নাবিক-বধূ/সপ্তম পরিচ্ছেদ

সপ্তম পরিচ্ছেদ

ডড্‌লে অল্পক্ষণ পরে গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হইলেন। পরদিন প্রভাতে তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। এই দীর্ঘনিদ্রায় তাঁহার শরীর বেশ সুস্থ হইল। আমেদ বেন্-কাসেনের দণ্ডাঘাতে তাঁহার মস্তকে যে প্রদাহ উপস্থিত হইয়াছিল, তাহার উপশম হইল।—কিছুকাল চিন্তা করিলে বা কথা বলিলে তাঁহার মাথা ঘুরিয়া উঠিত, সে ভাবটা দূর হইল। মাথা বেশ পাতলা হইল। তখনও তাহার সর্ব্বাঙ্গে কাল বার্ণিস মাখানো ছিল, তিনি তাহা ধৌত করা অযৌক্তিক মনে করিলেন।

 নিদ্রাভঙ্গে তিনি সমুদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন, দেখিলেন, প্রভাত-রৌদ্রে সমুদ্রের নীল জল ঝক্-মক্ করিতেছে, সমুদ্র স্থির, যেন একখানি মুকুর। মৃদু মন্দ শীতল সমীরণ প্রবাহিত হইতেছিল। সেই সুশীতল প্রভাত-সমীরণে তাহার সর্ব্বাঙ্গ যেন জুড়াইয়া গেল।

 মিঃ ডড্‌লে যে জাহাজে আশ্রয়লাভ করিয়াছিলেন, তাহা তেমন বৃহৎ জাহাজ নহে, তাহাতে প্রায় তিন হাজার টন বোঝাই ধরিতে পারিত। জাহাজ খানিতে তেমন অধিক মাল-পত্র না থাকিলেও তাহা দ্রুত চলিতেছিল না। ডড্‌লে মধ্যাহ্নকালে ধীরে-ধীরে পূর্ব্বোক্ত পাচকের নিকট উপস্থিত হইয়া তাহাকে অভিবাদন করিলেন। পাচকটি হাসিয়া বলিল, “তুমি এতদূর হাঁটিয়া আসিতে পারিয়াছ? ভাল, ভাল, তোনার শরীর সবল হইয়াছে দেখিয়া বড় খুসী হইলাম। তোমার জন্য কি করিতে হইবে বল, বেশ ক্ষুধা হইয়াছে ত?”

 পাচক তাঁহার উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই তাঁহাকে কিছু খাবার, আনিয়া দিল। তিনি তাহা আহার করিয়া, জাহাজের একপাশে দাঁড়াইয়া মুক্ত সমুদ্রের পোত দেখিতেছেন, এমন সময় জাহাজের প্রধান মেট্ তাহার সহকারীর সহিত হঠাৎ সেই স্থানে উপস্থিত হইল। মিঃ ডড্‌লেকে সেখানে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া প্রধান মেট্ ক্রোধে আগুন হইয়া উঠিল, মুখ বিকৃত করিয়া বলিল, “এখানে এ কে?—ইহাকেই আমরা বোট হইতে জাহাজে তুলিয়াছিলাম না?—জোয়ান মিন সে, বসিয়া-বসিয়া খাইতে উহার লজ্জা হয় না? তিন বেলা খাইবে,অথচ কোন কার্য্য করিবে না, ইহা হইতেই পারে না। ওয়াট সন্, উহাকে রীতিমত খাটাইয়া লইবার ব্যবস্থা কর, যদি অন্য কোনও কায করিতে না পারে ত উহাকে পিতলের সাজ-সরঞ্জামগুলা পালিশ করিতে দাও। হতভাগাটা খাটিয়া খাউক। কে উহাকে বসিয়া খাইতে দিবে?”

 প্রধান মেটের সহকারী বলিল, “আমি শীঘ্রই তাহার ব্যবস্থা করিতেছি।”

 প্রধান মেটের অবজ্ঞাপূর্ণ উক্তি শুনিয়া ডড্‌লের মনে অত্যন্ত ক্রোধের সঞ্চার হইল। তাঁহার ন্যায় পদস্থ রাজকর্ম্মচারীকে একটা ইতর ওলন্দাজ এভাবে অবমানিত করিতে সাহস করিল? তাঁহাকে একটা সামান্য কুলির কাযে নিযুক্ত করিবার আদেশ দিল।—কিন্তু তাঁহার ক্রোধ স্থায়ী হইল না। তিনি ভাবিয়া দেখিলেন, ইহাতে তাঁহার সুবিধাই হইবে, তিনি অনায়াসে জাহাজের সকল স্থানে যাইতে পারিবেন, কাহাকেও কোন কৈফিয়ৎ দিতে হইবে না, এমন কি, সুযোগ পাইলে তিনি মিস্ এরস্‌কাইনের সহিত দেখা করিতে পারিবেন, হয় ত গোপনে তাঁহাকে সকল কথা বলিতেও পারিবেন।—এই সকল কথা ভাবিয়া তাঁহার মন অপেক্ষাকৃত প্রফুল্ল হইল।

 অর্দ্ধঘণ্টা পরে প্রধান মেটের সহকারী তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া গেল,এবং ডেকের উপর, কেবিনের দরজায় যে সকল পিতলের সাজ, হাতল প্রভৃতি ছিল, তাহা পরিষ্কার করিতে বলিল। তিনি এই কার্য্যে এরূপ তৎপরতা দেখাইলেন যে, জাহাজের কর্ম্মচারীরা তাহা দেখিয়া অত্যন্ত খুসী হইল, প্রথম দিনেই তিনি প্রশংসা লাভ করিলেন। ইতিমধ্যে জাহাজের কাপ্তেন সেই স্থানে উপস্থিত হইল। ডড লে তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া বুঝিতে পারিলেন—এই লোকটিরই সহিত ডাক্তার ল্যাম্পিয়নের পরামর্শ হইয়াছিল। অল্পক্ষণ পরে ল্যাম্পিয়ন একটি চুরুট টানিতে-টানিতে সেই স্থানে আসিয়া দাঁড়াইল। ডড্‌লে লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন, ডাক্তার হ্যাম্পিয়ন আজ যেন কিছু বিষণ্ন—কিছু উৎকণ্ঠিত —ল্যাম্পিয়ন তখন এতই অন্যমনস্কভাবে চলিতেছিল যে, ডড্‌লে সেখানে বসিয়া কার্য করিতেছেন—তাহা সে দেখিতে পাইল না। সে ডড্‌লের উপর হুমড়ি খাইয়া পড়িবার মত হইল, ডড্‌লেকে লক্ষ্য করিয়া সক্রোধে বলিল, “ওরে কদাকার জানোয়ার, তুই এখানে কেন? দূর হ এখান থেকে—” সঙ্গে সঙ্গে ডড্‌লের পৃষ্ঠে এক প্রচণ্ড পদাঘাত।

 ডড্‌লের ইচ্ছা হইল—তিনি তৎক্ষণাৎ তাহার মুখে এক ঘুসি মারিয়া তাহার এক-পাটি দাঁত উপড়াইয়া দেন, কিন্তু তিনি বিপুল চেষ্টায় ক্রোধ দমন করিয়া প্রকৃতিস্থ হইলেন, এবং পুনর্ব্বার কার্য্যে মনঃসংযোগ করিলেন। ল্যাম্পিয়ন সেখান হইতে সিঁড়ির নিকট গিয়া আর কাপ্তেনকে দেখিতে পাইল না, কাপ্তেন তখন স্থানান্তরে গিয়াছিল। ল্যাম্পিয়ন সিঁড়ির নিকট দাঁড়াইয়া জাহাজের মেট্ কে বলিল, “কাপ্তেন কোথায়?—তাহার সহিত দেখা করিয়া বল, আমি দুই এক মিনিটের জন্য তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাই, বিশেষ কোন কথা আছে।”

 মেট্ কাপ্তেনকে ডাকিয়া আনিলে, কাপ্তেন ডাক্তার ল্যাম্পিয়নকে বলিল, গুড মর্ণিং ডাক্তার। আজ সকালে আমি আমার কেবিনে বসিয়াই খাইয়াছিলাম, এজন্য পূর্ব্বে আপনার সহিত দেখা হয় নাই, আবার গরম হইল না কি?”

 ল্যাম্পিয়ন এ প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়া কাপ্তেনের হাত ধরিয়া তাহার কেবিনের দিকে চলিল। ডড্‌লে কাপ্তেনের কথা শুনিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি তার কথার অর্থ বুঝিতে পারিলেন না। তাঁহার কৌতূহল বর্দ্ধিত হইল। এই কাপ্তেনই ল্যাম্পিয়নের নিকট কোন কার্য্যের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকার দাবি করিয়াছিল, কাযটা কি, তাহা জানিবার জন্য তাঁহার প্রবল আগ্রহ হইলেও তিনি এই আগ্রহ পূর্ণ করিবার কোন উপায় দেখিলেন না। তিনি দেখিলেন, ল্যাম্পিয়ন কাপ্তেনকে সঙ্গে লইয়া তাহার কেবিনে প্রবেশ করিল। তাহাদের কি পরামর্শ হয়—তাহা শুনিবার জন্য তাঁহার মন অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল।

 ল্যাম্পিয়ন কাপ্তেন সহ কেবিনে প্রবেশ করিয়া ভিতর হইতে দরজা বন্ধ করিল, ডড্‌লে তখন অদূরে দাঁড়াইয়া কার্য্য করিতেছিলেন। তিনি তাহাদের গুপ্ত পরামর্শ শুনিতে পাইবেন, বা শুনিলেও তাহা বুঝিতে পারিবেন, এ সন্দেহ ল্যাম্পিয়ন বা কাপ্তেন কাহারও মনে মুহূর্ত্তের জন্য স্থান পায় নাই।—ডড্‌লে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে কেবিনের দরজার নিকট উপস্থিত হইলেন। তিনি শুনিতে পাইলেন, কাপ্তেন ল্যাম্পিয়নকে বলিতেছে, “তুমি আমাকে তাড়াতাডি ডাকিয়া পাঠাইয়াছিলে, খবর কি?”

 ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন বলিল, “সে আজ ভাল নাই।”

 কাপ্তেন বলিল, “এই সামান্য কাযে তুমি এত সময় লইতেছ কেন, তাহা আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। কেপ টাউনে যখন তোমার সহিত আমার বন্দোবস্ত হয়, তখন আমি মনে করিয়াছিলাম, খুব শীঘ্রই ঝঞ্জাটটা মিটিয়া যাইবে।

 ল্যাম্পিয়ন একটু উত্তেজিত স্বরে বলিল, “আমি তোমাকে সেই সময়েই বলিয়াছিলাম, তাড়াতাডি করিলে কোন ফল হইবে না। তুমি কি বুঝিতে পারিতেছ না অতিরিক্ত তাড়াতাডি করিলে তোমার জাহাজের কর্ম্মচারীদের, এমন কি, থালাসীগুলার পর্য্যন্ত মনে সন্দেহ হইবে? তুমি কি আমাদের সর্ব্বনাশের পথ প্রশস্ত করিতে চাও? ঠিকানায় পৌছিয়া হাতে হাতকড়ি পরাই কি তোমার ইচ্ছা?—তোমার ব্যস্ততা দেখিয়া আমার ত তাহাই মনে হয়।

 কাপ্তেন গম্ভীর স্বরে বলিল, “তুমি যে রকম ঢিমে তালে কায করিতেছ, তাহাতে মনে হয় নিজের পায়ে তুমিই কুড়ল মারিবার ব্যবস্থা করিতেছ। যদি তুমি তাড়াতাডি কায শেষ করিতে না পার, তবে আপাততঃ উহা মুলতুবি রাখিয়া দাও। তাহাতে বিপদের আশঙ্কা অল্প।”

 তাহার পর ডাক্তার নিম্নস্বরে দুই তিনটি কথা বলিল, ডড্‌লে তাহা শুনিতে পাইলেন না, কিন্তু তিনি বুঝিলেন—এ কথায় কাপ্তেনের বিলক্ষণ ক্রোধ হইয়াছে। সে উত্তেজিত স্বরে বলিল, “তোমার যা খুশী কর। তোমার ছাগল তুমি ল্যাজের দিকে কাটো, আমার তাহাতে ক্ষতিবৃদ্ধি নাই, কিন্তু যদি শেষে কোন গণ্ডগোল হয়, তাহা হইলে আমার ঘাড়ে দোষ চাপাইও না। বোঝ কর, ইহাতে আমার কোন দায়িত্ব নাই।

 এবার ল্যাম্পিয়ন একটু নরম হইয়া বলিল, “দেখ ভাই, আমাদের ঝগড়া করিয়া কোন লাভ নাই। যদি অনিষ্ট হয়, আমাদের উভয়েরই হইবে, সুতরাং আমাদের মঙ্গলের জন্য পরস্পর মিলিয়া-মিশিয়া এক পরামর্শে কায করাই সঙ্গত। এখন আর পিছাইবার উপায় নাই, যেরূপে হউক হাতের কায শেষ করিতেই হইবে।”

 কাপ্তেন বলিল, “কে তোমাকে পিছাইতে বলিতেছে? বিপদের মধ্যে লাফাইয়া পড়িতেই-বা কে তোমার মাথার দিব্য দিতেছে? আমি কোন দায়িত্ব ঘাডে লইতে রাজী নহি। তুমি মন স্থির করিতে পারিতেছ না, কায শেষ করিতে অনর্থক বিলম্ব করিতেছ,এজন্য আমি ফাঁসের দড়ি গলায় পরিব— এরূপ তুমি আশা করিতে পারি না। সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকিয়াও যদি কায শেষ করিতে না পার ত সে দোষ কি আমার?”

 ল্যাম্পিয়ন বলিল, “কি যে বল তার ঠিক নাই। আমার সঙ্কল্প স্থির আছে ইহা ত তুমি জান।”

 কাপ্তেন বলিল, “তবে আর তর্কবিতর্কে কায নাই, এখন বল কায শেষ হইতে আর কয় দিন লাগিবে?

 ল্যাম্পিয়ন বলিল, “আর তিন দিন। যদি কোনও ব্যাঘাত না ঘটে, তবে শুক্রবারই সব শেষ হইবে। কেমন, ইহাতে তোমার আপত্তি নাই ত?”

 কাপ্তেন বলিল, “বেশ কথা, আমি ইহাতেই রাজী।—আমরা বন্দরে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই গোলমাল থামিয়া যাইবে। ও কথা লইয়া আর কোন উচ্চবাচ্য হইবে না। এ সকল তুচ্ছ বিষয় লইয়া আন্দোলন-আলোচনার সুযোগ যত কম দেওয়া যায়, ততই ভাল।”

 ল্যাম্পিয়ন বলিল, “ব্যাপারটা বুঝি খুব তুচ্ছ হইল?—কি সর্ব্বনাশ। তুমি কি এ রকম কায পূর্ব্বে আরও করিয়াছ?”

 কাপ্তেন হাসিয়া বলিল, “এরকম তুচ্ছ কায পূর্ব্বেও আমার হাত দিয়া, হইয়াছে—একথা কি তোমাকে বলিয়াছি?—তুমি আগামী শুক্রবার এই শুভ কার্য্যের দিন স্থির করিয়াছ, আমার তাহাতে আপত্তি নাই, কতক গুলা বাজে কথা বলিয়া সময় নষ্ট করিবার আবশ্যক কি?”

 উভয়ের একজন চেয়ার ছাড়িয়া উঠিল—বুঝিতে পারিয়া ডড্‌লে লঘুপদবিক্ষেপে দূরে সরিয়া গিয়া একটা পিতলের হাতল পরিষ্কার করিতে লাগিলেন। মুহূর্ত্ত পরে উভয়ে কেবিন হইতে বাহিরে আসিয়া ডড লেকে দেখিতে পাইল, কাপ্তেন ডাক্তার লাম্পিয়নের মুখের দিকে চাহিয়া কুঞ্চিত করিল। ল্যাম্পিয়ন তাহার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া বলিল, “ইংরাজী জানে না।”—তাহারা উভয়ে অন্যদিকে প্রস্থান করিল।

 মিঃ ডড্‌লে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ভাবে কিয়ৎকাল সেই স্থানে বসিয়া রহিলেন, তাঁহার সন্দেহ যে অমূলক নহে, এ ধারণা তাঁহার মনে বদ্ধমূল হইল। তিনি বুঝিলেন এই দুই নরপিশাচ মিস্ এরসকাইনকে হত্যা করিবার জন্য ষড়যন্ত্র করিয়াছে। ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন কোন প্রকার মৃদু বিষ প্রয়োগে তিল তিল করিয়া তাঁহার প্রাণ নষ্ট করিবে, এবং আর তিন দিনের মধ্যেই তাহার সঙ্কল্প সিদ্ধ হইবে। তিনি ইহাও বুঝিতে পারিলেন যে, ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন নানাপ্রকার বদ খেয়ালে তাহার যথাসর্ব্বস্ব নষ্ট করিয়া তাহার মহাসমৃদ্ধ ভগিনীপতির বিপুল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারিণী মিস্ এরস ইনকে এইভাবে হত্যাপূর্ব্বক অবৈধ উপায়ে তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি আত্মসাৎ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছে, এবং জাহাজের কাপ্তেনটা এবিষয়ে তাহার সাহায্য করিতেছে। তাহাদের অর্থলালসা চরিতার্থ করিবার জন্য এই সংসারজ্ঞান-বিরহিত, আত্মরক্ষায় অসমর্থ, সরলা যুবতীকে জীবন বিসর্জ্জন করিতে হইবে।—এই নৃশংস হতাকাণ্ডের কথা লইয়া যাহাতে কোন আন্দোলন-আলোচনা না হয়, বা কেহ তাহাদিগকে সন্দেহ করিতে না পারে,—এই উদ্দেশ্যে সমুদ্রবক্ষে জাহাজের এই পৈশাচিক অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করিবার ব্যবস্থা হইয়াছে।

 মিঃ ডড্‌লে মনে মনে বলিলেন, “আমার দেহে জীবন থাকিতে আমি এই দুর্বত্তদের সঙ্কল্প সিদ্ধ হইতে দিব না! আমি উহাদের অভিসন্ধি কতক-কতক বুঝিতে পারিয়াছি, দেখি,আমি মিস্ এরস্‌কাইনকে রক্ষা করিতে পারি কি না,  মিঃ ডড্‌লে অতঃপর স্বকার্যে মনঃসংযোগ করিলেন। তিনি মিস্ এরস্‌কাইনকে ডেকের উপর দেখিবার আশায় বেলা দশটা পর্য্যন্ত সেই স্থান হইতে নড়িলেন না, অত্যন্ত অভিনিবেশসহকারে কল-কব্জাই পরিষ্কার করিতে লাগিলেন। কিন্তু সেদিন প্রভাতে মিস্ এরস কাইন ডেকের উপর আসিলেন না। ডড লের সন্দেহ হইল, মিস্ এরস্‌কাইন পূর্ব্বাপেক্ষা অধিক অসুস্থ হওয়াতেই তাঁহার কেবিন ছাডিয়া ডেকে আসিতে পারেন নাই।—ডড লে কোন কৌশলে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য অধীর হইয়া উঠিলেন।—এখন সতর্ক হইতে না পারিলে বা মিস্ এরস ইনকে সতর্ক করিতে না পারিলে তাঁহার জীবনরক্ষার কোনও আশা থাকিবে না, সুতরাং আর একমুহূর্ত্তও নষ্ট করা উচিত নহে।

 ডড্‌লে একদিকে কায শেষ করিয়া জাহাজের অন্যদিকে কলকব্জা পরিষ্কার করিতে চলিলেন।—এবার তিনি যে স্থানে বসিয়া কায করিতে লাগিলেন, সেই স্থান হইতে জাহাজের সমস্ত ভাগটা বেশ দেখিতে পাওয়া যায়। তাঁহার অজ্ঞাতসারে যে মিস্ এরস্‌কাইন ডেকের উপর যাইবেন, তাহার সম্ভাবনা হিল না। অপরাহ্নে তিনি দেখিতে পাইলেন, জাহাজের ষ্টুয়ার্ড একখানি ‘রগ্’ ও দুইটি পাতলা বালিশ লইয়া ডেকের দিকে চলিল। ইহা সে কাহার জন্য লইয়া যাইতেছে, তা তিনি তৎক্ষণাৎ বুঝিতে পারিলেন। কয়েক মিনিট পরে মিস্ এরস্‌কাইন তাঁহার মাতুলের স্কন্ধে ভর দিয়া অতি কষ্টে ডেকের দিকে চলিলেন। সেদিন তাঁহাকে অধিকতর অসুস্থ দেখাইতেছিল, তাঁহার মুখে কে যেন কালি মাড়িয়া দিয়াছে। তাঁহার জীর্ণ দেহের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া ডড্‌লের সর্বাঙ্গ ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিল, তাঁহার ক্ষোভের সীমা রহিল না অতি কষ্টে তিনি আত্মসংবরণে সমর্থ হইলেন। তিনি কায করিতে-করিতে দেখিতে পাইলেন, দুর্বত্ত ল্যাম্পিয়ন তাঁহাকে একথানি ডেক-চেয়ারে বসাইয়া, তাঁহাকে দুই একটি মৌখিক সান্ত্বনার কথা বলিয়া ধীরে ধীরে সেখান হইতে চলিয়া গেল। তাহার চক্ষুদু’টি যেন হাসিতেছিল, কার্য্যোদ্ধারের আর অধিক বিলম্ব নাই বুঝিয়া সে উৎসাহ ও প্রফুল্লতা গোপন করিতে পারিতেছিল না। বিধাতা যে তাহার অলক্ষ্যে তাহার দুষ্কর্মের প্রতিফল দানের জন্য জাল বিস্তার করিতেছেন,—তাহা তাহার অনুমান কবিবার শক্তি ছিল না।

 ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন প্রস্থান করিলে মিস্‌ এরস্‌কাইন একখানি নভেল খুলিয়া তাহাতে দৃষ্টি সংযোগ করিলেন, কিন্তু তিনি তাঁহার দুই চারিছত্রও পাঠ করিতে পারিলেন না, হঠাৎ পুস্তকখানি তাঁহার অবসন্ন হস্ত হইতে খসিয়া ডেকের উপর পতিত হইল। তিনি পুস্তকখানি তুলিয়া লইবার চেষ্টা করিয়া উদাসীনভাবে সেইদিকে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার চক্ষু হইতে এক বিন্দু অশ্রু গড়াইয়া পড়িল, বোধ হয় তিনি জীবনে হতাশ হইয়াছিলেন। এত চেষ্টাতেও তাঁহার শরীর সুস্থ হইতেছে না। মুক্ত সমুদ্রের নির্ম্মল বায়ু তাঁহার কোন উপকার করিতে পারিতেছে না।—হায়, তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নাই, ঔষধ বলিয়া তিনি যাহা প্রত্যহ যথানিয়মে সেবন করিতেছেন—তাহা ঔষধ নহে, বিষ। যাহারা তাঁহার রক্ষক, তাঁহারাই যে ভক্ষক। তাঁহার নয়নে অশ্রুবিন্দু দেখিয়া ডড লে কোনরূপে আত্মসংবরণ করিতে পারিলেন না। তিনি ভাবিলেন, এই সুযোগে মিস্ এরস্‌কাইনকে তাঁহার মনের কথা বলিতে না পারিলে এমন সুযোগ হয় ত আর আসিবে না। তিনি একবার তীক্ষ দৃষ্টিতে চতুর্দ্দিকে চাহিলেন, কিন্তু নিকটে কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। তখন তিনি ডেকের রেলিং পরিষ্কার করিবার ভান করিয়া ধীরে ধীরে মিস এরস্‌কাইনের নিকট উপস্থিত হইলেন। তিনি কি করিয়া আত্মপরিচয় জ্ঞাপন করিবেন তাহাই ভাবিতে লাগিলেন, কারণ ডড লের আশঙ্কা হইতেছিল—তাঁহার কথা শুনিয়া কিছু বুঝিবার পূর্ব্বেই যদি মিস্ এরস্‌কাইন হঠাৎ ভয় পাইয়া আর্ত্তনাদ করিয়া উঠেন, তাহা হইলেই সর্ব্বনাশ! কিন্তু অন্য উপায় ত নাই। ডড্‌লে ক্ষণকাল ইতস্ততঃ করিয়া নিম্নস্বরে বলিলেন, “মিস্ এরস কাইন, আপনি কি আমাকে চিনিতে পারিতেছেন?

 মিস্ এরস্‌কাইন তখন আত্মচিন্তায় বিভোর ছিলেন, ডড্‌লের মৃদু কণ্ঠস্বর তাঁহার কর্ণগোচর হইল না, সুতরাং ডড্‌লে পুনর্ব্বার সেই কথা বলিলেন। এবার তাঁহার কথা শুনিয়া মিস্ এরস্‌কাইন বিস্ময়াবিল নেত্রে তাঁহার মুখের দিকে চাহিলেন, কিন্তু তিনি কোন কথা বলিবার পূর্ব্বেই ডড্‌লে পূর্ব্ববৎ মৃদু স্বরে বলিলেন, “মিস্ এরস্‌কাইন, আপনি বেশী জোরে কথা বলিবেন না, শুনিতে পাইলে বিপদ ঘটিবে।—অগ্রে বলুন,আমাকে কি চিনিতে পারিয়াছেন?”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “তুমি আমার নাম জান দেখিতেছি। তুমি কে? আমার নিকট তোমার কি আবশ্যক?”

 ডড্‌লে বলিলেন, “আপনি আমাকে চিনিতে পারেন নাই, আমি লেফটেনাণ্ট ডড্‌লে। আমাকে ভাল করিয়া দেখিলে আপনি বোধ হয় আমার এই ছদ্মবেশে চিনিতে পারিবেন।

 মিস্ এরাইন বলিলেন, “ডড্‌লে আপনি?—ব্যাপার কি? আমি কি স্বপ্ন দেখিতেছি?”

 ডড্‌লে আর একবার চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, “না, মিস্। স্বপ্ন নহে, সত্য। আমি আপনার প্রাণরক্ষা করিতে আসিয়াছি। আপনার জীবন কিরূপ বিপন্ন হইয়াছে, আপনার বিকদ্ধে কিরূপ ষড়যন্ত্র হইয়াছে, তাহা আপনি জানেন না, আব সে সকল কথা আপনাকে খুলিয়া বলিবারও সময় নাই। আপনার কেবিন কোন্ দিকে দয়া করিয়া বলিবেন কি?”

 মিস এরস্‌কাইন তাঁহার কেবিনের অবস্থান নির্দ্দেশ করিয়া বলিলেন, “কিন্তু মিঃ ডড্‌লে, আমি যে——

 ডড্‌লে বাধা দিয়া বলিলেন, “আস্তে মিস্, খুব আস্তে কথা বলুন। বেশী কিছু না বলাই ভাল। আমাদের চারিদিকে শত্রু। আপনি আজ রাত্রে আপনার কেবিনের সমুদ্রের দিকের গবাক্ষ খুলিয়া রাখিবেন, আমি যেরূপে পারি আপনাকে সংবাদ দিব। আপনার মামা আপনাকে ঔষধ দিলে তাহা খাইবেন না, না খাইবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে যাহা খুসী উত্তর করিবেন; কিন্তু সাবধান, ঔষধ যেন আপনার ওষ্ঠ স্পর্শ না করে।

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “মিঃ ডড্‌লে, আপনার কথা বুঝিতে পারিলাম আপনার কথা শুনিয়া আমার মনে বড়ই আতঙ্ক হইল।—আপনি যে ভয়ানক কথা বলিতেছেন।” এখন  ডড্‌লে বলিলেন, “আপনার প্রাণরক্ষার জন্যই একথা বলিতে হইয়াছে। আজ রাত্রে জাহাজের সকল লোক নিদ্রিত হইলে আপনাকে সকল কথা খুলিয়া বলিব। তখন আপনি বুঝিবেন, আমি আপনাকে ঔষধ খাইতে বারণ করিয়া ভালই করিয়াছি। ঔষধ ত খাইবেনই না, ষ্টুয়ার্ড ভিন্ন অন্য কেহ আপনাকে কিছু খাইতে দিলে তাহাও স্পর্শ করিবেন না। আমি ছদ্মবেশী, —ইহা প্রকাশ হইলে আমরা উভয়েই মারা পড়িব। এই ছদ্মবেশের উপর আমাদের উভয়ের জীবন নির্ভর করিতেছে।”

 ডড্‌লে আর কোন কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে ডেকের অন্য অংশে চলিলেন।—তিনি মিস্ এরস্‌কাইনের নিকটে আর দুই-এক মিনিট থাকিলেই মহা বিপদে পডিতেন, হয় ত তাঁহার সকল সঙ্কল্প ব্যর্থ হইত। কারণ তিনি স্থানান্তরে যাইবার অব্যবহিত পরেই ডাক্তার ল্যাম্পিয়ন ও কাপ্তেন্ মিস্ এরস কাইনের নিকট উপস্থিত হইল। মিস্ এরস্‌কাইনের সহিত তাহাদের কি কথা হইল অদূরে দাড়াইয়া কার্য্য করিতে করিতে ডড্‌লে তাহা শুনিতে পাইলেন।

 কাপেন টুপি খুলিয়া মিস্ এরস্‌কাইনকে অভিবাদন করিয়া বলিল, “আশা করি আপনি এখন অনেকটা ভালই আছেন। এত চেষ্টাতেও আপনার শরীর সুস্থ হইতেছে না, ইহা আমাদের বড়ই দুর্ভাগ্যের কথা। যাহা হউক, দুই চারি দিনের মধ্যে আপনি নিশ্চয়ই নীরোগ হইবেন।

 ল্যাম্পিয়ন বলিল, “আমি বড় গলা করিয়া বলিতেছি, এক সপ্তাহ মধ্যে মা আমার একদম্ সুস্থ হইয়া উঠিবে।—আহা, বইখানা যে ফেলিয়া দিয়াছ মা। কুড়াইয়া দিই।”

 কি স্নেহার্দ্র কণ্ঠস্বর।—ল্যাম্পিয়ান তৎক্ষণাৎ কেতাবখানি ডেকের উপর হইতে তুলিয়া মিস, এরস কাইনের জানুর উপর রাখিয়া দিল, তারপর কোমলস্বরে বলিল, “আজ সকালে তোমার ঔষধটা বদলাইয়া দিয়াছি, এবার ভাল ভাল ঔষধ, দিয়াছি, খাইয়াছ ত?

 মিস্ এরস্‌কাইন মৃদুস্বরে বলিলেন, “হ্যাঁ।

 ল্যাম্পিয়ন সোৎসাহে বলিল, “বেশ বেশ। ঐ ঔষধেই তোমার রোগ সারিয়া যাইবে। ঔষধটা ফুরাইলে আর একশিশি ঔষধ প্রস্তুত করিয়া দিব।—সেই শিশি খাইবার পর আর তোমাকে ঔষধ খাইতে হইবে না।”

 কথাটা সত্য। কথাটা শুনিয়া ডড্‌লে মনে মনে হাসিয়া বলিলেন, “আর তোমার চালাকী খাটিবে না, বেটা ভণ্ড।”

 কথা শেষ করিয়া ল্যাম্পিয়ন কাপ্তেনের সঙ্গে অন্যদিকে প্রস্থান করিল। ডড্‌লেও কায শেষ করিয়া সে-স্থান ত্যাগ করিলেন। সমুদ্রের দিকে যে গবাক্ষ ছিল—তাহা দিয়া মিস্ এরস্‌কাইনের সহিত সাক্ষাৎ করা কিরূপ কঠিন, তাহা বুঝিয়া ডড লে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইলেন, কিন্তু মিস্ এরস্‌কাইনের সহিত সাক্ষাৎ করিবার অন্য উপায় ছিল না। দ্বারের দিক দিয়া যাইলে হঠাৎ ধরা পড়িবার আশঙ্কা ছিল। কেহ তাঁহাকে সন্দেহ না করিতে পারে—তাহাই তাহার প্রথম কর্ত্তব্য, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না।

 ডড্‌লে বুঝিয়াছিলেন, জাহাজ না থামিলে তিনি সেই গবাক্ষর দিকে যাইবার চেষ্টা করিতে পারিবেন না, চলন্ত জাহাজে সেরূপ চেষ্টা করিলে তাঁহার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। রাত্রি আটটার পর জাহাজের গতি মন্দীভূত হইলে মিঃ ডড লে অন্যের অলক্ষ্যে প্রধান ইঞ্জিনিয়ারের কেবিন অতিক্রম করিয়া প্রধান ডেক পার হইলেন, এবং সিঁড়ি দিয়া নামিয়া জাহাজের কিনারায় গিয়া একগাছি রজ্জু বাহির করিলেন, তাহা রেলিংএর সঙ্গে বাঁধিয়া, সেই রজ্জু অবলম্বন পূর্ব্বক ঝুলিয়া পড়িলেন।—আর দুই গাছি দড়ি দুই হাতে ধরিয়া ভারকেন্দ্র স্থির রাখিলেন। সেই অবস্থায় মিস্ এরস্‌কাইনের গবাক্ষ প্রান্তে মুখ রাখিয়া তিনি অতি মৃদুস্বরে মিস্ এরস্‌কাইনকে ডাকিলেন। মিস্ এরস্‌কাইন তাঁহার প্রতীক্ষায় জাগিয়াছিলেন। তিনি ডড লের কণ্ঠস্বর শুনিয়া গবাক্ষ-সন্নিকটে উপস্থিত হইলেন, মৃদুস্বরে বলিলেন, “মিঃ ডড্‌লে। আপনি কি সত্যই ডড্‌লে?”

 ডড্‌লে বলিলেন, “এ বিষয়ে আপনি সন্দেহ করিবেন না। আমি সত্যই ফিলিপ্ ডড্‌লে। আস্তে কথা বলিবেন। আমাদের কোন কথা কাহারও কর্ণগোচর হইলে আর আমাদের রক্ষা নাই। আপনাকে আমার অনেক কথা বলিবাৱ আছে।”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “আপনি ছদ্মবেশে কেন? কিরূপেই বা এ জাহাজে আসিলেন? আপনি কেপ্ টাউনে আমাকে বলিয়াছিলেন, কোন জরুরী কার্য্যে শীঘ্রই আপনাকে দেশান্তরে যাইতে হইবে।”

 মিঃ ডড্‌লে তাঁহার লোমহর্ষণ অভিযান সম্বন্ধে সকল কথাই সংক্ষেপে মিস এরস কাইনের গোচর করিলেন, তাঁহারই করুণায় তিনি মৃত্যুকবল হইতে রক্ষা পাইয়া এই জাহাজে আশ্রয়লাভ করিয়াছেন, তাহা জানাইলেন। শেষে বলিলেন, “এ সকল কথা পরে হইবে, আগে ত আপনার প্রাণরক্ষা হউক, আপনার অনুগ্রহে আমার প্রাণরক্ষা হইয়াছে, আমিও প্রাণপণে আপনার প্রাণরক্ষা করিব। আপনি আর ঔষধ খান নাই ত?”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “না, খাই নাই, কিন্তু আপনার কথা শুনিয়া পর্য্যন্ত আমার যে কি দুশ্চিন্তা ও ভয় হইয়াছে তাহা বুঝাইতে পারিব না। আপনি সে সকল কথা বলিয়াছিলেন কেন? আমার বিরুদ্ধে কে কি যড়যন্ত্র করিবে? আমি ত কাহারও অনিষ্ট করি নাই।”

 মিঃ ডড্‌লে বলিলেন,“সে কথা পরে শুনিবেন, কিন্তু আপনি মহা ধনবান কন্যা একথা ত ভুলিলে চলিবে না। আপনার আমার চরিত্র কিরূপ, আপনি বোধ হয় তাহা জানেন না, আপনি কি যথার্থই তাহাকে ভালবাসেন?”

 মিস, এরস্‌কাইন বলিলেন, “মামাকে আমি ভালবাসি কি না? আপনি একথা কেন জিজ্ঞাসা করিতেছেন বলুন।”

 মিঃ ডড্‌লে বলিলেন, “আপনার মামা অত্যন্ত অর্থপিশাচ। তাহার নিজের যাহা কিছু ছিল, সব ফুরাইয়াছে, এখন তাহার বহুৎ টাকার দরকার, অথচ তাহা পাইবার উপায় নাই। আমি কেপ্ টাউন ত্যাগ করিবার পূর্ব্বে হঠাৎ একটা জুয়ার আড্ডায় গিয়া পড়িয়াছিলাম, সেখানে আপনার মামার সহিত এই কাপ্তেনটার গুপ্ত পরামর্শ শুনিতে পাইয়াছিলাম। ডাক্তার ল্যাম্পিয়নের অনুকূলে উইলখানি হইলে তাহার অর্থকষ্ট দূর হইবে—ইহাও জানিতে পারিয়াছিলাম। ঈশ্বর না করুন, আপনার যদি মৃত্যু হয়—তা হইলে আপনার সম্পত্তি কে পাইবে?”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “কাহারও কাহারও বৃত্তির ব্যবস্থা আছে।

তদ্ভিন্ন সমস্ত সম্পত্তি মামাই পাইবে। এই সম্পত্তির লোভে মামা আমাকে বিষ খাওয়াইয়া মারিবার ষড়যন্ত্র করিয়াছে? আপনি বলেন কি। না, না, মামা এতদূর পিশাচ নহে। আপনি অতি ভয়ানক কথা বলিয়াছেন।”

 মিস্ এরস্‌কাইন আর আত্মসংবরণ করিতে পারিলেন না, তাঁহার একমাত্র অভিভাবক, তাঁহার জীবন ও সম্পত্তির রক্ষাকর্ত্তা মাতুলের এই ব্যবহার?— তিনি অশ্রুরোধ করিতে পারিলেন না, ফোঁপাইয়া-ফোঁপাইয়া কঁদিতে লাগিলেন।—তাহার ক্রন্দন-শব্দে ডড্‌লে অত্যন্ত ভীত হইলেন, ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “মিস্, আপনি চুপ করুন, যদি কেহ আমাদের পরামর্শ শুনিতে পায়, তাহা হইলেই সর্ব্বনাশ। আমরা উভয়েই মারা পড়িব। আমাদের অবস্থা অতি শঙ্কটজনক, সামান্য ত্রুটিতেই সব নষ্ট হইবে, আপনার প্রাণরক্ষার কোনও উপায় হইবে না। আপনার মামা মনুষ্যমূর্ত্তিতে শয়তান, তাহার অসাধ্য কর্ম্ম কিছুই নাই, আর এই জাহাজের কাপ্তেনটি আপনার মামার মতই ভয়ানক প্রকৃতির লোক, শয়তানীতে কেহ কাহারও অপেক্ষা থাটো নহে। ইহার অনুগ্রহে আমি যখন এখানে আসিয়া পড়িয়াছি, তখন আপনার প্রাণরক্ষার উপায় হইবেই। আমি আপনার প্রাণরক্ষার জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিতেও বুণ্ঠিত হইব না। কি উপায়ে আপনার প্রাণরক্ষা হইতে পারে-তৎসম্বন্ধে আলোচনা করা আবশ্যক। আমি এখানে আর অধিক সময় থাকিতে পারিব না, আমি সমুদ্রের উপর শূন্যে ঝুলিতেছি, ধরা পডিবারও আশঙ্কা আছে। আমার প্রস্তাব মন দিয়া শুনুন।—প্রথমত, আপনি আর এক বিন্দু ঔষধ ও গলাধঃকরণ করিবেন না। আপনি ঔষধ খাইতে অসম্মত হইলে এই দুর্বত্তদের মনে সন্দেহ হইতে পারে। পাপীর মন সর্ব্বদাই সন্দেহাকুল।—যাহাতে তাহার মনে কোন সন্দেহ না হয়, তাহার ব্যবস্থা করা আবশ্যক।—আপনাকে যে ঔষধ দিয়াছে তাহার বর্ণ কিরূপ?”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “ঠিক জলের মত।”

 ডড্‌লে বরিলেন,“উত্তম,আপনি ঔষটা জানালা দিয়া ঢালিয়া ফেলিয়া শিশিতে জল পূরিয়া রাখুন। আপনার মামা তার সাক্ষাতে আপনাকে ঔষধ খাইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিলে আপনি সেই জল পান করিবেন, একবারে এক দাগের বেশী খাইবেন না। দ্বিতীয় কথা, আপনি কোথায় বসিয়া আহার করেন?”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “আজ কাল আমার কেবিনেই খাবার দিয়া যায়।—ভোজনাগারে যাইবার ত শক্তি নাই।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “খুব ভাল কথা। আপনি সেই খাবারের কিয়দংশ জানালা দিয়া সমুদ্রে ফেলিয়া দিবেন, কিন্তু কিছুই খাইবেন না, আপনার মামা যেন বুঝিতে পারে ক্ষুধার অভাবে আপনি যৎকিঞ্চিৎ-মাত্র আহার করিয়াছেন। কয়েক দিন বিস্কুট খাইয়াই কাটাইবেন, অন্য উপায় নাই।”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “বিস্কুট আমার নিজের কাছেও আছে, তাই খাইব।—কিন্তু তাহাতে মামার মনে সন্দেহ হইবে না ত?”

 ডড্‌লে বলিলেন, “ইহাও চিন্তার কথা বটে, যাহা হউক, আপনি যে অপেক্ষাকৃত সুস্থ হইয়াছেন, এ ভাব প্রকাশ করিবেন না। তাহাদিগকে বুঝিতে দিবেন যেন আপনার রোগ ক্রমেই কঠিন হইতেছে, তাহা হইলে তাহাদের সন্দেহের কারণ থাকিবে না।”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “কিন্তু এভাবে কতদিন তাহাদের ভুলইয়া রাখিব?—আমি যে বড়ই সঙ্কটে পডিলাম।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “আমার উপর নির্ভর করিয়া থাকুন, একটা উপায় হইবেই। বলিয়াছি ত আপনার জীবনরক্ষার জন্য আমি প্রাণবিসর্জ্জনেও কুষ্ঠিত হইব না। আমি একটা মতলব করিয়াছি, তাহা কার্য্যে পরিণত করিতে পারিনে আপনার জীবনরক্ষায় সমর্থ হইব। আপনি হতাশ হইবেন না। ভগবান আপনাকে রক্ষা করিবেন। আর কোন কথা নাই, এখন আমি বিদায় গ্রহণ করিলাম।”

 মিস্ এরস্‌কাইন বলিলেন, “পরমেশ্বর আপনার মঙ্গল করুন, আমার রক্ষার ভার আপনার উপর।”—অনন্তর মিঃ ডড্‌লে মিস্‌ এরস্‌কাইনের প্রসারিত হস্ত চুম্বন করিয়া স্পন্দিত বক্ষে নিঃশব্দে জাহাজের উপর উঠিলেন।