নেতাজী সুভাষ চন্দ্র/সুদূরের যাত্রী
ছয়
সুদূরের যাত্রী
কাবুলে উত্তমচাঁদের গৃহে—রুশদুতের সাহায্য প্রার্থনা—অক্ষশক্তির সাহায্য প্রার্থনা—বে-আইনী পন্থায় মস্কৌ যাইবার সঙ্কল্প—অক্ষশক্তি-কর্ত্তৃক পাসপোর্ট মঞ্জুর—বার্লিণ যাত্রা—২৮শে মার্চ্চ বার্লিণে।
সুভাষচন্দ্র কলিকাতা হইতে বাহির হন, ১৯৪১ সালের ১৫ই জানুয়ারী— রাত তখন ৮টা। তারপর চল্লিশ মাইল দূরবর্ত্তী এক রেলওয়ে স্টেশন হইতে ট্রেণে চাপিয়া পেশোয়ার পৌছান ১৭ই জানুয়ারী রাত ৯টায়। ১৯শে জানুয়ারী তাঁহারা পেশোয়ার হইতে কাবুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং কাবুলে পৌঁছিতে তাঁহাদের তিনদিন কাটিয়া যায়।
কাবুলে লাহোরী-দরওয়াজার সরাইখানায় ১৩ দিন কোন রকমে বাস করিয়া, একদিন প্রাতঃকালে রহমৎ খাঁ অর্থাৎ ভগৎরাম পুনরায় উত্তমচাঁদের অন্বেষণে তাঁহার দোকানে যাইয়া উপস্থিত হইলেন।
সেদিন ৩রা ফেব্রুয়ারী।—
উত্তমচাঁদ তাঁহার দোকানে বসিয়া আছেন, তাঁহার এক বালক কর্ম্মচারী অমরনাথও সেখানে উপস্থিত, এমন সময় খাকী পেশোয়ারী পোষাকে এক অপরিচিত পাঠান তাঁহার দোকানে প্রবেশ করিয়া, তাঁহাকে পুস্তুভাষায় অভ্যর্থনা করিলেন, “আস্সালাম আলাইকুম।”
উত্তমচাঁদ বিস্মিত ও চমকিত হইলেন। তিনি একমুহূর্ত্ত নীরব থাকিয়া, পরক্ষণে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বলুন, আপনার কি প্রয়োজন?”
আগন্তুক কোন কথা কহিলেন না, তিনি দু’ একবার ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিয়া অবশেষে অমরনাথের দিকে চক্ষু ফিরাইলেন।
উত্তমচাঁদ বুঝিলেন, আগন্তুক অমরনাথের সম্মুখে কথা বলিতে চাহেন না। তিনি তখন অমরনাথকে স্থানান্তরে সরাইবার অভিপ্রায়ে তাহাকে কহিলেন, “যাও, তুমি দুই কাপ চা লইয়া আইস।”
অমরনাথ চলিয়া গেল—আগন্তুক তখন তাঁহার পরিচয় দিয়া কহিলেন, “আমার নাম ভগৎরাম, মর্দ্দন জেলায় ঘল্লা-ধের গ্রামে আমার বাড়ী। আমারই ভাই পাঞ্জাবের গভর্ণর বাহাদুরকে গুলি করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। নওজোয়ান ভারত-সভার আমিও একজন কর্ম্মী ছিলাম।”
উত্তমচাঁদ এখন তাঁহাকে চিনিতে পারিলেন। যাহোক, তাঁহার কি প্রয়োজন, তিনি তাহা জানিতে চাহিলেন।
ভগৎরাম কহিলেন, “সুভাষবাবুর নাম নিশ্চয়ই জানেন। কয়েক দিন যাবৎ তিনি পলাইয়া কাবুলে আসিয়াছেন, আমরা তাঁহাকে রাশিয়ায় পাঠাইতে চাই; কিন্তু যে সরাইখানায় আমার সঙ্গে তিনি আছেন, সেখানে এক আফগান সি. আই. ডি. বড়ই উৎপাত শুরু করিয়াছে। তাই তিনি আমাকে আপনার নিকট পাঠাইয়াছেন। তাঁহার জন্য যদি একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করিয়া দেন!”
স্বর্গ হইতে চাঁদ খসিয়া পড়িলেও বুঝি উত্তমচাঁদ ইহা অপেক্ষা বেশী বিস্মিত হইতেন না! অন্তর্হিত সুভাষচন্দ্রের সহসা কাবুলে আবির্ভাবের সংবাদে তিনি এতই বিস্মিত হইলেন!
উত্তমচাঁদের সমগ্র অন্তঃকরণ আনন্দে ও গৌরবে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। স্বদেশপ্রেমের জ্বলন্ত প্রতিমূর্ত্তি, ভারতের জাতীয় মহাসভার ভূতপূর্ব্ব রাষ্ট্রপতি, বাংলার পুরুষসিংহ— সুভাষচন্দ্র বসু আজ বিপন্ন হইয়া তাঁহারই নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করিতেছেন! ইহা যে উত্তমচাঁদের পক্ষে কত বড় সৌভাগ্য ও কত বড় গৌরবের কথা, তিনি তাহা সম্পূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করিলেন। সুতরাং এই সুযোগ তিনি পরিত্যাগ করিতে পারেন না—তিনি ভগৎরামের এই প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করিলেন।
তিনি কহিলেন, “বোস্ বাবু আমার এখানে থাকিতে পারিবেন, কিন্তু গুটি কয়েক অসুবিধা আছে। আপনারা উভয়েই আছেন মুসলমানের ছদ্মবেশে। আমি আছি হিন্দু বস্তীতে। এখানে হিন্দুর বাড়ীতে, হিন্দুর বস্তীতে দুজন মুসলমানের বাস করা অনেকটা সন্দেহজনক হইয়া উঠে। কেবল তাহাই নহে, আমি থাকি উপর তলায়; আমার বাড়ীতে নীচের তলায় অন্য একটি ভাড়াটিয়া আছেন। অথচ সেই ভাড়াটিয়ার অজ্ঞাতসারেই আপনাদিগকে বাস করিতে হইবে।
তাহা ছাড়া, আরো একটা অসুবিধা এই যে, আমার স্ত্রী জার্ম্মাণ মহিলা—তিনি পর্দ্দানশীন নহেন। তাঁহাকে না জানাইয়া আপনাদিগকে বাড়ীতে রাখা—সে এক মহা সমস্যা! কাজেই আমি প্রথমে আমার এক মুসলমান বন্ধুর সাহায্য প্রার্থনা করিব। মুসলমানের বাড়ীতে মুসলমানের অবস্থান, একেবারেই সন্দেহজনক হইবে না।
আমার সেই মুসলমান বন্ধুটিকে আমরা ‘হাজি সাহেব’ বলিয়া ডাকি। তিনি সত্তর বৎসর বয়স্ক এক বৃদ্ধ ব্যক্তি; এক জার্ম্মাণ মহিলাকে তিনি বিবাহ করিয়াছেন; চীন, জাপান, আমেরিকা, জার্ম্মাণী ইত্যাদি বহুদেশ তিনি দেখিয়াছেন—বিষম ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাবাপন্ন। ভারতের জাতীয় আন্দোলনে তাঁহার খুবই সহানুভূতি আছে। আমি তাঁহাকে একবার বলিয়া দেখিব। যদি সেখানে হয় ভালই,—না হইলে অগত্যা আমার এইখানেই ব্যবস্থা হইবে। যাহোক্, আপনি বিকাল বেলায় বোস্ বাবুকে লইয়া আসিবেন।”
ভগৎরাম আশ্বস্ত হইয়া চলিয়া গেলেন; তিনি বলিয়া গেলেন, অপরাহ্নে ৪টার সময় তিনি বোস্ বাবুকে লইয়া আসিবেন।
অপরাহ্ণ—প্রায় ৪টা, মাত্র দশ মিনিট বাকী আছে, এমন সময় রহমৎ খাঁর ছদ্মবেশে ভগৎরাম পুনরায় উত্তমচাঁদের দোকানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
উত্তমচাঁদ তাঁহাকে একাকী দেখিয়া বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি একা কেন? বোস্ বাবু কোথায়?”
—“ঐ যে তিনি নদীর অপর তীরে দাঁড়াইয়া আছেন।” রহমৎ খাঁ বলিলেন।
উত্তমচাঁদের বাড়ী তাঁহার দোকানের সঙ্গেই। দোকানের সম্মুখ দিয়া কাবুল-নদী প্রবাহিত হইয়াছে। নদীর উপরে একটি সেতু। উত্তমচাঁদ ও রহমৎ সেই সেতুর দিকে অগ্রসর হইলেন।
সেতুর অপর প্রান্তে রহমৎ খাঁ যাঁহাকে বোস্ বাবু বলিয়া দেখাইয়া দিলেন, উত্তমচাঁদ তাঁহাকে দেখিয়া একেবারে বিস্মিত হইয়া গেলেন! তাঁহার বেশ-ভূষা, চেহারা—সম্পূর্ণই পাঠান। তাঁহাকে দেখিয়া পাঠান না ভাবিয়া অন্য কিছু মনে করিতে পারে, এমন সাধ্য কাহারও ছিল না! কে বলিবে ইনিই সুভাষচন্দ্র? তাঁহার সেই অতিপরিচিত চশমাটি পর্য্যন্ত নাই।
যা হোক্, পরিপূর্ণ বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া, শ্রদ্ধামুগ্ধ অন্তরে উত্তমচাঁদ তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিয়া গৃহে লইয়া আসিলেন, এবং উপরে একটি কক্ষে সর্ব্বক্ষণ তালাবদ্ধ অবস্থায় তাঁহাদের থাকিবার ব্যবস্থা করিলেন।
হাজি সাহেবের কথা জিজ্ঞাসা করিতেই উত্তমচাঁদ জানাইলেন যে, সেখানে সুবিধা হইল না। ভগৎরাম চলিয়া যাইবার পরক্ষণেই তিনি হাজি সাহেবের নিকট গিয়াছিলেন। তিনি এতদিন অনেক বড়-বড় কথা বলিতেন বটে, কিন্তু সুভাষ বাবুকে বাড়ীতে রাখিতে তিনি নানা আপত্তি ও অসুবিধার কথা তুলিয়াছেন। মোট কথা, একজন পলাতক নেতাকে গৃহে আশ্রয় দিতে তিনি ভয় পাইতেছেন। সুতরাং বোস্ বাবুর স্থান তাঁহার নিজের বাড়ীতেই করিতে হইয়াছে।
উত্তমচাঁদ প্রথমে ভাবিয়াছিলেন, বোস্ বাবুর পরিচয় তিনি তাঁহার স্ত্রীর নিকটও গোপন করিয়া যাইবেন; কিন্তু বুদ্ধিমতী মহিলা প্রথম হইতেই সন্দেহ করিয়াছিলেন যে, তাঁহার স্বামী তাঁহার নিকট গোপন করিয়া দুটি অপরিচিত পুরুষকে গৃহে আশ্রয় দিয়াছেন। ইহাতে স্ত্রী-সুলভ অভিমানে তাঁহার সমস্ত হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল এবং তিনি তাঁহাদের পরিচয় জানিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। সুতরাং স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে অগত্যা উত্তমচাঁদকে প্রকৃত ঘটনা খুলিয়া বলিতে হইল।
সুভাষচন্দ্রের নাম ও দেশপ্রেমের পরিচয় উক্ত মহিলার অজ্ঞাত ছিল না। তিনি সেই মুহূর্ত্ত হইতে শ্রদ্ধামুগ্ধ হৃদয়ে স্বামীর এই মহৎ কাজে তাঁহাকে সাহায্যই করিতে লাগিলেন। সত্য বলিতে কি, উক্ত মহিলার সাহায্য না পাইলে, সুভাষচন্দ্রের গোপনে অবস্থিতি তৎকালে অসম্ভব হইয়া পড়িত।!
এই মহাপুরুষকে আত্মগোপনের সম্পূর্ণ সুযোগ দান সম্পর্কে বুদ্ধিমতী মহিলা এত বেশী সতর্ক ছিলেন যে, সুভাষচন্দ্রের কখনও কাশি উঠলেও পাছে অপর কেহ তাহা শুনিতে পায় এই আশঙ্কায়, তিনি অন্য কোন গোলমালের সৃষ্টি করিয়া অপরকে বিভ্রান্ত করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন!
কাবুলে অবস্থানকালে সুভাষচন্দ্রের অনুরোধে ভগৎরাম প্রথমে রাশিয়ার দূতের সঙ্গে কথাবার্ত্তা চালাইবার চেষ্টা করেন। কারণ, সুভাষচন্দ্রের অভিপ্রায় ছিল, তিনি মস্কৌ গমন করিবেন। কিন্তু বহু চেষ্টায়ও তাহাতে বিশেষ কোন ফলোদয় হইল না। মস্কৌএর দূতকে যেন এ বিষয়ে অনেকটা উদাসীন দেখা গেল!
অবশেষে ইটালীয় রাজদূতকেও সমস্ত ব্যাপার জানানো হইল এবং তাঁহাদের দেশে যাইবার জন্য পাসপোর্ট বা অনুমতি প্রার্থনা করা হইল। ইটালীর রাজদূত সীনর ক্যারণী ও তাঁহার পত্নী সীনরা কারণী, এ বিষয়ে সুভাষচন্দ্রকে ব্যক্তিগত ভাবেও যে শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখাইয়াছেন, এবং রোম হইতে তাঁহার পাসপোর্ট মঞ্জুর করাইবার জন্য যে অসাধারণ পরিশ্রম করিয়াছিলেন, তাহা সত্যই অতুলনীয়।
কিন্তু সুদীর্ঘ কাল চেষ্টার ফলেও যখন পাসপোর্ট মঞ্জুর হইয়া আসিল না, তখন সুভাষচন্দ্র অস্থির হইয়া পড়িলেন; তাঁহার আশ্রয়দাতা উত্তমচাঁদও তখন অন্য পন্থা চিন্তা করিতে লাগিলেন।
উত্তমচাঁদ সীমান্ত-প্রদেশের অধিবাসী এমন এক ব্যক্তিকে জানিতেন, যে অর্থের জন্য পারিত না এমন কোন অসাধ্য কর্ম্মই ছিল না। অথচ লোকটিকে তিনি বিশ্বাসী বলিয়াই মনে করিতেন। তিনি ভাবলেন, ঐ লোকটির সাহায্যে কি বোস্ বাবুকে রাশিয়ায় পাঠানো চলে না?
সে নাকি বহুবার পাসপোর্ট ব্যতীতই রাশিয়ায় গিয়াছে। আফগানিস্থান পার হইয়া কিছুদূর অতিক্রম করিলে ‘হ্যাঙ্গো’ নামে এক নদী আছে। সেই নদীর অপর তীরেই রাশিয়ার সীমান্ত।
উত্তমচাঁদ তাহার সহিত ধীরে-ধীরে আলাপ করিলেন, অবশেষে কাজের কথা আরম্ভ হইল।
সে লোকটি বলিল যে, পাসপোর্ট ছাড়াও রাশিয়ায় প্রবেশ করা যায়, তাহা একেবারেই কষ্টকর নহে। যাহারা সেই ভাবে প্রবেশ করে, তাহারা নৌকায় বা সেতু পার হইয়া যাইবার চেষ্টা করে না। তাহারা নদী পার হইবার জন্য ভিস্তিওয়ালার মশক ব্যবহার করিয়া থাকে।
মশকগুলি বায়ুপূর্ণ করিয়া ফুলাইয়া, তাহার উপর জেলেদের একখানি জাল বিছাইয়া দেওয়া হয়। যাত্রীরা তখন তাহাতে বসিয়া স্বচ্ছন্দে নদী পার হইতে পারে। সুভাষচন্দ্র ও রহমৎ খাঁ কাবুল-নদীও এইভাবে পার হইয়াছিলেন।
আর কোন উপায় না দেখিয়া উত্তমচাঁদ অগত্যা এই পন্থাই স্থির করিয়া রাখিলেন। সুভাষচন্দ্রও তখন রাশিয়ায় যাইবার জন্য এত বেশী আগ্রহান্বিত যে, আইনের পন্থায় কি বে-আইনী পন্থায়, তাহা তিনি বিচার করিতে চাহিলেন না। রাশিয়ায় পৌঁছিয়া যদি রাশিয়ার কারাগারেও তাঁহাকে অতিবাহিত করিতে হয়, তিনি তখন তাহাতেও সম্মত। তথাপি আফগানিস্থান পরিত্যাগ করিয়া, রাশিয়ায় যাওয়াই তাঁহার একমাত্র কাম্য হইল। সুতরাং ঐভাবে নদীপার হইয়া, বিপজ্জনক পন্থায় যাইতেও তাঁহার আপত্তি হইল না। কেবল ভাবিলেন, তাঁহার সেই ‘চালক’ লোকটি নির্ভরযোগ্য হইবে কি না!
সেই লোকটির সঙ্গে উত্তমচাঁদ দর-কষাকষি করিলেন, তাহার পারিশ্রমিক নির্দ্ধারণ করিলেন, কিছু অগ্রিমও প্রদান করিলেন; কিন্তু তথাপি আরও নানাভাবে ব্যাপারটিকে চিন্তা করিবার জন্য তখনও কোন দিনস্থির করা হইল না।
এমনই সময়ে একদিন—১৫ই মার্চ্চ, সীনর ক্যারণীর পত্নী আসিয়া সুভাষচন্দ্রকে একখানি পত্র প্রদান করিলেন।
পত্রে ছিল সুভাষচন্দ্রের বহু-আকাঙিক্ষত সুসংবাদ; অক্ষশক্তির অন্তর্গত ইটালী ও জার্ম্মাণী—তাঁহার পাসপোর্ট মঞ্জুর করিয়াছেন।
১৮ই মার্চ্চ প্রাতে ৯টার সময় তিনি অক্ষশক্তির সাহায্যে আফগানিস্থান হইতে যাত্রা করিলেন। একজন ইতালীয় ও দুই জন জার্ম্মাণ—তন্মধ্যে এক জন অতি তীক্ষ্ণধী ডাঃ ওয়েলার—তাঁহার সহযাত্রী হলেন। পাসপোর্টে সুভাষচন্দ্রের নাম লিখিত হইল ‘ক্যারাটাইন’!
এইভাবে বাংলার, তথা সমগ্র ভারতের সুভাষচন্দ্র, ছদ্মবেশী জিয়াউদ্দিন ও পরবর্ত্তী যাত্রাপথে ক্যারাটাইন্, স্বাধীনতার নেশায় উন্মত্ত হইয়া, স্বদেশ হইতে সুদূরে বিদেশের পথে সাময়িক ভাবে অন্তর্হিত হইলেন।
তাঁহারা প্রথমে একখানি মোটরে চড়িয়া কবুল হইতে রাশিয়ার সীমান্ত-পথে যাত্রা করেন। রাত্রিটা মধ্যপথে ‘পুল খুমড়ী’ নামক স্থানে সকলেই বিশ্রাম করিলেন এবং পরদিন, ১৯শে মার্চ্চ, তাঁহারা রাশিয়ায় প্রবেশ করিলেন।
২০শে মার্চ্চ সুভাষচন্দ্র ট্রেণে গমন করিলেন মস্কৌ। ২৭শে মার্চ্চ তিনি মস্কৌ উপস্থিত হইলেন বটে, কিন্তু মাত্র একটি রাত্রির বেশী তিনি সেখানে কাটাইতে পারিলেন না। সেখান হইতে রওয়ানা হইয়া ২৮শে মার্চ্চ তিনি জার্ম্মাণীর রাজধানী বার্লিনে উপনীত হইলেন।[১]
সুভাষচন্দ্র কাবুল পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবার মাত্র কয়েক দিন পরেই পুলিশ-বিভাগ জানিতে পারে যে, দুইজন ভারতীয় (সুভাষচন্দ্র ও ভগৎরাম) কাবুলে কোন হিন্দুর গৃহে আশ্রয় লইয়াছেন। সুতরাং তখন জোর পুলিশের অনুসন্ধান আরম্ভ হইল, উত্তমচাঁদের নিকট অনুসন্ধান করা হইল।
উত্তমচাঁদকে শুধু প্রশ্ন করিয়াই পুলিশ-বিভাগ ক্ষান্ত রহে নাই! সুভাষচন্দ্রকে আশ্রয়দান ও তাঁহাকে বিদেশ গমনে সাহায্য করিবার অপরাধে তিনি দীর্ঘকাল কারাদণ্ড ভোগ করিয়াছেন এবং পুলিশ তাঁহার লক্ষাধিক টাকার সম্পত্তি ক্রোক ও নিলাম-বিক্রয় করিয়া তাঁহাকে সর্ব্বস্বান্ত করিয়া দিয়াছে। বস্তুতঃ এই মহাপুরুষের সাহায্য না পাইলে, সুভাষচন্দ্রের যাবতীয় উদ্যম সম্ভবতঃ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হইয়া যাইত।
সুভাষচন্দ্র বার্লিণে পৌঁছিয়া প্রায় মাস তিনেক পরে হাজি সাহেবের জার্ম্মাণ পত্নীর নিকট যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাতে এই মহাপুরুষের নিকট তাঁহার প্রাণের গভীর কৃতজ্ঞতা জানাইয়া লিখিয়াছিলেন—
উত্তমচাঁদ নমস্তে! আপনি যাহা করিয়াছেন, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। সারাজীবনেও আমি তাহা কখনও ভুলিতে পারিব না।
- ↑ পাঠকদের স্মরণ থাকিতে পারে, ইহার মাত্র মাস-কয়েক পরেই—১৯৪১ সালের ২২শে জুন তারিখে রাশিয়া ও জার্ম্মাণীর মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়া উঠিয়াছিল।