নীতিকণা/ক্ষুদ্র তরঙ্গিণী

ক্ষুদ্র তরঙ্গিণী

অয়ি ক্ষুদ্র তরঙ্গিণি! তোমার সহিত,
বাল্যকালে খেলিতাম হ’য়ে আনন্দিত।
এই কুঞ্জবন-স্থিত ঝরণা হইতে,
কল কল শব্দে তুমি সতত বহিতে।
এই কুঞ্জে পাখিগণ করিত যে গান,
তাহাতে মোহিত হ’ত বালকের প্রাণ।
তাই আমি ঘন ঘন হেথা আসিতাম,
হরিত নিকুঞ্জ-বন সুখে হেরিতাম।
দক্ষিণ হইতে মন্দ মন্দ সমীরণ,
কুসুম-সৌরভ সদা করিত বহন।
কৃষকের বসন্তের গীত শুনিতাম,
নানাবিধ বরণের ফুল তুলিতাম।
নাচিতাম গাইতাম তোমারি মতন,
অতুল আনন্দ-রসে গ’লে যে’ত মন।
ক্রমে ক্রমে দিন গেলে বয়স বাড়িলে,
সুখ্যাতি-লাভের তরে বাসনা হইলে,
প্রতিদিন তব তীরে আসি বসিতাম,
ছোট ছোট নানাবিধ পদ্য লিখিতাম।

সে সময় সংসারের পদার্থ নিকর,
দেখা’ত আমার নেত্রে কতই সুন্দর!
কত আশা মনো-মধ্যে হইত উদয়,
সে সব বলিতে এবে জনমে বিস্ময়।
কাল-পরিবর্ত্তে তব পরিবর্ত্ত নাই,
তীরস্থিত বটগাছ রহিয়াছে তাই।
বাল্যকালে ভয়ে ভয়ে এসেছি যখন,
পার্শ্বস্থিত বনস্থল করে’ছি ভ্রমণ।
উল্লাসে নাচিয়া তুমি বহিতে যেমন,
তার কিছু পরিবর্ত্ত না হেরি এখন।
এখনো নাচা’য়ে শুভ্র তরঙ্গ নিকর,
বালুকা রাশির সনে খেলিছ সুন্দর।
তখন যে ধ্বনি শুনি জুড়া’ত শ্রবণ,
অবিকল শুনিতেছি তাহাই এখন।
এখনো তেমনি তব সলিল নির্ম্মল,
তপন-কিরণ-যোগে করে ঝল মল।
তেমনি তোমার তীরে ঘন তরু-রাজি,
অবিকৃত রহিয়াছে দেখিতেছি আজি।
বনকুসুমের গন্ধে হইয়া আকুল,
উড়িতেছে মধুলোভে মধুকর-কুল।

এখনো পূর্ব্বের মত বিহঙ্গমগণ,
সুস্বরে করিয়া গান মুগ্ধ করে মন।
কালবশে পরিবর্ত্ত নাহিক তোমার,
কিন্তু কত পরিবর্ত্ত হ’য়েছে আমার।
এবে হৃষ্ট-চিত নই পূর্ব্বের মতন,
অপূর্ব্ব গম্ভীর ভাব করে’ছি ধারণ।
বাল্যকালে এ সংসার ছিল দীপ্তিময়,
হইয়াছে অন্ধকারপূর্ণ এ সময়।
কেবল দেখিতে পাই প্রকৃতির শোভা,
সর্ব্ব স্থানে সর্ব্ব কালে অতি মনোলোভা।
কালের গতিতে তা’র পরিবর্ত্ত নাই,
পূর্ব্ব কালে যাহা ছিল, রহিয়াছে তাই।
বিগত হইলে পর আরো কিছুদিন,
শরীর মলিন মম হ’বে শক্তিহীন।
বাঁচি যদি পুনর্ব্বার এখানে আসিব,
মনোহর শোভা পুনঃ নয়নে হেরিব।
অবশেষে কাটাইয়া ভব-মায়া-জাল,
হয় ত তোমার তীরে র’ব চিরকাল।
কত মাস কত দিন, কতই বৎসর,
কতই শতাব্দ ক্রমে যাইবে সত্বর।

আমার মতন আরো কত শত জন,
আসিয়া তোমার শোভা করিবে দর্শন।
কালবশে তাহারাও ধূলিসাত হবে,
তুমি কিন্তু এইরূপ অবিকৃত র’বে।
এমনি উল্লাসে তুমি চিরকাল র’বে,
উপহাস করি সদা নশ্বর মানবে।