পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৯৩
শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবীকে লিখিত
শ্রীচরণেষু—
মা, অনেকদিন যাবৎ আপনার কোনও খবর পাই নাই। ২।৩ দিন পূর্ব্বে মেজদাদার পত্রে আপনার খবর পেলুম। অনেকদিন থেকে আপনাকে পত্র দিবার ইচ্ছা হচ্ছে—উত্তর পাবার জন্য নয়—যদিও উত্তর পেলে যার পর নাই সুখী হব। পত্রটা লিখলে হয়তাে মনটা হাল্কা হবে—এই জন্য। কিছুদিন পূর্ব্বে আপনার খবর পাবার জন্য মিঃ হালদারকে পত্র দিই। তিনি উত্তর দেন কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, সে পত্র পুলিশ কর্ত্তৃক আটক হয়। জানি না আপনার খবর পাবার জন্য আমার মন কেন উতলা হয়।
মধ্যে আমার ইচ্ছা হয়েছিল সরকারের নিকট একটা দরখাস্ত দিই আপনার সহিত একবার দেখা করার অনুমতির জন্য। রাজবন্দীদের মধ্যে আত্মীয়স্বজনদের সহিত দেখা করতে দেওয়া হয়—এমন কি ৫।৭ দিন পর্য্যন্ত বাড়ীতে থেকে আসতে দিয়েছে আমি জানি। কিন্তু ভেবে দেখলুম দরখাস্ত করে কোনও লাভ নাই, কারণ সে সৌভাগ্য আমার ভাগ্যে ঘটবে বলে ভরসা হয় না। প্রার্থনা করাই সার হবে—আর লাভের মধ্যে মনকে আরও উদ্বিগ্ন করা হবে এবং বর্ত্তমান অবস্থার বিরুদ্ধে একটা অর্থহীন আপত্তি করা হবে। তাই অনেক চিন্তার পর দরখাস্ত করার প্রস্তাব মন থেকে দূর করেছি।
আপনার শরীর অত্যন্ত দুর্ব্বল এবং স্বাস্থ্য খুব খারাপ শুনে খুব চিন্তিত হয়েছি। কি করি আমরা এত নিঃসহায় যে কিছুই করিতে পারি না। আমাদের কপালে যে কি আছে তাহাও জানি না। কত কথা বলতে ইচ্ছা করে—কত কথা বলবার আছে— কিন্তু বলবার সময় এখনও আসে নাই। এ পত্রও অনেক দ্বিধার পর লিখতে বসেছি—কারণ এ পত্র অন্যের হাত দিয়ে যাবে।
খবর-কাগজে কংগ্রেসের নিকট আপনার বাণী পাঠ করলুম। ঐ করুণামাখা Pathos-পরিপূর্ণ কথাগুলি আমার হৃদয়তন্ত্রীকে কি ভাবে আঘাত করেছে তা বলতে পারি না। নিজের পর্ব্বতপ্রমাণ বিপদ ও দুঃখরাশি পায়ে ঠেলে যিনি পরের জন্য কাঁদেন তার প্রতি লোকে কৃতজ্ঞ না হয়ে পারে না। অপর কেহ যদি ঐ বাণী পাঠাতেন তা হলেও আমি কৃতজ্ঞ হতুম এবং কৃতজ্ঞতা জানাতুম—কিন্তু এক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রয়োজন নাই, কারণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মত সম্বন্ধ এ নয়। এত বড় হৃদয়ের পরিচয় না পেলে আপনার দেশবাসী আপনাকে “মা” বলে সম্বোধন করবে কেন? যাঁকে মা বলা হয়, তাঁহাকে কি কৃতজ্ঞতা জানান যায়? মার প্রাণ যদি সন্তানের জন্য না কাঁদে, তবে কার প্রাণ কাঁদবে? কৃতজ্ঞতা জানালে কি মাতা-সন্তানের পবিত্র সম্বন্ধক অপমান করা হয় না? আশা করি আপনার সকল শোক ও বিপদের মধ্যে আপনি ভুলবেন না বাঙ্গলার কত সন্তান আপনাকে “মা” বলে থাকে। হয়তো এ কথা মনে পড়লে আপনি কিছু সান্ত্বনা পেতে পারেন। তারা নিঃস্ব ও নিঃসহায় হলেও, আপনার বিপদকে তারা নিজেদের বিপদ বলে মনে করে নিয়েছে।
আজ আপনার ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা আপনার দেশবাসীকে—— আমাদের সকলকে—ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা দিচ্ছে। আপনি যদি এত সহিতে পারেন, আমরা কি তার কিয়দংশও সইতে পারব না? আশীর্ব্বাদ করুন— যত বড় বিপদ আসুক না কেন—যেন সঙ্গে সঙ্গে সহ্য করবার শক্তিও আসে। ভগবানের কৃপায় আজ পর্য্যন্ত এই শক্তি পেয়ে আসছি—চিরকাল যেন এই শক্তি পাই, এর চেয়ে বড় প্রার্থনা আমার জীবনে আর নাই। আজ তবে আসি মা।
আর কি লিখিব? কি লিখিতে কি লিখেছি জানি না।
আপনার সেবক
Patna