পঞ্চরাত্র
স্থাপনা
নান্দ্যন্তে সূত্রধারের প্রবেশ

 সূত্র। যিনি কৃষ্ণবর্ণ, পৃথিবীতে যিনি অর্জ্জুন ও ভীমের দূত হয়েছিলেন, যিনি শকুনীশ্বর গরুড়ের ঈশ্বর, যিনি যুদ্ধে শত্রুগণের অনভিগম্য, ভয়ঙ্কর, কিন্তু স্থির, যিনি প্রশস্তকর্ম্মা, যিনি যজ্ঞে আহূত হয়ে থাকেন, সেই বিরাট শ্রীকৃষ্ণ তোমাদিগকে পালন করুন।[১]

 (পরিভ্রমণ করিয়া) সমবেত আর্য্যগণকে এরূপই বলব। একি! আমি একান্ত উৎসুক হয়ে বলতে যাচ্ছি সত্য, কিন্তু একটা শব্দ যেন শুনছি। তাইত, আচ্ছা দেখছি।

 (নেপথ্যে) আহা, এই যজ্ঞ কুরুপতির বিপুল সমৃদ্ধিরই পরিচায়ক বটে!

 সূত্র। হয়েছে, বুঝেছি;

 কুরুরাজ দুর্য্যোধন যজ্ঞ কচ্ছেন, এবং সমস্ত ক্ষত্রিয় রাজগণ যজ্ঞ দেখবার জন্য পত্নীবর্গের সহিত প্রফুল্লচিত্তে এখানে সমাগত হয়েছেন। [প্রস্থান।


বিষ্কম্ভক
তিন জন ব্রাহ্মণের প্রবেশ

 সকলে। অহো! কুরুরাজের যজ্ঞের কি বিপুল সমারোহই হয়েছে!

 প্রথম। চতুর্দ্দিকে দ্বিজোচ্ছিষ্ট অন্ন, যেন সর্ব্বত্র কাশকুসুম ফুটে আছে। ধূম-গন্ধে তরুগণের কুসুম-গন্ধকে নষ্ট ক’রে দিয়েছে। ব্যাঘ্রগণ পর্ব্বত প্রদেশে মৃগের ন্যায় বিচরণ কচ্ছে, এবং সিংহসমূহও হিংসা-পরাঙ্মুখ হয়েছে। মহারাজ যজ্ঞে দীক্ষিত হয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে যেন সমস্ত জগৎও দীক্ষা প্রাপ্ত হয়েছে।

 দ্বিতীয়। তুমি ঠিক বলেছ।

 অগ্নি দেবগণের মুখ স্বরূপ।[২] তিনি হবি দ্বারা তৃপ্তি লাভ করেছেন। বিশিষ্ট ব্রাহ্মণগণ ধনলাভে তৃপ্ত হয়েছেন, গোকুলের সহিত পক্ষিগণ তৃপ্তি লাভ করেছে, এবং সমাগত ক্ষত্রিয় রাজন্যবর্গও সন্তুষ্ট হয়েছেন। ফলকথা, সমগ্র জগৎ হৃষ্ট হ’য়ে মহারাজের গুণকীর্ত্তন কচ্ছে, এবং এইরূপে তাঁহার সদ্গুণাবলী[৩] পৃথিবী অতিক্রম ক’রে দেবালয়ে (স্বর্গে) পরিব্যাপ্ত হয়েছে।

 তৃতীয়। সমাগত ব্রাহ্মণগণ, দেখুন, দেখুন—

 মহারাজের পট্টবেষ্টিত মস্তকে দ্বিজগণের স্থাপিত চরণ কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে! ইঁহারা সকলেই শ্লাঘ্য ও সুবিখ্যাত এবং স্বাধ্যায়-শূরগণের অগ্রণী। বৃদ্ধকালে ইঁহাদের তপোনিষ্ঠা আরও বর্দ্ধিত হয়েছে। বৃদ্ধ গজগুলি যেমন বলবান হস্তীর স্কন্ধদেশে শুণ্ড স্থাপন ক’রে অগ্রসর হয়, সেরূপ বর্ষাতিশয়ে শিথিল-চরণ বিপ্রগণ হস্ত দ্বারা শিষ্যের স্কন্ধদেশ জড়িয়ে ধ’রে অগ্রসর হচ্ছেন, আবার একটি যষ্টি ইঁহাদের তৃতীয় চরণের পংক্তি-স্থানীয় হয়েছে।

 সকলে। ওহে যজ্ঞ-ব্রতী পুরোহিতগণ, মহারাজের যজ্ঞান্ত-স্নান না হ’লে আপনারা যজ্ঞাগ্নি পরিত্যাগ ক’রে যাবেন না।

 প্রথম। ধিক্, ধিক্, তুমি যে ব্রাহ্মণসুলভ চপলতা দেখালে দেখছি!

 কনকময় এই সুন্দর যূপটি দেখে বোধ হচ্ছে যেন দেবী বসুধা একটি সুবর্ণময় ভুজ তুলে রেখেছেন। দ্বিজ যেমন স্বীয় পার্শ্বে শূদ্রের[৪] উপস্থিতি সহ্য কত্তে পারেন না, তদ্রূপ যজ্ঞবেদিকার অগ্নিও পার্শ্বে লৌকিকাগ্নি সহ্য কত্তে পারে না। ঐ দেখ হরিত কুশে আস্তীর্ণ থাকাতে যজ্ঞবেদীর পৃষ্ঠদেশ সমধিক দগ্ধ হতে পারে নাই। আর গজ যেমন প্রফুল্প পদ্মবনে (সরোবরে) প্রবেশ করে, এই ধূমও সেইরূপ যজ্ঞগৃহের পুরোবর্ত্তী গৃহে প্রবেশ কচ্ছে।

 দ্বিতীয়। কুল কলঙ্কিত হলে জ্ঞাতি যেমন জ্ঞাতি ভয়ে স্থানান্তরিত হয়, সেরূপ অগ্নিতাপে নিপীড়িত দ্বিজগণ অগ্নি-ভয়েই অগ্নিকে স্থানান্তরিত কচ্ছেন।[৫]

 তৃতীয়। অপত্যনাশে শোকার্ত্তা নারী যেরূপ পুত্রের প্রতি স্নেহ বশতঃ শোকানলে দগ্ধ হয়, সেরূপ ঘূতপরিপূর্ণ (যজ্ঞীয়) ক্ষুদ্র শকটখানিতে জল সিঞ্চন করা সত্ত্বেও সদ্য ঘৃতে (স্নেহ) আগুন ধরেছে বলে জ্বলে যাচ্ছে।

 প্রথম। তুমি বেশ বলেছ—

 শুষ্ক দর্ভ আশ্রয় ক’রে অগ্নি যজ্ঞের জন্য ব্যবহৃত দুর্য্যোধনের এই ক্ষুদ্র শকটটি দগ্ধ কত্তে উদ্যত হয়েছে, কিন্তু নূতন তৃণে ঢাকা রয়েছে বলে থেকে থেকে খর্ব্ব হয়ে যাচ্ছে। ঐ দেখ, বায়ু-তাড়িত হয়ে শিখাবিস্তার পূর্ব্বক ক্রমশঃ শকটের চক্র পর্য্যন্ত এসে পৌঁছেছে। ঐ যে, দেখতে দেখতে, নেমীতে আগুন ধরে গেল, এবং মণ্ডলাকার অগ্নিরাশি সূর্য্যের ন্যায় গোলাকার হয়ে উঠল।

 দ্বিতীয়। আর একটা ব্যাপার দেখ—

 অগ্নিতাপে ভীত হ’য়ে বল্মীকমূলের কোটর থেকে এক সময়েই পাঁচটা সাপ মৃত ব্যক্তির দেহ হতে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের ন্যায় বেরিয়ে গেল।

 তৃতীয়। আবার এ দিকে চেয়ে দেখ—

 বায়ুসহায় যজ্ঞাগ্নি-দগ্ধ গাছটার কোটর থেকে পাখীগুলি উড়ে গেল, বোধ হ’ল যেন ইহার শরীরের ভিতর থেকে প্রাণ বেরিয়ে গেল।

 প্রথম। তোমাদের কথা যথার্থ বটে। আমার কিন্তু বোধ হচ্ছে দূষিত-চরিত্র একটা লোকের দোষে যেমন সমস্ত বংশ নষ্ট হয়, তেমনি একটা মাত্র শুষ্ক বৃক্ষের জন্যও পুষ্পিত-পাদপ সমগ্র উপবন দগ্ধ হয়।

 ঐ দেখ, বৃক্ষলতা ও গুল্ম পরিপূরিত সমগ্র উপবনটি ভোজ্য বস্তুর ন্যায় নিঃশেষে ভক্ষণ ক’রে, আচমন করার জন্যই যেন অগ্নিদেব এখন কুশমাত্র অনুসরণ ক’রে নদীতে অবতীর্ণ হয়েছেন।

 দ্বিতীয়। ঐ দেখ, তরু-লম্বিত কুশ ও বল্কলের সাহায্যে অগ্নি বৃক্ষ থেকে বৃক্ষান্তরে গমন কচ্ছে, এবং পাকা ফলের ন্যায় পোড়া কলাগুলি কলাগাছ থেকে নীচে পড়ছে। আবার ঐ দেখ, সম্মুখে তালগাছটার আগায় একটা প্রকাণ্ড মৌচাক—অনেকক্ষণ ধরে গোড়া জ্বলে জ্বলে এখন মৌচাকটা শুদ্ধ মহাদেবের পরশুর ন্যায় সমস্ত গাছটা পড়ে গেল।

 তৃতীয়। বাঁচা গেল। সাধু ব্যক্তির রোষের ন্যায় ভগবান হুতাশন এখন প্রশান্ত হয়েছেন।

 বিভব ক্ষীণ হ’লে উন্নতমন ব্যক্তির যেমন দানশক্তি ক’মে যায়, সেইরূপ ইন্ধন শেষ হ’য়ে যাওয়াতে অগ্নির তেজও ক’মে গিয়েছে।

 প্রথম। অমিত ব্যয়ের ফলে দরিদ্র হ’য়ে লোক যেমন পরিশেষে স্বীয় পরিচ্ছদ বিক্রয় ক’রে জীবন ধারণ করে (খায়), তদ্রূপ হুতাশনও এখন স্রুক, ভাণ্ড, অরণী ও দর্ভ ভক্ষণ কচ্ছেন।

 দ্বিতীয়। ঐ দেখ, বৃক্ষটার পত্র-বহুল শাখাগুলি নুয়ে পড়ে নদীর জল স্পর্শ কচ্ছে, এবং বায়ুসঞ্চালনে পাতাগুলি আন্দোলিত হওয়াতে জল ছিটে উঠছে; বোধ হচ্ছে যেন দাবাগ্নি-পীড়িত পাদপ-সমূহের জীবন রক্ষার জন্য বৃক্ষটি স্বীয় পর্ণরূপ হস্তে ইহাদের গায় জলসিঞ্চন কচ্ছে।

 তৃতীয়। আচ্ছা এস, যাই আমরাও আচমন করি গিয়ে।

 উভয়ে। হাঁ, এস।

(সকলের আচমন)

 প্রথম। ঐ যে, কুরুপতি দুর্য্যোধন এই দিকেই আসছেন। তাঁহার অগ্রে ভীষ্ম ও দ্রোণ এবং পশ্চাতে অন্যান্য ক্ষত্রিয় রাজগণ।

 ইঁহারা সকলেই মহারাজ দুর্য্যোধনের সঙ্গে উপস্থিত প্রসঙ্গক্রমে উত্থাপিত বিষয় সম্বন্ধে[৬] মধুর আলাপ কচ্ছেন। বলছেন, যজ্ঞ ক’রে সমগ্র পৃথিবী ভোজন করাও, পরাক্রমে পৃথিবী জয় কর, রোষ পরিত্যাগ কর, স্বজনকে স্নেহ কর; সুতরাং ইহাদের কথা শুনে মনে হয় যেন পৌরবর্গ পাণ্ডবগণেরই পক্ষাবলম্বন করেছে।

 এস যাই, আমরাও গিয়ে কুরুরাজকে অভিবাদন করি।

প্রথম অঙ্ক
ভীষ্ম ও দ্রোণের প্রবেশ

 দ্রোণ! ধর্ম্মাচরণতৎপর দুর্য্যোধন আমার প্রতিই অনুগ্রহ প্রদর্শন কচ্ছেন—তা হবে, কারণ শিষ্যের দোষ বন্ধু বা মিত্রকে স্পর্শ করে না, আচার্য্যকেই আশ্রয় ক’রে থাকে। গুরুর হাতে বালককে একবার সমর্পণ ক’রে দিলে মাতাপিতার আর কোনও অপরাধের (পাপের) ভয় থাকে না।

 ভীষ্ম। এই যে দুর্য্যোধন এ দিকেই আসছে। এই দুর্য্যোধনই অর্থ গ্রহণ ক’রে সুসমৃদ্ধ হয়েছিল, এবং রণপ্রিয় বলে বিস্তর অযশের ভাগীও হয়েছিল;[৭] কিন্তু এখন যজ্ঞ ক’রে পুণ্যলাভ করেছে, সুতরাং তাহার এই অতুল ঐশ্বর্য্য ও দেহকান্তি এখন আবার তাহার শোভাই বর্দ্ধন কচ্ছে।

দুর্য্যোধন, কর্ণ ও শকুনির প্রবেশ

 দুর্য্যো। আমার আত্মা এখন সন্তোষ-তৃপ্ত, গুরুজন পরিতুষ্ট, আমি এখন জগৎবাসীর বিশ্বাসের পাত্র, আমার অযশ দূর হয়েছে এবং ধার্ম্মিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লোকে বলে মৃত্যুর পর স্বর্গলাভ হয়; কিন্তু এটা মিথ্যা কথা, কারণ স্বর্গ পরোক্ষ বস্তু নহে—পুণ্যের ফলে পৃথিবীতেই স্বর্গলাভ হয়।

 কর্ণ। গান্ধারী-তনয়, ন্যায়-পথে অর্জ্জিত ধন দান ক’রে আপনি উপযুক্ত কার্য্যই করেছেন, কারণ—

 ক্ষত্রিয়গণের সমৃদ্ধি বাণ-সাপেক্ষ। যে ক্ষত্রিয় পুত্রাদির জন্য অর্থ সঞ্চয় করে সে স্বয়ং বঞ্চিত হয়। সুতরাং ক্ষত্রিয়ের পক্ষে, বিপ্রগণকে সমস্ত বিত্ত দান ক’রে, পুত্রের জন্য ধনু মাত্র রেখে যাওয়াই উচিত।

 শকুনি। অঙ্গরাজ, তুমি গঙ্গা-তীরবাসী, সুতরাং গঙ্গা-সংস্পর্শে তোমার সমস্ত পাপ ধৌত হয়েছে। এই বাক্য তোমার মুখেই শোভা পায় বটে।

 কর্ণ। ইক্ষ্বাকু, শর্য্যাতি, যযাতি, রাম, মান্ধাতা, নাভ, অগ, নৃপ, অম্বরীষ প্রভৃতি রাজগণের অতুল রাজকোষ ছিল, বিস্তীর্ণ রাজ্য ছিল। এখন সেই রাজগণ নাই, তাঁহাদের ধন-ভাণ্ডারও নাই, এবং রাজাও নাই। কিন্তু ধর্ম্মকার্য্য (যজ্ঞ) করেছিলেন বলে এখনও তাদের নাম লুপ্ত হয় নাই।

 সকলে। গান্ধারী-তনয়, যজ্ঞ সম্পন্ন ক’রে আপনি মঙ্গল ও সমৃদ্ধি লাভ করেছেন।

 দুর্য্যো। আমি অনুগৃহীত হলেম। আচার্য্য, দুর্য্যোধন আপনাকে অভিবাদন কচ্ছে।

 দ্রোণ। পুত্র, এস। কিন্তু প্রথমে আমাকে অভিবাদন করা তোমার অন্যায়।[৮]

 দুর্য্যো। তবে কাকে প্রথমে অভিবাদন করব?

 দ্রোণ। কেন, তুমি কি দেখছ না, সম্মুখে ভীষ্ম রয়েছেন। তিনি দেবতা ও মানুষ হ’তে জন্মলাভ করেছেন, তাঁহাকেই প্রথমে নমস্কার কর। ভীষ্মকে পরিত্যাগ ক’রে অন্য ব্যক্তিকে প্রথম নমস্কার কল্লে অন্যায় হয়।

 ভীষ্ম। মহাশয়, এরূপ বলবেন না। অনেক বিষয়ে আমি আপনার চেয়ে অপকৃষ্ট।

 আমি মাতৃ-গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেছি, আপনি স্বয়ম্ভূ। আমার বৃত্তি যুদ্ধ—ইহা আপনার পক্ষে গর্হিত। আপনি দ্বিজ, আমি ক্ষত্রিয়াত্মজ। আপনি গুরু, আমি মাত্র আপনার শিষ্যবর্গের মধ্যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ।

 দ্রোণ। হাঁ, মহাত্মারা নিজদের অপ্রশংসা ক’রে থাকেন; ইহা কিন্তু ভাল নয়। পুত্র, এস, তাহলে আমাকেই অগ্রে অভিবাদন কর।

 দুর্য্যো। আচার্য্য, দুর্য্যোধন আপনাকে অভিবাদন কচ্ছে।

 দ্রোণ। পুত্র, এস আশীর্ব্বাদ করি, যেন এরূপে যজ্ঞ ক’রে ক’রেই তুমি খিন্ন হও।

 দুর্য্যো। অনুগৃহীত হলেম। পিতামহ, দুর্য্যোধন আপনাকে অভিবাদন কচ্ছে।

 ভীষ্ম। পৌত্র, এস। এরূপেই তোমার বুদ্ধিপ্রশমন হউক।

 দুর্য্যো। অনুগৃহীত হলেম। মাতুল, দুর্য্যোধন আপনাকে অভিবাদন কচ্ছে।

 শকুনি। বৎস, দক্ষিণা দান ক’রে এরূপে সমস্ত যজ্ঞ নির্ব্বিঘ্নে সম্পন্ন কর, এবং নৃপতিবৃন্দকে জয় ক’রে জরাসন্ধের[৯] ন্যায় রাজসূয়ে মিলিত কর।

 দ্রোণ। কি আশ্চর্য্য, শকুনির আশীর্ব্বাদ-বাক্যেও দেখছি উত্তেজনা আছে। এই ক্ষত্রিয়-তনয় বিরোধপ্রিয়ই বটে।

 দুর্য্যো। বয়স্য কর্ণ, গুরুজনকে প্রণাম করা হয়েছে, এখন বন্ধুবর্গের সঙ্গে যথাক্রমে মিলন-সুখ উপভোগ কর।

 কর্ণ। গান্ধারী-তনয়, যজ্ঞের নিয়ম পালন করায় আপনার শরীর কৃশ হয়েছে। তথাপি আপনার কর-মর্দ্দন কচ্ছি। আশা করি, এখনও এই কর-মর্দ্দন সহ্য করার মত বল আপনার আছে। কিন্তু বিশেষ বিবেচনা না ক’রে আমি আর কোনও প্রগল্‌ভ বাক্য উচ্চারণ করব না। কারণ, এখন রাজর্য্যুচিত আপনার ধীরগম্ভীর বাক্য শুনে আমার ভয় হয়।

 দুর্য্যো। তুমি এরূপ ভাবেই (বন্ধুর ন্যায়) আমার সঙ্গে সর্ব্বদা আলাপ ক’রো।

 দ্রোণ। পুত্র দুর্য্যোধন, মহেন্দ্রের প্রিয়সখা রাজা ভীষ্মক তোমার সম্বর্দ্ধনা কচ্ছেন।

 দুর্য্যো। আর্য্য, আসুন। আপনাকে অভিবাদন কচ্ছি।

 ভীষ্ম। পৌত্র দুর্য্যোধন, দক্ষিণাপথের পরিঘতুল্য রাজা ভূরিশ্রবা তোমাকে সম্বর্দ্ধনা কচ্ছেন।

 দুর্য্যো। আর্য্য, আসুন।

 দ্রোণ। পুত্র দুর্য্যোধন, বসুভদ্র তোমার যজ্ঞ সম্বর্দ্ধনা করেছেন, এবং তোমাকে সম্বর্দ্ধনা করার জন্য অভিমন্যুকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

 শকুনি। পুত্র দুর্য্যোধন, ইনি জরাসন্ধের পুত্র সহদেব—তোমাকে সম্বর্দ্ধনা কচ্ছেন।

 দুর্য্যো। বৎস, এস। পিতার ন্যায় পরাক্রম শালী হও।

 সকলে। সমাগত রাজন্যবর্গ সকলেই মহারাজকে সম্বর্দ্ধনা কচ্ছেন।

 দুর্য্যো। অনুগৃহীত হলেম। রাজগণ, আপনারা সকলেই সমাগত হয়েছেন, কিন্তু রাজা বিরাট ত আসেন নি!

 শকুনি। আমি বিরাটের নিকট দূত পাঠিয়েছি। আমার মনে হয়, এঁরা পথে আছেন।

 দুর্য্যো। গুরুদেব, আপনি এই ধর্ম্মকার্য্যে গুরু, অস্ত্রবিদ্যায়ও আমার গুরু, দক্ষিণা গ্রহণ করুন।

 দ্রোণ। দক্ষিণা! বেশ! বেশ! প্রথম তোমার শ্রম দূর করাই; তারপর দক্ষিণা।

 দুর্য্যো। কি! আচার্য্য আমাকে বিগতশ্রম করাবেন!

 ভীষ্ম। হা, বিগতশ্রম করাবেন বৈ কি—

 তুমি যজ্ঞে দীক্ষিত হ’য়ে তরুণবয়স্ক ব্রাহ্মণ-প্রদত্ত সোমরস পান করেছ—তুমি যশস্বী এবং রাজচ্ছত্রের ছায়া উপভোগ ক’রে থাক। ক্ষত্রিয়গণের আচার্য্য যে স্থলে দরিদ্র সে স্থলে দ্রব্য, ফল বা বিশিষ্ট তার আবার বিচার কি?[১০]

 দুর্য্যো। আচার্য্য, আপনার কি ইচ্ছা আজ্ঞা করুন। আদেশ করুন, আমাকে কি কত্তে হবে।

 দ্রোণ। পুত্র দুর্য্যোধন, এই বলছি।

 দুর্য্যো। আপনি আবার কি চিন্তা কচ্ছেন, প্রভো? আমি আপনার প্রাণাপেক্ষাও প্রিয়তর, আপনিই আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন, আমি শূরের মধ্যে গণ্য, সাহসের কাজও আমি অনেক করেছি। আপনার যা ইচ্ছা স্বচ্ছন্দে বলুন; বলুন আমাকে কি দক্ষিণা দিতে হবে। যতক্ষণ আমার হস্তে গদা আছে ততক্ষণ সমস্তই আপনার হস্তগত আছে মনে করবেন।

 দ্রোণ। পুত্র, বলব বৈ কি। এই বলছি, শুধু বাষ্পবেগে আমার কণ্ঠরোধ হ’য়ে আসছে।

 সকলে। কি! আচার্য্যও অশ্রুবিসর্জন কচ্ছেন!

 ভীষ্ম। পৌত্র দুর্য্যোধন, তোমার পরিশ্রম নিষ্ফল হ’ল দেখছি।

 দুর্য্যো। কে আছ এখানে?

ভটের প্রবেশ

 ভট। মহারাজের জয় হ’ক।

 দুর্য্যো। জল নিয়ে এস।

 ভট। যে আজ্ঞা, মহারাজ।
প্রস্থান ও পুনঃ প্রবেশ

 মহারাজের জয় হ’ক। জল এনেছি।

 দুর্য্যো। নিয়ে এস। (কলশ গ্রহণ)

 আচার্য্য, অশ্রুপাতে আপনার মুখ কলুষিত হয়েছে, ধুয়ে ফেলুন।

 দ্রোণ। হাঁ, তাই বটে। এখন আমার মুখ ধোয়াই কর্ত্তব্য।

 দুর্য্যো। হা ধিক্‌!

 আচার্য্য, আমার পূর্ব্ব শঠতার কথা মনে ক’রে যদি আমাকে সন্দেহ করেন, অথবা কৃত প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করব না যদি আপনার মনে এরূপ সন্দেহ হ’য়ে থাকে, তা হ’লে শত শত শর-প্রহারে আপনার যে হস্ত কঠিন হ’য়েছে সেই হাতখানি বাড়িয়ে দিন, এই জলই দান-গ্রহণের প্রধান উপাদান[১১] হ’ক।

 দ্রোণ। বেশ। এখন আমি আশ্বস্ত হ’লেম। পুত্র শ্রবণ কর—

 যারা নিরাশ্রয়, দ্বাদশ বৎসর যাদের গতিবিধির কোনও সংবাদ পাওয়া যায় নি, সেই পাণ্ডবদিগকে রাজ্যার্দ্ধ প্রদান কর—ইহাই আমার ভিক্ষা ও দক্ষিণা।

 শকুনি। (উদ্বেগের সহিত) মশায়, এরূপ বলবেন না। যে শিষ্য আপনার গৌরব-সম্পাদনে চেষ্টিত, যে শিষ্য আপনাকে বিশ্বাস করে, ও যে শিষ্য এখন আপনার সম্মুখেই দাঁড়িয়ে রয়েছে তার কাছে সে যা প্রদান কত্তে প্রস্তুত নয় এইরূপ প্রস্তাব ক’রে ধর্ম্মবঞ্চনা করবেন না।

 দ্রোণ। বলি ধর্ম্মবঞ্চনা কেমন ক’রে হ’ল। শকুনি, তুমি গান্ধার দেশের রাজা বলে নিজকে বড় মনে কচ্চ, এবং সকলকেই নিজের মত ভাবচ।[১২]

 ভাইদের ন্যায্য প্রাপ্য পৈতৃক রাজ্য দিতে বলছি এটা বঞ্চনা হ’ল বটে! বলি তারা ভিক্ষা চেয়েছে ব’লে কি রাজ্য তাদের দান করা হচ্ছে, না তারা জোর ক’রে রাজ্যটা কেড়ে নিচ্ছে?

 সকলে। না, না, জোর ক’রে নেবে কেন! এ কি কথা!

 ভীষ্ম। পৌত্র দুর্য্যোধন, তুমি এখন যজ্ঞশেষে স্নান করেছ এটা যেন মনে থাকে।[১৩] সুতরাং যার মুখের কথাটি মাত্র মিত্রের কথার ন্যায়[১৪] এই রকম শকুনির কথা এখন তোমার শোনা উচিত নয়। পৌত্র ভেবে দেখ—

 দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডবেরা যে দুর্গম বনে ধূলিধূসরিত পদে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তুমি যে তাদের প্রতি বিমুখ, এবং তারাও যে তোমার প্রতি বাম—এই সকলের একমাত্র কারণ শকুনির অসহনীয় অহঙ্কার।

 দুর্য্যো। বেশ, আচার্য্য, ধ’রে নিলুম এ কথা ঠিক। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি।

 দ্রোণ। পুত্র, স্বচ্ছন্দে বল।

 দুর্য্যো। আচ্ছা পূর্ব্বে যে সভার মধ্যে তাদের অপমান করা হ’য়েছে বলছেন এবং রাজ্য সম্বন্ধে তাদের উপর অন্যায় হ’ল বলছেন তারা ত তখন ইচ্ছা কল্লে বলপ্রয়োগ কত্তে পাত্ত, তবু তারা ক্রোধ প্রকাশ কল্লে না কেন?

 দ্রোণ। এই বিষয়ে যে যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এবং ধর্ম্মচ্ছলে যাকে বঞ্চনা করা হ’য়েছে, তাকেই জিজ্ঞাসা করা উচিত।

 যখন ভীম সভাগৃহের একটি স্তম্ভ প্রায় তুলছিলেন তখন যুধিষ্ঠিরই তাকে বারণ করেছিলেন। যদি সেই স্তম্ভ (তখন) সেখানে একজনের উপর পড়ত তা’হ’লে শকুনির কি হ’ত?[১৫]

 ভীষ্ম। ‘উদোর পিণ্ড বুধোর ঘারে গেল’[১৬] দেখছি। আচার্য্য, এ বড় গুরুতর বিষয়। কলহ করা উচিত নয়।

 দ্রোণ। তাই ব’লে অপমানের দান নোব না।[১৭] কলহই হ’ক।

 ভীষ্ম। আচার্য্য, প্রসন্ন হন। পৌত্র দেখ,

 যারা দুর্ব্বল, বিপন্ন ও নিরাশ্রয় তারাই অনুগ্রহ চায়, অহঙ্কার করে না। তুমি ক্ষমতাশালী (শ্রেষ্ঠ), তুমি (তাদের) আত্মীয়, তোমার কাছে তারা যাচক। তুমি কি তাদের বাঁচাবে, না তারা বনে বনে পশুর সঙ্গে থাকবে?

 শকুনি। বেশ, পশুর সঙ্গেই থাকুক।

 কর্ণ। আচার্য্য, রাগ ক’রে ফল নাই। এ দুর্য্যোধন। ভাল কথা জোর করে শোনাতে চাইলে রেগে যায়। আর সামনে ভাল লোকের গুণ কীর্ত্তন শুনতে পারে না। শিষ্যের কাজ কত্তে উদ্যত হয়েছেন—কাজ যে প্রায় পণ্ড হ’ল। কাজটি যাতে কত্তে পারেন তারই চেষ্টা করুন। দুষ্ট হাতীকে যেমন নরম হ’য়ে চালান যায় (দুর্য্যোধনকেও) সেই রূপে চালাতে চেষ্টা করুন।

 দ্রোণ। বৎস কর্ণ, ব্রাহ্মণের তেজ এখনও লুপ্ত হয় নি। সময় থাকতেই সাবধান করেছ। আমি তোমার ইচ্ছা মতই কাজ করব। বৎস দুর্য্যোধন, তোমার উপর কি আমার প্রভুত্ব খাটে না?

 ভীষ্ম। (স্বগত) হাঁ, এখন পথে এসেছে। মিষ্ট কথাই দুষ্টের ঔষধ।

 দুর্য্যো। কেবল আমার উপর কেন, আমার বংশের উপরও আপনার প্রভুত্ব খাটে।

 দ্রোণ। হাঁ, তোমার উপযুক্ত কথাই বলেছ। পুত্র, তোমাকে আমি যদি বঞ্চনা করি তা হ’লেও তোমার কোন দোষ হবে না। তোমাকে যদি আমি পীড়ন করি তা’হলেও তোমার লাভ। মহাবংশে যে পরস্পর মনান্তর থাকে ধর্ম্মকথায় তা দূর হয়।

 দুর্য্যো। হাঁ, পরামর্শ কত্তে হবে।

 দ্রোণ। কার সঙ্গে, পুত্র? ভীষ্মের সঙ্গে, কি কর্ণের সঙ্গে, কি সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের সঙ্গে, কি অশ্বথামার সঙ্গে, কি বিদুরের সঙ্গে, কি পিতার সঙ্গে, কি ভাইদের সঙ্গে—কার সঙ্গে পরামর্শ কত্তে চাও বল।

 দুর্য্যো। না, এদের সঙ্গে নয়। মাতুলের সঙ্গে।

 দ্রোণ। কি! শকুনির সঙ্গে! (স্বগত) তা, হ’লেই সব মাটি হ’ল।

 দুর্য্যো। মাতুল, এদিকে আসুন। বয়স্য কর্ণ, এদিকে এস।

 দ্রোণ। (স্বগত) আচ্ছা তা’হ’লে এক কাজ করা যা’ক।

 (প্রকাশ্যে) বৎস গান্ধাররাজ, এদিকে এস।

 শকুনি। এই যে, এসেছি।

 দ্রোণ। বৎস, জীবনে যথেষ্ট ক্রোধ প্রকাশ করেছ। এখন দিন ত প্রায় শেষ হ’য়ে এসেছে। ব্রাহ্মণের চপলতা থাকেই, কিছু মনে করো না। কোলাকুলি করলেই রুক্ষ কথার দোষ শান্তি হয়।

 ভীষ্ম। (স্বগত) শিষ্যের স্নেহের বশবর্ত্তী হয়ে গুরু দ্রোণ শকুনিকেও অনুনয় কচ্ছেন। কিন্তু শকুনিকে শান্ত কত্তে চেষ্টা কল্লেও সে কুটিলতা ছাড়বে না।

 শকুনি। (স্বগত) হাঁ, আচার্য্যও শঠ কম নয় কার্য্যসিদ্ধির জন্য আমাকে শান্ত কত্তে চেষ্টা কচ্ছেন

[আসিয়া সকলের উপবেশন।

 দুর্য্যো। পাণ্ডবদের রাজ্যের অর্দ্ধেক দেওয়া সম্বন্ধে আপনার কি মত।

 শকুনি। আমার মত না দেওয়া।

 দুর্য্যো। মাতুল, ‘দেওয়াই’ কর্ত্তব্য এ কথাই আপনার বলা উচিত।

 শকুনি। যদি রাজ্য দেওয়াই তোমার অভিপ্রায় তা’হ’লে আমাদের সঙ্গে আবার পরামর্শ কেন? সবটাই দিয়ে দাও—অর্দ্ধেক আর কেন?

 দুর্য্যো। বয়স্য অঙ্গরাজ, তুমি ত কিছু বলছ না।

 কর্ণ। এখন আমার কি বলবার আছে।

 ভাইয়ে ভাইয়ে যে ভাব—রাম যা দেখিয়ে গেছেন, এবং নিজে পালন করছেন, সেই ভাব আমি নষ্ট কত্তে ইচ্ছুক নই। ক্ষমা করা উচিত কি না, কিংবা কাকে ক্ষমা কত্তে হবে ইত্যাদি বিষয় আপনিই বিচার করবেন। আমরা যুদ্ধের সময় আপনার সহায়।

 দুর্য্যো। মাতুল, এমন একটা দেশের নাম বলুন ত যেখানে প্রজাগুলি ভাল নয়, যেখানে শস্য জন্মে না। সেখানেই না হয় পাণ্ডবেরা থাকবে।

 শকুনি। শোন বলি,

 আমার মতে কিছুই দেওয়া উচিত নয়। পার্থের চাইতে পরাক্রমশালী আর কে আছে! মরুভূমি হ’লেও যুধিষ্ঠির যেখানে রাজা সেখানে শস্য হবে।

 দুর্য্যো। মাতুল, এখন আমি গুরুর হাতে জল দিয়েছি। কুলবৃদ্ধদের মতে ইহার অন্যথা করা উচিত নয়। সুতরাং আমার পক্ষে ভাল নীতিই হ’ক আর মন্দনীতিই হ’ক এই জলের (সত্যের) মর্য্যাদা আমি রাখব।

 শকুনি। অসত্য বিষয় থেকে তোমার মুক্ত হওয়া উচিত।[১৮]

 দুর্য্যো। হাঁ মাতুল।

 শকুনি। তা হ’লে এদিকে এস। (আসিয়া) আচার্য্য, কুরুরাজ আপনাকে জিজ্ঞাসা কচ্ছেন—

 দ্রোণ। বৎস গান্ধাররাজ, স্বচ্ছন্দে বল।

 শকুনি। যদি পাঁচ রাত্রের মধ্যে পাণ্ডবদের কোন খরর পাওয়া যায় তা হ’লে দুর্য্যোধন বলছেন পাণ্ডবদের রাজ্যার্দ্ধ দেবেন। সুতরাং তাদের খবর আনুন।

 ছলনা কত্তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে তারাই বার বৎসর যাদের কোন সংবাদ পেল না, পাঁচ রাত্রের মধ্যে আমাকে তাদের খবর নিয়ে আসতে হবে। এর চাইতে “বরং রাজ্য দেওয়া হবে না” এ কথা পরিষ্কার ক’রে বল না কেন?

 ভীষ্ম। পৌত্র দুর্য্যোধন, ধর্ম্মের মধ্যে ছলনা থাকতে নেই। আমরা সকলেই তোমার কার্য্যে সন্তুষ্ট হয়েছি। পৌত্র দেখ, এক বৎসরের মধ্যেই হ’ক আর শত বৎসরের মধ্যেই হ’ক, পাণ্ডবদিগকে অর্দ্ধেক রাজ্য দাও। হে বীর, কুরুবংশীয়েরা সর্ব্বদাই প্রতিজ্ঞা পালন ক’রে থাকে। তুমিও সত্য পালন কর।

 দুর্য্যো। যা বলেছি তাই ঠিক।

 দ্রোণ। (স্বগত) হনুমান যেমন সাগর লঙ্ঘন ক’রে নষ্ট সীতার সংবাদ এনেছিলেন এস্থলে আমার আকাঙ্ক্ষাও হনুমানের দশা প্রাপ্ত হ’ল দেখছি। কোথা থেকে পাণ্ডবদের সংবাদ আনব?

 ভট। মহারাজের জয়। বিরাট নগর থেকে একজন দূত এসেছে।

 সকলে। শীঘ্র সভায় নিয়ে এস।

 ভট। যে আজ্ঞা।

ভটের প্রবেশ

 দূত। মহারাজের জয়।

 সকলে। বিরাট-রাজ কি এলেন?

 তিনি বড় বিষন্ন, তাই আসতে পাল্লেন না। রাজার সম্বন্ধী কীচক ও কীচকের যে একশত ভাই তাঁর কাছে থাকতেন তাদিগকে কে রাত্রিকালে গুপ্তভাবে শুধু বাহু দিয়ে পিষে মেরে ফেলেছে! দেখে বোধ হয় শস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু হয় নি।

 ভীষ্ম। কি! শস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু হয় নি! (স্বগত) আচার্য্য, পাঁচ রাত্রি স্বীকার করুন।

 দ্রোণ। কেন?

 ভীষ্ম। নিশ্চয় বাহুশালী ভীমেরই এই কাজ! এই শত ভাইর উপর যে রাগটা ছিল, সেই রাগটা সেই শত ভাইর উপর প্রকাশিত হয়েছে।

 দ্রোণ। কি ক’রে বুঝলেন?

 ভীষ্ম। বংশে যারা অভিজ্ঞ তাদের বালকসুলভচঞ্চলতা থাকে না। বাছুরের কোথায় শিং উঠবে ষাঁড় তা জানে।

 দ্রোণ। কি ষাঁড়! বটে! তা হ’লে কার্য্য সিদ্ধ হ’ল। (প্রকাশ্যে) পুত্র দুর্য্যোধন, আচ্ছা পাঁচ রাত্রই স্বীকার।

 দুর্য্যো। বেশ।

দূতের প্রবেশ

 দ্রোণ! যে সকল রাজা যজ্ঞ দেখতে এসেছেন সকলে শুনুন। এই কুরুরাজ দুর্য্যোধন—না না মাতুলের সহিত এই কুরুরাজ দুর্য্যোধন—বলছেন যদি পাঁচ রাত্রের মধ্যে পাণ্ডবদের সংবাদ পাওয়া যায় তা’হ’লে অর্দ্ধেক রাজ্য তা দিগকে ছেড়ে দেবেন। পুত্র, বটে ত।

 দুর্য্যো। হাঁ।

 দ্রোণ। আচ্ছা, এই কথা দুই তিন বার বল।

 শকুনি। আচ্ছা, সময় হ’লে বুঝব।

 দ্রোণ। গাঙ্গেয়, শুনলে ত?

 ভীষ্ম। (স্বগত)

 যখন আচার্য্যের আনন্দ ধৈর্য্য অতিক্রম ক’রে প্রকাশিত হয়েছে তখনই বুঝেছি যিনি বঞ্চিত হ’তে যাচ্ছিলেন তিনিই দুর্য্যোধনকে এস্থলে বঞ্চনা কল্লেন। (প্রকাশ্যে) পৌত্র দুর্য্যোধন, বিরাটের সঙ্গে আমার শক্রতা আছে। ইহা তোমরা কেউ জান না। আবার বিরাট তোমার যজ্ঞ দেখতেও এলেন না। অতএর তাঁর সমস্ত গোরু নিয়ে আসা যা’ক। (স্বগত) হে সরলবুদ্ধি ব্রাহ্মণ, পাণ্ডবেরা রথের শব্দ শুনে, ধর্ষিত হ’য়ে ক্রুদ্ধ হবে। তাদের কৃতজ্ঞতা আছে | জোর ক’রে গোরু আনতে গেলেই আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।

ভটের প্রবেশ

 ভট। রথ ও বাহন সজ্জিত হয়ে বিরাটের গো-গৃহে গমন কত্তে উদ্যত হয়েছে।

 দুর্য্যো। এ সকল রথ নিয়ে গিয়ে সত্বর বিরাটের গোরুগুলি নিয়ে এস। যজ্ঞের সময় গদা শান্তি ভোগ করেছে, এখন আবার হাতে নিব।

 দ্রোণ। লোক পাঠিয়ে দাও আমার রথও নিয়ে আসুক।

 শকুনি। আমার হাতী নিয়ে এস।

 কর্ণ। যুদ্ধ-সামগ্রী ব’য়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘোড়ার রথ নিয়ে এস।

 ভীষ্ম। বিরাট-নগরে যাওয়ার জন্য আমার মন (বুদ্ধি) ব্যগ্র হয়েছে। ধনুটাও যাওয়ার জন্য ব্যগ্রতা প্রকাশ করুক।

 সকলে। আমরা সকলে আপনার আজ্ঞাকারী। আপনি এখানে থাকুন। শুধু অস্ত্রশস্ত্র আমাদের সঙ্গে যাবে|

 দ্রোণ। আমরা দু’জনে কিন্তু এই যুদ্ধে তোমার পরাক্রম দেখতে চাই।

 দুর্য্যো। আপনাদের যা অভিরুচি তাই হবে।

 দ্রোণ। বৎস গান্ধাররাজ, এই গোরু আনার কার্য্যে তোমার রথই প্রথম যাবে।

 শকুনি। বেশ ভাল কথা।

[সকলের প্রস্থান।

  1. দ্রোণঃ, পৃথিব্যর্জ্জুন-ভীম-দূতো,
    যঃ কর্ণধারঃ শকুনীশ্বরস্য।
    দুর্য্যোধনো ভীষ্মযুধিষ্ঠিরঃ স
    পায়াদ্‌ বিরাডুত্তরগোহভিমন্যুঃ॥

  2. মূলে “অমরোত্তমমুখং” পাঠ আছে। আমি ‘অমরোত্তমমুখঃ’ পাঠ ধরিয়া অনুবাদ করিয়াছি।
  3. মূলে ‘তদ্‌গুণৈঃ’ পাঠ আছে, কিন্তু ‘তদ্‌গুণঃ’ পাঠ ধরিলেই অর্থপ্রতিপত্তি সহজ হয়।
  4. “পার্শ্বে বৃষলং ন সহতে” —বৃষল শব্দ ঐতিহাসিকের পক্ষে এ স্থলে বড়ই মূল্যবান।
  5. “জ্ঞাতি জ্ঞাতিভয়াদিব” পাঠ আছে। ‘জ্ঞাতি-ভয়’ শব্দের গূঢ় অর্থ আছে—সম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব লইয়া গোলযোগ।
  6. মূলে ‘আগত কথা’ পাঠ আছে।
  7. ‘অযশো নিপীতবান’—মূলে এই বাক্যটি আছে— ইহাতে বুঝা যায় যে, তিনি যতদূর সম্ভব অযশ লাভ করেছিলেন।
  8. মূলে “অয়মক্রমঃ” এই পাঠ আছে—এটা অভিবাদনের ক্রম নহে। “অথ কঃ ক্রমঃ?”
  9. এ স্থলে পৌরাণিক কথার আভাস আছে।
  10. কিং তদ্ দ্রব্যং, কি ফলং, কো বিশেষঃ
    ক্ষত্রাচার্য্যো যত্র বিপ্রো দরিদ্রঃ।

    —এ সকলের বিচার না ক’রেই দান কত্তে হবে।

  11. প্রতিজ্ঞা স্বরূপ।
  12. “গান্ধার-বিষয়বিস্মিত! শকুনে! ত্বমনার্য্যভাবাৎ সর্ব্বলোকমনার্য্যমিতি মন্যসে?”—‘বিষয়’ শব্দটি দ্ব্যর্থক—দেশ এবং সম্পত্তি। তাৎপর্য্য এই—
     (১) তুমি গান্ধার দেশের রাজা, সুতরাং নিজকে বড় মনে ক’রে লঘু-গুরু বিচার না ক’রে মুখে যা আস্‌চে তাই বল্‌চ। (২) তুমি গান্ধার দেশের লোক সুতরাং অনার্য্য (গান্ধার দেশে তখন অনার্য্য দিগের বসতি ছিল বুঝিতে হইবে) কাজেই নিজে যেমন অনার্য্য তেমনি অন্যকেও নিজের মত অনার্য্য ভাবে পূর্ণ মনে কচ্ছ।
  13. তাৎপর্য্য, এখন তুমি পাশা খেলছ না।
  14. “মিত্র মুখস্য,” পড়িলে বিষকুম্ভ পয়োমুখ’ কথা মনে আসে।
  15. ‘ন শকুনিরাক্ষিপেৎ’—শকুনির আক্ষেপের কিছু কারণ হইত না। মরিলে তোমাদের ভাইদের মধ্যেই কেহ মরিত।
  16. “অন্যৎ প্রস্তুতমন্যদাপতিতম্”—কথা হচ্ছিল এক বিষয়ে এখন গেল অন্য বিষয়ে।
  17. “অত্র কদর্থং ন কার্য্যং”—কুৎসিৎ যাচ্ঞা করব না।
  18. ‘অনৃতবচনান্মোচয়িতব্যো ভবান ননু’ —শকুনি এক ভাবে বলিলেন, দুর্য্যোধন আর এক ভাবে বুঝিলেন।