নেতাজী সুভাষ চন্দ্র/বিদ্যার্থি-জীবন

দুই

বিদ্যার্থি জীবন

র‍্যাভেন্‌শা কলেজিয়েট স্কুলে—রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রভাব—বেণীমাধব দাসের প্রভাব—ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা—ধর্ম্মভাবের প্রাবল্য—তেজস্বীতার প্রথম বিকাশ—বি. এ. উপাধি লাভ—আই. সি. এস্.—কেম্ব্রিজের বি. এ.।

দ্বাদশ বৎসর বয়ঃক্রমকালে সুভাষচন্দ্রকে প্রটেষ্টাণ্ট ইয়োরোপীয়ান স্কুল হইতে লইয়া আসিয়া র‍্যাভেন্‌শা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্ত্তি করিয়া দেওয়া হয়। বর্ষার বারিধারা-সম্পাতে সুপ্ত বীজ যেমন অঙ্কুরিত হইয়া উঠে, এইবার সময় এবং সুযোগের প্রভাবে সুভাষচন্দ্রের মনোজগতে সেইরূপ সুপ্ত বৃত্তিসমূহ জাগিয়া উঠিল।

 এতদিন ইয়োনরাপীয় স্কুলে বিদ্যাভ্যাসে নিরত থাকায়, ঠিক জাতীয় ধর্ম্মভাবের প্রেরণা তিনি লাভ করিতে পারেন নাই। র‍্যাভেন্‌শা কলেজিয়েট স্কুলে আসিবার পর হইতে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সুমধুর উপদেশাবলীর সহিত তিনি পরিচিত হইতে আরম্ভ করেন; সঙ্গে-সঙ্গে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের প্রধান শিষ্য ও বাণী-প্রচারক ভারতের অন্যতম গৌরব ও দেশমাতৃকার অন্যতম সুসন্তান স্বামী বিবেকানন্দের কার্য্যাবলী তাঁহাকে অনুপ্রাণিত করিতে আরম্ভ করে।

 চুম্বকের আকর্ষণে লৌহ যেমন তাহার দিকে আকৃষ্ট হয়, তেমনি স্বামী বিবেকানন্দ-প্রবর্ত্তিত রামকৃষ্ণ মিশনের সেবাকার্য্যের দিকে কিশোর সুভাষচন্দ্রও ঢলিয়া পড়িলেন। তিনি সেকেণ্ড ক্লাসে পড়িতেন, তখনই তিনি রোগীর শুশ্রূষায়, দুঃখীর দুঃখ-মোচনে এবং দরিদ্রের সেবায় দিবসের অধিকাংশ সময় কাটাইয়া দিতেন।

 এই সময় কটক র‍্যাভেন্‌শা কলেজিয়েট স্কুলের হেড্‌মাষ্টার ছিলেন শ্রীযুক্ত বেণীমাধব দাস এম্‌ এ.। ইনি পরে কলিকাতা সংস্কৃত কলেজিয়েট্‌ স্কুল হইতেই পেন্‌সন্‌ গ্রহণ করেন।

 ইনি অত্যন্ত ধার্ম্মিক ও স্বদেশপ্রেমিক ছিলেন। ইহার জন্মস্থান চট্টগ্রাম। ইহার কন্যা শ্রীমতী বীণা দাস কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে মহামান্য গভর্ণর বাহাদুরকে গুলি করিয়া রাজদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিলেন। সম্প্রতি তাঁহাকে মুক্তিদান করা হইয়াছে।

 শ্রীযুক্ত বেণীমাধব দাস মহাশয় সুশিক্ষক বলিয়া বিশেষ খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। এতদ্ভিন্ন তাঁহার সরল অমাটি ব্যবহার এবং ছাত্রগণের প্রতি সস্নেহ আচরণ তাঁহাকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করিয়া তুলিয়াছিল। কাহারও কোনরূপ দোষ-ত্রুটি দেখিলে তিনি প্রথমে মিষ্ট ব্যবহারে তাহা সংশোধনের প্রয়াস পাইতেন। উহাতে কোনরূপ ফল না হইলে পরে শৃঙ্খলা-রক্ষার্থ কঠোরতা অবলম্বনও দ্বিধা-বোধ করিতেন না।  গুরুর এই দুইটি সদ্‌গুণ—কোমল ও কঠোরের অপূর্ব্ব সংমিশ্রণ-শিষ্য সুভাষচন্দ্রে সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হইয়াছিল। মহাকবি ভবভূতির ভাষায় বলা যায়, তিনি ছিলেন-

“বজ্রদপি কঠোরাণি মৃদুনি কুসুমাদপি।
লােকোত্তরাণাং চেতাংসি কোহি বিজ্ঞাতুমীশ্বরঃ॥”

 ১৯১৩ খৃষ্টাব্দে সুভাষচন্দ্র কটক র‍্যাভেন্‌শা কলেজিয়েট স্কুল হইতে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা প্রদান করেন। এই পরীক্ষায় তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়া বৃত্তি লাভ করেন। এইবার মহানদীর তীর হইতে বাসভূমি জাহ্নবীর তীরে পরিবর্ত্তিত হইল—কটক ত্যাগ করিয়া তিনি বিদ্যাশিক্ষার্থ কলিকাতা আগমন করিলেন এবং প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্ত্তি হইলেন।

 প্রেসিডেন্সী কলেজে আই. এ. পড়িবার সময় স্বামী বিবেকানন্দের ন্যায় তিনিও তাঁহার বুকের মাঝে কি এক নিদারুণ অশান্তি ও অতৃপ্তি অনুভব করিতে লাগিলেন! কণ্টক-শষ্যায় যাঁহার ভবিষ্যৎ বিশ্রাম, তিনি কি কখনও ধনীর দুলালের ন্যায় তৃপ্তি লাভ করিতে পারেন? শীঘ্রই তাঁহার মনোজগতে এক ধর্ম্মভাবের প্রাবল্য উপস্থিত হইল। বাহ্যজগতে পার্থিব বিষয়ে উন্নতি অপেক্ষা আত্মার মুক্তি উজ্জ্বলতর হইয়া ফুটিয়া উঠিল। গৃহে বাস তাঁহার নিকট বন্ধনরূপে দেখা দিল।

 যে রহস্য মীমাংসার জন্য বুদ্ধদেব একদিন রাজ্যৈশ্বর্য্য ত্যাগ করিয়া ভিক্ষু সাজিয়াছিলেন, যে ভূমানন্দের প্রত্যাশায় নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিত তাঁহার পাণ্ডিত্য-খ্যাতি, সুন্দরী স্ত্রী, স্নেহশীলা জননী প্রভৃতি ত্যাগ করিয়া নীলাচলের পথে-পথে গাহিয়া বেড়াইতেন

“ন ধনং, ন জনং, ন সুন্দরীং, কবিতাং বা জগদীশং কাময়ে”—

সুভাষচন্দ্রের প্রাণেও সে রহস্য-মীমাংসার চিন্তা সমুদিত হইল, সে ভূমানন্দ লাভের আকাঙ্ক্ষা জাগরিত হইল।

 তিনি আর গৃহে থাকিতে পারিলেন না—আত্মীয়-স্বজনের অজ্ঞাতসারে সদ্‌গুরু লাভ করিয়া জীবন কৃতার্থ করিবার অভিপ্রায়ে গৃহত্যাগ করিয়া প্রব্রজ্যা অবলম্বন করিলেন। ভারতের বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে পরিভ্রমণ করিয়া জটাজুট-বিমণ্ডিত বিভূতি-ভূষিত সন্নাসি-মহলে তিনি সদ্‌গুরুর অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। কিন্তু বিধাতা তাঁহাকে বুদ্ধ, চৈতন্য, কবির, নানক, তুলসীদাস, বিজয়কৃষ্ণ প্রভৃতি মহাপুরুষগণের পদধূলি-বিরঞ্জিত ক্ষুণ্ণ মার্গে বিচরণ করিবার জন্য সৃষ্টি করেন নাই—তাঁহার কর্ম্মক্ষেত্র ছিল সম্পূর্ণ বিভিন্ন। পর-পদানতা শৃঙ্খলিতা স্বদেশ-জননী যেন মলিন-বদনে তাঁহারই মুখের দিকে কাতর ভাবে দৃষ্টিপাত করিয়া ছিলেন! সেই জন্য তিনি গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর দলে মিশিয়াও ঠিক মনের মত গুরুর দর্শন পাইলেন না। সুতরাং তিনি গৃহে ফিরিয়া সুবােধ বালকের ন্যায় আবার পাঠ্য পুস্তকে মনঃসংযোেগ করিলেন।

 ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে তিনি আই. এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং দর্শন শাস্ত্রে অনার্স লইয়া প্রেসিডেন্সী কলেজেই বি. এ. পড়িতে থাকেন।

 সুভাষচন্দ্র যখন তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে অধ্যয়ন করিতেন, তৎকালে ই. এফ্. ওটেন মহােদয় প্রেসিডেন্সী কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন[] এবং এইচ্. আর. জেম্‌স্‌ ছিলেন প্রিন্সিপ্যাল। ই. এফ্. ওটেন মহােদয় পরে বাংলার ডিরেক্টর অফ্ পাবলিক ইন্‌স্ট্রাক্‌শন্‌স্‌-এর পদ অলঙ্কত করিয়াছিলেন।

  মিঃ ওটেন অনেক সময় ভারতীয় ছাত্রদের মনােবৃত্তি আহত করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। ইহাতে সুভাষচন্দ্র জীবনে প্রথম শাসকজাতির গর্ব্ব এবং ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইলেন এবং তাঁহার জীবনে এই প্রথম পুঁথিগত নীতি ও পুঁথিগত স্বদেশপ্রেম কর্ম্মক্ষেত্রে ভীষণ পরীক্ষার সম্মুখীন হইল; এবং যখন তিনি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া অক্ষত শরীরে বাহির হইয়া আসিলেন, তখন তাঁহার ভবিষ্যৎ জীবন চিরকালের জন্য নির্দ্ধারিত হইয়া গেল।[]

 অধ্যাপক মিঃ ওটেনকে প্রহার করার অভিযােগে সুভাষচন্দ্র অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য প্রেসিডেন্সী কলেজ তথা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বিতাড়িত হন। পরে শিক্ষাব্রতী পুরুষসিংহ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয় এই বিষয়ে অবহিত হন। তাঁহার প্রচেষ্টায় সুভাষচন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় হইতে আবার অধ্যয়ন করিবার অনুমতি লাভ করিলেন।

 সুভাষচন্দ্র এবার আর প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্ত্তি হইলেন না, তিনি স্কটিশ-চার্চ্চ কলেজে ভর্ত্তি হইলেন এবং ১৯১৯ খৃষ্টাব্দে দর্শনশাস্ত্রের অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়া বি. এ. উপাধি লাভ করেন। অতঃপর তিনি ব্যবহারিক মনোবিজ্ঞানে এম্. এ. পড়িতে আরম্ভ করিলেন।

 সুভাষচন্দ্রের সমগ্র পরিবারই উচ্চশিক্ষিত। সুতরাং তাঁহারা সুভাষচন্দ্রের ন্যায় মেধাবী ছাত্রকে বাঙ্গালী জীবনের ইন্দ্রত্ব করিবার উদ্দেশ্যে, আই. সি. এস্. পরীক্ষার প্রস্তুত হইবার জন্য ইংলণ্ডে যাইতে আদেশ করেন।

 সুভাষচন্দ্র অভিভাবকের আদেশ কোন দিনই লঙ্ঘন করেন নাই; রণক্ষেত্রের সৈনিকের মত তিনি ঊর্দ্ধতন ব্যক্তির আদেশ চিরকালই অবনত মস্তকে পালন করিতেন। সুতরাং অভিভাবকের সন্তোষ-বিধানার্থ তিনি ১৯১৯ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ইণ্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের প্রতিযোগিতা-পরীক্ষা প্রদানার্থ ইংলণ্ড যাত্রা করেন।

 ইংলণ্ডে উপনীত হইবার আট মাস পরে তিনি ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা প্রদান করেন এবং গুণানুসারে চতুর্থ স্থান অধিকার করিয়া উত্তীর্ণ হন। মাত্র আট মাস পড়িয়া এইরূপ কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এতাদৃশ কৃতিত্ব প্রদর্শন সুভাষচন্দ্রের অসাধারণ প্রতিভার পরিচায়ক।

 কিন্তু আই. সি. এস্. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াও সুভাষচন্দ্র অন্তরে অন্তরে ঠিক আত্ম-প্রসাদ লাভে সমর্থ হন নাই। সেইজন্য তিনি পুনরায় মনো-বিজ্ঞান ও নীতি-বিজ্ঞানে ট্রাইপোজসহ কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বি. এ. পড়িতে আরম্ভ করেন এবং অনতিবিলম্বে উক্ত বিষয়ে ট্রাইপোজসহ বি. এ. উপাধি লাভ করিলেন।

 এইখানেই ব্যবহারিক ভাবে তাঁহার বিদ্যাশিক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে এবং তাঁহার বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের একটি অঙ্কে যবনিকা নিপতিত হয়।


  1. দি ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেটে ই. এফ্. ওটনকে প্রিন্সিপ্যাল বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। উহা ভ্রমাত্মক।}}
  2. {{smaller|“Prof. Oaten was said to have wounded the feelings of the Indian Students and Subhash Chandra, for the first time in his life, made a bold stand against the pride and arrogance of the ruling class and it was the first occasion in his life when his ‘theoretical morality and theoretical patriotism were put to a trial and a very severe test’; and when he came out of the ordeal unscathed, his ‘future career had been chalked out once for all.’” —The Calcutta Municipal Gasette, Vol XLII, No. 16, P. 442 (a)