নীল-দর্পণ নাটক

নীল-দর্পণ নাটক।

নীলকর-বিষধর-দংশন-কাতর-প্রজানিকর-

ক্ষেমঙ্করেণ কেনচিৎ পথিকেনাভিপ্রণীতং।

তৃতীয় সংস্করণ।

কলিকাতা

বি, এ, বন্ধু এণ্ড কোং কর্ত্তৃক ইণ্ডিয়ান রয়াল যন্ত্রে

মুদ্রিত।

শকাব্দা ১৭৯৪।

ভূমিকা।

 নীলকরনিকরকরে নীল-দর্পণ অৰ্পণ করিলাম। এক্ষণে তাঁহারা নিজ নিজ মূখ সন্দর্শন পূর্ব্বক তাঁহাদিগের ললাটে বিরাজমান স্বার্থ-পরতা-কলঙ্ক-তিলক বিমােচন করিয়া তৎপরিবর্ত্তে পরােপকার শ্বেত-চন্দন ধারণ করুন, তাহা হইলেই আমার পরিশ্রমের সাফল্য, নিরাশ্রয় প্রজা ব্রজের মঙ্গল এবং বিলাতের মুখ রক্ষা। হে নীলকরগণ! তােমাদিগের নৃশংস ব্যবহারে প্রাতঃস্মরণীয় সিড্নি, হাউয়ার্ড, হল প্রভৃতি মহানুভব দ্বারা অলঙ্কৃত ইংরাজকূলে কলঙ্ক রটিয়াছে। তােমাদিগের ধনলিপ্সা কি এতই বলবতী যে, তােমরা অকিঞ্চিৎকর ধনানুরােধে ইংরাজজাতির বহুকালার্জ্জিত বিমল যশস্তামরসে কীটস্বরূপে ছিদ্র করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছ। এক্ষণে তােমরা যে সাতিশয় অত্যাচার দ্বারা বিপুল অর্থ লাভ করিতেছ তাহা পরিহার কর, তাহা হইলে অনাথ প্রজারা সপরিবারে অনায়াসে কালাতিপাত করিতে পারিবে। তোমরা এক্ষণে দশ মুদ্রা ব্যয়ে শত মুদ্রার দ্রব্য গ্রহণ করিতেছ, তাহাতে প্রজাপুঞ্জের যে ক্লেশ হইতেছে, তাহা তোমরা বিশেষ জ্ঞাত আছ; কেবল ধনলাভপরতন্ত্র হইয়া প্রকাশ করণে অনিচ্ছুক। তােমরা কহিয়া থাকি যে, তােমাদের মধ্যে কেহ কেই বিদ্যাদানে অর্থ বিতরণ করিয়া থাকেন এবং সুযােগ ক্রমে ঔষধ দেন, একথা যদিও সত্য হয়, কিন্তু তাহাদের বিদ্যাদান পয়স্বিনী ধেনুবধে পাদুকা দানাপেক্ষাও ঘৃণিত এবং ঔষধ বিতরণ কালকূটকুম্ভে ক্ষীর ব্যবধান মাত্র। শ্যামচাঁদ আঘাত উপরে কিঞ্চিৎ টারপিন তৈল দিলেই যদি ডিস্পেন্সারি করা হয়, তবে তোমাদের প্রত্যেক কূটিতে ঔষধালয় আছে বলিতে হইবে। দৈনিক সংবাদপত্র সম্পাদকদ্বয় তোমাদের প্রশংসায় তাহাদের পত্র পরিপূর্ণ করিতেছে, তাহাতে অপর লােক যেমত বিবেচনা করুক, তােমাদের মনে কখনই ত আমন জন্মিতে পারে না; যেহেতু তােমরা তাহাদের এরূপ করণের কারণ বিলক্ষণ অবগত আছ। রজতের কি আশ্চর্য্য আকর্ষণ শক্তি! ত্রিংশৎ মুদ্রালােভে অবজ্ঞাস্পদ জুডাস, খীষ্ট-ধর্ম্ম-প্রচারক মহাত্মা যীজস্কে করাল পাইলেট করে অর্পণ করিয়াছিল; সম্পাদকযুগল সহজ মুদ্রা লাভ পরবশ হইয়া উপায়হীন দীন প্রজাগণকে তােমাদের করাল কবলে নিক্ষেপ করিবে আশ্চর্য্য কি? কিন্তু “চক্রবৎ পরিবর্ত্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ।” প্রজাবৃন্দের সুখ-সূর্য্যোদয়ের সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে। দাসী দ্বারা সন্তানকে স্তনদুগ্ধ দেওয়া অবৈধ বিবেচনায় দয়াশীল প্রজা-জননী মহারাণী ভিক্টোরিয়া প্রজাদিগকে স্বক্রোড়ে লইয়া স্তনপান করাইতেছেন। সুধীর সুবিজ্ঞ সাহসী উদারচরিত্র ক্যানিং মহােদয় গবর্ণর জেনেরল হইয়াছেন। প্রজার দুঃখে দুঃখী, প্রজার সুখে সুখী, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, ন্যায়পর গ্রাণ্ট মহামতি লেফ্টেনেণ্ট গবর্ণর হইয়াছেন এবং ক্রমশঃ সত্যপরায়ণ, বিচক্ষণ, নিরপেক্ষ ইডেন্, হারসেল্ প্রভৃতি রাজকার্য্য পরিচারকগণ শতদল স্বরূপে সিবিল্ সরভিস্ সরােবরে বিকসিত হইতেছেন। অতএব ইহা দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, নীলকর দুষ্টরাহুগ্রস্ত প্রজাবৃন্দের অসহ্য কষ্ট নিবারণার্থে উক্ত মহানুভবগণ যে অচিরাৎ সদ্বিচাররূপ সুদর্শনচক্র হস্তে গ্রহণ করিবেন, তাহার সূচনা হইয়াছে।

কস্যচিৎ পথিকস্য।

তৃতীয় বারের বিজ্ঞাপন।

 বঙ্গীয় সাহিত্য সমাজে যত নাটক দেখা যায় তন্মধ্যে “নীল-দর্পণ” যে সর্বোৎকৃষ্ট, যিনি ইহা একবার পাঠ বা শ্রবণ করিয়াছেন তিনি তাহা অবশ্যই স্বীকার করিবেন। এই নাটক দ্বারা প্রণেতার আন্তরিক উদ্দেশ্য সংসাধিত হইয়াছে কি না, তিনিই বলিতে পারেন। এ স্থলে সে বিষয়ের প্রসঙ্গ করা আমাদিগের অভিপ্রেত নহে। ইহা দ্বারা বঙ্গ ভাষার যে কতদূর উন্নতি হইয়াছে, তাহাই আমাদিগের বক্তব্য। অন্যান্য ভাষার ন্যায় বঙ্গভাষায় বিশুদ্ধ নাটক প্রচলিত ছিল না। সুতরাং ইনি অপরাপর ভাষাপেক্ষা কিছু দীনভাবাপন্ন ছিলেন। পরে এই নাটক মুদ্রিত হইলে বঙ্গভাষা তাঁহার প্রাচীন ও নব সহচরীগণের ন্যায় এই অপূর্ব্ব নাট্য রত্নকে মণিহারের মধ্যমণি করিয়া স্বীয় গলদেশে লম্বমান করিলেন। এই নাটক দ্বারা কেবল যে ভাষাই অলঙ্কৃত হইয়াছেন এমত নহে। ইহা অপর নাট্যকারগণকে প্রােৎসাহিত করিআছে। কিন্তু ক্ষোভের বিষয় এই যে, এই নাটক প্রায় আর কোন পুস্তকালয়েই বিক্রয়ার্থ দৃষ্ট হয় না। প্রথম মুদ্রিত পুস্তক নিঃশেষিত হইলে পর, মহামান্য সাহিত্য সমাজ শিরােমণি মৃত কালীপ্রসন্ন সিংহ মহােদয় ইহা দ্বিতীয় বার মুদ্রিত করেন। এক্ষণে তাহাও প্রায় আর দৃষ্টি গােচর হয় না। ভবিষ্যৎ নাট্যকার গণের আদর্শস্বরূপ ও বঙ্গ সাহিত্যের ভূষণ স্বরূপ এই অপূর্ব নাটকের এবম্প্রকার অভাব নিরাকরণ করা বঙ্গবাসীর পক্ষে সর্ব্বতােভাবে বিধেয়। এই সমস্ত পর্য্যালােচনানন্তর মৃত সিংহ মহােদয়ের মুদ্রিত পুস্তককে আদর্শ করিয়া এই নীলদর্পণের তৃতীয় মুদ্রাঙ্কন কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলাম।

কলিকাতা।

২রা বৈশাখ।

শকাব্দা ১৭৯৪।

নাট্যোল্লিখিত ব্যক্তিগণ।

পুরুষগণ।

গোলোকচন্দ্র বসু
নবীনমাধব ও গোলোকচন্দ্র বসুর পুত্রদ্বয়।
বিন্দুমাধব
সাধুচরণ   প্রতিবাসী রাইয়ত।
রাইচরণ   সাধুর ভ্রাতা।
গোপীনাথ দাস   দেওয়ান।
আই, আই, উড নীলকর।
পি, পি, রোগ
আমিন।
খালাসী।
তাইদ্‌গীর।
ম্যাজিষ্ট্রেট, আমলা, মোক্তার, ডেপুটি ইনস্পেক্‌টর, পণ্ডিত, জেলদারোগা, ডাক্তার, গোপ, কবিরাজ, চারি জন শিশু, লাটিয়াল, রাখাল।

কামিনীগণ।
সাবিত্রী   গোলোকের স্ত্রী।
সৈরিন্ধ্রী   নবীনের স্ত্রী।
সরলতা   বিন্দুমাধবের স্ত্রী।
রেবতী   সাধুচরণের স্ত্রী।
ক্ষেত্রমণি   সাধুর কন্যা।
আদুরী   গোলোক বসুর বাড়ীর দাসী।
পদী ময়রাণী।

নিম্নে মুদ্রিত কয়েকটি সঙ্গীত সাদরে নীলকরদিগকে উপহার প্রদত্ত হইল।


রাগিণী আড়ানা বাহার—তাল ভেওটা

হে নিরদয় নীলকরগণ।
আর সহে না প্রাণে এ নীল দহন॥
কৃষকের ধনে প্রাণে, দহিলে নীল আগুনে,
গুণরাশি কি কুদিনে, কল্লে হেতা পদার্পণ।
দাদনের সুকৌশলে, শ্বেত সমাজের বলে,
লুঠেছ সকল তো হে কি আর আছে এখন॥
দীন জনে দুঃখ দিতে কাহার না লাগে চিতে,
কেবল নীলের হেরি পাষাণ সমান মন।
বৃটন স্বভাবে শেষে, কালী দিলে বঙ্গে এসে,
তরিলে জলধিজল, পোড়াতে স্বর্ণভবন।

(বিদ্যাভূণী ক্বত)

কবির সুর।

নীল বানরে সোনার বাংলা কল্লে এবার ছারেখার।
অসময়ে হরিশ মলো লংয়ের হলো কারাগার।
প্রজার আর প্রাণ বাঁচানো ভার।
রাম সীতার কারণে, সুগ্রীবে মিতালী করে বধে রাবণে,
যত সওদাগরেরা সহায় এদের, ** দুটো এডিটার।
এখন স্পষ্ট লেখা ঘুচে গ্যালো, জজ সাহেব এক অবতার।
যত ** ** রাজত্ত্ব হলো, সাধুর পক্ষে গঙ্গাপার॥

(ঐ)

(সোমপ্রকাশ হইতে উদ্ধৃত)

রাগ সুরটমল্লার—তাল আড়াঠেকা।

নীল-দর্পণে লং সাহেব যথার্থ যা তাই লিখেছে।
নীলে নীলে সব নিলে প্রজার বল ভাই কি রেখেছে॥ ১
কারো * * কার, তাদের উপর অত্যাচার,
তাই নিয়ে বার বার, লিখে লিখে হরিশ মরেছে॥ ২
ইডন্, গ্রাণ্ট মহামতি, ন্যায়বান উভয়ে অতি,
করিতে প্রজার গতি, কত চেষ্টা পাইতেছে॥ ৩
ইণ্ডিগো রিপোর্ট পোড়ে, কে না অন্তরে পোড়ে,
তবু নীলির| নোড়ে চোড়ে, পোঁড়ার মুখ দেখাতেছে॥ ৪
বল্‌তে দুখে বুক বিদরে, ওয়েল্‌স অবিচার কোরে,
নির্দ্দোষী লংকে ধোরে, একটি মাস যাদ দিয়েছে॥ ৫
ওয়েল্‌স, পিকক, জাকসনে, বসিয়া বিচারাসনে,
* * * * * * * * হাজার টাকা ফাইন্ কোরেছে॥ ৬
নিদারুণ সেন্‌টেন্‌স শুনে, সিংহ বাবু দয়াগুণে,
হাজার টাকা দিলেন গুণে, ওয়াল্‌টারব্রেট তায় তাকে

হয়েছে॥ ৭

ইংলণ্ডেশ্বরী শুন, পিউনির সকল গুণ,
আইনে যে সুনিপুণ এবার তা বেরিয়ে পোড়েছে। ৮
যে অবধি কলিকাতা, পাইয়াছে এই বিধাতা,
সেই অবধি দেখি মাতা, রেস্ হেট্রেড খুব চেগেছে। ৯
বেঞ্চে বাতুলের মত, লম্প ঝম্প করে কত,
আবার বলে আমার মত, কে বা জজ হেথা এসেছে। ১০
কিন্তু পীল, সিটন আদি, এক এক বুদ্ধির কাঁদি,
তাদের লাগি আজো কাঁদি, হায় কি বিচার কোরে গেছে।
মহারাণী তোমা প্রতি, এই ক্ষণে এই মিনতি,
ওয়েল্‌স পাপে দেও মুকতি, ধীরাজ এই বলিতেছে। ১২

(ধীরাজকৃত)

পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

সূচীপত্র

এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।