বর্ষার মাঝামাঝি।

 পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরশুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোনাে সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই। সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শত শত আলাে অনির্বাণ জোনাকির মতাে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। জেলে নৌকার আলাে ওগুলি। সমস্তরাত্রি আলোগুলি এমনিভাবে নদীবক্ষের রহস্যময় ম্লান অন্ধকারে দুর্বোধ্য সংকেতের মতাে সঞ্চালিত হয়। একসময় মাঝরাত্রি পার হইয়া যায়। শহরে গ্রামে রেলস্টেশনে ও জাহাজঘাটে শান্ত মানুষ চোখ বুজিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। শেষ রাত্রে ভাঙা ভাঙা মেঘে ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি ওঠে। জেলে নৌকার আলােগুলি তখনও নেভে না। নৌকার খােল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলােয় মাছের আঁশ চকচক করে, মাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতাে দেখায়।

 কুবের মাঝি আজ মাছ ধরিতেছিল দেবীগঞ্জের মাইল দেড়েক উজানে। নৌকায় আরও দুজন লােক আছে। ধনঞ্জয় এবং গণেশ। তিনজনের বাড়িই কেতুপুর গ্রামে।

 আরও দুমাইল উজানে পদ্মার ধারেই কেতুপুর গ্রাম।

 নৌকাটি বেশি বড় নয়। পিছনের দিকে সামান্য একটু ছাউনি আছে। বর্ষা-বাদলে দু-তিন জনে কোনােরকমে মাথা গুঁজিয়া থাকিতে পারে। বাকি সবটাই খােলা। মাঝখানে নৌকার পাটাতনে হাত দুই ফাঁক রাখা হইয়াছে। এই ফাঁক দিয়া নৌকার খােলের মধ্যে মাছ ধরিয়া জমা করা হয়। জাল ফেলিবার ব্যবস্থা পাশের দিকে। ত্রিকোণ বাঁশের ফ্রেমে বিপুল পাখার মতাে জালটি নৌকার পাশে লাগানাে আছে। জালের শেষ সীমার বাঁশটি নৌকার পার্শ্বদেশের সঙ্গে সমান্তরাল। তার দুই প্রান্ত হইতে লম্বা দুটি বাঁশ নৌকার ধারে আসিয়া মিশিয়া পরস্পরকে অতিক্রম করিয়া নৌকার ভিতরে হাত দুই আগাইয়া আসিয়াছে। জালের এ দুটি হাতল। এই হাতল ধরিয়া জাল উঠানাে এবং নামানাে হয়।

 গভীর জলে বিরাট ঠোঁটের মতাে দুটি বাঁশে বাঁধা জাল লাগে। দড়ি ধরিয়া বাঁশের ঠোঁট হাঁ-করা জাল নামাইয়া দেওয়া হয়। মাছ পড়িলে খবর আসে জেলের হাতের দড়ি বাহিয়া, দড়ির দ্বারাই জলের নীচে জালের মুখ বন্ধ করা হয়।

 এ নৌকাটি ধনঞ্জয়ের সম্পত্তি। জালটাও তারই। প্রতি রাত্রে যত মাছ ধরা হয় তার অর্ধেক ভাগ ধনঞ্জয়ের, বাকি অর্ধেক কুবের ও গণেশের। নৌকা এবং জালের মালিক বলিয়া ধনঞ্জয় পরিশ্রমও করে কম। আগাগােড়া সে শুধু নৌকার হাল ধরিয়া বসিয়া থাকে। কুবের ও গণেশ হাতল ধরিয়া জালটা জলে নামায় এবং তােলে, মাছগুলি সঞ্চয় করে। পদ্মার ঢেউয়ে নৌকা টলমল করিতে থাকে, আলােটা মিটমিট করিয়া জ্বলে, জোর বাতাসেও নৌকার চিরস্থায়ী গাঢ় আঁশটে গন্ধ উড়াইয়া লইয়া যাইতে পারে না। একহাত একখানি কাপড়কে নেংটির মতাে কোমরে জড়াইয়া ক্রমাগত জলে ভিজিয়া ও শীতল জলােবাতাসে শীত বােধ করিয়া, বিনিদ্র আরক্ত চোখে লণ্ঠনের মৃদু আলােয় নদীর অশান্ত জলরাশির দিকে চাহিয়া থাকিয়া কুবের ও গণেশ সমস্ত রাত মাছ ধরে। নৌকা স্রোতে ভাসিয়া যায়। বইঠা ধরিয়া নৌকাকে তারা ঠেলিয়া লইয়া আসে সেইখানে যেখানে একবার একেবারে ঝাঁকের মধ্যে জাল ফেলিয়া বেশি মাছ উঠিয়াছিল। আজ খুব মাছ উঠিতেছিল। কিন্তু ভােরে দেবীগঞ্জের মাছের দর না জানা অবধি এটা সৌভাগ্য কিনা বলা যায় না। সকলেরই যদি এরকম মাছ পড়ে, দর কাল এত নামিয়া যাইবে যে বিশেষ কোনাে লাভের আশা থাকিবে না। তবে বড়াে মাছের বড়াে ঝাঁক একই সময় সমস্ত নদীটা জুড়িয়া থাকে না, এই যা ভরসার কথা। বেশি মাছ সকলের না-ও উঠিতে পারে।

 কুবের হাঁকিয়া বলে, যদু হে এ এ এ—মাছ কিবা?

 খানিক দুরের নৌকা হইতে জবাব আসে, জবর।

 জবাবের পর সে-নৌকা হইতে পালটা প্রশ্ন করা হয়। কুবের হাঁকিয়া জানায় তাদেরও মাছ পড়িতেছে জবর।

 ধনঞ্জয় বলে, সাঁঝের দরটা জিগা দেখি কুবের।

 কুবের হাঁকিয়া দাম জিজ্ঞাসা করে। সন্ধ্যাবেলা আজ পৌনে পাঁচ, পাঁচ এবং সওয়া পাঁচ টাকা দরে মাছ বিক্রি হইয়াছে। শুনিয়া ধনঞ্জয় বলে, কাইল চাইরে নামবাে। হালার মাছ ধইরা জুত নাই।

 কুবের কিছু বলে না। ঝপ করিয়া জালটা জলে ফেলিয়া দেয়।

 শরীরটা আজ তাহার ভালাে ছিল না। তার স্ত্রী মালা তাকে বাহির হইতে বারণ করিয়াছিল। কিন্তু শরীরের দিকে তাকাইবার অবসর কুবেরের নাই। টাকার অভাবে অখিল সাহার পুকুরটা এবারও সে জমা লইতে পারে নাই। সারাটা বছর তাকে পদ্মার মাছের উপরেই নির্ভর করিয়া থাকিতে হইবে। এ নির্ভরও বিশেষ জোরালাে নয়, পদ্মার মাছ ধরিবার উপযুক্ত জাল তার নাই। ধনঞ্জয় অথবা নড়াইলের যদুর সঙ্গে সমস্ত বছর তাকে এমনিভাবে দু আনা চার আনা ভাগে মজুরি খাটিতে হইবে। ইলিশের মরশুম ফুরাইলে বিপুলা পদ্মা কৃপণ হইয়া যায়। নিজের বিরাট বিস্তৃতির মাঝে কোনখানে সে যে তার মীন সন্তানগুলিকে লুকাইয়া ফেলে খুঁজিয়া বাহির করা কঠিন হইয়া দাঁড়ায়। নদীর মালিককে খাজনা দিয়া হাজার টাকা দামের জাল যারা পাতিতে পারে তাদের স্থান ছাড়িয়া দিয়া, এতবড়ো পদ্মার বুকে জীবিকা অর্জন করা তার মতাে গরিব জেলের পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার। ধনঞ্জয় ও যদুর জোড়াতালি দেওয়া ব্যবস্থায় যে মাছ পড়ে তার দু-তিন আনা ভাগে কারও সংসার চলে না। উপার্জন যা হয় এই ইলিশের মরশুমে। শরীর থাক আর যাক এসময় একটা রাত্রিও ঘরে বসিয়া থাকিলে কুবেরের চলিবে না।

 মাঝরাত্রে একবার তারা খানিকক্ষণ বিশ্রাম করিয়াছে। রাত্রি শেষ হইয়া আসিলে কুবের বলিল, একটু জিরাই গাে আজান খুড়া।

 জিরানের লাইগা মরস ক্যান ক দেহি? বাড়িত্ গিয়া সারাডা দিন জিরাইস। আর দুই খেপ দিয়া ল।

 কুবের বলিল, উহুঁ, তামুক বিনা গায়ে সাড় লাগে না। দেহখান জানাে গাে আজান খুড়া, আইজ বিশেষ ভালাে নাই।

 জাল উঁচু করিয়া রাখিয়া কুবের ও গণেশ ছইয়ের সামনে বসিল। ছইয়ের গায়ে আটকানাে ছােটো হুঁকাটি নামাইয়া টিনের কৌটা হইতে কড়া দা-কাটা তামাক বাহির করিয়া দেড় বছর ধরিয়া ব্যবহৃত পুরাতন কল্কিটিতে তামাক সাজিল কুবের। নারিকেল ছােবড়া গােল করিয়া পাকাইয়া ছাউনির আড়ালে একটিমাত্র দেশলাইয়ের কাঠি খরচ করিয়া সেটি ধরাইয়া ফেলিল। বারাে বছর বয়স হইতে অভ্যাস করিয়া হাত একেবারে পাকিয়া গিয়াছে।

 নৌকা স্রোতে ভাসিয়া চলিয়াছিল।

 এক হাতে তীরের দিকে কোনাকুনি হাল ধরিয়া ধনঞ্জয় অন্য হাতটি বাড়াইয়া দিয়া বলিল, দে কুবের, আমারে দে, ধরাই।

 কলিকাটি তাহার হাতে দিয়া কুবের রাগ করিয়া বসিয়া রহিল।

 কুবেরের পাশে বসিয়া গণেশ বাড়াবাড়ি রকমের কাঁপিতেছিল। এ যেন সত্যসত্যই শীতকাল।

 হঠাৎ সে বলিল, ইঃ আজ কি জাড় কুবির!

 কথাটা কেহ কানে তুলিল না। কারও সাড়া না পাইয়া কুবেরের হাঁটুতে একটা খোঁচা দিয়া গণেশ আবার বলিল, জানস কুবির, আইজকার জাড়ে কাঁইপা মরলাম।

 এদের মধ্যে গণেশ একটু বােকা। মনের ক্রিয়াগুলি তার অত্যন্ত শ্লথ গতিতে সম্পন্ন হয়। সে কোনাে কথা বলিলে লােকে যে তাহাকে অবহেলা করিয়াই কথাটা কানে তােলে না এইটুকুও সে বুঝিতে পারে না। একটা কিছু জবাব না পাওয়া পর্যন্ত বারবার নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করে। ধমকের মতাে করিয়া যদি কেউ তার কথার জবাব দেয় তাতেও সে রাগ করে না। দুঃখও তাহার হয় কিনা সন্দেহ।

 কুবেরের সে অত্যন্ত অনুগত। জীবনের ছােটোবড়াে সকল ব্যাপারে সে কুবেরের পরামর্শ লইয়া চলে। বিপদে আপদে ছুটিয়া আসে তাহারই কাছে। এক পক্ষের এই আনুগত্যের জন্য তাহাদের মধ্যে যে বন্ধুত্বটি স্থাপিত হইয়াছে তাহাকে ঘনিষ্ঠই বলিতে হয়। দাবি আছে, প্রত্যাশা আছে, সুখদুঃখের ভাগাভাগি আছে, কলহ এবং পুনর্মিলনও আছে। কিন্তু গণেশ অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির বলিয়া ঝগড়া তাহাদের হয় খুব কম।

 পুড়িয়া শেষ হওয়া অবধি তাহারা পালা করিয়া তামাক নিল। নৌকা এখন অনেক দূরে আগাইয়া আসিয়াছে। কলিকার ছাই জলে ঝাড়িয়া ফেলিয়া হুঁকাটি ছইয়ে টাঙাইয়া দিয়া জাল নামাইয়া কুবের ও গণেশ বইঠা ধরিল।

 গণেশ হঠাৎ মিনতি করিয়া বলিল, একখান গীত ক দেখি কুবির?

 হ, গীত না তর মাথা॥

 কুবেরের ধমক খাইয়া গণেশ খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তারপর নিজেই ধরিয়া দিল গান। সে গাহিতে পারে না। কিন্তু তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না। ধনঞ্জয় ও কুবের মন দিয়া গানের কথাগুলি শুনে। যে যাহারে ভালােবাসে সে তাহারে পায় না কেন, গানে এই গভীর সমস্যার কথা আছে। বড়াে সহজ গান নয়।


পুবদিক লাল হইয়া ওঠা পর্যন্ত তাহারা জাল ফেলিয়া বেড়াইল। তারপর রওনা হইল জাহাজঘাটের দিকে। সেখানে পৌঁছিতে পৌঁছিতে চারিদিক আলাে হইয়া উঠিল।

 নদীর তীরে, নদীর জলে এখন জীবনের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। থাকিয়া থাকিয়া স্টিমারের বাঁশি বাজিয়া উঠে। সশব্দে নােঙর তুলিয়া কোনাে স্টিমার ছাড়িয়া যায়, কোনাে স্টিমার ভেড়ে গিয়া জেটিতে। কলিকাতা হইতে মেল ট্রেনটি আসিয়া পড়িয়াছে। ঘাটের ও স্টেশনের দোকানপাট সমস্ত খােলা হইয়াছে। অনেকে নদীর জলে স্নান করিতে নামিয়াছে। মােটবাহী ও যাত্রীবাহী অসংখ্য ছােটোবড়াে নৌকা ঘাটে ভিড় করিয়া আসিয়াছে। ঘাটের দুদিকে বহুদূর অবধি তীর ঘেঁষিয়া কাদায় পোঁতা লগির সঙ্গে বাঁধা আরও যে কত নৌকা তার সংখ্যা নাই।

 নদীতে শুধু জলের স্রোত। জলে স্থলে মানুষের অবিরাম জীবনপ্রবাহ।

 মেছাে নৌকার ঘাটটি একপাশে। ইতিমধ্যে অনেকগুলি নৌকা মাছ লইয়া হাজির হইয়াছে। হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকিতে স্থানটি হইয়া উঠিয়াছে সরগরম। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দরাদরি সম্পন্ন হইয়া হরদম মাছ কেনাবেচা চলিতেছে। চালানের ব্যবস্থাও হইতেছে সঙ্গে সঙ্গেই।

 এই ব্যস্ততা ও কোলাহলের মধ্যে আসিয়া পড়িয়া সমস্ত রাত্রিব্যাপী পরিশ্রমের ক্লান্তি ভুলিয়া কুবের প্রতিদিন খুশি হইয়া উঠে। আজ সে একেবারে ঝিমাইয়া পড়িয়াছিল। শেষরাত্রির দিকে শীত করিয়া বােধ হয় তাহার জ্বরই আসিয়াছে। চোখ দুটো যে তাহার ভয়ানক লাল হইয়া উঠিয়াছে গণেশ তাহা দেখিতে পাইয়া বলিয়াছে চার-পাঁচবারের বেশি।

 নেংটি ছাড়িয়া তিনহাতি ছােটো ময়লা কাপড়খানি পরিয়া কুবের তীরে উঠিল। কাদার মধ্যেই একটা লােহার চেয়ার ও কাঠের টেবিল পাতিয়া চালানবাবু কেদারনাথ মাছ গােনা দেখিয়া খাতায় লিখিয়া যাইতেছে। একশ মাছ গােনা হইবামাত্র তার চাকরটা ছোঁ মারিয়া চালানবাবুর চাঁদা পাঁচটি মাছ মস্ত একটা কেরােসিন কাঠের বাক্‌সে ভরিয়া ফেলিতেছে। পাশেই কাঠের প্যাকিং কেসে এক সারি মাছ ও এক পরল করিয়া বরফ বিছাইয়া চালানের ব্যবস্থা হইতেছে। খানিক দূরে মেন লাইন হইতে গায়ের জোরে টানিয়া আনা একজোড়া উঁচুনিচু ও প্রায় অকেজো লাইনের উপর চার-পাঁচটা ওয়াগন দাঁড়াইয়া আছে। মাছের বােঝাই লইয়া যথাসময়ে ওয়াগনগুলি কলিকাতায় পৌঁছিবে। সকালে বিকালে বাজারে বাজারে ইলিশ কিনিয়া কলিকাতার মানুষ ফিরিবে বাড়ি। কলিকাতার বাতাসে পাওয়া যাইবে পদ্মার ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ।

 একটা ওয়াগনের আড়ালে দাঁড়াইয়া লম্বা শার্ট গায়ে বেঁটে ও মােটা এক ব্যক্তি অনেকক্ষণ হইতে কুবেরের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করিতেছিল। কুবের তাহার দিকে চাহিতেই সে হাতছানি দিয়া ডাকিল।

 কুবের খানিকক্ষণ নড়িল না। উদাসভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর কাছে গিয়া বলিল, কী কন?

 সে রাগ করিয়া বলিল, কী কন! কী কই জানস না? মাছ লইয়া আয়, তিনডা আনিস।

 মাছ তাে নাই শেতলবাবু।

 নাই কী রে, নাই? রােজ আমারে মাছ দেওনের কথা না তর? নিয়া আয় গা, যা। বড়াে দেইখা আনিস।

 কুবের মাথা নাড়িল, আইজ পারুম না শেতলবাবু। আজান খুড়া সিদা মাের দিকে চাইয়া রইছে দেখ না? বাজারে কেনাে গা আইজ।

 কিন্তু কুবের চুরি করিয়া যে দামে মাছ দেয় বাজারে কিনিতে গেলে তার তিনগুণ দাম পড়িবে। শীতল তাই হঠাৎ আশা ছাড়িতে পারিল না।

 সে মিনতি করিয়া বলিল, তিনডা মাছ আইজ তুই দে কুবের। অমন করস ক্যান? পয়সা নয় কয়ডা বেশিই লইস, আঁই?

 তালি খানিক খাড়াও শেতলবাবু।

 কুবের ফিরিয়া গিয়া কাপড়টা ভালাে করিয়া গায়ে জড়াইয়া নৌকায় বসিল। চারিদিকে চেনা লােক কম নয়। চুপিচুপি মাছ লইয়া তাহাকে তীরে উঠিতে দেখিলে নিশ্চয়ই সন্দেহ করিবে। লজ্জার তাহার সীমা থাকিবে না। তবে একটা ভরসার কথা এই যে সকলেই নিরতিশয় ব্যস্ত। নিজের নৌকা হইতে কে কোথায় দুটা মাছ চুরি করিতেছে তাকাইয়া দেখিবার অবসর কাহারও নাই। চারিদিকে নজর রাখিয়া তিনটা মাছ কুবের একসময় গায়ের কাপড়ের তলে লুকাইয়া ফেলিল। তীরে উঠিয়া শীতলের হাতে দিতেই মাছ কটা সে চটের থলির মধ্যে পুরিয়া ফেলিল।

 পয়সা কাইল দিমু কুবের।

 বলিয়া সে চলিয়া যায়, কুবেরও সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়াইয়া বলিল, রন শেতলবাবু, অমন ত্বরা কইরা যাইয়েন না। দামটা দ্যান দেখি।

 কাইল দিমু কইলাম যে?

 অঁই, অখন দ্যান। খামু না? পােলাগাে খাওয়ামু না?

 পয়সা নাই তাে দিমু কী? কাল দিমু, নিয্যস দিমু।

 পিছল নরম মাটিতে পায়ের বুড়া আঙুল গাঁথিয়া গাঁথিয়া শীতল চলিয়া গেল। আরক্ত চোখে তাহার দিকে চাহিয়া থাকিয়া অস্ফুটস্বরে কুবের বলিল, হালা ডাকাইত! বিড়বিড় করিয়া শীতলকে আরও কয়েকটা গাল দিয়া কুবের নৌকায় গিয়া গলুইয়ের দিকে গা এলইয়া শুইয়া পড়িল।

 গণেশটা বােকা। মাছের দাম বুঝিয়া পাওয়ার সময় একটু চেষ্টা করিয়াই ধনঞ্জয় তাহাকে সরাইয়া দিতে পারিয়াছিল। একা একা দাম লইবার সুযােগ সে কোনােদিনই প্রায় পায় না। কুবের এই সময়টা জোঁকের মতাে তাহার সঙ্গে লাগিয়া থাকে। টাকা পাওয়া মাত্র সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভাগটা বুঝিয়া লয়।

 ধনঞ্জয় নৌকায় আসিলে মাথা উঁচু করিয়া কুবের জিজ্ঞাসা করিল, কতটি মাছ হইল আজান খুড়া? শ চারের কম না, এ্যাঁ?

 ধনঞ্জয় মুখে একটা অবজ্ঞাসূচক শব্দ করিয়া বলিল, হ, চাইরশ না হাজার। দুইশ সাতপঞ্চাশখান মাছ। সাতটা ফাউ নিয়া আড়াইশর দাম দিছে।

 কুবের উঠিয়া বসিল।

 ইটা কী কও খুড়া? কাইল যে এক্কেরে মাছ পড়ে নাই, কাইল না দুইশ সাতাইশটা মাছ হইছিল?

 ধনঞ্জয় তৎক্ষণাৎ রাগ করিয়া বলিল, মিছা কইলাম নাকি রে কুবির? জিগাইস না, গণেশ আইলে জিগাইস।

 কুবের নরম হইয়া বলিল, জিগানের কাম কী? তা কই নাই খুড়া। মিছা কওনের মানুষ তুমি না। মাছনি কাল বেশি বেশি পড়ছিল, তাই ভাবলাম তােমারে বুঝি চালানবাবু ঠকাইছে।

 ঘুমে ও শ্রান্তিতে কুবেরের চোখ দুটি বুজিয়া আসিতে চায় আর সেই নিমীলন-পিপাসু চোখে রাগে দুঃখে আসিতে চায় জল। গরিবের মধ্যে সে গরিব, ছােটোলােকের মধ্যে আরও বেশি ছোটোলােক। এমনভাবে তাহাকে বঞ্চিত করিবার অধিকারটা সকলে তাই প্রথার মতাে, সামাজিক ও ধর্মসম্পৰ্কীয় দশটা নিয়মের মতাে, অসংকোচে গ্রহণ করিয়াছে। সে প্রতিবাদ করিতেও পারিবে না। মনে মনে সকলেই যাহা জানে মুখ ফুটিয়া তাহা বলিবার অধিকার তাহার নাই।

 গণেশকে ধনঞ্জয় চিড়া কিনিতে পাঠাইয়াছিল। সে ফিরিয়া আসিলে নৌকা খুলিয়া দেওয়া হইল। এখন বইঠা না ধরিলেও চলে। উজান স্রোতের টানে নৌকা আপনি গ্রামের দিকে ভাসিয়া চলিবে। গণেশ ও ধনঞ্জয় গুড় মুখে দিয়া শুকনাে চিড়া চিবাইতে লাগিল। কুবের কিছু খাইল না। কেবল কয়েক আঁজলা নদীর জল পান করিল। নদীর বুক জুড়িয়া এখন ভাঙা ঢেউগুলির মাথায় অসংখ্য সূর্য জ্বলিয়া উঠিতেছে। কাকচিলা মাছরাঙা প্রভৃতি পাখিগুলি ক্রমাগত জলে ঝাঁপাইয়া মাছ ধরিতেছে। অনেক দূরে অস্পষ্ট সংকেতের মতাে একটি স্টিমারের ধোঁয়া চোখে পড়ে। আকাশ উজ্জ্বল ও নির্মল। মেঘের চিহ্নও নাই।

 গণেশ সহসা মমতা বােধ করিয়া বলে, না আইলে পারতি কুবির আইজ। কুবের কোনাে জবাব দেয় না। নিঃশব্দে থাকে।

 গণেশ বলে, মাথাটা টিপা দিমু নাকি? কুবের বলে, অঁ হঁ।

 গণেশ খানিকক্ষণ ভাবিয়া বলে হাল ধইরা যদি বইবার পারস কুবির, খুড়া আর আমি বইঠা বাই, তড়াতড়ি পৌছান যায়।


পুবদিকে গ্রামের বাহিরে জেলেপাড়া। চারিদিকে ফাঁকা জায়গার অন্ত নাই। কিন্তু জেলেপাড়ার বাড়িগুলি গায়ে গায়ে ঘেঁষিয়া জমাট বাঁধিয়া আছে। প্রথম দেখিলে মনে হয় এ বুঝি তাহাদের অনাবশ্যক সংকীর্ণতা উন্মুক্ত উদার পৃথিবীতে দরিদ্র মানুষগুলি নিজেদের প্রবঞ্চনা করিতেছে। তারপর ভাবিয়া দেখিলে ব্যাপারটা বুঝিতে পারা যায়। স্থানের অভাব এ জগতে নাই। তবু মাথা গুঁজিবার ঠাঁই এদের ওইটুকুই। সবটুকু সমতল ভূমিতে ভূস্বামীর অধিকার বিস্তৃত হইয়া আছে। তাহাকে ঠেলিয়া জেলেপাড়ার পরিসর বাড়িতে পায় না। একটি কুঁড়ের আনাচেকানাচে তাহারই নির্ধারিত কম খাজনার জমিটুকুতে আরেকটি কুঁড়ে উঠিতে পায়। পুরুষানুক্রমে এই প্রথা চলিয়া আসিতেছে। তারই ফলে জেলেপাড়াটি হইয়া উঠিয়াছে জমজমাট।

 দিন কাটিয়া যায়। জীবন অতিবাহিত হয়। ঋতুচক্রে সময় পাক খায়, পদ্মার ভাঙন ধরা তীরে মাটি ধ্বসিতে থাকে, পদ্মার বুকে জল ভেদ করিয়া জাগিয়া উঠে চর, অর্ধ শতাব্দীর বিস্তীর্ণ চর পদ্মার জলে আবার বিলীন হইয়া যায়। জেলেপাড়ার ঘরে ঘরে শিশুর ক্রন্দন কোনােদিন বন্ধ হয় না। ক্ষুধাতৃষ্ণার দেবতা, হাসিকান্নার দেবতা, অন্ধকার আত্মার দেবতা, ইহাদের পূজা কোনােদিন সাঙ্গ হয় না। এ দিকে গ্রামের ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণেতর ভদ্রমানুষগুলি তাহাদের দুরে ঠেলিয়া রাখে, ও দিকে প্রকৃতির কালবৈশাখী তাহাদের ধ্বংস করিতে চায়, বর্ষার জল ঘরে ঢােকে, শীতের আঘাত হাড়ে গিয়া বাজে কন্‌কন্। আসে রােগ, আসে শােক। টিকিয়া থাকার নির্মম অনমনীয় প্রয়ােজনে নিজেদের মধ্যে রেষারেষি কাড়াকাড়ি করিয়া তাহারা হয়রান হয়। জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ণ। জীবনের স্বাদ এখানে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সংকীর্ণতায়। আর দেশি মদে। তালের রস গাঁজিয়া যে মদ হয়, ক্ষুধার অন্ন পচিয়া যে মদ হয়। ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লিতে। এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।

 পদ্মা ও পদ্মার খালগুলি ইহাদের অধিকাংশের উপজীবিকা। কেহ মাছ ধরে, কেহ মাঝিগিরি করে। কুবেরের মতাে কেহ জাল ফেলিয়া বেড়ায় খাস পদ্মার বুকে, কুঁড়ােজাল লইয়া কেহ খালে দিন কাটায়। নৌকার যাহারা মাঝি, যাত্রী লইয়া মাল বােঝাই দিয়া পদ্মায় তাহারা সুদীর্ঘ পাড়ি জমায়, এ গাঁয়ের মানুষকে ও গাঁয়ে পৌছাইয়া দেয়। এ জলের দেশ। বর্ষাকালে চারিদিক জলে জলময় হইয়া যায়। প্রত্যেক বছর কয়েকটা দিনের জন্য এই সময়ে মানুষের বাড়িঘর আর উঁচু জমিগুলি ছাড়া সারাটা দেশ জলে ডুবিয়া থাকে জল যেবার বেশি হয় মানুষের বাড়ির উঠানও সেবার রেহাই পায় না। পথঘাটের চিহ্নও থাকে না। একই গ্রামে এ পাড়া হইতে ও পাড়ায় যাইতে প্রয়ােজন হয় নৌকার। কয়েকদিন পরে জল কমিয়া যায়, জলের ভিতর হইতে পথগুলি স্থানে স্থানে উঁকি দিতে আরম্ভ করে কিন্তু আরও এক মাসের মধ্যে পথগুলি ব্যবহার করা চলে না। যানবাহন এ দেশে একরকম নাই। মানুষের সম্বল নৌকা। উঠিতে বসিতে সকলের নৌকার দরকার হয়।

 নৌকার প্রয়ােজন কমে সেই শীতের শেষে, ফাল্গুন চৈত্র মাসে। খালে তখন জল থাকে না, মাঠে জলের বদলে থাকে ফসল অথবা ফসল-কাটা রিক্ততা। মানুষ মাঠের আলে আলে হাঁটিয়া গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে যায়।

 নৌকা চলে পদ্মায়। পদ্মা তাে কখনও শুকায় না। কবে এ নদীর সৃষ্টি হইয়াছে কে জানে। সমুদ্রগামী জলপ্রবাহের আজও মুহূর্তের বিরাম নাই। গতিশীল জলতলে পদ্মার মাটির বুক কেহ কোনােদিন দেখে নাই, চিরকাল গােপন হইয়া আছে।


জেলেপাড়া নদী হইতে বেশি দূরে নয়। তবু এইটুকু পথ চলিতেই কুবেরের কষ্ট হইতেছিল। নৌকায় সমস্ত পথটা আবােল-তাবােল বকিয়া গণেশ এতক্ষণে চুপ করিয়াছে। ধনঞ্জয় নৌকা হইতে নামে নাই। পাশের গ্রামে কুটুমবাড়িতে তাহার কী প্রয়ােজন ছিল। নৌকা লইয়া সে একাই সেখানে চলিয়া গিয়াছে।

 গণেশের বাড়িটাই পড়ে আগে। সে বাড়িতে ঢুকিল না। অসুস্থ কুবেরের সঙ্গে আগাইয়া চলিল।

 নকুল দাস ঘরের দাওয়ায় বসিয়া তামাক খাইতেছিল।কুবেরকে দেখিতে পাইয়া ডাকিয়া বলিল, অ কুবির শােন, শুইনা যা।

 গণেশ বলিল, কুবির জ্বরে বড়াে কাতর গাে।

 নকুল বলিল, জ্বর নাকি? তবে যা, বাড়িত্ যা। দ্যাখ গিয়া বাড়িতে কী কাণ্ড হইয়া আছে।

 এমন কথা শুনিয়া ব্যাপারটা না জানিয়া যাওয়া চলে না। কুবের উদ্‌বিগ্ন হইয়া বলিল, কীসের কাণ্ড নকুলদা?

 শ্যাষ রাইতে তর বউ খালাস হইছে কুবির।

 কুবের অবাক হইয়া বলিল, হ? নয় মাস পুইরা যে মাত্র কয়টা দিন গেছে নকুলদা। ইটা হইল কিবা?

 ক্যান? নয় মাসে খালাস হয় না?

 গণেশ জিজ্ঞাসা করিল, পুরুষ ছাওয়াল হইছে না?

 নকুল সায় দিয়া বলিল, হ। আমাগাের পাচী গেছিল, আইসা কয় কি কুবেরের ঘরে নি রাজপুত্তুর আইছে বাবা, ওই একরত্তি একখান পােলা, তার চাঁদপানা মুখের কথা কী কমু। রং হইছে গােরা।

 কুবেরের স্তিমিত চোখ দুটি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। নকুল শয়তানি হাসি হাসিয়া পরিহাস করিয়া বলিল, তুই তাে দেখি কালাকুষ্ঠি কুবির, গােরাচাঁদ আইল কোয়ান থেইকা? ঘরে তাে থাকস না রাইতে, কিচ্ছু কওন যায় না বাপু।

 গণেশ রাগিয়া বলিল, বউ গােরা না নকুলদা?

 হ, বউ তাে গােরাই, হ?

 এর বাড়ির পিছন দিয়া ওর বাড়ির উঠান দিয়া কুবের ও গণেশ এবার একটু জোরে জোরে পা ফেলিয়াই বাড়ির দিকে আগাইয়া গেল। গণেশ ভারী খুশি। বারবার সে বলিতে লাগিল, পােলা হইব কই নাই কুবির? কই নাই ইবার তর পােলা না হইয়া যায় না?

 শেষে বিরক্ত হইয়া কুবের বলিল, চুপ যা গণেশ। পােলা দিয়া করুম কী? নিজেগাের খাওন জোটে না, পােলা!

 গণেশ ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, তুই নি গােসা করস কুবির?

 করুম না? মইরবার কস নাকি আমারে তুই?

 তাহার মেজাজের এই আকস্মিক উত্তাপ গণেশের কাছে বড়ােই দুর্বোধ্য ঠেকিল। অত তাহার ভবিষ্যতের কথা ভাবিবার, হিসাব করিবার ক্ষমতা নাই। বউ থাকিলে মাঝে মাঝে ছেলেমেয়ে হয় এই পর্যন্ত সে জানে, সুবিধা অসুবিধার কথাটা ভাবিয়া দেখে না। তা ছাড়া পৃথিবীতে মানুষ আসিলে তাহাকে খাওয়ানাের দায়িত্ব যে মানুষের নয়, যিনি জীব দেন তাঁর, গণেশ এটা বিশ্বাস করে। সুতরাং ছেলে হওয়ার সংবাদে কুবেরের রাগ করিবার কী কারণ আছে সে ভাবিয়া পাইল না। ভাবিবার চেষ্টাও করিল না।

 বেড়া দেওয়া ছােটো একটি উঠানের দুদিকে দুখানা ঘর, কুবেরের বাড়ির এর বেশি পরিচয় নাই। এদিকের ঘরের সংকীর্ণ দাওয়ায় একটা ছেঁড়া মাদুর চট প্রভৃতি দিয়া ঘেরিয়া লওয়া হইয়াছে। চাহিলেই বুঝিতে পারা যায় ওটি আঁতুরঘর। কারণ চটের ফাঁক দিয়া ভিতরে শায়িতা মালাকে দেখিতে পাওয়া যাইতেছে।

 কুবের ওদিকের দাওয়াবিহীন ঘরটিতে ঢুকিয়া পড়িল। বাহিরে বর্ষার আকাশে কড়া রােদ উঠিলেও জানালা দরজার বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায় এ ঘরের ভিতরটা একটু অন্ধকার। কোনার দিকে রক্ষিত জিনিসগুলি চিনিতে হইলে ঠাহর করিয়া দেখিতে হয়। ঘরের একদিকে মাটিতে পোঁতা মােটা বাঁশের পায়ায় চৌকি সমান উঁচু বাঁশের বাতা বিছানাে মাচা। মাচার অর্ধেকটা জুড়িয়া ছেঁড়া কাঁথার বিছানা। তৈলচিক্কণ কালাে বালিশটি মাথায় দিয়া কুবেরের পিসি এই বিছানায় শয়ন করে। মাচার বাকি অংশটা হাঁড়িকলসিতে পরিপূর্ণ। নানা আকারের এতগুলি হাঁড়িকলসি কুবেরের জীবনে সঞ্চিত হয় নাই, তিন পুরুষ ধরিয়া জমিয়াছে। মাচার নীচেটা পুরাতন জীর্ণ তক্তায় বােঝাই। কুবেরের বাপের আমলের একটা নৌকা বারবার সারাই করিয়া এবং চালানাের সময় ক্রমাগত জল সেঁচিয়া বছর চারেক আগে পর্যন্ত ব্যবহার করা গিয়াছিল, তারপর একেবারে মেরামত ও ব্যবহারের অনুপযুক্ত হইয়া পড়ায় ভাঙিয়া ফেলিয়া তক্তাগুলি জমাইয়া রাখা হইয়াছে। ঘরের অন্যদিকে ছােটো একটা ঢেঁকি। ঢেঁকিটা কুবেরের বাবা হারাধন নিজে তৈয়ারি করিয়াছিল। কাঠ সে পাইয়াছিল পদ্মায়। নদীর জলে ভাসিয়া আসা কাঠ সহজে কেহ ঘরে তােলে না, কার চিতা রচনার প্রয়ােজনে ও-কাঠ নদীতীরে আনা হইয়াছিল কে বলিতে পারে? শবের মতাে চিতার আগুনের জড়তম সমিধটিরও মানুষের ঘরে স্থান নাই। কিন্তু এই ঢেঁকির কাঠটির ইতিহাস স্বতন্ত্র। কুবের তখন ছােটো, পদ্মানদীর মাঝির ছেলে যতটুকু বয়সে পদ্মায় সাঁতার দিবার মতাে পাকা সাঁতারু হইয়া উঠিতে পারে না, তত ছােটো। ছােটো একটি নৌকায় ছেলেকে সঙ্গে করিয়া হারাধন পদ্মা পার হইতেছিল। নদীর মাঝামাঝি পুরানো নৌকার তলাটা হঠাৎ কী করিয়া ফাঁসিয়া যায়। তখন আশ্বিন মাস, সেখানে পদ্মার এ তীর ও তীরের ব্যবধান তিন মাইলের কম নয়। পদ্মা যাহাকে বুকে করিয়া মানুষ করিয়াছে, পদ্মার বুকে যত ঢেউ থাক, মাইল দেড়েক সাঁতার দিয়া তীরে উঠা তার পক্ষে কষ্টকর কিন্তু অসম্ভব নয়। হারাধন একা হইলে ভাবনা ছিল না। কুবের আর একটু বড়াে এবং শক্তসমর্থ হইলেও সে বিপদে পড়িত না। কিন্তু ছেলেমানুষ কুবের ভয় পাইয়া সাঁতার দিতে চাহে নাই, দিশেহারা হইয়া ক্রমাগত হারাধনকে জড়াইয়া ধরিবার চেষ্টা করিয়াছিল। তখন যে লম্বা কাঠের গুঁড়িটি হাতের কাছে আগাইয়া আসিয়া তাহাদের বাঁচাইয়া দিয়াছিল, হয়তাে তাহা চিতা রচনার জন্যই কেহ শ্মশানে আনিয়াছিল। হারাধন কিন্তু কাঠটি ফেলিয়া দিতে পারে নাই, ঘরের আসবাবে পরিণত করিয়া সাদরে গৃহে স্থান দিয়াছে।

 কুবেরের পিসি আর তার বড় মেয়ে গােপি কুবেরকে দেখিয়াই চেঁচামেচি করিয়া কাছে আসিয়াছিল। কুবের কারও সঙ্গে কথা বলিল না। লম্বা হইয়া পিসির বিছানায় শুইয়া পড়িল।

 পিসি বলিল, শুলি যে ধন? বউ ওদিকে পােলা বিয়াইয়া সারছে, দেইখা আয়।

 গােপি বলিল, বাই উ ওই বাবুগাের পােলার নাখান ধলা হইছে বাবা। নকুইলার মাইয়া পাচী কী কইয়া গেল শুনবা? সায়েবগাে এমন হয় না। না পিসি?

 কুবের চেঁচাইয়া ধমক দিয়া বলিল, নকুইলা কী লাে হারামজাদি? জ্যাঠা কইবার পার না?

 গােপি মুখ ভার করিয়া বলিল, ক্যান কমু জ্যাঠা? বজ্জাতটা আমারে যা মুখে লয় কয় না?

 কী কয়?

 রাইত কইরা মাইজাবাবু নি আমাগাের বাড়ি আহে তাই জিগায়। ইবার জিগাইলে একদল পাঁক দিমুনে ছুঁইড়া মুখের মধ্যে।

 দিস, বলিয়া কুবের ঝিমাইতে থাকে। খানিক পরেও ঘরের দাওয়া হইতে শিশুর জোরালাে কান্না শুনিতে পাওয়া যায়। মনে হয় ছেলেটা আগেভাগে আসিয়া পড়িলেও গলায় রীতিমতো জোর করিয়া আসিয়াছে। চেচাঁইতে পারে।