আট

বজ্রপাত

নেতাজীর মৃত্যু-সংবাদ·· বিভিন্ন ব্যক্তির শ্রদ্ধাঞ্জলি।

দুঃখের বিষয়, সমগ্র গৌরবে যিনি অধিকারী, —না জানি তিনি আজ কোথায়? জীবিত কি মৃত, এই প্রশ্ন সকলেরই বুকে আজ খুব বড় আকারে দেখা দিয়াছে! এ অশুভ প্রশ্নের একমাত্র কারণ, বিগত ১৯৪৫ সালের ২৩শে আগস্ট জাপানী নিউজ এজেন্সী সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু-সংবাদ ঘোষণা করিয়াছেন।

 ১৯৪২ সালের মার্চ্চ মাসেও অনুরূপ এক গুজব রটিয়াছিল তখন প্রকাশ হইয়াছিল যে, ‘স্বাধীন-ভারত কংগ্রেসে’ যোগদানের জন্য টোকিও যাইবার পথে সুভাষচন্দ্র বিমান-দুর্ঘটনায় নিহত হইয়াছেন।

 মহাত্মা গান্ধীও এই সংবাদে মর্ম্মাহত হইয়া সুভাষচন্দ্রের আত্মীয়-স্বজনের নিকট সমবেদনা-পূর্ণ এক বাণী প্রেরণ করিয়াছিলেন। পরে যখন প্রতিপন্ন হইল যে এই সংবাদ মিথ্যা, তখন মহাত্মা তাঁহার বাণী প্রত্যাহার করেন; কিন্তু এইবার আর জাপানী নিউজ এজেন্সীর সংবাদ সঠিক ভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন হইতেছে না, দেশবাসীর পক্ষে ইহাই পরম বেদনার বিষয়।

 ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দের ২৩শে আগষ্ট তারিখে জাপানী নিউজ এজেন্সী সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করিয়াছেন। তিনি আকাশ-যান দুর্ঘটনায় আহত হইয়া এক জাপানী হাসপাতালে মারা গিয়াছেন বলিয়া জাপানী নিউজ এজেন্সী জানাইয়াছে।

 জাপ-গভর্ণমেণ্টের সহিত আলোচনা করিবার জন্য অস্থায়ী আজাদ-হিন্দ গভর্ণমণ্টের প্রধান কর্ত্তা সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪৫ সালের ১৬ই আগষ্ট তারিখে বিমানযোগে সিঙ্গাপুর হইতে টোকিও যাত্রা করেন; ১৮ই আগস্ট বেলা ২টার সময় তাইহোকু বিমানক্ষেত্রে তাঁহার বিমানখানি এক দুর্ঘটনায় পতিত হয় এবং তিনি গুরুতররূপে আহত হন। এক জাপানী হাসপাতালে তাঁহার চিকিৎসা হয়—কিন্তু সেখানে মধ্যপথেই তিনি মারা যান। লেফটেন্যাণ্ট জেনারেল সুনামাসা তৎক্ষণাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং সুভাষচন্দ্র বসুর এড্‌জট্যাণ্ট হাবির রহমান ও অপর চারিজন জাপানী অফিসার দুর্ঘটনার ফলে আহত হন।

 জাপানী সূত্রে সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পর্কে সর্ব্বশেষ সংবাদে ইতঃপূর্ব্বে জানা গিয়াছিল, জাপানীদের রেঙ্গুণ পরিত্যাগের শেষ দিনে তিনি রেঙ্গুণ ত্যাগ করেন এবং তাঁহার গভর্ণমেণ্ট ব্যাঙ্ককে স্থানান্তরিত হয়।

 কিন্তু এখনও বহুলোক তাঁহার মৃত্যু-সংবাদ বিশ্বাস করেন না। শিখিল ভারত কংগ্রেস-কমিটির সভায় যে সমস্ত বিশিষ্ট নর-নারী গত অধিবেশনের পর পরলোক গমন করিয়াছেন, শোক-প্রকাশের জন্য তাঁহাদের নামের দীর্ঘ তালিকার মধ্যেও সুভাষচন্দ্র বসুর নাম ছিল না। ইহা দেখিয়া জনৈক সদস্য ঐ বিষয়ে প্রশ্ন করিলে সভাপতি বলেন—“সুভাষবাবুর নাম অন্তর্ভুক্ত না করার কারণ এই যে, তাঁহার মৃত্যু-সংবাদ এখনও নিশ্চিতরূপে সমর্থিত হয় নাই। প্রকৃত সংবাদের অভাবে কাহারও মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা ভাল দেখায় না।”

 সত্য হউক, মিথ্যা হউক, কাহারও মৃত্যু-সংবাদে পরম শত্রুও মিত্ররূপ ধারণ করিয়া অশ্রু-বিসর্জ্জন করে। মৃত্যুর হস্তপর্শে সমস্ত বিদ্বেষ ও শত্রুতা, বিভেদ ও কলহ—কোথায় দূরে সরিয়া যায়! দুর্ব্বল মানব-প্রাণ মৃত ব্যক্তির মঙ্গললাভের জন্য হাহাকার করিয়া কাঁদিয়া উঠে। এইটি চিরন্তন সত্য!

 সুভাষচন্দ্র চলিয়া গিয়াছেন; আজ তাঁহার জন্যও সমগ্র দেশ শোকে অভিভূত!

 তাঁহার মৃত্যুতে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলিয়াছেন:—“আমি আমার এই পুরাতন এবং সাহসী সহকর্ম্মীর মৃত্যু-সংবাদে স্তম্ভিত হইয়াছি। ভারতের প্রতি তাঁহার ভালবাসা কাহারও অপেক্ষা কম নহে ভারতের এই মহৎ সন্তানের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে মিশিবার সুযোগ আমার ১৯২০ খৃষ্টাব্দ হইতে হইয়াছিল এবং তাঁহার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ছিল, ভারতের প্রতি তাঁহার অগাধ ভালবাসা এবং উদ্দেশ্যের সাধুতা সন্দেহের অতীত।”

 সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বলিয়াছেন:—“ভারতের শ্রেষ্ঠ বীর সন্তান এবং দেশহিতব্রতীদের অগ্রণী সুভাষচন্দ্র বসুর ঘটনাবহুল জীবনের আকস্মিক অবসানে সমগ্র দেশ গভীর শোকে আচ্ছন্ন হইয়াছে। এমন কিছুই নাই, যাহা তিনি স্বাধীনতা-সংগ্রামের জন্য উৎসর্গ করেন নাই।”

 শ্রীমতী সরোজিনী নাইডু বলিয়াছেন:—সুভাষ মৃত; বহুবর্ণে চিত্রিত, অদ্ভুত এবং ঘটনাবহুল জীবননাট্যের শেষ বিয়োগান্ত দৃশ্য অভিনীত হইয়া গেল! বহু নর-নারীর নিকট তাঁহার মৃত্যু জাতীয় ক্ষতি নহে, পরন্তু ব্যক্তিগত শোকাবহ ঘটনা! তাঁহার উদগ্র গর্ব্বিত এবং প্রবল মনোবৃত্তি কোষমুক্ত জ্বলন্ত তরবারির মত দেশরক্ষায় নিযুক্ত ছিল। তাঁহার জীবন ও মৃত্যু স্বাধীনতার বেদীমূলে বলিদান ভিন্ন অন্য কিছুই নহে। তিনি তাঁহার দেশ ও দেশের লোকের জন্য জীবন বিসর্জ্জন দিয়াছেন—ইহা অপেক্ষা মহত্তর ভালবাসা আর কিছুই হইতে পারে না।”

 পট্টভি সীতারামিয়া বলিয়াছেন:—“সুভাষ বাবুর মত্যুসংবাদ আমাকে স্তম্ভিত কহিয়াছে। ভারতের মুক্তির জন্য তিনি নিজের পথ নিজে বাছিয়া লইয়াছিলেন; তজ্জন্য তিনি তাঁহার কংগ্রেস-সহকর্ম্মিগণের নিকট কম প্রিয় নহেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁহার অবস্থা পরিজ্ঞাত হইবার জন্য সকলেই ব্যাকুল ছিলেন। যদি তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া থাকেন, তবে সেই ব্যাকুলতা দেশ ব্যাপী দুঃখ-বন্যায় তলাইয়া যাইবে! যদি তিনি জীবিত থাকেন, তবে তাঁহার চতুর্দ্দিকস্থ জ্যোতির্ম্মণ্ডল গভীর ও উজ্জ্বল হইয়া দেখা দিবে।”

 ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদ বলিয়াছেন:—“তাঁহার মৃত্যু দেশের পক্ষে একটি বিরাট দুর্ঘটনা। তাঁহার মত লোক কদাচিৎ জন্মগ্রহণ করেন এবং যখন তাঁহারা চলিয়া যান, তখন সেই শূন্যস্থান সহজে পূর্ণ হয় না।”

 খাঁ আবদুল গফুর খাঁ বলিয়াছেন:—“আমার পুরাতন সহকর্ম্মী মিঃ সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যুতে আমি শোকাহত হইয়াছি। আমরা উভয়ে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরূপে একসঙ্গে কাজ করিয়াছি এবং তিনি ভারতের মঙ্গল এবং উন্নতির জন্য যাহা করিয়াছেন, তজ্জন্য আমি তাঁহাকে শ্রদ্ধা করি।”

 ডক্টর শ্যাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলিয়াছেন:—“সত্যই যদি সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু হইয়া থাকে, তবে এই সংবাদ ভারতের সর্ব্বত্র গভীর দুঃখের সহিত গৃহীত হইবে। দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি যথাসর্ব্বস্য ত্যাগ করিয়াছিলেন।”

 এস. কে. পাটিল বলিয়াছেন:—“এই মুত্যু-সংবাদে সমগ্র দেশে শোকচ্ছায়া ছড়াইয়া পড়িয়াছে; দুর্ঘটনার মধ্যে আমাদের বর্ত্তমান কালের শ্রেষ্ঠ দেশ-সেবকের ঝটিকাময় জীবনের অবসান হইল। তিনি তাঁহার জীবনে যাহা কিছু করিয়াছেন, সবই দেশপ্রমে উদ্বুদ্ধ হইয়া করিয়াছেন।”

 কিরণশঙ্কর রায় বলিয়াছেন:—“এখন তিনি (সুভাষচন্দ্র) ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত। তথাপি ভারতের প্রত্যেক গৃহে গভীর দুঃখ এবং শোকের ছায়া নিপতিত হইবে।”

 স্বামী সহজানন্দ বলিয়াছেন:—“সুভাষচন্দ্রের অকালমৃত্যুর কথা শুনিয়া আমি গভীর ভাবে শোকাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছি। দীর্ঘকাল ব্যাপী তাঁহার সাহচর্য্যে আমার বিশ্বাস হইয়াছে যে, তিনি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক। তাঁহার সমগ্র জীবন মাতৃভূমির সাধনার জন্য কঠোর ত্যাগের নিদর্শন।”

 পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থ বলিয়াছেন:—“বৈদেশিক শাসন হইতে মাতৃভূমিকে মুক্তিদানের গ্বলন্ত মনোবৃত্তি দ্বারা সুভাষচন্দ্র গঠিত ছিলেন। সেই একটিমাত্র উদ্দেশ্য দ্বারা প্রণোদিত হইয়া তিনি জীবনপথে অগ্রসর হইয়াছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সুভাষচন্দ্র একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিবেন”।

 শ্রীমতী কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় বলিয়াছেন:—“দুর্ঘটনার ফলে সুভাষচন্দ্র বসুর এই মৃত্যুতে দেশের সকলে শোকপ্রকাশ করিবে। তাঁহার দুঃসাহসিক মনোবৃত্তি এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য অবিচল অনুরাগে তিনি সর্ব্বস্ব ত্যাগ করিয়াছিলেন এবং উহাই তাঁহাকে দেশের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বীররূপে পরিণত করিয়াছে”,

 নলিনীরঞ্জন মাষ্ঠার বলিয়াছেন:—“সুভাষচন্দ্র নিজের উন্নতিময় জীবন পরিহার করিয়া দেশের স্বাধীনতার কার্য্যে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন। তাঁহার মৃত্যু-সংবাদে সমগ্র জাতি শোক-সাগরে নিমগ্ন। যে উদ্দেশ্যে তিনি আত্মবিসর্জ্জন দিয়াছেন, একদিন তাহা জয়যুক্ত হইবে এবং দেশবাসী তাঁহার বীরত্বময় আত্মত্যাগের মূল্য দিতে শিখিবে।”

 শ্রীযুক্ত বিশ্বনাথ দাস বলিয়াছেন:—“আমি স্বদেশপ্রেমিক আত্মার শোচনীয় পরিণামে শোক প্রকাশ করিতেছি। তিনি নিজের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপায়ে ভারতের স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাঁহার স্বার্থত্যাগ ও স্বদেশপ্রেমে তাঁহার প্রতি আমাদের বরাবর একটা শ্রদ্ধা ছিল। বসু-পরিবার অনেক ক্ষতি স্বীকার করিয়াছেন; আমি তাঁহাদের এই ক্ষতিতে আমার সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছি।”

 শ্রীমতী লাবণ্যপ্রভা দত্ত বলিয়াছেন:—“ভারতের শ্রেষ্ঠ স্বদেশপ্রেমিক সন্তান সুভাষচন্দ্র বসুর এইরূপ আকস্মিক ভাবে মৃত্যুর সংবাদে আমরা এরূপ শোকাভিভূত হইয়াছি যে, তাহা হইতে মুক্তিলাভ সুকঠিন। এইরূপ মৃত্যু বাস্তবিক শোকাবহ। ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁহার জীবন-বৃত্তান্ত একটি প্রয়োজনীয় অধ্যায়রূপে পরিগণিত হইবে।

 ডক্টর পি. এন্. ব্যানার্জ্জি বলিয়াছেন:—সমগ্র দেশ মাতৃভূমির অনুরক্ত সেবকের বিয়োগান্ত পরিসমাপ্তিতে শোক প্রকাশ করিবে।”

 শ্রীযুক্ত হরেকৃষ্ণ মহতাব্ বলিয়াছেন:—“মিঃ বসুর মৃত্যুতে সমগ্র ভারত শোক প্রকাশ করিবে। তাঁহার আত্মত্যাগ, মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য জ্বলন্ত আগ্রহ, তাঁহার অসামান্য সঙ্ঘ-গঠনশক্তি—এই সমস্ত দেশের যুবকগণের সম্মুখে চিরকাল আদর্শ-স্বরূপ অবস্থিতি করিবে।”

 অধ্যাপক এন্. জি. রঙ্গ বলিয়াছেন:—“ভারতে যে সমস্ত বীর জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, সুভাষ তাঁহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তাঁহার সাহস এবং অধ্যবসায় তাঁহার মহত্ত্বের প্রমাণ।”

 পুরুষোত্তম দাস ট্যাণ্ডন বলিয়াছেন:—“সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু-সংবাদে ব্যথিত হইয়াছি। আমাদের জন্মভূমি তাঁহার শ্রেষ্ঠ বীর সন্তানকে হারাইলেন।”

 অনুগ্রহ-নারায়ণ সিংহ বলিয়াছেন:—“দেশের প্রতি সুভাষচন্দ্র বসুর ভালবাসা এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁহার অসীম উদ্যমের কথা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে! ভবিষ্যৎ বংশধরগণ বিস্ময়-পরিপ্লুত হৃদয়ে তাঁহার জীবনের রোমাঞ্চকর কাহিনী ও তাঁহার স্বদেশপ্রেমের বিবরণ পাঠ করিবে, সন্দেহ নাই।”

 প্রতাপচন্দ্র গুহরায় বলিয়াছেন:—“সমগ্র দেশ সুভাষচন্দ্রের অকাল-মৃত্যু-সংবাদে শোকাহত হইয়াছে। তিনি ভারতের শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক। ভারতের স্বাধীনতার জন্য জ্বলন্ত ইচ্ছা লইয়া তিনি দেহত্যাগ করিয়াছেন।”

 জগৎনারায়ণ লাল বলিয়াছেন:—“তাঁহার কঠোর দেশসেবা, মহৎ আদর্শবাদ, সর্ব্বোপরি আত্মোৎসর্গ ভারতের জাতীয়তার ইতিহাসে পুরুষানুক্রমে চলিতে থাকিবে।”