নীল-দর্পণ নাটক/প্রথম অঙ্ক
নীল দর্পণ
নাটক।
প্রথম অঙ্ক।
প্রথম গর্ভাঙ্ক।
স্বরপুর গোলোকচন্দ্র বসুর গোলাঘরের রোয়াক।
(গোলোকচন্দ্র বসু এবং সাধুচরণ আসীন।)
সাধু। আমি তখনি বলেছিলাম, কর্ত্তা মহাশয়, আর এদেশে থাকা নয়, তা আপনি শুনিলেন না। কাঙ্গালের কথা বাসি হলে খাটে।
গোলোক। বাপু, দেশছেড়ে যাওয়া কি মুখের কথা? আমার এখানে সাত পুরুষ বাস। স্বর্গীয় কর্ত্তারা যে জমাজমি করে গিয়েছেন, তাতে কখন পরের চাকরী স্বীকার কত্তে হয়নি। যে ধান জন্মায় তাতে সম্বৎসরের খোরাক হয়, অতিথি সেবা চলে, আর পূজার খরচ কুলায়; যে শরিষা পাই, তাহাতে তেলের সংস্থান হইয়া ৬০।৭০ টাকার বিক্রী হয়। বল কি বাপু, আমার সোনার স্বরপূর, কিছুরি ক্লেশ নাই। ক্ষেতের চাল, ক্ষেতের ডাল, ক্ষেতের তেল, ক্ষেতের গুড়, বাগানের তরকারি, পুকুরের মাচ। এমন সুখের বাস ছাড়্তে, কার হৃদয় না বিদীর্ণ হয়? আর কেই বা সহজে পারে।
সাধু। এখন তাে আর সুখের বাস নাই। আপনার বাগান গিয়াছে, গাঁতিও যায় যায় হয়েছে। আহা! তিন বৎসর হয়নি সাহেব পত্তনি নিয়েছে, এর মধ্যে গাঁখান ছারক্ষার করে তুলেছে। দক্ষিণ পাড়ার মােড়লদের বাড়ীর দিকে চাওয়া যায় না, আহা! কি ছিল কি হয়েছে। তিন বৎসর আগে দুবেলায় ৬০ খান পাত পড়্তাে, ১০ খান লাঙ্গল ছিল, দাম্ড়াও ৪০।৫০টা হবে। কি উঠানই ছিল, যেন ঘােড় দৌডের মাঠ, আহা! যখন আসধানের পালা সাজাতাে বোধ হতাে যেন চন্দন বিলে পদ্ম ফুল ফুটে রয়েছে। গােয়াল খান ছিল যেন একটা পাহাড়। গেল সন্, গোয়াল সারিতে না পারায় উঠানে হুম্ড়ি খেয়ে পড়ে রয়েছে। ধানের ভূঁয়ে নীল করেনি বলে মেজো সেজো দুই ভাইকে ধরে সাহেব বেটা আর বৎসর কি মারটিই মেরেছিল; উহাদের খালাশ করে আন্তে কত কষ্ট, হাল গােরু বিক্রী হয়ে যায়। ঐ চোটেই দুই মােড়ল গাঁ ছাড়া হয়।
গােলোক। বড় মােড়ল না তার ভাইদের আন্তে গিয়াছিল?
সাধু। তারা বলেছে, ঝুলি নিয়ে ভিক্ষে করে খাব, তবু ওগাঁয় আর বাস কর্বো না! মােড়ল এখন একা পড়েছে। দুইখান লাঙ্গল রেখেছে, তা নীলের জমিতেই যােড়া থাকে। এও পালাবার যােগাড়ে আছে। কর্ত্তা মহাশয়, আপনিও দেশের মায়া ত্যাগ করুণ। গতবারে আপনার ধান গিয়াছে, এইবারে যান যাবে।
গোলােক। যান যাওয়ার আর বাকি কি? পুষ্করিণীটির চার্ পাড়ে চাস দিয়াছে, তাহাতে এবার নীল কর্বে, তা হলেই মেয়েদের পুকুরে যাওয়া বন্ধ হলাে! আর সাহেব বেটা বলেছে, যদি পুর্ব্ব মাঠের ধানি জমি কয় খানায় নীল না বুনি, তবে নবীন মাধবকে সাত কুটির জল খাওয়াইবে।
সাধু। বড়বাবু না কুটি গিয়াছেন?
গােলােক। সাধে গিয়াছেন, প্যায়দায় লয়ে গিয়াছে।
সাধু। বড়বাবুর কিন্তু ভ্যালা সাহস। সেদিনে সাহেব বলে “যদি তুমি আমিন্ খালাসিরকথা না শােনাে, আর চিহ্ণিত জমিতে নীল না কর, তবে তােমার বাড়ি উঠাইয়ে বেত্রাবতীর জলে ফেলাইয়া দিব, এবং তােমারে কুটির গুদামে ধান খাওয়াইব” তাহাতে বড়বাবু কহিলেন “আমার গতসনের ৫০ বিঘা নীলের দাম চুকায়ে না দিলে এবৎসর এক বিঘাও নীল করিব না, এতে প্রাণ পর্য্যন্ত পণ, বাড়ি কি ছার!”
গোলােক। তা না বলেই বা করে কি! দেখ দেখি, পঞ্চাশ বিঘা ধান হইলে আমার সংসারের কিছু কি ভাবনা থাকতো! তাই যদি নীলের দাম্ গুণো চুক্য়ে দেয়, তবু অনেক কষ্ট নিবারণ হয়।
(নবীন মাধবের প্রবেশ।)
কি বাবা, কি করে এলে?
নবীন। আজ্ঞে, জননীর পরিতাপ বিবেচনা করে কি কালসর্প ক্রোড়স্থ শিশুকে দংশন করিতে সঙ্কুচিত হয়? আমি অনেক স্তুতিবাদ করিলাম, তা তিনি কিছুই বুঝিলেন না। সাহেবের সেই কথা, তিনি বলেন ৫০ টাকা লইয়া ৬০ বিঘা নীলের লেখাপড়া করিয়া দাও, পরে একেবারে দুইসনের হিসাব চুকাইয়া দেওয়া যাবে।
গোলােক। ৬০ বিঘা নীল কত্তে হলে অন্য ফসলে হাত দিতে হবে না। অন্ন বিনাই মারা যেতে হলাে।
নবীন। আমি বলিলাম, সাহেব, আমাদিগের লােকজন লাঙ্গল গােরু সকলি আপনি নীলের জমিতে নিযুক্ত করে রাখুন, কেবল আমাদিগের সম্বৎসরের আহার দিবেন; আমরা বেতন প্রার্থনা করি না। তাহাতে উপহাস করিয়া কহিলেন, “তোমরাতো যবনের ভাত খাওনা।”
সাধু। যারা পেট ভাতায় চাক্রি করে, তারাও আমাদিগের অপেক্ষা সুখী।
গােলোক। লাঙ্গল প্রায় ছেড়ে দিয়াছি, তবুতাে নীল করা ঘােচে না। নাছোড়্ হইলে হাত কি? সাহেবের সঙ্গে বিবাদতো সম্ভবেনা, বেঁধে মারে সয় ভাল, কাযে কযেই গত্তে হবে।
নবীন। আপনি যেমন অনুমতি করিবেন, আমি সেইরূপ করিব। কিন্তু আমার মানস একবার মোকদ্দমা করা।
(আদুরীর প্রবেশ।)
আদুরী। মাঠাকুরুণ যে বক্তি লেগেচে, কত বেলা হলো, আপনারা নাবা খাবা কর্বেন্ না? ভাত শুক্য়ে যে চাল হয়ে গেল।
সাধু। (দাঁড়ায়ে) কর্ত্তা মহাশয়, এর একটা বিলি ব্যবস্থা করুণ, নতুবা আমি মারা যাই। দেড়খানা লাঙ্গলে নয় বিঘা নীল দিতে হলে, হাঁড়ি সিকেয় উঠ বে। আমি আসি, কর্ত্তা মহাশয় অবধান, বড়বাবু নমস্কার করি গো।
গোলোক। পরমেশ্বর এভিটায় স্নান আহার কত্তে দেন, এমত বোধ হয় না, যাও বাবা, স্নান করগে!
প্রথম অঙ্ক।
দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক।
সাধুচরণের বাড়ী।
(লাঙ্গল লইয়া রাইচরণের প্রবেশ)
রাই। (লাঙ্গল রাখিয়া) আমীন সুমুন্দি য্যান বাগ্, যে রোক্ করে মোর দিকি আস্চিলো বাবারে! মুই বলি মোরে বুঝি খালে। সাঁপোল তলার ৫ কুড়ো ভূঁই যদি নীলি গ্যাল, তবে মাগ্ ছেলেরে খাওয়াব কি। কাঁদাকাটি করে দ্যাক্বো, যদি না ছাড়ে তবে মোরা কাযেই দ্যাশ ছাড়ে যাব।
(ক্ষেত্রমণির প্রবেশ)
দাদা বাড়ি এয়েছে?
ক্ষেত্র। বাবা বাবুদের বাড়ি গিয়েছে, আলেন, আর দেরি নেই। কাকিমারে ডাক্তি যাবা না? তুমি বক্চো কি?
রাই। বক্চি মোর মাতা। একটু জল আন দিনি খাই, তেষ্টায় যে ছাতি ফেটে গ্যাল। সুমুন্দিরি—অ্যাত করি বল্লাম, তা কিছুতি শোন্লে না।
(সাধুচরণের প্রবেশ এবং ক্ষেত্রমণির প্রস্থান)
সাধু। রাইচরণ, তুই এত সকালে যে বাড়ি এলি?
রাই। দাদা, আমীন শালা সাঁপোল তলার জমিতি দাগ্ মেরেচে। খাব কি, বচ্ছোর যাবে কেমন করে। আহা জমিতো না, য্যান সোণার চাঁপা। এক কোন্ কেটে মহাজন কাৎকত্তাম। খাবকি, ছেলে পিলে খাবে কি, এতডা পরিবার না খাতি পেয়ে মারা যাবে, ও মা! রাত পোয়ালি যে দুকাটা চালির খরচ, না খাতি পেয়ে মর্বো, আরে পোড়া কপাল, আরে পোড়াকপাল; গোড্ডার নীলি কল্লে কি? অ্যাঁ! অ্যাঁ।
সাধু। ঐ ক বিঘা জমির ভরসাতেই থাকা, তাই যদি গ্যালো তবে আর এখানে থেকে কর্বো কি। আর যে দুই এক বিঘা নােনা ফেলা আছে, তাতেতো ফলন নাই, আর নীলের জমিতে লাঙ্গল থাক্বে, তা কারকিৎই বা কখন কর্বো। তুই কাঁদিস্নে, কাল হাল্ গোরু বেচে গাঁর মুখে ঝাঁটা মেরে বসন্ত বাবুর জমিদারিতে পাল্য়ে যাব।
(ক্ষেত্রমণি ও রেবতীর জল লইয়া প্রবেশ)
জল খা, জল খা, ভয় কি, “জীব দিয়েচে যে, আহার দেবে সে!” তা তুই আমিনকে কি বলে এলি।
রাই। মুই বলবো কি, জমিতি দাগ মার্তি নাগ্লাে, মোর বুকি য্যান বিদে কাটি পুড়্য়ে দিতি নাগ্লো। মুই পায় ধল্লাম, ট্যাকা দিতে চালাম; তা কিছুই শােন্লে না। বলে, “যা তাের বড় বাবুর কাছে যা, তাের বাবার কাছে যা,” মুই ফোজদুরি কর্বো বলে সেঁস্য়ে এইচি। (আমিনকে দূরে দেখিয়া।) ঐ দ্যাখ্ শালা আস্চে, প্যায়দা সঙ্গে করে এনেচে, কুটি ধরে নিয়ে যাবে।
(আমিন এবং দুইজন পেয়দার প্রবেশ)
আমিন। বাঁদ্, রেয়ে শালাকে বাঁদ্।
(পেয়দাদ্বয় দ্বারা রাইচরণের্ বন্ধন)
রেবতী। ওমা, ইকি, হ্যাঁগা বাঁদো ক্যান। কি সর্ব্বনাশ, কি সর্ব্বনাশ। (সাধুর প্রতি) তুমি দেঁড়্য়ে দ্যাক্চো কি, বাবুদের বাড়ি যাও, বড় বাবুকে ডেকে আনো।
আমিন। (সাধুর প্রতি) তুই যাবি কোথা, তোরও যেতে হবে। দাদন লওয়া রেয়ের কর্ম্ম নয়। ঢ্যারা সইতে অনেক সইতে হয়। তুই লেখা পড়া জানিস তােকে খাতায় দস্তখৎ করে দিয়ে আস্তে হবে।
সাধু। আমিন মহাশয়! একেকি নীলের দাদন বলাে, নীলের গাদন বল্যে ভাল হয় না? হা পােড়া অদৃষ্ট, তুমি আমার সঙ্গে আছ, যার ভয়ে পাল্য়ে এলাম, সেই ঘায় আবার পড়্লাম। পত্তনির আগে এ তাে রামরাজ্য ছিল, তা “হাবাতেও ফকির হলো দেশেও মন্বন্তর হলাে।”
আমিন। (ক্ষেত্রমণির প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া স্বগত) এ ছুঁড়িতো মন্দ নয়। ছােট সাহেব এমন মাল পেলেতাে লুপে নেবে— আপনার বুন দিয়ে বড় পেস্কারি পেলাম, মালটা ভাল— —দেখা যাক।
রেবতী। ক্ষেত্র, মা তুই ঘরের মধ্যে যা।
আমিন। চল্ সাধু, এই বেলা মানে মানে কুটি চল্।
রেবতী। ও যে এট্টু জল খাতি চেয়েলাে, ও আমিন মশাই, তােকার কি মাগ্ ছেলে, নেই, কেবল লাঙ্গল রেখেছে আর এই মারপিট্! ওমা ও যে ডব্কা ছেলে, ওযে এতক্ষণ দুবার খায়, না খেয়ে সাহেবের কুটি যাবে কেমন করে, সে অনেক দূর। দোহাই সাহেবের। ওরে চাড্ডি খেইয়ে নিয়ে যাও—আহা, আহা, মাগ ছেলের জন্যেই কাতর, এখনাে চকি জল পড়্চে, মুখ শুইকে গেছে—কি কর্বো; কি পােড়া দেশে এলাম ধনে প্রাণে গ্যালাম, হায়, হায়, হায়, ধনে প্রাণে গ্যালাম (ক্রন্দন)
আমিন। আরে মাগি, তাের নাকিসুর এখন রাখ্, জল দিতে হয়তো দে, নয় ওমনি নিয়ে যাই।
(রাই চরণের জলপান এবং সকলের প্রস্থান।)
প্রথম অঙ্ক।
তৃতীয় গর্ভাঙ্ক।
বেগুণ বেড়ের কুটি, বড় বাঙ্গালার বারেন্দা।
(আই, আই, উড সাহেব এবং গোপীনাথ দাস
দেওয়ানের প্রবেশ।)
গােপী। হুজুর, আমি কি কসুর করিতেছি; আপনি স্বচক্ষেইতাে দেখিতেছেন। অতি প্রত্যুষে ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিয়া তিন প্রহরের সময় বাসায় প্রত্যাগমন করি, এবং আহারের পরেই আবার দাদনের কাগচ পত্র লইয়া বসি, তাহাতে কোন দিন রাত্র দুইপ্রহরও হয়, কোন দিন বা একটাও বাজে।
উড। তুমি শালা বড় না লায়েক আছে। স্বরপুর, শাম নগর, শান্তিঘাটা এ তিন গাঁয় কিছু দাদন হলাে না। শ্যামচাঁদ বেগোর তোম্ দোরস্ত হােগা নেই।
গোপী। ধর্ম্মাবতার, অধীন হুজুরের চাকর, আপনিই অনুগ্রহ করিয়া পেস্কারি হইতে দেওয়ানী দিয়াছেন। হুজুর মালিক, মারিলেও মারিতে পারেন, কাটিলেও কার্টিতে পারেন। এ কুটির কতকগুলিন প্রবল শত্রু হইয়াছে, তাহাদের শাসন ব্যতীত নীলের মঙ্গল হওয়া দুস্কর।
উড। আমি না জানিলে কেমন করে শাসন করিতে পারে। টাকা, ঘোড়া লাটিয়াল, শড়কি— ওয়ালা আমার অনেক আছে, ইহাতে শাসন হইতে পারেনা? সাবেক দেওয়ান, শত্রুর কথা আমাকে জানাইতো—তুমি দেখিনি, আমি বজ্জাতদের চাবুক দিয়াছি, গোরু কেড়ে অনিয়াছি, জরু কয়েদ করিয়াছি; জোরু কয়েদ করিলে শালা লোক বড় শাসিত হয়। বজ্জাতি কা বাত্ হাম্ কুচ্ শুনা নেই—তুমি বেটা লক্কি ছাড়া আমারে কিছু বলিনি—তুমি শালা বড় না লায়েক আছে। দেওয়ানি কাম কায়েট্ কা হায় নেই বাবা—তোম কো জুতি মার্কে নেকাল ডেকে হাম্ এক আদ্মি ক্যাওটকো একাম্ দেগা।
গোপী। ধর্ম্মাবতার, যদিও বন্দা জাতিতে কায়স্থ, কিন্তু কার্য্যে ক্যাট, ক্যাওটের মতই কর্ম্ম দিতেছে। মোলাদের ধান ভেঙ্গে নীল করিবার জন্য এবং গোলোক বসের সাত পুরুষে লাখেরাজ বাগান ও রাজার আমলের গাঁতি বাহির করিয়া লইতে আমি যে সকল কার্য্য করিয়াছি, তাহা ক্যাওট কি, চামারেও পারে না, তা আমার কপাল মন্দ, তাই এত করেও যশ নাই।
উড। নবীনমাধর শালা সব টাকা চুক্য়ে চায়—— ওস কো হাম্ এক কৌড়ি নেহি দেগা, ওস্কো হিসাব দোরস্ত কর্কে রাখ—— বাঞ্চৎ বড়া মাম্লাবাজ্, হাম্ দেখেগা শালা কেস্তারে রূপেয়া লেয়।
গোপী। ধর্ম্মাবতার, ঐ এক জন কুটির প্রধান শত্রু। পলাশপুর জ্বালান কখনই প্রমাণ হইত না, যদি নবীন বস ওর ভিতরে না থাকিত। বেটা আপনি দরখাস্তের মুসাবিদা করিয়া দেয়, উকীল মোক্তারদিগের এমন সলা পরামর্শ দিয়াছিল, যে তাহার জোরেই হাকিমের রায় ফিরিয়া যায়। এই বেটার কৌশলেই সাবেক দেওয়ানের দুই বৎসর মেয়াদ হয়। আমি বারণ করিয়াছিলাম, নবীন বাবু, সাহেবের বিরুদ্ধাচরণ কর না। বিশেষ সাহেব তো তোমার ঘর জ্বালান্ নাই, তাতে বেটা উত্তর দিল “গোরিব প্রজাগণের রক্ষাতে দীক্ষিত হইয়াছি, নিষ্ঠুর নীলকরের পীড়ন হইতে যদি এক জন প্রজাকেও রক্ষা করিতে পারি, তাহা হইলেই আপনাকে ধন্য জ্ঞান করিব, আর দেওয়ানজিকে জেলে দিয়ে বাগানের শোধ লব।” বেটা যেন পাদরি হয়ে বসেছে। বেটা এবার আবার কি যোটা যোট করিতেছে, তার কিছুই বুঝিতে পারি না।
উড। তুমি ভয় পাইয়াছ, হাম্ বোলাকি নেই তুমি বড় না-লায়েক আছে, তোম ছে কাম্ হোগা নেই।
গোপী। হুজুর ভয় পাওয়ার মত কি দেখিলেন, যখন এ পদবীতে পদার্পণ করিছি, তখন ভয়, লজ্জা, সরম্, মান, মর্য্যাদার মাথা খাইয়াছি, গোহত্যা, ব্রহ্মহত্যা, স্ত্রীহত্যা, ঘর জ্বালান অঙ্গের অভরণ হইয়াছে, আর জেলখানা শিওরে করে বসে আছি।
উড। আমি কথা চাইনে, আমি কায চাই।
(সাধুচরণ, রাইচরণ, আমিন ও পেয়াদা দ্বয়ের
সেলাম্ করিতে করিতে প্রবেশ)
এ বজ্জাতের হস্তে দড়ি পড়িয়াছে কেন?
গোপী। ধর্ম্মাবতার, এই সাধুচরণ এক জন মাতব্বর রাইয়ত, কিন্তু নবীন বসের পরামর্শে নীলের ধ্বংসে প্রবৃত্ত হইয়াছে।
সাধু। ধর্ম্মাবতার নীলের বিরুদ্ধাচরণ করি নাই, করিতেছি না এবং করিবার ক্ষমতা নাই, ইচ্ছায় করি আর অনিচ্ছায় করি, নীল করিছি, এবারেও করিতে প্রস্তুত আছি। তবে সকল বিষয়ের সম্ভব অসম্ভব আছে, আদ্ আঙ্গুল চুঙ্গিতে আট্ আঙ্গুল বারূদ পুরিলে কাযেই ফাটে। আমি অতি ক্ষুদ্র প্রজা দেড় খানি লাঙ্গল রাখি, আবাদ হদ্দ ২০ বিঘা তার মধ্যে যদি ৯ বিঘা নীলে গ্রাস করে, তবে কাযেই চট্তে হয়। তা আমার চটায় আমিই মর্বো হুজুরের কি!
গোপী। সাহেবের ভয়, পাছে তুমি সাহেবকে তোমাদের বড়বাবুর গুদামে কয়েদ করে রাখ।
সাধু। দেওয়ানজি মহাশয়, মড়ার উপর আর খাঁড়ার ঘা কেন দেন। আমি কোন্ কীটস্য কীট, যে সাহেবকে কয়েদ কর্ব্যো, প্রবল প্রতাপশালী——
গোপী। সাধু, তোর সাধুভাষা রাখ, চাসার মুখে ভাল শুনায় না, গায় যেন ঝাঁটার বাড়ি মারে—
উড। বাঞ্চৎ বড় পণ্ডিত হইয়াছে।
আমিন। বেটা রাইয়েতদিগের আইন পরােয়ানা সব বুঝাইয়া দিয়া গোল করিতেছে, বেটার ভাই মরে লাঙ্গলঠেলে, উনি বলেন “প্রতাপশালী”
গােপী। ঘুঁটেকুড়ানির ছেলে সদরনায়েব।— ধর্ম্মাবতার! পল্লীগ্রামে স্কুল স্থাপন হওয়াতে চাসালােকের দৌরাত্ম্য বাড়িয়াছে।
উড। গবরণমেণ্টে এ বিষয়ে দরখাস্ত করিতে আমাদিগের সভায় লিখিতে হইবেক, স্কুল রহিত করিতে লড়াই করিব।
আমিন। বেটা মােকদ্দমা করিতে চায়।
উড। (সাধুচরণের প্রতি) তুমি শালা বড় বজ্জাত আছে। তােমার যদি ২০ বিঘার ৯বিঘা নীল করিতে বলেছে, তবে তুমি কেন আর ৯ বিঘা নূতন করিয়া ধান কর না।
গােপী। ধর্ম্মাবতার, যে লোকসান জমা পড়ে আছে তাহা হইতে ৯ বিঘা কেন, ২০ বিঘা পাট্টা করিয়া দিতে পারি।
সাধু। (স্বগত) হা ভগবান্! শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল। (প্রকাশে) হুজুর, যে ৯বিঘা নীলের জন্যে চিহ্ণিত হইয়াছে, তাহা যদি কুটির লাঙ্গল, গোরু ও মাইন্দার দিয়া আবাদ হয়, তবে আমি আর ৯বিঘা নূতন করিয়া ধানের জন্যে লইতে পারি। ধানের জমিতে যে কারকিত করিতে হয়, তার চার গুণ কারকিত নীলের জমিতে দরকার করে, সুতরাং যদিও ৯বিঘা আমার চাস দিতে হয় তবে বাকী ১১ বিঘার পড়ে থাক্বে, তা আবার নূতন জমি আবাদ কর্বো।
উড। শালা বড় হারাম্জাদা, দাদনের টাকা নিবি তুই, চাস দিতে হবে আমি, শালা বড় বজ্জাত (জুতার গুঁতা প্রহার) শ্যামাচাঁদ্কা সাৎ মুলাকাৎ হোনেছে হারামজাদ্কি সব ছােড় যা গা (দেয়াল হইতে শ্যামচাঁদ গ্রহণ)
সাধু। হুজুর, মাছি মেরে হাত কাল করা মাত্র, আমরা—
রাই। (সক্রোধে) ও দাদা, তুই চুপ দে, ঝা ন্যাকে নিতি চাচ্চে ন্যাকে দে। ক্ষিদের চোটে নাড়ী ছিঁড়ে পড়্লো, সারাদিন্ডে গ্যাল, নাতিও পালাম না, খাতিও পালাম না।
আমিন। কই শালা, ফৌজদারী কর্লিনে? (কান মলন)
রাই। (হাঁপাইতে২) মলাম, মাগো! মাগো!
উড। ব্লাডি নিগার মারো বাঞ্চৎ কো (শ্যামচাঁদাঘাত)
(নবীনমাধবের প্রবেশ।)
রাই। বড়বাবু, মলাম গো! জল খাবো গো! মেরেফ্যাল্লে গো!
নবীন। ধর্ম্মাবতার, উহাদিগের এখন স্নানও হয় নাই আহারও হয় নাই। উহাদের পরিবারেরা এখনও বাসি মুখে জল দেয় নাই। যদি শ্যামাচাঁদ আঘাতে রাইয়ত সমুদায় বিনাশ করিয়া ফেলেন, তবে আপনার নীল বুন্বে কে? এই সাধুচরণ গত বৎসর কত ক্লেশে ৪ বিঘা নীল দিয়াছে, যদি উহাকে এরূপ নিদারুণ প্রহারে এবং অধিক দাদন চাপাইয়া ফেরার করেন, তবে আপনারই লোকসান। উহাদের অদ্য ছাড়িয়া দেন, আমি কল্য প্রাতে সমভিব্যহারে আনিয়া আপনি যেরূপ অনুমতি করিবেন সেই রূপ করিয়া যাইব।
উড। তোমার নিজের চরকায় তেল দেও। পরের বিষয়ে কথা কহিবার কি আবশ্যক আছে? সাধু ঘোষ, তোর্ মত্কি, তা বল? আমার খানার সময় হইয়াছে।
সাধু। হুজুর, আমার মতের অপেক্ষা আছে কি? আপনি নিজে গিয়া ভাল ২ চার বিঘাতে মার্ক দিয়া আসিয়াছেন, আজ্ আমিন মহাশয় আর যে কয় খান ভাল জমী ছিল, তাহাতেও চিহ্ন দিয়া আসিয়াছেন। আমার অমতে জমী নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে, নীলও সেইরূপ হইবে। আমি স্বীকার করিতেছি বিনা দাদনে নীল করে দিব।
উড। আমার দাদন সব মিছে, হারামজাদা, বজ্জাত, বেইমান (শ্যামাচাঁদ প্রহার।)
নবীন। (সাধুচরণের পৃষ্ঠে হস্ত দিয়া আবরণ) হুজুর, গরিব ছা পোষা লোকটাকে একেবারে মেরে ফেলিলেন। আহা! উহার বাড়ীতে খাইতে অনেক গুলিন। এ প্রহারে একমাস শয্যাগত হইয়া থাকিতে হইবে। আহা! উহার পরিবারের মনে কি ক্লেশ হইতেছে, সাহেব, আপনারও পরিবার আছে, যদি আপনাকে খানার সময় কেহ ধৃত করিয়া লইয়া যায়, তবে মেম্সাহেবের মনে কেমন পরিতাপ জন্মে।
উত। চপ্রাও, শালা, পাজি, গোরুখোর। এ আর অমর নগরের মাজিষ্ট্রেট নয় যে কথায় কথায় নালিশ কর্বি, আর কুটির লােক ধরে মেয়াদ দিবি। ইন্দ্রাবাদের মাজিষ্ট্রেট তােমার মৃত্যু হইয়াছে। র্যাসকেল্ — এই দিনের মধ্যে তুই ৬০ বিঘা দাদন লিখিয়া দিবি তবে তাের ছাড়ান, নচেৎ শ্যাঁমচাদ তাের মাথায় ভাঙ্গিব। গোস্তাকি! তাের দাদনের জন্যে দশ খানা গ্রামের দাদন বন্ধ রহিয়াছে।
নবীন। (দীর্ঘ নিশ্বাস) হে মাতঃ পৃথিবী! তুমি দ্বিধা হও, আমি তন্মধ্যে প্রবেশ করি। এমন অপমান আমার জন্মেও হয় নাই — হা বিধাত!
গােপী। নবীন বাবু, বাড়াবাড়ি কায কি, আপনি বাড়ী যান।
নবীন। সাধু, পরমেশ্বরকে ডাক, তিনিই দীনের রক্ষক।
উড। গোলামকি গোলাম। দেওয়ান, দপ্তরখানায় লইয়া যাও, দস্তুর মােতাবেক দাদন দেও।
“বাড়াভীতে ছাই তব বাড়াভাতে ছাই।
ধরেছে নীলের যমে আর রক্ষা নাই।”
প্রথম অঙ্ক
চতুর্থ গর্ভাঙ্ক।
গোলোক বসুর দরদালান
সৈরিন্ধী চুলেরদড়ী বিনাইতে নিযুক্ত।
সৈরিন্ধী। আমার হাতে এমন দড়ী এক গাছিও হয় নি। ছােট বােউ বড় পয়মন্ত। ছােটবোয়ের নাম করে যা করি তাই ভাল হয়। এক পণ ছুট্ করেছি কিন্তু মুটোর ভিতর থাক্বে। যেমন একঢাল চুল তেমনি দড়ী হয়েছে। আহা চুলতো নয়, শ্যামাঠাকুরণের কেশ, মুখ্খানি যেন পদ্মফুল, সর্ব্বদাই হাস্য বদন। লোকে বলে “যাকে যায় দেখ্তে পারে না” আমিতো তার কিছুই দেখিনে। ছোটবােয়ের মুখ দেখলে আমারতো বুক জুড়িয়ে যায়। আমার বিপিনও যেমন, ছোটবউও তেমন। ছোট বউতো আমাকে মায়ের মত ভালবাসে।
(সিকাহস্তে সরলতার প্রবেশ)
সর। দিদি, দ্যাখ দেখি, আমি সিকের তলাটি বুন্তে পেরেছি কি না?—হয় নি?
সৈরিন্ধ্রী। (অবলোকন করিয়া) হ্যাঁ এই বার দিব্বি হয়েছে। ওবোন্, এই খান্টি যে ডুবিয়েছো, লালের পর জরদ্তে খোলেনা।
সর। আমি তোমার দিকে দেখে বুন্ছিলাম—
সৈরি। তাতে কি লালের পর জরদ আছে?
সর। না তাতে লালের পর সবুজ আছে। কিন্তু আমর সবুজ সুতা ফুর্য়ে গেছে, তাই আমি ওখানে জরদ দিয়েছি।
সৈরি। তোমার বুঝি আর হাটের দিন পর্য্যন্ত তর সইল না—তোমার বোন্ সকলি তাড়াতাড়ি বলে?
“বৃন্দাবনে অছেন হরি।
ইচ্ছা হলে রইতে নারি॥”
সর। বাহবা— আমার কি দোষ, হাটে কি পাওয়া যায়? ঠাকুরুণ গেলহাটে মহাশয়কে আন্তে বলেছিলেন, তা তিনি পান্ নি।
সৈরি। তবে ওঁরা যখন ঠাকুরপোকে চিটি লিখিবেন সেই সময় পাঁচ রঙ্গের সুতার কথা লিখে দিতে বল্বো।
সর। দিদি এ মাসের আর কদিন আছে গা —
সৈরি। (হাস্যবদনে) যার যে খানে ব্যথা, তার সেখানে হাত। ঠাকুরপোর কালেজ বন্দ হলে বাড়ি আস্বের কথা আছে—তাই তুমি দিন গুণ্চো—আর বোন্, মনের কথা বের্য়ে পড়েছে!
সর। মাইরি দিদি আমি তা ভেবে জিজ্ঞাসা করিনি — মাইরি।
তৈরি। ঠাকুরপোর আমার কি সুচরিত্র, কি মধুমাখা কথা! ওঁরা যখন ঠাকুরপোর চিটি গুলিন পড়েন, যেন অমৃত বর্ষণ হইতে থাকে? দাদার প্রতি এমন ভক্তি কখন দেখিনি, দাদারি বা কি স্নেহ, বিন্দু মাধবের নামে মুখে লাল পড়ে, আর বুক খান পাঁচ হাত হয়। আমার যেমন ঠাকুরপো, তেমনি ছোট বউ — (সরলতার গাল্ টিপে) সরলতা তো সরলতা — আমি কি তামাক পোড়ার কটোটা আনিনি, যেমন এক দণ্ড তামাক পোড়া নইলে বাঁচিনে, তেমনি কটোটা যেন আগে ভুলে এসিছি।
(আদুরীর প্রবেশ)
ও আদর, তামাক পোড়ার কোটটা আন্না দিদি।
আদুরী। মুই অ্যাকন কনে খুঁজে মর্বে।?
সৈরি। ওরে, রান্না ঘরের রকে উঠ্তে ডান দিকে চালের বাতায় গোঁজা আছে।
আদুরী। তবে খামাত্তে মোই খান আনি, তা নলি চালে ওটবো ক্যামন করে।
সর। বেশ বুঝেছে।
সৈরি। কেন ও তো ঠাকুরুণের কথা বেশ বুঝতে পারে? তুই রক কারে বলে জানিসনে, তুই ডান বুঝিস নে?
অঙ্গুরী। মুট ডান হতি গ্যালামি ক্যান। মোগার কপালের দোষ, গোরিব নোকের মেয়ে যদি বুড়ো হলো আর দাঁত পড়্লো, তবেই সে ডান হয়ে ওটলো। — মা ঠাকুরুণিরি বল্বো দিনি, মুইকি ডান হবার মত বুড়ো হইচি।
সৈরি। মরণ আর কি! (গাত্রোত্থান করে) ছোট বউ বসিস, আমি আস্চি, বিদ্যাসাগরের বেতাল শুন্বো।
আদুরী। সেই সাগর নাড়ের বিয়ে দেয়, ছ্যা—নাকি দুটো দল হয়েছে, মুই আজাদের দলে।
সর। হ্যাঁ আদুরী, তোর ভাতার তোরে ভালবাস্তো? আদুরী। ছোট হালদার্ণি, সে খ্যাদের কথা আর তুলিস্নে? মিন্সের মুখ্খান মনে পড়্লি আজো মোর পরাণডা ডুক্রে কেঁদে ওটে। মোরে বড্ডি ভাল বাস্তো। মোরে বাউ দিতি চেয়েলো।
পুঁইচে কি এত ভারি রে প্রাণ, পুঁইচে কি এত ভারি।
মনের মত হলি পরে বাউ পরাতি পারি।
দেখদিনি খাটে কি না, মোরে ঘুমুতি দিত না, বিমুলি বল্তো, “ও পরাণ ঘুমুলে”।
সর। তুই ভাতারের নাম ধরে ডাক্তিস্?
আদুরী। ছি, ছি, ছি, ভাতার যে গুরুনোক, নাম ধত্তি আছে!
সর। তবে তুই কি বলে ডাক্তিস?
আদুরী। মুই বল্তাম, হ্যাদে ওয়ো শোন্চো —
(সৈরিন্ধ্রীর পুনঃ প্রবেশ)
সৈরি। আবার পাগ্লিকে কে খ্যাপালে?
আদুরী। মোর মিন্সের কথা সুদুচ্চেন তাই মুই বল্তি লেগিচি।
সৈরি। (হাস্যবদনে) ছোটবয়ের মত পাগল আর দুটি নাই, এত জিনিস থাক্তে আদুরীর ভাতারের গল্প ঘাঁটিয়ে ঘাঁটিয়ে শোনা হচ্চে।
(রেবতী ও ক্ষেত্রমণির প্রবেশ।)
আয় ঘােষ দিদি আয়, তােকে আজ্ কদিন ডেকে পাঠাচ্চি তা তাের আর বার হয় না। ছােটবউ এই নাও, তােমার ক্ষেত্রমণি এসেছে, আজ্ কদিন আমারে পাগল করেছে, বলে দিদি ঘােষেদের ক্ষেত্র শ্বশুর বাড়ি হতে এসেছে তা আমাদের বাড়ি এল না?
রেবতী। তা মােদের পত্তি এম্নি কের্পা বটে। ক্ষেত্র তাের কাকি মাদ্দের পরণাম কর।
সৈরি। জন্মায়তি হও, পাকাচুলে সিঁদূর পর, হাতের ন ক্ষয় যাক,ছেলে কোলে করে শ্বশুর বাড়ি যাও।
আদুরী। মাের কাছে ছােট হালদার্ণির মুখি খােই ফুট্তি থাকে, মেয়েডা গড় কল্লে তা বাঁচো মরাে একটা কথাও কলে না।
সৈরি। বালাই সেটের বাছা — আদুরী যা ঠাকুরুনকে ডেকে আন্গে ৷
পােড়া কপালি কি বলিতে কি বলে তা কিছু বােঝে না,— কমাস হলাে?
রেবতী। ওকথা কি আজোদিদি পর্কাশ করিছি। মোর যে ভাঙ্গা কপাল, সত্যি কি মিথ্যে তাই বা কেমন করে জান্বো। তোমরা আপনার জন তাই বলি — এই মাসের কডা দিন গেলি চার মাসে পড়্বে।
সর। আজো পেট বেরোইনি।
সৈরি। এই আর এক পাগল, আজো তিন মাস পুরিনি ও এখনি পেট ডাগর হইয়াছে কি না তাই দেখ্চে।
সর। ক্ষেত্র তুনি ঝাপাটা তুলে ফেলছ কেন?
ক্ষেত্র। মোর ঝাপাটা দেখে মোর ভাশুর বড় খাপা হয়েলো, ঠাকুরুনিরি বল্লে ঝাপ্টা কাটা কস্বিদের আর বড়নোকের মেয়েগার সাজে। মুই শুনে নজ্জায় মরে গ্যালাম, সেই দিন ঝাপ্টা তুলে ফ্যাল্লাম।
সৈরি। ছোট বোউ, যাও দিদি কাপড় গুনো তুলে আন্গে, সন্ধা হলো।
(আদুরীর পুনঃ প্রবেশ।)
সর। (দাঁড়ায়ে) আয় আদুরী ছাদে গিয়ে কাপড় তুলি।
আদুরী। ছোট হালদার আগে বাড়িই আসুক, হা, হা, হা হা।
সৈরি। (সরোষে এবং হাস্য বদনে) দূর পোড়াকপালি, সকল কথাতেই তামাসা—ঠাকুরুন কইলো —
(সাবিত্রীর প্রবেশ।)
এই যে এসেছেন।
সাবি। ঘোযবোউ এইচিস, তোর মেয়ে এনিচিস বেস করিচিস — বিপিন আব্দার নিচ্লো তাকে শান্ত করে বাইরে দিয়ে এলাম!
রেবতী। মাঠাকুরুন পর্ণাম করি। তোর দিদি মারে পর্ণাম কর।
সাবি। সুখে থাক, সাত বেটার মা হও— (নেপথ্যে কাশি) বড় বোউমা ঘরে যাও বাবার বুঝি নিদ্রা ভেঙ্গেছে — আহা! বাছার কি সময়ে নাওয়া আছে, না সময়ে খাওয়া আছে, ভেবে ভেবে নবীন আমার পাতখানি হয়ে গিয়েছে —(নেপথ্যে “আদুরী”) মা যাওগো জল চাচ্ছেন বুঝি।
সৈরি। (জনান্তিকে আদুরীর প্রতি) আদুরী দেখ তোরে ডাক্চে।
আদুরী। ডাক্চেন মোরে, কিন্তু চাচ্চেন তোমারে।
সৈরি। পোড়ার মুখ — ঘোয দিদি আর এক দিন আসিস্।
রেবতী। মাঠাকুরুণ, আরতো এখানে কেউ নেই— মুইতো বড় আপদে পড়িছি, পদী ময়রাণী কাল মোদের বাড়ি এয়েলো —
সাবি। রাম্, রাম্, রাম্, ও নচ্ছার বেটিকেও কেউ বাড়ি আস্তে দেয় — বেটির আর বাকি আছে কি, নাম লেখালেই হয়।
রেবতী। মা, তা মুই কর্বো কি, মোরতো আর ঘেরা বাড়ি নয়, মর্দেরা ক্ষ্যাতে খামারে গেলি বাড়ি বল্লিইবা কি, আর হাট বল্লিইবা কি — গস্তানি বিটি বলে কি — মা মোর গাডা কাঁটা দিয়ে ওট্চে— বিটি বলে, ক্ষেত্রকে ছোট সাহেব ঘোড়া চেপে যাতি যাতি দেখে পাগল হয়েচে, আর তার সঙ্গে একবার কুটির কামরাঙ্গার ঘরে যাতি বলেছে।
আদুরী। থু, থু, থু! — গোন্দো! প্যাঁজির গোন্দো! — সাহেবের কাছে কি মোরা জাতি পারি, গোন্দো থু থু! প্যাঁজির গোন্দো!— মুইতো আর একা বেরোব না, মুই সব সইতি পারি, প্যাঁজির গোন্দো সইতি পারিনে—থু, থু, গােন্দো! প্যাঁজির গোন্দো!
রেবতী। মা, তা গোরিবের ধর্ম্ম কি ধর্ম্ম নয়? বিটি বলে, টাকা দেবে, ধানের জমি ছেড়ে দেবে, আর জামাইরি কর্ম্ম করে দেবে —পোড়া কপাল টাকার! ধর্ম্ম কি ব্যাচ্বার জিনিস, না এর দাম আছে! কি বল বো বিটি সাহেবের নোক, তা নইলি মেয়ে নাতি দিয়ে মুখ ভেঙ্গে দেতাম। মেয়ে আমার অবাক হয়েছে, কাল থেকে ঝম্কে ঝম্কে ওট্চে।
আদুরী। মাগো যে দাড়ি! কথা কয় যে বােকা ছাগলে ফ্যাবা মারে। দাড়ি প্যাঁজ না ছাড়লি মুই তাে কখনই যাতি পার্বাে না, থু, থু, থু,! গোন্দো, প্যাঁজির গোন্দো।
রেবতী। মা সর্ব্বনাশী বলে, যদি মাের সঙ্গে না পেট্য়ে দিস তবে নেটেলা দিয়ে ধরে নিয়ে যাবে
সাবি। মগের মুলুক আর কি!— ইংরেজের রাজ্যে কেউ নাকি ঘর ভেঙ্গে মেয়ে কেড়ে নিয়ে যেতে পারে।
রেবতী। মা চাসার ঘরে সব পারে। মেয়ে লােক ধরে মর্দদের কায়দা করে, নীল দাদনে এ কত্তি পারে, নজোরে ধল্লি কত্তি পারে না? মা, জান না, নয়দারা রাজি নামা দিতি চাইনি বলে ওদের মেজো বোউরি ঘর ভেঙ্গে ধরে নিয়ে গিয়েলাে।
সাবি। কি অরাজক! সাধুকে একথা বলেছ?
রেবতী। না, মা, সে য়্যাকিই নীলির ঘায় পাগল, তাতে একথা শুনে কি আর রক্ষে রাখবে, রাগের মাথায় আপনার মাথায় আপ্নি কুড়ুল মেরে বস্বে।
সাবি। আচ্ছা, আমি কত্তাকে দিয়ে একথা সাধুকে বলবাে, তােমার কিছু বল্বার আবশ্যক নেই — কি সর্ব্বনাশ! নীলকর সাহেবেরা সব কত্তে পারে, তবে যে বলে সাহেবের বড় সুবিচার করে, আমার বিন্দু যে সাহেবদের কত ভাল বলে, তা এরা কি সাহেব না, না এরা সাহেবদের চণ্ডালি।
রেবতী। ময়রাণী বিটি আর এক কথা বলে গ্যালাে, তা বুঝি বড় বাবু শুনিন্ নি — কি একটা নতুন হুকুম হয়েছে, তাতে নাকি কুটেল সাহেবরা মাচেরটক্ সাহেবের সঙ্গে যােগ দিয়ে যাকে তাকে ৬ মাস ম্যাদ দিতি পারে। তা কত্তা মশাইরি নাকি এই ফাঁদে ফ্যালবার পথ কচ্চে।
সাবি। (দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া) ভগবতীর মনে যদি তাই থাকে, হবে।
রেবতী। মা কত কথা বলে গ্যাল, তাকি আমি বুঝতি পারি, নাকি এ ম্যাদের পিল্ হয় না —
আদুরী। ম্যাদেরে বুঝি পেটপোড়া খেব্এচে।
সাবি। আদুরী, তুই একটু চুপ কর বাছা।
রেবতী। কুটির বিবি এই মকদ্দামা পাকাবার জন্যি মাচেরটক্ সাহেবকে চিঠি ন্যাকেচে, বিবির কথা হাকিম নাকি বড্ডো শোনে।
আদুরী। বিবির আমি দেখিছি, নজ্জ্বাও নেই, সরমও নেই, — জ্যলার হাকিম মাচেরটক্ সাহেব, কত নাঙ্গাপাকড়ি, তেরোনাল ফির্তি থাকে, মাগো নাম কল্লি প্যাটের মধ্যি হাত পা সেঁদোয়— এই সাহেবের সঙ্গি ঘোড়া চেপে ব্যাড়াতি এয়েলো। বউ মান্সি ঘোড়া চাপে! —কেশের কাকি ঘরের ভাশুরির সঙ্গি হেসে কথা কয়েলো, তাই লোকে কত নজ্জ্বা দেলে, এতো জ্যালার হাকিম।
সাবি। তুই আবাগি কোন্ দিন মজাবি দেক্চি, তা সন্ধ্যা হলো, ঘোষবউ তোরা বাড়ি যা, দুর্গা আছেন।
রেবতী। যাই মা, আবার কলু বাড়ি দিয়ে তেল নিয়ে যাব, তবে সাজ জ্বলবে।
সাবি। তাের কি সকল কথায় কথা না কইলে চলে না?
(সরলতার কাপড় মাথায় করিয়া প্রবেশ।)
আদুরী। এই যে ধােপাবউ কাপড় নিয়ে আলেন।
(সরলতায় জিবকেটে কাপড় বাখন্।)
সাবি। ধোপাবউ কেন হতে গেললা, আমার সােনার বউ আমার রাজলক্ষী (পৃষ্ঠে হস্ত দিয়া) হ্যাগা মা, তুমি বই কি আর আমার কাপড় আনিবার মানুষ নাই — তুমি কি এক জায়গায় ১ দণ্ড স্থির হয়ে বসে থাক তে পার না —এমন পাগ লির পেটেও তােমার জন্ম হয়েছিল — কাপড়ডায় ফালাদিলে কেমন করে, তবে বােধ করি গায়েও ছড় গিয়েছে — আহা! মার আমার রক্ত-কমলের মত রং, একটু ছড় লেগেছে যেন রক্ত ফুটে বেরােচ্চে। তুমি মা আর অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে অমন করে যাওয়া আসা করাে না।
(সৈরিন্ধ্রীর প্রবেশ।)
সৈরি। আয় ছােটবউ ঘাটে যাই।
সাবি। যাও মা, দুই যায়ে এই বেলা বেলা থাক্তে থাক্তে গাধুয়ে এস।