নেতাজী সুভাষ চন্দ্র/সুভাষ-স্মরণে

নয়

সুভাষ-স্মরণে

সুভাষ-দিবস—সুভাষ-জন্মোৎসব—স্বাধীনতা-দিবস—মেজর-জেনারেল শা নওয়াজের কলিকাতায় আগমন—ভাবের বন্যা।

সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু-সংবাদে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ‘সুভাষদিবস’ প্রতিপালিত হইয়াছে। বোম্বাই প্রথমে ‘সুভাষ-দিবস’ প্রতিপালনে অগ্রণী হইয়াছিল।

 সেদিন বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্রগণ সুভাষচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ক্লাসে অনুপস্থিত ছিল। জি. আই. পি. রেলওয়ের কারখানায় যে সমস্ত কর্ম্মচারী সকালবেলা কাজ করিতে আসিয়াছিল, তাহারা কাজ না করিয়াই গৃহে ফিরিয়া গেল। ছয়টি মিল বন্ধ ছিল, শহরের বাজারও বন্ধ ছিল।

 ২৪শে আগষ্ট তারিখে কলিকাতায় কলেজ স্ট্রীট মার্কেটস্থিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস-কর্ম্মিদলের অ্যাসোসিয়েশন-গৃহে ‘হাফ-মাস্ট’ করিয়া জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হইল। সেদিন বহু বিদ্যালয়ের ছাত্রগণ ক্লাসে যোগদান করে নাই, বড় বাজার ও কলেজ স্ট্রীটে দোকান-পাট বন্ধ ছিল। অপরাহ্ণে বহু ছাত্র রাস্তায় জাতীয় সঙ্গীত গান করিতে-করিতে শোভাযাত্রা করিয়াছিল।

 ‘ইণ্ডিয়ান্ সোশ্যালিষ্ট ষ্টুডেণ্ট ব্যুরো’-অফিসে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। বেঙ্গল প্রভিন্স্যাল মারোয়াড়ী ফেডারেশন অফিস বন্ধ করা হয়। বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্রগণ ক্লাস হইতে বাহির হইয়া আসে এবং ২৫শে আগষ্ট তারিখে শোক-সভায় ‘সুভাষ-দিবস’ প্রতিপালন করে। যাদবপুর কলেজ অফ এঞ্জিনিয়ারিং অ্যাণ্ড টেকনোলজির ছাত্র ও শিক্ষকগণ সম্মিলিত ভাবে এক সভায় নেতাজী সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেন।

 লক্ষ্ণৌ, দিল্লী, করাচী. রাওয়ালপিণ্ডি, সুরাট, পুণা সিটি, কাণপুর, আমেদাবাদ, এলাহাবাদ, পাটনা, লাহোর, নাগপুর, ওয়ার্দ্দা, কটক, জব্বলপুর, শান্তি-নিকেতন, ব্যাঙ্গালোর, সিমলা, ঢাকা প্রভৃতি স্থানে ছাত্রগণ সুভাষ-দিবস প্রতিপালন করিয়াছে। বহু স্থানে পূর্ণ হরতাল অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। এতদ্ভিন্ন নানা স্থানে সভা-সমিতির অনুষ্ঠান হয় ও শোভাযাত্রা করিয়া সকলে মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে।

 ইহার কয়েক মাস পরে, ১৯৪৬ সালের জানুয়ারী মাসে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত শা নওয়াজ খাঁর কলিকাতায় আগমন ও নেতাজী সুভাষচন্দ্রের জন্মোৎসব উপলক্ষে, কলিকাতা মহানগরীর বুকে আনন্দের যে বিপুল উচ্ছ্বাস বহিয়াছিল, সমগ্র পৃথিবীতেই তাহার তুলনা বিরল।

 শা নওয়াজ খাঁ কলিকাতায় আসেন ২২শে জানুয়ামী; ২৩শে জানুয়ারী ছিল নেতাজী সুভাষচন্দ্রের জন্মোৎসব-দিবস; এবং ২৬শে জানুয়ারী ছিল ভারতের স্বাধীনতা-দিবস।

 এই কয়েকটি ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া সমগ্র মহানগরী সেদিন আনন্দে উদ্বেল হইয়া উঠিয়াছিল। নেতাজীর বিশ্বস্ত অনুচর, পরম ভক্ত ও দুর্দ্ধর্ষ বীর শা নওয়াজ খাঁ কলিকাতায় পদার্পণ করিয়াই সর্ব্বাগ্রে নেতাজীর গৃহে উপস্থিত হইলেন; তারপর নেতাজীর ক্ষুদ্র কক্ষে প্রবেশ করিয়াই তিনি যে দৃশ্যের সৃষ্টি করিয়াছিলেন, আজও তাহা মনে হইলে নয়নযুগল হইতে যেন গঙ্গা-যমুনার পুণ্য-প্রবাহ নামিয়া আসে!

 সুসাহিত্যিক শ্রীযুক্ত বিজয়রত্ন মজুমদার মহাশয় তাঁহার অমর লেখনী-নিঃসৃত স্বর্ণাক্ষরে তাহা যে ভাবে গাঁথিয়া রাখিয়াছেন, আমরা তাহারই সামান্য কিছু অংশমাত্র পাঠক-পাঠিকাদিগকে উপহার দিতেছি।

 “সেই কক্ষ। এই কক্ষ-সন্নিধানে সেদিনও জনতা জমিত, আজও জনতা অপেক্ষমান! কেদারার উপরে সুভাষের সেই ছবিখানি!

 শা নওয়াজ খাঁ ভদ্র ও ভাল মানুষটির মত সিঁড়ি দিয়া উঠিলেন, তারপর গৃহে প্রবেশ করিয়া সেই ছবি—তাঁহার নেতাজীর সেই ছবিখানি সবলে বুকে চাপিয়া ধরিয়া, সে কি বালকের কান্না! সেকি নারীর ক্রন্দন! কোথায় ছিল এত জল? পাষাণের তলে সাগরের উচ্ছ্বাস কত দিন ছিল, লুকানাে; কতকাল ছিল, গােপনে? অবরােধে? কে উন্মুক্ত করিয়া দিল অশ্রুর উৎস?

 সুভাষের সেই শয্যা! শ নওয়াজ খাঁ খাটের নীচে জানু পাতিয়া শয্যায় মুখ লুকাইলেন; চোখের জলে চাদর ভিজিল; উপাধান সিক্ত হইল।—

 মেজর-জেনারেল শা নওয়াজ তখনও চাদরে মুখ ঘসিতেছেন, আর অতি মৃদু, অতি ধীর, অপরাধীর কণ্ঠে বলিতেছেন, “নেতাজী, আমি পারি নাই; নেতাজী, আমি পারি নাই (I have failed! I have failed)! নেতাজী, আমায় ক্ষমা করুন, আমি পারি নাই, আমি পারি নাই!”

 নেতাজীর নিকট শা নওয়াজ খাঁ ও সমগ্র আজাদ-হিন্দ্ ফৌজ একদিন স্বাধীনতার যে ব্রত উদ্‌যাপনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিলেন, তাহারই ব্যর্থতা স্মরণ করিয়া, কত ট্যাঙ্ক ও মেশিনগান-বিজয়ী মেজর জেনারেল শা নওয়াজ খাঁর বীরহৃদয় সেদিন গভীর দুঃখে কাঁপিয়া-কাপিয়া উঠিতেছিল।

 এ দৃশ্য বর্ণার নহে, এ দৃশ্য অনুভূতির।

 আজাদ-হিন্দ ফৌজের নিকট নেতাজী সুভাষচন্দ্র যে কি ছিলেন এবং কে ছিলেন, এই একটি মাত্র দৃষ্টান্তেই তাহা সুস্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম করা যায়।