পঞ্চরাত্র/দ্বিতীয় অঙ্ক

প্রবেশক
বৃদ্ধ গোপালকের প্রবেশ

 বৃদ্ধ গোপালক। আমাদের গাইগুলির যেন বাছুর না মরে। গোপ-যুবতীগণ যেন বিধবা না হয়। আমাদের রাজা বিরাট পৃথিবীর একচ্ছত্র রাজা হ’ন। বিরাটের জন্মোৎসব[] উপলক্ষে গোদানের জন্য নগরের উপবনবীথীতে গোরুগুলি এবং উৎসব-হৃষ্ট[] গোপদের ছেলে মেয়েরা আসুক। যাই আমিও তাড়াতাড়ি গিয়ে আমোদ করি। একি! শুকনা গাছের শুকনা ডালে কাকটা ঠোঁট ঘসছে, আবার সূর্য্যের দিকে তাকিয়ে বিকট শব্দও কচ্ছে। গোরুগুলির ও আমাদের মঙ্গল হ’ক। যাই তাড়াতাড়ি গিয়ে গোয়ালাদের ছেলে মেয়েদের ডেকে নিয়ে আসি। গোমিত্রক, গোমিত্রক।

 গোমিত্রক। মাতুল, প্রণাম করি।

 বৃদ্ধ গোপালক। আমাদের ও আমাদের গোরুগুলির শান্তি হ’ক। ওরে গোমিত্রক, মহারাজ বিরাটের জন্মোৎসব উপলক্ষে গোদানের জন্য নগরের উপবনবীথীতে সমস্ত গোধন এবং উৎসব-হৃষ্ট গোয়ালাদের ছেলে মেয়েরা আসুক। ওরে গোমিত্রক, গোয়ালাদের ছেলে মেয়েদের ডেকে আন।

 গোমিত্রক। যে আজ্ঞা মাতুল। ওগো গো-রক্ষিণিকা, ঘৃতপিণ্ড, স্বামিনী, বৃষভদত্ত, কুম্ভদত্ত, মহিষদত্ত, শীঘ্র এস, শীঘ্র এস।

সকলের প্রবেশ

 সকলে। মাতুল, প্রণাম।

 বৃদ্ধ গোপালক। আমাদের ও গোয়ালাদের ছেলে মেয়েদের মঙ্গল হ’ক। মহারাজ বিরাটের জন্মোৎসব উপলক্ষে গোদানের জন্য এই নগরের উপবন-বীথীতে সমস্ত গোধন আসুক। যতক্ষণ না সব গোরু আসে আমরা সকলে নাচব গাইব।

 সকলে। যে আজ্ঞা, মাতুল।

 বৃদ্ধ গোপালক। বাঃ! বেশ নেচেছ। বেশ গেয়েছ। আমিও নাচব এখন।

 সকলে। হায় হায়! মাতুল, দেখ কত ধূলি উড়ছে।[]

 বৃদ্ধ গোপালক। কেবল ধূলি নয়, শঙ্খ এবং দুন্দুভির শব্দও শোনা যাচ্ছে।

 সকলে। দিবসে চন্দ্রের প্রভার ন্যায় পাণ্ডুর বর্ণ জ্যোৎস্নাঢাকা শতমণ্ডল-বেষ্টিত সূর্য্য[] যেন এই দেখা যাচ্ছে আবার এই দেখা যাচ্ছে না।

 গোমিত্রক। হায়! হায়! মাতুল, দধিপিণ্ডের ন্যায় ছাতাযুক্ত সাদা ঘোড়ার গাড়ীতে চ’ড়ে এই সকল চোর সমস্ত ঘোষপল্লী ছেয়ে ফেল্লে যে! এরা কে?

 বৃদ্ধ গোপালক। হায়! হায়! বাণে বাণে আকাশ ছেয়ে ফেল্লে! ছেলে মেয়েরা সব বাড়ীতে ঢুকে পড়।

 সকলে। যে আজ্ঞা, মাতুল।

 বৃদ্ধ গোপালক। হায়! হায়! থাম,থাম। মার, মার, ধর, ধর। যাই মহারাজ বিরাটকে খবর দেই গিয়ে।


দ্বিতীয় অঙ্ক
ভটের প্রবেশ

 ভট। ওহে সকলে বিরাট-রাজকে বল গিয়ে যে দস্যুর কাজে বিক্রম প্রকাশ[] ক’রে ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা গোরু চুরি ক’রে নিয়ে যাচ্ছে। বাছুরগুলি পালিয়ে যাচ্ছে, গোরুগুলি ব্যথিত হ’য়েছে, ষাঁড়গুলি চকিতনয়নে মুখ তুলে চাচ্ছে। চারিদিকেই আকুল চীৎকার। গোরুগুলি ভারী ভয় পেয়েছে। এদের দিকে তাকান যাচ্ছে না।

নেপথ্যে

 কি! ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা গোরু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।

 ভট। হাঁ, আর্য্য।

কাঞ্চুকীয়ের প্রবেশ

 কাঞ্চু। যারা ভ্রাতৃদ্রাহী এই কার্য্য তাদের উপযুক্তই বটে। তারা—

 ধনুতে গুণ চড়িয়ে, গোধার চামড়ার অঙ্গুলিত্র প’রে, বর্ম্ম দিয়ে শরীর ঢেকে, সুসজ্জিত রথে চ’ড়ে, বলে দর্পিত হ’য়ে, যুদ্ধ সজ্জা ক’রে এবং অস্ত্র নিয়ে বিরাট রাজার গোরুগুলির উপর শত্রুতা প্রকাশ কচ্ছে।

 জয়সেন, মহারাজ এখন জন্ম-নক্ষত্রাধিষ্ঠাত্রী দেবীর পূজায় ব্যাপৃত। এই সংবাদ এই অসময়ে দিলে তিনি রাগ করবেন। সুতরাং দেবকার্য্য শেষ হ’লে রাজাকে সংবাদ দিব।

 ভট। আর্য্য, এটা বড় গুরুতর বিষয়। শীঘ্রই সংবাদ দিন।

 কাঞ্চুকীয়। আচ্ছা, তবে দিচ্ছি।

রাজার প্রবেশ

 রাজা। রথের শব্দে ভীত হ’য়ে গোরুগুলি ছোট ছোট বাছুর গুলির সঙ্গে ত্রাসে চারিদিকে পালিয়ে যাচ্ছে, এবং (ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা) আমার গোধন চুরি ক’রে নিয়ে যাচ্ছে—আর কি না কাঁধের দিকে স্থূল, চঞ্চল বলয়যুক্ত, চন্দনচর্চ্চিত আমার হাত দুটি এখন উপাদেয় অন্ন[] তুলে মুখে দিচ্ছে! এ বড় লজ্জার কথা। জয়সেন! জয়সেন!

ভটের প্রবেশ

 ভট। মহারাজের জয় হ’ক।

 রাজা। মহারাজ ব’লে আর আমাকে ডেকো না। আমার ক্ষত্রিয়ত্ব অপমানিত হয়েছে। যুদ্ধের বিস্তারিত খবর বল।

 ভট। অপ্রিয় খবর বিস্তারিত বলতে নেই। মোটামুটি বলছি—

 রথের ধূলিতে সমস্ত গোরুর এক রং হ’য়ে গেছে। কেবল কশাঘাত কল্লে পর এদের গায়ের নানা বর্ণের রেখা দেখা যায়।

 রাজা। তা হ’লে, আমার রথ শীঘ্র সাজিয়ে আন। আমার প্রতি যাদের প্রকৃত ভক্তি আছে তারা আমার অনুগমন করুক। গোধন উদ্ধারের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুসৈন্যের সম্মুখে থেকে যত্ন কত্তে হবে। মৃত্যু হ’লেও তাতে যশ। আর মোচন কত্তে পাল্লে ত ধর্ম্ম আছেই।

 ভট। যে আজ্ঞা মহারাজ।

[ প্রস্থান।

 রাজা। আমার সঙ্গে দুর্য্যোধনের শত্রুতার কারণ কি? অ’! তাই! যজ্ঞ দেখতে যাই নি। হাঁ, বুঝেছি! কীচকেরা মরেছে— আমাদের এখন শোকের সময়—কাজেই আক্রমণের এই সুযোগ। অথবা আর একটা কারণ আছে। আমি পরোক্ষে পাণ্ডবগণের সুহৃৎ—সুতরাং আমার সঙ্গে যুদ্ধ কত্তে হবে। ভগবান (যুধিষ্ঠির) হস্তিনাপুরে ছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই দুর্য্যোধনের প্রকৃতি বেশ জানেন।

 অথবা দুর্যোধনের দোষ জানলেও ভগবান বলবেন না। কিন্তু আমার প্রয়োজন। যার প্রয়োজন আছে সে অক্লান্ত ভাবে বারে বারে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ক’রে থাকে (শিষ্টতা মানে না)।

 কে আছ এখানে?

ভটের প্রবেশ

 ভট। মহারাজের জয় হ’ক।

 রাজা। ভগবানকে ডেকে দাও।

 ভট। যে আজ্ঞা, মহারাজ। [প্রস্থান।

ভগবানের প্রবেশ

 ভগবান! (চারিদিকে দেখিয়া) ব্যাপার কি?

 হাতী সব সাজছে, ঘোড়াগুলি বর্ম্ম পরেছে। এই উদ্যোগ দেখে আমি যেরূপ ভয় কখনও অনুভব করি নি আজ আমার মনে সেরূপ ভয় আসছে। আমি স্থির-বুদ্ধি সুতরাং নিজের জন্য ভয় করি না, কিন্তু আমার ভাইরা সব যে চপল।

 রাজা। ভগবান, আপনার জয় হ’ক। বিরাট আপনাকে অভিবাদন কচ্ছে।

 ভগবান। স্বস্তি।

 বিরাট। ভগবান, এই আসনে বসুন।

 ভগবান। (বসিয়া) মহারাজ, যুদ্ধের উদ্যোগ কেন? রাজলক্ষ্মী কি এখনও সন্তুষ্ট হন নি? গর্ব্বিতকে পীড়ন করবেন, না পীড়িতকে মুক্ত করবেন?

 রাজা। ভগবান, আমার গোরু নিয়ে গিয়ে যে আমার অপমান করেছে।

 ভগবান। কে?

 রাজা। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা।

 ভগবান। (স্বগত) হায়! কি কষ্টের কথা।

 জ্ঞাতিত্বের (শোণিত সম্পর্কের) কথা মনে হ’লে মনস্বীর মনও আকুল হয়। বৈরনির্য্যাতনপ্রিয় ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রের অপরাধ কল্লে আমাদেরও অপরাধ হ’য়েছে মনে হয়।

 বিরাট। ভগবান, ভাবছেন কি?

 ভগবান। না কিছু নয়। এদের বিষয়ই চিন্তা কচ্ছি।[]

 রাজা। আজ থেকে সব শেষ হবে। ক্ষমতা থাকলেও যুধিষ্ঠির ক্ষমা করেছেন, কিন্তু আমি কচ্ছি না।

 ভগবান! (স্বগত) এখন যে খড়ের বিছানায় মাটিতে শুই, আমাদের যে রাজ্যনাশ হয়েছে, দ্রৌপদীর যে অপমান হয়েছে, আমরা যে ছদ্মবেশ ধ’রে আছি, আশ্রিতের আশ্রয় ল’য়ে বাস কচ্ছি—এই সমস্তই এখন শ্লাঘ্য মনে হচ্ছে—কেন না, এতে আমার ক্ষমা প্রকাশ পাচ্ছে।

ভটের প্রবেশ

 ভট। মহারাজের জয় হ’ক।

 রাজা। দুর্য্যোধন কি কত্তে চাচ্ছে?

 ভট কেবল দুর্য্যোধন নয়—পৃথিবীর সমস্ত ক্ষত্রিয়ই এসেছে। দ্রোণ এসেছেন, জয়দ্রথ এসেছেন, শৈল্য, অঙ্গরাজ, শকুনি ও কৃপ এসেছেন। তাঁদের রথের দোলায় পতাকার সঙ্গে ধ্বজ-দণ্ড নড়েই আমাদিগকে যুদ্ধক্ষেত্র হ’তে তাড়িয়ে দিয়েছে, বাণের আর প্রয়োজন হয় নি।

 রাজা। (উঠিয়া করযোড়ে) কি! গাঙ্গেয়ও এসেছেন!

 ভগবান। বেশ! বেশ! অপমানিত হয়েও আপনি শিষ্টাচার দেখালেন।

 (স্বগত) কুরুদের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ও পূজনীয় গুরু কি জন্য এলেন। মনে হয়, আমরা প্রতিজ্ঞা হ’তে উত্তীর্ণ হ’য়েছি তা’ই মনে ক’রে দিতে এসেছেন।

 (প্রকাশ্যে)   *   *   *   *   *

 রাজা। এখানে কে?

ভটের প্রবেশ

 ভট। মহারাজের জয় হ’ক।

 বিরাট। সারথিকে ডাক।

 ভট। যে আজ্ঞা, মহারাজ।

[ প্রস্থান।
সারথির প্রবেশ

 সারথি। মহারাজ দীর্ঘায়ু হ’ন। মহারাজের জয় হ’ক।

 বিরাট। শীঘ্র আমার রথ আন। আজ রণের পূজনীয় অতিথি এসেছেন। শর দিয়ে আজ তাকে তুষ্ট করব। ‘যুদ্ধে জয় ক’রে আসব’ তার এই আশা নিষ্ফল করব।

 সারথি। যে আজ্ঞা আয়ুষ্মান। আয়ুষ্মন,

 আপনি যে রথে চড়ে সৈন্য বিনাশ করেন, যে রথ আপনার পরিচিত, রথ চালাবার কৌশল দেখাবার জন্য সেই রথে চড়ে কুমার উত্তর যুদ্ধে গিয়েছেন।

 বিরাট। কি! উত্তর যুদ্ধে গেছে!

 ভগবান। মহারাজ! কুমারকে নিবারণ করুন—রণাগ্নির অনেক গুণ ও অনেক দোষ, আর রণাগ্নি বড় উগ্র। সামনে পেলে বালক ব’লে কাকেও ছেড়ে দেয় না। অথচ ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা যে কিছু দয়া করবে তাও নয়। মহারাজ, কুমারের পরাজয় আশঙ্কা করেই যুদ্ধের দোষ কীর্ত্তন কল্লুম, কিছু মনে করবেন না।

 রাজা। তা’হ’লে শীঘ্র আর একখানা রথ সাজিয়ে আন।

 সারথি। যে আজ্ঞা, আয়ুষ্মান।

 রাজা। আচ্ছা, এদিকে এস।

 সারথি। আয়ুষ্মান, এই যে আমি এসেছি।

 রাজা। তুমি কুমারের রথ চালাতে গেলে না কেন? কুমার কি তোমাকে বলেন নি? তুমিত রাজার সারথি!

 সারথি। আয়ুষ্মন, প্রসন্ন হ’ন। রথ সাজিয়ে শিষ্টাচার দেখিয়ে আমি উপস্থিত হয়েছিলুম। সারথির শিষ্টাচারকে অগ্রাহ্য করবার জন্যই হ’ক, অথবা সারথ্যে আবার কি কৌশল আছে—এটা প্রমাণ করার জন্যই হ’ক, আমাকে না ক’রে বৃহন্নলাকে কুমার সারথি করেছেন।

 ভগবান। মহারাজ, আর রাগ করবেন না।

 নিজের রথের চাকার ধূলিতে দুর্দ্দিন ক’রে যদি বৃহন্নলার সঙ্গে উত্তর যুদ্ধে গিয়ে থাকে তা হ’লে মুহূর্ত্ত মধ্যে চাকার শব্দেই শত্রুদিগকে নিবারণ ক’রে বাণছাড়া রথই যুদ্ধ জয় করে আসবে।

 রাজা। শীঘ্র অন্য রথ সাজিয়ে আন।

 সারথি। যে আজ্ঞা আয়ুষ্মান।

[ প্রস্থান।
ভটের প্রবেশ

 ভট। কুমারের রথ ভেঙ্গে গিয়েছে।

 রাজা। কুমারের রথ ভেঙ্গে গিয়েছে!

 ভট। তবে শুনুন মহারাজ— সমরকুশল বহু শত্রুসৈন্য দ্বারা অশ্বপথ বদ্ধ হ’য়েছিল। তখন বৃহন্নলা শ্মশানের দিকে রথ চালিয়ে দিল। শত্রুরা অশ্বের লোভে রথখানি ভেঙ্গে দিল।[]

 ভগবান। (স্বগত) আ! সেখানে গাণ্ডীব রয়েছে যে। (প্রকাশ্যে) মহারাজ, কিছু অমঙ্গল দেখা যাচ্ছে। রথ শ্মশানের দিকে গেল! যেখানে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা আছে সেখানে শ্মশান ত হবেই।

 রাজা। ভগবান, অসময়ে গুরুতর বিষয় নিয়ে পরিহাস কল্লে রাগ হয়।

 ভগবান। রাগ করবেন না। এযাবৎ একটি কথাও মিথ্যা বলি নি।

 রাজা। হবে। যাও, আবার গিয়ে সংবাদ নিয়ে এস।

 ভট। যে আজ্ঞা মহারাজ।

 রাজা। একি! গর্জ্জনশীল স্রোত আবদ্ধ হ’লে যেমন সহসা একটা ভয়ঙ্কর শব্দ সমস্ত মেদিনী কম্পিত ক’রে আরও গভীর হ’য়ে উঠে, তেমনি একটা শব্দ শুনছি! কারণ জানতে হবে।

ভটের প্রবেশ

 ভট। মহারাজের জয় হ’ক। শ্মশানে মুহূর্ত্ত মাত্র বিশ্রাম ক’রে রথ ও ঘোড়া নিয়ে—

 ভগবান। (স্বগত) এব্যক্তি নিশ্চয়ই আমাকে মিথ্যবাদী করবে না।

 ভট। শত শত শর নিক্ষেপ ক’রে নীল হাতীগুলি কপিল বর্ণ ক’রে দিল। এমন একটি ঘোড়া বা যোদ্ধা নেই যার গায়ে অন্ততঃ একশ শর বসে নি। বড় বড় রথগুলি শর-প্রহারে স্তম্ভিত হ’য়ে আছে। শর দ্বারা সমস্ত পথ আচ্ছন্ন হ’য়ে গেছে। প্রচণ্ড ধনু শরের নদী বহাচ্ছে।[]

 ভগবান। (স্বগত) অর্জ্জুনের অক্ষয় তূণীত্বই ইহার কারণ। এই অক্ষয়তূণীত্বের জন্যই খাণ্ডবদাহন কালে যতক্ষণ বাসব বৃষ্টিধারা বর্ষণ করেছিলেন অর্জ্জুনও ততক্ষণ শরবর্ষণ করেছিলেন।

 রাজা। শত্রুর সংবাদ কি?

 ভট। আমি স্বয়ং শত্রুর কোন সংবাদ জানি না, তবে দূতের মুখে শুনেছি দ্রোণ ধনুষ্টঙ্কার শুনেই বুঝেছেন এ তাঁরই ধনুর টঙ্কার, সুতরাং যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ ক’রে প্রস্থান করেছেন। পায়ের পাশে শর পড়েছে দেখেই যথেষ্ট মনে ক’রে ভীষ্ম আর তীর ছোড়েন নি। শরপ্রহার সহ্য কত্তে না পেরে কর্ণ পালিয়েছেন। অন্য রাজাদের ত কথাই নেই। কেবল বালক অভিমন্যু বিপদ দেখেও ভীত হয় নি।

 ভগবান। কি! অভিমন্যুও যুদ্ধে এসেছে! মহারাজ, কুরু ও পাণ্ডব বংশের উজ্জ্বল জ্বালাময় অগ্নিতুল্য অভিমন্যু যদি যুদ্ধে এসে থাকে, তা’হ’লে অন্য সারথি পাঠিয়ে দিন। বৃহন্নলা অভিমন্যুর সঙ্গে যুদ্ধে একেবারেই অক্ষম।

 রাজা। ভগবন, বলেন কি?

 পরশুরাম শরপ্রহারে ভীষ্মের কবচ ভেদ কত্তে পারেন নি, দ্রোণাচার্য্য সমস্ত শর মন্ত্রপূত ক’রে নিক্ষেপ ক’রে থাকেন। তাঁরা দু’জনই যুদ্ধে বিমুখ হয়ে প্রস্থান করেছেন। কর্ণ ও জয়দ্রথ পরাজিত হ’য়েছেন। অন্যান্য নৃপতিবৃন্দও রণস্থল পরিত্যাগ করেছেন। পিতার পরাক্রমের ভয়ে ভীত হ’য়ে কি কুমার (উত্তর) অভিমন্যুকে ছেড়ে দেবেন? তবে একটা কথা আছে। অভিমন্যু আমাদের আত্মীয়, আর উভয়েরই তুল্যরূপ ও তুল্যবয়স। এতে যদি অভিমন্যু রক্ষা পায়!

 ভট। মহারাজ,

 অশ্বরশ্মি শিথিল হ’লেই কুমারের রথ প্রবল বেগে ছুটে অভিমন্যুর সম্মুখ থেকে চলে যায়, নিকটে পেয়েও (কুমার) অভিমন্যুকে প্রহার করেন না, অভিমন্যুর কোনও অপকার করেন না। অভিমন্যুর নিকটে নিকটে রথখানি ঘুরে বেড়ায়, মনে হয় যেন ইচ্ছে ক’রে এরূপ কচ্ছে।

 রাজা। আবার গিয়ে শত্রুর সংবাদ নিয়ে এস।

 ভট। যে আজ্ঞা, মহারাজ।

প্রস্থান ও পুনঃ প্রবেশ

 মহারাজের জয় হ’ক। বিরাট-রাজের জয় হ’ক। সুসংবাদ আছে। যারা গোরু চুরি কত্তে এসেছিল তার পরাজিত হ’য়েছে। ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদিগকে তাড়িয়ে দেওয়া হ’য়েছে।

 ভগবান। মহারাজের সৌভাগ্য লাভ হয়েছে শুনে প্রীত হলুম।

 রাজা। না, এ আমার সৌভাগ্য নয়। ভগবানের অনুগ্রহ। কুমার কোথায়?

 ভট। শত্রুপক্ষের যে সকল বীরপুরুষ রণক্ষেত্রে যুদ্ধ-কৌশল প্রদর্শন করেছেন তাদের বীরত্ব-কাহিনী লিপিবদ্ধ কচ্ছেন।

 রাজা। কুমারের এই কার্য্য বাস্তবিকই প্রশংসনীয়। পরাজিত শত্রুর গুণ কীর্ত্তন ক’রে সম্মান দেখালে তাদের মনোবেদনার লাঘব হবে। বৃহন্নলা কোথায়?

 ভট। সুসংবাদ নিয়ে অন্তঃপুরে গেছেন।

 রাজা। বৃহন্নলাকে ডেকে আন।

 ভট। যে আজ্ঞা, মহারাজ।

বৃহন্নলার প্রবেশ

 বৃহ। (চারিদিকে তাকাইয়া সবিষাদে)

 গাণ্ডীবে গুণ চড়িয়ে যোদ্ধাদের সঙ্গে অল্পকাল মাত্র যুদ্ধ কত্তে হয়েছে। শর-পরিবর্ত্তনে শিথিল মুষ্টি সংহতও হয় নি। অঙ্গুলিত্র পরা অঙ্গুলিরও বিশেষ কোন কৌশল দেখাতে হয় নি। এখানে যে বীরত্ব দেখাবার বেশী প্রয়োজন হয় নি তা ভালই হ’য়েছে। স্ত্রী-বেশ ধারণ করেছি বলে দেহ অনেকটা শিথিল হ’য়েছে। গাণ্ডীব হাতে ছিল বলেই আমার মনে হয়েছে যে আমিই সেই অর্জুন।

 আমি স্ত্রী-বেশ ধারণ ক’রে লজ্জিত হ’য়েই ধনু আকর্ষণ ক’রে রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। এই যুদ্ধ যে শীঘ্র শীঘ্র শেষ হ’য়ে গিয়েছে তা ভালই হ’য়েছে।[১০]

 গোধন উদ্ধার করেছি, শত্রুকে পরাজিত করেছি, তবু আমার মনে আনন্দ হচ্ছে না। সৈন্য-শ্রেণীর সম্মুখভাগে দুষ্ট দুঃশাসনকে শর-প্রহারে বিকল ক’রে বিরাটরাজের রাজধানীতে বেঁধে নিয়ে আসতে পাল্লুম না!

 উত্তরা আদর ক’রে যে সকল অলঙ্কার দিয়েছিল সেগুলি প’রে রাজার সামনে যেতে আমার লজ্জা বোধ হচ্ছে। যাক্‌, যাই দেখা ক’রে আসি। এই যে! আর্য্য যুধিষ্ঠিরও যে এখানে।

 তিনি এখন যুবক হ’য়েও সন্ন্যাসী, ক্ষত্রিয় হ’য়েও ব্রাহ্মণ-ধর্ম্মাবলম্বী, রাজ্যলক্ষ্মীর অনুগ্রহ ভাজন (রাজা) তবু রাজ্যহীন। তিনি এখন সন্ন্যাসাশ্রম অবলম্বন করেছেন সুতরাং বিচারকার্য্যের ভার পরিত্যাগ করেছেন।[১১]

 (নিকটে আসিয়া) ভগবন, প্রণাম গ্রহণ করুন।

 ভগবান। স্বস্তি।

 বৃহ। প্রভুর জয় হ’ক।

 রাজা। রূপের বা বংশের কোনও বিশেষত্ব নেই। নীচ ব্যক্তি ভাল কাজ কল্লেই মহৎ হয়। বৃহন্নলার এই স্ত্রীরূপ ঘৃণ্য, কিন্তু এখন এই স্ত্রীরূপই সম্মান পাওয়ার যোগ্য হয়েছে। বৃহন্নলে, তুমি পরিশ্রান্ত হয়েছ, কিন্তু তোমাকে আরও পরিশ্রান্ত করব। যুদ্ধের সংবাদ সমস্ত খুলে বল।

 বৃহন্নলা। মহারাজ, শুনুন।

 রাজা। বীরের কাজ বর্ণন ক’চ্ছ, প্রাকৃতে না ব’লে সংস্কৃতে বল।

 বৃহন্নলা। শুনুন, মহারাজ।

ভটের প্রবেশ

 ভট। মহারাজের জয় হ’ক।

 রাজা। তোমাকে অত্যন্ত প্রসন্ন দেখছি। তোমার এত হর্ষের কারণ কি?

 ভট। এমন সুসংবাদ আছে যা সহজে বিশ্বাস হবে না। অভিমন্যু বন্দী হ’য়েছে।

 বৃহ। কিরূপে বন্দী হ’ল?

 (আত্মগত) আজ আমি সমস্ত সৈন্যের বল পরীক্ষা করেছি অভিমন্যুর বলও পরীক্ষিত হতে দেখেছি।

কীচক নিহত হয়েছে। বিরাট সৈন্যের মধ্যে অভিমন্যুকে বন্দী কত্তে পারে এমন ত কাউকে দেখছি না!

 ভগবান। বৃহন্নলে, কি শুনছি?

 বৃহ। ভগবন্‌

 অভিমন্যু বলবান ও যুদ্ধবিদ্যাবিশারদ, কে তাকে বন্দী করেছে জানি না। পিতার ভাগ্য-দোষেই আজ তার পরাজয় হ’ল।

 রাজা। বন্দী হ’ল কিরূপে?

 ভট। রথে আরোহণ ক’রে নির্ভয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে রথ থেকে নামিয়ে এনেছে।

 রাজা। কে?

 ভট। মহারাজ যার উপর পাকশালার ভার দিয়েছেন তিনি।

 বৃহ। (জনান্তিকে) আর্য্য ভীম তাকে আলিঙ্গন করেছেন, বন্দী করেন নি।

 আমি দূরে থেকে দেখেই সন্তুষ্ট হয়েছি, এই কাজ ক’রে তিনি পুত্রস্নেহ সম্পূর্ণ-রূপে উপভোগ করেছেন।

 রাজা। শিষ্টাচারের সহিত অভিমন্যুকে সভায় নিয়ে এস।

 ভগবান। মহারাজ, অভিমন্যু কৃষ্ণ ও পাণ্ডব বংশের গৌরব। ইহাকে সম্মান কল্লে লোকে বলবে রাজ বিরাট ভয় পেয়েছেন। সুতরাং তার অপমান করাই উচিত।

 রাজা। যদুবংশের তনয় অপমানের যোগ্য নহে।

 অভিমন্যু যুধিষ্ঠিরের পুত্র, কুমার উত্তরের সমবয়স্ক; দ্রুপদের সহিত আমাদের কুলগত সম্বন্ধ আছে, সুতরাং অভিমন্যু আমার পৌত্র। বিশেষতঃ অতিথি পূজার্হ, এবং পাণ্ডবেরা আমার প্রিয়।

 ভগবান। হাঁ, ঠিক কথা। আমি যা বলেছিলুম তা আমার বলা উচিত হয় নি।

 রাজা। তা’ হ’লে অভিমন্যুকে কে সভায় নিয়ে আসবে?

 ভগ। বৃহন্নলাই তাকে নিয়ে আসুক।

 রাজা। বৃহন্নলে, অভিমন্যুকে রাজ-সভায় নিয়ে এস।

 বৃহ। যে আজ্ঞা, মহারাজ। (আত্মগত) যা এতক্ষণ চাচ্ছিলুম তাই এখন কত্তে পেয়েছি।

 ভগবান। (আত্মগত)

 আমার সাক্ষাতে পুত্রকে দেখে অর্জ্জুন লজ্জায় কিছু বলতে পারবে না। এখন উভয়ের দেখা হবে, নির্জ্জন স্থানে দেখা হ’লে বৃহন্নলা পুত্রকে আলিঙ্গনও কত্তে পারবে। অর্জ্জুনের চক্ষু হ’তে আনন্দাশ্রু নির্গত হ’লেও আর কেহ দেখবে না।

 রাজা। ভগবন্‌, কুমার উত্তরের বীরত্বের কাহিনী শুনুন—

 ভীষ্ম প্রভৃতি রাজগণ বিতাড়িত হয়েছেন, অভিমন্যু বন্দী হয়েছেন। সংক্ষেপে বলতে গেলে উত্তর আজ সমস্ত পৃথিবী জয় করেছে।

ভীমসেনের প্রবেশ

 ভীম। (স্বগত) জতুগৃহে যখন অগ্নি লাগে তখন মাতা কুন্তী ও ভাইদিগকে বাহুতে তুলে নিয়ে পালিয়েছিলুম। কিন্তু এক বালক অভিমন্যুকে বাহু দিয়ে তুলে রথ থেকে নামিয়ে আজই প্রথম ঠিক তেমন শ্রম অনুভব করেছি।

 কুমার, এদিকে।

অভিমন্যুর প্রবেশ

 অভি। এ কে?

 ইহার বক্ষোদেশ বিশাল, উদর তনিমাযুক্ত, অংসদেশ উন্নত, ঊরু মহান্‌, কটীদেশ কৃশ। এরূপ বলশালী লোক এক হাত দিয়ে জোরে ধরে আমাকে রথ থেকে নামিয়ে নিয়ে এল, অথচ আমার শরীরে একটুও ব্যথা দিল না!

 বৃহ। কুমার, এদিকে।

 অভি। ইনি আবার কে?

 হস্তিনীর রূপ যেমন গজের শরীরে শোভা পায় না, রমণীর রূপও তেমন ইহার শরীরে শোভা পাচ্ছে না। ইহার পরাক্রম মহান, কিন্তু বেশ হীন, সুতরাং ইহাকে উমারূপধারী মহেশ্বরের মত দেখাচ্ছে।

 বৃহ। (জনান্তিকে) আর্য্য ভীম অভিমন্যুকে এখানে এনে বড় অন্যায় করেছেন।

 পরাজিত হয়েছে বলে অভিমন্যুর মনে একটা গ্লানি আসবে। স্বামী-পুত্র-বিহীনা সুভদ্রা শোকার্ত্তা হবেন। অভিমন্যু পরাজিত হয়েছে মনে করে কৃষ্ণও রুষ্ট হবেন। কি আর বলব, এই কার্য্যে বাহুবল দূষিত হ’য়েছে।

 ভীম। অর্জ্জুন!

 বৃহ। হাঁ-হাঁ—অর্জ্জুন-পুত্রই বটে।

 ভীম। (জনান্তিকে)

 অভিমন্যুর নিগ্রহে যে এ সকল দোষ ঘটেছে তা আমি বুঝেছি। বিশেষতঃ শত্রু-হস্তে পুত্রের পরাজয় কেহই আকাঙ্ক্ষা করে না। কিন্তু দ্রৌপদী অভিমন্যুকে না দেখে দারুণ দুঃখ ভোগ কচ্ছিল। এজন্যই অভিমন্যুকে ধরে এনেছি।

 বৃহ। (জনান্তিকে) আর্য্য, অভিমন্যুর সঙ্গে কথা বলবার আমার বড় আকাঙ্ক্ষা হয়েছে তাকে রাগিয়ে দিন ত, যেন খুব কথা বলে।

 ভীম। ওহে অভিমন্যো!

 অভি। কি! অভিমন্যু!

 ভীম। (জনান্তিকে) বালক আমার উপর রেগে গিয়েছে। তুমি ডেকে জিজ্ঞাসা কর।

 বৃহ। অভিমন্যো!

 অভি। কেন? কেন? হাঁ—সকলেই জানে আমার নাম অভিমন্যু। যারা নীচ তারাই আমাদের মত ক্ষত্রিয়কে নাম ধরে ডাকে। আমাকে এরূপ ভাবে বন্দী করায় তোমাদের পূর্ব্বেই যথেষ্ট শিষ্টাচার প্রকাশিত হয়েছিল! এখন নাম ধরে ডেকে সেই শিষ্টাচারকেও অতিক্রম করেছ!

 বৃহ। অভিমন্যো, তোমার জননী ভাল আছেন?

 অভি। কি! কি! জননী!

 তোমরা কি আমার নিকট যুধিষ্ঠির, না ভীমসেন, না ধনঞ্জয়, যে পিতা যেমন পুত্রকে প্রশ্ন করে তোমরাও আমাকে ঠিক তেমনি জননীর কথা জিজ্ঞাসা কচ্ছ।

 বৃহ। অভিমন্যো! দেবকী-তনয় কেশবের কুশল ত?

 অভি। কি! তাঁকেও নাম ধরে! হাঁ—হাঁ— তোমাদের মত লোকের সঙ্গে সংসৃষ্ট হ’য়ে কেশব কুশলেই আছেন!

 অভি। কি! আমার দিকে অবজ্ঞার সহিত চেয়ে চেয়ে আবার হাসচ!

 বৃহ। না, হাসব কেন?

 যার পিতা পার্থ, মাতুল জনার্দ্দন, যে তরুণবয়স্ক ও অস্ত্র-বিদ্যায় নিপুণ তার যুদ্ধে পরাজয় উপযুক্তই বটে!

 অভি। নিজের গুণ কীর্ত্তন ক’রে ফল নেই। আমাদের বংশে কেউ তা করে না। মৃতের উপর অস্ত্রাঘাত ক’রে কিছু লাভ নেই।

 বৃহ। (আত্মগত) কুমার ঠিক বলেছে। রথ, তুরঙ্গ ও মত্তহস্তী-সঙ্কুল এই যুদ্ধক্ষেত্রে শরনিপুণ কোন যোদ্ধাই অভিমন্যুর শরে আহত না হ’য়ে যেতে পারেন নি। যদি আমিও রথ ফিরিয়ে না দিতুম তা হলে আমিও শরাহত হতুম।

 (প্রকাশ্যে) বাঃ! কথায় ত তুমি বেশ নিপুণ! পদাতির হাতে বন্দী হ’লে কেন?

 অভি। শস্ত্র গ্রহণ না ক’রে আমার রথে এসেছিল বলেই আমি বন্দী হয়েছি। অর্জ্জুন যার পিতা সে কখনও নিরস্ত্র ব্যক্তিকে আঘাত করে না।

 ভীম। অর্জ্জুনই ধন্য! দু’জনের কথাই সাক্ষাতে শুন্‌তে পেয়েছি। পিতা অপেক্ষাও সংগ্রামে পুত্রের বীরত্ব সমধিক প্রশংসনীয়।

 রাজা। অভিমন্যুকে শীঘ্র শীঘ্র সভায় নিয়ে এস।

 বৃহ। কুমার, এদিকে! এদিকে! ইনিই মহারাজ, কুমার এস।

 অভি। কার মহারাজ?

 বৃহ। না, না। মহারাজ ব্রাহ্মণের সঙ্গে উপবিষ্ট আছেন।

 অভিমন্যু। কি! ব্রাহ্মণের সঙ্গে! ভগবন, অভিবাদন কচ্ছি।

 ভগবান। বৎস, এস।

 বাকপটুতা, ধৃতি, বিনয়, আশ্রিতবাৎসল্য, মধুরভাষিত, পরাক্রম ও বিজয়—পিতার এই সমস্ত গুণ যুগপৎ লাভ কর। তারপর অবশিষ্ট চার পাণ্ডবের আর যে যে গুণ তোমার লাভ কত্তে ইচ্ছে হয় সেই সব গুণ লাভ করো।

 রাজা। পুত্র, এস। আমাকে অভিবাদন কচ্ছ না যে! বটে! এই ক্ষত্রিয় বালক গর্ব্বিত হয়েছে! আমি এর দর্প চূর্ণ করব। কে তোমাকে বন্দী করেছে?

 ভীম। মহারাজ, আমি।

 অভি। আপনি নিরস্ত্র ছিলেন একথা ব’লে দিন।

 ভীম। (স্বগত) এই পাপকথা আর শুনে কাজ নেই।

 (প্রকাশ্যে) উন্নত এবং মাংসল স্কন্ধসংলগ্ন, সহজাত ভুজদুটিই আমার অস্ত্র। এই অস্ত্র দিয়েই আমি যুদ্ধ করি। যারা দুর্ব্বল তারাই ধনু গ্রহণ ক’রে থাকে।

 অভি। মশায়, এরূপ কথা বলবেন না—

 যাঁহার বাহুবল অক্ষৌহিনী সেনার তুল্য, যাঁহার পরাক্রমে ছলনা নেই আপনি কি আমার সেই মধ্যম তাত। আপনি যে তাঁর মত কথা বলছেন!

 ভগবান। পুত্র, তোমার সেই মধ্যম তাত কি করেছেন?

 অভি। শুনুন। না, আমি ব্রাহ্মণের কথার উত্তর দিই না। আর কেউ জিজ্ঞাসা করুক।

 রাজা। পুত্র, আমি জিজ্ঞাসা কচ্ছি—তোমার মধ্যম তাত কি করেছেন?

 অভি। শুনুন,

 কণ্ঠদেশে বাহুবদ্ধ ক’রে জরাসন্ধকে শৃঙ্গে তুলে তিনি তার প্রাণ সংহার করেছেন। কৃষ্ণ যা কত্তে পারেন নি, তিনি তাই করেছেন।

 রাজা। তোমার নিন্দা শুনে আমি রাগ করব না। তোমার ক্রোধ দেখে আমার আহ্লাদ হয়। আর বেশী বলে কি লাভ! আমার কোন অপরাধ নেই। তুমি এখানে থেকে আর কি করবে, যাও! তোমাকে মুক্তি দেওয়া গেল।

 অভি। যদি অনুগ্রহই দেখাবেন, তা’হ’লে আমার পায়ের কাছে পড়ে নিগ্রহের অনুরূপ শিষ্টাচার দেখাতে হবে। ভীম (?) বাহু দিয়ে ধ’রে বুকে ক’রে এনেছেন, তাঁকে আবার এরূপ ভাবেই আমাকে নিয়ে যেতে হবে।

উত্তরের প্রবেশ

 উত্তর। যারা মিথ্যা প্রশংসা লাভ করে, তারা মনে বড় কষ্ট পায়। যুদ্ধ-বিষয়ে আমার সম্বন্ধে যে কথা হচ্ছে তাতে আমি বড় লজ্জিত হচ্ছি।

(অগ্রসর হইয়া)

 ভগবন, অভিবাদন কচ্ছি।

 ভগবান | স্বস্তি।

 উত্তর। তাত, অভিবাদন কচ্ছি।

 রাজা। পুত্র, এস। দীর্ঘায়ু হও। পুত্র, যে সকল যোদ্ধা বীরত্ব দেখিয়েছেন তাদের সম্মান করা হয়েছে?

 উত্তর। হাঁ, হয়েছে। কিন্তু যিনি শ্রেষ্ঠ পূজার পাত্র তাঁর পূজা আপনাকে কত্তে হবে।

 রাজা। পুত্র, ইনি কে?

 উত্তর। ইনি পূজনীয় ধনঞ্জয়।

 রাজা। কি! ধনঞ্জয়!

 উত্তর। হাঁ, পূজনীয় ধনঞ্জয় শ্মশানতরু থেকে ধনু, অক্ষয় তূণীর ও শর গ্রহণ করে ভীষ্মাদি রাজগণকে পরাজিত করেছেন, এবং আমাদিগকেও রক্ষা করেছেন।

 বৃহ। মহারাজ, প্রসন্ন হ’ন, প্রসন্ন হ’ন।

 উত্তর বালক, ভীত হয়েছিল ব’লে যা করেছে, তা মনে নেই। নিজে সমস্ত ক’রে মনে কচ্ছে অন্য ব্যক্তি সব করেছে।

 উত্তর। আচ্ছা, আপনি আমাদের শঙ্কা দূর করুন— আমার এই প্রশ্নটির উত্তর দিন—

 মণিবন্ধে গাণ্ডীবের জ্যাঘাতাঙ্ক আপনার পরিহিত অলঙ্কারে ঢাকা রয়েছে। বার বৎসর পরেও ত সেই দাগ আপনার শরীরের স্বাভাবিক বর্ণ প্রাপ্ত হয় নি!

 বৃহ। অলঙ্কারের ঘর্ষণেই এ সকল দাগ পড়েছে। অলঙ্কারে সর্ব্বদা ঢাকা থাকে বলেই এসকল দাগ জ্যাঘাতাঙ্কের মত দেখা যাচ্ছে।

 রাজা। বুঝলুম।

 বৃহ। আমিই যদি রুদ্রের শর-প্রহারে ক্ষতদেহ ভরতবংশজাত অর্জ্জুন হ’য়ে থাকি তা’হ’লে এতদিন যিনি ছদ্মবেশে কাটিয়েছেন, ইনিই সেই ভীমসেন, আর ইনিই রাজা যুধিষ্ঠির।

 রাজা। ধর্ম্মরাজ, বৃকোদর, ধনঞ্জয়, আমাকে আপনারা বিশ্বাস কচ্ছেন না কেন? আচ্ছা উপযুক্ত সময়ে বিশ্বাস হবে। বৃহন্নলে, তুমি অন্তঃপুরে যাও।

 বৃহ। যে আজ্ঞা, মহারাজ।

 ভগ। অন্তঃপুরে যাওয়ার আর প্রয়োজন নেই। আমরা প্রতিজ্ঞা হ’তে উত্তীর্ণ হয়েছি।

 অর্জ্জুন। যে আজ্ঞা, আর্য্য।

 রাজা। যাঁরা সত্যবাদী, যাঁরা শর দ্বারা প্রতিজ্ঞা পালন করেছেন এমন পাণ্ডবগণ আমার গৃহে বাস করেছেন বলে আমার বংশ নিষ্পাপ হ’ল।

 অভি। ইঁহারাই আমার আরাধ্য পিতা, তাই—

 আমি রুষ্ট হ’লেও তারা রুষ্ট হন নি, হেসে হেসে আমার ক্রোধ বাড়িয়ে দিয়েছেন। গোধন-গ্রহণ-ব্যাপার আমার পক্ষে সৌভাগ্যের প্রসূতি হ’ল। গোধন গ্রহণ কত্তে এসেছিলুম বলেই পিতৃচরণ দর্শন কত্তে পেরেছি।

 (ভীমসেনের প্রতি)

 তাত, চিনতে পারি নি ব’লে প্রথমে আপনাকে অভিবাদন করি নি। পুত্রের অপরাধ ক্ষমা করুন।

 ভীম। পুত্র, এস। পিতার ন্যায় পরাক্রমশালী হও। পুত্র, পিতাকে অভিবাদন কর।

 অভি। তাত, অভিবাদন কচ্ছি।

 অর্জ্জুন। পুত্র, এস—

 দ্বাদশ বর্ষান্তে বনবাসের পর পুত্রের সহিত এই অপ্রত্যাশিত মিলনে আমার হৃদয়ে অসীম আনন্দ হয়েছে।

 পুত্র, বিরাট-রাজকে অভিবাদন কর।

 অভি। মহারাজ, অভিবাদন কচ্ছি।

 রাজা। বৎস, এস। যুধিষ্ঠিরের ধৈর্য্য, ভীমের বল, অর্জ্জুনের নৈপুণ্য, নকুলসহদেবের দেহশ্রী এবং জগৎপ্রিয় শ্রীকৃষ্ণের কীর্ত্তি লাভ কর। (আত্মগত) উত্তরার এখনও বিবাহ হ’ল না। এই কথা মনে হ’লে আমি অস্থির হই। কি করব। আচ্ছা ইহাই করা যাক। এখানে কে?

ভটের প্রবেশ

 ভট। মহারাজের জয় হ’ক।

 রাজা। জল নিয়ে এস।

 ভট। যে আজ্ঞা মহারাজ।

[ প্রস্থান ও পুনঃ প্রবেশ।

 এই জল এনেছি।

 রাজা। অর্জ্জুন, গোধন-রক্ষার মূল্য স্বরূপ উত্তরাকে গ্রহণ করুন।

 ভগ। এবার অর্জ্জুনের মাথা হেট্‌ হ’ল।

 অর্জ্জুন। রাজা কি আমার চরিত্র পরীক্ষা কচ্ছেন?

 মহারাজ,

 আপনার অন্তঃপুরের রমণীবর্গ সকলেই আমার প্রীতির পাত্র ও মাতৃস্বরূপিণী। আপনার প্রদত্ত উত্তরাকে আমার পুত্রের জন্য গ্রহণ কল্লুম।

 ভগ। এবার মস্তক উন্নত হ’ল।

 রাজা। এখন পিতামহের নিকট উত্তরকে পাঠাব। ধর্ম্মরাজ, বৃকোদর, ধনঞ্জয়, এদিকে আসুন।

[ সকলের প্রস্থান।

  1. ‘বর্ষবর্দ্ধনগোপ্রদান নিমিত্তং’—বর্ষবর্দ্ধন শব্দের তিন রকম অর্থ হ’তে পারে—
    (১) জন্মোৎসব (২) বার্ষিক সমৃদ্ধিলাভের উৎসব (৩) বৃষ্টির জন্য উৎসব।
  2. ‘কৃতমঙ্গল মোদকাঃ’—ইহাও দ্ব্যর্থক—
    (১) উৎসব হেতু হৃষ্ট। (২) উৎসবোপলক্ষে প্রস্তুত মোদক সহ।
  3. ‘মহান রেণুরুৎপতিতঃ’—অমঙ্গলের চিহ্ন।
  4. “শতমণ্ডলঃ সূর্য্যঃ”—মণ্ডল = উপসূর্য্যক। কখন কখন সূর্য্যের চারিদিকে সূর্য্যের ন্যায় মণ্ডল দৃষ্ট হয়। ইহা অমঙ্গলের চিহ্ন। জ্যোতির্ব্বিদগণ এই জ্যোতিষ্ক সম্বন্ধীয় দৃশ্যকে দৃষ্টিবিভ্রম বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন।
  5. ‘দস্যুকর্ম্মপ্রচ্ছন্নবিক্রমৈঃ’—প্রচ্ছন্ন শব্দের সার্থকতা— ভাল কাজে বিক্রম দেখাবার ক্ষমতা নেই। চোর সেজে বিক্রম কলুষিত করা হ’ল।
  6. ‘করাণি’ অন্ন বিশেষাণ্‌।
  7. ‘তেষামুৎসুকঃ’-দ্ব্যর্থক। (১) ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের বিষয় (২) আমার ভাইদের বিষয়।
  8. “ভগ্নঃ বাহন-লোভেন শ্মশানাভিমুখো রথঃ”— রথখানি বাঁচাবার জন্য বাহনের অনুরোধে শ্মশানের দিকে পালিয়ে গেল—আর এক অর্থ। ‘ভগ্নঃ’ দ্ব্যর্থক।
  9. কৃতা নীলা নাগাঃ শরশতনিপাতেন কপিলা
      *   *   *   *  
    শরৈশ্ছন্না মার্গাঃ শ্রবতি ধনুরুগ্রাং শরনদীম্।


     প্রথম পংক্তিতে শরশব্দের প্রয়োগের সৌন্দর্য্য দেখুন—নলবনে শত শত নল ভেঙ্গে নীল নাগের উপর পড়লে যেমন হাতীকে কপিল বর্ণ দেখায় তেমনি।
     চতুর্থ পংক্তিতে আবার দেখুন—খরস্রোতা নদীর বেগে নলরাশি তাড়িত হ’লে যেমন নদীবক্ষ নলে আচ্ছন্ন হ’য়ে যায় তেমনি

  10. ‘শীঘ্রং নিম্নঃ কলুষশ্চ রেণুঃ’—‘কলুষ রেণু’ দ্ব্যর্থক—  (১) স্ত্রীজনোচিত ভাব (২) উত্থিত ধূলিরাশি।
     (১) = আমার স্ত্রীবেশ যে বেশীক্ষণ দেখাতে হয় নি সেটা ভালই হ’য়েছে।
     (২)= উত্থিত ধূলিরাশি যে পুনরায় ভূপৃষ্ঠে পড়ে আকাশ শীঘ্র পরিষ্কার ক’রে দিয়েছে সেটা ভালই হয়েছে।
  11. “ত্রিদণ্ডধারী ন চ দণ্ডধারকঃ।”