পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৯৪
পরবর্ত্তী তিনখানি পত্র শ্রীহরিচরণ বাগচীকে লিখিত
তুমি যাহা লিখিয়াছ তাহা সত্য—খাটি কর্ম্মীর অভাব বড় বেশী তবে যেরূপ উপাদান যােগাড় হয় তাহা লইয়াই কাজ করিতে হইবে। জীবন না দিলে যেমন জীবন পাওয়া যায় না—ভালবাসা না দিলে যেমন প্রতিদানে ভালবাসা পাওয়া যায় না—তেমনি নিজে মানুষ না হইলে মানুষ তৈয়ারী করাও যায় না।
রাজনীতির স্রোত ক্রমশঃ যেরূপ পঙ্কিল হইয়া আসিতেছে, তাহাতে মনে হয় যে, অন্ততঃ কিছু কালের জন্য রাজনীতির ভিতর দিয়া দেশের কোনও বিশেষ উপকার হইবে না। সত্য ও ত্যাগ—এই দুইটি আদর্শ রাজনীতির ক্ষেত্রে যতই লোপ পাইতে থাকে, রাজনীতির কার্য্যকারিতা ততই হ্রাস পাইতে থাকে। রাজনীতির আন্দোলন নদীর স্রোতের মত কখনও স্বচ্ছ কখনও পঙ্কিল; সব দেশে এইরূপ ঘটিয়া থাকে। রাজনীতির অবস্থা এখন বাঙ্গলা দেশে যাহাই হউক না কেন, তোমরা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া সেবার কাজ করিয়া যাও।
* * *
তোমার মনের বর্ত্তমান অশান্তিপূর্ণ অবস্থার কারণ কি তাহা তুমি বুঝিতে পারিয়াছ কিনা জানি না—আমি কিন্তু বুঝিতে পারিয়াছি। শুধু কাজের দ্বারা মানুষের আত্মবিকাশ সম্ভবপর নয়। বাহ্য কাজের সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া ও ধ্যান-ধারণার প্রয়োজন। কাজের মধ্য দিয়া যেমন বাহিরের উচ্ছৃঙ্খলতা নষ্ট হইয়া যায় এবং মানুষ সংযত হয়, লেখাপড়া ও ধ্যান-ধারণার দ্বারা সেরূপ internal discipline অর্থাৎ ভিতরের সংযম প্রতিষ্ঠিত হয়। ভিতরে সংযম না হইলে বাহিরের সংযম স্থায়ী হয় না। আর একটি কথা, নিয়মিত ব্যায়াম করিলে শরীরের যেরূপ উন্নতি হয়— তেমনি নিয়মিত সাধনা করিলেও সদ্বৃত্তির অনুশীলন ও রিপুর ধ্বংস হইয়া থাকে। সাধনার উদ্দেশ্য দুইটি:—(১) রিপুর ধ্বংস, প্রধানতঃ কাম, ভয় ও স্বার্থপরতা জয় করা, (২) ভালবাসা, ভক্তি, ত্যাগ, বুদ্ধি প্রভৃতি গুণের বিকাশ সাধন করা।
কামজয়ের প্রধান উপায় সকল স্ত্রীলোকের মধ্যে মাতৃরূপ দেখা ও মাতৃভাব আরোপ করা এবং স্ত্রী-মূর্ত্তিতে (যেমন দুর্গা, কালী) ভগবানের চিন্তা করা! স্ত্রী-মূর্ত্তিতে ভগবানের বা গুরুর চিন্তা করিলে মানুষ ক্রমশঃ সকল স্ত্রীলোকের মধ্যে ভগবানকে দেখিতে শিখে, সে অবস্থায় পৌঁছিলে মানুষ নিষ্কাম হইয়া যায়। এই জন্য মহাশক্তিকে রূপ দিতে গিয়া আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা স্ত্রী-মূর্ত্তি কল্পনা করিয়াছেন। ব্যবহারিক জীবনে সকল স্ত্রীলোককে “মা” বলিয়া ভাবিতে ভাবিতে মন ক্রমশঃ পবিত্র ও শুদ্ধ হইয়া যায়।
ভক্তি প্রেমের দ্বারা মানুষ নিঃস্বার্থ হইয়া পড়ে। মানবের মনে যখনই কোন ব্যক্তি বা আদর্শের প্রতি ভালবাসা ও ভক্তি বাড়ে তখন ঠিক সেই অনুপাতে স্বার্থপরতাও কমিয়া যায়। মানুষ চেষ্টার দ্বারা ভক্তি ও ভালবাসা বাড়াইতে পারে এবং তার ফলে স্বার্থপরতাও কমাইতে পারে। ভাল বাসিতে বাসিতে মনটা ক্রমশঃ সকল সঙ্কীর্ণতা ছাড়াইয়া বিশ্বের মধ্যে লীন হইতে পারে। তাই ভালবাসা, ভক্তি বা শ্রদ্ধার যে-কোন বস্তু-বিষয়ের ধ্যান বা চিন্তা করার দরকার। মানুষ যাহা চিন্তা করে ঠিক সেইরূপ হইয়া পড়ে। নিজেকে ‘দুর্ব্বল পাপী’ যে ভাবে, সে ক্রমশঃ দুর্ব্বল হইয়া পড়ে, যে নিজেকে শক্তিমান ও পবিত্র বলিয়া নিত্য চিন্তা করে সে শক্তিমান ও পবিত্র হইয়া উঠে। “যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী।”
ভয় জয় করার উপায় শক্তি সাধনা। দুর্গা, কালী প্রভৃতি মূর্ত্তি শক্তির রূপবিশেষ। শক্তির যে কোন রূপ মনে মনে কল্পনা করিয়া তাঁহার নিকট শক্তি প্রার্থনা করিলে এবং তাঁহার চরণে মনের দুর্ব্বলতা ও মলিনতা বলিস্বরূপ প্রদান করিলে মানুষ শক্তিলাভ করিতে পারে। আমাদের মধ্যে অনন্ত শক্তি নিহিত আছে, সেই শক্তির বোধন করিতে হইবে। পূজার উদ্দেশ্য—মনের মধ্যে শক্তির বোধন করা। প্রত্যহ শক্তিরূপ ধ্যান করিয়া শক্তিকে প্রার্থনা করিবে এবং পঞ্চেন্দ্রিয় ও সকল রিপুকে তাঁহার চরণে নিবেদন করিবে। পঞ্চপ্রদীপ অর্থ পঞ্চেন্দ্রিয়। এই পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে মায়ের পূজা হইয়া থাকে। আমাদের চক্ষু আছে তাই আমরা ধূপ, গুগ্গুল প্রভৃতি সুগন্ধি জিনিষ দিয়া পূজা করি ইত্যাদি। বলির অর্থ—রিপু বলি—কারণ ছাগই কামের রূপবিশেষ।
সাধনার একদিকে রিপু ধ্বংস করা অপরদিকে সদ্বৃত্তির অনুশীলন করা। রিপুর ধ্বংস হইলেই সঙ্গে সঙ্গে দিব্যভাবের দ্বারা হৃদয় পূর্ণ হইয়া উঠিবে। আর দিব্যভাব হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিলেই সকল দুর্ব্বলতা পলায়ন করিবে।
প্রত্যহ (সম্ভব হইলে) দুইবেলা এইরূপ ধ্যান করিবে। কিছুদিন ধ্যান করার সঙ্গে সঙ্গে শক্তি পাইবে, শান্তিও হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিবে।
আপাততঃ স্বামী বিবেকানন্দের এই বইগুলি পড়িতে পার। তাঁহার বই-এর মধ্যে “পত্রাবলী” ও বক্তৃতাগুলি বিশেষ শিক্ষাপ্রদ। ‘ভারতে বিবেকানন্দ’ বই-এর মধ্যে এসব বোধ হয় পাইবে। আলাদা বইও বোধ হয় পাওয়া যায়। ‘পত্রাবলী’ ও বক্তৃতাগুলি না পড়িলে অন্যান্য বই পড়িতে যাওয়া ঠিক নয়। ‘Philosophy of Religion,’ বা ঐ জাতীয় বইতে আগে হস্তক্ষেপ করিও না। তারপর সঙ্গে সঙ্গে ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ পড়িতে পার। রবিবাবুর অনেক কবিতার মধ্যে খুব inspiration পাওয়া যায়। ডি. এল. রায়ের অনেক বই আছে (যেমন ‘মেবার পতন’, ‘দুর্গাদাস’) যা পড়িলে বেশ শক্তি পাওয়া যায়। বঙ্কিমবাবু ও রমেশ দত্তের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলিও খুব শিক্ষাপ্রদ, নবীন সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ও পড়িতে পার। ‘শিখের বলিদান’ও (বোধ হয় শ্রীমতী কুমুদিনী বসু লিখিত) ভাল বই, Victor_Hugo-র ‘Les Miserables’ পড়িও (বোধ হয় লাইব্রেরীতে আছে), খুব শিক্ষা পাইবে। তাড়াতাড়ি এখন বেশী নাম দিতে পারিলাম না। আমি অবসরমত চিন্তা করিয়া একটি তালিকা করিয়া পাঠাইব। ইতি—