জাগরণ।

যশোধরা! বিশ্বভরা একি আর্ত্তনাদ?
পর্ণের কুটার কিম্বা স্বর্ণের প্রাসাদ,
বাসনা-অনল-তাপে যাতনার ধমে
কৃষ্ণকান্তি, শান্তিহীন। তবু, ভ্রান্তি ঘুমে
মুদিছে নয়ন নর, শয়ন পাতিয়া;
ভীষণ দুঃস্বপ্নে পুনঃ শ্বাসিছে কাঁদিয়া!

মথিয়া আনন্দ-গীতি রোধিয়া শ্রাবণ,
রোদনের ভীমাধ্বনি অসীম গগণ
ব্যাপিয়া ভ্রমিছে ঘন গুরুনাদে ডাকি’;
স্ফুরিছে বিদ্যুত দ্রুত ঝলসিয়া আঁখি।
বেদনা-জলদ-জাল—নিবিড়, ধূসর,
ঢাকে আসি রবি শশী নক্ষত্র ভাস্বর।
যন্ত্রণার অন্ধকার উজলিয়া তাপে,
বাজ্রনাদে আর্ত্তনাদ গরজিয়া কাঁপে।

ভ্রমিতে জীবন-পথে যৌবনের রথে——
সারাথী দেখাল মোরে,—চরিছে মরতে
জরা ব্যাধি মৃত্যু নর-গৌরবের দ্বারে।
কে দিবে মানবে শান্তি? কে তারে উদ্ধারে?


মানবের আনন্দের ক্ষেত্র-—মধুবনে,
হেরিলাম ‘মার’ আর ‘মার’-বধূগণে।
নহেক সুন্দর তা’রা; ভুষণে বসনে
প্রচ্ছন্ন করে গো অঙ্গ শীর্ণ অনশনে।
বিবসনা বাসনার হাসি নাই মুখে,
নয়নেতে দীপ্তি নাই তৃপ্তি নাই বুকে।


অবশ্য লালসা তথা অনবগুষ্ঠিতা,
বাঁধিয়া গলায় ফাঁস ধূলায় লুণ্ঠিত।
‘মার’-পূজ্যা লজ্জাহীনা হেরিলাম রতি,—
বিঘ্ন-পঙ্কে নগ্নতনু কঙ্কাল মূরতি;
বিভৎস উৎসব-শব টেনে ছিঁড়ে খায়,
গৃধিণী প্রেতিনী সম ক্ষুধার জ্বালায়।

মার-দত্ত বিত্ত তেজি শুদ্ধ নিত্যমণি
কোথা পাব? কহ মোরে হে সতী রমণী।
রোগ-শোক-জরা-মৃত্যু উতরিতে চাই;
কহ কান্তে কোথা পন্থা! দেখিতে না পাই
খুঁজিয়া খুঁজিয়া সারা হতেছে অন্তর।
সদ্যজাত শিশুসম অসহায় নর!


তব প্রেমে, প্রিয়তমে লভেছি ইঙ্গিত,—
সেবা-সংযমের মহা মহিমা-সঙ্গীত
গাইয়া ফিরিতে চাই সংসারের দ্বারে।
স্বার্থ-নাশে সিদ্ধি আশে, শিখালে আমারে


শুনিতে শুনিতে কথা অমৃত-নিচিত,
বক্ষেতে শয়ন পাতি—— প্রেমেতে রচিত,
রাখি তথা তথাগাতে দেবী যশোধরা——
চিন্তিল, “করুণা ধারে ধন্য হবে ধরা;”
“ধন্য আমি, পুণ্যফলে পেয়েছি এ পতি,
জীবনে মরণে যিনি জগতের গতি।”

নিশায় সেদিন দেবী যশোধরা
স্বপ্নে শুনিল বাণী ঃ—
“কষায় বসনে সাজ তুমি ত্বরা
হবে যদি রাজা-রাণী।
“নির্ঘোষে দূরে ধর্ম্ম-চক্র,
রথেতে তোমার পতি;
“জ্বালাও আলোক, সাজাও কক্ষ,
কেন বিলম্ব সতী?
“নব উৎবাহে মিলিবে দুজনা—
পাতি আসিছেন রথে;
“স্বগে মর্ত্তে বাজিছে বাজনা,
নর — কোলাহল পথে।”
কহে যশোধরাঃ—“বিবাহ আবার?
কেন না শুনিনু আগে?
অলস অঙ্গ ঘুমে যে আমার,
অবশ্য প্রাণ না জাগে।
বাজনা বাজায়ে এই আসে বর!
প্রদীপ হয়নি জ্বালা;
সাজাব কখন ধূলাভরা ঘর?
গাঁথিব কখন মালা?

বিনয়-খচিত কোথা নীলাম্বরী?
কোথা ত্রিরতন-হার?
শীলের সূত্রে বাঁধিনি কবরী,
লুটিছে কেশের ভার।
বল্লভ মোর আসিছেন হেসে
দুর্লভ নব সাজে;
পদধ্বনি ওই শুনি দ্বারদেশে!
সঘনে বাজনা বাজে।”



নিশীথে জাগিলা দেবী হেরিয়া স্বপন;
কোথা চক্রবর্তী পতি? নিষ্প্রভ ভবন।
শয্যায় নিদ্রিত পুত্র, না জানে বিষাদ;
পতি দেবতার দত্ত মূর্ত্ত আশীর্বাদ।
কবে আসিবেন পতি, ফিরিয়া ভবনে?
অপেক্ষিয়া জাগে সতী নব জাগরণে!