নেতাজীর জীবনী ও বাণী/ব্যক্তিত্ব ও সমষ্টিগত সাধনা
ব্যক্তিত্ব ও সমষ্টিগতসাধনা
সমাজ বা রাষ্ট্রের উন্নতি নির্ভর করে একদিকে ব্যক্তিত্বের বিকাশের উপর এবং অপরদিকে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার শক্তির উপর। আমাদের একদিকে খাঁটি মানুষ সৃষ্টি করিতে হইবে এবং সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ করিতে শিখিতে হইবে। সমগ্র সমাজের উন্নতি না হইলে একমাত্র ব্যক্তির উন্নতির দ্বারা বিশেষ ফল হয় না। এরূপ ব্যক্তিগত উন্নতির বেশী মূল্য থাকে না। সামাজিক জীবনে যে আদর্শের স্থান নাই সেই আদর্শের বেশী মূল্য নাই। ব্যক্তিত্ব ফুটাইবার জন্য যেরূপ গভীর সাধনা আবশ্যক, সামাজিক বৃত্তির বিকাশের জন্য সেরূপ সাধনার প্রয়োজন। আমাদের সমাজে কতকগুলি anti-social (বা সমাজ গঠন বিরোধী) বৃত্তি প্রবেশ করিয়াছিল যাহার ফলে আমরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ করিবার শক্তি ও অভ্যাস হারিয়েছিলাম, যেমন সন্ন্যাসের প্রতি আগ্রহ আমাদিগের মধ্যে সমাজের ও রাষ্ট্রের বন্ধন শিথিল করিল এবং সমাজ বা রাষ্ট্রের উন্নতি অপেক্ষা নিজের মোক্ষলাভ শ্রেয়ঙ্কর বিবেচিত হইল।
আমার নিজের মনে হয় যে স্বার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতা, উশৃঙ্খলতা প্রভৃতি সমাজ বিরোধী বৃত্তির জন্যই আমরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ করিতে পারি না। ......আমাদের বর্তমান পরাধীনতা ও সকল প্রকার দুর্দ্দশার মধ্যে যে কত মহাপুরুষ জন্মাইতেছেন তার একমাত্র কারণ যে খাঁটি মানুষ সৃষ্টির প্রচেষ্টা আমাদের জাতি কোনদিনই ভুলে নাই। কিন্তু আমরা ভুলিয়া গিয়াছিলাম Collective Sadhana বা সমষ্টিগত সাধনা। আমরা ভুলিয়া গিয়াছিলাম যে জাতিকে বাদ দিয়া যে সাধনা সে সাধনার কোন সার্থকতা নাই। তাই সমাজ গঠন-বিরোধী বৃত্তি আমাদের মানসক্ষেত্রে জন্মিয়াছে এবং ঐরূপ প্রতিষ্ঠান পরগাছার মত আমাদের জাতীয় জীবনকে ভারগ্রস্থ ও শক্তিহীন করিয়া তুলিয়াছে। আজ বাংলার তরুণ সমাজকে রুদ্রের মত বলিতে হইবে—জাতি-সমাজ-গঠন-বিরোধী বৃত্তি নিচয় আমরা কুসংস্কার জ্ঞানে বিষবৎ পরিত্যাগ করিব এবং জাতি-সমাজ-গঠনের প্রতিকূল সমস্ত প্রতিষ্ঠান আমরা একেবারে নির্ম্মুল করিব।
বর্তমান যুগে যুগোপযোগী সাধনায় যদি প্রবৃত্ত হইতে হয় তবে দেশাত্মবোধকেই জাতির আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করিতে হইবে।