পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৬৯

◄  ৬৮
৭০  ►
৬৯
মান্দালয় জেল
১৪।৩।২৫

পরম পূজনীয় মেজদাদা,

 কাহাকেও পত্র লেখা এখন আমার পক্ষে একটা সমস্যা হইয়া দাঁড়াইয়াছে, প্রায় একটা দুঃস্বপ্নের মত। দুঃস্বপ্ন বলিতেছি এই কারণে যে, ডেমােক্লিসের তরবারির মত মাথার উপরে সর্ব্বদাই পুলিসের সেন্সর ঝুলিতেছে, যাহার স্বেচ্ছাচারিতা ভূতপূর্ব্ব জারকেও সহজেই হার মানায়। জানি না এ পত্রও সেন্সরের দৃষ্টি এড়াইয়া আপনার নিকট পৌছিবে কিনা—তবু আমাকে লিখিতেই হইবে।

 অনেক কষ্টে এ পত্র লিখিবার জন্য তৈরী হইয়াছি। শুধু যে দুঃস্বপ্নের ভয়টাকেই জয় করিতে হইয়াছে তাহা নয়, ডিস্‌পেপসিয়া ও ফ্লু-র যুগপৎ আক্রমণে যে ভয়ানক আলস্য আমাকে পাইয়া বসিয়াছে তাহাও আমাকে কাটাইয়া উঠিতে হইয়াছে। আজ সপ্তাহের শেষ দিন এবং আমার হাতে পত্র লিখিবার আর যে সামান্য সময়টুকু অবশিষ্ট আছে তাহা নষ্ট করিতে আমার ইচ্ছা নাই।

 মিউনিসিপ্যাল গেজেটের প্রতি সংখ্যা এখন আমি পাইতেছি; কিন্তু ইহা বুঝিতে পারিতেছি না কেন কর্পোরেশনের সভার কার্য্য- বিবরণী আটক করিয়া রাখা হইতেছে। পুলিসের কর্ত্তাদের যুক্তি বড় অদ্ভুত। রেঙ্গুনের পত্রিকাগুলিতে দেখিলাম যে, আমার ছুটি আরও ৩ মাস বর্দ্ধিত করা হইয়াছে।

 *  *  *

 যে সব ভাউচার, রসিদ ইত্যাদির কথা উল্লেখ করিয়াছেন, অনুগ্রহ করিয়া উহা রাখিয়া দিতে ভুলিবেন না। কেননা কারামুক্তির পর আমি এ বিষয়ে লড়িতে চাই। চরম দুঃসময়েরও একটা শেষ আছে; অতএব লড়িতে একদিন পারিবই। ইহা আমার বিশ্বাস যে, আমি ভাতা পাইবার অধিকারী এবং এ ব্যাপারে আমার যুক্তিও দুর্ব্বল নয়।

 আপনি জানিতে চাহিয়াছেন যে, Regulation III-র পরিবর্ত্তে অর্ডিন্যান্স জারীর ফলে এখানে আমার প্রতি অন্য কোনও রকম ব্যবহার করা হইতেছে কিনা। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি অসমর্থ কারণ আমি অনুভব করিতে পারিতেছি যে, দুঃস্বপ্নটা আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সঞ্চালিত হইয়া আঙ্গুলগুলিকে পর্য্যন্ত অবশ করিয়া ফেলিতেছে। দৈহিক কষ্ট, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে কোনও প্রশ্নের উত্তরও ঐ একই কারণে আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। জানি না পুলিসের সেন্সর আমাকে একথা বলিতে দিবেন কিনা যে, এখানে আমাদের বইপত্র কিছু দেওয়া হয় না এবং মানসিক ক্ষুধা নিবৃত্তির কোনও উপায়ও আমাদের নাই। গভর্ণমেণ্টের নিকট হইতে এ পর্য্যন্ত একখানি বইও আমি পাই নাই। বন্দীদের প্রতি যেরূপ ব্যবহার করা হইয়া থাকে উহা তাহাদের মর্য্যাদার অনুরূপই বটে!

 অনুগ্রহ করিয়া রামিয়াকে বলিবেন যে কর্পোরেশনের ছুটি, পেন্সন ও প্রভিডেণ্ট ফাণ্ড সংক্রান্ত নিয়মাবলী যেন তিনি আমাকে পাঠান। বিদ্যাধরী সমস্যার বিষয়ে জ্ঞান লাভ করিবার জন্য কর্পোরেশনের অফিসের জন্য আমি দুই তিনখানা বই কিনিয়াছিলাম। বাঙ্গলা দেশের নদনদীর উপরে লেখা Adams Williams-এরও একখানা বই আছে যাহা আমার পড়িবার ইচ্ছা আছে।

 *  *  *

 বাঙ্গলা দেশে আমাকে বদলি করিবার জন্য বাঙ্গলা গভর্ণমেণ্টের নিকট আবেদন করিব স্থির করিয়াছি; কারণ এ জায়গাটা আমার ঠিক সহ্য হইতেছে না। এখানে আসিবার পর হইতে ডিস্‌পেপসিয়া আমার নিত্য সঙ্গী হইয়া উঠিয়াছে এবং সর্দ্দিকাশিও লাগিয়াই আছে। সর্দ্দিকাশি না বলিয়া বরং স্থানীয় ভাষায় বলা যায় ফ্লু, তবে পার্থক্য এই যে, ইহাতে জ্বর খুব বেশী হয় না। কিন্তু সাধারণতঃ ফ্লু যেরূপ কষ্ট দিয়া থাকে এখানকার ফ্লু-ও ঠিক তাহাই।

 বাবু জিতেন্দ্রিয় বসু একদা তাঁহার সাধের কাশীপুরের বর্ণনা দিতে গিয়া বলিয়াছিলেন যে, ইহা নাকি “ধূলার রাজ্য।” আমি নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি তিনি সত্যিকারের ধূলার রাজ্য এখনও দেখেন নাই, আর সেটা হইল মান্দালয়। জনৈক কবি একবার বলিয়াছিলেন যে, মৃত্যুর কাছে বছরের সব ঋতুই সমান; মান্দালয়ের ধূলাও তেমনি বছরের ১২ মাসই দেখা যায়। কারণ পৃথিবীর এ প্রান্তে বর্ষা ঋতু বলিয়া কিছু নাই। মান্দালয়ে বাতাসে ধূলা উড়িয়া বেড়ায়; ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে উহা শরীরে প্রবেশ করে। খাদ্যের সঙ্গেও উহা গ্রহণ করিতে হয়। টেবিলে, চেয়ারে, বিছানায় সর্ব্বত্র ধূলার কোমল স্পর্শ অনুভব করা যায়। মাঝে মাঝে ধূলার ঝড়ও উঠে, তখন দূরের গাছপালা আর পাহাড় ঢাকা পড়িয়া যায়; অতএব ইহার সকল সৌন্দর্য্য না দেখিয়া কোনও উপায় নাই। বাস্তবিক মান্দালয়ের চারিদিকেই ধূলা ছড়াইয়া আছে—সর্ব্বত্র ইহা ব্যাপ্ত অতএব এক অর্থে ইহাকে দ্বিতীয় বিধাতাও বলা যায়। ঈশ্বর আমাদিগকে এই নূতন বিধাতার হাত হইতে রক্ষা করুন!

 কোনও কোনও দার্শনিক মনে করেন যে, আমাদের এই ক্ষুদ্র গ্রহটি মানুষের আনন্দোপভোগের জন্যই সৃষ্ট হইয়াছে। এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ যে, পৃথিবীর আর সকল দেশ অপেক্ষা বর্মা দেশেই তাঁহারা তাঁহাদের অনুগামীদের অধিক সংখ্যায় দেখিতে পাইবেন। যদি এই জগৎ—বিশেষতঃ প্রাণিজগৎ মানুষের জন্যই সৃষ্ট হইয়া থাকে তাহা হইলে অখাদ্য বলিয়া কিছু এখানে থাকিতে পারে না; এবং আপনি জানিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইবেন যে, বর্মী বিধানে অখাদ্য মাংস বলিয়া কিছু নাই। কাক, বিড়াল, কুকুর—এমন কি সাপ পর্য্যন্ত সাদরে রান্নাঘরে গৃহীত হইয়া থাকে এবং ঐ সকল প্রাণী মানুষের পেটে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করে। এদেশে খাদ্যের ব্যাপারে কোনও পক্ষপাতিত্ব চলে না; এমন কি কীটপতঙ্গাদিও বলিতে পারে না যে এ ব্যাপারে তাহারা উপেক্ষিত।

 এখানকার জলহাওয়া আমাকে ক্রমেই যেন দুর্ব্বল করিয়া ফেলিতেছে। গাঁটে গাঁটে খিল ধরিয়া যাওয়াটা একটা সাধারণ ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। যে বর্মীরা অনেক বিষয়েই একটী আশ্চর্য্য সভ্যতা গড়িয়া তুলিয়াছে, তাহারা এই রোগের প্রতিকারের জন্য ম্যাসাজ্ও আবিষ্কার করিয়াছে যাহা আশ্চর্য্য ফলদায়ক।

 ভয় হইতেছে বোধহয় আমার পত্র দীর্ঘ হইয়া যাইতেছে; অতএব আজ এখানেই শেষ করি।

 * * *

ইতি— 

আপনার স্নেহের 
সুভাষ 

(এস. সি. বোস) 

(ইংরাজী হইতে অনূদিত)