পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৯৫

◄  ৯৪
৯৬  ►
৯৫
মান্দালয় জেল (১৯২৬?)

 স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য তুমি যদি প্রত্যহ কিছু ব্যায়াম-চর্চ্চা কর, তবে খুব উপকার পাবে। Muller-এর “My System” বই জোগাড় ক’রে যদি তদনুসারে ব্যায়াম কর তবে ভাল হয়। আমি নিজে মধ্যে মধ্যে Muller-এর ব্যায়াম ক’রে থাকি এবং উপকারও পেয়েছি। Muller-এর ব্যায়ামের বিশেষত্ব এই:—(১) কোনও খরচ লাগে না এবং ব্যায়াম করবার জন্য জায়গা খুব কমই লাগে। (২) ব্যায়াম করিলে অতিরিক্ত পরিশ্রম হয় না এবং অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে কোনও বিপদের আশঙ্কা নাই। (৩) শুধু অঙ্গবিশেষের পরিচালনা না হয়ে সমস্ত শরীরের মাংসপেশীর চালনা হয়। (৪) পরিপাক-শক্তি বৃদ্ধি হয়।

 আমার মনে হয় যে, আমাদের দেশে— বিশেষতঃ ছাত্রসমাজে—যদি মুলারের ব্যায়ামের বহুল প্রচলন হয় তা হইলে খুব উপকার হবে।

 মানুষের দৈনন্দিন কাজ করেই সন্তুষ্ট বোধ করলে চলবে না। এই সব কাজকর্ম্মের যে উদ্দেশ্য বা আদর্শ অর্থাৎ আত্মবিকাশ সাধন— সে কথা ভুললে চলবে না। কাজটাই চরম উদ্দেশ্য নয়; কাজের ভিতর দিয়ে চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হবে এবং জীবনের সর্ব্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন করতে হবে। মানুষকে অবশ্য নিজের ব্যক্তিত্ব ও প্রবৃত্তি অনুসারে একদিকে বৈশিষ্ট্য লাভ করতে হবে; কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যের মূলে (specialization) একটা সর্ব্বাঙ্গীণ বিকাশ চাই। যে ব্যক্তির সর্ব্বাঙ্গীণ উন্নতি হয় নাই সে অন্তরে কখনও সুখী হতে পারে না; তার মনের মধ্যে সর্ব্বদা একটা শূন্যতা বা অভাব-বোধ শেষ পর্য্যন্ত রয়ে যায়। এই সর্ব্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য চাই:—(১) ব্যায়াম-চর্চ্চা (২) নিয়মিত পাঠ (৩) দৈনিক চিন্তা বা ধ্যান। কাজের চাপে মধ্যে মধ্যে এসব দিকে দৃষ্টি থাকে না বা দৃষ্টি থাকলেও সময় হয়ে ওঠে না। কিন্তু কাজের চাপ কমলেই আবার এই সব দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। দৈনিক কাজকর্ম্ম করে নিশ্চিন্ত হলে চলবে না; তার মধ্যে ব্যায়ামের সময় এবং লেখাপড়া ও ধ্যান-ধারণারও সময় করে নিতে হবে। এই তিনটি অতি প্রয়োজনীয় কাজের জন্য মানুষ যদি অন্ততঃপক্ষে প্রতিদিন দেড় ঘণ্টা বা দু’ ঘণ্টা সময় দিতে পারে, তা হলে খুব উপকার হবে। মুলার বলেন যে, যদি কোনও ব্যক্তি নিয়মিতভাবে প্রতিদিন পনর মিনিট করে তাঁর উপদেশানুসারে ব্যায়াম করে তা হলেই যথেষ্ট। তারপর মানুষ যদি প্রতিদিন পনর মিনিট করে নির্জ্জনে চিন্তা বা ধ্যান করে—তবে মোট সময় লাগবে আধ ঘণ্টা। এর সঙ্গে যদি আর এক ঘণ্ট লেখাপড়ার জন্য রাখা যায় (খবর-কাগজ পড়া নয়—খবর-কাগজ পড়বার সময় আলাদা ধরতে হবে) —তবে দিনের মধ্যে মোট সময় লাগবে দেড় ঘণ্টা। অন্ততঃ পক্ষে এই দেড় ঘণ্টা সময় করে নিতে হবে—তারপর “অধিকন্তু ন দোষায়”—যত বেশী সময় দিতে পার—তত ভাল। প্রত্যেককে নিজের সুবিধা অনুসারে এই সময় করে নিতে হবে। ধ্যান-ধারণার বিষয়ে আমি বোধ হয় পূর্ব্ব পত্রে কিছু লিখেছি—তাই সে সম্বন্ধে এখানে আর কিছু লিখিলাম না। বইগুলির নাম আমি এই পত্রে দিচ্ছি। প্রথমে যে বইগুলি সমিতির লাইব্রেরীতে পাবে তার নাম দিচ্ছি—তারপর অন্যান্য বইয়ের নাম দিচ্ছি:

 (ক) ধর্ম্ম সম্বন্ধীয়

(১) ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’; (২) ‘ব্রহ্মচর্য্য’—সুরেন্দ্র ভট্টাচার্য্য; ঐ—রমেশ চক্রবর্ত্তী; ঐ—ফকির দে; (৩) ‘স্বামী-শিষ্য সংবাদ’—শরৎ চক্রবর্ত্তী; (৪) ‘পত্রাবলী’—বিবেকানন্দ; (৫) ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য’—বিবেকানন্দ; (৬) ‘বক্তৃতাবলী’—বিবেকানন্দ; (৭) ‘ভাববার কথা’—ঐ; (৮) ‘ভারতের সাধনা’—স্বামী প্রজ্ঞানন্দ; (১) ‘চিকাগো (Chicago) বক্তৃতা’—স্বামী বিবেকানন্দ।

 (খ) সাহিত্য, কবিতা, ইতিহাস প্রভৃতি:—

(১) ‘দেশবন্ধু গ্রন্থাবলী’— (বসুমতী সংস্করণ); (২) ‘বাঙ্গলার রূপ’—গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী; (৩) ‘বঙ্কিম গ্রন্থাবলী’; (৪) নবীন সেনের ‘কুরুক্ষেত্র’, ‘প্রভাস’, ‘রৈবতক’ ও ‘পলাশীর যুদ্ধ’; (৫) ‘যোগেন্দ্র গ্রন্থাবলী’ (বসুমতী সংস্করণ); (৬) রবি ঠাকুরের ‘কথা ও কাহিনী’, ‘চয়নিকা’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘গোরা’; (৭) ভূদেব বাবুর ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ ও ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’; (৮) ডি, এল, রায়ের ‘দুর্গাদাস’, ‘মেবার পতন’, ‘রাণা প্রতাপ’; (৯) ‘ছত্রপতি শিবাজী’—সত্যচরণ শাস্ত্রী; (১০) ‘শিখের বলিদান’—কুমুদিনী বসু; (১১) রাজনারায়ণ বসুর ‘সেকাল ও একাল’; (১২) সত্যেন দত্তের ‘কুহু কেকা’ (কবিতা-গ্রন্থ); (১৩) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ‘আত্মজীবনচরিত’; (১৪) ‘রাজস্থান’ (বসুমতী সংস্করণ); (১৫) ‘নব্য জাপান’—মন্মথ ঘোষ; (১৬) ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’—রজনীকান্ত গুপ্ত; (১৭) উপেনবাবুর ‘নির্ব্বাসিতের আত্মকথা’ ও অন্যান্য পুস্তক; (১৮) ‘কর্ণেল সুরেশ বিশ্বাস’—উপেন্দ্রকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শিশুপাঠ্য তিন আনা সংস্করণের ভারতের অনেক মহাপুরুষের ছোট ছোট জীবনী পাবে।

 এই বই-এর তালিকা যথেষ্ট। অন্ততঃ পক্ষে এক বৎসরের খোরাক এর মধ্যে পাবে। প্রাথমিক শিক্ষা সম্বন্ধে কিছু বলি।

 প্রাথমিক শিক্ষার সহিত উচ্চ শিক্ষার একটা বড় প্রভেদ এই যে প্রাথমিক শিক্ষায় নূতন facts শিখাবার চেষ্টাই বেশী প্রয়োজন। উচ্চ শিক্ষায় নূতন facts যেরূপ শিখাতে হয় তার সঙ্গে সঙ্গে reasoning faculty-র অনুশীলনও সেইরূপ করতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষায় ইন্দ্রিয়-শক্তির উপর বেশী নির্ভর করতে হয়, কারণ তখন চিন্তা করবার বা মনে রাখার শক্তি ভাল রকম জাগে। সেইজন্য কোনও বিষয় শেখাতে গেলে যেমন, গরু, ঘোড়া, ফল, ফুল, সেই জিনিষগুলি চোখের সামনে না ধরলে শেখান মুস্কিল। উচ্চ শিক্ষায় এমন বিষয় বা বস্তু শেখান হয় যা ছাত্র কখনও দেখে নাই এবং ছাত্র সেই বস্তু না দেখেও নিজের চিন্তাশক্তির বলে তা বুঝতে পারে। আর একটা কথা—শেখাবার সময়ে যত বেশী ইন্দ্রিয়ের সাহায্য নেওয়া যায়—তত সহজে শেখান সম্ভব। বাঁশী বা কোনও রকম বাজনা সম্বন্ধে যদি কিছু বোঝাতে চাও— তবে ছাত্র যদি জিনিষটা চোখে দেখে, হাতে স্পর্শ করে এবং বাজিয়ে তার আওয়াজ কানে শোনে, তবে সেই বিষয়ে তার জ্ঞান খুব শীঘ্র লাভ হবে। কারণ দৃষ্টিশক্তি, স্পর্শশক্তি এবং শ্রবণশক্তি সে এক সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে। কোলের শিশু যে-কোন জিনিষ দেখা মাত্র স্পর্শ করিতে চায় এবং মুখে দিতে চায়—তার কারণ এই যে, শিশু সকল ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বাহ্য বস্তুর জ্ঞান লাভ করতে চায়। অতএব প্রকৃতির নিয়ম অনুসরণ করে আমরা যদি সকল ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জ্ঞান জন্মাতে পারি তবে ফললাভ খুব শীঘ্র হবে। পাটীগণিত শেখাবার সময়ে শুধু মুখস্থ না করিয়ে যদি কড়ি, marble অথবা ইটপাথরের টুকরা দিয়ে আমরা যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ প্রভৃতির উদাহরণ দেখাতে পারি তবে সেই সব জিনিষ শিশুরা খুব শীঘ্র শিখতে পারবে।

 আর একটা বড় কথা—শুধু মানসিক শিক্ষা না দিয়ে শিল্প শিক্ষার ব্যবস্থাও সঙ্গে সঙ্গে করা চাই। পুতুল তৈয়ারী করা, মাটী দিয়ে মানচিত্র তৈরী করা, ছবি আঁকা, রঙের ব্যবহার, সহজ গান শিক্ষা—এ সবের ব্যবস্থা করা চাই। ইহার দ্বারা শিক্ষাটা যে শুধু সর্ব্বাঙ্গীণ হবে তা নয়—সঙ্গে সঙ্গে লেখা-পড়ারও বিশেষ উন্নতি হবে। পাঁচরকম জিনিষ শেখাতে পারলে ছেলেদের মনটা সজাগ হয়, বুদ্ধি বাড়ে, লেখাপড়ায় মন লাগে—এবং লেখা-পড়ার নাম শুনলে ভীতির উদ্রেক হয় না। পাঁচরকম জিনিষ না শিখে যদি কেবলি মুখস্থ ক’রে লেখা-পড়া শিখতে আরম্ভ করে, তবে সে লেখা-পড়ার মধ্যে রস পায় না, লেখা-পড়াকে ভয় করতে শেখে এবং তার বুদ্ধি বিকশিত হয় না। শিশুর চোখ, কান, হাত, জিহ্বা, নাক যদি উপভোগের এবং জানবার বস্তু পায়, তবে এই সব ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে, এর ফলে মনেও বুদ্ধি জাগরিত হয় এবং সকল রকম জ্ঞান সংগ্রহের ফলে লেখা-পড়ায় সে রস পায়। Manual training না হ’লে শিক্ষার গোড়ায় গলদ রয়ে যায়। নিজের হাতে কোনও জিনিষ প্রস্তুত করলে যেরূপ আনন্দ পাওয়া যায়, সেরূপ আনন্দ পৃথিবীতে খুব অল্পই পাওয়া যায়। সৃষ্টির মধ্যে গভীর আনন্দ নিহিত রয়েছে। সেই Joy of Creation শিশুরা অল্প বয়সেই উপভোগ করে যখন তারা নিজের হাতে কোনও বস্তু তৈয়ারী করে। বাগানে বীজ পুঁতে গাছের সৃষ্টির দ্বারাই হোক অথবা নিজের হাতে পুতুল তৈরী করেই হোক, যে কোন বস্তু নূতন করে সৃষ্টি করতে পারলে শিশুরা গভীর আনন্দ উপভোগ করে। যে সব উপায়ে ছাত্রেরা এই আনন্দ অল্প বয়সেই উপভোগ করতে পারবে তার ব্যবস্থা করা চাই। দ্বার। তাদের originality বা ব্যক্তিত্বের বিকাশের সুবিধা হবে এবং লেখা-পড়াকে ভয় না করে তারা উপভোগ করতে শিখবে। বিলাতে অধিকাংশ প্রাথমিক স্কুলে ছাত্রেরা বাগানের কাজ শেখে, ব্যায়াম-চর্চ্চা করে, drill করে, পড়ার মাঝখানে খেলাধূলা করে, গান-বাজনা শেখে, route march ক’রে পথে পথে সঙ্ঘবদ্ধভাবে ঘুরে বেড়ায়, clay-modelling (মাটি দিয়ে পুতুল প্রভৃতি তৈয়ারী করা) শেখে, গল্পচ্ছলে নানা বিষয় এবং নানা দেশের কথা শেখে। গল্পচ্ছলে শেখান সব চেয়ে বেশী দরকার। ছাত্রেরা যেন না বুঝতে পারে যে তারা লেখা-পড়া শিখছে, তারা যেন অনুভব করে যে তারা গল্প শুনছে অথবা খেলা করছে। প্রথমাবস্থায় Text-Book-এর আদৌ প্রয়োজন নাই। গাছ-পালা, ফুল প্রভৃতি সম্বন্ধে যখন শেখাবে তখন যেন সামনে গাছপালা এবং ফুল থাকে। আকাশ, তারা প্রভৃতি সম্বন্ধে যখন শেখাবে তখন মুক্ত আকাশের তলে নিয়ে গিয়ে তাদের শিক্ষা দেবে। যে জিনিষই শেখাবে তা যেন সকল ইন্দ্রিয়ের সামনে উপস্থিত থাকে। যখন ভূগোল শেখাবে তখন মানচিত্র, Globe প্রভৃতি যেন থাকে, ইতিহাস যখন শেখাবে তখন সুবিধামত museum প্রভৃতি স্থানে নিয়ে যাবে। খুব গরীব চালেও গানশিক্ষা, Painting, Drawing প্রভৃতি শিক্ষা, Gardening শিক্ষা প্রভৃতি চাই। তা না হলে প্রাথমিক শিক্ষা একেবারে ব্যর্থ। বস্তুজ্ঞানই বেশী দরকার। পাঠ মুখস্থের তত বেশী প্রয়োজন নাই।

 আমি প্রাথমিক শিক্ষার Principles বা নীতি বিষয়ে কিছু বললুম। Text-Book-এর কথা ইচ্ছে করেই বলি নাই। TextBook-এর প্রয়োজন কম এবং পাঠ্য-পুস্তক যেগুলি রাখতে হবে সেগুলির importance কম, ভাল শিক্ষক না হলে প্রাথমিক শিক্ষা সার্থক হতে পারে না। প্রাথমিক শিক্ষার Fundamental Principles সর্ব্বপ্রথমে শিক্ষককে বুঝতে হবে। তারপর তিনি নূতন প্রণালীতে শিক্ষা-প্রবর্ত্তন করতে পারবেন। শিক্ষকের অন্তরের ভালবাসা ও সহানুভূতির দ্বারা শিক্ষককে ছাত্রের দিক থেকে সব জিনিষ দেখতে হবে। ছাত্রের অবস্থায় যদি শিক্ষক নিজেকে কল্পনা না করতে পারে, তবে সে কি করে ছাত্রের difficulty এবং ভুলভ্রান্তি বুঝতে পারবে? সুতরাং Personality of teacher হচ্ছে সব চেয়ে বড়। শিক্ষার প্রধান উপাদান তিনটী:—(১) শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব, (২) শিক্ষার প্রণালী, (৩) শিক্ষার বিষয় ও পাঠ্যপুস্তক। শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব না থাকলে কোনও শিক্ষা সম্ভবপর নয়। চরিত্রবান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শিক্ষক পাওয়া গেলে তারপর আমাদের শিক্ষার প্রণালী নির্দ্ধারিত হয়, তবে যে-কোনও বিষয়ক পুস্তক সহজে শেখান যাইতে পারে।

 * * *

 আশা করি তোমাদের কুশল। ইতি—