নেতাজী সুভাষ চন্দ্র/আজাদ-হিন্দ ফৌজ ও আজাদ-হিন্দ গভর্ণমেণ্ট
সাত
আজাদ-হিন্দ ফৌজ ও আজাদ্-হিন্দ্
গভর্ণমেণ্ট
১৯৪২ সালে প্রাচের পরিস্থিতি—সিঙ্গাপুরের পতন—ভারতীয় সৈন্যগণকে জাপ-হস্তে সমর্পণ—জাপানের উদ্দেশ্যমূলক উদারতা—মোহন সিংএর নেতৃত্ব—আজাদ-হিন্দ-ফৌজ ও আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘ গঠন—জাপ গভর্ণমেণ্টের সহিত সঙ্ঘর্ষ—সুভাষচন্দ্রের আগমন—সভাপতি রাসবিহারীর পদত্যাগ—‘নেতাজী’ সুভাষচন্দ্র—আজাদ-হিন্দ গভর্ণমেণ্টের কর্ম্ম-পরিষদ্—নারী বাহিনী—আত্মঘাতী বাল-সেনা—আজাদ-হিন্দ ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা—ইম্ফল-অবরোধ—জাপ-গভর্ণমেণ্টের পতন-আজাদ-হিন্দ গভর্ণমেণ্টের বিলোপ—আজাদ-হিন্দ ফৌজের বিচার।
সুভাষচন্দ্র যখন ভারতবর্ষ হইতে পলায়ন করিয়া, অবশেষে বার্লিণে পৌঁছিয়া সেখানে অবস্থান করিতেছিলেন, প্রাচ্য ভূখণ্ডে এসিয়া মহাদেশে তখন ক্রমশঃ এক বিপুল পরিবর্ত্তন সাধিত হইতেছিল। শেষকালে এমন অবস্থা হইল যে, ইংরেজের সুপ্রতিষ্ঠিত সিংহাসন এসিয়া মহাদেশে টলটলায়মান হইয়া উঠিল।
১৯৪২ সালের প্রথম ভাগে ব্রিটিশ-শক্তি বিজয়ী জাপানীদের নিকট পরাভূত হইয়া দক্ষিণ-পূর্ব্ব এসিয়া হইতে সরিয়া আসিতেই বাধ্য হইল।
১৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে ব্রিটিশ নৌ-ঘাঁটির অন্যতম কেন্দ্র সিঙ্গাপুরের পতন হয়। ব্রিটিশ সৈন্যগণ পূর্ব্বাহ্ণেই পলায়ন করে। তাহাদের পলায়নের জন্য সকল প্রকার ব্যবস্থা পূর্ব্বেই করা হইয়াছিল; কিন্তু ভারতীয় সৈন্যগণকে কিছু না জানাইয়া তাহাদিগকে অনিশ্চিত ভাগ্যের উপর ফেলিয়া রাখা হয়। ইহার ফলে সিঙ্গাপুরের সমস্ত ভারতীয় সৈন্য বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে।
সিঙ্গাপুরের পতনের সঙ্গে-সঙ্গেই—১৬ই ফেব্রুয়ারী তারিখে সন্ধ্যাবেলা সমগ্র ভারতীয় বাহিনীর মধ্য হইতে ব্রিটিশ অফিসারদিগকে পৃথক্ করা হইল এবং ব্রিটিশ কম্যাণ্ডিং অফিসার স্বদেশীয় সৈন্যদিগকে নিরাপদে অন্যত্র পাঠাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন; কিন্তু হতভাগ্য ভারতীয় অফিসার ও সৈন্যদিগকে ১৭ই তারিখে প্রাতঃকালে ফেরার পার্কের দিকে মার্চ্চ করিয়া লইয়া যাওয়া হইল।
লেঃ কর্ণেল হাণ্ট সেখানে হতভাগ্য ভারতীয় সৈন্যদিগকে জাপ-গভর্ণমেণ্টের প্রতিনিধি মেজর ফুজিয়ারার হস্তে সমর্পণ করিয়া তাহাদিগকে চূড়ান্তভাবে বলিয়া দিলেন, “তোমরা এতদিন আমাদিগকে যেভাবে মানিয়াছ, এখন হইতে জাপ-কর্ত্তৃপক্ষকে মান্য করিয়া চলিও।”
তৎকালীন অবস্থা বর্ণনা-প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন সাইগল বিচারকালে তাঁহার জবানবন্দীতে বলিয়াছিলেন, “ব্রিটিশের পক্ষ হইতে লেঃ কর্ণেল হাণ্ট ভারতীয় অফিসার ও সৈন্যদিগকে একদল ভেড়ার মতই জাপদের হাতে সঁপিয়া দিলেন।”
মেজর ফুজিয়ারা অসহায় যুদ্ধবন্দী ভারতীয় সৈন্যদের মানসিক অবস্থা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করিতে পারিলেন। তিনি তাহাদের ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাবের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করিবার উদ্দেশ্যে ভারতীয় বাহিনীকে সম্বোধন করিয়া বলেন, “জাপান পূর্ব্ব-এসিয়ার সমস্ত জাতিকে স্বাধীন ও মুক্ত দেখিবার অভিলাষী; কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা ব্যতীত সুদূর প্রাচ্যের পরিস্থিতি কখনও ভাল হইতে পারে না। সুতরাং ভারতের উক্ত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জাপ-সরকার সকল রকম সাহায্য ও সহযোগিতা করিতে প্রস্তুত। কাজেই আমি আপনাদিগকে যুদ্ধবন্দীরূপে দেখিতে চাহি না। আমাদের পক্ষ হইতে বলিতে পারি, আপনারা স্বাধীন। আমি ক্যাপ্টেনমোহন সিংএর হস্তে আপনাদিগকে সমর্পণ করিতেছি।”
ক্যাপ্টেনমোহন সিং তখন তাঁহার সেনাবাহিনীকে সম্বোধন করিয়া বলেন, “বর্ত্তমানে ভারতের স্বাধীনতা অর্জ্জনের জন্য ভারতীয়দের যুদ্ধ করিবার সুযোেগ আসিয়াছে।”
মেজর ফুজিয়ারার উদ্দেশ্য ছিল, জাপানের তাঁবেদার হিসাবে একটি ভারতীয় সমিতি খাড়া করিতে হইবে; কিন্তু ভারতীয়গণ মেজর ফুজিয়ারাকে কোনরূপে এড়াইবার জন্য বলেন যে, এ বিষয়ে তাঁহারা আরও গভীর ভাবে চিন্তা করিবেন এবং প্রয়োজন হইলে মেজর ফুজিয়ারার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন।
ইছার পর ৯ই এবং ১০ই মার্চ্চ, ১৯৪২ সালে মালয়ের বিভিন্ন স্থান হইতে আগত ভারতীয় নেতৃবৃন্দ সিঙ্গাপুরে একটি সভা করেন। সিঙ্গাপুরের সভায় স্থির হয় যে, টোকিওতে একটি শুভেচ্ছা দল-পাঠান হইবে।
ইহার পর রাসবিহারী বসুর সভাপতিত্বে টোকিওতে একটি সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে উল্লিখিত শুভেচ্ছা-দলের প্রতিনিধিবৃন্দ ছাড়াও হংকং, সাংহাই ও জাপান-প্রবাসী ভারতীয় প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এই সম্মেলনে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, পূর্ব্ব-এসিয়া-প্রবাসী ভারতীয়গণের পক্ষে স্বাধীনতা-আন্দোলন আরম্ভ করিবার ইহাই প্রকৃষ্ট সময়; এই স্বাধীনতা হইবে পূর্ণ স্বাধীনতা এবং সকল প্রকার বৈদেশিক শাসন ও নিয়ন্ত্রণ হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত; ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান এবং ক্রিয়াকলাপের অধিকারী হইতে পারিবে একমাত্র ভারতীয়গণের নেতৃত্বে এবং ভারতীয় স্বার্থে চালিত ‘স্বাধীন ভারতবাহিনী’ বা ‘আজাদ-হিন্দ ফৌজ’; সকল ক্ষমতা আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘ পরিচালিত করিবে; আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘের একটি কর্ম্ম-পরিষদ্ থাকিবে; এই কর্ম্ম-পরিষদ্ সামরিক প্রয়োজনে জাপানের নিকট হইতে নৌবল, বিমানবল প্রভৃতি চাহিতে পারেন, ইত্যাদি।
এই সম্মেলন আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব করেন যে, ভারতের ভবিষ্যৎ শাসন-তন্ত্র রচনা করিবার অধিকার ভারতভূমিতে স্বয়ং ভারতীয় নেতৃবৃন্দের উপরই বর্ত্তিবে; ভারতের জাতীয় কংগ্রেসই এই অধিকারের মালিক।
১৯৪২ সালের ১৫ই হইতে ২৩শে জুন পর্য্যন্ত ব্যাঙ্ককে একটি প্রতিনিধি-সম্মেলন বসে। জাপান, মাঞ্চুকুও, হংকং, বোর্ণিও, জাভা, মালয় ও শ্যাম হইতে ১০০ জন প্রতিনিধি সমবেত হন। ভারতীয় বাহিনী হইতেও প্রতিনিধি আসেন। ইঁহারা সকলেই যুদ্ধবন্দী ছিলেন। এই সম্মেলনে আজাদ-হিন্দ আন্দোলনের মূলনীতি নির্দ্ধারিত হয়—
(১) ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য পূর্ব্ব-এসিয়ার প্রবাসী ভারতীয়গণকে লইয়া একটি আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘ গঠন করিতে হইবে।
(২) অজাদ-হিন্দ সঙ্ঘের আদর্শ, কার্য্যক্রম ও সকল প্রকার পরিকল্পনা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শ, কার্য্যক্রম ও উহার পরিকল্পনা অনুযায়ী অনুসৃত হইবে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব মানিয়া চলিতে হইবে; কংগ্রেসের আন্দোলনের সহিত যোগসূত্র সাধন করিতে হইবে।
(৩) পূর্ব্ব এসিয়ার ভারতীয় বাহিনী হইতে এবং ভারতীয় বেসামরিক জনসাধারণের মধ্য হইতে সৈন্য সংগ্রহ করিয়া একটি আজাদ-হিন্দ ফৌজ গঠন করিতে হইবে।
(৪) ভারতবর্ষের প্রতি এবং নবগঠিত আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘের প্রতি জাপানীদের নীতি কি, তাহা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করার জন্য জাপানী কর্ত্তৃপক্ষের নিকট দাবী জানাইতে হইবে।
এইরূপে ব্যাঙ্কক-সম্মেলন হইতে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘ গঠিত হইল। ইহার সভাপতি হইলেন শ্রীরাসবিহারী বসু। সিঙ্গাপুরে উক্ত সঙ্ঘের প্রধান কর্ম্মস্থল হইল এবং পূর্ব্ব-এশিয়ার প্রত্যেক দেশে ইহার শাখাসঙ্ঘ স্থাপিত হইল। এই সময় গান্ধীজির নেতৃত্বে কংগ্রেস ১৯৪২ সালে ৮ই আগষ্ট ‘ভারত ত্যাগ কর’ প্রস্তাব গ্রহণ করিলেন। সমগ্র ভারতবর্ষ দুইটি মন্ত্রে দীক্ষিত হইল— “করেঙ্গে ঔর মরেঙ্গে।”
ভারতব্যাপী দাবানল জ্বলিয়া উঠিল, ভারতবর্ষের সমস্ত কংগ্রেস-নেতাকে তড়িৎ আক্রমণ হানিয়া ব্রিটিশ শক্তি কারারুদ্ধ করিল; সহস্র-সহস্র কংগ্রেসকর্ম্মী ও জনগণ ব্রিটিশের গুলিতে প্রাণ বিসর্জ্জন দিতে লাগিলেন; ব্রিটিশ বিমান হইতে বোমাবর্ষণ করিয়া গ্রাম, নগর ধ্বংস করিতে লাগিল।
এই সকল সংবাদে পূর্ব্ব-এশিয়ার সর্ব্বত্র অভূতপূর্ব্ব চাঞ্চল্য এবং অদম্য কর্ম্মোৎসাহ চূড়ান্ত সীমায় ঠেলিয়া উঠিল। এই চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতিতে এইবার সর্ব্বপ্রথম ক্যাপ্টেনমোহন সিংএর অধিনায়কত্বে আজাদ-হিন্দ ফৌজের গঠন-কার্য্য আরম্ভ হইল। মালয়ে যে সকল ভারতীয় সৈন্য আত্মসমর্পণ করিয়াছিল, তাহাদের লইয়াই বাহিনী গঠনের প্রাথমিক কর্ম্মসূচী অনুসৃত হইতে লাগিল; মালয়-প্রবাসী ভারতীয়গণের নিকট আবেদন জানাইলে আশাতিরিক্ত সাড়া পাওয়া যাইতে লাগিল।
ভারতীয়গণের এই স্বাধীন প্রচেষ্টা জাপান কিছুতেই প্রীতির চক্ষে দেখিতে পারে নাই। ইহাতে বরং সাম্রাজ্যবাদী জাপানের মনেও আতঙ্ক এবং ভীতির সঞ্চার হইয়াছিল। সুতরাং জাপানী কর্ত্তৃপক্ষের সহিত আজাদ-হিন্দ ফৌজের কর্ম্ম-পরিষদের সংঘর্ষ বাধিয়া উঠিল। প্রধানতঃ দুইটি কারণে তিক্ততা চরম হইয়া পড়িল—
(১) কর্ম্ম-পরিষদ দাবী জানাইয়াছিলেন যে, ভারতবর্ষ, পূর্ব্ব-এসিয়া এবং আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের প্রতি জাপানের নীতি কি, ইহা জাপান অবিলম্বে ঘোষণা করুক।
জাপান উত্তরে কতকগুলি মামুলী জবাব জানাইয়াছিল; কিন্তু কর্ম্ম-পরিষদ্ জাপানী গভর্ণমেণ্টের ঐ মামুলী জবাব সন্তোষজনক বলিয়া গণ্য করিতে পারেন নাই।
(২) সম্পূর্ণভাবে জাপানীগণ-কর্ত্তৃক পরিচালিত ‘ইয়াকুরোকিকান’ নামক ‘লায়াসন’ ডিপার্টমেণ্টের অফিসারগণ আজাদ-হিন্দ ফৌজের কার্য্য-কলাপে হস্থক্ষেপ করিতে আসিতেন, সুতরাং ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসেই চরম সঙ্কট ঘনাইয়া উঠি। মালয়ে গঠিত আজাদ-হিন্দ ফৌজকে জাপানী সমর-কর্ত্তাদের আদেশ অনুসারে বার্ম্মায় স্থানান্তরিত করিতে কর্ম্ম-পরিষদ অস্বীকার করিল; জাপানীদের অন্যান্য অনেক দাবীও সরাসরি অগ্রাহ্য করা হইল।
কর্ম্ম-পরিষদকে না জানাইয়া জাপানীরা ৮ই ডিসেম্বর অজাদ হিন্দ ফৌজের কর্ণেল এন. এস. গিলকে গ্রেপ্তার করিলে অবস্থা চরমে গিয়া পৌঁছে।
এই সম্পর্কে জেনারেলমোহন সিং নিজে বলিয়াছেন; একদিন রাত্রে কয়েক জন জাপ সামরিক কর্ম্মচারী তাঁহার নিকট আসেন এবং কর্ণেল নিরঞ্জন সিংহ গিলকে গ্রেপ্তার করিতে চাহেন; কিন্তু তিনি তাঁহাকে তাহাদের নিকট সমর্পণ করিতে অসম্মত হন। তিনি বলেন, তাঁহার কোন অফিসার কোন অপরাধ করিলে তিনি সামরিক আদালতে তাঁহার বিচার করিবেন, কিন্তু তাঁহাকে তাহাদের নিকট সমর্পণ করিবেন না। ইহাতে জাপ সামরিক কর্ত্তৃপক্ষ বিরক্ত হন এবং পরে কর্ণেল গিল ও জেনারেলমোহন সিং উভয়কেই গ্রেপ্তার করা হয়।[১]
জেনারেলমোহন সিং বলেন, ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসেই জাপানের বিজয়-সম্ভাবনা সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ছিল। আর তখন ভারতকে এ কার্য্যে নিয়োজিত করাই তাহাদের অভিপ্রায় ছিল।
জাপ সামরিক কর্ত্তৃপক্ষ প্রথমে ‘ভারতীয় জাতীয় সেনাদল’ নামে আপত্তি করেন এবং ‘ভারতীয় স্বাধীনতা সেনাবাহিনী’ নামকরণ প্রস্তাব করেন। কিন্তু তাঁহারা ‘ভারতীয় জাতীয় বাহিনী’ নাম করিতে চাহেন। কারণ, তাঁহারা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসেরই প্রতিনিধি। প্রভেদ এই যে, আজাদ-হিন্দ ফৌজ স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ব্যবহার সমর্থন করেন, আর কংগ্রেস মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংস সংগ্রামই চালাইতেছে।
উপসংহারে জেনারেলমোহন সিং বলেন, ভারতের স্বাধীনতার জন্যই আজাদ-হিন্দ ফৌজ গঠিত হইয়াছিল।[২]
কর্ণেল গিল ওমোহন সিংএর এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে পরিষদের সভ্যগণ পদত্যাগ করেন। ইহাতে শ্রীরাসবিহারী অবস্থার গুরুত্ব বুঝিতে পারেন এবং জানান, তিনি অবিলম্বে জাপান যাইবেন এবং প্রধান-প্রধান বিষয়ে জাপানীদের স্পষ্ট নীতি কি, তাহা বাহির করিবেন। ইতোমধ্যে সঙ্ঘের কার্য্য চলিতে থাকিবে।
এই সময় মালয়-শাখাও প্রস্তাব করেন যে, শ্রীরাসবিহারী বসুকে এতদ্দ্বারা অনুরোধ করা যাইতেছে যে, তিনি প্রধান প্রধান বিষয়ে টোকিও-গভর্ণমেণ্টের মতামত ও নীতি কি, তাহা জানিতে সম্ভাব্য চেষ্টা করুন, এবং টোকিও-গভর্ণমেণ্টও ঘোষণা, বিবৃতি যা অন্য যে-কোন উপায়ে তাহা যত শীঘ্র সম্ভব প্রকাশ করুক। ইতিমধ্যে সঙ্ঘের কাজ পূর্ব্বের মতই চলিতে থাকিবে, কিন্তু টোকিও-গভর্ণমেণ্টের ঘোষণা বা বিবৃতির পরই নূতনভাবে অগ্রসর হওয়া যাবে।
এই যখন অবস্থা, তখন ইয়াকুরো-কিকান আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘকে হীনবল করিবার জন্য একটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল গঠন করিল। উহার অফিসারগণ আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘের বিরুদ্ধে গুপ্ত যুব-আন্দোলন গঠন করিতে লাগিলেন এবং নিজেরাও তাঁবেদার অনুচর লইয়া আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে প্রচার কার্য্য এং মিথ্যা রটনা শুরু করিলেন।
১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মালয়-শখা-কমিটি তিন দিন মিটিং ও আলোচনার পর শ্রীরাসবিহারীর নিকট একটি স্মারকলিপি পাঠাইতে মনস্থ করেন; এই স্মারক লিপি যথাস্থানে পৌছিবার পূর্ব্বেই জাপানীরা গোপনে তাহা হস্তগত করিয়া লয়। তাহারা মালয়-শাখার সভাপতি শ্রী এন্. রাঘবন্কে পদত্যাগ করিতে বাধ্য করার জন্য শ্রীযুত রাসবিহারী বসুর উপর চাপ দিতে লাগিল। ফলে শ্রীরাঘবন্ পদত্যাগ করেন।
উক্ত শাখার অন্যান্য সভ্যগণ বুঝিলেন যে, পদত্যাগই জাপানীদের কাম্য; কেননা, তাহা হইলে জাপানের তাঁবেদারগণকে লইয়া সঙঘ পুনর্গঠিত করা যাইবে, আর ইহাতে আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘ সম্পূর্ণভাবে জাপানীদের ‘পুত্তলিকা’ হইবে। এই সকল বিবেচনা করিয়া আর কোন সভ্যই পদত্যাগ করিলেন না।
এরূপ শোনা যায় যে, রাসবিহারী বসুর কার্য্যকলাপ এবং নেতৃত্বে যোগ্যতার অভাব ঘটিয়াছে, এরূপ ধারণা ভারতীয়গণের মন বদ্ধমূল হইয়াছিল। উৎসাহের অভাবও পরিলক্ষিত হইতে ছিল। ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে সিঙ্গাপুরে আর একটি প্রতিনিধি-সম্মেলন হয়। ইহাতে পূর্ব্ব-এসিয়ার সমস্ত দেশের ভারতীয় প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এখানে কার্য্যকলাপের কঠোর সমালোচনা করা হয়। এই সভায় শ্রীরাসবিহারী বসু জানান যে, সুভাষচন্দ্র বসু আসিতেছেন এবং আন্দোলনের গুরু দায়িত্বভার তাঁহার ন্যায় একজন যোগ্যতম জননেতার উপর অর্পিত হইলে তিনি পদত্যাগ করিতে সম্মত আছেন।
১৯৪৩ সালের ২০শে জুন শ্রীযুক্ত হাসান নামক এক মুসলমান যুবকের সঙ্গে সুভাষচন্দ্র সাবমেরিণ যোগে জাপানে উপস্থিত হন। ২রা জুলাই তারিখে তিনি সিঙ্গাপুরে পৌঁছেন এবং ৪ঠা জুলাই আহূত এক প্রতিনিধি-সম্মেলনে সর্ব্ব-সম্মতিক্রমে আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘের ‘নেতাজী’ অর্থাৎ সভাপতি নির্ব্বাচিত হন এবং সকল আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শ্রীরাসবিহারী পদত্যাগ করেন।
বাংলার তথা ভারতের একজন জনপ্রিয় কংগ্রেস-নেতাকে লাভ করিয়া আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘ এবং তদীয় বাহিনী নবপ্রাণসঞ্চারে চঞ্চল হইয়া উঠিল। ৫ই জুলাই সিঙ্গাপুরে আজাদ-হিন্দ ফৌজের কার্য্য-বিবরণী গৃহীত হয় এবং ঐ তারিখে উক্ত বাহিনীর গঠন-সংবাদ প্রকাশ্য ভাবে জগতে ঘোষণা করা হইল। উক্ত বিরাট জনসঙ্ঘকে সম্বোধন করিয়া সুভাষচন্দ্র সেদিন বলিয়াছিলেন,—
“ভারতের স্বাধীনতার সেনাদল! আজ আমার জীবনের সবচেয়ে গর্ব্বের দিন। আজ ঈশ্বর আমাকে এই কথা ঘোষণা করার অপূর্ব্ব সুযোগ এবং সম্মান দিয়েছেন যে, ভারতকে স্বাধীন করার জন্য সেনাদল গঠিত হয়েছে।
হে আমার সতীর্থগণ, সেনাদল! তোমাদের রণধ্বনি হোক্ —‘দিল্লী চলো, দিল্লী চলো!’ প্রাচীন দিল্লীর লাল কেল্লায় বিজয়োৎসব সম্পন্ন না করা পর্য্যন্ত আমাদের কর্ত্তব্য শেষ হবে না। মনে রেখো যে তোমাদের মধ্য থেকেই স্বাধীন-ভারতের ভাবী সেনানায়ক-দল গড়ে উঠবে।
আজ আমার জীবনের সবচেয়ে বেশী গর্ব্বের দিন— একথা আমি বলেছি। পরাধীন জাতির পক্ষে স্বাধীনতা-সংগ্রামের সৈনিক হওয়ার চেয়ে বড় সম্মান এবং গৌরবের বিষয় অন্য কিছুই নাই। কিন্তু এই সম্মানের সঙ্গে সমপরিমাণ দায়িত্বও রয়েছে এবং সে দায়িত্ব সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ সচেতন।
আমি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করছি—আলোকে এবং অন্ধকারে, দুঃখে এবং সুখে, পরাজয়ে এবং বিজয়ে আমি সর্ব্বদা তোমাদের পাশে-পাশে থাকব; বর্ত্তমানে তোমাদের আমি ক্ষুধা-তৃষ্ণা, দুঃখ-কষ্ট, দুর্গম অভিযান এবং মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু দিতে অসমর্থ।”
সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্ব গ্রহণের পর হইতে ঘটনাবলী দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। নারীগণও দলে-দলে আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘের সভ্য হইতে থাকে। তাহাদের মধ্য হইতে স্বেচ্ছাসেবিকা বাছাই করিয়া শ্রীমতী লক্ষীর নেতৃহে ‘রাণী অফ্ ঝান্সী রেজিমেণ্ট’ গঠিত হইল। অনেক মহিলা রেড্-ক্রসের সভ্য হইলেন। ১৯৪৩ সালের অক্টোবরে সিঙ্গাপুরে এবং পরে রেঙ্গুণেও নারীদিগকে সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করিবার জন্য দুইটি সামরিক শিক্ষা-বিদ্যালয় স্থাপিত হইল।
সুভাষচন্দ্র ঝান্সীর রাণী-বাহিনীর প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৪৩ সালে ২২শে অক্টোবর। ২২শে অক্টোবর ভারতের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিবস। কারণ ১৮৫৭ সালে, প্রথম যে স্বাধীনতা-সংগ্রাম সিপাহী-যুদ্ধ হহয়াছিল, তাহার অধিনায়িকা ঝান্সীর রাণী লক্ষীবাইএর জন্ম-তারিখ ছিল ২২শে অক্টোবর। সুভাষচন্দ্র সেই জন্য ঝান্সীর রাণী-বাহিনীর প্রতিষ্ঠা-দিবসও ২২শে অক্টোবর বাছিয়া লইয়াছিলেন।
সুভাষচন্দ্র সেদিন বলিয়াছিলেন, “ঝান্সীর রাণী-বাহিনীর শিক্ষাকেন্দ্রের উদ্বোধন বিশেষ তাৎপর্য্যপূর্ণ ঘটনা। পূর্ব্ব-এসিয়ায় আমাদের আন্দোলনের অগ্রগতির পথে ইহা একটি স্মরণীয় কাহিনী। ইহার গুরুত্ব উপলব্ধি করিতে হইলে আমাদের একথা স্মরণ রাখিতে হইবে যে,এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |
আমাদের আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, আমরা আমাদের দেশের পুনর্জীবনের মহান্ কাজে অবতীর্ণ হইয়াছি। আমরা ভারতের জন্য এক নবযুগ আনয়ন করিতেছি। কাজেই আমাদের নূতন জীবনের ভিত্তি হইবে সুদৃঢ়। স্মরণ রাখুন যে, ইহ ঢক্কা-নিনাদ নয়, আমরা ভারতের পুনর্জীবন আসন্ন দেখিতেছি। এই নবজাগরণ ভারতের নারীদের মধ্যেও স্বাভাবিক।
আজ যে শিক্ষা-শিবিরের উদ্বোধন করা হইতেছে, তাহাতে আমাদের ১৫৬ জন ভগ্নী শিক্ষালাভ করিতেছেন। আমি আশা করি, শোনানে (অর্থাৎ সিঙ্গাপুরে) তাঁহাদের সংখ্যা শীঘ্রই এক হাজার হইবে। থাইল্যাণ্ড এবং ব্রহ্মদেশেও নারীশিক্ষা-শিবির স্থাপিত হইয়াছে; কিন্তু শোনানে হইতেছে কেন্দ্রীয় শিবির। আমার বিশ্বাস, এই কেন্দ্রীয় শিবিরে এক হাজার ‘ঝান্সীর রাণী’ প্রস্তুত হইবে।”
নেতাজী সুভাষচন্দ্র কেবল নারী-বাহিনী গঠন করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন না, সমগ্র দেশে তখন স্বাধীনতার জন্য এরূপ বিপুল চাঞ্চল্য লক্ষিত হইল যে, বালক-বালিকাদের সমন্বয়ে একটি বাল-সেনাদলও গঠিত হইয়া উঠিল। ইহারা আত্মঘাতী সেনাদল হিসাবে কার্য্য করিত।
ব্রহ্ম-রণাঙ্গণে এই কিশোর-কিশোরীগণ যে অদ্ভুত আত্মোৎসর্গের পরিচয় দিয়াছে, তাহা স্বাধীনতার ইতিহাসে চিরদিনই স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে।
এই বাল-সেনাদলের প্রধান কাজ ছিল শত্রুর ট্যাঙ্ক ধ্বংস করা। তাহারা নিজেদের পিঠে মাইন বাঁধিয়া সহসা শত্রুর ট্যাঙ্কের তলায় শুইয়া পড়িত। ট্যাঙ্কগুলি ধ্বংস হইত বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে তাহাদের দেহও চূর্ণ-বিচূর্ণ ও পিষ্ট হইয়া যাইত, এবং তাহাদের নিষ্পাপ সাহসী আত্মা অমর-ধামে চলিয়া যাইত।
১৯৪২ সালে আজাদ-হিন্দ ফৌজে স্বেচ্ছা-সৈন্য সংগ্রহ করিবার জন্য আহ্বান জানান হইয়াছিল। অগণিত লোক সৈন্যদলে নাম লিখিয়াছিল, কিন্তু জাপানীদের অস্পষ্ট নীতির ফলে সৈন্যদের শিক্ষাদান-কার্য্যে বেশীদূর অগ্রসর হওয়া যায় নাই। এইবার সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে অবস্থা পরিবর্ত্তিত হইল। তিনি স্পষ্ট ভাষায় এই মতামত ব্যক্ত করিলেন যে,——
এই আজাদ হিন্দ ফৌজই ভাবতবর্ষের প্রতিনিধিলমুক জাতীয় বাহিনী। জাপানীদের সহিত ইহার কোনরূপ সংশ্রব থাকিলে ইহা বিভীষণ-বাহিনী বলিয়া কুখ্যাত হইবে। ইহার নীতি, কার্য্যকলাপ ও নেতৃত্ব ভারতীয় দেশ-প্রেমিকগণ-কর্ত্তৃকই চালিত হইবে; কোনরূপ বৈদেশিক কর্ত্তৃত্ব, অথবা একজনও বৈদেশিক সৈন্যকে ভারতভূমিতে স্বীকার করা চলিবে না। জাপানীদের ভারত আক্রমণের অধিকার নাই। জাপানীগণ যদি বলেন যে, তাঁহারা ভারতকে ব্রিটিশ-শক্তির কবল হইতে মুক্ত করিয়া স্বাধীনতা দান করিতে যাইতেছেন, তথাপি আজাদ হিন্দ ফৌজ তাহাদিগকে অন্যায় আক্রমণকারী হিসাবেই গণ্য করিবে। ভারতবর্ষকে যদি ব্রিটিশের কবল হইতে মুক্ত করিতে হয়, তবে একমাত্র ভারতের নিজস্ব বাহিনীই তাহা করিতে পারে। জাপানীদের সামরিক কৌশল ও নীতির দ্বারা এই ভারতীয় বাহিনী কখনই চালিত হইতে পারিবে না; জাপানীদের নীতির সহিত ইহার কোনরূপ সংশ্রব থাকিলে ইহা ‘পঞ্চম বাহিনী’ বলিয়া ইতিহাসে কলঙ্কভাগী হইবে।
এই নীতিগত সুস্পষ্ট ঘোষণার ফলে আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘ এবং আজাদ-হিন্দ ফৌজ নবশক্তিতে উজ্জীবিত হইল। দেশপ্রেমিক ভারতীয়গণ এই প্রতিষ্ঠান এবং এই বাহিনীকে সর্ব্বান্তঃকরণে স্বীকার করিয়া ইহাকে আরও শক্তিশালী করিবার জন্য সকল শক্তি-সামর্থ্য প্রয়োগ করিলেন। মালয়ে একটি সামরিক শিক্ষাকেন্দ্র খোলা হইল। ইহাতে পালাক্রমে এই সময়ে ৭০০০ জনকে করিয়া সামরিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হইয়াছিল। ৭০০০ ব্যক্তি লইয়া একটি দল গঠিত হইত। এইরূপে দলে-দলে স্বেচ্ছা-সৈন্য শিক্ষিত হইতে লাগিল। ভারতীয় বাহিনী ও নন্-কমিশন অফিসারগণের মধ্য হইতে উর্দ্ধতন অফিসার বাছাই করিয়া শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হইয়াছিল।
নেতাজী সুভাষচন্দ্রের পরিচালনায় আজাদ-হিন্দ ফৌজ সমগ্র প্রাচ্যখণ্ডে এক বিরাট চাঞ্চল্যের ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করিল। ভারতীয়গণ স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হইয়া অকাতরে অবদান করিতে লাগিলেন। অর্থভাণ্ডার, সৈন্যবাহিনী, নানাপ্রকার জনহিতকর কার্য্য-কলাপ প্রভৃতি ক্রমশঃ ব্যাপকতা লাভ করায় একটি গভর্ণমেণ্ট স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হইল।
সুতরাং সুভাষচন্দ্র একটি অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট গঠন করিলেন। ইহার নাম হইল ‘স্বাধীন-ভারত অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট’। তাঁহাকেই রাষ্ট্রের সর্ব্বপ্রধান অধিনায়ক করা হইল। ইহা ইংলণ্ডের বিরুদ্ধে যুধ্যমান সকল রাষ্ট্র-কর্ত্তৃক স্বীকৃত হইল। ঐ বৎসর ২৫শে অক্টোবর স্বাধীন-ভারত অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট যথাযথ নিয়ম ও রীতি অনুযায়ী ইংলণ্ড ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিল।
আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘ ও স্বাধীন-ভারত অস্থায়ী গভর্ণমেণ্টের কর্ম্মস্থল ভারতের নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে হওয়া আবশ্যক বিবেচনায় ১৯৪৪ সালের ৭ই জানুয়ারী উহার কর্ম্মস্থল বার্ম্মায় স্থানান্তরিত হয়। বার্ম্মায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর হইতে অস্থায়ী গভর্ণমেণ্টের কার্য্য-কলাপ আরও ব্যাপক হইয়া উঠিল।
স্বাধীন-ভারত অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট যথাযথ ভাবে মন্ত্রী নিয়োগ করিয়াই বিভিন্ন রাষ্ট্রিক কার্য্য চালাইতেন, কাহারও খুসীমত বা নীতিশূন্য ভাবে কিছুই ঘটিতে পারিত না। এই সকল মন্ত্রী ছিলেন আজাদ-হিন্দ সভ্যের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। রেঙ্গুণই ছিল অস্থায়ী গভর্ণমেণ্টের রাজধানী এবং প্রধান কর্ম্মস্থল। এখানে ১৯টি বিভিন্ন ডিপার্টমেণ্ট ছিল। প্রত্যেকটি ডিপার্টমেণ্টেরই রীতিমতভাবে রেকর্ড-বুক্স্, নথিপত্র, হিসাব প্রভৃতি বিষয়ের সংরক্ষিত ব্যবস্থা ছিল। যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিগণকেই এই সকল কার্য্যে নিয়োগ করা হত। উর্দ্ধতন কর্ম্মচারীর নিকট তাঁহাদের জবাবদিহি করিতে হইত।
এই সঙ্ঘের রিয়ার হেড্-কোয়াটার্স ছিল সিঙ্গাপুরে; এখান হইতেই মালয়, সুমাত্রা, জাভা, বোর্ণিও প্রভৃতি অঞ্চলের তদারক করা হইত। আজাদ হিন্দ সঙ্ঘের শাখা কেবল মালয়েই ছিল ৭০ টি; মালয়-শাখার সভ্য-সংখ্যা দুই লক্ষেরও উপর; বার্ম্মায় ছিল ১০০টি শাখা, শ্যামে ছিল ২৪টি। ইহা ছাড়া আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, সুমাত্রা, জাভা, বোর্ণিও, সেলিবিস দ্বীপপুঞ্জ, চীন, মাঞ্চুকুয়ো এবং জাপান প্রভৃতি স্থানেও ইহার অসংখ্য শাখা এবং অভাবনীয় প্রভাব বৃদ্ধি পাইয়াছিল।
আজাদ-হিন্দ ফৌজের জন্য সৈন্য এবং সিভিল সার্ভিসের জন্য অফিসার সংগ্রহ করা হইত; কিন্তু ইহাতে কোন প্রকার জোর-জুলুম ছিল না।
আজাদ-হিন্দ গভর্ণমেণ্টের অন্যতম সদস্য, লেঃ কর্ণেল এ. বি. চাটার্জ্জি মুক্তিলাভান্তে কলিকাতায় আসিয়া দেশপ্রিয়-পার্কে সমবেত জনতার সম্মুখে বলিয়াছেন,—
“প্রত্যেক অফিসার, সৈনিক ও স্বেচ্ছাসেবক স্ব-ইচ্ছায়, নিজের স্বাধীন সম্মতিতে ইহাতে যোগদান করিয়াছেন। এই সংগঠনে কোন প্রাদেশিক বা সঙ্কীর্ণ ধর্ম্মভাব পর্য্যন্ত এতটুক ছিল না। এই সংগঠনে ব্যক্তিগত উন্নতির মানদণ্ড ছিল শুধু তাহার কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতা —সে যে-কোন প্রদেশেরই হউক বা যে-কোন ধর্ম্মাবলম্বীই হউক কেন!
সিঙ্গাপুরে যখন একবার টাকা তুলিবার কথা হয়, তখন সেখানকার চেটিয়ার সম্প্রদায় নেতাজীকে বলিয়া পাঠাইলেন—তাঁহারা টাকা দিতে রাজী আছেন, কিন্তু তাঁহাদের মন্দিরে গিয়া সেজন্য নেতাজীকে বলিতে হইবে।
তখন নেতাজী বলিলেন—যে-কোন ধর্ম্মাবলম্বীই হউক, মানুষ ভগবানকে ডাকিতে পারে; কিন্তু কর্ম্মক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ব্যাপারে, দেশের ব্যাপারে ধর্ম্মের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নাই। তিনি মন্দিরে যাইতে রাজী আছেন, যদি তাঁহারা হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, শিখ-নির্ব্বিশেষে সকলকে তাঁহাদের মন্দিরে যাইতে অনুমতি দেন। তাহা যদি না দেওয়া হয়, তাহা হইলে তিনি তাঁহাদের টাকা চাহেন না।
তাঁহারা বলিয়া পাঠাইলেন—যাহাকে খুশী তাহাকে লইয়া নেতাজী তাঁহাদের মন্দিরে যাইতে পারেন। কোন রকম আপত্তি করিবেন না।
সেদিন নেতাজীর সঙ্গে মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান, শিখ সব জাতীয় অফিসার ও সৈনিক—চেটিয়ার মন্দিরে প্রবেশ করছিল। সিঙ্গাপুরের ইতিহাসে ইহা তিনি প্রথম প্রবর্ত্তন করেন। তাহার আগে সে মন্দির হিন্দু ছাড়া কেহ ঢুকে নাই এবং ব্রাহ্মণ ছাড়া কেহ মন্দিরের ভিতর যাইতে পারে নাই। শুধু তাহাই নহে—মন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণ আসিয়া সকলের কপালে বিভূতি আঁকিয়া দিয়াছিল মায় মুসলমান ও খৃষ্টান অফিসার পর্য্যন্ত।”
সামরিক শিক্ষাদানের জন্য নয়টি কেন্দ্র ছিল, সিঙ্গাপুর এবং রেঙ্গুণে অফিসার-ট্রেণিংএর জন্য দুইটি কেন্দ্র ছিল; কোন কেন্দ্রেই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য ভিন্ন রকমের ব্যবস্থা প্রবর্ত্তন করা হয় নাই, শিক্ষার্থিগণই পালাক্রমে সে তার গ্রহণ করিয়াছিলেন; অফিসার ও এন্. মি. ও. গণ হিন্দুস্থানী ভাষায় শিক্ষাদান করিতেন। যুদ্ধে আদেশ-দানের রীতিও ছিল হিন্দুস্থানীতে। এক মাত্র মালয়েই ২০ হাজার বেসামরিক ব্যক্তিগণকে শিক্ষাদান করিয়া আজাদ-হিন্দ ফৌজের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছিল। ইহা ছাড়া, বিভিন্ন অঞ্চল হইতে হাজারে-হাজারে শিক্ষার্থী শিক্ষালাভ করিতে আসিয়াছিল, ইহাদের অনেককেই আজাদ-হিন্দ ফৌজের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে।
আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘের সমগ্র আন্দোলনে একমাত্র ভারতীয়গণের অর্থই ব্যয় করা হইত। বার্ম্মায় ভারতীয়গণের নিকট হইতে কিছুদিনের মধ্যে ৮ কোটি টাকা সংগৃহীত হইয়াছিল। ১৯৪৫ সালের জানুয়ারী মাসে নব-বৎসরের উপহার হিসাবে ভারতকে মালয় ৪০ লক্ষ টাকা দান করিয়াছিল। আজাদ-হিন্দ ফৌজ নিজ প্রয়োজনের জন্য যাবতীয় অস্ত্রপাতি গোলাবারুদ নিজ অর্থ দিয়াই ক্রয় করিত।
আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘ ছিল একটি রাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠান। সুতরাং ইহাকে সমাজ-সেবার গুরু দায়িত্বভারও গ্রহণ করিতে হইয়াছিল। যুদ্ধ-পীড়িতদের সাহায্যকল্পে ইহার ভাণ্ডার হইতে অজস্র অর্থ ব্যয় করা হইত। মালয়ের শ্রমিকগণ এক সময় চরম দুর্দ্দশায় পড়িয়াছিল; উক্ত সঙ্ঘ তখন মজুরদিগের জন্য চিকিৎসালয়, ডাক্তার, ঔষধ, পথ্য, খাদ্য প্রভৃতি ব্যাপারে প্রচুর অর্থব্যয় করিয়াছে
কুয়ালালামপুরে ছিল সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ সাহায্য-কেন্দ্র। এখানে প্রত্যহ এক হাজারের উপর, নারী, শিশু ও দুর্গতজনকে নানাবিধ সাহায্য দেওয়া হইত। ইহার মাসিক খরচ ছিল ৭৫ হাজার ডলার।
এই সঙ্ঘ বার্ম্মাতে অনেকগুলি দাতব্য চিকিৎসালয় চালাইত, শ্যামেও একটি আধুনিক ধরণের উচ্চাঙ্গের হাসপাতাল খুলিয়াছিল; তা ছাড়া, দুর্গত ভারতীয়গণের বসতি স্থাপনের জন্য উক্ত সঙঘ ভূমি-সংগঠনের কার্য্যও গ্রহণ করিয়াছিল। বিশেষ করিয়া মালয়ের জঙ্গল অপসারিত করিয়া প্রায় ২০০০ হাজার একর জমি বাসোপযোগী করা হইয়াছে। ভারতীয়গণ এখানে ভূমি-কর্ষণের ও বাণিজ্যোপযোগী বৃক্ষ রোপণের ব্যবস্থা করিয়াছিল। বালক-বালিকাদিগকে শিক্ষাদানের জন্যও আজাদ-হিন্দ সহ সচেষ্ট হইয়াছিল। পূর্ব্ব-এসিয়াবাসী ভারতীয়গণের জন্য হিন্দুস্থানী শিক্ষা দিবার সুবন্দোবস্ত করা হইয়াছিল। উক্ত সঙ্ঘ চতুর্দ্দিকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়িয়া জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল। কেবল বার্ম্মাতেই উক্ত সঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণাধীনে ৬৫টি জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।
স্বাধীন-ভারতের এই অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট, আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘ এবং আজাদ-হিন্দ ফৌজের পিছনে শুধু যে পূর্ব্ব-এসিয়ার ভারতীয়গণেরই সামগ্রিক সমর্থন ছিল তাহা নহে, পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের, এমন কি তথাকথিত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অধিবাসীদের মধ্যেও সমর্থনের অভাব ছিল না।
আজাদ-হিন্দ বা স্বাধীন-ভারত অস্থায়ী গভর্ণমেণ্টের সদস্যগণ
(১) | শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসু—রাষ্ট্রাধিনায়ক, প্রধান মন্ত্রী, পররাষ্ট্র ও যুদ্ধমন্ত্রী | ||
(২) | ক্যাপ্টেন মিস্ লক্ষ্মী—নারী-সংগঠন | ||
(৩) | মিঃ এস. এ. আয়েঙ্গার—প্রচার | ||
(৪) | লেফ্টেন্যাণ্ট কর্ণেল এ. সি. চ্যাটার্জ্জি—অর্থ | ||
(৫) | লেফ্টেন্যাণ্ট কর্ণেল„ এস্. এস্. ভগৎ | ||
(৬) | লেফ্টেন্যাণ্ট কর্ণেল„ জে. কে. ভোঁসলে | ||
(৭) | লেফ্টেন্যাণ্ট কর্ণেল„ গুলজারা সিং | ||
(৮) | লেফ্টেন্যাণ্ট কর্ণেল„ এম্. জেড্. কিয়ানি | ||
(৯) | লেফ্টেন্যাণ্ট কর্ণেল„ এ. ডি. লোকনাথন | ||
(১০) | লেফ্টেন্যাণ্ট কর্ণেল„ ঈশান কাদির | ||
(১১) | লেফ্টেন্যাণ্ট কর্ণেল„ আজিজ আমেদ | ||
(১২) | লেফ্টেন্যাণ্ট কর্ণেল„ শা নওয়াজ—সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি | ||
(১৩) | মিঃ এ. এম্. সহায়—সম্পাদক (মন্ত্রীর পদমর্য্যাদাসম্পন্ন) | ||
(১৪) | শ্রীযুক্ত রাসবিহারী বসু—(সর্বোচ্চ পরামর্শদাতা) | ||
(১৫) | মঃ করিম গণি | —পরামর্শদাতাগণ | |
(১৬) | শ্রীদেবনাথ দাস | ||
(১৭) | মঃ ডি. এম্. খান | ||
(১৮) | মিঃ এ. ইয়েলাপ্পা | ||
(১৯) | মিঃ আই. খিবি | ||
(২০) | সর্দ্দার ঈশ্বর সিং | ||
(২১) | মিঃ এ. এন্. সরকার—আইনবিষয়ক পরামর্শদাতা |
উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গকে লইয়া আজাদ-হিন্দ গভর্ণমেণ্ট গঠিত হইয়াছিল।
আজাদ-হিন্দ ফৌজের সৈনিকগণ কুচ-কাওয়াজের সময় যে সামরিক সঙ্গীত করিত, তাহা নিম্নে উদ্ধৃত হইল—
কদম্ কদম্ বাড়ায়ে জা
খুসীতে গীত গায়ে জা
এ জিন্দ্গী হ্যায় কৌম্ কী
(তো) কৌম্ পৈ লুটায়ে জা॥
তুঁ শেরে হিন্দ আগে বাঢ়
মরণেসে ফিরভি তু ন ডর
অসমান তক্ উঠাকে শির
জোশে বতন্ বঢ়ায়ে জা॥
তেরী হিম্মত বাঢ়তি রহে
খুদা তেরে শুনতা রহে
জো সামনে তেরে চঢ়ে
তো খাক্মে মিলায়ে জা॥
চলো দিল্লী পুকারকে
কৌমী নিশান্ সামালকে
লাল কিল্লে পৈ গাড়কে
লহ্রায়ে জা লহ্রায়ে জা॥
আজাদ-হিন্দ ফৌজের ভারতে প্রবেশের পূর্ব্বে বার্ম্মার পরিস্থিতি খুব আশাপ্রদ ছিল না। সুভাষচন্দ্রের সর্ব্বাপেক্ষা কৃতিত্ব এই যে, তাঁহারই অনমনীয় নীতির ফলে জাপানীরা ভারত-আক্রমণের নীতি পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হয়।
হকোয়াং উপত্যকায় ব্রিটিশের আক্রমণ এবং তাহাদের চিন্দুইন নদী অতিক্রমের সম্ভাবনায় জাপানীরা অধীর হইয়া পড়িল। তাহা তাড়াহুড়া করিয়া একটা পরিকল্পনা করিয়া ফেলিল। ইম্ফল দখল করবার জন্য অবিলম্বে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু আজাদ-হিন্দ ফৌজ জাপানীদের ভারত-আক্রমণের অধিকার কিছুতেই স্বীকার করিবে না। সুতরাং সুস্পষ্টভাবে জাপানীদের নীতি ঘোষণা করিতে হইল যে, উহারা কেবল ইম্ফলই দখল করিতে চায়; অতঃপর ভারতআক্রমণের সমস্ত সামরিক কার্য্য-কলাপ আজাদ-হিন্দ ফৌজের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হইবে।
আজাদ-হিন্দ ফৌজ পরিস্থিতি সম্যক্ বুঝিতে পারিলেন, তথাপি ইম্ফল দখলের যুদ্ধে তাঁহারাই প্রধান অংশ গ্রহণ করিতে মনস্থ করিলেন। ১৯৪৪ সালের ৪ঠা জানুয়ারী আজাদ-হিন্দ ফৌজ আক্রমণাত্মক কার্য্য শুরু করে, এবং ১৮ই মার্চ্চ তাঁহাদের বাহিনী ভারত-ব্রহ্ম সীমা অতিক্রম করিয়া ভারতভূমিতে পদার্পণ করে।
এই বাহিনীতে প্রধানত তিনটি ব্রিগেড ছিল:—(১) কর্ণেল শা’ নওয়াজের নেতৃত্বে ৬২০০ সৈন্য লইয়া গঠিত ‘সুভাষ-ব্রিগেড’।
(২) কর্ণেল ইনায়ৎ কয়ানির নেতৃত্বে ‘গান্ধী ব্রিগেড’; ইহার সৈন্য-সংখ্যা ২৮০০ জন।
(৩) কর্ণেলমোহন সিং-এর নেতৃত্বে ‘আজাদ ব্রিগেড’, ইহাতে দুই নম্বর ব্রিগেডের সমান-সংখ্যক সৈন্য ছিল।
ইহা ছাড়া, তিন শত বাহাদুর-দলের ফৌজ ছিল; সাত শত বেসামরিক সাহায্যকারীও ইহাদের সঙ্গে ছিলেন। কর্ণেল গুরুবক্স সিং ধীলনের নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্য লইয়া গঠিত ‘নেহেরু ব্রিগেড’—ইহাদের পিছনে ছিল।
তাঁহার মোরাই, কোহিমা ও অন্যান্য স্থান দখল করিয়া ইম্ফলে উপস্থিত হন এবং ইম্ফল অবরোধ করেন। কিন্তু এই সময় ভীষণ বর্ষা আরম্ভ হইল এবং ইম্ফল আক্রমণ ও অধিকার অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইল।
প্রকৃতির এই দুর্য্যোগময়ী অবস্থায় আক্রমণ পরিহার করা হইল এবং আক্রমণ পরিহারের পর সংযোগসূত্র রক্ষা করা দুরূহ হইয়া পড়িল; সুতরাং আজাদ-হিন্দ ফৌজ পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়।
অনন্তর আজাদ-হিন্দ ফৌজ কেবল আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন। ব্রিটিশ শক্তি যখন বার্ম্মা আক্রমণ করিল, তখন এই বাহিনীর অনেক ‘স্টাফ অফিসার’ ব্রিটিশ পক্ষে যোেগ দেন। ব্রিটিশের হস্তে মিণ্ডিলার পতন হইলে যখন পরিষ্কার বোঝা গেল যে, জাপানীরা ব্রিটিশ অগ্রসরকে আর বেশীদিন ঠেকাইতে পারিবে না, তখন রেঙ্গুণ পরিত্যাগের পরিকল্পনা করা হইল।
১৯৪৫ সালে ২৩শে এপ্রিল জাপানী প্রধান সেনাপতি ও বার্ম্মা-গভর্ণমেণ্ট রেঙ্গুণ ত্যাগ করিল। তাহাদের সহিত একত্রে বেঙ্গুণ ত্যাগ করিতে সুভাষচন্দ্রের অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট অস্বীকার করিয়াছিলেন।
এই সময় সর্ব্বাধিনায়ক শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ-হিন্দ ফৌজের প্রতি তাঁহার শেষ নির্দ্দেশনামা প্রচার করেন! উহা নিম্নরূপ—
আজাদ-হিন্দ ফৌজের অফিসার ও সৈন্যদের প্রতি—
১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাস হইতে আপনারা যেখানে বীরোচিত সংগ্রাম চালাইয়াছেন এবং এখনও চালাইতেছেন, আজ গভীর বেদনার সহিত আমি সেই ব্রহ্মদেশ ত্যাগ করিয়া যাইতেছি। ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হইছে; কিন্তু উহা প্রথম চেষ্টাই মাত্র। আমাদিগকে আরও বৃহু চেষ্টা করিতে হইবে। আমি চির-আশাবাদী। কোন অবস্থাতেই আমি পরাজয় মানিয়া লইব না। ইম্ফলের সমতলভূমিতে, আরাকানের অরণ্য-অঞ্চলে, ব্রহ্মদেশের তৈলখনি ও অন্যান্য অংশে শত্রুদের বিরুদ্ধে বীরত্বের কাহিনী আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে চিরকাল লিখিত থাকিবে।
ইনক্লাব জিন্দাবাদ্! অজাদ-হিন্দ জিন্দাবাদ! জয় হিন্দ!
২১শে এপ্রিল,
|
|
(স্বাঃ) সুভাষচন্দ্র বসু |
শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র ও তাঁহার অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট ১৯২৫ সালের ২৪শে এপ্রিল রেঙ্গুণ ত্যাগ করা আসেন; কিন্তু ভারতীয়গণের ধন-প্রাণ রক্ষার জন্য মেজর-জেনারেল লোকনাথনের অধিনায়কত্বে ছয় হাজার আজাদ-হিন্দ ফৌজেয় সৈন্য রাখিয়া এবং সঙ্ঘের সহকারী সভাপতি শ্রীযুক্ত জে. এন. ভাদুড়ীর উপর সঙ্ঘের সকল দায়িত্বভার অর্পণ করিয়া চলিয়া আসা হইয়াছিল।
রেঙ্গুণ ত্যাগের পূর্ব্বেই স্বাধীন-ভারত অস্থায়ী গভর্ণমেণ্টের দেনা-পাওনা পরিশোধ করা হইয়াছিল। জাপানীদের পশ্চাদপসরণ ও ব্রিটিশ-কর্ত্তৃক পুনরধিকারের সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে রেঙ্গুণে একটিও রাহাজানি বা অন্য কোনরূপ বিশৃঙ্খল অরাজক অবস্থা ঘটে নাই।
১৯৭৪ সালের এপ্রিলে রেঙ্গুণে আজাদ-হিন্দ ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। ১৯৪৫ লশের মে মাস পর্য্যন্ত এই ব্যাঙ্ক বাবতীয় কাজ-কর্ম্ম চালাইতেছিল। ১৯শে মে ব্রিটিশ সামরিক কর্ত্তৃপক্ষ উহা (আজাদ-হিন্দ ন্যাশন্যাল ব্যাঙ্ক) অধিকার করিয়া বসে। ফিল্ড-সিকিউরিটি সার্ভিসের কর্ত্তৃপক্ষ ২৮শে মে শ্রীযুক্ত ভাদুড়ীকে গ্রেপ্তার করেন এবং তখন হইতে আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘের কার্য্য-কলাপ বন্ধ হইয়া যায়। তখন হইতেই আজাদ-হিন্দ সঙ্ঘের কর্ম্মিগণ ও তাঁহাদের সহিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণকে দলে-দলে গ্রেপ্তার করা হইতে লাগিল।
বর্ত্তমানে আজাদ-হিন্দ গভর্ণমেণ্ট বিলুপ্ত হইয়াছে এবং জাপানের আত্মসমর্পণের ফলে আজাদ-হিন্দ ফৌজকেও আত্মসমর্পণ করিতে হইয়াছে। আজাদ-হিন্দ ফৌজের অনেককেই ভারতে আনিয়া মুক্তিদান করা হইয়াছে। তাঁহাদের কয়েকজনের বিচার হইতেছে, কাহারও বা বিচার-পর্ব্ব সমাপ্ত হইয়া গিয়াছে।
১৯৪৫ সালের ৫ই নভেম্বর আজাদ-হিন্দ ফৌজের প্রথম তিন জনের বিচার আরম্ভ হয়। ক্যাপ্টেন শা নওয়াজ, ক্যাপ্টেন পি. কে. সাইগল ও ক্যাপ্টেন গুরুবক্স সিং ধীলনের বিরুদ্ধে যথারীতি চার্জ্জসিট দাখিল করা হইল এবং অবশেষে কয়েক সপ্তাহ পরিপূর্ণ উত্তেজনার মধ্যে তাঁহাদের এই বিচারপর্ব্ব শেষ হইয়া গিয়াছে।
ভারতীয় বাহিনীর নিম্নলিখিত সাত জন অফিসারকে লইয়া সামরিক আদালত গঠিত হইয়াছিল।
(১) মেজর-জেনারেল এ. বি. ব্ল্যাকল্যাণ্ড
(২) ব্রিগেডিয়ার এ. এইচ. হার্ক
(৩) লেফ্টেন্যাণ্ট কর্ণেল সি. আর. স্কট্
(৪) ” টি. আই. ষ্টিভেনসন
(৫) ” নাসির আলি খাঁন
(৬) মেজর বি. প্রীতম সিংহ
(৭) ” বনোয়ারীলাল
সরকারপক্ষে মামলা পরিচালনা করিয়াছিলেন অ্যাডভাকেট জেনারেল সার এন. পি. ইঞ্জিনিয়ার ও মেজর ওয়াল্স্। সার তেজ বাহাদুর সপ্রু ও শ্রীযুক্ত ভুলাভাই দেশাই অভিযুক্তদিগের পক্ষ-সমর্থন করিয়াছিলেন।
দিল্লীর লালকেল্লাকে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করিয়া তন্মধ্যে সামরিক আদালতের কর্ম্মক্ষেত্র নির্দ্দিষ্ট হইয়াছিল।
ক্যাপ্টেন শা নওয়াজ, ক্যাপ্টেন সাইগল ও লেফ্টেন্যাণ্ট ধীলন সামরিক আদালতে সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার অভিযোগে অভিযুক্ত হইয়াছিলেন। লেফটেন্যাণ্ট ধীলনের বিরুদ্ধে নরহত্যার অভিযোগ এবং অপর দুই জনের বিরুদ্ধে নরহত্যার সহায়তার অভিযোগও আনা হয়।
সামরিক আদালত সাব্যস্ত করিলেন যে, তিন জনই সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার অভিযোগে অপরাধী। ক্যাপ্টেন শা নওয়াজ তদুপরি নরহত্যার সহায়তার অভিযোগেও অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছেন। ক্যাপ্টেন সাইগলকে নরহত্যার সহায়তা ও লেফ্টেন্যাণ্ট ধীলনকে নরহত্যার অভিযোগ হইতে অব্যাহতি দেওয়া হইয়াছে।
বিচারে সামরিক আদালত তাঁহাদের সকলকেই যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিত করেন এবং তাঁহাদিগকে চাকুরী হইতে বরখাস্ত করিবার ও তাঁহাদের প্রাপ্য বেতন ও ভাতা বাজেয়াপ্ত করিবার আদেশ প্রদান করেন। কিন্তু সামরিক আদালত কর্ত্তৃক প্রদত্ত দণ্ড বা রায় জঙ্গীলাট-কর্ত্তৃক অনুমোদিত না হইলে কার্য্যকরী হয় না। সুখের বিষয়, জঙ্গীলাট বাহাদুর অফিসারত্রয়ের প্রতি যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ডের আদেশ মার্জ্জনা করিয়াছেন; শুধু চাকরী হইতে বরখাস্ত ও ভাতা বাজেয়াপ্তের আদেশই বলবৎ রহিয়াছে
দুঃখের বিষয়, প্রথম বিচার-পর্ব্বের ন্যায় অপর বিচারপর্ব্বগুলি শাসকবর্গের দূরদৃষ্টির পরিচায়ক বলিয়া মনে হয় নাই। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যাইতে পারে, আজাদ-হিন্দ ফৌজের অন্যতম অভিযুক্ত সৈন্যাধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন রসিদ সাত বৎসর কারাবাসের আদেশে দণ্ডিত হইয়াছেন। তাঁহার এই কঠোর দণ্ডে সমগ্র দেশব্যাপী—হিন্দু-মুসলমান সকলের হৃদয়েই যে ক্ষোভের সঞ্চার হইয়াছে, তাহা আত্মপ্রকাশ করায় স্থানে-স্থানে অতি চরম পরিণতি ও শোচনীয় দুর্ঘটনার সৃষ্টি করিয়াছে। সম্প্রতি ক্যাপ্টেন বুরহানউদ্দিনের কঠোর দণ্ডের কথা শুনিয়াও সমগ্র ভারতবর্ষ স্তব্ধ হইয়াছে।
পরাধীন ভারতবর্ষের এক বাঙ্গালী অধিবাসীর সম্পর্কে অন্যান্য স্বাধীন দেশের অধিবাসীরাও যে কি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করেন, তাহা সুপ্রসিদ্ধ জাপানী সাংবাদিক মিঃ হাগিওয়ারার বিবৃতি পাঠ করিলেই স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম হইবে।
ইউনাইট প্রেস্ অভ্ আমেরিকার প্রতিনিধির নিকট তিনি সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে যে বিবৃতি দিয়াছেন, তাহাতে প্রকাশ যে, ১৯৪৩ খৃষ্টাব্দে মানিলায় এক সাংবাদিক-সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বসু তাঁহার নিজের ও গান্ধীর মতবাদকে একই লক্ষ্যে পৌঁছিবার স্বতন্ত্র পথ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছিলেন; বসু এ-কথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন, সামরিক কার্য্য-কলাপ, তাঁহার সহকর্ম্মী এবং ভারতীয় জনসাধারণের রক্তে উষ্ণতা সঞ্চার করিবে ও তাহাদের হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করিবে। তাঁহার প্রচেষ্টা হয়ত ব্যর্থ হইতে পারে এবং ব্যর্থতার নৈরাশ্যে শোচনীয় ভাবে হয়ত তাঁহাকে মরিতে হইতে পারে, কিন্তু তবুও তিনি বিশ্বাস করেন যে, ভারতের মুক্তি-সংগ্রামের চরম সাফল্যের জন্য সশস্ত্র শক্তি-প্রয়োগ আবশ্যক।
মিঃ হাসিওয়ারা বলিয়াছেন, “চারিবার আমি পূর্ব্ব-এসিয়ার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক-সম্মেলনে সুভাষচন্দ্রকে দেখিয়াছি—রেঙ্গুণে, ব্যাঙ্ককে, সিঙ্গাপুরে ও ম্যানিলায়। তাঁহাকে দেখিয়া আমার মনে হইয়াছে যে, তিনি অত্যন্ত তীক্ষ্ণধী।”
স্বয়ং হিট লার পর্য্যন্ত সুভাষচন্দ্রকে যে সম্মান প্রদর্শন করিয়াছিলেন, তাহাতে স্পষ্টই প্রমাণিত হইয়াছে যে, বীরের মর্য্যাদা সর্ব্বত্রই স্বীকৃত হইয়া থাকে। তিনি তাঁহার সৈন্যদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিয়াছিলেন, “মনে রাখিও আমি এক ক্ষুদ্র দেশের ‘ফুরার’ বা অধিনায়ক, কিন্তু তিনি এক বিশাল দেশের ‘ফুরার’। সুতরাং তাঁহাকে তদ্রূপ সম্মান প্রদর্শনে কার্পণ্য করিও না।”
এস্থলে ইহা বলিলে প্রাসঙ্গিক হবে না যে, প্রাচ্য রণাঙ্গনে এসিয়া মহাদেশে যখন শ্রীযুক্ত রাসবিহারী বসু ও ক্যাপ্টেনমোহন সিংএর নেতৃত্বে ভারতের মুক্তিকামী একদল আজাদ-হিন্দ ফৌজ গড়িয়া উঠিতেছিল, সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে পাশ্চাত্ত্যে ইয়োরোপের রণাঙ্গনেও তখন অপর একদল আজাদ-হিন্দ ফৌজ গঠিত হইয়াছিল। জার্ম্মাণগণ তাহাদিগকে “ফ্রী ইণ্ডিয়ান” নামে অভিহিত করিয়াছিলেন।
ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের মধ্য হইতেই এই মুক্তিকামী সৈন্যদল গড়িয়া উঠিয়াছিল। ইহাদের মোট সংখ্যা ছিল ৩৫০০ এবং ১৫টি কোম্পানীতে বিভক্ত ছিল।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র জার্ম্মাণ গভর্ণমেণ্টকে সুস্পষ্ট ভাবে এই নির্দ্দেশ দিয়াছিলেন যে, আজাদ-হিন্দ ফৌজকে যেন কেবল ইংরেজ ও আমেরিকানদের বিরুদ্ধেই নিয়োজিত করা হয়, রুশ বা অপর কোন জাতির বিরুদ্ধে যেন তাহাদিগকে ব্যবহার করা না হয়। নেতাজীর এই নির্দ্দেশ অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হইয়াছিল।
ভারতবর্ষে আজাদ-হিন্দ ফৌজের প্রথম বিচার-পর্ব্বের পূর্ব্ব পর্য্যন্ত স্বদেশে ও বিদেশে সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে হয় তো বা একটা বিরুদ্ধ অভিমত বর্ত্তমান ছিল! তখন পর্য্যন্ত কেহ হয় তো মনে করিতেন, সুভাষচন্দ্র এক শত্রুকে বিতাড়িত করিবার জন্য অপর এক বিদেশী শত্রুকে আমন্ত্রণ করিয়া আনিতেছিলেন; সুতরাং জয়চাঁদের সঙ্গেই তিনি তুলনীয়, এবং তাঁহার সৈন্যবাহিনী বিভীষণ-বাহিনী ছাড়া আর কিছুই নহে। কিন্তু সুখের বিষয়, ক্যাপ্টেন শা নওয়াজ, ক্যাপ্টেন সাহগল ও লেফ টেন্যাণ্ট ধীলনের বিচারকালেই প্রমাণিত হইয়াছে যে, সুভাষচন্দ্রের আজাদ-হিন্দ গভর্ণমেণ্ট ও আজাদ-হিন্দ ফৌজ একেবারেই জাপানের তাঁবেদার ছিল না,—এবং সেইজন্যই সুভাষচন্দ্রকে জাপানীদের সঙ্গে অবিরতই দৃঢ় ভাবে ও সুকৌশলে দ্বন্দ করিতে হইয়াছে। সুতরাং আজাদ-হিন্দ ফৗজের বিচারে এইটুকুই দেশবাসীর লাভ।
সমগ্র জগৎ আজ বুঝিয়া লইয়াছে, সুভাষচন্দ্রের ন্যায় দ্বিতীয় ব্যক্তি পৃথিবীতে অদ্যাপি জন্মগ্রহণ করেন নাই। পলায়নের অপমান-পঙ্কিল কালিমার মধ্য হইতে তিনি যে বিজয়-গৌরব অর্জ্জন করিয়াছেন, সেই অনুভূতি আজ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ, জরাজীর্ণ ভারতবর্ষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন-জলুষে মহিমোজ্জ্বল করিয়া তাহার লাঞ্ছিত নত মস্তকে তারুণ্যের কিরীট পরাইয়া দিয়াছে।