নীল-দর্পণ নাটক/তৃতীয় অঙ্ক
তৃতীয় অঙ্ক।
প্রথম গর্ভাঙ্ক।
বেগুন বেড়ের কুটির দপ্তরখানার সন্মুখ।
(গোপীনাথ ও এক খালাসীর প্রবেশ)
গোপী। তােদের ভাগে কম্ না পড়িলেতো আমার কাণে কোন কথা তুলিস্নে।
খালাসী। ও গু কি অ্যাকা খ্যায়ে হজোম করা যায়? মুই বল্লাম, যদি খাবা, তবে দেওয়ানজিরি দিয়ে খাও, তা বল্লে “তোর দেওয়ানের মুরদ বড়, এত আর সে ক্যাওটের পুত নয়, যে সাহেবেরে বাঁদর খ্যালয়ে নে বেড়াবে,
গােপী। আচ্ছা। তুই এখন যা, কায়েতবাচ্ছা কেমন মুগুর তা আমি দেখাব।
ছােটসাহেবের জোরে ব্যাটার এত জোর। বোনাই যদি মনিব হয়, তবে কর্ম্ম করিতে বড়সুখ, ও কথাও বলবাে —বড়সাহেব ওকথায় আগুণ হয়, কিন্তু ব্যাটা আমার উপর ভারি চটা, আমারে কথায় কথায় শ্যামচাঁদ দেখায়। সে দিন মোজা সহিত লাতি মার্লে। কয়েক দিন কিছু ভাল ভাল দেখিতেছি। গোলােক বসের তলব হওয়া অবধি আমার প্রতি সদয় হইয়াছে। লােকের সর্ব্বনাশ করিতে পারিলেই সাহেবের কাছে পটু হওয়া যায়। “শত মারী ভবেৎ বৈদ্যঃ” (উড কে দর্শন করিয়া) এই যে আসিতেছেন, বসেদের কথা বলিয়া অগ্রে মন নরম করি।
(উডের প্রবেশ।)
ধর্ম্মাবতার, নবীন বসের চক্ষে এই বার জল বাহির হইয়াছে। বেটার এমন শাসন কিছুতেই হয় নাই! বেটার বাগান বাহির করিয়া লওয়া গিয়াছে, গাঁতি গদাই পােদ্কে পাটা করিয়া দেওয়া গিয়াছে, আবাদ এক প্রকার রহিত করা গিয়াছে, বেটার গোলা সব খালি পড়ে রহিয়াছে, বেটাকে দুই বার ফৌজদারিতে সােপর্দ্দ করা গিয়াছে, এত ক্লেশেও বেটা খাড়া ছিল, এই বারে একবারে পতন হইয়াছে।
উড। শালা শামনগরে কিছু কত্তে পারিনি।
গােপী। হুজুর, মুন্সিরে ওর কাছে এসেছিল, তা বেটা বল্লে “আমার মন স্থির নাই, পিতার ক্রন্দনে অঙ্গ অবশ হইয়াছে, আমারে ঘােল বলাইয়াছে।” নবীন বসের দুর্গতি দেখে শ্যামনগরের ৭।৮ ঘর প্রজা ফেরার হইয়াছে, আর সকলে হুজর যেমন হুকুম দিয়াছেন তেমনি করিতেছে।
উড। তুমি আচ্ছা দেওয়ান আছে, ভাল মত লব বার করেছিলে।
গােপী। আমি জান্তাম গােলােক বস্ বড় ভীত মানুষ, ফৌজদারীতে যাইতে হইলে পাগল হইবে। নবীন বসের যেমন পিতৃভক্তি তাহা হইলে বেটা কাযে কাযেই শাসিত হইবে, এই জন্যে বুড়ােকে আসামী করিতে বল্লাম, হুজর যে কৌশল বাহির করিয়াছেন তাহাও মন্দ নয়, বেটার স্করিপুণীর পাড়ে চার দেওয়া হইরাছে, উহার অন্তঃকরণে সাপের ডিম পড়িয়াছে।
উড। এক পাথরে দুই পক্ষী মরিল, দশ বিঘা নীল হইল, বাঞ্চতের মনে দুঃখ হইল। শালা বড় কাঁদাকার্টি করেছিল, বলে পুকুরে নীল হইলে আমার বাস উঠিবে, আমি জবাব দিয়াছি ভিটা জমতে নীল বড় ভাল হয়।
গোপী। ঐ জবাব পেয়ে বেটা নালিস করিয়াছে।
উড। মোকদ্দমা কিছু হইবে না, এ মাজিষ্ট্রেট বড় ভাল লোক আছে। দেওয়ানী কর্লে পাঁচ বচোরে মোকদ্দমা শেষ হবে না। মাজিষ্ট্রেট আমার বড় দোস্ত! দেখ তোমার সাক্ষী মাটোব্বর করে নটুন আইনে চার বজ্জাট্কে ফাটক দিয়াছে; এই আইনটা শ্যামচাঁদের দাদা হইয়াছে।
গোপী। ধর্ম্মাবতার, নবীন বস্ ঐ চারি জন রাইয়তের ফসল লোকসান হবে বলিয়া আপনার লাঙ্গন গোরু মাইন্দার দিয়া তাহাদের জমি চসিয়া দিতেছে এবং উহাদিগের পরিবারদিগের যাহাতে ক্লেশ না হয় তাহারি চেষ্টা করিতেছে।
উড। শালা দাদনের জমি চসিতে হইলে বলে আমার লাঙ্গল গোরু কমে গিয়েছে; বাঞ্চত্ বড় বজ্জাত, আচ্ছ। জব্দ হইয়াছে। দেওয়ান তুমি আচ্ছা কাম করিয়াছ, তোম্ছে কাম বেহেতার চলেগা।
গোপী। ধর্ম্মাবতারের অনুগ্রহ। আমার মানস বৎসর বৎসর দাদন বৃদ্ধি করি; এ কর্ম্ম একা করিবার নয়, ইহাতে বিশ্বাসী আমীন খালাসী আবশ্যক করে; যে ব্যক্তি দুটাকার জন্য হুজুরের ৩ বিঘা নীল লোক্সান করে, তার দ্বারা কর্ম্মের উন্নতি হয়?
উড। আমি সমজিয়াছি, আমীন শালা গোলমাল করিয়াছে।
গোপী। হুজুর, চন্দ্র গোল দারের এখানে নূতন বাস, দাদন কিছু রাখে না; আমীন উহার উঠানে রীতিমত এক টাকা দাদন বলিয়া ফেলিয়া দেয়, টাকাটি ফেরত দিবার জন্যে অনেক কাঁদাকাটি করে, এবং মিনতি করিতে করিতে রথ তলা পর্য্যন্ত আমীনের সঙ্গে আইসে, রথতলায় নীলকণ্ঠ বাবুর সহিত সাক্ষাৎ হয়, যিনি কালেজ হইতে একেবারে উকীল হইয়া বাহির হইয়াছেন।
উড। আমি ওকে জানি, ঐ বাঞ্চত্ আমার কথা খবরের কাগজে লিখিয়া দেয়।
গােপী। আপনাদের কাগজের কাছে উহাদের কাগজ দাঁড়াইতে পারে না, তুলনা হয় না, ঢাকাই জালার কাছে ঠাণ্ডাজলের কুঁজো। কিন্তু সংবাদ পত্রটি হস্তগত করিতে হুজুরদিগের অনেক ব্যয় হইয়াছে, যেমন সময়,
“সময় গুণে আপ্ত পর।
খোঁড়া গাধা ঘােড়ার দর॥”
নীলকণ্ঠ বাবু আমীনকে অনেক ভর্ৎসনা করেন, আমীন তাহাতে লজ্জিত হইয়া গােলদারের বাড়ী ফিরিয়া গিয়া দুই টাকার সহিত দাদনের টাকাটি ফেরত্ লইয়া আসিয়াছে! চন্দ্র গােলদার সয়তান, ৩।৪ বিঘা নীল অনায়াসে দিতে পারিত এই কি চাকরের কায? আমি দেওয়ানি আমিনি দুই করিতে পারি তবেই এসব নিমক্হারামী রহিত হয়।
উড। বড় বজ্জাতি, ছাফ্ নেমক্হারামী
গােপী। ধর্ম্মাবতার, বেয়াদবি মাফ্ হয়— আমীন আপনার ভগিনীকে ছােট সাহেবের কামরায় আনিয়াছিল।
উড। হাঁ হাঁ আমি জানি, ঐ বাঞ্চত্ আর পডী ময়রাণী ছােট সাহেবকে খারাপ করিয়াছে। বজ্জাত কো হাম্ জরূর শেখ লায়েঙ্গে, বাঞ্চত কো হামারা বট নেকা ঘরমে ভেজ ডেয়।
গোপী। দেখ দেখি বাবা কার হাতে বাঁদোর ভাল খেলে। কায়েত ধূর্ত্ত আর কাক ধূর্ত্ত।
ঠেকিয়াছ এই বার কায়েতের ঘায়।
বানাই বাবার বাবা হার মেনে যায়।
তৃতীয় অঙ্ক।
দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক।
নবীন মাধবের শয়নঘর।
(নবীন মাধব এবং সৈরিন্ধ্রী আসীন)
সৈরিন্ধ্রী। প্রাণনাথ, অলঙ্কার আগে না শ্বশুর আগে— তুমি যে জন্যে দিবা নিশি ভ্রমণ করে বেড়াইতেছ, যে জন্যে তুমি আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়াছি; যে জন্যে তোমার চক্ষু হইতে অবিরল জলধারা পড়িতেছে, যে জন্যে তোমার প্রফুল্ল বদন বিষণ্ণ হইয়াছে, যে জন্য তোমার শিরঃপীড়া জন্মিয়াছে, হে নাথ! আমি সেই জন্যে কি অকিঞ্চিৎকর আভরণ গুলিন দিতে পারি নে?
নবীন। প্রিয়সি, তুমি অনায়াসে দিতে পার কিন্তু আমি কোন্ মুখে লই। কামিনীকে অলঙ্কারে বিভূষিতা করিতে পতির কত কষ্ট, বেগবতী নদীতে সন্তরণ, ভীষণ সমুদ্রে নিমজ্জন, যুদ্ধে প্রবেশ, পর্ব্বতে আরােহণ, অরণ্যে বাস, ব্যাঘ্রের মুখে গমন,—পতি এত ক্লেশে পত্নীকে ভূষিত করে, আমি কি এমন মূঢ়, সেই পত্নীর ভূষণ হরণ করিব। পঙ্কজনয়নে, অপেক্ষা কর। আজ দেখি যদি নিতান্তই টাকার সুযােগ করিতে না পারি তবে কল্যতােমার অলঙ্কার গ্রহণ করিব।
সৈরিন্ধ্রী। হৃদয়বল্লভ! আমাদের অতি দুঃসময়, এখন কে তােমাকে পাঁচ শত টাকা বিশ্বাস করে ধার দেবে? আমি পুনর্ব্বার মিনতি করিতেছি, আমার আর ছােট বয়ের গহনা পোদ্দারের বাড়ীতে রেখে টাকার যােগাড় কর, তােমার ক্লেশ দেখে সােণার কমল ছােট বউ আমার মলীন হয়েছে।
নবীন। আহা! বিধুমুখি! কি নিদারুণ কথা বলিলে, আমার অন্তঃকরণে যেন অগ্নিবান প্রবেশ করিল—ছােট বধূমাতা আমার বালিকা, উত্তম বসন, উত্তম অলঙ্কারেই তাঁর অমেদ, তাঁর জ্ঞান কি, তিনি সংসারের বার্ত্তা কি বুঝেছেন, কৌতুকছলে বিপিনের গলার হার কেড়ে লইলে বিপিন যেমন ক্রন্দন করে, বধূমাতার অলঙ্কার লইলে তেমনি রােদন করবেন। হা ঈশ্বর! আমাকে এমন কাপুরুষ করিলে! আমি এমন নির্দ্দয় দস্যু হইলাম। আমি বালিকাকে বঞ্চিত করিব? জীবন থাকিতে হইবেনা—নরাধম নিষ্ঠুর নীলকরেও এমন কর্ম্ম করিতে পারে না—প্রণয়িনি! এমন কথা আর মুখে আনিও না।
সৈরি। জীবনকান্ত, আমি যে কষ্টে ও নিদারুণ কথা বলিয়াছি তাহা আমিই জানি আর সর্ব্বান্তর্যামী পরমেশ্বরই জানেন, ও অগ্নিবান তার সন্দেহ কি — আমার অন্তঃকরণ বিদীর্ণ করেছে, জিহ্বা দগ্ধ করেছে, পরে ওষ্ঠ ভেদ করে তােমার অন্তঃকরণে প্রবেশ করিয়াছে—প্রাণনাথ! বড় যন্ত্রণাতেই ছােট বয়ের গহনা লইতে বলিয়াছি — তােমার পাগলের ন্যায় ভ্রমণ, শ্বশুরের ক্রন্দন, শ্বাশুড়ির দীর্ঘ নিশ্বাস, ছােট বয়ের বিরস বদন, জ্ঞাতি বান্ধবের হেঁট মুখ, রাইয়ত জনের হাহাকার, এ সকল দেখে কি আমােদ আনন্দ মনে আছে? কোন রূপে উদ্ধার হইতে পারিলে সকলের রক্ষা। হে নাথ! বিপিনের গহনা দিতেও আমার যে কষ্ট, ছোট বয়ের গহনা দিতেও সেই কষ্ট; কিন্তু ছোট বয়ের গহনা দেওয়ার পূর্ব্বে বিপিনের গহনা দিলে ছোট বয়ের প্রতি আমার নিষ্ঠুরাচরণ করা হয়, ছোট বউ ভাবিতে পারে দিদি বুঝি আমায় পর ভাবিলেন। আমি কি এমন কায করে তার সরল মনে ব্যথা দিতে পারি, একি মাতৃতুল্য বড় যায়ের কাজ?
নবীন। প্রণয়িণি! তোমার অন্তঃকরণ অতি বিমল, তোমার মত সরল নারী নারীকুলে দুটী নাই — আহা! আমার এমন সংসার এমন হইল। আমি কি ছিলাম কি হলাম! আমার ৭ শত টাকা মুনফার গাঁতি, আমার ১৫ গোলা ধান, ১৬ বিঘার বাগান, আমার ২০ খান লাঙ্গল, ৫০ জন মাইন্দার, পূজার সময় কি সমারোহ, লোকে বাড়ী পরিপূর্ণ, ব্রাহ্মণ ভোজন, কাঙ্গালিকে অন্ন বিতরণ, আত্মীয়গণের আহার, বৈষ্ণবের গান, আমোদজনক যাত্রা, আমি কত অর্থ ব্যয় করিয়াছি, পাত্র বিবেচনায় এক শত টাকা দান করিয়াছি; আহা! এমন ঐশ্বর্য্যশালী হইয়া এখন আমি স্ত্রী ভাদ্র বধূর অলঙ্কার হরণ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, কি বিড়ম্বনা! পরমেশ্বর তুমিই দিয়াছিলে, তুমিই লইয়াছ, আক্ষেপ কি —
সৈরি। প্রাণনাথ, তােমাকে কাতর দেখিলে আমার প্রাণ কাঁদিতে থাকে (সজলনেত্রে) আমার কপালে এত যাতনা ছিল, প্রাণকান্তের এত দুর্গতি দেখিতে হলাে — আর বাধা দিও না (তাবিজ খুলন)
নবীন। তােমার চক্ষে জল দেখিলে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয় (চক্ষে জল মােচন করিয়া) চুপ্ কর, শশিমুখি চুপ্ কর, (হস্ত ধরিয়া) রাখ আর এক দিন দেখি।
সৈরি। প্রাণনাথ, উপায় কি — আমি যা বলিতেছি তাই কর, কপালে থাকে অনেক গহনা হবে (নেপথ্যে হাঁচি) সত্যি — আদুরী আস ছে।
(দুইখান লিপি লইয়া আদুরীর প্রবেশ)
আদুরী। চিটি দুখান কন্তে আসেচে মুই কতি পারিনে, মাঠাকুরুণ তােমার হাতে দিতি বল্লে।
নবীন। তোমাদের গহনা লইতে হয় না হয়, এই দুই লিপিতে জানিতে পারিব—(প্রথম লিপি খুলন)
সৈরি। চেঁচিয়ে পড়।
নবীন। (লিপিপাঠ) “রোকার আশীর্ব্বাদ জানিবেন —
আপনাকে টাকা দেওয়া প্রত্যুপকার করা মাত্র,
কিন্তু আমার মাতা ঠাকুরাণীর গতকল্য গঙ্গা
লাভ হইয়াছে, তদাদ্যকৃত্যের দিন সংক্ষেপ,
এ সংবাদ মহাশয়কে কল্যই লিখিয়াছি—
তামাক অদ্যাপি বিক্রয় হয় নাই। ইতি
কি দুর্দ্দৈব! মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের মাতৃশ্রাদ্ধে আমার এই কি উপকার! দেখি, তুমি কি অস্ত্র ধারণ করিয়া আসিয়াছ।
(দ্বিতীয় লিপি খুলন)
সৈরি। প্রাণনাথ, আশা করে নিরাশ হওয়া বড় ক্লেশ — ও চিটি ওম্নি থাক্ —
নবীন। (লিপিপাঠ)
“ প্রতিপাল্য শ্রীগোকুলকৃষ্ণ
পালিতস্য বিনয় পূর্ব্বক নমস্কারা নিবেদনঞ্চ
বিশেষ। মহাশয়ের মঙ্গলে নিজ মঙ্গল পরং
লিপি প্রাপ্তে সমাচার অবগত হইলাম। আমি
৩০০ টাকার যোগাড় করিয়াছি, কল্য সমভি-
ব্যাহারে নিকট পৌছিব, বক্রী এক শত টাকা
আগামী মাসে পরিশোধ করিব। মহাশয় যে
উপকার করিয়াছেন, আমি কিঞ্চিৎ সুদ দিতে
ইচ্ছা করি ইতি।”
সৈরি। পরমেশ্বর বুঝি মুখ তুলে চাইলেন— যাই আমি ছোট বউকে বলিগে।
নবীন। (স্বগত) প্রাণ আমার সারল্যের পুত্তলিকা; এ ত ভীষণ প্রবাহে তৃণমাত্র—এই অবলম্বন করিয়া পিতাকে ইন্দ্রাবাদে লইয়া যাই, পরে অদৃষ্টে যাহা থাকে তাই হবে। দেড় শত টাকা হাতে আছে — তামাক কয়েক খান আর এক মান রাখিলে ৫০০ টাকা বিক্রয় হইতে পারে, তা কি করি সাড়ে তিন শত টাকাতেই ছাড়িতে হইল, আমলা খরচ অনেক লাগিবে যাওয়া আসাতে বিস্তর ব্যয় —এমন মিথ্যা মোকদ্দমায় যদি মেয়াদ হয়, তবে বুঝিলাম যে এ দেশে প্রলয় উপস্থিত। কি নিষ্ঠুর আইন প্রচার হইয়াছে। আইনের দোষ কি, আইন কর্ত্তাদিগের বা দোষ কি— যাহাদিগের হস্তে আইন অর্পিত হইয়াছে, তাহারা যদি নিরপেক্ষ হয়, তবে কি দেশের সর্ব্বনাশ ঘটে। আহা! এই আইনে কত ব্যক্তি বিনাপরাধে কারাগারে ক্রন্দন করিতেছে—তাহাদের স্ত্রী পুত্রের দুঃখ দেখিলে বক্ষ বিদীর্ণ হয়—উনানের হাঁড়ি উনানেই রহিয়াছে, উঠানের ধান উঠানেই শুকাইতেছে, গোয়ালের গোরু গোয়ালেই রহিয়াছে—ক্ষেত্রের চাস সম্পূর্ণ হলো না, সকল ক্ষেত্রে বীজ বপন হলো না, ধানের ক্ষেত্রের ঘাস নির্ম্মূল হলো না, বৎসরের উপায় কি—কোথা নাথ, কোথা তাত শব্দে ধূলায় পতিত হইয়া রোদন করিতেছে। কোন কোন মাজিষ্ট্রেট সুবিচার করিতেছেন, তাঁহাদের হস্তে এ আইন যমদণ্ড হয় নাই। আহা! যদি সকলে অমরনগরের মাজিষ্ট্রেটের ন্যায় ন্যায়বান্ হইতেন, তবে কি রাইয়তের পাকা ধানে মই পড়ে, শস্যপূর্ণ ক্ষেত্রে শলভ পতন হয়? তা হলে কি আমায় এই দুস্তর বিপদে পতিত হইতে হয়? হে লেফ্টেনাণ্ট গভর্ণর! যেমন আইন করিয়াছিলে, তেমনি সজ্জন নিযুক্ত করিতে তবে এমন অমঙ্গল ঘটিত না। হে দেশপালক! যদি এমত একটি ধারা করিতে যে, মিথ্যা মোকদ্দমা প্রমাণ হইলে ফরিয়াদীর মেয়াদ হইবে; তাহা হইলে অমরনগরের জেল নীলকরে পুর্ণ হইত এবং তাহারা এমত প্রবল হইতে পারিত না —আমাদিগের মাজিষ্ট্রেট বদলি হইয়াছে, কিন্তু এ মােকদ্দামা শেষ পর্য্যন্ত এখানে থাকিবে, তাহা হইলেই আমাদিগের শেষ।
(সাবিত্রীর প্রবেশ।)
সাবি। নবীন! সব লাঙ্গল যদি ছেড়ে দাও তাহলেও কি দাদন নিতে হবে? লাঙ্গল গােরু সব বিক্রী করে ব্যবসা কর, তাতে যে আয় হবে সুখে ভােগ করা যাবে, এ যাতনা আর সহ্য হয় না।
নবীন। মা, আমারও সেই ইচ্ছ। কেবল বিন্দুর কর্ম্ম হওয়া অপেক্ষা করিতেছি। আপাততঃ চাস ছাড়িয়া দিলে সংসার নির্ব্বাহ হওয়া দুস্কর, এই জন্য এত ক্লেশেও লাঙ্গল কয়েক খান রাখিয়াছি।
সাবি। এই শিরঃপীড়া লয়ে কেমন করে যাবে বল দেখি? হা পরমেশ্বর! এমন নীল এখানে হয়েছিল। (নবীনের মস্তকে হস্তামর্ষণ।)
(রেবতীর প্রবেশ।)
রেবতী। মা ঠাকুরুণ! মুই কনে যাব, কি কর্বাে, কল্লে কি, ক্যান মত্তি এনেলাম। পরের জাত ঘরে অ্যানে সামাল দিতে পাল্লাম না। বড় বাবু মােরে বাঁচাও, মাের পরাণ ফ্যাটে বারহলো—মোর ক্ষেত্রমণিরি অ্যানে দাও, মোর সোনার পূতুল অ্যানে দাও।
সাবি। কি হয়েচে, হয়েচে কি?
রেবতী। ক্ষেত্র মোর বিকেল বেলা পেঁচোর মার সঙ্গে দাস-দিগিতি জল আন্তি গিয়েলো। বাগান দিয়ে আসবার সমে চার জন নেটেলাতে বাছারে ধরে নিয়ে গিয়েছে। পদী সর্ব্বনাশী দেখ্য়ে দিয়ে পেল্য়েচে। বড়বাবু, পরের জাত কি কল্লাম কেন এনেলাম, বড় সাধে সাদ দেবো ভেবেলাম।
সাবি। কি সর্ব্বনাশ! সর্ব্বনেশেরা সব কত্তে পারে—লোকের জমি কেড়ে নিচ্চিস্, ধান কেড়ে নিচ্চিস্, গোরু বাচুর কেড়ে নিচ্চিস্, লাটির আগায় নীল বুন য়ে নিচ্চিস্—তা লোক কেঁদিই হোক্, কোকিই হোক্ কচ্চে—একি! ভাল মানুষের জাত্ খাওয়া!
রেবতী। মা! আদ পেটা খেয়ে নীল কত্তি নেগিচি, যে ক কুড়োয় দাগ মার্লি, তাই বোন্লাম—রেয়ে ছোঁড়া জমি চসে, আর ফুলে ফুলে কেঁদে ওটে— মাটেত্তে অ্যাসে একথা শুনে পাগল হয়ে যাবে অ্যানে।
নবীন। সাধু কোথায়?
রেবতী। বাইরি বসে কান্তি নেগেচে।
নবীন। সতীত্ব, কুলমহিলার অয়স্কান্ত মণি, সতীত্ব ভূষণে বিভূষিতা রমণী কি রমণীয়া! পিতার সরপুর বৃকোদর জীবিত থাকিতে কুলকামিনী অপহরণ! এই মুহুর্ত্তেই যাইয়া কেমন দুঃশাসন দেখিব; সতীত্ব শ্বেত উৎপলে নীলমণ্ডূক কখনই বসিতে পারিবে না।
সতীত্ব সােণর নিধি বিধিদত্ত ধন।
কাঙ্গালিনী পেলে রাণী এমন রতন।
যদি নীল বানবের হস্ত হইতে পবিত্র মাণিক্য অপবিত্র না হইতে হইতে আনিতে পার, তবেই তােমাকে সার্থক গর্ভে স্থান দিয়াছিলাম। এমন অত্যাচার বাপের কালেও শুনি নাই — চল ঘােষ বউ, বাইরের দিকে যাই।
তৃতীয় অঙ্ক।
তৃতীয় গর্ভাঙ্ক।
রোগ সাহেবের কাম্রা।
(রোগ আসীন। পদী ময়রাণী এবং ক্ষেত্রমণির প্রবেশ।)
ক্ষেত্র। ময়রাপিসি! মোরে এমন কথা বলো না, মুই পরাণ দিতি পার্বো, ধর্ম্ম দিতি পার্বো না, মোরে কেটে কুচি কুচি কর, মোরে পুড়্য়ে ফেল, ভেসয়ে দাও, পূঁতে রাখ, মুই পর পুরুষ ছুঁতি পার্বো না; মোর ভাতার মনে কি ভাব্বে?
পদী। তোর ভাতার কোথায়, তুই কোথায়? এ কথা কেউ জান্তে পার্বে না এই রাত্রেই আমি সঙ্গে করে তোর মায়ের কাছে দিয়ে আস্বো।
ক্ষেত্র। ভাতারই যেন জান্তি পার্লে না— ওপরের দেবতাতো জান্তি পার্বে, দেবতার চকিতো ধুলো দিতি পার্বো না। আমার প্রাণের ভিতরতো পাঁজার আগুণ জল্বে। মোর স্বামী সতী বলে যত ভাল বাস্বে, তত মোর মনতো পুড়তি থাক্বে, জানাই হোক্ আর অজানাই হোক্, মুই উপপতি কত্তি কখনই পার্বো না।
রোগ। পদ্ম! খাটের উপরে আন্ না।
পদ্ম। আয় বাচা তুই সাহেবের কাছে আয়, তাের যা বল্তে হয় ওকে বল, আমার কাছে বলা অরণ্যে রােদন।
রোগ। আমার কাছে বলা শুয়ারের পায়ে মুক্ত ছড়ান, হা হা হা! আমরা নীলকর, আমরা যমের দোসর হইয়াছি, দাড়িয়ে থেকে কত গ্রাম জ্বালাইয়া দিয়াছি, পুত্রকে স্তন ভক্ষণ করাইতে করাইতে কত মাতা পুড়ে মরিল, তা দেখে কি আমরা স্নেহ করি, স্নেহ করিলে কি আমাদের কুটি থাকে। আমরা স্বভাবতঃ মন্দ নই, নীলকর্ম্মে আমাদের মন্দ মেজাজ বৃদ্ধি হইয়াছে। এক জন মানুষকে মারিতে মনে দুঃখ হইত, এখন দশ জন মেয়ে মানুষকে নিদ্দম করিয়া রামকান্ত পেটা করিতে পারি, তখনি হাঁসিতে হাঁসিতে খানা খাই—আমি মেয়ে মানুষকে অধিক ভাল বাসি, কুটির কর্ম্মে ও কর্ম্মের বড় সুবিধা হইতে পারে; সমুদ্রে সব মিশ্য়ে যাইতেছে। তাের গায় জোর নাই?—পদ্ম! টানিয়া আন্।
পদী। ক্ষেত্রমণি! লক্ষী মা আমার, বিছানায় এস, সাহেব তােরে একটা বিবির পােষাক দেবে বলেচে।
ক্ষেত্র। পােড়া কপাল বিবির পােষাকের চট্ পরে থাকি সেও ভাল, তবু য্যান বিবির পােষাক পর্তি না হয়। ময়রা পিসি! মাের বড় তেষ্টা পেয়েছে, মােরে বাড়ী দিয়ে আয়, মুই জল খেয়ে শেতল হই আহা, আহা! মাের মা এত বেল্ গলায় দড়ি দিয়েচে,মাের বাপ মাথায় কুড়ুল মেরেচে, মাের কাকা বুনাে মষির মত ছুটে ব্যাড়াচ্চে। মাের মার আর নেই, বাবা কাকা দুজনের মধ্যি মুই অ্যাখ সন্তান। মােরে ছেড়ে দে, মােরে বাড়ী রেখে আয়, তাের পায় পড়ি; পদি পিসি, তাের গু খাই—মা-রে মলাম!—জল তেষ্টায় মলাম্।
রােগ। কুঁজোয় জল আছে খাইতে দেও।
ক্ষেত্র। মুই কি হিঁদুর মেয়ে হয়ে সাহেবের জল খাতি পারি—মােরে নেটেলায় ছুঁয়েচে, মুই বাড়ী গিয়ে না নেয়ে তাে ঘরে যাতি পার্বো না।
পদী। (স্বগত) আমার ধর্ম্মও গেচে, জাতও গেচে। (প্রকাশে) তা মা! আমি কি কর্বো, সাহেবের খপ্পরে পড়্লে ছাড়া ভার। ছােট সাহেব! ক্ষেত্রমণি আজ বাড়ী যাক্, তখন আর এক দিন আস্বে।
রােগ। তুমি তবে আমার সঙ্গে থেকে মজা কর। তুই ঘর হইতে যা, আমার শক্তি থাকে আমি নরম কর্বো, নচেৎ তাের সঙ্গে বাড়ী পাঠাইয়ে দিব—ড্যাম্নেড্হাের, আমার বোধ হইতেছে তুই বাধা করে ছিলি, আসিতে দিস্নি, তাইতে ভদ্র লােকের মেয়েকে লাটিয়াল দিয়ে আনা হইল, আমি সহজে নীলের লাটিয়াল একার্য্যে কখন দিয়াছি? হারাম্ জাদী পদিময়রাণী।
পদী। তােমার কলিকে ডাকো, সেই তােমার বড় প্রিয় হয়েছে, আমি তা বুঝিয়াছি।
ক্ষেত্র। ময়রা পিসি! যাস্নেময়রা পিসি!। যাস্নে।
মােরে কাল সাপের গত্তের মধ্যি একা রেকে গেলি, মাের যে ভয় করে, মুই যে কাঁপ্তি, নেগিচি, মাের যে ভয়্তে গা ঘুরতি নেগেচে, মাের মুখ যে তেষ্টায় ধুলাে বেটে গেল।
রােগ। ডিয়ার! (দুই হস্থে ক্ষেত্রমণির দুই হস্থ ধরিয়া টানন) আইস, আইস—
ক্ষেত্র। ও সাহেব! তুমি মাের বাবা; ও সাহেব! তুমি মাের বাবা, মােরে ছেড়ে দেও, পদী পিসির সঙ্গে দিয়ে মােরে বাড়ী পেট্য়ে দাও, আঁদার রাত, মুই একা যাতি পার্বাে না—(হস্ত ধরিয়া টানন) ও সাহেব! তুমি মাের বাবা, ও সাহেব? তুমি মাের বাবা, হাত ধল্লি জাত যায়, ছেড়ে দাও—তুমি মোর বাবা!
রােগ। তাের ছেলিয়ার বাবা হইতে ইচ্ছা হইয়াছে, আমি কোন কথায় ভুলিতে পারি না, বিছানায় আইস, নচেৎ পদাঘাতে পেট ভাঙ্গিয়া দিব।
ক্ষেত্র। মাের ছেলে মরে যাবে, দই সাহেব, মাের ছেলে মরে যাবে—মুই পােয়াতি!
রােগ। তােমাকে উলঙ্গ না করিলে তোমার লজ্জা যাইবে না।
ক্ষেত্র। ও সাহেব! মুই তােমার মা, মােরে ন্যাংটো করাে না, তুমি মাের ছেলে, মাের কাপড় ছেড়ে দাও
রােগ। ইন্কর্ন্যাল বিচ্! (বেত্র গ্রহণ করিয়া) এই বার তােমার ছেনালি ভঙ্গ হইবে।
ক্ষেত্র। মােরে অ্যাক্বারে মেরে ফ্যাল, মুই কিছু বল্বাে না। মাের বুকি অ্যাকটা তেরোনালের খোঁচা মার্ মুই স্বগ্গে চলে যাই—ও গুখেগাের বেটা, আঁটকুড়ির ছেলে, তাের বাড়ী যােড়া মরা মরে, মাের গায়ে যদি আবার হাত দিবি, তাের হাত মুই এঁচ্ড়ে কেম্ড়ে টুক্রাে টুক্রাে কর্বো, তোর মা বুন নেই, তাদের গিয়ে কাপড় কেড়ে নিগে না, দেঁড়য়ে রলি কেন, ও ভাই ভাতারির ভাই! মার না, মোর প্রাণ বার করে ফ্যাল না, আর যে মুই সইতি পারি নে।
রোগ। চুপ রাও হারামজাদী, ক্ষুদ্র মুখে বড় কথা।
ক্ষেত্র। কোথায় বাবা! কোথায় মা! দেখগো, তােমাদ্দের ক্ষেত্র মলে গাে (কম্পন)
(জানেলার খড়খড়ি ভাঙ্গিয়া নবীনমাধব ও তােরাপের
প্রবেশ।)
নবীন। (রােগের হস্ত হইতে ক্ষেত্রমণির কেশ ছাড়াইয়া লইয়া) রে নরাধম, নীচবৃত্তি, নীলকর! এই কি তােমার খ্রীষ্টান ধর্ম্মের জিতেন্দ্রিয়তা? এই কি তােমার খ্রীষ্টানের দয়া, বিনয়, শীলতা? আহা, আহা! বালিকা, অবলা, অন্ত্বর্ব্বত্নী কামিনীর প্রতি এই রূপ নির্দ্দয় ব্যবহার!
তােরাপ। সুমুন্দি দেঁড়িয়ে যেন কাটের পুতুল—গােডার বাক্যি হরে গিয়েছে—বড় বাবু! সুমুন্দির কি এমান আছে তা ধরম কথা শােন্বে, ও ঝ্যামন কুকুর মুই তেমনি মুগুর, সুমুন্দির ঝ্যামন চাবালি, মাের তেমনি হাতের পোঁচা (গলদেশ ধরিয়া গালে চপেটাঘাত) ডাকবি তাে যােমের বাড়ী যাবি (গাল টিপে ধরে) পাঁচ দিন চোরের এক দিন সেদের, পাঁচ দিন খাবালি এক দিন খা (কান মলন)
নবীন। ভয় কি ভাল করে কাপড় পর (ক্ষেত্রমণির বস্ত্র পরিধান) তােরাপ! তুই বেটার গাল টিপে রাখিস্, আমি ক্ষেত্রকে পাঁজা করে লইয়া পালাই—আমি বুনােপাড়া ছাড়্য়ে গেলে তবে ছেড়ে দিয়ে তুই দৌড় দিবি। নদীর ধার দিয়া যাওয়া বড় কষ্ট, আমার শরীর কাঁটায় ছড়ে গিয়েছে, এতক্ষণ বোধ করি বুনােরা ঘূময়েছে, বিশেষতঃ একথা শুন্লে কিছু বল্বে না, তুই তার পর আমাদের বাড়ী যাস, তুই কি রূপে ইন্দ্রাবাদ হইতে পালাইয়ে এলি এবং এখন কোথায় বাস করিতেছিস তাহা আমি শুন তে চাই।
তােরাপ। মুই এই নাতি নদীডে সাঁত্রে পার হয়ে ঘরে যাব—মোর নছিবির কথা আর কি শোন্বা—মুই মোক্তার সুমুন্দির আস্তাবলের ঝরকা ভেঙ্গে পেলয়ে একেবারে বসন্তবাবুর জমিদারীতে পেলয়ে গ্যালাম, তার পর নাতকরে জরু ছাবাল ঘর পোর্লাম! এই সুমুন্দিই তো ওটালে, নাঙ্গল করে কি আর খাবার যো নেকেচে, নীলের ঠ্যালাটি কেমন—তাতে আরার নেমোখারামী কত্তি বলে—কই শালা, গ্যাড্ ম্যাড্ করে জুতার গুতা মারিস্ নে?
নবীন। তোরাপ! মার্বার আবশ্যক কি, ওরা নির্দ্দয় বলে আমাদের নির্দ্দয় হওয়া উচিত নয়; আমি চলিলাম।
তোরাপ। এমন বস্গারও বেছাপ্পর কত্তি চাস—তোর বড় বাবারে বলে মেন্য়ে জুন্য়ে কাজ মেরে নে, জোর জোরাবতি কদিন চলে, পেলিয়ে গেলিতো কিছু কত্তি পার্বা না, মরার বাড়াতে গাল্ নেই! ও সুমুন্দি, নেয়েত্ ফেরার হলি ঝে কুটি কবরের মধ্যি ঢোক্বে। বড়বাবুর আরবচুরে টাকা গুনন চুক্য়ে দে, আর এবচোর ঝা বুন তি চাচ্ছে তাই নিগে, তোদের জন্যই ওরা বেপালটে পড়েচে, দাদন গাদ লিইতো হয় না, চসা চাই—ছোট সাহেব, স্যালাম, মুই আসি।
রোগ। বাই জোভ! বিটেন টু জেলি।
তৃতীয় অঙ্ক।
চতুর্থ গর্ভাঙ্ক।
গোলোক বসুর ভবনের দরদালান।
(সাবিত্রীর প্রবেশ।)
সাবিত্রী। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক) রে নিদারুণ হাকিম! তুই আমাকেও কেন তলব দিলিনা—আমি পতি পুত্রের সঙ্গে জেলায় যেতাম। এ শ্মশানে বাস অপেক্ষা আমার সে যে ছিল ভাল। হা! কর্ত্তা আমার ঘরবাসী মানুষ—কখন গাঁ অন্তরে নিমন্ত্রণ খেতে যান না, তাঁর কপালে এত দুঃখ, ফোজদুরীতে ধরে নেগেল, তাঁর জেলে যেতে হবে; ভগবতি! তোমার মনে এই ছিল মা? আহা হা! তিনি যে বলেন আমার এড়োঘরে না শুলে ঘুম হয় না, তিনি যে আতপ চালের ভাত খান, তিনি যে বড় বউমার হাতে নইলে খান্ না, আহা! বুক চাপ্ড়ে চাপ্ড়ে রক্ত বার করেছেন, কেঁদে কেঁদে চক্ষু ফুলিয়েছেন, যাবার সময় বলেন “গিন্নি! এই যাত্রা আমার গঙ্গাযাত্রা হলাে”— (ক্রন্দন) নবীন বলেন, “মা! তােমার ভগবতীকে ডাক, আমি অবশ্য জয়ী হয়ে ওঁরে নিয়ে বাড়ী আস্বাে”—বাবার আমার কাঞ্চনমুখ কালী হয়ে গিয়েছে, টাকার যােগাড় করিতেইবা কত কষ্ট, ঘুরে ঘুরে ঘুর্ণি হয়েছে, পাছে আমি বউদের গহনা দিই, তাই আমারে সাহস দেন, মা টাকার কমি কি, মােকদ্দমায় কতই খরচ হবে। গাঁতির মােকদ্দমায় আমার গহনা বন্দক পড়্লে বাবার কতই খেদ—বলেন কিছু টাকা হতে এলেই মার গহনা গুলিন আগে খালাস করে আন্বাে—বাবার আমার মুখে সাহস, চক্ষে জল— বাবা আমার কাঁদিতে কাঁদিতে যাত্রা কর্লেন—আমার নবীন এই রােদে ইন্দ্রাবাদ গেল,আমি ঘরে বসে রলাম, মহাপাপিনী! এই কি তাের মার প্রাণ!—
(সৈরিন্ধ্রীর প্রবেশ।)
সৈরি। ঠাকুরুণ অনেক বেলা হয়েচে, স্নান কর। আমাদের অভাগা কপাল, তা নইলে এমন ঘটনা হবে কেন।
সাবিত্রী। (ক্রন্দন করিতে করিতে) না মা! আমার নবীন বাড়ী না ফিরে এলে আমি আর এদেহে অন্ন জল দেব না, বাছারে আমার খাওয়াবে কে?
সৈরি। সেখানে ঠাকুরপোর বাসা আছে, বামন আছে, কষ্ট হবেনা। তুমি এস স্নান করসে।
(তৈলপাত্র লইয়া সরলতার প্রবেশ।)
ছোট বউ! তুমি ঠাকুরুণকে তৈল মাখায়ে স্নান করায়ে রান্নাঘরে নিয়ে এস, আমি খাওয়ার জায়গা করিগে।
সাবিত্রী। তোতাপাখী আমার নীরব হয়েছে, মার মুখে আর কথা নাই, মা আমার বাসি ফুলের মত মলীন হয়েছেন। আহ, আহা! বিন্দুমাধবকে কত দিন দেখি নাই, বাবার কালেজ বন্দ হবে বাড়ী অস্বেন আশা করে রইচি, তাতে এই দায় উপস্থিত! (সরলতার চিবুকে হস্ত দিয়া) বাছার মুখ শুকাইয়া গিয়াছে, এখনো বুঝি কিছু খাউনি? ঘোর বিপদে পড়ে রইচি, তা বাছাদের খাওয়া হলো কি না, দেখিব কখন্? আমি আপনি স্নান করিতেছি, তুমি কিছু খাওগে মা, চল আমিও যাই।