনি বুঝিতে পারিলেন, দুরন্ত আরব তাঁহাকে ও সামওয়েলিকে হাত-পা বাঁধিয়া এই নৌকায় তুলিয়া নৌকাখানি সমুদ্রে ভাসাইয়া দিয়াছে।—কয়দিন ধরিয়া তাঁহারা সমুদ্রে ভাসিয়া চলিয়াছেন কে বলিবে?—উদরে অন্ন নাই, শরীর অতি দুর্ব্বল, পিপাসায় কণ্ঠ শুষ্ক, হস্ত পদের বন্ধন এরূপ দৃঢ় যে, নড়বারও সামর্থ্য নাই, রজ্জু মাংস কাটিয়া বসিয়াছে, বন্ধন-স্থান ফুলিয়া উঠিয়াছে, শোণিত-সঞ্চালন রহিত হওয়ায় শিরাগুলি টন্-টন্ করিতেছে, চক্ষু মেলিবারও শক্তি নাই। ডড্লের মাথা ঘুরিতে লাগিল, বুদ্ধিভ্রংশ হইল, অবশেষে তাঁর সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইল। কিছুকালের জন্য সকল যন্ত্রণার অবসান হইল।—সামওয়েলির অবস্থা তাঁহার অবস্থা অপেক্ষাও শোচনীয় হইয়াছিল, দারুণ পিপাসায় অস্থির হইয়া সে ক্রমাগত জল জল করিয়া আর্ত্তনাদ করিতেছিল। তাহার পর তাহারও চেতনা বিলুপ্ত হইয়াছিল।
প্রায় দুই ঘণ্টা এই ভাবে অতিবাহিত হইল, তাহার পর পুনর্ব্বার ডড্লের চেতন’-সঞ্চার হইল। তিনি চক্ষু খুলিয়া ঊর্দ্ধাকাশে দৃষ্টিপাত করিলেন,সূর্যের প্রখর কিরণ তাঁহার চক্ষুর উপর প্রতিফলিত হইল, তিনি চক্ষু মুদিত করিলেন। সেই অবস্থায় তাঁহার মনে হইল—তাঁহার চক্ষুর উপর কিসের ছায়া পড়িয়াছে। মেঘ কি?—আকাশের কোন দিকে তখন ত মেঘ ছিল না।—তিনি চক্ষু মেলিয়া দেখিলেন, তাঁহার দেহের উপর একখানি বোটের প্রকাণ্ড পালের ছায়া পড়িয়াছে।—তিনি সোৎসুক-নেত্রে চাহিয়া দেখিলেন, কিছুদূর দিয়া একখানি ‘ধাও’ ভাসিয়া যাইতেছে। দেখিবামাত্র চিনিলেন—ইহা আমেদ বেন্-হাসেনের ধাও! আমেদ বেন্ পূর্ব্ব-কথিত জাহাজ হইতে অস্ত্রশস্ত্রাদি সংগ্রহ করিয়া আফ্রিকার উপকূল অভিমুখে প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছে। ধাওখানি তাঁহার নৌকার এত নিকট দিয়া যাইতেছিল যে, তিনি তাহার দুই চারিজন মাল্লাকেও চিনিতে পারিলেন। তিনি আরও দেখিলেন, তাঁহার শত্রু আমেদ বেন্ হাসেন ধাওর এক পাশে দাঁড়াইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিয়াছে; তাহার হাতে একটি বন্দুক। সে তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া গুলি করিল, কিন্তু গুলি তাঁহার দেহে বিদ্ধ হইল না, তাঁহার মস্তকের অদূরে পড়িয়া নৌকার পাটাতনে বিদ্ধ হইল, পাটাতনের খানিকটা কাঠ চটিয়া গেল।—ডড্লে মনে মনে বলিলেন, “গুলিটা কেন আমার মস্তকে প্রবেশ করিল না? তাহা হইলে ত এই মুহূর্ত্তে আমার সকল যন্ত্রণার অবসান হইত।—আমার ভাগ্যদোষেই উহার লক্ষ্য ব্যর্থ হইল।”
ধাওখানি অদৃশ্য হইলে ডড্লে ক্ষীণস্বরে সামওয়েলিকে আহ্বান করিলেন, কিন্তু তাহার কোন সাড়া পাইলেন না। তখন তাঁহার ধারণা হইল, সামওয়েলি নিদারুণ যন্ত্রণায় প্রাণত্যাগ করিয়াছে, কিন্তু সে সত্যই মরিয়াছে কি না তাহা দেখিবার শক্তি হইল না। তিনি একইভাবে নৌকার উপর পড়িয়া রহিলেন। ক্রমে দিবাবসান হইল। শ্রান্ত রবি ধীরে ধীরে পশ্চিম গগন-প্রান্তে অস্তগমন করিলেন। সূর্য্যাস্তের পর সমুদ্রের মুক্ত বক্ষের উপর দিয়া শীতল সমীরণ প্রবাহিত হইতে লাগিল। সেই সুশীতল সমীরণ-প্রবাহে ডড্লের বেদনাপ্লুত দেহ যেন অনেকটা সুস্থ হইল, স্নেহময়ী জননী যেন বেদনাতুর শ্রান্ত শিশুকে ধীরে ধীরে বীজন করিয়া তাঁহার সকল সন্তাপ দূর করিতে লাগিলেন। তখন তাঁহার চেতনা বিলুপ্তপ্রায়, সেই অবস্থাতেও তাঁহার হৃদয়ে নূতন আশার সঞ্চার হইল, মনে হইল, এত কষ্টেও যখন প্রাণ বাহির হয় নাই, তখন ভগবান হয় ত তাঁহার প্রাণরক্ষা করিবেন। এই দারুণ সঙ্কট হইতে তিনি উদ্ধার লাভ করিবেন।—আশা মায়াবিনী।
ক্রমে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইল। জীব-কোলাহলশূন্য দিগন্তব্যাপী মহাসমুদ্রে সন্ধ্যা কি গম্ভীর। কি নিস্তব্ধ।—দেখিতে দেখিতে গগনের নীল সরোবরে শত-শত শুভ্রজ্যোতি নক্ষত্র শ্বেতকমলের ন্যায় বিকশিত হইল। তাহারা যেন স্থির-দৃষ্টিতে সহানুভূতিভরে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।—আরও কিছুাল পরে শশধর পূর্ব্বাকাশে সমুদিত হইয়া সমগ্র প্রকৃতি রজত-ধবল কিরণ-প্রবাহে প্লাবিত করিলেন। শুভ-স্নিগ্ধ কিরণ সম্পাতে বিশ্ব-প্রকৃতি হাসিতে লাগিল। সঙ্গে-সঙ্গে নৈশ-সমীরণ-প্রবাহ প্রবল হইল। বায়ুবেগে ক্ষুদ্র নৌকাখানি উত্তাল সমুদ্র-তরঙ্গে আন্দোলিত হইতে লাগিল, নৌকার উপর দুই একবার জলও উঠিল। ডড্লের মনে হইল, এইবার বুঝি ভরা ডুবিবে।— কিন্তু নৌকা ডুবিল না, হেলিয়া-দুলিয়া জলের উপর দিয়া ভাসিয়া চলিল। ডড্লে বিস্ফারিত নেত্রে স্নিগ্ধজ্যোতি জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর দিকে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার মনে হইতে লাগিল,শত শত ভীষণ-দর্শন প্রেত সহসা সমুদ্রগর্ভ হইতে সমুত্থিত হইয়া তাঁহার ক্ষুদ্র তরণীখানি পরিবেষ্টনপূর্ব্বক উদ্দাম নৃত্য আরম্ভ করিয়াছে। বায়ু প্রবাহে তিনি তাঁহার উষ্ণ দেহে তাহাদের শীতল স্পর্শ অনুভব করিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। ভয়ে কি?—এখনও ভয়।—মৃত্যুর অতলস্পর্শ অনন্তশয্যায় আশাহীন, শান্তিহীন, অবলম্বনহীন, অবসাঙ্গ প্রসারিত করিয়াও ভয়?—মৃদু হাস্য তাঁহার শুষ্ক অধরপ্রান্তে আত্মপ্রকাশ করিয়া তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত হইল, তিনি ধীরে-ধীরে চক্ষু মুদিত করিলেন। এবার তাঁহার মনে হইল- কে একজন আলোক-সামান্য রূপবতী নারী রূপের প্রভায় চতুর্দ্দিক উদ্ভাসিত করিয়া এক খানি সুদৃশ্য হিরন্ময় তরণীতে আরোহণ পূর্ব্বক ধীরে ধীরে চন্দ্রমণ্ডল হইতে তাঁহার দিকে নামিয়া আসিতেছেন। তাঁহার অঙ্গে প্রস্ফুটিত শুভ্র-কুসুমের পরিচ্ছদ, তাঁহার স্বর্ণাভ কেশদাম মন্দার-মাল্যে সমাচ্ছন্ন, তাঁহার মুখে প্রসন্ন হাস্য, তাঁহার নয়নের স্নিগ্ধ দৃষ্টি হইতে যেন করুণা ও সমবেদনা ক্ষরিত হইতেছে সেই রমণীমূর্ত্তি ধীরে ধীরে তাঁহার শিয়র-প্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইলে তিনি চিনিতে পারিলেন—রমণী তাঁহার স্বর্গবাসিনী পুণ্যবতী জননী। ডড্লে ‘মা মা’ বলিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, তাঁহার মুদিত নেত্রের প্রান্তে অশ্রুর উৎস উৎসারিত হইল। পাছে সেই মূর্ত্তি মুহূর্ত্তে অদৃশ্য হয়—এই ভয়ে তিনি চক্ষু মেলিয়া চাহিতে পারিলেন না। রমণী ধীরে ধীরে তাঁহার মাথায় হাত বুলাইয়া কোমল কণ্ঠে বলিলেন, “ভয় কি বাছা।—আমি তোমাকে রক্ষা করিতে আসিয়াছি। বিপদ হইতে তোমাকে উদ্ধার করিব,—তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাও।”—ডড্লে বিকারঘোরে ঘুমাইয়া পড়িলেন। তাঁহার সকল জ্বালা যন্ত্রণা বেদনা অন্তর্হিত হইল।
পরদিন যখন তিনি চক্ষু খুলিলেন, তখন দেখিতে পাইলেন, তাঁহার হস্তপদ আর রজ্জুবদ্ধ নহে, বন্ধন অপসারিত হইয়াছে। তিনি যে নৌকায় নিপতিত ছিলেন, সেই নৌকাখানিও আর দেখিতে পাইলেন না। তাঁহার বোধ হইল, তিনি একখানি বৃহৎ জাহাজে স্থূল ক্যাম্বিসের শয্যায় শায়িত রহিয়াছেন। এ কি স্বপ্ন, না সত্য? তিনি চাহিয়া চাহিয়া দেখিলেন জাহাজের মাঝি মাল্লারা তাঁহার চারিদিকে নানা কার্য্যে বাস্তভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। স্টীমারের ঘসঘস শব্দ তাঁহার শ্রবণবিবরে প্রবেশ করিতেছে। জাহাজের মেট এক একবার উচ্চৈঃস্বরে নাবিকদিগকে আদেশ করিতেছিল—তাহাও তিনি শুনিতে পাইলেন, তখন আর তিনি ইহা স্বপ্ন বলিয়া মনে করিতে পারিলেন না। তিনি আকুলদৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন। তাঁহাকে জাগরিত দেখিয়া একজন নাবিক উচ্চৈঃস্বরে কাহাকে কি বলিল, তাহা শুনিয়া শুভ্রবেশধারী একজন পাচক এক পেয়ালা ব্রথ্ একখানি চাম্চে দিয়া নাড়িতে-নাড়িতে তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, এবং কোমলস্বরে বলিল, “কিহে খোদার পোলা, তুমি যে জাগিয়াছ দেখিতেছি। কেমন আছ? বড় কাবু হইয়াছ, নয়?—আচ্ছা উঠিয়া বসিয়া এই ব্রথ্টুকু খাইয়া ফেল দেখি।—ওহো, তুমি বড়ই দুর্ব্বল, তোমার ভাব দেখিয়া বোধ হইতেছে উঠিতে পারিবে না। তা, না পার ক্ষতি নাই, তুমি একটু মাথা তুলিয়া হাঁ কর, আমি এই চাম্চে দিয়া এক-একটু করিয়া খাওয়াইয়া দিতেছি।”
ডড্লে মাথা তুলিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু পারিলেন না। তখন সেই পাচকটি তাঁহার মাথার কাছে বসিয়া সবটুকু ব্রথ্ ধীরে-ধীরে তাঁহাকে পান করাইল। ব্রথ্টুকু সুস্বাদ না হইলেও তাহা পান করিয়া তাঁহার দেহে কিঞ্চিৎ বলাধান হইল। তাঁহার বাক্স্ফূর্ত্তি হইল। তিনি ক্ষীণস্বরে সেই পাচককে জাহাজের নাম জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু শরীর এতই দুর্ব্বল যে, আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিলেন না। তাঁহার অবস্থা বুঝিয়া পাচকটিও তাঁহাকে আর কোন কথা বলিতে দিল না। তাঁহাকে ঘুমাইতে বলিয়া সে প্রস্থান করিল।—ডড্লে অঘোর নিদ্রায় অভিভূত হইলেন। তাঁহার যন্ত্রণার অনেক উপশম হইয়াছিল।
যখন তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল, তথন মধ্যাহ্নকাল। তিনি চক্ষু মেলিয়া দেখিলেন, জাহাজেব খালাসীরা তাঁহার অদূরে বসিয়া মধ্যাহ্ন ভোজনে রত আছে। দীর্ঘকাল সুনিদ্রায় তাহার শ্রান্তি ক্লান্তি বিদূরিত হইয়াছিল, দেহে যেন নবজীবনের সঞ্চার হইয়াছিল।—তিনি জাগিয়াছেন শুনিয়া পূর্বোক্ত পাচকটি কিছু লঘু খাদ্যদ্রব্য লইয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত হইল, এবং সযত্নে তাঁহাকে ভোজন করাইল, তাঁহার আহার শেষ হইলে সে বলিল, “তুমি বাপু এ যাত্রা বড় বাঁচিয়া গিয়াছ। আমরা যখন তোমাকে ধরাধরি করিয়া নৌকা হইতে জাহাজে তুলিলাম-তখন মনে হইয়াছিল ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তুমি অক্কা পাইবে।—তোমার শরীরে কিছু ছিল না, তাহার উপর যে শক্ত বাঁধন। যাহা হইক, এখন আর তোমার অধিক কথা কহিয়া কায নাই। তুমি আর একটু সবল হইলে তোমার বিপদের সকল কথা খুলিয়া বলিও,—তাহা শুনিবার জন্য আমাদের সকলেরই বড় আগ্রহ হইয়াছে। কে তোমাকে বাঁধিয়াছিল, কেন বাঁধিয়াছিল, ছোট নৌকাখানিতেই—বা কিরূপে উঠিয়াছিলে—এ সকল কথা আমরা শুনিতে চাই। অনেক-কাল জাহাজে কায করিতেছি, এরকম কাণ্ড কখনও দেখি নাই।—দেখিতেছি তুমি মুসলমান, আরর বা ঐ রকম কোন দেশের লোক, ইংরাজী বলিতে পার ত?”
এতক্ষণ পরে ডড্লের মনে পড়িল-তখনও তিনি ছদ্মবেশেই আছেন, তাঁহাকে ইংরাজ বলিয়া জাহাজের কোনও লোক চিনিতে পারে নাই।—তিনি তৎক্ষণাৎ সেই পাচকের নিকট তাঁহার প্রকৃত পরিচয় দিতে উদ্যত হইয়াছেন,—এমন সময় পাচকটা কাহাকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া সসম্ভ্রমে অভিবাদন করিল, তিনি আগন্তুকের দিকে মুখ ফিরাইয়া দারুণ বিস্ময়ে অভিভুত হইলেন। তিনি দেখিলেন, এই আগন্তুক তাঁহারই পূর্ব্ব-পরিচিত ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন, মিস্ এরস্কাইনের মাতুল।—ডাক্তার ল্যাম্পিয়নকে দেখিয়া তাঁহার মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল।
ডড লে দেখিলেন, ডাক্তার ল্যাম্পিয়নের পরিধানে শুভ্র পরিচ্ছদ, এবং তাঁহার মুখে একটা প্রকাণ্ড চুরুট ও মস্তকে একটা ছত রিওয়ালা সাদা টুপি। সে ডড লেকে দেখিয়া একমুখ ধোঁয়া ছাডিয়া পূর্ব্বোক্ত পাচককে বলিল, “বাবুর্চ্চি, আধ-মরা ‘নিগর’টা এখন কেমন আছে?”
পাচক বলিল, “অনেকটা সুস্থ হইয়াছে, এ যাত্রা বোধ হয় বাঁচিয়া গেল কিন্তু ধাক্কা সামলাইতে এখনও সময় লাগবে। আরব কি না, ভারি কাঠপ্রাণ, নতুবা রক্ষা পাইত কি না সন্দেহ।”
ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন বলিলেন, “বেটা নৌকার উপর মরিলেও কোন ক্ষতি ছিল না, উহার জন্য মিছামিছি বিস্তর হয়রাণ হওয়া গিয়াছে। উহাকে খোলা নৌকায় ভাসিতে দেখিয়া জাহাজের চৌকিদার উহার খোঁজ-খবর লওয়া আবশ্যক মনে করে নাই, কিন্তু আমার ভাগিনেয়ী কিছুতেই ছাডিল না, তাই উহাকে জাহাজে তুলিয়া আনিতে হইয়াছে।—সে-ই প্রথমে উহাকে নৌকার উপর দেখিতে পায়।
মিস্ এরস্কাইনও কি এই জাহাজে আছেন?—ডাক্তার ল্যাম্পিয়নের কথা শুনিয়া ডড্লের হৃদয় আনন্দে নৃত্য করিয়া উঠিল। কথাটা হঠাৎ তাহী বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্ত হইল না। ছদ্মবেশেও পাছে ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন তাঁহাকে চিনিতে পারে—এই আশঙ্কায় তিনি মুখ ফিরাইয়া রহিলেন। ডাক্তার লাম্পিয়ন তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া অবজ্ঞাভরে বলিল, “জানোয়ার আর কি? এই আরবগুলোর মত নিমকহারাম দুনিয়ায় নাই। উহাদের উপকার কর, সুবিধা পাইলেই তোমাকে ছোবল্ মারিবে, কৃতজ্ঞতার সহিত উহাদের পরিচয় নাই। লাঠি না খাইলে উহারা সায়েস্তা থাকে না।”
ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন আরব-বেশধারী ডড্লেকে লক্ষ্য করিয়া আরও কিঞ্চিৎ নীতিকথার প্রচার করিত, কিন্তু আর একজন ভদ্রলোক সেই দিকে অগ্রস হইয়া তাহার সহিত আলাপ আরম্ভ করিতেই তাহার উচ্ছাস বন্ধ হইল। আগন্তুক তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার রোগী কেমন, ডাক্তার? বোধ হয় বেচারা বাঁচিয়া উঠিবে?
মিঃ ডড্লে আগন্তুকের কথা শুনিয়া চম্কাইয়া উঠিলেন। এ কণ্ঠস্বর ত তাঁহার অপরিচিত নহে, কিন্তু কোথায় শুনিয়াছেন?—হঠাৎ তাহার মনে পডিল, তিনি মোজাম্বিক হইতে যাত্রা করিবার পূর্ব্বে কেপ টাউনের সমুদ্রতীরবর্তী একটি জুয়ার আড্ডায় ডাক্তার ল্যাম্পিয়নের সহিত এই লোকটিকে কথা কহিতে শুনিয়াছিলেন।—ইহারা কি উদ্দেশ্যে কোথায় যাইতেছে?
সেইদিন অপরাহ্নে ডড্লে মিস্ এরস্কাইনকে জাহাজের ডেকের উপর রেলিংএর নিকট দণ্ডায়মান দেখিলেন। মিস্ এরস্কাইনকে দেখিয়া বোধ হইল তিনি অত্যন্ত অসুস্থ, সে লাবণ্য আর নাই, শরীর যেন আধখানা হইয়া গিয়াছে, চোখের কোণে কালি পডিয়াছে, মুখখানি সাদা কাগজের মত ফ্যাকাসে।— এত অল্প দিনে তাহার এই অদ্ভুত পরিবর্তেনে ডড্লে অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন। কে জানিত এরূপ স্থানে এরূপ অবস্থায় পুনর্ব্বার তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে?—এখন যে তাঁহার আত্ম-পরিচয় দানেরও উপায় নাই।—তাহার আশঙ্কা হইল, মিস্ এরস্কাইন কোন দুর্ভেদ্য ষড়যন্ত্র-জালে বিজডিত হইয়াছেন, তাঁহার মনের সুখশান্তি নষ্ট হইয়াছে, এই জন্যই তিনি মনোকষ্টে এরূপ জীর্ণশীর্ণ হইয়াছেন। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র কি, ইহাদের সমুদ্রযাত্রার উদ্দেশ্য কি, তাহা তিনি অনুমান করিতে পারিলেন না। মিস্ এরস্কাইন কোনরূপে বিপন্ন হইয়া থাকিলে তাঁহার উদ্ধারসাধনের জন্য তিনি প্রাণপণ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন, কিন্তু নিজের শোচনীয় অবস্থার কথা স্মরণ করিয়া তাঁহার হাসি আসিল। তিনি লাম্পিয়নের গুপ্ত অভিসন্ধির সন্ধান না লইয়া ছদ্মবেশ ত্যাগ করিবেন না—স্থির করিলেন।”
মিঃ ডড্ল মনে মনে বলিলেন, “যদি আমার ধারণা সত্য হয়, তাহা হইলে ল্যাম্পিয়নের ন্যায় নরপ্রেত পৃথিবীতে দ্বিতীয় আছে কি না সন্দেহ, কিন্তু আমি হয় ত অন্যায় সন্দেহের বশবর্ত্তী হইয়া তাহার সম্বন্ধে মিথ্যা ধারণা পোষণ করিতেছি। আমার ভুল হওয়াও বিচিত্র নহে। মিস্ এরস্কাইন এই জাহাজে কি জন্য আসিয়াছেন?—তাঁহাকে এরূপ চিন্তাক্লিষ্ট ও জীর্ণ-শীর্ণ দেখিতেছি কেন?
ডড্লে বিস্তর চিন্তা করিয়াও কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারিলেন না। মানুষের মনে একবার সন্দেহের উদয় হইলে, তাহা সত্য হউক, মিথ্যা হউক, সহজে দূর হয় না। তাঁহারও সন্দেহ বিদূরিত হইল না। ‘মিস্ এরস্কাইন ডেকের উপর হইতে প্রস্থান করিলেও তাঁহার উদ্বেগ-কাতব পাণ্ডুর মুখখানি পুনঃ পুনঃ ডড্লের মনে পডিতে লাগিল, তাঁর মন অত্যন্ত অস্থির হইয়া উঠিল। তিনি মনে মনে বলিলেন, “একটা কিছু করিতেই হইবে। আমি ভিন্ন বিপদ-সমুদ্র হইতে এই যুবতীকে উদ্ধার করিবার আর কেহই নাই, কিন্তু আমি এখন করি কি? ল্যাম্পিয়নের নিকট আত্ম-পরিচয় দিয়া তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা বৃথা, তাতে বিপরীত ফল হইবে। কৌশলে উহাদিগের সঙ্কল্প বিফল করিতে হইবে, কিন্তু উহাদের মতলবটা কি তাই যে বুঝিতে পারিতেছি না।”
অর্ধঘণ্টা পরে পূর্ব্বোক্ত পাচক ডড্লের জন্য আর এক পেয়ালা সুপ্ আনিয়া তাঁহাব সম্মুখে উপস্থিত হইল। ডড্লে তাহাকে ধন্যবাদ দিয়া উঠিয়া বসিলেন, এবং সুপ্ টুকু পান করিয়া আরবী ভাষায় তাহাকে দুই-একটি কথা জিজ্ঞাসা করিলেন।
পাচক তাঁহার কথা বুঝিতে না পারিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল, “তোমার ভাষা আমি বুঝি না, ইংরাজীত তোমার মনের ভাব প্রকাশ করিতে পার না? ইংরাজী কি আদৌ জান না?—তুমি কিরূপে নৌকার উপর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পডিয়াছিলে, কে তোমায় সে-রকম দুর্দ্দশা করিয়াছিল,—তাহা জানিবার জন্য আমার বড় আগ্রহ হইয়াছে। কেবল আমি নহি, জাহাজের সকল লোকই এ সকল কথা জানিতে চাহে।”
ডড্লে কতক ইংরাজী, কতক আরবীতে যাহা বলিলেন, তাহার মর্ম্ম এই যে-জাঞ্জিবার হইতে পম্বা উপসাগরে একখানি ‘ধাও’ যাইতেছিল, তাঁহার চাচা সেই ধাওর মালিক। এই চাচাটি বড়ই লোভী ও হিংস্র প্রকৃতির, তিনি বিস্তর পৈতৃক অর্থের উত্তরাধিকারী হওয়াতে সে তাঁহার বড়ই হিংসা করিত, এবং যখন-তখন তাঁহার নিকট টাকা চাহিত। তিনি সেই ‘ধাও’য়ে তাঁহার চাচার সহিত বাণিজ্যে যাইতেছিলেন। পথিমধ্যে কথায়-কথায় চাচার সহিত বচসা হয়, ইহাতে সেই দুর্বৃত্ত ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার মস্তকে দণ্ডাঘাত করে। আঘাতে তিনি অজ্ঞান হইয়া পড়িলে চাচা তাঁহাকে হাত-পা বাঁধিয়া একথানি নৌকায় তুলিয়া সমুদ্রে ভাসাইয়া দেয়। তাঁহার সঙ্গে তাঁহার একটি বিশ্বাসী ক্রীতদাস ছিল, পাছে সে এই অত্যাচারের কথা প্রকাশ করে, এই ভয়ে চাচা তাহাকেও প্রহারে অচৈতন্য করিয়া দড়ি দিয়া হাত-পা বাঁধিয়া সেই খোল নৌকায় ফেলিয়া রাখে। নৌকাখানি তাহাদিগকে লইয়া অকুল সমুদ্রে ভাসিয়া চলে।—তাহার পর যাহা যাহা ঘটিয়াছিল তাহা বলা বাহুল্য মাত্র।
পাচক বলিল, “দুনিয়ার সকল চাচাই প্রায় ঐ রকম। আমারও এক চাচা ছিল, আমি জাহাজে চাকরী লইবার পূর্ব্বে সেই চাচা বেটার সঙ্গে একান্নে ছিলাম। সে আমার উপর বড় অত্যাচার করিত, হাতে কোন কায না থাকিলে আমাকে ধরিয়া ঠেঙ্গাইত। তাহার অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া আমি বাড়ী ছাড়িয়া পলাই, এবং জাহাজে চাকরী লই। এখন বেশ আছি, কোন চাচা-কাচার ধার ধারি না।—তুমি যদি দেশে ফিরিয়া যাও, তাহা হইলে তোমার চাচা বেটার দেখা পাইলে তাহার দাড়িতে আগুন লাগাইয়া দিও; মুখ পোড়াইয়া না দিলে সে সায়েস্তা হইবে না।—মুগুর না খাইলে কি কুকুর জব্দ হয়?
ডড্লে বলিলেন, “চাচার ভাগ্যে যাহা হয় হইবে, কিন্তু তোমাকে একটা: কথা জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিয়াছি। আমার সেই চাকরটা আমার মতই হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নৌকায় পডিয়াছিল। তোমরা আমাকে তোমাদের জাহাজে তুলিয়া আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছ, কিন্তু আমার চাকরটাকে ফেলিয়া আসিয়াছ কেন?—আহা, বেচারা আমার জন্য অনায়াসে জান্ দিতে পারিত, এ রকম প্রভুভক্ত বিশ্বাসী নফর অনেক ভাগ্যে পাওয়া যায়।”
পাচক বলিল, “সে বাঁচিয়া থাকিলে তাহাকেও জাহাজে তুলিয়া লইতাম, কিন্তু আমরা নৌকায় গিয়া দেখিলাম সে মরিয়া গিয়াছে। তোমারও বোধ হয় আর দুই-এক ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হইত। তুমি ধুকধুক করিতেছ দেখিয়া তোমাকে জাহাজে তুলিয়া লইলাম, নৌকাখানি তাহার মৃতদেহ লইয়া সমুদ্রে ভাসিয়া চলিল। নৌকার উপর হইতেই সে বোধ হয় হাঙ্গরের পেটে গিয়াছে। আমবা তোমাকে উদ্ধার না করিলে তোমারও সেই দশা ঘটিত।”