নেতাজী সুভাষ চন্দ্র/অন্তর্দ্ধান

চারি

অন্তর্দ্ধান

অন্তর্দ্ধান—নানা জনরব—সুভাষচন্দ্রের রেডিয়ো-বার্ত্তা—অন্তর্দ্ধানের কারণ—সুভাষচন্দ্রের স্বপ্ন—মহাজাতি-সদনের ইতিহাস—সাময়িক আকর্ষণ—অন্তর্দ্ধানের সর্ব্বপ্রথম বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ।

১৯৪১ সালের ২৬শে জানুয়ারী।—

 ২৬শে জানুয়ারী প্রতি বৎসরই ‘স্বাধীনতা দিবস’ নামে কীর্ত্তিত হইয়া আসিতেছে; সুতরাং সেদিনও ছিল জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্মরণীয় দিন; কিন্তু সেই স্মরণীয় দিনে সহসা এক বিস্ময়কর সংবাদে সকলেই চমকিত হইয়া উঠিল—সকলেই শুনিল, সুভাষচন্দ্র তাঁহার গৃহে নাই।

 কোথায় সুভাষচন্দ্র? এল্‌গিন্ রোড়ের সমস্ত প্রবেশ-পথ, আশে-পাশে চতুর্দ্দিক, সবই যে গোয়েন্দা-বিভাগের নখদর্পণে! সুভাষচন্দ্র জেলখানা হইতে মুক্তিলাভ করিয়া গৃহেই আসিয়াছিলেন বটে, কিন্তু সে তো সম্পূর্ণভাবে মুক্তি নহে! সরকারী অনুগ্রহে তিনি জেলখানায় আবদ্ধ না থাকিয়া, তখন কার্য্যতঃ গৃহে অবরুদ্ধ ছিলেন মাত্র! সুতরাং সি. আই. ডি. বিভাগের গোয়েন্দাগণ তখনও তাঁহাকে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চোখেচোখে রাখিয়াছিল। হিংস্র শিকারী কুকুরের ন্যায় তীক্ষ্ণদৃষ্টি গোয়েন্দাদের সদা-সতর্ক চক্ষুকে ফাঁকি দিয়া, অসুস্থ সুভাষচন্দ্র কোথায় যাইতে পারেন? না, তাহা কখনও সম্ভব?— কাজেই সম্ভব-অসম্ভব কত স্থানেই সুভাষচন্দ্রের অন্বেষণ আরম্ভ হইল!

 চতুর্দ্দিকে কড়া পাহারা—তাহার মধ্য হইতে একটা লোক বেমালুম অদৃশ্য হইয়া গেল! এল্‌গিন্ রোডের বাড়ীর ভিতর, বাড়ীর বাহিরে, সমগ্র পাড়ায় এবং অবশেষে সারা কলিকাতায় ও ভারতের সর্ব্বত্র-সুভাষচন্দ্রের অন্বেষণ আরম্ভ হইল; গোয়েন্দা বিভাগ ও বিশাল পুলিশ-বিভাগ, সকলেই কর্ম্ম-তৎপর হইয়া উঠিল।

 পুলিশের পক্ষে, তথা সারা শাসন-যন্ত্রের পক্ষে ইহা যে কত বড় লজ্জা ও পরাজয়, সকলেই তাহা মর্ম্মে-মর্ম্মে বুঝিতে পারিল। কিন্তু মর্ম্মে-মর্ম্মে অনুভব করিলেও তখন আর উপায় কি ছিল? সুভাষচন্দ্রের আত্মীয়-স্বজন ও অন্যান্য যাঁহারা সেই এলগিন্ রোডের বাড়ীতেই অবস্থান করিতেছিলেন, তাঁহারা সরকারী পুলিশী লাঞ্ছনার শত আশঙ্কায়ও বিশেষ কোন খবরই দিতে পারিলেন না।

 কেবল এইটুকু জানা গেল যে, ঘটনার কিছুকাল পূর্ব্ব হইতেই সুভাষচন্দ্র নির্জ্জনে নিঃসঙ্গ জীবন অতিবাহিত করিতেছিলেন। সুভাষচন্দ্র বিশেষ ভাবে সকলকেই তখন জানাইয়া দিয়াছিলেন, কেহই যেন তাঁহার কক্ষে প্রবেশ না করে; কাহারও নিতান্ত প্রয়োজন হইলে, তিনি সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করিতে পারেন; কিন্তু কখনও কোন কারণেই তাঁহার সঙ্গে কাহারও সাক্ষাৎ হইবে না।

 আহার্য্য পরিবেষণ সম্পর্কেও কয়েক দিন পূর্ব্বে তিনি নির্দ্দেশ দিয়াছিলেন যে, তাঁহার আহার্য্য লইয়া কেহ ভিতরে আসিবে না,—কক্ষের বাহিরে একটি টেবিলের উপর আহার্য্য রাখিয়া চলিয়া যাইবে, তিনি প্রয়োজন মত নিজেই তাহা আনিয়া লইবেন।

 মোট কথা, সুভাষচন্দ্র তাঁহার গৃহমধ্যেই নির্জ্জনে আধ্যাত্মিক জীবন অতিবাহিত করিতেছিলেন, কেবল এইটুকু সংবাদই সংগৃহীত হইল, তাঁহার পলায়নের পন্থা-সম্পর্কে কোন সংবাদই পাওয়া গেল না।

 সুভাষচন্দ্রের এই রহস্যজনক নিরুদ্দেশের পর কিছুকাল তাঁহার কার্য্যাবলী সম্বন্ধে কোনরূপ জ্ঞান আহরণ করা একেবারেই সম্ভব হয় নাই। তবে জনশ্রুতি, বৈদেশিক রেডিয়ো এবং সাংবাদিকগণের নিকট হইতে তাঁহার জীবন ও কার্য্যাবলী সম্বন্ধে যাহা জানা গিয়াছিল, আজ সেগুলি উন্মাদ জনরব বলিয়া প্রমাণিত হইলেও, কিছু কিছু এখানে লিপিবদ্ধ হইল।—

 অ্যাসোসিয়েটেড্ প্রেসের বোম্বাইয়ের সংবাদাতা তৎকালে লিখিয়াছিলেন,—

 “তিনি ১৯৪১ খৃষ্টাব্দে কলিকাতায় তাঁহার নিজ গৃহে অন্তরীণাবস্থায় ছিলেন। তথা হইতে সহসা একদিন তিনি অন্তর্হিত হন। তিনি ভারতবর্ষ ত্যাগ করিয়া, গরুর গাড়ীতে লুকাইয়া আফগানিস্থানে যান।

 ১৯৪২ খৃষ্টাব্দে তিনি বার্লিণ হইতে বেতার-বক্তৃতা করেন বলিয়া শোনা যায়। উক্ত বৎসরেই তিনি জাপানের টোকিও সহরে উপনীত হন। এই স্থানে জাপানীরা একদল ভারতীয় সৈন্যের সেনাপতি-পদে তাঁহাকে বরণ করিতে প্রতিশ্রুত হয়। এই সৈন্যদল ভারতবর্ষ হইতে ইংরাজদিগকে তাড়াইয়া দিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল।”[]

 বােম্বাইয়ের ভূতপূর্ব্ব মেয়র মিঃ ইউসুফ মেহেরালি বলিয়াছিলেন,—

 “যখন দেশে ব্যক্তিগত আইন-অমান্য়-আন্দোলন চলিতেছিল, তখন সমগ্র দেশ হঠাৎ এই সংবাদে চমকিত হইয়া উঠিল যে, সুভাষ অন্তর্হিত হইয়াছেন। কেহই জানে না যে তিনি কোথায় আছেন! কেহ কেহ বলেন যে, তিনি সংসারাশ্রম পরিত্যাগ করিয়া হিমালয়ে সন্ন্যাসাশ্রমে আছেন—যৌবনের প্রারম্ভেও তিনি একবার অনুরূপ কার্য্য করিয়াছিলেন। কেহ কেহ বলেন যে, তিনি পাতালে গমন করিয়াছেন! আবার কাহারও মত,—তিনি কোন বৈদেশিক রাজ্যে পলায়ন করিয়াছেন! সুভাষ কোথায়? জনরব তাঁহাকে একই সময়ে কলিকাতা, রেঙ্গুণ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, মস্কো, বার্লিণ, রোম, টোকিও প্রভৃতি স্থানে অবস্থিতি করিতেছেন বলিয়া প্রকাশ করিল।”

 রয়টার এইসঙ্গে কিছু যােগ করিয়া বলিয়াছিলেন যে, সুভাষচন্দ্র জার্ম্মাণীতে যাইয়া হিট্‌লারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়াছেন! হিট্‌লার তখন সুভাষকে ‘ফুরার অব্ ইণ্ডিয়া’ (‘Fuhrer of India’) নামে সম্বোধন করিয়াছিলেন। পরে জানা গিয়াছে যে, সুভাষ ভারতীয় জাতীয় বাহিনী গঠন করিয়া তাহার সর্ব্বাধ্যক্ষ-রূপে স্বাধীন ভারতে প্রবেশ করিবেন।

 সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষ ছাড়িয়া বিদেশে চলিয়া গিয়াছেন, এই সংবাদ একদিন সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইল সুভাষচন্দ্রের নিজের কথায়। তিনি একদিন রেডিয়ো-বার্ত্তায় ঘোষণা করিলেন,—

 “বিগত ২০০ বৎসরের বৈদেশিক ইতিহাস আমি গভীর অভিনিবেশ-সহকারে পাঠ করিয়াছি—বিশেষতঃ স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাস। কিন্তু কোথাও বৈদেশিক সাহায্য ব্যতিরেকে কোন দেশ স্বাধীনতা অর্জ্জন করিয়াছে, এইরূপ একটি দৃষ্টান্তও পাই নাই; এবং ব্রিটেনও শুধু যে স্বাধীন জাতির সাহায্য গ্রহণ করিতেছে এমন নয়, পরন্তু ভারতের মত পরাধীন দেশের সাহায্যও গ্রহণ করিতেছে। যদি ব্রিটেনের সাহায্য ভিক্ষার কোন দোষ না থাকে, তবে সাহায্য গ্রহণে ভারতের পক্ষে তো কোন দোষই নাই; এবং আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধে সর্ব্বপ্রকার সাহায্যই সাদরে বরণ করিব।[]

 সুভাষচন্দ্রের এই রেডিয়ো-বার্ত্তায় স্পষ্টই বুঝিতে পারা গিয়াছিল যে, স্বাধীনতার উদগ্র নেশায় উন্মাদের ন্যায় আত্মহারা হইয়া, বিপদ্-সঙ্কুল বিশ্বের পথে অতি রহস্যজনক ভাবে তিনি যে অন্তর্হিত হইয়াছিলেন, তাহার মূলে ছিল, বিদেশী শক্তির সাহায্যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আনয়নের আকাঙক্ষা; কিন্তু পরাধীন দেশের এক পলাতক বন্দীর পক্ষে এমন আকাঙক্ষা—ইহা কি স্বপ্ন নহে?

 হয়তো স্বপ্ন—যথার্থ ই স্বপ্ন! কিন্তু সুভাষচন্দ্র তাঁহার সারাজীবনই যে এরূপ স্বপ্ন দেখিয়া কাটাইয়াছেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেন:—

 “ওরা বলে, আমি স্বপনচারী। আমি স্বীকার করছি, আমি স্বপনচারীই বটে। সারাজীবন আমি স্বপ্ন দেখেছি। শিশুকাল থেকেই এ আমার এক রোগ। কত স্বপ্নই না আমি দেখেছি। কিন্তু আমার স্বপ্নের সেরা স্বপ্ন আমার জীবনের সব চাইতে প্রিয় স্বপ্ন—ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন!”

 ১৯৩৭ সালে—সুভাষচন্দ্র যখন স্বাস্থ্যলাভার্থ ডালহৌসী পাহাড়ে অবস্থান করিতেছিলেন, আমরা জানি, তখনও তিনি একবার স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন! সুভাষচন্দ্র ও তাঁহার বন্ধু শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত বিজয়রত্ন মজুমদার মহাশয় তখন ডক্টর ধরমবীরের অতিথি।

 সুভাষচন্দ্র সেই সময় একদিন বিজয়বাবুকে যাহা বলিয়াছিলেন, স্বপ্ন হইলেও, আমরা তাহা নিম্নে উদ্ধৃত করিলাম।

 “কাউকে এখনও বলিনি, আজ আপনাকেই প্রথম বলছি, কলকাতায় আমার একটা কংগ্রেস-ভবন গড়বার ইচ্ছা আছে। ‘কংগ্রেস হাউস্’ নাম হলেও তাতে শুধু যে কংগ্রেসের কাজই হবে, তা নয়! আসলে হবে সেটা জাতীয় বাহিনীর প্রধান শিবির! তার সঙ্গে থাকবে লাইব্রেরী, ষ্টেজ, জিমনেসিয়াম; কংগ্রেস-অফিসও থাকবে বটে; কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি মুলতঃ সৈনিক-কেন্দ্র হবে। অনেক দিন থেকেই প্ল্যানটা মাথায় আছে, এইবার কলকাতায় গিয়ে কাজ আরম্ভ করবো।”[]

 কাজ তিনি আরম্ভও করিয়াছিলেন— তাঁহার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করিতে তিনি উদ্যোগীও হইয়াছিলেন। ১৯৩৮ সালে কলিকাতা কর্পোরেশনের সভায় সুভাষচন্দ্রের স্বপ্নে-দেখা এই রকম একটি জাতীয় ভবনের কথা আলোচিত হয়।

 কলিকাতা কর্পোরেশন বার্ষিক একটাকা মাত্র খাজনায়, চিত্তরঞ্জন এভিনিউর উপর অবস্থিত বৃহৎ একখণ্ড ভূমি সুভাষচন্দ্রকে প্রদান করেন। কিন্তু জমি পাওয়া গেলেই তো প্রাসাদ নির্ম্মাণ সম্ভব হয় না! সুতরাং সুভাষচন্দ্রের গুণমুগ্ধ ভক্তগণ—যাঁহারা কর্পোরেশনের অভ্যন্তরে ছিলেন—তাঁহারা নির্ম্মাণ কার্য্যের জন্য কর্পোরেশন হইতে একলক্ষ টাকা অর্থসাহায্যও মঞ্জুর করাইয়াছিলেন।

 কিন্তু ব্যাপারটা সমাপ্ত হইল ঐখানেই। ১৯৩৯ সালের ত্রিপুরী কংগ্রেসের বাঁশী তখনও করুণ সুরে বাজিয়া যাইতেছিল! ডাঃ পট্টভি সীতারামিয়ার পরাজয়ে মহাত্মা গান্ধী স্বয়ং পরাভব স্বীকার করিয়া এবং ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদিগকে একে-একে নিজের কোলে টানিয়া লইয়া নব-নির্ব্বাচিত রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্রকে হস্তপদ-বিহীন ‘ঠুঁটো জগন্নাথে’ পরিণত করিয়াছিলেন। আর রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্র তখন পুনঃ পুনঃ কংগ্রেসের ঐক্য-সাধনের চেষ্টা করিয়া, অবশেষে হতাশ হইয়া, পদত্যাগ করিয়া নিষ্কৃতি পাইয়াছিলেন।

 দেশের আবহাওয়া তখন এইরূপ—বাংলা ও বিহারের দ্বন্দ্ব, প্রাচীন ও তরুণের দ্বন্দ্ব। কিন্তু প্রাচীন ও তরুণের এই দ্বন্দ্বে, জগৎ স্বভাবতঃই প্রাচীনের চরণে শ্রদ্ধানত হইয়া পড়ে। সুতরাং কর্পোরেশনেও অতি অল্প দিনের মধ্যে তাহাই আত্মপ্রকাশ করিল। শ্রীযুক্ত বিজয়বাবু লিখিয়াছেন:—

 “কর্পোরেশনে একদল লোক ধুয়া ধরিয়া ফেলিল। বলিল, রাধাও নাচিবে না, তেলও পুড়িবে না, অর্থাৎ লক্ষ টাকায় জাতীয় ভবনও হইবে না, ভারতীয় জাতীয় বাহিনীও হইবে না,—টাকাগুবি গান্ধী-মারণ যজ্ঞে ঘৃতাহুতি দিতেই শেষ হইয়া যাইবে।”


 সুতরাং তাহারা আইনের প্যাঁচে ফেলিয়া কর্পোরেশনের প্রধান কর্ম্মকর্ত্তাকে আটকাইয়া ফেলিলেন, আর শেষ মুহূর্ত্তে আসিল হাইকোর্টের ইঞ্জাংশন্! কাজেই লক্ষ টাকার চেক্ আর কোনদিনই সুভাষচন্দ্রের হস্তগত হইল না—আর তাহার ফলে সেই কংগ্রেস-ভবন বা জাতীয় ভবন—গুরুদেবের প্রদত্ত নামে যাহা ‘মহাজাতি-সদন’ নামে পরিচিত হইয়াছিল,—আজও তাহা অসমাপ্ত ও অবজ্ঞাত অবস্থায় কলিকাতা মহানগরীর বুকে জাতীয় ঈর্য্যা বিদ্বেষ ও ষড়যন্ত্রের মূর্ত্ত সাক্ষ্যের ন্যায় দণ্ডায়মান।

 বিগত যুগের ‘মহাজাতি-সদনের’ এই মর্ম্মভেদী করুণ ইতিহাস এস্থলে অপ্রাসঙ্গিক হইলেও আমাদের বলিবার উদ্দেশ্য এই যে, সুভাষচন্দ্র চিরদিনই কত স্বপ্ন দেখিয়া আসিয়াছেন।

 বাংলার বুকে একটা জাতীয় ভবন হইবে, জাতীয় বাহিনী গড়িয়া উঠিবে, সামরিক শিক্ষাকেন্দ্র হইবে, ইহাই না তাঁহার সেদিনের স্বপ্ন ছিল?

 ১৯২৮ সালেও বুঝি সুভাষচন্দ্র এমনই এক স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন! সেবার কলিকাতায়ই ছিল কংগ্রেসের অধিবেশন, আর সভাপতি নির্ব্বাচিত হইয়াছিলেন পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু।

 জানিনা, সুভাষচন্দ্র সেদিন কোন সামরিক চিত্র বা জাতীয় বাহিনীর স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন কি না! সম্ভবতঃ সেরূপ কোন স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হইয়াই তিনি সেদিন কংগ্রেস-মণ্ডপে উপস্থিত ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক-বাহিনীর অধিনায়ক-রূপে! তাঁহার সুদর্শন বলিষ্ঠ বপু সেদিন তরুণের অগ্রদূত-রূপে সকলের চক্ষুর সমক্ষে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছিল!

 কিন্তু হতভাগ্য সুভাষচন্দ্র! সেদিনও তিনি ঈর্য্যা-বিদ্বেষের হীন মন্তব্য হইতে আত্মরক্ষা করিতে পারেন নাই। সুভাষচন্দ্র স্বেচ্ছা-সেবক-বাহিনীর ‘জেনারেল-অফিসার-কম্যাণ্ডিং’ বা G. O. C. নির্ব্বাচিত হইয়াছিলেন। এই পদ-মর্য্যাদার অপভ্রংশ ‘গক্’ (GOC) শব্দটিকে লইয়াই কত না ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হইয়াছিল। এমন কি মহাত্মা গান্ধীও সেদিন তাহাতে হীন দৌর্ব্বল্যই প্রকাশ করিয়াছিলেন।

 “স্বেচ্ছাসেবক-বাহিনীর ও বাহিনীর অধিনায়কের যোদ্ধৃবেশ ও যোদ্ধাসম্ভব কুচকাওয়াজ দর্শনে সার্কাসের অভিনয়ের সহিত ব্যঙ্গাত্মক তুলনা গান্ধীজীই করিয়াছিলেন।”[]

 কিন্তু যিনি যতই তুলনা করুন বা যিনি যতই বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করুন না কেন, আজ পৃথিবীতে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে যে, সুভাষচন্দ্র স্বপ্ন দেখিতেন বটে, কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করিবার উদগ্র প্রচেষ্টাও তাঁহার ছিল।

 সামরিক চিত্র যে তাঁহার কত আকাঙিক্ষত, সে বিষয়ে তিনি শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত বিজয়বাবুর নিকট কথা-প্রসঙ্গে একদিন বলিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন,—

 “দাদা, সামরিক বেশভূষা ও আদব-কায়দার ওপর আমাদের মত দুর্ব্বল, নিরস্ত্র ও পরাধীন দেশের লোকদেরও যে কতখানি সম্ভ্রম ও সমীহ, তা বােধহয় আপনারা কল্পনা করতেও পারেন না। অন্য়ে পরে কা কথা! মহাত্মা গান্ধী যখন সামনে দিয়ে যান, তখন লােকের মনে শুধু ভক্তিই জেগে ওঠে, পায়ের ধূলো নেবার জন্যে হুড়ােহুড়ি পড়ে যায়— এই মাত্র! কিন্তু আমাদের স্বেচ্ছাসেবক-বাহিনী যখন নিয়মবদ্ধ সারিবদ্ধ হয়ে কদমে-কদমে চলে যায়, তখন জনতা দু’ধারে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে, শ্রদ্ধান্বিত অন্তরে কি ভাবে, জানেন? ভাবে, আমিও কেন স্বেচ্ছাসেবক হই নি? হােলে আমিও ত অমনি বীরদর্পে কদমে-কদমে হাঁটতে পারতুম! দাদা, এর মুল্য আমার কাছে অনেক— অনেক; অমুল্য, মহামুল্য!”

 কথাটা খুবই সত্য, আমরাও তাহা স্বীকার করি। স্বাধীন ভারতের সামরিক চিত্রই যদি তাঁহার সম্মুখে স্বর্ণ-কিরীটী নবারুণের উজ্জ্বল বিভায় ফুটিয়া না উঠিত, তাহা হইলে কি এমন উন্মাদের মত সর্ব্বস্ব পরিত্যাগ করিয়া, চূড়ান্ত বিপদের ঝুকি কাঁধে লইয়া, রাষ্ট্রশক্তিকে ফাঁকি দিবার জন্য তিনি মারাঠা-বীর চতুর শিবাজীর অভিনয়ে সাহসী হইতেন?

 সুভাষচন্দ্রের অন্তর্দ্ধান-কাহিনী, স্বাধীনতার জাতীয় ইতিহাসে চিরদিনই রক্ত-অক্ষরে লিখিত থাকিবে, আর

কর্ত্তব্যপরায়ণ দায়িত্বশীল পুলিশ কর্ম্মচারীদের স্মৃতিপটে ইহা গভীর কলঙ্ক ও ব্যর্থতার ইতিহাস-রূপে চিরদিনই তাহাদিগকে নির্ম্মম কশাঘাত করিবে।

 নিরুদ্দিষ্ট সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে কিছুকাল নানা জনরব ও নানা গবেষণাই চলিতেছিল; কিন্তু কেমন করিয়া, কোন্ উপায়ে তিনি তাঁহার প্রহরী-বেষ্টিত গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছিলেন, অনেক-কিছু সে সম্পর্কে প্রচারিত হইলেও, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস—সুভাষচন্দ্রের নিজ মুখ হইতে তাঁহার অন্তর্দ্ধানের পরিপূর্ণ বিবরণ যদি কখনও শুনিবার সৌভাগ্য আমাদের হয়, তবে তাহাই হইবে প্রামাণ্য; এবং তাহা এতাবৎকালে প্রকাশিত যাবতীয় বিবরণ, এমন কি,— অনেক চমকপ্রদ গোয়েন্দা-কাহিনীর শিহরণ এবং কৌতূহলকেও তুচ্ছ ও নিষ্প্রভ করিয়া দিবে!

 সুবিখ্যাত আকালী নেতা, মাষ্টার তারা সিং তাঁহার “শান্ত্ সিপাহী” নামক মাসিক কাগজে সুভাষচন্দ্রের অন্তর্দ্ধান-সম্পর্কে যে বিবরণ প্রকাশ করিয়াছিলেন, সম্ভবতঃ তাহাই আমাদের সর্ব্বপ্রথম বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ।

 তিনি লিখিয়াছিলেন যে, সুভাষচন্দ্রের নিরুদ্দেশ-সংবাদ ২৬শে জানুয়ারী প্রকাশিত হইলেও, প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁহার এল্‌গিন্ রোডের গৃহ হইতে বাহির হইয়াছিলেন তাহার বহু পূর্ব্বে,—১৯৪০ সালের ১৩ই ডিসেম্বর তারিখে।

 সম্ভবতঃ তিনি তাহারও অনেকদিন আগে হইতেই পলায়নের সঙ্কল্প করিয়াছিলেন, এবং সেই উদ্দেশ্যে নির্জ্জন সাধনায় অবস্থানের ছলে, লোক-লোচনের অন্তরালে কক্ষমধ্যে আবদ্ধ থাকিয়া তাঁহার শ্মশ্রু ও কেশরাশি সুদীর্ঘ হইবার সুযোগ গ্রহণ করিয়াছিলেন।

 সুতরাং ১৩ই ডিসেম্বর যখন তিনি পেশোয়ারী পোষাকে গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হন, তখন তাঁহার সুদীর্ঘ কেশ ও শ্মশ্রুরাশিতে তাঁহাকে যথার্থ ই পেশোয়ারী বলিয়া মনে হইতেছিল।

 এইরূপ ছদ্মবেশে তিনি একখানি মোটরযোগে বর্দ্ধমান পর্য্যন্ত যান; সেখানে পূর্ব্ব-নির্দ্দিষ্ট বন্দোবস্ত অনুসারে তিনি ট্রেণে একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর কক্ষে আরোহণ করিয়া পেশোয়ার গমন করেন।

 পেশোয়ার হইতে তিনি কাবুল চলিয়া যান, এবং সেখান হইতে দৈবযোগে সুবিধা পাইয়া বিমানে তিনি বার্লিণে হিটলারের দরবারে উপস্থিত হন।

 মাষ্টার তারা সিংএর এই বিবরণ যে আংশিক সত্য, তাহা কাবুলের এক বেতার-যন্ত্র ব্যবসায়ী—লালা উত্তমচাঁদের লিখিত বিবরণেও অনেকটা প্রমাণিত হইয়াছে। তাঁহার লিখিত বিবরণে যাহা প্রকাশ পাইয়াছে, আমরা পরবর্ত্তী অধ্যায়ে তাহার আলোচনা করিব।


  1. “In 1942, he was reported broadcasting from Berlin and later in that year, he appeared in Tokyo, when the Japanese promise to put him at the head of the Army of Indians ready to march back into India and drive the British out.”—Ibid, P. 442'g).
  2. “If there is nothing wrong in Britain begging for help, there can be nothing wrong in India accepting an offer of assistance which she needs, and we shall welcome any help in India in our struggle against British Imperialism.”—Ibid, P. 442(r).
  3. আজাদ-হিন্দের অঙ্কুর (শ্রীবিজয়রত্ন মজুমদার)
  4. আজাদ-হিন্দের অঙ্কুর।