পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৮৪

◄  ৮৩
৮৫  ►
৮৪

দিলীপকুমার রায়কে লিখিত

কেয়ার অব ডি আই জি,

আই বি, সি আই ডি, বেঙ্গল
১৩, এলিসিয়াম রো

কলিকাতা
মান্দালয় জেল
১১. ৯. ২৫

প্রিয়বরেষু,

 দিলীপ,

 আমার পূর্ব্বেকার পত্র শেষ হয়নি। পরের সপ্তাহে তোমাকে আর একটি পত্র পাঠাব ভেবে রেখেছিলাম কিন্তু ইতিমধ্যে যে দারুণ বিপদ ঘটে গেল তা আমাদের সকলকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছে। হয়তো আমার মত সকলেই আজ একটা অনিশ্চিত অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে তবু ব্যক্তিগতভাবে এ ক্ষতি আমার পক্ষে অপূরণীয়; তাছাড়া এই বিপদের দিনে আমি জেলে পড়ে আছি—এই চিন্তা আমার মনকে আরও বেশী শোকাচ্ছন্ন করে তুলেছে।

 কালের আবর্ত্তনে ব্যক্তিগত ক্ষতির প্রশ্নটা হয়তো মুছে যাবে কিন্তু দেশের যে ক্ষতি হল তা তাঁর দেশবাসী যতই দিন যাবে মর্ম্মে মর্ম্মে উপলব্ধি করতে থাকবে। বাস্তবিক তাঁর প্রতিভা ও কর্ম্মধারা এমনই বহুবিস্তৃত ছিল যে সর্ব্বশ্রেণীর মানুষ এই নিদারুণ আঘাতে বিচলিত বোধ করেছে। কখনও কখনও আমি তাঁর সমালোচনা করে বলেছি যে, অনেক কাজের মধ্যে কেন তিনি নিজেকে এভাবে জড়িয়ে ফেলছেন। কিন্তু সৃজনশীল প্রতিভার বৈশিষ্ট্যই এই যে, কোনও যুক্তিতর্কের সীমার বন্ধনে তা আবদ্ধ হতে চায় না। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় অখণ্ড জীবনের উপলব্ধি ছিল বলেই তিনি জাতীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে পুনর্গঠনের প্রেরণা লাভ করেছিলেন।

 তোমাদের অন্ততঃ একটা সুযোগ ছিল তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবার; এবং তাঁর স্মৃতিরক্ষার কর্ম্ম প্রয়াসের মধ্যেও কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে নিতে পার। কিন্তু এই বিপদের দিনে সুদূর মান্দালয়ে কারাবাসের মুহূর্ত্তগুলিতে এই দুঃসংবাদ আমাদের কয়েকজনকে এমনই আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে আমরা নিতান্ত অসহায় বোধ করছি—বোধহয় ঈশ্বরের ইচ্ছাই এরূপ। তবু আমি অতি মাত্রায় আশাবাদী বলে নিজেকে কিছুটা সংযত রাখতে পেরেছি। মনের গভীরে যখন অসংখ্য চিন্তা তোলপাড় করতে থাকে তখন তাকে ভাষায় প্রকাশ করা সহজসাধ্য নয়; তাই এ প্রসঙ্গ ত্যাগ করে এখন অন্য প্রসঙ্গ শুরু করছি।

 তোমার বই প্রকাশ হতে আর কত দেরি? এখনও কি প্রেসেই আছে? কবে নাগাদ বেরোবে আশা করছ? ভারতীয় সঙ্গীতে পুনরায় প্রাণ সঞ্চার ও তার প্রচারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ইংরাজীতে (অন্য প্রদেশের লোকদের সুবিধা হয় তাহলে) কেন বই লেখ না একটা?

 কিছুদিন পূর্ব্বে রুদ্রকে তার শোকে সমবেদনা জানিয়ে এক পত্র দিয়েছিলাম। তার কোনও উত্তর পাইনি। তুমি কোনও পত্র পেয়েছ কি?

 তোমার মহান্ পিতার রচনাবলীর একটা সম্পূর্ণ সেট পাঠাতে পারবে কি? আমরা আবার ঐ বইগুলো পড়ে ফেলতে চাই। যদি সম্ভব হয় তাহলে এখানকার জেলের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টের নামে তা সরাসরি পাঠাতে পার। ঐ বইগুলোর কথা লিখে সঙ্গে একখানি পত্রও (বইগুলোর নাম সহ) পাঠাবে। আমাদের সব পত্র কলিকাতার অফিসে পরীক্ষা করে দেখা হয় কিন্তু এখানকার জেলের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট বইগুলো পরীক্ষা করে দেখেন। সুতরাং বই-টই সব তার নামে পাঠানোই ভাল, এতে অনেকখানি সময় বেঁচে যাবে। ভাল কথা, টুর্গেনিভের ‘Smoke' বইটি পাওয়া গিয়েছে কি? কলিকাতার সি আই ডি বিভাগ আমাকে জানিয়েছে যে, এরকম কোনও বই তাদের কাছে পাঠানো হয়নি। বইটি সত্যই হারিয়ে গিয়ে থাকলে দুঃখের ব্যাপার হবে।

 যদিও এখানকার আবহাওয়া আমাকে খুশী করতে পারেনি তবু অনেকটা যেন আরাম বোধ হচ্ছে। যে সব জটিল প্রশ্নের উত্তর এতদিন খুঁজে পাইনি সেগুলোরও সমাধানের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আমাদের জীবনের নানা সমস্যার সমাধানের জন্য যে নিরাসক্ত মনোভাব গড়ে তোলা প্রয়োজন, এই নির্জ্জনতা ও প্রবাসজীবনের ফলে তা আমি পেয়েছি, এজন্য কৃতজ্ঞ বোধ না করে পারছি না। যদি আমার শরীর সুস্থ থাকত তাহলে যে নির্ব্বাসন আমাকে বাধ্য হয়ে ভোগ করতে হচ্ছে তার দ্বারা আরও অনেক কিছু লাভ হত। তবে যে রকম বোঝা যাচ্ছে তাতে মনে হয় আমাকে দীর্ঘকাল এখন এখানেই থাকতে হবে।

 নানা দিক থেকে বর্ম্মা এক আশ্চর্য্য দেশ; এবং এখানকার জীবন ও সংস্কৃতি পর্য্যালোচনার ফলে অনেক নূতন অভিজ্ঞতাও লাভ করেছি। কিছু কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি এদের আছে—তবু আমার মনে হয় বর্ম্মীরা চীনাদের মতই সামাজিক দিক থেকে অনেক অগ্রসর। তবে যেটা এদের একান্ত অভাব তা হল কর্ম্মশক্তির প্রেরণা, Bergson যাকে বলতেন ‘elan vital'—অর্থাৎ সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে প্রগতির পথে ছুটে চলার যে প্রচণ্ড আবেগ তা এদের নেই। এখানকার সমাজে গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে, শুধু তাই নয় ইউরোপের যে কোনও দেশ অপেক্ষা এখানে স্ত্রীস্বাধীনতাও অনেক বেশী। কিন্তু হায়! প্রকৃতির বৈচিত্র্যহীনতাই বোধ হয় সব উৎসাহ কেড়ে নিয়েছে এদের। সুদূর অতীত কাল থেকে বিরলবসতি এই দেশে প্রচুর শস্য জন্মানোর ফলে এদের জীবনযাত্রা সহজ হয়ে পড়েছিল, যার অবশ্যম্ভাবী ফল দেহ ও মনের দিক থেকে এরা সবাই অলস হয়ে উঠেছে। এ সম্বন্ধে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে, যদি এরা কোনও দিন কর্ম্মশক্তির প্রেরণা খুঁজে পায় তাহলে সমৃদ্ধির পথে এরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবে।

 তুমি বোধহয় জান বর্ম্মাতে স্ত্রী ও পুরুষ মিলিয়ে শিক্ষিতের শতকরা হার ভারতবর্ষের যে কোনও প্রদেশের চেয়ে অনেক বেশী। ধর্ম্মীয় সেবা-প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় প্রথায় আশ্চর্য্য অল্প খরচে যে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে তার ফলেই সম্ভব হয়েছে এটা। বর্ম্মাতে আজও প্রত্যেক ছেলেকে কয়েক বছর না হলেও অন্ততঃ কয়েক মাস ব্রহ্মচর্য্য পালন করে গুরুর কাছে পাঠ নিতে হয়। এ প্রথার শুধু যে একটা শিক্ষাগত ও নৈতিক মূল্য আছে তা নয়, এর আর একটা দিকও আছে—ধনীদরিদ্রনির্ব্বিশেষে সবাই একসঙ্গে মানুষ হবার সুযোগ পায়। সারা দেশ জুড়েই এই অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা চালু আছে।

 তোমার পূর্ব্বেকার পত্রে তুমি এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলে যে, যারা দার্শনিক নয় তারা কারাজীবনের মধ্যে শুধু যন্ত্রণাই খুঁজে পায়। এটা পুরোপুরি সত্য নয়। এমন অনেক লোক আছে যারা দার্শনিক নয় কিন্তু কোনও না কোনও আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত। গত মহাযুদ্ধের সময় বহু লোক দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নানা প্রকার দুঃখ-লাঞ্ছনা ভোগ করেছে, তারা কেউ দার্শনিক ছিল না। যতক্ষণ আদর্শের প্রেরণা থাকে, আমার বিশ্বাস যেকোনও লোক সেরকম সাহস অবলম্বন করে আনন্দের সঙ্গে দুঃখকে বরণ করে নিতে পারে। একথাও ঠিক যে, দার্শনিকের পক্ষে এ সব দুঃখ-যন্ত্রণার দ্বারা আত্মিক উন্নতি ঘটানো সম্ভব; এবং একে মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের কাজেও লাগাতে পারে সে। সুতরাং একথা কি ঠিক নয় যে, আমাদের মধ্যে দার্শনিকতার বোধ এখনও জন্মায়নি, আর সে বোধকে জাগ্রত করতে হলে এই যন্ত্রণানুভূতির প্রয়োজন আছে?

 আজ এখানেই শেষ করছি। আশা করি শীঘ্রই তুমি আমার পত্রের উত্তর দেবে। প্রীতি ও শুভেচ্ছা নেবে। বন্ধুবান্ধবদেরও আমার প্রীতি-সম্ভাষণ জানাবে।

ইতি—
তোমার চিরসুহৃদ
সুভাষ
শ্রীযুক্ত ডি. কে. রায়

৩৪ থিয়েটার রোড

কলিকাতা

(ইংরাজী হইতে অনূদিত)