নেতাজী সুভাষ চন্দ্র/বাল্য-জীবন
নেতাজী সুভাষচন্দ্র
এক
বাল্য-জীবন
জন্ম—মাতাপিতা—প্রথম বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ।
বাংলার সুসন্তান, দেশ-মাতৃকার একনিষ্ঠ সেবক অলােকসামান্য ত্যাগী, সুখে-দুঃখে নিঃস্পৃহ, বাঙ্গালী বীর, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু মহাশয় ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দের ২৩শে জানুয়ারী মহানদীর তীরবর্ত্তী কটক শহরে স্বর্গচ্যুত মন্দার-কুসুমের মত ধূলি-মলিন ধরণী-বক্ষে এক শুভ মুহূর্ত্তে সর্ব্বপ্রথম সূর্য্যালােককে অভিনন্দিত করেন।
এই দিন যে নবীন জ্যোতিষ্ক ভারতের ভাগ্য-গগনে সমুদিত হইল, তাহার বিমল দ্যুতি আজ ভারতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত পরিপূর্ণ বিকীর্ণ, এবং তাহার প্রভাবে, আজ শুধু আসমুদ্রহিমাচল নহে, প্রতীচির শ্বেতদ্বীপ পর্য্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে!
সুভাষচন্দ্রের পিতার নাম জানকীনাথ বসু এবং মাতার নাম প্রভাবতী বসু। বসু-পরিবারের আদি নিবাস জেলা চব্বিশ-পরগণার অন্তর্গত কোদালিয়া গ্রামে। জানকীনাথ বাংলাদেশ ত্যাগ করিয়া সুদূর কটকে ব্যবহারাজীবের কার্য্যে যোগদান করেন। এই স্থানে ভাগ্যলক্ষ্মীর অপার করুণা তাঁহার উপর বর্ষিত হইতে থাকে। ধীরে-ধীরে তিনি স্থানীয় উকিলগণের শীর্ষস্থান অধিকার করিয়া বার-লাইব্রেরীর নেতৃত্ব এবং গভর্নমেণ্ট প্লীডারের পদ পর্য্যন্ত লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার কার্য্যে সন্তুষ্ট হইয়া গভর্নমেণ্ট তাহাকে “রায় বাহাদুর” উপাধি দ্বারা সমলংকৃত করেন।
জানকীনাথ নিজে যেরূপ বিদ্বান্ ও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন, তিনি স্বীয় পুত্রগণকেও অনুরূপভাবে শিক্ষিত করিবার প্রয়াস পান। ব্যবহারাজীবের কার্য্যে উপার্জ্জিত বিপুল অর্থ তিনি পুত্রগণের সুশিক্ষার জন্য অকাতরে ব্যয় করিয়াছেন। তাঁহার আটটি পুত্র এবং ছয়টি কন্যার মধ্যে দুইটি পুত্র এবং চারিটি কন্যা পূর্ব্বেই পরলোক গমন করিয়াছেন; অবশিষ্ট ছয়টি পুত্রের নাম—সতীশচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, সুধীরচন্দ্র, সুরেশচন্দ্র, সুনীলচন্দ্র এবং সুভাষচন্দ্র।
জানকীনাথ পুত্রগণের প্রত্যেককে শিক্ষাদানের জন্য ইয়োরোপে পাঠাইতে দ্বিধা বোধ করেন নাই; কারণ, তিনি বুঝিয়াছিলেন,—পাশ্চাত্ত্য শিল্প, বিজ্ঞান ও শিক্ষা আয়ত্ত করিতে না পারিলে, এবং যে সমস্ত জাতি বর্ত্তমান জগতে প্রভাব বিস্তার করিয়া বড় হইয়াছে তাহাদের সংস্পর্শে না আসিলে, জগতের বুকে মানুষের মত দাঁড়ান সম্ভব নহে।
জানকীনাথের ইচ্ছা আজ পরিপূর্ণ হইয়াছে—তাঁহার সকল পুত্রই কৃতবিদ্য; তম্মধ্যে দুই পুত্র—সুভাষচন্দ্র ও শরৎচন্দ্রের যশোরশ্মি সূর্য্য ও পূর্ণচন্দ্রের মত ভাৱতাকাশ চির-দীপ্তিতে সমুদ্ভাসিত রাখিবে।
জানকীনাথ নিজে অত্যন্ত তেজস্বী ছিলেন। গভর্ণমেণ্ট প্লীডার এবং গভর্ণমেণ্টের উপাধিধারী হইলেও তিনি কোন দিন গভর্ণমেণ্টের অন্যায় কার্য্য সমর্থন করিতে পারেন নাই। আইন-অমান্য আন্দোলনের সময় গভর্ণমেণ্ট যখন প্রচণ্ডভাবে দমন-নীতির প্রয়োগ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, তখন তেজস্বী জানকীনাথ গভর্ণমেণ্টের এই কার্য্যের প্রতিবাদ-স্বরূপ “রায় বাহাদুর” উপাধি বর্জ্জন করিতেও কুণ্ঠা বোধ করেন নাই। পিতার এই তেজস্বিতা এবং স্বাধীনচিত্ততা পুত্র সুভাষচন্দ্রের মধ্যে পূর্ণভাবে সংক্রমিত হইয়াছিল।
জানকীনাথ পঁচাত্তর বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন। সুভাষচন্দ্রের জননী প্রভাবতী সর্ব্বাংশে স্বামীর অনুরূপ ছিলেন। তাঁহার অসামান্য দয়া, মায়া, স্নেহ প্রভৃতি চারিত্রিক সদ্গুণরাজি তাঁহার পুত্র-কন্যাগণের—বিশেষতঃ সুভাষচন্দ্রের মধ্যে সমুজ্জ্বলভাবে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল।
তিনি আদর্শ হিন্দু রমণী ছিলেন; কিন্তু সুশিক্ষার জন্য পুত্র-কন্যাগণের ইয়োরোপ গমনে কখনও বাধা প্রদান করেন নাই। দীন-দরিদ্রের দুঃখ-দুর্দ্দশা দর্শনে তাঁহার হৃদয় বিগলিত হইত এবং তিনি সর্ব্বদাই মুক্তহস্তে তাহাদের দুঃখ-মোচনে নিরত থাকিতেন। পরবর্ত্তীকালে বিভিন্ন কর্ম্মক্ষেত্রে মাতার এই পরদুঃখ-কাতরতাও সুভাষচন্দ্রের মধ্যে আত্ম-বিকাশ করিয়াছিল। বিগত ১৯৪৩ খৃষ্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর তারিখে শরৎচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্রের জননী প্রভাবতী দেবী ছিয়াত্তর বৎসর বয়সে হিন্দুর চির-আকাঙ্ক্ষিত স্বর্গে গমন করিয়াছেন।
পাঁচ বৎসর বয়সে সুভাষচন্দ্র কটকের প্রটেষ্টাণ্ট ইয়োরোপীয়ান্ স্কুলে ভর্ত্তি হন। এই বিদ্যালয়ে তিনি দ্বাদশ বৎসর বয়স পর্য্যন্ত অধ্যয়ন করিয়াছিলেন।
সুভাষচন্দ্রের বাল্য-জীবনের এই ছয়-সাত বৎসর, সমগ্র জীবনের অতি সামান্য অংশ হইলেও, চরিত্র-গঠনে ইহা তাঁহাকে নিতান্ত কম সাহায্য করে নাই। পাশ্চাত্ত্য মানব-চরিত্রের দোষ-গুণ তিনি অতি মনোযোগর সঙ্গেই লক্ষ্য করিতে পারিয়াছিলেন। পাশ্চাত্ত্যের সজীবতা ও নিজেদের জড়তা তিনি নিজের অন্তরে অনুভব করিয়া ক্ষুন্ন হইয়া পড়িতেন। আর সঙ্গে-সঙ্গে সমস্ত দুর্ব্বলতা, গ্লানি ও অপমান এক মুহূর্ত্তে দূরে নিক্ষেপ করিয়া সিংহ-বিক্রমে জগতে দণ্ডায়মান হইবার আকাঙক্ষায় অনুপ্রাণিত হইয়া উঠিতেন! আর তখন হইতেই কি এক দৃঢ় সঙ্কল্পের নির্ম্মম গুরুভার তাঁহার ভবিষ্যৎ জীবনের সুপ্ত ভাবরাশিকে মহানদীর তরঙ্গ-কল্লোলে প্রতিধ্বনিত করিয়া, তাঁহাকে উন্মনা করিয়া তুলিত!
সুভাষচন্দ্র বাক্যকাল হইতে চিন্তাশীল ছিলেন। বিদ্যাশিক্ষার প্রতি তাঁহার অনুরাগও বাল্যকাল হইতেই পরিলক্ষিত হইত। লেখাপড়ার জন্য তাঁহাকে কোনদিন কোনরূপ তাড়না করিতে হয় নাই। স্বাভাবিক সংস্কার-বশেই যেন তিনি পাঠ্য পুস্তক লইয়া বসিতেন! দীন-দরিদ্রের দুঃখ-মোচনের আন্তরিক ইচ্ছা, আর্ত্তের পরিত্রাণ-কামনা, রোগীর রোগ-শয্যায় শুশ্রূষা করিবার অভিলাষ, মোট কথা, সমগ্রভাবে জনসাধারণের তথা জননী জন্মভূমির সেবার আকাঙ্ক্ষা, তাঁহার অন্তরলোকে বিকশিত হইয়া উঠিত; কিন্তু তখনও তাহার বাহ্য-বিকাশ তেমন দেখা যাইত না। এক কথায় বলা চলে—তাঁহার বৃহত্তর জীবনের ছায়া যেন সেই বাল্য-জীবনেই প্রতিফলিত হইয়া উঠিত। এই প্রসঙ্গে স্বতঃই মনে পড়ে পাশ্চাত্ত্য অন্ধ মহাকবির অমর বাণী-
"Childhood shows the man,
As morning shows the day."