নীল-দর্পণ নাটক/চতুর্থ অঙ্ক

চতুর্থ অঙ্ক।

প্রথম গর্ভাঙ্ক।

ইন্দ্রাবাদের ফৌজদারি কাছারি।

উড, রােগ মাজিষ্ট্রেট, আমলা আসীন। গোলোকচন্দ্র,

নবীনমাধব, বিন্দুমাধব, বাদী প্রতিবাদীর মােক্তার,

নাজীর চাপরাসি; আরদালি, রাইয়ত প্রভৃতি

দণ্ডায়মান।)

 প্র মােক্তার। অধীনের এই দরখাস্তের প্রার্থনা মঞ্জুর হয় (সেরেস্তাদারের হস্তে দরখাস্ত দান)—

 মাজি। আচ্ছ। পাঠ কর। (উড সাহেবের সহিত পরামর্শ এবং হাস্য)

 সেরেস্তা। (প্র মােক্তারের প্রতি) রামায়ণের পুথি লিখেছ যে, দরখাস্ত চুম্বক না হইলে কি সকল পড়া গিয়া থাকে? (দরখাস্তের পাত উল্‌টায়ন)

 মাজি। (উড সাহেবের সহিত কথােপকথনানন্তর হাস্য সম্বরণ করিয়া) খােলােসা পড়।

 সেরেস্তা। আসামির এবং আসামির মােক্তরের অনুপস্থিতিতে ফরিয়াদির সাক্ষী গণের সাক্ষ্য লওয়া হইয়াছে—প্রার্থনা ফরিয়াদির সাক্ষীগণকে পুনর্ব্বার হাজির আনা হয়।

 বা মোক্তার। ধর্ম্মাবতার। মোক্তারগণ মিথ্যা শঠতা প্রবঞ্চনায় রত বটে, অনায়াসে হলোপ করিয়া মিথ্যা বলে, মোক্তারেরা অবিরত অপকৃষ্ণ কার্য্যে রত, বিবাহিতা কামিনীকে বিসর্জ্জন দিয়া তাহারা তাহাদের অমরালয় বারমহিলালয়ে কাল যাপন করে, জমিদারেরা ফলতঃ মোক্তারগণকে বিশেষ ঘৃণা করে, তবে স্বকার্য্য সাধন হেতু তাহারদিগের ডাকে এবং বিছানায় বসিতে দেয়, ধর্মাবতার! মোক্তারগণের বৃত্তিই প্রতারণা। কিন্তু নীলকরের মোক্তারদিগের দ্বারা কোন রূপে কোন প্রতারণা হইতে পারে না। নীলকর সাহেবেরা খ্রীষ্টিয়ান—খ্রীষ্টিয়ান—ধর্ম্মে মিথ্যা অতি উৎকট পাপ বলিয়া গণ্য হইয়াছে; পরদ্রব্য অপহরণ, পরনারীগমন, নরহত্যা প্রভৃতি জঘন্য কার্য্য খ্রীষ্টিয়ান ধর্ম্মে অতিশয় ঘৃণিত, খ্রীষ্টিয়ান ধর্ম্মে অসৎ ধর্ম্ম নিষ্পন্ন করা দূরে থাক্‌, মনের ভিতরে অসৎ অভিসন্ধিকে স্থান দিলেই নরকানলে দগ্ধ হইতে হয়। করুণা, মার্জ্জনা, বিনয়, পরোপকার খ্রীষ্টিয়ান ধর্ম্মের প্রধান উদ্দেশ্য; এমন সত্য সনাতন ধর্ম্ম পরায়ণ নীলকরগণ কর্ত্তৃক মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া কখনই সম্ভবে না। ধর্ম্মাবতার! আমরা এই নীলকরের বেতন ভােগী মােক্তার, আমরা তাঁহাদিগের চরিত্র অনুসারে চরিত্র সংশােধন করিয়াছি, আমারদিগের ইচ্ছা হইলেও সাক্ষীকে তালিম দিতে সাহস হয় না, যেহেতুক সত্যপরায়ণ সাহেবেরা সূচাগ্রে চাকরের চাতুরী জানিতে পারিলে তাহার যথােচিত শাস্তি করেন। প্রতিবাদীর মানিত সাক্ষী কুটির আমীন মজ কুর তাহার এক দৃষ্টান্তের স্থল,—রাইয়াতকে বঞ্চিত করিয়া ছিল বলিয়া, দয়াশীল সাহেব উহাকে কর্ম্ম চ্যুত করিয়াছেন; এবং গােরিব ছাঁপােষা রাইয়তের ক্রন্দনে রােষপরবশ হইয়া প্রহারও করিয়াছেন।

 উড। (মাজিস্ট্রেটের প্রতি) এক্সট্রিম্ প্রােভাকেশান্, এক্সট্রিম্ প্রােভােকেশান্।

 বা মােক্তার। হুজুর! হুজুর হইতে আমার সাক্ষীগণের প্রতি অনেক সোয়াল হইয়াছিল, যদ্যপি তাহারা তালিমী সাক্ষী হইত, তবে সেই সােয়ালেই পড়িত; আইনকারকেরা বলিয়াছেন “বিচারকর্ত্তা আসামির আড ভােকেট্ স্বরূপ” সুতরাং আসামির পক্ষের যে সকল সােয়াল, তাহা হুজুর হইতেই হইয়াছে, অতএব সাক্ষীগণকে পুনর্ব্বার আনয়ন করিলে আসামির কিছুমাত্র উপকার দর্শাইবার সম্ভাবনা নাই, কিন্তু সাক্ষীগণের সমূহ ক্লেশ হইতে পারে। ধর্ম্মাবতার! সাক্ষীগণ চাসউপজীবী দীন প্রজা, তাহারা স্বহস্তে লাঙ্গল ধরিয়া স্ত্রী পুত্রের প্রতিপালন করে, তাহারদিগের সমস্ত দিবস ক্ষেত্রে না থাকিলে তাহারদিগের আবাদ ধ্বংস হইয়া যায়, বাড়ীতে ভাত খাইতে আইলে চাসের হানি হয় বলিয়া তাহারদের মেয়েরা গামছা করিয়া অন্ন ব্যঞ্জন ক্ষেত্রে লইয়া গিয়া তাহারদের খাওয়াইয়া আইসে। চাসাদিগের এক দিন ক্ষেত্র ছাড়িয়া আইলে সর্ব্বনাশ উপস্থিত হয়, এ সময়ে এত দূরস্থ জেলায় রাইয়ত দিগের তলর দিয়া আনিলে তাহারদিগের বৎসরের পরিশ্রম বিফল হয়; ধর্ম্মাবতার! ধর্ম্মাবতার যেমত বিচার করেন।

 মাজি। কিছু হেতুবাদ দেখা যায় না। (উডের সহিত পরামর্শ) আবশ্যক হইতেছে না।

 প্র মােক্তার। হুজুর! নীলকরের দাদন কোন গ্রামের কোন রাইয়তে স্বেচ্ছাধীন গ্রহণ করে না, আমীন্ খালাসীর সমভিব্যাহারে নীলকরসাহেব, অথবা তাঁহার দেওয়ান ঘােড়ায় চড়িয়া ময়দানে গমন পূর্ব্বক উত্তম উত্তম জমিতে কুটির মার্ক দিয়া রাইয়তদিগকে নীল করিতে হুকুম দিয়া আইসেন, পরে জমিয়াতের মালিকান রাইয়তদিগের কুটিতে ধরিয়া আনিয়া বেওরা ওয়ারি করিয়া দাদন লিখিয়া লয়নে। দাদন লইয়া রাইয়তেরা কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ী যায়, যে দিবস যে রাইয়ত দাদন লইয়া আইসে, সে দিবস সে রাইয়তের বাড়ীতে মরা কান্না পড়ে। নীলের দ্বারা দাদন পরিশােধ করিয়া ফাজিল পাওনা হইলেও রাইয়তদের নামে দাদনের বকেয়া বাকি বলিয়া খাতায় লেখা থাকে। এক বার দাদন লইলে রাইয়তেরা সাত পুরুষ ক্লেশ পায়। রাইয়তেরা নীল করিতে যে কাতর হয়, তাহা তাহারাই জানে, আর দীনরক্ষক পরমেশ্বর জানেন। রাইয়তেরা পাঁচ জন একত্রে বসিলেই পরস্পর নিজ নিজ দাদনের পরিচয় দেয় এবং ত্রাণের উপায় প্রস্তাব করে, তাহারদিগের সলা পরামর্শের আবশ্যক করে না, আপনারাই মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল। এমন রাইয়তে সাক্ষী দিয়া গেল যে, তাহারদিগের নীল করিতে ইচ্ছা ছিল, কেবল আমার মক্কেল তাহাদিগের পরামর্শ দিয়া এবং ভয় দেখাইয়া তাহাদের নীলের চাস রহিত করিয়াছেন, এ অতি আশ্চর্য্য এবং প্রত্যক্ষ প্রতারণা। ধর্ম্মাবতার! তাহারদিগের পুনর্ব্বার হুজুরে আনান হয়, অধীন দুই সােয়ালে তাহাদিগের মিথ্যা সাক্ষ্য প্রমাণ করিয়া দিবে। আমার মক্কেলের পুত্র নবীনমাধর বসু, করাল নীলকর নিশাচরের কর হইতে উপায়হীন চাসাদিগকে রক্ষা করিতে প্রাণপণে যত্ন করিয়া থাকেন, একথা স্বীকার করি এবং তিনি উড সাহেবের দৌরাত্ম্য নিবারণ করিতে অনেকবার সফলও হইয়াছেন, তাহা পলাশপূর জ্বালান মােকদ্দমার নথিতে প্রকাশ আছে। কিন্তু আমার মক্কেল গোলােকচন্দ্র বসু অতি নিরীহ মনুষ্য; নীলকর সাহেবদের ব্যাঘ্র অপেক্ষা ভয় করে, কোন গােলের মধ্যে থাকে না, কখন কাহারাে মন্দ করে না, কাহাকে মন্দ হইতে উদ্ধার করিতেও সাহসী হয় না, ধর্ম্মাবতার! গােলােকচন্দ্র বসু যে সুচরিত্রের লােক, তাহা জেলার সকল লোকে জানে, আমলাদিগের জিজ্ঞাসা হইলে প্রকাশ হইতে পারে—

 গেলােক। বিচারপতি! আমার গত বৎসরের নীলের টাকা চুক্‌য়ে দিলেন না, তবু আমি ফৌজদারির ভয়েতে ৬০ বিঘা নীলের দাদন লইতে চাহিয়াছিলাম। বড় বাবু বলিলেন “পিতা! আমারদিগের অন্য আয় আছে, এক বৎসর কিম্বা দুই বৎসরের নীলের লােক্‌সানে কেবল ক্রিয়া কলাপ্‌ই বন্দ হবে, একেবারে অন্নাভাব হবে না, কিন্তু যাহাদের লাঙ্গলের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর, তাহাদের উপায় কি? আমরা এই হারে নীল করিলে সকলেরি তাই করিতে হইবে।” বড় বাবু একথা বিজ্ঞের মত বলিলেন, আমি কাযে কাযেই বলিলাম তবে সাহেবের হাতে পায় ধরে ৫০ বিঘায় রাজি করগে। সাহেব হাঁ না কিছুই বলিলেন না, গােপনে গােপনে আমাকে এই বৃদ্ধ দশায় জেলে দেবার যোগাড় করিলেন। আমি জানি, সাহেবদিগের রাজি রাখিতে পারিলেই মঙ্গল। সাহেবদের হাকিম ভাই ব্রাদার; সাহেবদের অমতে চলিতে আছে? আমাকে খালাস দেন, আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যদিও হাল গােরু অভাবে নীল করিতে না পারি, বৎসর বৎসর সহেবকে এক শত টাকা নীলের বদলে দিব। আমি কি রাইয়তদের শেখাইবার মানুষ? আমার সঙ্গে কি তাহাদের দেখা হয়?

 প্র মােক্তার। ধর্ম্মাবতার! যে ৪ জন রাইয়ত সাক্ষ্য দিয়াছে, তাহার এক জন টিকিরি, তার কোন পুরুষে লাঙ্গল নাই, তার জমি নাই, জমা নাই, গোরু নাই, গোয়ালঘর নাই, সারে জমিনে তদারক্ হইলে প্রকাশ হইবে। কানাই তরফদার ভিন্ন গ্রামের রাইয়ত, তাহার সহিত আমার মক্কেলের কখন দেখা নাই, সে ব্যক্তি সেনাক্ত করিতে অশক্ত। এই এই কারণে আমি তাহারদের পুনর্ব্বার কোর্টে আনয়নের প্রার্থনা করি— ব্যবস্থা-কর্ত্তারা লিখিয়াছেন, নিষ্পত্তির অর্থে আসামিকে সকল প্রকার উপায়ের পন্থা দেওয়া কর্ত্তব্য। ধর্ম্মাবতার, আমার এই প্রার্থনা মঞ্জুর করিলে আমার মনে আক্ষেপ থাকে না।

 বা মোক্তার। হুজর—

 মাজি। (লিপি লিখন) বল, বল, আমি কর্ণ দিয়া লিখিতেছি না।

 বা মোক্তার। হুজুর! এসময় রাইয়তগণকে কষ্ট দিয়া জেলায় আনিলে তাহাদের প্রচুর ক্ষতি হয়, নচেৎ আমিও প্রার্থনা করি সাক্ষীদিগকে আনান হয়, যেহেতু সোয়ালের কৌশলে আসামীর সাব্যস্ত অপরাধ আরো সাব্যস্ত হইতে পারে। ধর্ম্মাবতার! গোলোক বসের কুচরিত্রের কথা দেশ বিদেশ রাষ্ট আছে; যে উপকার করে, তাহারই অপকার করে। অপার সমুদ্র লঙ্ঘন করিয়া নীলকরেরা এদেশে আসিয়া গুপ্তনিধি বাহির করিয়া দেশের মঙ্গল করিতেছেন, রাজকোষের ধন বৃদ্ধি করিতেছেন এবং আপনারা উপকৃত হইতেছেন। এমত মহাপুরুষদিগের মহৎ কার্য্যে যে ব্যক্তি বিরুদ্ধাচরণ করে, তাহার কারাগার ভিন্ন আর স্থান কোথায়?

 মাজি। (লিপির শিরোনাম লিখন) চাপরাসি।

 চাপ। খোদাবন্দ্।

(সাহেবের নিকট গমন।)

 মাজি। (উডের সহিত পরামর্শ) বিবিউড্‌কা পাস দেও-খানসামাকো বোলো, বাহারকা সাহেবলোক্ আজ্ জাগা নেই।

 সেরেস্তা। হুজুর! কি হুকুম লেখা যায়।

 মাজি। নথির সামিল থাকে।

 সেরেস্তা। (লিখন) হুকুম হইল যে নথির সামিল থাকে। (মাজিষ্ট্রেটের দস্তখৎ) ধর্ম্মাবতার! আসামীর জবাবের হুকুমে হুজুরের দস্তখৎ হয় নাই—

 মাজি। পাঠ কর।

 সেরেস্তা। হুকুম হইল যে অসামীর নিকট হইতে ২০০ শত টাকা তাইনে দুই জন জামিন লওয়া হয় এবং সাফাই সাক্ষীদিগের নামে রীতিমত সফিনা জারী হয়।

(মাজিস্ট্রেটের দস্তখৎ।)

 মাজি। মিরগাঁর ডাকাতি মোকদ্দমা কাল পেস্‌ কর।

(মাজিস্ট্রেট, উড, রোগ, চাপরাসি ও
আরদালীর প্রস্থান)

 সেরেস্তা। নাজির মহাশয়! রীতিমত জামানত্‌নামা লেখাপড়া করিয়া নাও।

(সেরস্তাদার, পেস্কার, বাদীর মোক্তার ও
রাইয়তগণের প্রস্থান)

 নাজির। (প্রতিবাদীর মোক্তারের প্রতি) অদ্য সন্ধ্যাকালে জামানত্‌নামা লেখা পড়া কিরূপে হইতে পারে, বিশেষ আমি কিছু ব্যস্ত আছি—

 প্র মোক্তার। নাম্‌টা খুব বড় বটে, কিন্তু কিছু নাই (নাজিরের সহিত পরামর্শ) গহনা বিক্রী করিয়া এই টাকা দিতে হইবে।

 নাজির। আমার তালুকও নাই, ব্যবসাও নাই, আবাদও নাই; এই উপজীবিকা। কেবল তোমার খাতিরে এক শত টাকায় রাজি হওয়া। চল আমার বাসায় যাইতে হইবে। দেওয়ান্‌জি ভায়া না শোনেন, ওঁদের পূজা আলাহিদা হয়েছে কি না?

(সকলের প্রস্থান)

চতুর্থ অঙ্ক।

দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক।

ইন্দ্রাবাদ, বিন্দুমাধবের বাসাবাড়ী।

(নবীনমাধব, বিন্দুমাধব এবং সাধূচরণ আসীন)

 নবীন। আমার কাযে কাযেই বাড়ী যাইতে হইল। এ সংবাদ জননী শুনিবামাত্র প্রাণত্যাগ করিবেন। বিন্দু! তোমারে আর বল্‌বো কি; দেখ, পিতা যেন কোনমতে ক্লেশ না পান। বাস পরিত্যাগ করা স্থির করিয়াছি, সর্ব্বস্ব বিক্রয় করিয়া আমি টাকা পাঠাইয়া দিব, যে যত টাকা চাহিবে তাহাকে তাহাই দিবা।

 বিন্দু। জেল্‌দারগা টাকার প্রয়াসী নহে, মাজিষ্ট্রেট্ সাহেবের ভয়ে পাচক ব্রাহ্মণ লইয়া যাইতে দিতেছে না।

 নবীন। টাকাও দেও মিনতিও কর। আহা! বৃদ্ধশরীর! তিন দিন অনাহার! এত বুঝাইলাম, এত মিনতি করিলাম—বলেন “নবীন! তিন দিন গত হইলে আহার করি না করি বিবেচনা করিব, তিন দিনের মধ্যে এ পাপ মুখে কিছু মাত্র দিব না।”

 বিন্দু। কিরূপে পিতার উদরে দুটি অন্ন দিব তাহার কিছুই উপায় দেখিতেছি না। নীলকরক্রীতদাস মূঢ়মতি মাজিষ্ট্রেটের মুখ হইতে নিষ্ঠুর কারাবাসানুমতি নিঃসৃত হওয়াবধি পিতা যে, চক্ষে হস্ত দিয়াছেন তাহা এখন পর্য্যন্ত নামাইলেন না। পিতার নয়নজলে হস্ত ভাসমান হইয়াছে, যে স্থানে প্রথম বসাইয়াছিলাম সেই স্থানেই উপবিষ্ট আছেন। নীরব, শীর্ণ-কলেবর, স্পন্দহীন, মৃতকপোতবৎ কারাগারপিঞ্জরে পতিত আছেন। আজ্ চার দিন, আজ্ তাঁহাকে অবশ্যই আহার করাইব। আপনি বাড়ী যান, আমি প্রত্যহ পত্র প্রেরণ করিব।

 নবীন। বিধাতঃ! পিতাকে কি কষ্টই দিতেছ। বিন্দু তােমাকে রাত্র দিন জেলে থাকিতে দেয়, তাহা হইলেই আমি নিশ্চিন্ত হইয়া বাড়ী যাইতে পারি।

 সাধু। আমি চুরি করি, আপনারা আমাকে চোর বলে ধরে দেন, আমি একরার করিব, তা হলেই আমাকে জেলে দেবে, আমি সেখানে কর্ত্তা মহাশয়ের চাকর হয়ে থাকিব।

 নবীন। সাধু! তুমি এমনি সাধুই বট। আহা! ক্ষেত্রমণির সাংঘাতিক পীড়ার সমাচারে তুমি যে ব্যাকুল, তােমাকে যত শীঘ্র বাড়ী লইয়া যাইতে পারি ততই ভাল।

 সাধু। (দীর্ঘ নিশ্বাস) বড় বাবু! মাকে গিয়ে কি দেখিতে পাব? আমার যে আর নাই।

 বিন্দু। তােমাকে যে আরোক্ দিয়াছি, উহা খাওয়াইলে অবশ্যই নির্ব্ব্যাধি হইবে, ডাক্তার বাবু আদ্যোপান্ত শ্রবণ করে ঐ ঔষধ দিয়াছেন।

(ডেপুটি ইনিস্পেক্‌টারের প্রবেশ)

 ডেপু। বিন্দুবাবু! আপনার পিতার খালাসের জন্য কমিসনর সাহেব বিশেষ করিয়া লিখিয়াছেন।

 বিন্দু। লেফ্‌টেনাণ্ট গবর্ণর নিষ্কৃতি দিবেন সন্দেহ নাই।

 নবীন। নিষ্কৃতির সমাচার কতদিনে আসিতে পারে?

 বিন্দু। পোনের দিবসের অধিক হইবে না।

 ডেপু। অমর নগরের আসিস্‌টাণ্ট মাজিস্ট্রেট এক জন মোক্তারকে এই আইনে ৬ মাস ফাটক দিয়াছিল, তাহার ১৬ দিন জেলে থাকিতে হয়।

 নবীন। এমন দিন কি হবে, গবর্ণর সাহেব অনুকূল হইয়া প্রতিকূল মাজিষ্ট্রেটের নিকৃষ্ট নিষ্পত্তি খণ্ডন করিবেন?

 বিন্দু। জগদীশ্বর আছেন, অবশ্যই করিবেন। আপনি যাত্রা করুন, অনেক দূর যাইতে হইবে।

(নবীনমাধব, বিন্দুমাধব ও সাধুচরণের প্রস্থান)

 ডেপু। আহা! দুই ভাই দুঃখে দগ্ধ হইয়া জীবন্মৃত হইয়াছেন। লেফ্‌টেনাণ্ট গবর্ণরের নিষ্কৃতি অনুমতি সহোদরদ্বয়ের মৃতদেহ পুনর্জীবিত করিবে। নবীন বাবু অতি বীর পুরুষ, পরোপকারী, বদান্য, বিদ্যোৎসাহী, দেশহিতৈষী; কিন্তু নির্দ্দয় নীলকর কুজ্‌ঝটিকায় নবীন বাবুর সদ্ গুণ সমূহ মকুলেই ম্রীয়মান হইল।

(কালেজের পণ্ডিতের প্রবেশ)

অস তে আজ্ঞা হয়।

 পণ্ডিত। স্বভাবতঃ শরীর আমার কিঞ্চিৎ উষ্ণ, রৌদ্র সহ্য হয় না। চৈত্র বৈশাখ মাসে আতপতাপে উন্মত্ত হইয়া উঠি। কয়েক দিন শিরঃপীড়ায় সাতিশয় কাতর, বিন্দুমাধবের বিষম বিপদের সময় এক বার আসিতে পারি নাই।

 ডেপু। বিষ্ণুতৈলে আপনার উপকার দর্শিতে পারে। বিষ্ণু বাবুর জন্য বিষ্ণুতৈল প্রস্তুত করা গিয়াছে, আপনার বাসায় আমি কল্য কিঞ্চিৎ প্রেরণ করিব।

 পণ্ডিত। বড় বাধিত হলেম। ছেলে পড়ালে সহজ মানুষ পাগল হয়, আমার তাহাতে এই শরীর।

 ডেপু। বড় পণ্ডিত মহাশয়কে আর যে দেখিতে পাইনে?

 পণ্ডিত। তিনি এ স্ববৃত্তি ত্যাগ করিবার পন্থা করিতেছেন—সোণার চাঁদ ছেলে উপার্জ্জন করিতেছে, তাঁহার সংসার রাজার মত নির্ব্বাহ হইবে। বিশেষ বৃষকাষ্ঠ গলায় বন্ধন করে কালেজে যাওয়া আসা ভাল দেখায় না, বয়স্ তো কম্ হয় নাই।

(বিন্দুমাধবের পুনঃ প্রবেশ।)

 বিন্দু। পণ্ডিত মহাশয় এসেছেন—

 পণ্ডিত। পাপাত্মা এমত অবিচার করেছে। তোমরা শুনিতে পাও না, বড় দিনের সময় ঐ কুটিতে একাদিক্রমে দশ দিবস যাপন করে আসিয়াছে। উহার কাছে প্রজার বিচার! কাজির কাছে হিন্দুর পরোব।

 বিন্দু। বিধাতার নির্ব্বন্ধ।

 পণ্ডিত। মোক্তার দিয়াছিলে কাহাকে?

 বিন্দু। প্রাণধন মল্লিককে।

 পণ্ডতি। ওকেও মোক্তীরনামা দেয়? অপর কোন ব্যক্তিকে দিলে উপকার দর্শিত; সকল দেবতাঁই সমান, ঠক্‌ বাচতে গা ঁউজোর

 বিন্দু। কমিসনর সাহেব পিতার নিষ্কৃতির জন্য গবর্ণমেণ্টে রিপোর্ট করিয়াছেন।

 পণ্ডিত। “এক ভন্ম আর ছার, দোষগুণ কব কার”। যেমন মাজিষ্ট্রেটে তেমনি কমিসনার।

 বিন্দু। মহাশয় কমিসনারকে বিশেষ জানেন না, তাহাই একথা বলিতেছেন। কমিসনার সাহেব অতি নিরপেক্ষ, নেটিবদের উন্নতি আকাংক্ষী।

 পণ্ডিত। যাহা হউক, এক্ষণ ভগবানের আনুকূল্যে তােমার পিতার উদ্ধার হইলেই সকল মঙ্গল। জেলে কি অবস্থায় আছেন?

 বিন্দু। সর্বদা রােদন করিতেছেন এবং গত তিন দিন কিছু মাত্র আহার করেন নাই। আমি এখনি জেলে যাইব, আর এই সুসংবাদ বলিয়া তাঁহার চিত্ত বিনােদ করিব।

(এক জন চাপরাসির প্রবেশ)

 তুমি জেলের চাপরাসি না?

 চাপ। মশাই এট্টু জলদি করে জেলে আসেন। দারগা ডেকেচেন।

 বিন্দু। আমার বাবাকে তুমি আজ দেখেছ?

 চাপ। আপনি আসেন। আমি কিছু বল্তি পারিনে

 বিন্দু। চল বাপু। (পণ্ডিতের প্রতি) বড় ভাল বােধ হইতেছে না, আমি চলিলাম।

(চাপরাসি ও বিন্দুমাধবের প্রস্থান)

 পণ্ডিত। চল আমরাও জেলে যাই, বোধ হয় কোন মন্দ ঘটনা হইয়া থাকিবে।

(উভয়ের প্রস্থান)

চতুর্থ অঙ্ক।

তৃতীয় গর্ভাঙ্ক।

ইন্দ্রাবাদের জেলখানা।

(গোলোক চন্দ্রের মৃত দেহ উড়ানি পাকান দড়িতে দোদুল্যমান, জেল দারগা এবং জমাদার আসীন)

 দার। বিন্দুমাধব বাবুকে কে ডাকিতে গিয়াছে?

 জমা। মনিরদ্দি গিয়েছে। ডাক্তার সাহেব এলে তো নাবান হইতে পারে না।

 দার। মাজিষ্ট্রেট সাহেবের আজ্ আসিবার কথা আছে না?

 জমা। আজ্ঞে না; তাঁর আর চার্ দিন্ হবে। শনিবারে শচীগঞ্জের কুটিতে সাহেবদের সামপিন্ পার্টি আছে, বিবিদের নাচ হবে। উড সাহেবের বিবি আমারদিগের সাহেবের সঙ্গে নইলে নাচিতে পারেন না, আমি যখন আরদালি ছিলাম দেখিয়াছি। উড সাহেবের বিবিরি খুব দয়া, এক খান চিটীতে এ গোরিবকে জেলের জমাদ্দার করিয়া দিয়াছেন।

 দার। আহা! বিন্দুবাবু পিতা আহার করেন নাই বলিয়া কত বিলাপ করিয়াছেন; এ দশা দেখলে প্রাণ ত্যাগ করিবেন।

(বিন্দুমাধবের প্রবেশ)

সকলি পরমেশ্বরের ইচ্ছা।

 বিন্দু। একি, একি, আহা, আহা! পিতার উদ্বন্ধনে মৃত্যু হইয়াছে! আমি যে পিতার মুক্তির সম্ভাবনা ব্যক্ত করিতে আসিতেছি, কি মনস্তাপ! (নিজ মুস্তক গোলোকের বক্ষে রক্ষা করিয়া মৃত দেহ আলিঙ্গন পূর্ব্বক ক্রন্দন) পিতা আমাদিগের মায়া একেবারে পরিত্যাগ করিলেন! বিন্দুমাধবের ইংরাজী বিদ্যার গৌরব আর লোকের কাছে করবেন না? নবীনমাধবকে “স্বরপুর বৃকোদর” বলা শেষ হইল? বড় বধূকে “আমার মা, আমার মা,” বলিয়া বিপিনের সহিত যে আনন্দবিবাদ তাহার সন্ধি করিলেন! হা! আহারান্বেষণে ভ্রমনকারী বকদম্পতির মধ্যে বক ব্যাধ কর্ত্তৃক হত হইলে শাবক বেষ্টিত বকপত্নী যেমন সঙ্কটে পড়ে, জননী আমার তোমার উদ্বন্ধন সংবাদে সেই রূপ হইবেন—

 দার। (হস্ত ধরিয়া বিন্দুমাধবকে অন্তরে আনিয়া) বিন্দু বাবু! এখন এত অধীর হইবেন না। ডাক্তার সাহেবের অনুমতি লইয়া সত্বরে অমৃতঘাটের ঘাটে লইয়া যাইবার উদ্যোগ করুন।

(ডিপুটি ইনস্পেক্টার এবং পণ্ডিতের প্রবেশ)

 বিন্দু। দারগা মহাশয়! আমাকে কিছু বলবেন না। যে পরামর্শ উচিত হয় পণ্ডিত মহাশয় এবং ডেপুটি বাবুর সহিত করুন, আমার শোক বিকারে বাক্য রোধ হইয়াছে, আমি জন্মের মত একবার পিতার চরণ বক্ষে ধারণ করিয়া বসি।

(গোলোকের চরণ বক্ষে ধারণ পুর্ব্বক উপবিষ্ট)

 পণ্ডিত। (ডেপুটি ইনস্পেক্টারের প্রতি) আমি বিন্দ মাধবকে ক্রোড়ে করিয়া রাখি, তুমি বন্ধন উন্মোচন কর—এ দেবশরীর, এ নরকে ক্ষণকালও রাখা নয়।

 দার। মহাশয়! কিঞ্চিৎ কাল কাল অপেক্ষা করিতে হইবে—

 পণ্ডিত। আপনি বুঝি নরকের দ্বারপাল? নতুবা এমত স্বভাব হইবে কেন।

 দার। আপনি বিজ্ঞ, আমাকে অন্যায় ভর্ৎসনা করিতেছেন—

(ডাক্তার সাহেবের প্রবেশ)

 ডাক্তার। হো, হো, বিন্দুমাধব! গড্স উইল—পণ্ডিত মহাশয় আসিয়াছেন, বিন্দুকে কালেজ ছাড়া হয় না।

 পণ্ডিত। কালেজ ছাড়া বিধি হয় না।

 বিন্দু। আমাদের বিষয় আশয় সব গিয়াছে, অবশেষে পিতা আমাদিগকে পথের ভিখারি করিয়া লােকান্তর গমন করিলেন (ক্রন্দন) অধ্যয়ন আর কি রূপে সম্ভবে।

 পণ্ডিত। নীলকর সাহেবেরা বিন্দুমাধবদিগের সর্বস্ব লইয়াছে—

 ডাক্তার। পাদরি সাহেবদের মুখে আমি প্লাণ্টার সাহেবদের কথা শুনিয়াছি এবং আমিও দেখিল। আমি মাতঙ্গ নগরের কুটি হইতে আসিল, একটি গ্রামে বসিয়াছে, আমার পাল্কির নিকট দিয়া দুই জন রাইয়ত বাজারে যাইল, একজনের হস্তে দুগ্দো আছে, আমি দুগ্‌দো কিনিতে চাহিল, এক রাইয়ত এক রাইয়তকে বলিল, নীলমাম্‌দো নীলমাম্‌দো” দুগ্‌দো রাখিয়া দৌড় দিল। আমি আর একজন রাইয়তকে জিজ্ঞাসা করিল, সে কহিল, রাইয়ত দুইজন দাদনের ভয়ে পলাইয়াছে। আমি দাদন লইয়াছি আমার গুদামে যাইতে কি কারণ হইতে পারে। আমি বুঝিলাম আমাকে প্লাণ্টার লইয়াছে। রাইয়তের হস্তে দুগ্‌দো দিয়া আমি গমন করিল।

 ডেপু। ভ্যালিসাহেবের কান্সারণের এক গ্রাম দিয়া পাদরি সাহেব যাইতেছিলেন। রাইয়তেরা তাঁহাকে দেখিয়া “নীলভূত বেরিয়াছে, নীলভূত বেরিয়াছে” বলিয়া রাস্তা ছাড়িয়া স্ব স্ব গৃহে পলায়ন করিয়াছিল। কিন্তু ক্রমশঃ পাদরি সাহেবের বদান্যতা, বিনয় এবং ক্ষমা দর্শন করিয়া রাইয়তেরা বিস্ময়াপন্ন হইল এবং নীলকর পীড়নাতুর প্রজাপুঞ্জের দুঃখে পাদরি সাহেব যত আন্তরিক বেদনা প্রকাশ করিতে লাগিলেন, তাহারা তাঁহাকে তত ভক্তি করিতে লাগিল। এক্ষণ রাইয়তের পরম্পর বলাবলি করে “এক ঝাডের বাঁশ বটে—কোন খানায় দুর্গা-ঠাকুরুণের কাঠাম, কোন খানায় হাড়ির ঝুড়ি।”

 পণ্ডিত। আমরা মৃত শরীরটি লইয়া যাই।

 ডাক্তার। কিঞ্চিৎ দেখিতে হইবে। আপনারা বাহিরে আনিতে পারেন।

(বিন্দুমাধব এবং ডেপুটি ইনস্পেক্টার বন্ধন
মোচন পূর্ব্বক মৃত দেহ লইয়া যাওন
এবং সকলের প্রস্থান)