নীল-দর্পণ নাটক/দ্বিতীয় অঙ্ক
দ্বিতীয় অঙ্ক।
প্রথম গর্ভাঙ্ক।
বেগুনবেড়ের কুটির গুদাম ঘর।
(তোরাপ ও আর চারি জন রাইয়ত উপবিষ্ট)
তােরাপ। ম্যারে ক্যান ফ্যালায় না, মুই নেমােখ্যারামি কভি পার্বো না — ঝে বড় বাবুর জন্যি জাত বাঁচেচে, ঝার হিল্লেয় বসতি কত্তি নেগিচি, ঝে বড় বাবু হাল গােরূ বেঁচেয়ে নে ব্যাড়াচ্চে, মিত্যে সাক্ষি দিয়ে সেই বড় বাবুর বাপ্কে কয়েদ করে দেব? মুই তাে কখনুই পার্বাে না — জান কবুল।
প্রথম রাই। কুঁদির মুখি বাঁক্ থাকবে না, শ্যামচাঁদের ঠ্যালা বড় ঠ্যালা। মোদের চকি কি আর চামড়া নেই, না মােরা বড় বাবুর নুন খাইনি—করবো কি, সাক্ষি না দিলি যে আস্ত রাখে না — উট সাহেব মাের বুকি দেঁড়য়ে ঊটেলো — দ্যাদিনি অ্যাকন তবাদি অক্ত ঝােজানি দিয়ে পড়চে — গোডার পা য্যান বল্দে গােরুর খুর।
দ্বিতীয়। প্যারেকের খোঁচা — সাহেবেরা যে প্যারেক্মারা জুতাে পরে, জানিসনে!
তােরাপ। (দন্ত কিড়মিড় করিয়া) দুত্তোর প্যারেকের মার প্যাট করে, লৌ দেখে গাডা মাের ঝাঁকি মেরে ওট্চে। উঃ কি বলবো — সমিন্দির অ্যাকবার ভাতারমারির মাটে পাই, এম্নি থাপ্পোড় ঝাঁকি, সমিন্দির চাবালিডে আসমানে উড়্য়ে দেই, ওর গ্যাড্ ম্যাড্ করা হের ভেতর দে বার করি।
তৃতীয়। মুই টিকির — জোন খাটে খাই। মুই কত্তা মশার সলা শুনে নীল কল্লাম না, তবে বল্লিতো খাটবে না, তবে মােরে গুদোমে পাের লে ক্যান — তানার সেমনতোনের দিন ঘুনয়ে এস্তেচে, ভেবেলাম এই হিড়িকি খাটে কিছু পূঁজি কর্বো করে সেমনতোনের সমে পাঁচ কুটম্বুর খবর নেব, তা গুদোমে ৫দিন পচতি লেগিচি আবার ঠ্যালবে সেই আন্দার বাদ।
দ্বিতীয়। আন্দারবাদে মুই অ্যাকবার গিয়েলাম — ঐ যে ভাবনাপুরীর কুটি, যে কুটির সাহেবডারে সকলি ভালবলে — ঐসুমুন্দি মাের অ্যাকবার ফোজদুরিতি ঠেলেলো। মুই সেবের কেচ্রির ভেতর অনেক তামসা দেখেলাম। ওয়াঃ! ন্যাজের কাছে বসে মাচেরটক সাহেব যেই হ্যাল মেরেছে, দুই সুমুন্দি মােক্তার ওমনি র,র, করে অ্যাসেছে, হেড়া হেড়ি যে কত্তি নেগলো, মুই ভাবলাম ময়নার মাটে সাদখাঁদের ধলা দামড়া আর জমাদ্দারদের বুদো এড়ের নড়ুই বেদ্লাে।
তােরাপ। তাের দোষ পেয়েলো কি? ভাবনাপুরীর সাহেবতো মিছে হ্যাংনামা করে না। সাচা কথা করে। ঘােড়া চড়ে সাব। সব সুমিন্দি যদি ঐ সুমিন্দির মত হতাে তা হলি সুমিন্দিগার এত বদ্নাম নট্তাে না।
দ্বিতীয়। আহ্লাদে যে আর বাঁচিনে গা।
ভাল ভাল করে গ্যালাম কেলাের মার কাছে।
কেলোর মা বলে আমার জামার সঙ্গে আছে।
এব্রে ও সুমিন্দির ইকসুল করা বেইরে গেছে, সুমিন্দির গুদোম্তে সাতটা রেয়েত বেইরেছে। অ্যাকটা নিচু ছেলে। সুমিন্দি গাই বাচুর গুদমে ভরলে — সুমিন্দি যে ঘাটা মাত্তি লেগেছে, বাবা!
তােরাপ। সুমিন্দিরে ভাল মানুষ পালি খ্যাতি আসে, মাচেরটক্ সাহেবডারে গাংপার করবার কোমেট কত্তি লেগেছে।
দ্বিতীয়। এ জেলার মাচেরটক্ না—ওজেলার মাচেরটকের দোষ পালে কি তাওতো বুঝ্তি পাচ্চিনে।
তোরাপ। কুটি খাতি যাইনি। হাকিমডেরে গাঁতবার জন্যি খানা পেক্য়েলো, হাকিমডে চোরা গোরুর মত পেল্য়ে রলো, খাতি গেল না — ওডা বড় নোকের ছাবাল, নীল মামদোর বাড়ী যাবে ক্যান। মুই ওর অণ্ডেরা পেইচি, এ সুমিন্দিরে বেলাতের ছোট নোক।
প্রথম। তবে এগোনের গারনাল সাহেব কুটি কুটি আইবুডো ভাত খেয়ে বেড়্য়েলো ক্যামন করে? দেখিস্নি, সুমিন্দিরে গোঁট বেঁদে তাঁনারে বর সেজ্য়ে মোদের কুটিতি এনেলো?
দ্বিতীয়। তানার বুঝি ভাগ ছেল।
তোরাপ। ওরে না, লাট সাহেব কি নীলির ভাগ নিতি পারে। তিনি নাম কিন্তি এয়েলেন। হালের গারনাল সাহেবডারে যদি খোদা বেঁচ্য়ে রাকে, মোরা প্যাটের ভাত করে খাতি পার্বো, আর সুমিন্দির নীল মামদো ঘাড়ে চাপ্তি পার্বে না —
তৃতীয়। (সভয়ে) মুই তবে মলাম, মামদোভূতি পালি নাকি ঝক্কোতে ছাড়ে না? বউ যে বলেলাে।
তােরাপ। এমান্নির ভাইরি আনেছে ক্যান! মান্নির ভাই নচা কথা সােমােজ কত্তি পারে না — সাহেবগার ডরে নেক সব গাঁ ছাড়া হতি নেগলাে, তাই বচোরদ্দি নানা নচে দিয়েলো —
ব্যারাল চকো হাঁদা হেম্দো।
নীলকুটির নীল মেম্দো।
বচোরদ্দি নানা কবি নচ্তি খুব।
দ্বিতীয়। নিতে আতাই একটা নচেচে সুনিস্ নি?
“জাত মাল্লে পাদ্রি ধরে।
ভাত মাল্লে নীল বাঁদরে॥”
তােরাপ। এওল নচন নচেচে; “জাত মাল্লে” কি?
দ্বিতীয়।“জাত মাল্লে পাদ্রি ধরে।
ভাত মাল্লে নীল বাঁদরে॥”
চতুর্থ। হা! মাের বাড়ী যে কি হতি নেগেছে তা কিছুই জান্তি পাল্লাম না—মুই হলাম ভিনগাঁর রেয়েত, মুই স্বরপুর আলাম কবে, তা বস মশার সলায় পড়ে দাদন ঝ্যাড়ে ফ্যাল লাম? মাের কোলের ছেলেডার গা তেতো করেলাে তাইতি বস মশার কাছে মিচ্রি নিতি অ্যাকবার স্বরপুর আয়েলাম। আহা কি দয়ার শরীল, কি চেহারার চটক, কি অরপুরুবরূপে দেখেলাম, বসে আছেন য্যান গজেন্দ্রগামিনী।
তােরাপ। এবার ক কুড়াে ঢুক্য়েছে?
চতুর্থ। গ্যালবার দশ কুড়ো করেলাম, তার দাম দিতি আদা খ্যাচ্ড়া কল্লে —এবারে ১৫ বিঘের দাদন গতিয়েছে, ঝা বলচে তাই কচ্চি তবুতাে ব্যাভ্রম কত্তি ছাড়ে না।
প্রথম। মুই দুবচ্ছোর ধরে নাঙ্গ্ল দিয়ে এক বন্দ জমি তোল্লাম, এইবারে যাে হয়েলাে, তিলির জন্যিই জমিডে রেখেলাম, সে দিন ছােট সাহেব ঘােড়া চাপে অ্যাসে দেড়্য়ে থেকে জমিডের মার্গ মারালে — চাসার কি আর বাচন আছে?
তােরাপ। এডা কেবল আমীন সুমিন্দির হির ভিতি। সাহেব কি সব জমি খবর নাকে। ঐ সুমিন্দি সব ঢুঁড়ে বার করে দেয়। সুমিন্দি য্যান হন্নে কুকুরের মত ঘুরে ব্যাড়ায়, ভাল জমিডে দ্যাখে, ওমনি সাহেবের মার্গ মারে। সাহেবের তাে ট্যাকার কমি নি, ওরতাে আর মহাজন কত্তি হয় না, সুমিন্দি তবে ওমন করে ক্যান—নীল কর্বি তা কর, দামড়া গোরু কেন্, নাঙ্গল বেন্য়ে নে, নিজি না চস্তি পারিস মেইন্দার রাঘ, তাের জমির কমি কি, গাঁকে গাঁ ক্যান চসে ফ্যাল্না, মােরা গাঁতা দিতিতো নারাজ নই, তা হলি দু সনে নীল যে ছেপ্য়ে উট্তি পারে, সুমিন্দি তা কর বে না, মান্নির ভার নেয়েতের হেই বড় মিষ্টি নেগেছে, তাই চোস্চেন, তাই চোস্চেন (নেপথ্যে হো, হো, হো, মা, মা,) গাজিসাহেব, গাজিসাহেব, দরগা, দরগা, তােরা আম নাম কর, এডার মধ্যি ভুত আছে। চুপদে চুপদে——
(নেপথ্যে—হা নীল! তুমি আমারদিগের সর্ব্বনাশের জন্যেই এদেশে এসেছিলে—আহা! এ যন্ত্রণা যে আর সহ্য হয় না, এ কান্সারনের আর কত কুটি আছে না জানি, দেড় মাসের মধ্যে ১৪ কুটির জল খেলেম, এখন কোন্ কুটিতে আছি তাওতাে জানিতে পারিলাম না, জানিবই বা কেমন করে, রাত্রি যোগে চক্ষু বন্ধন করিয়া এক কুটি হইতে অন্য কুটি লইয়া যায়, উঃ মাগাে তুমি কোথায়!)
তৃতীয়। আম, আম, আম, কালী, কালী, দুর্গা, গণেশ, অসুর! — তােরাপ! চুপ, চুপ।
(নেপথ্যে) আহা! ৫ বিঘা হারে দাদন লইলেই এ নরক হইতে ত্রাণ পাই—হে মাতুল! দাদন লওয়াই কর্ত্তব্য, সংবাদ দিবার তাে আর উপায় দেখিনে, প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছে, কথা কহিবার শক্তি নাই, মাগাে! তােমার চরণ দেড় মাস দেখিনি।
তৃতীয়। বউরি গিয়ে এ কথা বলবাে — শুনলি তাে মর্যে ভুত হয়েছে তবু দাদনের হাত ছাড়িতি পারিনি।
প্রথম। তুই মিনসে এমন হেবলাে—
তােমরা ভাল মানসির ছাবাল — মুই কথায় জান্তি পেরিছি — পরাণে চাচা, মােরে কাঁদে কত্তি পারিস, মুই ঝরকা দিয়ে ওরে পুচ করি, ওর বাড়ি কনে—
প্রথম। তুই যে নেড়ে।
তােরাপ। তবে তুই মাের কঁদে উটে দ্যাক্ —(বসিয়া ওট—কান্ধে উঠন) দ্যাল ধরিস, ঝরকার কাছে মুখ নিয়ে যা— (গােপীনাথকে দুরে দেখিয়া) চাচা লাব, চাচা লাব, গুপে সুমিন্দি আস্চে (প্রথম রাইয়তের ভূমিতে পতন)
(গোপীনাথ ও রামকান্ত হস্তে করিয়া
রোগসাহেবের প্রবেশ।)
তৃতীয়। দেওয়ানজি মশাই, এই ঘরডার মধ্যি ভুত আছে। এত বেল কানতি নেগেলাে।
গোপী। তুই যদি যেমন শিখাইয়া দেই তেমনি না বলিস তবে তুই ওমনি ভূত হবি। (জনান্তিকে রােগের প্রতি) মজুমদারের বিষয় এরা জানিয়াছে, এ কুর্টিতে আর রাখা নয়। ওঘরে রাখাই অবিধি হইয়াছিল।
রোগ। ও কথা পরে শােনা যাবে। নারাজ আছে কে, কোন বর্জ্জাত নষ্ট (পায়ের শব্দ)
গােপী। এরা সব দোরস্ত হয়েছে। এই নেড়ে বেটা ভারি হারামজাদা, বলে নেমকহারামি করতে পারিব না।
তােরাপ। (স্বগত) বাবারে! যে নাদনা, অ্যাকন তাে নাজি হই, ত্যাকন ঝা জানি তা করবাে। (প্রকাশে) দোই সাহেবের, মুই ও সােদা হইচি।
রোগ। চপরাও, শূয়ারকি বাচ্চা। রামকান্ত বড় মিষ্টি আছে (রামকান্তাঘাত এবং পায়ের, গুতা)
তোরাপ। আল্লা! মাগো গ্যালাম, পরাণে চাচা; একটু জল দে, মুই পানি তিসেয় মলাম, বাবা, বাবা, বাবা—
রােগ। তাের মুখে পেসাব করে দেবে না? (জুতার গুতা)
তোরাপ। মােরে ঝা বলবা মুই তাই করবাে— দোই সাহেবের, দোই সাহেবের, খােদার কসম।
রােগ। বাঞ্চতের হারাম জাদকি ছেড়েছে। আজ রাত্রে সব চালান দেবে। মুক্তিয়ারকে লেখ, সাক্ষ্য আদায় না হােলে কেউ বাইরে যেতে না পায়। পেস্কার সঙ্গে যাবে — (তৃতীয় রাইয়তের প্রতি) তোম রোতা হায় কাহে? (পায়ের গুতা)
তৃতীয়। বউ তুই কনেরে, মােরে খুন কর্যে ফ্যালালে, মারে, বউরে, মারে, মেলেরে, মেলেরে, (ভুমিতে চিত হইয়া পতন)
রােগ। বাঞ্চৎ বাউরা হায়।
গােপী। (কমন তোরাপ, প্যাঁজ পয়জার দুইতাে হলাে।
তােরাপ। দেওয়ানজি মশাই, মােরে এট্টু পানি দিয়ে বাঁচাও, মুই মলাম।
গোপী। বাবা নীলের গুদাম, ভাবরার ঘর, ঘামও ছােটে, জলও খাওয়া যায়। আয় তাের। সকলে আয়, তােদের একবার জল খাইয়ে আনি।
দ্বিতীয় অঙ্ক।
দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক।
(বিন্দুমাধবের শয়নঘর।)
(লিপি হস্তে সরলতা উপবিষ্ট।)
সরলা ললন জীবন এল না।
কমল হৃদয় দ্বিরদ দলনা
বড় আশায় নিরাশ হলেম। প্রাণেশ্বরের আগমন প্রতীক্ষায় নব সলিল শীকরাকাঙিক্ষণী চাতকিনী অপেক্ষাও ব্যাকুল হয়েছিলাম। দিন গণনা করিতেছিলাম যে দিদি বলেছিলেন, তাতে মিথ্যা নয়, আমার এক এক দিন এক এক বৎসর-গিয়েছে। —(দীর্ঘনিশ্বাস) নাথের আসার আশা তাে নির্ম্মূল হইল; এক্ষণে যে মহৎ কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়েছেন তাহাতে সফল হইলেই তাঁর জীবন সার্থক — প্রাণেশ্বর, আমাদের নারীকুলে জন্ম, আমরা পাঁচ বয়স্যায় একত্রে উদ্যানে যাইতে পারি না, আমরা নগর ভ্রমণে অক্ষম, আমাদিগের মঙ্গলসূচক সভা স্থাপন সম্ভব না, আমাদের কালেজ নাই, কাছারী নাই, ব্রাহ্মসমাজ নাই — রমণীর মন কাতর হইলে বিনােদনের কিছু মাত্র উপায় নাই, মন অবোধ হইলে মনেরতো দোষ দিতে পারি না। প্রাণনাথ আমাদের একমাত্র অবলম্বন — স্বামীই ধ্যান, স্বামীই জ্ঞান, স্বামীই অধ্যয়ন, স্বামীই উপার্জ্জন, স্বামীই সভা, স্বামীই সমাজ, স্বামীরই সতীর সর্ব্বস্বধন। হে লিপি! তুনি আমার হৃদয় বল্লভের হস্ত হইতে আসিয়াছ, তােমাকে চুম্বন করি, [লিপি চুম্বন] তােমাতে আমার প্রাণকান্তের নাম লেখা আছে, তােমাকে তাপিত বক্ষে ধারণ করি, [বক্ষে ধারণ] আহা! প্রাণনাথের কি অমৃত বচন, পত্রখানি যত পড়ি ততই মন মােহিত হয়, আর একবার পড়ি (পঠন)
“প্রাণের সরলা!
তােমার মুখারবিন্দ দেখিবার জন্য আমার প্রাণ যে কি পর্য্যন্ত্ব ব্যাকুল হইয়াছে তাহা পত্রে ব্যক্ত করা যায় না! তােমার চন্দ্রানন বক্ষে ধারণ করিয়া আমি কি অনির্ব্বচনীয় সুখ লাভ করি। মনে করিয়াছিলাম সেই সুখের সময় আসিয়াছে, কিন্তু হরিষে বিষাদ, কালেজ বন্ধ হইয়াছে, কিন্তু বড় বিপদে পড়িয়ছি, যদি পরমেশ্বরের আনুকূল্যে উত্তীর্ণ হইতে না পারি তবে আর মুখ দেখাইতে পারিব না নীলকর সাহেবেরা গােপনে গােপনে পিতার নামে এক মিথ্যা মােকদ্দমা করিয়াছে, তাহাদের বিশেষ যত্ন তিনি কোনরূপে কারাবদ্ধ হন। দাদা মহাশয়কে এ সংবাদ আনুপূর্ব্বিক লিখিয়া আমি এখানকার তদ বিরে রহিলাম। তুমি কিছু ভাবনা করাে না, করুণাময়ের কৃপায় অবশ্যই সফল হইব। প্রেয়সি, আমি তােমার বঙ্গভাষার সেস্কপেয়ারের কথা ভূলি নাই, এক্ষণে বাজারে পাওয়া যায় না, কিন্তু প্রিয়বয়স্য বঙ্কিম তাঁহার খান দিয়েছেন বাড়ি যাইবার সময় লইয়া যাইব—বিধুমুখি, লেখা পড়ার সৃষ্টি কি সুখের আকর, এত দূরে থাকিয়াও তােমার সহিত কথা কহিতেছি। আহা! মাতাঠাকুরাণী যদি তােমার লিখনের প্রতি আপত্তি না করিতেন, তবে তােমার লিপিসুধা পান করে আমার চিত্তচকোর চরিতার্থ হইত ইতি।
তােমারি বিন্দমাধব।”
তােমারি———তাতে আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে, প্রাণেশ্বর, তােমার চরিত্রে যদি দোষ স্পর্শে তবে সুচরিত্রের আদর্শ হবে কে? আমি স্বভাবতঃ চঞ্চল, এক স্থানে এক দণ্ড স্থির হয়ে বসিতে পারিনে বলে ঠাকুরুণ আমাকে পাগ্লির মেয়ে বলেন। এখন আমার সে চাঞ্চল্য কোথায়! যে স্থানে বসে প্রাণপতির পত্র খুলিয়াছি সেই স্থানেই এক প্রহর বসে আছি। আমার উপরে চঞ্চলতা অন্তরে প্রবেশ করিয়াছে। ভাত উথলিয়া ফেনা সমূহে আবৃত হইলে উপরিভাগ স্থির হয়, কিন্তু ভিতরে ফুটিয়া থাকে; আমি এখন সেইরূপ হইলাম। আর আমার সে হাস্য বদন নাই। হাসি মুখের রমণী; সুখের বিনাশে হাসির সহমরণ। প্রাণনাথ, তুমি সফল হইলেই সকল রক্ষা, তােমার বিরস বদন দেখিলে আমি দশদিক্ অন্ধকার দেখি। হে অবােধ মন! তুমি প্রবােধ মনিবে না? তুমি কি অবােধ হইলে পার আছে, তােমার কান্না কেহ দেখিতে পায় না, কেহ শুনিতেও পায় না; কিন্তু নয়ন, তুমিই আমাকে লজ্জা দেবে (চক্ষু মুছিয়া) তুমি শান্ত না হইলে আমি ঘরের বাহিরে যেতে পারিনে —
(আদুরীর প্রবেশ।)
আদুরী। তুমি কত্তি লেগেচো কি? বড় হালদার্ণি যে ঘাটে যাতি পাচ্চে না; বল্লে কি, ঝার পানে চাই তানারি মুখ তােলো হাঁড়ি —
সর। (দীর্ঘ নিশ্বাস) চল যাই।
আদুরী। তেলে দেক্চি অ্যাকন হাত দেউনি। চূলগল্লাডা কাদা হতি লেগেছে; চিটিখান অ্যাকন ছাড়নি —ছােট হালদার ক্যাত চিটিতি মাের নাম ন্যাকে দেয়।
সর। বড় ঠাকুর নেয়েছেন?
আদুরী। বড় হালদার যে গাঁয় গ্যাল, জ্যালায় যে মকদ্দমা হতি লেগেছে, তােমার চিটিতি ন্যাকিনি — কত্তামশা যে কান্তি নেগ্লো।
সর। (স্বগত) প্রাণনাথ, সফল না হইলে যথার্থই মুখ দেখাইতে পারিবে না, (প্রকাশে) চল রান্না ঘরে গিয়ে তেল মাখি।
দ্বিতীয় অঙ্ক।
তৃতীয় গর্ভাঙ্ক।
সরপুর তেমাতা পথ।
(পদী ময়রাণীর প্রবেশ)
পদী। আমিন আঁটকুড়ির বেটাইতাে দেশ মজাচ্ছে। আমার কি সাধ, কচি কচি মেয়ে সাহেবেরে ধরে দিয়ে আপনার পায় আপনি কুড়ুল মারি — রেয়ে যে খেঁটে এনেছিল, সাধুদাদা না ধর্লিই জম্মের মত ভাত কাপড় দিত — আহা! ক্ষেত্রমণির মুখ দেখলে বুক ফেটে যায় — উপপতি করিছি বলে কি আমার শরীরে দয়া নেই— আমারে দেখে ময়রা পিসি, ময়রা পিসি, বলে কাছে আসে। এমন সােণার হরিণ, মা নাকি প্রাণ ধরে বাঘের মুখে দিতে পারে।— ছােট সাহেবের আর আগায় না, আমি রয়েছি, কলিবুনো রয়েছে—মাগাে কি ঘৃণা, টাকার জন্যে জাত জন্ম গেলো, বুনাের বিছানা ছুঁতে হলো — বড় সাহেব ড্যাক্রা আমারে দ্যাক্মার করেছে, বলে নাক কান কেটে দেবে — ড্যাক্রার ভমরতি হয়েছে, ভাতার খাগির ভাতার মেয়ে মানুষ ধরে গুদমে রাখ্তে পারে, মেয়ে মান্ষের পাছায় নাতি মার্তে পারে, ড্যাকরার সে রকমতাে এক দিন দেখ্লাম না। যাই আমিন কালামুখরে বলিগে, আমারে দিয়ে হবে না—আমার কি গাঁয় বেরােবার যো আছে, পাড়ার ছেলে আঁটকুড়ির বেটারা আমারে দেখ্লে যেন কাকের পিছনে ফিঙ্গে লাগে। (নেপথ্যে গীত।)
“যখন ক্ষ্যাতে, ক্ষ্যাতে বসে ধান কাটি।
মাের মনে জাগে, ও তার লয়ান দুটি॥”
(এক জন রাখালের প্রবেশ)
রাখাল। সায়েব, তােমার নীলির চারায় নাকি পোক ধরেছে?
পদী। তাের মা বনের গে ধরুক, আঁটকুড়ির বেটা, মার্ কোল ছেড়ে যাও, যমের বাড়ী যাও, কল্মি ঘাটায় যাও
রাখাল। মুই দুটো নিড়িন গড়াতি দিইচি—
(এক জন লাঠিয়ালের প্রবেশ)
বাবারে! কুর্টির নেটেলা!
লাঠি। পদ্মমুখি, মিশি মাগগি করে তুল্যে যে।
পদী। (লাঠিয়ালের গােটের প্রতি দৃষ্টি করে) তাের চন্দরহারের যে বাহার ভারি।
লাঠি। জান না প্রাণ, প্যায়দার পােষাক, আর নটীর বেশ।
পদী। তাের কাছে একটা কালাে বক্না চেয়ে ছিলুম, তা তুই আজও দিলিনে। আর কখনতাে ভাই তাের কাছে কিছু চাব না—
লাঠি। পদ্মমুখি, রাগ করিস্নে। আমরা কাল শ্যামনগর লুট্তে যাব, যদি কাল কালাে বক্না পাই, সে তাের গােয়ালঘরে বাঁদা রয়েছে। আমি মাচ নিয়ে যাবার সময় তাের দোকান দিয়ে হয়ে যাব।
পদী। সাহেবদের লুট বই আর কাজ নাই। কম্য়ে জম্য়ে দিলে চাসারাও বাঁচে, তােদেরও নীল হয়। শ্যামনগরের মুন্সীরে ১০ খান জমি ছাড়াবার জন্যে কত মিনতি কল্লে। “চোরা না শুনে ধর্ম্মের কাহিনী।” বড় সায়েব পােড়ারমুখো পােড়ার মুখ পুড়্য়ে বসে রলাে।
(চারিজন পাঠশালার শিশুর প্রবেশ)
ময়রাণী লো সই। নীল গেঁজোছো কই।
ময়রাণী লো সই। নীল গেঁজোছো কই।
ময়রাণী লো সই। নীল গেঁজোছো কই।
পদী। ছি বাবা কেশব, পিসি হই এমন কথা বলে না —
৪জন শিশু। (নৃত্য করিয়া)
ময়রাণী লো সই। নীল গেঁজোছো কই।
পদী। ছি দাদা অম্বিকে, দিদিকে ওকথা বল্তে নাই—
৪জন শিশু। (পদী ময়রাণীকে ঘুরে নৃত্য)
ময়রাণী লো সই। নীল গেঁজোছো কই।
ময়রাণী লো সই। নীল গেঁজোছো কই।
ময়রাণী লো সই। নীল গেঁজোছো কই।
নবীন মাধবের প্রবেশ)
পদী। ওমা কি লজ্জ্বা! বড়বাবুকে মুখ খান দেখালাম।
নবীন। দুরাচারিণী, পাপীয়সি — (শিশুদের প্রতি) তােমরা পথে খেলা করিতেছ, বাড়ী যাও অনেক বেলা হইয়াছে—
আহা! নীলের দৌরাত্ম্য যদি রহিত হয়! তবে আমি পাঁচ দিবসের মধ্যে এই সকল বালকদের পাঠের জন্যে স্কুল স্থাপন করিয়া দিতে পারি। এপ্রদেশের ইনিস্পেক্টর বাবুটি অতি সজ্জন, বিদ্যা জন্মিলে মানুষ কি সুশীল হয়; বাবুজি বয়সে নবীন বটেন, কিন্তু কথায় বিলক্ষণ প্রবীণ। বাবুজির নিতান্ত মানস, এখানে একটী স্কুল স্থাপন হয়। আমি এ মাঙ্গলিক ব্যাপারে অর্থ ব্যয় করিতে কাতর নই, আমার বড় আটচালা পরিপাটী বিদ্যামন্দির হইতে পারে, দেশের বালকগণ আমার গৃহে বসিয়া বিদ্যার্জ্জন করে, এর অপেক্ষা আর সুখ কি, অর্থের ও পরিশ্রমের সার্থকতাই এই। বিন্দুমাধব, ইনিস্পেক্টর বাবুকে সমভিব্যাহারে আনিয়াছিল, বিন্দুমাধবের ইচ্ছা, গ্রামের সকলেই স্কুল স্থাপনে সমােদ্যোগী হয়। কিন্তু গ্রামের দুর্দ্দশা দেখে ভায়ার মনের কথা মনেই রহিল — বিন্দু আমার কি ধীর, কি শান্ত, কি সুশীল, কি বিজ্ঞ, অল্প বয়েসের বিজ্ঞতা চারা গাছের ফলের ন্যায় মনােহর। ভায়া লিপিতে যে খেদোক্তি করিয়াছেন তাহা পাঠ করিলে পাষাণ ভেদ হয়, নীলকরেরও অন্তঃকরণ আর্দ্র হয়।—বাড়ী যাইতে পা উঠে না, উপায় আর কিছু দেখি নে, পাঁচ জনের এক জনও হস্তগত করিতে পারিলাম না, তাহাদের কোথায় লইয়া গিয়াছে কেহই বলিতে পারে না। তোরাপ্ বোধ করি কখনই মিথ্যা বলিবে না। অপর চারি জন সাক্ষ্য দিলেই সর্ব্বনাশ, বিশেষ আমি এপর্য্যন্ত কোন যোগাড় করতে পারি নাই, তাহাতে আবার মাজিষ্ট্রেট সাহেব উড্ সাহেবের পরম বন্ধু।
(এক জন রাইয়ত দুই জন ফৌজদারীর পিয়াদা এবং কুটির তাইদগিরের প্রবেশ)
রাইয়ত। বড়বাবু, মোর ছেলেদুটোরে দেখো, তাদের খাওয়াবার আর কেউ নেই—গেল সন্ আট গাড়ি নীল দেলাম, তার একটা পয়সা দেলে না, আবার বকেয়াবাকী বলে হাতে দড়ী দিয়েছে, আবার আন্দারাবাদ নিয়ে যাবে —
তাইদ। নীলের দাদন ধোপার ভ্যালা, এক বার লাগ্লে আর ওটে না — তুই বেটা চল, দেওয়াঞ্জির কাছ দিয়ে হোয়ে যেতি হবে — তোর বড় বাবুরও এমনি হবে।
রাইয়ত। চল্ যাব, ভয় করিনে, জেলে পচে মর্বো তবু গোড়ার নীল কর্বো না — হা বিদেতা২, কাঙ্গালেরে কেউ দেখে না (ক্রন্দন) বড় বাবু, মোর ছেলে দুটোরে খাতি দিওগো, মোরে মোটেত্তে ধরে আন্লে তাদের এক বার দ্যাক্তি পালাম না।
(রাইচরণের প্রবেশ)
রাই। দাদা না ধল্লিই গোড়ার মেয়েরে দাম ঠাস করেলাম, মেরেতো ফ্যাল্তাম ত্যাকন না হয় ৬ মাস ফাঁসি য্যাতাম শালি।—
নবীন। ও রাইচরণ, কোথায় যাস?
রাই। মাঠাকুরুণ পূট ঠাকুরকে ডেকে আন্তি বল্লে পদী গুড়ি বল্লে তলপের প্যায়দা কাল আস বে।
নবীন। হা বিধাতঃ! এ বংশে কখন যা না হইয়াছিল তাই ঘটিল — পিতা আমার অতি নিরীহ, অতি সরল, অতি অকপট-চিত্ত, বিবাদ বিসম্বাদ কারে বলে জানেন না, কখন গ্রামের বাহির হন না, ফৌজদারীর নামে কম্পিত হন, লিপি পাঠ করে চক্ষের জল ফেলিয়াছেন, ইন্দ্রাবাদে যাইতে হইলে ক্ষিপ্ত হইবেন, কয়েদ হলে জলে ঝাঁপ দিবেন। হা! আমি জীবিত থাকিতে পিতার এই দুর্গতি হবে। মাতা আমার পিতার ন্যায় ভীতা নন, তাঁহার সাহস আছে, তিনি একেবারে হতাশ হন না, তিনি একাগ্রচিত্তে ভগবতীকে ডাকিতেছেন। কুরঙ্গনয়না আমার দাবাগ্নির কুরঙ্গিনী হয়েছেন, ভয়ে ভাবনায় পাগলিনীপ্রায়, নীলকুটির গুদামে তাঁর পিতার পঞ্চত্ব হয়, তাঁর সতত চিন্তা, পাছে পতির সেই গতি ঘটে। আমি কত দিকে সান্তনা করিব, সপরিবারে পলায়ন করা কি বিধি, না, পরোপকার পরম ধর্ম্ম, সহসা পরাঙ্মুখ হব না, —শামনগরের কোন উপকার করিতে পারিলাম না, চেষ্টার অসাধ্য ক্রিয়া কি, দেখি কি করিতে পারি—
(দুই জন অধ্যাপকের প্রবেশ)
প্রথম। ওহে বাপু, গোলোকচন্দ্র বসুর ভবন এই পল্লীতে বটে —পিতৃব্যের প্রমুখাত্ শ্রুত আছি বসুজ বড় সাধু ব্যক্তি, কায়স্থকুলতিলক।
নবীন। (প্রণিপাত করিয়া) ঠাকুর, আমি তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র।
প্রথম। বটে, বটে, আহা হা, সাধু সাধু, এবম্বিধ সুসন্তান সাধারণ পূণ্যের ফল নয়; যেমন বংশ——
“অস্মিৎস্তু নিগুর্ণং গােত্রে নাপত্যমুপজায়তে।
আকরে পদ্মরাগাণাং জন্ম কাচমণেঃ পুতঃ।”
শাস্ত্রের বচন ব্যর্থ হয় না, তর্কালঙ্কার ভায়া শ্লোকটা প্রণিধান করিলে না, হঃ, হঃ, হঃ, (নস্য গ্রহণ)
দ্বিতীয়। আমরা সৌগন্ধ্যার তারবিন্দ বাবুর আহূত, অদ্য গােলােকচন্দ্রের আলয়ে অবস্থান, তােমারদিগের চরিতার্থ করিব।
নবীন। পরম সৌভাগ্যের বিষয় এই পথে চলুন।