পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৭৩
(দিলীপকুমার রায়কে লিখিত)
প্রিয় দিলীপ,
আমার শেষ চিঠির পরে তোমার কাছ থেকে সর্ব্বসমেত তিনখানি চিঠি পেয়েছি। চিঠিগুলির তারিখ—৫ই মে, ১৫ই মে ও ১৫ই জুন।
তোমার প্রেরিত বইয়ের শেষ পার্শ্বেলটা পেয়েছি। টুর্গেনিভের ‘Smoke’ বইটা পাইনি। আফিসে পার্শ্বেলটী খোলা হয়েছিল, সুতরাং সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেছি। দরকার হলে কলকাতায় C. I. D. আফিসে তিনি খোঁজ করবেন, তুমিও D. I. G. C. I. D.-কে লিখে এ-বিষয়ে তাঁদের মনোেযোগ আকর্ষণ করতে পার।
Bertrand Russell-এর “Prospects of Industrial civilisation” খানি বহরমপুর জেলে কয়েকজন কয়েদীর কাছে আছে। আমাদের যখন স্থানান্তরিত করা হয়, তখন অনেকেই সেই বইখানি কাছে রাখবার আগ্রহ প্রকাশ করেন, আর বাস্তবিক একজন তখনও বইটা পড়ছিল। বইখানা তোমার দরকার হবে সে কথা না জেনে সেখানে রেখে এসেছিলাম। রাসেলের বইগুলির আদর এত বেশী যে, একখানা পেলে কেউ শীঘ্র ছাড়তে চায় না। বহরমপুর জেলের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকে আজ লিখিলাম তিনি যেন তোমার কাছে বইখানা পাঠিয়ে দেন। তুমি তাঁকে লিখতে পার, তাতে কাজটা তাগাদা হবে। তোমার এত দরকারের সময় বইটা আটকে রাখবার জন্য দায়ী বলে বিশেষ দুঃখিত, কিন্তু তুমি বুঝতে পারছ এত অসুবিধার কথা আগে আমি ভেবে উঠতে পারিনি। “free thought and official propaganda” ত আমার কাছে নেই —এ বইটা তুমি আমাকে পাঠাও নি?
বই বেছে দেওয়ার জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমরা সকলে আশা করি, তুমি যে কাজ আরম্ভ করেছ ভগবানের ইচ্ছায় তা ভালভাবেই চলবে। তোমার লেখাগুলি যে আমি সসম্মানে পাঠ করব সে কথা বিশেষ করে বলবার বোধ হয় প্রয়োজন নেই। বই প্রকাশ করবার সময় প্রচ্ছদপটের দিকে যেন নজর রেখো। এইমাত্র একখানা হালের “বঙ্গবাণী”তে রবীন্দ্রনাথের উপর তোমার লেখা একটা প্রবন্ধ দেখলাম, আমি এখনও সেটা পড়িনি কিন্তু বিষয়টা চিত্তাকর্ষক বলেই বোধ হল।
তুমি জান আজকের দিনে কিসে আমার মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে আমার বিশ্বাস আমাদের সকলেরই একই চিন্তা—সে হচ্ছে মহাত্মা দেশবন্ধুর দেহত্যাগ। কাগজে যখন এই দারুণ সংবাদ দেখি তখন এ দুটো চোখকে বিশ্বাস করতে পারি নি, কিন্তু হায়! সংবাদটা নিতান্তই নির্ম্মম সত্য। আমরা সমগ্র জাতিটাই যেন নিতান্ত হতভাগ্য বলে মনে হচ্ছে।
যে সব চিন্তা আমার অন্তরকে তোলপাড় করছে সে সব চিন্তাগুলি বাইরে প্রকাশ করে মনকে লাঘব করতে চাইলেও আমায় কষ্টের সহিত সংযত হ’তে হবে। যে সব চিন্তা আজ মনে উদয় হচ্ছে সেগুলি এত পবিত্র, এত মূল্যবান যে অচেনা লোকদের কাছে তা প্রকাশ করা যায় না—censor-দের ত অচেনা অজানা মনে না করে পারি না। আমি শুধু এই কথাটা বলতে চাই যে সমগ্র দেশের ক্ষতি যদি অপূরণীয়ই হয়ে থাকে, বাঙ্গালার যুবকদের পক্ষে এ একটা সব চেয়ে বড় সর্ব্বনাশ—সত্যই এটা আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।
আজকের দিনে এত বিচলিত ও শোকাচ্ছন্ন হয়েছি এবং সেই সঙ্গে মনোজগতে সেই স্বর্গীয় মহাত্মার এত কাছাকাছি নিজেকে অনুভব করছি যে, তাঁর গুণাবলী বিশ্লেষণ করে তাঁর সম্বন্ধে কিছু লেখা মোটেই সম্ভব নয়। আমি তাঁর অত্যন্ত কাছে থেকে নিতান্ত অসতর্ক মুহূর্ত্তগুলিতে তাঁর যে ছবি দেখেছিলাম সময় এলে জগতের সামনে তার কথঞ্চিৎ আভাস দিতে পারব আশা করি। তাঁর সম্বন্ধে আমার মত যাঁরা অনেক কথাই জানেন, তাঁরা পারলেও আজ কিছু বলতে সাহস করছেন না, আশঙ্কা হয়, তাঁর মহত্ত্বের সম্পূর্ণ পরিচয় দিতে না পেরে পাছে তাঁকে ছোট করে ফেলেন।
তুমি যখন ফলতঃ এই কথাটাই বল যে, দুঃখ কষ্ট নয়, তখন আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। জীবনে অবশ্য এমন সমস্ত ট্রাজেডি আছে—এই যেমন এখন একটা আমাদের উপর এসে পড়েছে—সেগুলিকে আমি সানন্দে বরণ করে নিতে পারি না। আমি এত বড় তত্ত্বজ্ঞানী বা এতবড় ভণ্ড নই যে, বলব আমি সকল প্রকার দুঃখ-কষ্টই আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে বরণ করে নিতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও ভেবে দেখতে হয় যে, কতকগুলি এমন হতভাগ্যও আছে—হয়ত তারা সত্য সত্যই ভাগ্যবান—যারা সকল রকম দুঃখ কষ্ট ভোগ করবার জন্যই যেন নির্দ্দিষ্ট আছে। বেশী কম যাই হোক, যদি কাউকে পাত্রভরে দুঃখ পান করতে হয় তাহলে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলিয়ে দিয়ে পান করা ভাল। এমনি একটা আত্মনিবেদন বা আত্মসমর্পণের ভাব চীনের প্রাচীরের মত অদৃষ্টের সমস্ত আঘাত একেবারে ব্যর্থ ক’রে দিতে নাও পারে। কিন্তু এতে নিশ্চয়ই আমাদের স্বাভাবিক সহিষ্ণুতার শক্তি অনেকখানি বাড়িয়ে তোলে। Bertrand Russell যখন বলছেন যে, জীবনে এমন সমস্ত ট্রাজেডি আছে যার হাত থেকে মানুষ নিষ্কৃতিই পেতে চায়, তখন ত তিনি খাঁটী সংসারী লোকের অভিমতই প্রকাশ করেছেন এবং আমার বিশ্বাস যে কেবল নিষ্কলঙ্ক সাধু ব্যক্তি অথবা সাধুত্বের ভাণ করে যে ভণ্ড, সে-ই এ কথার প্রতিবাদ করবে।
যারা ভাবুক বা তত্ত্বজ্ঞানী নয় তাদের যন্ত্রণাটা সম্পূর্ণ নিরবচ্ছিন্ন মনে করাটা হয়ত তোমার ঠিক হচ্ছে না। তত্ত্বজ্ঞানহীনদের (abstract point of view থেকে আমি তাদের তত্ত্বজ্ঞানহীনই বলি) নিজেদেরও একটা idealism আছে। তারা যাকে পূজার সামগ্রী মনে করে শ্রদ্ধা করে ও ভালবাসে নানা প্রকার দুঃখ যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ করবার সময় সেই ভালবাসার উৎস হতেই তারা সাহস ও ভরসা পায়। এখানে আমার সঙ্গে যারা কারাযন্ত্রণা ভোগ করছে, তাদের মধ্যে এমন অনেক আছে যারা ভাবুক বা দার্শনিক নয়, তবুও তারা শান্তভাবে যন্ত্রণা ভোগ করে এবং বীরের মত সহ্য করে। Technical অর্থে তারা দার্শনিক না হতে পারে, কিন্তু তাদের আমি সম্পূর্ণরূপে ভাব-বিবর্জ্জিত মনে করতে পারি না। সম্ভবতঃ জগতের সর্ব্বত্র যারা কর্ম্মী তাদের সম্বন্ধে সাধারণতঃ একথা খাটে।
সাধারণের মনে একটা ধারণা আছে যে, অপরাধীদের যখন ফাঁসিকাঠে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাদের একটা স্নায়বিক দৌর্ব্বল্য আসে এবং যারা কোন মহৎ উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য প্রাণ দেয় তারাই বীরের মত মরতে পারে। এ ধারণাটা ঠিক নয়। এ সম্বন্ধে আমি কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ অপরাধীরা সাহসের সহিত প্রাণ দেয়, এবং ফাঁসির দড়ি তাদের গলায় বসাবার আগে ভগবানের পায়েই আত্মনিবেদন করে। একেবারে ভেঙ্গে মুষড়ে পড়তে বড় একটা দেখা যায় না। একবার এক কারাধ্যক্ষ আমাকে বলেছিলেন যে একজন ফাঁসির কয়েদী তাঁর কাছে স্বীকার করেছিল যে, সে একজনকে হত্যা করেছিল। সে তার কাজের জন্যে অনুতপ্ত কি না জিজ্ঞাসা করায় সে বলেছিল যে, তার মোটেই অনুতাপ হয়নি, কারণ হত ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার ন্যায্য অনুযোগ ছিল। তারপর সে বীরদর্পে ফাঁসিকাঠে উঠেছিল এবং প্রাণ দিয়েছিল, কিন্তু একটি পেশীর সঙ্কোচনও তার বুঝতে পারা যায়নি।
অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব আলোচনা করে আমার চোখ ফুটে গেছে। আমার মনে হয়, মোটের উপর তাদের প্রতি যথেষ্ট অবিচার করা হয়। সেবারে অর্থাৎ ১৯২২ সালে যখন আমি জেলে ছিলাম, তখন একটা কয়েদী আমাদের yard-এ ভৃত্যের কাজ করত। সে সময়ে আমি মহাপ্রাণ দেশবন্ধুর সহিত এক কারাপ্রাঙ্গণে একই ঘরে বাস করতাম। দেশবন্ধুর প্রাণটা ছিল খুবই কোমল, তাই সহজেই এই কয়েদীর দিকে তিনি কেমন আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। সে একটা পুরানো পাপী, আটবার তার সাজা হয়। কিন্তু সেও কেমন নিজের অজ্ঞাতসারেই দেশবন্ধুর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে এবং আশ্চর্য্য রকমের শক্তির পরিচয় দেয়। কারামুক্তির সময় দেশবন্ধু তাকে বলেছিলেন যে, জেল থেকে মুক্তি পেলে সে যেন বরাবর তাঁর কাছে যায় আর তার পুরানো সহকারীদের ছায়া না মাড়ায়। কয়েদীটি রাজী হয়েছিল ও কথামত কাজও করেছিল। তুমি শুনলে আশ্চর্য্য হবে যে, যে ব্যক্তি এক সময়ে পুরানো দাগী ছিল, সে এখন উপরোক্ত ঘটনার পর থেকে তাঁর বাড়ীতে বাস করছে এবং মাঝে মাঝে অভদ্র মেজাজ তার দেখা দিলেও সে যে এখন শুধু অন্য মানুষ তাহা নয়, অধিকন্তু বেশ সরল ভাবেই জীবন কাটাচ্ছে এবং আজ, এই ক্ষতি যাদের সবচেয়ে বেশী বেজেছে তাদের মধ্যে সেও একজন। অনেকে বলেন যে, মানুষের জীবনের ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ ঘটনা দিয়ে তার মহত্ত্বের বিচার করা উচিত—একথা যদি সত্য হয় তবে তাঁর দেশের কাজের দিকটা বাদ দিলেও স্বর্গীয় দেশবন্ধু একজন মহাপুরুষ ছিলেন।
আমি আমার আসল বক্তব্য থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছি, এবং এখন আমার থামা উচিত। তােমার চিঠির জবাব লেখা এখনও শেষ করতে পারলাম না, কিন্তু আজকের ডাক ধরতে গেলে আমাকে এইখানেই শেষ করতে হয়। আমি জানি তুমি আমার খবর পাবার জন্যে উদ্বিগ্ন থাকবে, সুতরাং আজকের ডাক ধরতেই হবে। পরের পত্রে আরও খবর লিখব।
(ইংরাজী হইতে অনূদিত)