নেতাজী সুভাষ চন্দ্র/অন্তর্দ্ধানের বিবরণ

পাঁচ

অন্তর্দ্ধানের বিবরণ।

মৌলবীর বেশে মোটরে—ট্রেণে পেশোয়ার—সঙ্গী রহমৎ খাঁ—জামরুদের পথে—‘গাঢ়ি’ গ্রামে—লালপুরা―কাবুল-নদী অতিক্রম—‘ঠাণ্ডী’তে বাসের অপেক্ষায়—লাহোরী-দরওয়াজা—এক সরাইখানায়—সি. আই. ডি.র পাল্লায়।

মাষ্টার তারা সিং বলিয়াছেন—সুভাষচন্দ্র ১৩ই ডিসেম্বর তারিখে গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হন; কিন্তু লালা উত্তমচাঁদ যাহা বলিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায় সুভাষচন্দ্রের গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইবার তারিখ ১৫ই জানুয়ারী অর্থাৎ তাঁহার অন্তর্দ্ধানের সংবাদ কলিকাতায় প্রকাশিত হইবার ১১ দিন পূর্ব্বেই তিনি কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়াছিলেন।

 সুভাষচন্দ্র ১৯৪১ সালের ১৫ই জানুয়ারী তারিখে রাত্রি ৮টার সময় তাঁহার এলগিন রোডের বাড়ী হইতে একজন মুসলমান মৌলবীর বেশে বাহির হইয়া, পূর্ব্ব-নির্দ্দিষ্ট বন্দোবস্ত অনুসারে একখানি মোটর-গাড়ীতে আরোহণ করেন।

 গোয়েন্দা-পুলিশের ব্যূহ ভেদ করিয়া গাড়ী নক্ষত্র-বেগে ছুটিয়া চলিল। তাঁহাকে কেহ দেখিল, কেহ দেখিল না; কিন্তু সন্দেহ করিল না কেহই। কারণ, সুভাষচন্দ্র পূর্ব্ব হইতেই লোক-লোচনের অন্তরালে অবস্থান করিয়া তাঁহার গুম্ফ ও শ্মশ্রুরাজি সুদীর্ঘ করিবার সুযোেগ লইয়াছিলেন।

 কলিকাতা হইতে চল্লিশ মাইল দূরে এক রেলওয়ে স্টেশন পর্য্যন্ত তিনি এই ভাবে মোটরে চলিয়া যান। তারপর একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকিট—পেশোয়ার পর্য্যন্ত—কিনিয়া লইয়া তিনি ট্রেণে উঠিয়া বসেন।

 রাত্রিটা বেশ নির্ব্বিঘ্নেই কাটিয়া গেল; কিন্তু পরদিন একজন শিখ আরোহী ঐ দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় উঠিয়া, সুভাষচন্দ্রের প্রায় মুখোমুখি হইয়া বসিলেন।

 কয়েকবার বেশ তীক্ষভাবে সুভাষচন্দ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কোথায় যাইতেছেন? আর কি আপনার পরিচয়?”

 সুভাষচন্দ্র কহিলেন, “আমার নাম জিয়াউদ্দিন, আমি একজন জীবন-বীমা কোম্পানীর অর্গানাইজার। আমি লক্ষ্ণৌ হইতে আসিতেছি, রাওয়ালপিণ্ডি যাইব।”

 শিখ ভদ্রলোক তাঁহার সেই কৈফিয়ৎ শুনিলেন বটে, কিন্তু বিশ্বাস করিলেন কিনা, কে জানে? যাহা হউক্, সুভাষচন্দ্র অনেকটা সন্ত্রস্তভাবেই রহিলেন; এবং গাড়ী যখনই কোন ষ্টেশনে উপস্থিত হইতেছিল, সুভাষচন্দ্র জনতার দৃষ্টি হইতে নিজেকে যথাসাধ্য গোপন করিবার জন্য, সংবাদপত্র পড়িবার ছলে, তাহারই পশ্চাতে নিজের মুখমণ্ডল ঢাকিয়া রাখিতেছিলেন।

 এইভাবে বাকি পথটা কাটিয়া গেল। অবশেষে ১৭ই জানুয়ারী রাত্রি ৯টার সময় তিনি পেশোয়ার পৌঁছিলেন।

 পূর্ব্ব-বন্দোবস্ত অনুসারে একখানি মোটরগাড়ী তাঁহার জন্য ষ্টেশনে অপেক্ষা করিতেছিল; তিনি স্টেশনে পৌঁছিলেই গাড়ীখানি তাঁহাকে লইয়া নির্দ্দিষ্ট গন্তব্য স্থানের দিকে ছুটিয়া চলিল।

 এই সময় সুভাষচন্দ্রের বেশভূষা ছিল, একটি আঁটা পায়জামা, একটি শেরওয়ানী ও ফেজটুপী। মোট কথা, তাঁহাকে দেখিয়া একজন মৌলবী ব্যতীত আর কিছুই বুঝিবার উপায় ছিল না।

 পেশোয়ারে তাঁহাকে দুইদিন অবস্থান করিতে হইল। তাঁহার নির্দ্দিষ্ট বন্ধুবান্ধবগণ এরূপ সাবধানেই তাঁহাকে রাখিয়াছিলেন যে, কেহই কোন সন্দেহ করিতে পারিল না। অনন্তর তাঁহারা পরামর্শ করিলেন, “এখন কাবুল যাইতে হইলে, পেশোয়ার হইতে তাঁহার কোন্ বেশে যাওয়া উচিত হইবে?”

 স্থির হইল, যুক্তপ্রদেশের মৌলবীর সাজ এখন আর সুবিধাজনক হইবে না। আফগানিস্থানে যাতায়াত করিতে পাঠান বেশভূষাই স্বাভাবিক ও সহজ। সুতরাং ১৯শে জানুয়ারী তারিখে, যাত্রার পূর্ব্বক্ষণে সুভাষচন্দ্র পাঠানের পরিচ্ছদে সজ্জিত হইলেন।

 পূর্ব্বেই ঠিক ছিল, নওজোয়ান ভারত-সভার সেক্রেটারী শ্রীযুক্ত ভগৎরাম ও অপর একজন বন্ধু তাঁহার সঙ্গে যাইবেন। সুতরাং জিয়াউদ্দিনের সহচর-রূপে তাঁহাদেরও মুসলমান এবং পাঠান হওয়া সঙ্গত। কাজেই তাঁহারাও পাঠানী পোষাকে সজ্জিত হইলেন, এবং ভগৎরামের নূতন নাম হইল, রহমৎ খাঁ।

 এইভাবে সুভাষচন্দ্র ও ভগৎরাম, উভয়েই ছদ্মবেশে— জিয়াউদ্দিন ও রহমৎ খাঁ নাম ধারণ করিয়া অপর এক বন্ধুর সহিত মোটরে চড়িয়া বসিলেন; মোটরও তৎক্ষণাৎ তাঁহাদিগকে লইয়া, পেশোয়ার পরিত্যাগ করিয়া জামরুদের পথে কাবুলের দিকে ছুটিয়া চলিল।

 জামরুদ কেল্লা তাহার অনতিদূরেই। পাছে ধরা পড়িয়া যান, এই আশঙ্কায় তাঁহারা ঠিক্ সেই পথে না যাইয়া, একটা কাঁচা রাস্তা ধরিয়া চলিলেন। কিন্তু ‘গাঢ়ি’ নামে এক গ্রামে আসিয়াই তাঁহাদের রাস্তা বন্ধ হইয়া গেল, মোটর চলিবার মত রাস্তা ইহার পরে আর নাই।

 অগত্যা সকলকেই নামিতে হইল, এবং রহমৎ ব্যতীত অপর যে বন্ধুটি পেশোয়ার হইতে এতটা পথ তাঁহাদের সঙ্গে আসিয়াছিলেন, তিনি এইখান হইতে মোটর লইয়া পুনরায় পেশোয়ারে ফিরিয়া গেলেন। স্থির হইল, সুভাষচন্দ্র ও রহমৎ খাঁ দুইজন রাইফেলধারী পাঠান প্রহরীসহ পদব্রজে অগ্রসর হইবেন। আর ইহাও স্থির হইল যে, সুভাষচন্দ্র এখন হইতে বোবা ও কালার অভিনয় করিয়া যাইবেন। কারণ, সেদেশী ভাষায় তিনি একেবারেই অনভিজ্ঞ!

 পরদিন তাঁহারা ভারত-দীমান্ত পার হইয়া গেলেন এবং পার্ব্বত্য জাতি-সমূহের এক ক্ষুদ্র গ্রামে—আদ্দা-শরীফের তীর্থস্থানে উপস্থিত হইলেন। আদ্দা-শরীফের মসজিদে যে পীর সাহেব ছিলেন তিনি তাঁহাদের সুখ-সুবিধার দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখিয়াছিলেন।

 এই সময় তাঁহাদের সঙ্গী প্রহরী দুইজন চলিয়া গেল, তৎপরিবর্ত্তে অপর তিনজন সশস্ত্র প্রহরী তাঁহাদের সঙ্গী হইল। পরদিন পুনরায় যাত্রা সুরু হইল এবং রাত্রি প্রায় ৯টার সময় যে স্থানে পৌঁছিলেন, তাহার নাম লালপুরা।

 লালপুরায় আসিবার ব্যবস্থা তাঁহাদের পূর্ব্ব হইতেই নির্দ্দিষ্ট ছিল। তদনুসারে তাঁহারা লালপুরার সর্দ্দার ও জমিদার, প্রকাণ্ড এক খাঁ-সাহেবের অতিথি হইলেন। আফগান-সরকারে এই খাঁ-সাহেবের ক্ষমতা ছিল অসীম।

 কঠোর পথশ্রমে ও উদ্বেগে সুভাষচন্দ্র এই সময় রীতিমত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। খাঁ-সাহেব তাহা লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “আর সামান্য কয়েক মাইল গেলেই আপনারা কাবুল-নদীর তীরে উপস্থিত হইবেন। সে নদী পার হইলেই ওপারে বাঁধানো রাস্তা পাওয়া যাইবে। সেই পথে বাস-চলাচল করে; তাহারই কোন বাসে চাপিয়া আপনারা কাবুলে পৌঁছিতে পারিবেন।”

 লালপুরা পরিত্যাগ করিবার কালে তিনি সুভাষচন্দ্র ও রহমৎ খাঁকে একটি পরিচয়পত্র লিখিয়া দিয়া বলিলেন, “পথে কেউ আপনাদের কোন সন্দেহ করিলে বা কোন বিপদের আশঙ্কা দেখিলে এই পরিচয়পত্র দেখাইবেন—তাহা হইলে কেহই আর কোন বাধা সৃষ্টি করিতে সাহস পাইবে না।”

 পরিচয়পত্রখানি পারসী ভাষায় লেখা। তাহাতে লিখিত ছিল:—

 “এই পত্র-বাহক রহমৎ খাঁ ও জিয়াউদ্দিন পার্ব্বত্য প্রদেশের অধিবাসী। ইঁহারা সাখি-সাহেবের দরগায় যাইতেছেন। ইঁহাদের চরিত্রের জন্য আমি নিজে দায়ী। কেহই যেন ইঁহাদিগকে কোনভাবে বিরক্ত করিতে না পারে, এই ভরসায় আমি এই সার্টিফিকেট লিখিয়া দিতেছি।”

 লালপুরা হইতে দুইটি সশস্ত্র প্রহরী সঙ্গে লইয়া সুভাষচন্দ্র ও রহমৎ খাঁ কাবুলের পথে, কাবুল নদীর দিকে অগ্রসর হইলেন। কিন্তু কাবুল-নদীর তীরে পৌঁছিয়া তাঁহারা একেবারেই হতাশ হইয়া পড়িলেন। কারণ, নৌকা—নৌকা কোথায়? নৌকার কোন চিহ্নও সেখানে নাই। এক অপরূপ উপায়ে সেদেশে সকলে পারাপার হইয়া থাকে।

 কতকগুলি ভিস্তির মশক একসঙ্গে বাঁধিয়া তাহার উপরে জেলেদের একখানি জাল বিছাইয়া দেওয়া হইয়াছে। পারাপারের সময় লোকজন ঐ জালের উপর বসিয়া থাকে।

 সুভাষচন্দ্র ও রহমৎ ইহাতে অভ্যস্ত নহেন; সুতরাং এই বন্দোবস্তে তাঁহারা প্রথমে শিহরিয়া উঠিলেন। যাহা হউক, সাহসে নির্ভর করিয়া অগত্যা ঐ ভাবেই তাঁহাদিগকে কাবুলনদী অতিক্রম করিতে হইল।

 কাবুল-নদীর পরেই আফগান-রাজ্য। আফগান-রাজ্যের প্রবেশপথে পদে-পদে অসংখা বাধা। কেহ সেখানে সশস্ত্র ভাবে প্রবেশ করিতে পারে না; সুতরাং নদীর অপর তীরেই সশস্ত্র প্রহরী দুটিকে তাঁহাদের বিদায় দিতে হইল। ইহা ছাড়া, এখানে-সেখানে থানাতল্লাসীর বন্দোবস্তও রহিয়াছে; কিন্তু খানাতল্লাসীর কোন ব্যাপারই তাঁহাদের পক্ষে নিরাপদ নহে।

 সুভাষচন্দ্র তখন ছদ্মবেশে জিয়াউদ্দিন; রহমৎ খাঁও প্রকৃতপক্ষে ভগৎরাম। সুতরাং দুইটি ছদ্মবেশী লোকের পক্ষে কি খানাতল্লাসীর সম্মুখীন হওয়া চলে? কাজেই তাঁহারা চিন্তিত হইলেন।

 পেশোয়ার হইতে ৫০ মাইল দূরবর্ত্তী এক গ্রামের নাম ‘ডাকা’। ‘ডাকা’য় তল্লাসীর হিড়িকটা খুব বেশী, অবশ্য মাঝপথে—পেশোয়ার ও ডাকার মাঝখানে কয়েক স্থানে যাত্রীদিগকে তল্লাসী করা হয়। সুভাষচন্দ্র ও ভগৎরাম অনেকটা ঘুরপথে চলিতেন, অনেকটা বেশী পথ হাঁটিতেন, তথাপি তাঁহারা সহজে খানাতল্লাসীর সম্মুখীন হইতেন না।

 ‘ঠাণ্ডী’ নামক এক জায়গায় আসিয়া তাঁহারা কাবুল যাইবার জন্য বাসের অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। সুভাষচন্দ্র ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত দেহে এক গাছের তলায় বিশ্রাম করিতে লাগিলেন, আর রহমৎ খাঁ যখনই যে বাস্ দেখিতে ছিলেন, তখনই তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার জন্য হাত নাড়িতেছিলেন।

 বহু চেষ্টায়, অবশেষে এক লরীতে তাঁহাদের স্থান হইল—তাঁহারা উঠিয়া বসিলেন।

 জানুয়ারী মাস—শীত তখন নিদারুণ। বিশেষতঃ আফগান-রাজ্যের সেই শীত,—তাহার কল্পনা করাও কঠিন। সারা মাঠ তখন তুষারে সাদা হইয়া গিয়াছে! তবু—তাহারই মধ্য দিয়া, সেই তুষার-রাজ্য ভেদ করিয়া, সারা দিন, সারা রাত লরী ছুটিয়া চলিল।

 শীতে তাঁহাদের হাত-পা জমিয়া যাইবার মত হইল— তাঁহারা মাঝে-মাঝে চা পান করিয়া দেহের রক্ত উষ্ণ রাখিবার প্রয়াস পাইতেছিলেন।

 দ্বিতীয় দিন তাঁহারা যে স্থানে উপস্থিত হইলেন, তাহার নাম ‘বাট্‌খাক। এখানে যাত্রীদের পাসপোর্ট ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়, তাহাদিগকে নানারকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়।

 সুভাষচন্দ্র ও রহমৎ খাঁকে অনুরূপ ভাবে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হইলে, রহমৎ খাঁ বলিলেন, “ইনি আমার বড় ভাই; ইনি কালা ও বোবা। আমি ইঁহাকে লইয়া ধর্ম্ম-কর্ম্মের জন্য সাখি-সাহেবের দরগায় যাইতেছি। আমরা স্বাধীন পার্ব্বত্য প্রদেশের অধিবাসী।”

 এই বলিয়া তিনি লালপুরার খাঁ-সাহেবের দেওয়া সেই সার্টিফিকেটখানা দেখাইলেন। সঙ্গে-সঙ্গে প্রশ্নকর্ত্তা একেবারে নীরব হইয়া গেলেন।

 সুভাষচন্দ্র ও রহমৎ খাঁ অনন্তর সেইখানে কিছু চা পান করিয়া পুনরায় লরীতে উঠিলেন, লরীও আবার পূর্ণ বেগে ছুটিয়া চলিল।

 অপরাহ্ণ ৪টা কি ৫টার সময় শরী আসিয়া থামিল আফগানিস্থানের রাজধানী কাবুল সহরে। তাঁহারা এইখানে নামিয়া পড়িলেন এবং লরী ওয়ালাকে তাহার প্রাপ্য ভাড়া মিটাইয়া দিলেন।

 আফগান-রাজ্যে ভারতবর্ষীয় মুদ্রার প্রচলন নাই। সুতরাং পেশোয়ার হইতেই তাঁহাদিগকে আফগানী মুদ্রার ব্যবস্থা করিতে হইয়াছিল। নতুবা আফগানিস্থানে আসিয়া তাঁহাদিগকে বিশেষ বিপদে পড়িতে হইত।


 সুভাষচন্দ্র ও রহমৎ খাঁ কাবুলে আসিলেন বটে, কিন্তু কাবুল হইলেও ইহ কাবুলের একটা সীমান্ত-অংশ মাত্র। ইহার নাম ‘লাহোরী-দরওয়াজা’।

 এক উন্মুক্ত প্রান্তরের উপর লাহোরী-দরওয়াজা অবস্থিত। বাস ও লরীর ড্রাইভারগণ এইখানে আসিয়া, তাহাদের বাস ও লরীতে নির্দ্দিষ্ট সংখ্যার অতিরিক্ত আরোহী থাকিলে তাহাদিগকে নামিয়া যাইতে বলে, এবং এই ভাবে তাহারা পুলিশের দৃষ্টিকে ফাঁকি দেয়।

 সুভাষচন্দ্র ও রহমৎ খাঁ এইখানে নামিলেন; কিন্তু নামিয়া এখন তাঁহারা কোথায় যাইবেন? একটা আশ্রয় চাই তো! নিকটে কোথায়ও আশ্রয়-স্থান আছে কি না, তাহা কে জানে? রহমৎ খাঁ বাজার পর্য্যন্ত পৌঁছিয়া একজনকে জিজ্ঞাসা করিলেন।

 সে অদূরে একখানি বাড়ী দেখাইয়া কহিল, “ঐ একটা সরাই আছে। খুঁজিয়া দেখিতে পার সেখানে কোন জায়গা খালি আছে কিনা।”

 সুভাষচন্দ্র ও রহমৎ খাঁ একটু হাঁটিয়া গিয়া সেই সরাইখানায় উপস্থিত হইলেন। রহমৎ পুস্তুভাষায় একজনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানে একটু আশ্রয় পাইতে পারি কি?”

 লোকটি পুস্তুভাষা বুঝিল না। কিচির-মিচির করিয়া ক্রুদ্ধ ভাবে কি জবাব দিল! আফগানীদের মাতৃভাষা যে পুস্তু নহে, এই সর্ব্বপ্রথম তাঁহাদের সেই অভিজ্ঞতা হইল। ইতোমধ্যে আর একটি লোককে দেখিতে পাইয়া রহমৎ তাহাকেও পুস্তু ভাষায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “মশাই, আপনি বলিতে পারেন, এই সরাইএর মালিক কে? আমরা আশ্রয়-প্রার্থী হইয়া এখানে আসিয়াছি।”

 ভাগ্যক্রমে সে তাঁহার পুস্তুভাষা বুঝিল। সে দূরে একখানি ঘর দেখাইয়া কহিল, “ঐখানে সরাইয়ের চৌকীদার আছে; আপনারা তাহার কাছে যান, সে সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া দিবে।”

 সুভাষচন্দ্র ও রহমৎ তখন সেই ঘরের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, গুর্খা-ধরণের একটি লোক দিব্যি লেপ গায়ে দিয়া শুইয়া আছে।

 রহমৎ তাহাকে আশ্রয়ের কথা জিজ্ঞাসা করিলে, সে উঠিয়া আসিল এবং একখানি ক্ষুদ্র কক্ষ দেখাইয়া কহিল, “আপনারা এইখানে থাকিতে পারেন। এক টাকা করিয়া ভাড়া লাগিবে।”

 কক্ষটি অতি ক্ষুদ্র ও জানালা-দরজা শূন্য। দরজা বন্ধ করিয়া দিলে তাহা গুদামে পরিণত হইয়া যায়। তবু তাহাই তখন তাঁহাদের নিকট স্বর্গ বলিয়া মনে হইল! তাঁহারা সেইখানেই নিজেদের জিনিষ-পত্র আনিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিলেন।

 সেই সরাইটির প্রধান অধিবাসী ছিল কতকগুলি উট, খচ্চর ও গাধা-ঘোড়া এবং তাহাদের সহিসদের দল। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় সুভাষচন্দ্র ও ভগৎরাম ওরফে রহমৎ খাঁকেও আজ সেইখানেই আশ্রয় লইতে হইল।

 দিন পাঁচ-ছয় ভাল ভাবেই কাটিয়া গেল। ইহার পরে একদিন রহমৎ আসিয়া সুভাষচন্দ্রকে কহিলেন, “সাদা পোষাকে একটা লোক কাছেই রুটির দোকানে বসিয়া থাকে। সে সর্ব্বদাই আমার দিকে কট্‌মট্‌ করিয়া তাকায়। তাহাকে দেখিয়া আফগান সি. আই. ডি.র লোক বলিয়া মনে হয়।”

 কথার সঙ্গে-সঙ্গেই সেই কনস্টেবলটি তাঁহাদের দরজার সম্মুখে উদয় হইল।

 সে এক মুহূর্ত্ত তীক্ষ্ণভাবে তাঁহাদের দিকে তাকাইয়া রহিল; তারপর পরিচিত পুস্তুভাষায় সতেজে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনারা কে? আর এখানে আসিয়াছেন কেন?”

 রহমৎ খাঁ সুভাষচন্দ্রকে দেখাইয়া কহিলেন, “ইনি আমার বড় ভাই, বোবা ও কালা, এবং অসুস্থ। আমি ইঁহাকে লইয়া সাখি-সাহেবের দরগায় যাইতেছি; কিন্তু অতিরিক্ত তুষারপাত হওয়ায়, সাখি-সাহেবের পথ-ঘাট এখন বন্ধ হইয়া গিয়াছে, কাজেই আমরা এখানে অপেক্ষা করিতেছি।”

 কনষ্টেবলটি কহিল, “আপনাদের কথা সত্য বলিয়া আমার বিশ্বাস হয় না। যাহোক্, আপনারা আমার সঙ্গে কোতোয়ালীতে চলুন।”

 সুভাষচন্দ্র ও রহমৎ খাঁর সমস্ত শরীর ঘামিয়া উঠিল। তাঁহারা ভাবিলেন,—এত পরিশ্রম, এত যত্ন, সবই কি বিফল হইল? যাহোক্, রহমৎ খাঁ যেন খানিকটা গরম হইয়াই কহিলেন, “বেশ, চলুন আমি যাইতেছি; কিন্তু আমার দাদা খুবই অসুস্থ, তিনি যাইতে পারিবেন না।”

 কনস্টেবলের গলার সুর কতকটা নরম হইয়া গেল; সে ভাবিল, “সত্যই তো একটা রুগ্ন লোককে থানায় লইয়া গেলে কি লাভ হইবে? বরং তাহা না করিয়া যদি—”

 সে কহিল, “বেশ, তাহা হইলে থাক্, কাহারও যাইবার দরকার নাই। কিন্তু সাবধান, খুব শীগ্‌গির এখান হইতে চলিয়া যাইবেন—ইহার যেন অন্যথা না হয়। তবে—যাওয়ার আগে চা খাওয়ার জন্য আপনারা আমাকে কিছু দিয়া যান—ষে শীত পড়িয়াছে!”

 রহমৎ খাঁ বিরুক্তি না করিয়া তাহার হাতে একখানি দশ টাকার নোট গুঁজিয়া দিলেন। কনষ্টেবলটি চায়ের দক্ষিণা, সেই নোটখানি লইয়া আনন্দের সহিত চলিয়া গেল।

 সেদিন চলিয়া গেল বটে, কিন্তু তিন দিন পরেই আবার সে আসিয়া উপস্থিত। সেদিনও তাহাকে দক্ষিণা বাবদ পাঁচটি টাকা দিয়া বিদায় করিতে হইল।

 সুভাষচন্দ্র এবং রহমৎ বুঝিলেন, পুলিশের এই ভূতটি তাঁহাদের কাঁধে এখন জোঁকের মত আঁটিয়া থাকিবে। এখন ইহার হাত হইতে অব্যাহতি পাইবার উপায় কি, তাঁহারা ইহা চিন্তা করিতে লাগিলেন।

 রহমৎ খাঁ অর্থাৎ ভগৎরামের নিকট সুভাষচন্দ্র শুনিয়াছিলেন যে, কাবুল শহরে উত্তমচাঁদ নামে একজন রেডিয়োব্যবসায়ী আছেন। তিনি এক সময় নওজোয়ান ভারত-সভার জেনারেল সেক্রেটারী ছিলেন এবং সেই সংশ্রবে ১৯৩০ সালে পুলিশ তাঁহাকে গ্রেপ্তারও করিয়াছিল।

 সুভাষচন্দ্র ইহা শুনিয়া ভাবিলেন, দেশের কাজে যাঁহারা একবার পুলিশের কোপদৃষ্টিতে পড়িয়া লাঞ্ছিত হইয়াছেন, তাঁহাদের পক্ষে সুভাষচন্দ্রকে আশ্রয় দান করা অসম্ভব না হইতেও পারে। সুতরাং তিনি রহমৎ খাঁ অর্থাৎ ভগৎরামকে কহিলেন, “আপনি একবার সেইখানে যান, দেখুন তিনি আশ্রয় দিতে রাজী হন কি না!”

 সুভাষচন্দ্র বলিলেন বটে, কিন্তু রহমৎ খাঁ তখনও ইতস্ততঃ করিতেছিলেন। তিনি ভাবিতেছিলেন, “কি জানি, উত্তমচাঁদ যদিই বা কোন সাহায্য না করেন।”

 এই ভাবে হয়তো আরও কিছুকাল কাটিয়া যাইত, কিন্তু পরদিন যখন সেই সি. আই. ডি. কর্ম্মচারীটি আবার দেখা দিল, তখনই ব্যাপারটা খুব জরুরী হইয়া উঠিল।

 পুলিশ-কর্ম্মচারীটি কহিল, “খাঁ সাহেব, আপনারা এখনো এখানে আছেন? দেখুন আপনাদের সম্পর্কে আমার এখন নানা রকম সন্দেহ হইতেছে। আমি আজ আমার দারোগাসাহেবের সঙ্গে এ-বিষয়ে কথা বলিয়াছিলাম; তিনি আপনাদিগকে থানায় লইয়া যাইতে বলিয়াছেন। কাজেই চলুন, এখনই একবার থানায় যাইতে হইবে। আপনার দাদাটি বোবা-কালা হইলেও একটুখানি হাঁটিতে না পারিবার কোন কারণ নাই।”

 রহমৎ খাঁ বলিলেন, “নিতান্ত দরকারী মনে করেন তো আমি যাইব; কিন্তু আমার দাদা অসুস্থ, তাঁহাকে কেন কষ্ট দিবেন?” এই বলিয়া তিনি একখানি পাঁচ টাকার নোট তাহার হাতে গুঁজিয়া দিলেন।

 কনষ্টেবল সেই নোটখানি পকেটে রাখিতে-রাখিতে বলিল, “না, না, ওসব দু’পাঁচ টাকার ঘুষ আমি গ্রহণ করি না। চলুন, থানায় চলুন!”

 রহমৎ খাঁ পুনরায় একখানি পাঁচ টাকার নোট বাহির করিলেন এবং পুলিশটিকে তাহা দিলেন। কনষ্টেবলটি তাহা গ্রহণ করিল বটে, তথাপি দৃঢ় হইয়া রহিল।

 সে কহিল, “আপনারা আমাকে ভুল বুঝিয়াছেন। এই সামান্য গোটা-কয়েক টাকার জন্য আমি আমার দারোগাসাহেবের অবাধ্য হইতে পারি না।”

 অগত্যা আরও সাতটাকা— খরচ করিতে হইল; কিন্তু সতেরোটি টাকা হস্তগত করিয়াও সে নিশ্চল ভাবে দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার নড়িবার কোন লক্ষণই দেখা গেল না। সুভাষচন্দ্র ও রহমৎ খাঁ বিস্মিতভাবে তাহার দিকে তাকাইলেন।

 রহমৎ খাঁর হাতে ছিল সুভাষচন্দ্রের রিষ্ট্ ওয়াচ্। তাঁহারা উভয়েই লক্ষ্য করিলেন, কনস্টেবলের সতৃষ্ণ দৃষ্টি তাহাতেই নিবদ্ধ। মুখ ফুটিয়া সে তখন একবার জিজ্ঞাসা করিয়াও ফেলিল, “এই ঘড়ীটা খুব সুন্দর, বেশ দামী বলিয়া মনে হয়; ইহার দাম কত?”  রহমৎ খাঁ কহিলেন, “দাম?—কত দাম মনে নাই; তবে—ইহার দাম খুব বেশী নহে।”

 —“বটে! তাহা হইলে এই ঘড়ীটা আমায় দিন না? টাকা তো আপনারা আমাকে খুব বেশী কিছু দেন নাই!”

 উভয়েই বুঝিলেন, আর উপায় নাই! একবার যখন বাঘের নজর পড়িয়াছে, তখন আর ইহার রক্ষা নাই। কাজেই ঘড়ীটি তাহাকে দিতে হইল।

 এই ভাবে সেদিন কিছু মোটা মাল আদায় করিয়া সে চলিয়া গেল। রহমৎ খাঁও পরামর্শ অনুসারে উত্তমচাঁদের দোকানের খোঁজে বাহির হইয়া পড়িলেন।

 দোকান পাওয়া গেল বটে, কিন্তু উত্তমচাঁদ ছিলেন না, তাঁহার সঙ্গে দেখা হইল না। সেদিন আরও একবার তাঁহার খোজ করা হইল—কিন্তু একবারও তাঁহার দেখা পাওয়া গেল না।

 কনস্টেবলটি পরদিন আবার আসিয়া উদয় হইল। রহমৎকে দেখিয়াই সে কহিল, “খাঁ সাহেব, বড়ই বিপদ্ হইয়াছে! আচ্ছা, আপনার সেই ঘড়ীটার দাম কত ছিল বলিতে পারেন?”

 —“তাহা মনে নাই। কেন, কি হইয়াছে?”

 কনস্টেবল কহিল, “না, এমন কিছু নয়; তবে ঘড়ীটা দেখিতে ছিল বড়ই সুন্দর; কিন্তু তাহাতেই হইল যত বিপদ্! আমার দারোগা-সাহেব সেটি দেখিয়াই মুগ্ধ হইলেন, তিনি সেটি আমার নিকট হইতে লইয়া গিয়াছেন। যাহোক্, আমি সেটি ফিরাইয়া লইবার চেষ্টা করিব। কিন্তু দাদা, হাত আমার একেবারে খালি,—একখানা পাঁচ টাকার নোট যদি ধার দেন! তিনি আপনাদের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন; আমি তাঁহাকে বলিয়াছি, আপনারা এই সরাই হইতে কোথায় চলিয়া গিয়াছেন! যাহোক—পাঁচ টাকার একখানি নোট যদি—”

 উপায় নাই। রহমৎ খাঁ নিঃশব্দে তাহাকে একটি পাঁচ টাকার নোট বাহির করিয়া দিলেন। কনষ্টেবলটি তাহা ‘ধার’ লইয়া অদৃশ্য হইয়া গেল।

 কনস্টেবল অদৃশ্য হইতেই সুভাষচন্দ্র ও রহমৎ খাঁর পরামর্শ সভা বসিল। স্থির হইল, মুক্তি পাইতে হইলে আজই অন্যত্র যাইতে হইবে।

 উত্তমচাঁদের সঙ্গে তখনও তাঁহাদের দেখাই হয় নাই। রহমৎ খাঁ সেই উদ্দেশ্যেই বাহির হইয়া গেলেন।