কয়েকদিন পরে ছিল রথ।

 রথ উপলক্ষে কেতুপুরে কোনােরকম ধুমধাম হয় না। পদ্মার ওপারে আছে সােনাখালি গ্রাম, রথের উৎসব হয় সেইখানে। সােনাখালির জমিদারের ছােটো একটি রথ বাহির হয়। সােনাখালি হইতে মােহনপুর অবধি দশ মাইল লম্বা একটি উঁচু পথ আছে। বর্ষাকালে এই পথটিই এ অঞ্চলে জলের নীচে ডুবিয়া যায় না। পথটির নাম ছ-কোশের পথ। নামের মধ্যে পথটির এক ক্রোশ দৈর্ঘ্য কেমন করিয়া বাড়িয়া গিয়াছে বলা যায় না। সােনাখালির জমিদারদের রথ এই পথ ধরিয়া আধ মাইল খানেক গিয়া অন্নবাবার মাঠের একপাশে থামিয়া থাকে সাতদিন, তারপর উলটারথের দিনে আবার রওনা হয় জমিদারবাড়ির দিকে। স্থানটির অন্নবাবার মাঠ নাম হওয়ার একটু ইতিহাস আছে। অনেকদিন আগে এ অঞ্চলে একবার ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়। সে সময় কোথা হইতে এক সন্ন্যাসী আসিয়া এই মাঠে আস্তানা গাড়েন এবং একটি বিরাট অন্নসত্র খুলিয়া দেন। নিজের বলিতে সন্ন্যাসীর এক কানাকড়ি সম্বলও ছিল না। শােনা যায়, এমনই আশ্চর্য ছিল মানুষের উপর তাঁহার প্রভাব যে সামনে দাঁড়াইয়া চোখে চোখে চাহিয়া তিনি হুকুম দিতেন আর বড়াে বড়াে জমিদার মহাজনেরা মনে মনে চাল ডাল পাঠাইয়া দিত এই মাঠে। শত শত ভদ্র গৃহস্থ নিজেরাই কোমর বাঁধিয়া তাহা রান্না করিয়া দুর্ভিক্ষপীড়িত নরনারীদের বিতরণ করিত অন্ন। ব্যাপারটা যে ঠিক এইরকমই ঘটিয়াছিল তার কোনাে প্রমাণ এখন আর নাই। যেসব বড়াে বড়াে উনানে সেই বিরাট ক্ষুধা-যজ্ঞের আগুন জ্বলিত আজ তাহার একটু কালির দাগ পর্যন্ত কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।

 রথের দিন এই মাঠে প্রকাণ্ড মেলা বসে, উলটারথ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পদ্মা আগে তফাতে ছিল, এখন এত কাছে সরিয়া আসিয়াছে যে মেলার একটা প্রান্ত প্রায় নদীতীরেই আসিয়া ঠেকে। স্থলপথ ও জলপথে দল বাঁধিয়া আসিয়া মানুষ মেলায় ভিড় বাড়ায়। ভিড় বেশি হয় প্রথম এবং শেষ দিন, মাঝখানের কদিন মেলা একটু ঝিমাইয়া যায়। গ্রামবাসীর প্রয়ােজনীয় ও শখের পণ্য সমস্তই মেলায় আমদানি হয়, এমনকি শহরের নারী-পণ্যের আবির্ভাবও ঘটিয়া থাকে। কাপড়ের দোকান, মনােহারি দোকান, মাটির খেলনার দোকান, খাবারের দোকান, দোকান যে কত বসে তার সংখ্যা নাই। গােরু-ছাগল বিক্রয় হয়, কাঁটাল ও আনারসে মেলার একটা দিক ছাইয়া যায়, বড়াে বড়াে নৌকায় মালদহ ও ত্রিহুতের আম আসে। লেমােনেডের নামে বােতলে ভরা স্যাকারিনের লাল নিস্তেজ জল বিক্রয় হয় অজস্র। মেয়েরা সাধ মিটাইয়া শাঁখা ও কাচের চুড়ি পরে, ছেলেদের কোমরে বাঁধিয়া দেয় নূতন ঘুনসি। কয়েকটি স্থানে গবর্নমেট হইতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত জুয়াখেলা চলে। মেলার এটা একটি প্রধান অঙ্গ। সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় বালা খেলার কাছে। চারকোনা বাঁশের বেড়ার চারিদিকে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া চার-চার পয়সায় চার-চার বালা কিনিয়া বেশির ভাগ গরিব চাষাভুষারাই হরদম ছুঁড়িতে থাকে, রুদ্ধনিশ্বাসে চাহিয়া দেখে নিক্ষিপ্ত বালা ক-টি লাল শালুতে সাজানাে টাকা আধুলি সিকি ও দোয়ানির অরণ্যে অন্ধের মতাে ঘুরিয়া ঘুরিয়া স্থির হইতেছে ফাঁকা জায়গায়। পুনরাবর্তিত ব্যর্থতায় তাহাদের কোনােমতে যেন বিশ্বাস হইতে চায় না। কত কাছাকাছি সাজানাে মুদ্রাগুলি, ফাঁকা জায়গাই যে কম! ওদের মধ্যে কে বুঝি বউয়ের জন্য একখানা পাছাপাড় শাড়ি, ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু খেলনা ও খাবার এবং সংসারের জন্য কী সব জিনিস কিনিতে অনেক দিনের চেষ্টায় জমানাে ক-টা টাকা আনিয়াছিল, দ্যাখাে, সন্ধ্যার সময় দূরের মানুষ যখন বাড়ির দিকে শ্রান্ত পা বাড়াইয়াছে বেচারির কাছে বিড়ি কিনিবার পয়সাও নাই! আজীবন উপার্জন করিয়া সে পরকে খাওয়াইয়াছে, সে যে কী নিরীহ গৃহস্থ! কারও কথা না ভাবিয়া আজ সে এ কী করিয়া বসিল? একবেলা স্বাধীনভাবে স্বার্থপরতা করিবার সুযােগ পাইয়া নিজেকে সামলাইতে পারিল না?

 রথের দিন সকাল হইতে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি নার্মিয়াছিল। বেলা বাড়িলে নিদ্রাতুর চোখ মিটমিট করিতে করিতে গণেশ কুবেরের বাড়ি আসিল।

 কুবের তখনও ঘুমাইতেছিল। গণেশ তাহাকে ডাকিয়া তুলিল। বলিল, চল্ কুবির, না-টা ঠিক কইরা থুইয়া আহি। আমারে ডাইকা আজান খুড়া নায় গিয়া বইয়া আছে।

 কুবের প্রকাণ্ড একটা হাই তুলিয়া বলিল, বয় গণশা, বয়। অ পিসি,আমারে আর গণশারে দুগা মুড়ি দিবা গাে? আ লাে গােপি, আমারে নি এক ঘটি জল দিবার পারস? ঘরে মুড়ি ছিল না। কদাচিৎ থাকে। পিসি চারটি চিড়া আর একটু গুড় দিয়া গেল। গুড় মুখে দিয়া শুকনাে চিড়া চিবাইতে চিবাইতে কুবের বলিল, খা গণশা। রথের বাদলা নামছে দেখছস?

 হ।

 চালায় ছন চাপান লাগে। রাইতের বাদলায় ঘরে জল পড়ছিল, দ্যাখ।

 গণেশ চাহিয়া দেখিল, জল পড়িয়া ঘরের একটা কোণ সত্যই ভাসিয়া গিয়াছে। জিহ্বা দিয়া সে একটা আপশােশের শব্দ করিল। বলিল, কোণ দিয়া পড়ছে তাই বাঁচান, না তাে জিনিসপত্তর সকল ভাইসা যাইত। চালায় চাপাইবি নাকি ছন আইজ? মেলায় গেলি তাে সময় পাবি না?

 কুবের মাথা নাড়িয়া বলিল, ছন কই? নাই তাে।

 ছিল যে ছন?

 গােপির মার বিছানায় পাইতা দিছি।

ব্যাপারটা বুঝিয়া গণেশ গম্ভীর মুখে সায় দিয়া বলিল, ভালা করছস। যা বাদলা!

 ধীরে ধীরে তাহারা চিড়া চিবাইতে লাগিল। গণেশ যে তাগিদ লইয়া আসিয়াছিল সে যেন তাহারা ভুলিয়া গিয়াছে। খাওয়া বন্ধ করিল গণেশ আগে। বাড়ি হইতে সে দুটি পান্তা খাইয়া আসিয়াছে, কুবের খাক। ঘটিটা উঁচু করিয়া মুখে ঢালিয়া সে জল খাইল। আরও দুটি চিড়া মুখে দিয়া বাকিগুলি কুবের দান করিয়া দিল তাহার বড়ােছেলেকে। বলিয়া না দিলে চিড়াগুলি সে একাই খাইতে পারে সন্দেহ করিয়া বলিল, চণ্ডীরে দুগা দিস লখ্যা, আঁই?

 লখা মাথা নাড়িয়া বলিল, উঁহুক। উয়ারে পিসি দিব।

 পিসির আর নাই। দে কইলাম লখ্যা!

 কুবেরের দুই ছেলেই উলঙ্গ। বর্ষার ভাপসা গুমােটে ঘামিয়া তাহাদের শীর্ণ দেহ চকচক করিতেছে। পিতৃদত্ত প্রসাদের ভাগ বাটোয়ারা লইয়া ঘরের কোণে দুজনের একটা ছােটোখাটো কলহ বাধিয়া গেল। কুবের আর চাহিয়াও দেখিল না। এ যে তাহার ঠিক উদাসীনতা তা বলা যায় না। মনে মনে তাহার একটা অস্পষ্ট উদ্দেশ্যই বুঝি আছে। শিক্ষা হােক। নিজের নিজের ভাগ বুঝিয়া লইতে শিখুক! দুদিন পরে জীবনযুদ্ধে সমস্ত জগতের সঙ্গে যখন তাহাদের লড়াই বাধিবে তখন মধ্যস্থতা করিতে আসিবে কে?

 ঘটিটা তুলিয়া লইয়া ঘরের সামনে সংকীর্ণ দাওয়ায় উবু হইয়া বসিয়া কুবের উঠানে কুলকুচা করিল। গণেশের মতাে ঘটি উঁচু করিয়া আলগােছে জল খাইয়া কলিকায় তামাক সাজিতে বসিল। পিসি দাওয়ার এক পাশে ইলিশ মাছের তেলে ইলিশ মাছ ভাজিতেছে। অন্য পাশে মালার আঁতুড়। নিচু দাওয়ার মাটি জল শুষিয়া শুষিয়া ওখানটা বাসের অযােগ্য করিয়া দিয়াছে, তবু ওইখানেই ভিজা স্যাঁতসেঁতে বিছানায় নবজাত শিশুকে লইয়া মালা দিবারাত্রি যাপন করিবে। উপায় কী? যে নােংরা মানুষের জন্মলাভের প্রক্রিয়া! বাড়িতে ঘর থাকিলেও বরং একটা ঘর অপবিত্র করিয়া ফেলা চলিত। দুখানা কুঁড়ে যার সম্বল তার স্ত্রী আর কোথায় সন্তানকে জন্ম দিবে? ভদ্রলােকেরা উঠানে অস্থায়ী টিনের ঘর তুলিয়া দেয়, চৌকির ব্যবস্থা করে। যারা আরও বেশি ভদ্রলােক তাদের থাকে শুকনাে খটখটে স্থায়ী আঁতুড়ঘর। কুবেরের তাে সে ক্ষমতা নাই। তার যতখানি সাধ্য সে তা করিয়াছে। ভালাে করিয়া বেড়া দিয়া বৃষ্টির ছাঁট আটকাইয়াছে, ঘর ছাইবার শনগুলি বিছানার তলে পাতিয়া দিয়াছে, দেবীগঞ্জের রেল কোম্পানির কয়লা চুরি করিয়া আগুনের ব্যবস্থা করিয়াছে। আর সে কী করিতে পারে?

 হঠাৎ এক মিনিটেরও কম সময় ব্যাপিয়া ঝুপঝুপ করিয়া জোরে বৃষ্টি হইয়া গেল। তারপর যেমন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়িতেছিল তেমনি পড়িতে লাগিল। গণেশ দরজার কাছে সরিয়া আসিয়া বলিল, যাবি না কুবির?

 কুবের বলিল, হ, ল যাই। আইচ্ছা তুই ক দেখি গণেশ, হীরুজ্যাঠার ঠাঁই দুগা ছন চামু নাকি? দিব না?

 গণেশ বলিল, হীরুজ্যাঠা ছন দিব? জ্যাঠারে তুই চিনস না কুবির, কাইলের কাণ্ড জানস? বিহানে ঘরে ফির‍্যা শুমু, বউ কয় চাল বাড়ন্ত। খাও আইঠা কলা, ভর রাইত জাইগা ঘুমের লাইগা দুই চক্ষু আঁধার দ্যাহে—চাল বাড়ন্ত! বউরে কইলাম, হীরুজ্যাঠার ঠাঁই দুগা চাল কর্জ আন্‌গা, দুপুরে গাঁয়ে গিয়া কিনা আনুম। কলি না পিত্যয় যাবি কুবির, বউরে জ্যাঠা ফিরাইয়া দিল। কয় কী, বিষ্যুদবার কর্জ দেওন মানা।

 কুবের সবিস্ময়ে বলিল, হ? তর নিজের জ্যাঠা না?

 নিজের জ্যাঠা বইলাই পিরিত য্যান বেশি কুবির। খালি নিবার পারে, দিবার পারে না।

 এই কথাগুলি বলিতে পারার মধ্যে গণেশের পক্ষে বিস্ময়কর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় আছে। কবের শিরশ্চালনায় সায় দিয়া বলিল, আমার ঘরে পাঠালি না ক্যান বউরে?

 গণেশ যেমন বােকা, তেমনি সরল। সে বলিল, তুই চাল পাবি কনে?

 একথায় অপমান বােধ করিয়া কুবের উঠিল রাগিয়া।

 চাল পামু কনে! ক্যান, আমরা ভাত খাই না? গরিব বইলা দুগা চাল কর্জ না দেওনের মতাে গরিব আমি না, জাইনা থুইস!

 কুবের রাগে ও গণেশ লজ্জায় খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। শেষে গণেশ আস্তে আস্তে বলিল, গােসা করলানি কুবিরদা?

 মাঝে মাঝে, কুবেরের রাগের সময়, ভীরু গণেশ তাহাকে সম্মান করিয়া তুমি সম্বোধন করে।

 করুম না! গাও জ্বালাইনা কথা কস যে! আজান খুড়া বইয়া আছে, ল যাই।

 কুবের উঠানে নামিয়া গেল। বৃষ্টিতে ভিজিয়া ভিজিয়া উঠানটা কাদা ও পিছল হইয়া আছে। গৃহাঙ্গনের এই নােংরা পচা পাঁকের চেয়ে নদীতীরের কাদা অনেক ভালাে। সেই কাদায় হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়া গেলেও যেন এরকম অস্বস্তি বােধ হয় না। বাড়ির পাঁকে পায়ে হাজা হয়, পাক ঘাঁটিয়া যাহার জীবিকা অর্জন করিতে হয়, সেই পাঁকের সংস্পর্শে তাহারও পা কুটকুট করে। আকস্মিক ক্রোধে কুবের ছেলেমানুষের মতাে উঠানে একটা লাথি মারিল। পায়ের পাতার একটা পরিষ্কার ছাপ মাত্র উঠানে পড়িল, আর কিছু হইল না।

 আঁতুড় হইতে ক্ষীণস্বরে মালা বলিল, আ গাে যাইও না, শুইনা যাও। চালা দিয়া নি ঘরে জল পড়ছে? ছনগুলা লইয়া যাও, বিছানার তলে ছন দেওন না দেওন সমান।

 মালার মুখে এমন নিঃস্বার্থ উক্তি প্রায় শােনা যায় না। কুবেরের মুগ্ধ হওয়া উচিত ছিল কিন্তু তার পরিবর্তে সে বিরক্ত হইয়াই বলিল, কিয়ের সমান! ছন না পাইতা ভিজা ভিতে শােওন যায়? রঙ্গ কইরা কাম নাই, চুপ মাইরা শুইয়া থাক। চালার লাইগা ছন লাগে, আইনা লমু।

 হােসেন মিয়া না কইছিল খড় দিব?

 হােসেন মিয়া কইলকাতা গেছে।

 মালা আপশোশ করিয়া বলিল, কবে গেল? আগে নি একবার কইলা! এক পয়হার। সুই আইনবার কইতাম—কইলকাতায় পয়হায় দশখান পাওন যায়।

 কলিকাতা হইতে মালা এক পয়সার ছুঁচ আনিতে দিত শুনিয়া কেহ হাসিল না। পিসি বরং মালার কথায় সায় দিয়াই কী যেন বলিল, ঠিক বােঝা গেল না। জবাব দিবার প্রয়ােজন ছিল না। কুবেরের পায়ের আঙুলের ফাঁকে হাজার ঘায়ে বিষাক্ত পাক কামড়াইতেছিল। সে নীরবে বাহির হইয়া গেল।

 নদীতীরে নৌকায় তাহাদের কাজ ছিল। খাওয়া-দাওয়ার পর নৌকা লইয়া তাহারা সােনাখালির মেলায় যাইবে। সঙ্গে ছেলেমেয়েরা থাকিবে, কেতুপুর ও আশেপাশের গ্রাম হইতে এমন যাত্রীও পাওয়ার সম্ভাবনা আছে যাহারা ভাড়া দিয়া মেলায় যাইবে। নৌকাটা একটু সাফ করিয়া একটা অস্থায়ী হােগলার ছই খাটাইয়া দেওয়া দরকার। নৌকার ছােটো পালটি মেরামত করিবার জন্য নামানাে হইয়াছিল, বাঁশের মাস্তুলে সেটিও আবার ঠিক করিয়া খাটাইতে হইবে। বর্ষাকালে বাতাস প্রায় সােনাখালির দিকেই বহিতে থাকে, গুমােট করিয়া সামান্য বাতাস যদি উঠে, পাল তুলিয়া মেলায় পৌঁছিতে আজ এক ঘণ্টা সময়ও লাগিবে না।

 নদীর ধারে পৌঁছিয়া তাহারা দেখিতে পাইল ছাতি মাথায় দিয়া হােসেন মিয়া দাঁড়াইয়া আছে। ঘর ছাইবার জন্য হােসেনের কাছে বিনামূল্যে কিছু শণ পাইরের সম্ভাবনা ছিল, তাহাকে দেখিয়া কুবেরের খুশি হওয়াই উচিত ছিল। তবু লােকটার আবির্ভাবে চিরদিন যে দুর্জ্ঞেয় আশঙ্কা তাহাকে অস্বস্তি বােধ করায় আজও সেই আশঙ্কাই হঠাৎ তাহাকে দাঁড় করাইয়া দিল। চুপিচুপি বলিল, হােসেন মিয়া রে গণেশ!

 তাই তাে দেহি!

একটু রহস্যময় লােক এই হােসেন মিয়া। বাড়ি তাহার নােয়াখালি অঞ্চলে। কয়েক বৎসর হইতে কেতুপুরে বাস করিতেছে। বয়স তাহার কত হইয়াছে চেহারা দেখিয়া অনুমান করা যায় না, পাকা চুলে সে কলপ দেয়, নুরে মেহেদি রং লাগায়, কানে আতর মাখানাে তুলা গুঁজিয়া রাখে। প্রথম যখন সে কেতুপুরে আসিয়াছিল পরনে ছিল একটা ছেঁড়া লুঙ্গি, মাথায় একঝাঁক রুক্ষ চুল—ঘষা দিলে গায়ে খড়ি উঠিত। জেলেপাড়ানিবাসী মুসলমান মাঝি জহরের বাড়িতে সে আশ্রয় লইয়াছিল, জহরের নৌকায় বইঠা বাহিত। আজ সে তাহার বেঁটে খাটো তৈলচিক্কণ শরীরটি আজানুলম্বিত পাতলা পাঞ্জাবিতে ঢাকিয়া রাখে, নিজের পানসিতে পদ্মায় পাড়ি দেয়। জমি-জায়গা কিনিয়া, ঘরবাড়ি তুলিয়া, পরম সুখেই সে দিন কাটাইতেছে। গত বছর নিকা করিয়া ঘরে আনিয়াছে দু-নম্বর স্ত্রীকে। এইসব সুখের ব্যবস্থা সে যে কী উপায়ে করিয়াছে গ্রামের লােক ঠিক অনুমান করিয়া উঠিতে পারে না। নিত্য নূতন উপায়ে সে অর্থোপার্জন করে। নৌকা লইয়া হয়তাে সে পদ্মায় মাছ ধরিতে গেল—গেল সে সত্যই, কারণ যাওয়াটা সকলেই দেখিতে পাইল, কিন্তু পদ্মার কোনখানে সে মাছ ধরিল, মাছ বিক্রিই বা করিল কোন বন্দরে, কারও তাহা চোখে পড়িল না। তাহার নৌকার মাঝিদের জিজ্ঞাসা করিয়া একটা গল্প মাত্র শােনা গেল যে, যে বন্দরে তাহারা মাছ বিক্রয় করিয়াছে সেখানে নৌকায় যাতায়াত করিতে নাকি সাত-আট দিন সময় লাগে। তারপর কয়েকদিন হয়তাে হােসেন গ্রামেই বসিয়া থাকে, একেবারে কিছুই করে না। হঠাৎ একদিন সে উধাও হইয়া যায়। পনেরাে দিন এক মাস আর তাহার দেখা মেলে না। আবির্ভাব তাহার ঘটে হঠাৎ, এবং কিছুদিন পরে দুশাে গােরু ছাগল চালান হইয়া যায় কলিকাতায়।

 বড়াে অমায়িক ব্যবহার হােসেনের। লালচে রঙের দাড়ির ফাঁকে সবসময়েই সে মিষ্টি করিয়া হাসে। যে শত্রু, যে তাহার ক্ষতি করে, শাস্তি সে তাহাকে নির্মমভাবেই দেয় কিন্তু তাহাকে কেহ কোনােদিন রাগ করিতে দেখিয়াছে বলিয়া স্মরণ করিতে পারে না। ধনী-দরিদ্র, ভদ্র অভদ্রের পার্থক্য তার কাছে নাই, সকলের সঙ্গে তার সমান মৃদু ও মিঠা কথা। মাঝে মাঝে এখনও সে জেলেপাড়ায় যাতায়াত করে, ভাঙা কুটিরের দাওয়ায় ছেঁড়া চাটাইয়ে বসিয়া দা কাটা কড়া তামাক টানে। সকলে চারিদিকে ঘিরিয়া বসিলে তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠে। এইসব অর্ধ উলঙ্গ নােংরা মানুষগুলির জন্য বুকে যেন তাহার ভালােবাসা আছে। উপরে উঠিয়া গিয়াও ইহাদের আকর্ষণে নিজেকে সে যেন টানিয়া নীচে নামাইয়া আনে। না, মনে মনে ইহা বিশ্বাস করে না জেলেপাড়ার কেহই; জীবনযুদ্ধে জয়-পরাজয়ের একেবারে মিলন-সীমান্তে তাহারা বাস করে, মিত্র তাহাদের কেহ নাই। তবে বিশ্বাস অবিশ্বাসের জন্য কিছু আসিয়া যায় না। হােসেন মিয়া হাসিমুখে একেবারে বাড়ির ভিতরে গিয়া জাঁকিয়া বসিয়া তাহার গােপন, গভীর ও দুর্জ্ঞেয় মতলব হাসিলের আয়ােজন আরম্ভ করিলেও জেলেপাড়ায় এমন কেহ নাই যে তাহাকে কিছু বলিতে পারে। বলিতে হয়তাে পারে। বলে না শুধু এইজন্যে যে বলা নিরর্থক। তাতে কোনাে লাভ হয়না। যা সে ঘটায় সমস্তই স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী। অন্যথা করিবার জন্য বুক ঠুকিয়া দাঁড়াইলে কার কী লাভ হইবে? তার চেয়ে বর্ষাকালে ঘরের ফুটা চাল যদি একটু মেরামত হয়, উপবাসের সময় বিনা সুদে যদি কিছু কর্জ মেলে, তাই ঢের লাভ।

 হােসেন মিয়ার গােপন মতলবের দুটো একটার খবর যে জেলেপাড়ার লােকেরা রাখে না তা নয়। জেলেপড়ার তিনটি পরিবার উধাও হইয়া গিয়াছে। হােসেন মিয়া যে ছেলে বুড়াে স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে এক একটি সমগ্র পরিবারকে কোথায় রাখিয়া আসিত প্রথমে কেহ তাহা টের পায় নাই, পরে জানা গিয়াছিল নােয়াখালির ওদিকে সমুদ্রের মধ্যে ছােটো একটি দ্বীপে প্রজা বসাইয়া সে জমিদারি পত্তন করিতেছে। সে দ্বীপ নাকি গভীর জঙ্গলে আবৃত, শহর নাই, গ্রাম নাই, মানুষের বসতি নাই, শুধু আছে বন্য পশু এবং অসংখ্য পাখি।

 কিছু কিছু জঙ্গল সাফ করিয়া এই দ্বীপে হােসেন মিয়া ঋণগ্রস্ত উপবাসখিন্ন পরিবারদের উপনিবেশ স্থাপন করিতেছে। লােভ দেখাইয়া, আশা দিয়া, এক একটি নিরুপায় পরিবারকে সে এই দ্বীপে লইয়া যায়, সৃষ্টির দিন হইতে কখনও আবাদ হয় নাই এমন খানিকটা জমি দেয়, থাকিবার জন্য ঘর দেয়, আবাদের জন্য দেয় হাল বলদ ও জঙ্গল কাটিবার জন্য যন্ত্রপাতি। অন্যান্য স্থান হইতে আরও কতগুলি পরিবারকে সে ওখানে লইয়া গিয়াছে কে জানে, কেতুপুরের জেলেপাড়ার তিন ঘর মাঝিকে সে যে আদিম অসভ্য যুগের চাষায় পরিণত করিয়াছে এ খবর জেলেপাড়ার কারও অজানা নাই। তবু জানা না জানা তাহাদের পক্ষে সমান। মাথা নিচু করিয়া তাহারা হােসেন মিয়ার দেওয়া উপকার গ্রহণ করিবে। মনুষ্যবাসের অযােগ্য সেই দ্বীপকে জনপদে পরিণত করার আহ্বান আসিলে যতদিন পারে মাথা নাড়িয়া অস্বীকার করিবে, যেদিন পারিবে না সেদিন স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরিয়া, নিঃশব্দে হােসেন মিয়ার নৌকায় গিয়া উঠিবে।

 তাই মনে মনে লােকটাকে ভয় করিলেও কাছে গিয়া কুবের বলিল, ছালাম মিয়া বাই।

 হােসেন বলিল, ছালাম। কেমন ছিলা মাঝি? কাহিল মালুম হয়?

 জ্বরে ভুগলাম। কইলকাতার থনে আলেন কবে?

 আইজ আলাম। আর গণেশ বাই, খবর কী? মেলায় যাবা না?

 গণেশ ঢোঁক গিলিয়া বলিল, যামু মিয়া বাই, মেলায় যামু। পােলাপানেরা মেলায় যাওনের লেইগা খেইপা আছে, না গেলে চলব ক্যান?

 গুমটি দিছে, বাদাম চলব না, সকাল সকাল রওনা দিবা। বদর কইও মাঝি, সাঁঝের আগে ফির‍্যা আইও, আসমান ভালাে দেখি না। শুইনা আলাম আজকালির মদ্যি জবর ঝড় হইবার পারে।

 কুবের আকাশের দিকে ও নদীর দিকে চাহিল। পাতলা কুয়াশার মতো মেঘ আকাশ ভরিয়া আছে, নিস্তরঙ্গ পদ্মার বুকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিপাতে অসংখ্য ছােটো ছােটো বুদবুদ উঠিয়া ফাটিয়া গেলে যেমন দেখায় তেমনি দেখাইতেছে। নদীর অপর তীর চোখে পড়ে না, নদীর মাঝখানের নৌকা পর্যন্ত অস্পষ্ট। আরও এদিকে একটি স্পষ্টতর নৌকার দিকে চোখ রাখিয়া কুবের সংক্ষেপে প্রশ্ন করিল, যামু না মেলায়? বারণ করেন নাকি মিয়া বাই?

 হােসেন বলিল, যাবা না ক্যান? ডর কিসির? আসমান দেইখা রওনা দিবা, আসমান দেইখা ফিরবা। বাদলা দিনের ঝড় জানান দিয়া আহে।

 সায় দিয়া কুবের নৌকায় উঠিল। মুসলমান মাঝির দুটি নৌকা ইতিমধ্যেই মেলায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল, দুটি নৌকাই একসঙ্গে ছাড়িয়া গেল। নদীর জল তুলিয়া নৌকা ধুইতে ধুইতে কুবের একসময় চাহিয়া দেখিল, হােসেন চলিয়া গিয়াছে। চালার জন্য অবিলম্বে প্রয়ােজনীয় শণের কথাটা এতক্ষণে তাহার মনে পড়িয়াছে, হােসেনকে বলিয়া রাখিলে ভালাে হইত। লােকটা এই আছে, এই নাই। শণের জন্য কাল সকালে হয়তাে ওর বাড়ি গিয়া শুনিবে, রাতারাতি ও ঢাকায় পাড়ি দিয়াছে। কবে ফিরিবে? কে তাহা জানে!

 হােগলার ছাউনিটা বাতার সঙ্গে বাঁধিতে বাঁধিতে কুবের হঠাৎ সচকিত হইয়া বলিল, কে হাঁকে রে গণশা?

 বহুদূর নদীবক্ষ হইতে হাঁক আসিতেছিল, মানব কণ্ঠের একটানা একটা ক্ষীণ আওয়াজ। দুই কানের পিছনে হাত দিয়া হাঁক শুনিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কুবের সাড়া দিয়া উঠিল। এ এক ধরনের ভাষা, পূর্ববঙ্গের মাঝিশ্রেণির লােক ছাড়া এ ভাষা কেহ জানে না। এ ভাষায় কথা নাই, আছে শুধু তরঙ্গায়িত শব্দ। উন্মুক্ত প্রান্তরে, বিস্তৃত নদীবক্ষে এ শব্দ দূর হইতে দূরে চলিয়া যায়, ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া আসে কিন্তু তরঙ্গের তারতম্য অবিকল থাকিয়া যায়। অস্ফুট গুঞ্জনের মতাে মৃদু হইয়াও যদি কানে আসিয়া লাগে, পদ্মানদীর মাঝি কান পাতিয়া শুনিয়া অর্থ বুঝিতে পারে। শব্দের দুর্লক্ষ্য উৎসের দিকে চাহিয়া সে বুক ভরিয়া বাতাস গ্রহণ করে। বাঁ হাত কানের পিছনে রাখিয়া, ডান হাতটি মুখের সম্মুখে আনিয়া সঞ্চালিত করিয়া উচ্চারিত একটানা আওয়াজে সে তরঙ্গের সৃষ্টি করে।

 ধনঞ্জয় মন দিয়া শােনে নাই। সে জিজ্ঞাসা করিল, কেডা? কী কয়?

 কুবের কহিল, আমাগাের রাসু।

 ধনঞ্জয় অবাক হইয়া গেল।

 বিন্দা মাঝির পােলা? কস কী কুবির! শুনছসনি ঠিক?

 রাসুর গলা চিনি না খুড়া? অখনি আইবাে, দেইখাে।

 ধনঞ্জয়ের বিস্ময় কমিতে চায় না। বহুদূরের নৌকাটির দিকে চাহিয়া সে বলিল, রাসু না হােসেন মিয়ার দ্বীপে গেছিল?

 হ।

 আইল কিবা?

 কুবের বিরক্ত হইয়া কহিল, কিবা কমু খুড়া? আহুক, জিগাইও। হােসেন মিয়া ছাইড়া দিবার পারে, ও নিজে পলাইয়া আইবার পারে, না জিগাইয়া নি কওয়ন যায়?

 খানিক পরে আবার হাঁক আসিল, এবার আরও স্পষ্ট। হাঁকের আওয়াজে যে একটি উৎসুক সুর ছিল তিনজনের কানেই তাহা ধরা পড়িল। গণেশ কুবেরের মুখের দিকে চাহিয়া কী বলিতে গিয়া হাঁ করিয়া কিছুই বলিল না। হাঁকের জবাব দিবার জন্য কুবের সুদীর্ঘ শ্বাস গ্রহণ করিল।


কিছুক্ষণ পরে একটা জীর্ণ পুরাতন নৌকা আসিয়া ভিড়িল পাশে। দুজন অচেনা মাঝি নৌকা বাহিয়া আসিয়াছে। ভিন গাঁয়ের নৌকা। নৌকার খােলটা কাঁটালে এমনভাবেই বােঝাই করা হইয়াছে যে নৌকার প্রান্তভাগ জলের উপর কয়েক ইঞ্চিমাত্র ভাসিয়া আছে। উপরে কোনােরকম আবরণ নাই, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে মাঝি দুজন এবং রাসু তিনজনেই ভিজিয়া গিয়াছে। তাড়া দিয়া রাসুকে এ নৌকায় নামাইয়া দিয়া মাঝি দুজন বােধ হয় বিড়বিড় করিয়া তাহাকে গাল দিতে দিতেই তৎক্ষণাৎ আবার ঠেলা দিয়া নৌকার মুখ ফিরাইয়া বইঠা ধরিল। পদ্মানদীর চিরন্তন রীতি অনুসারে কুবের জিজ্ঞাসা করিল, কোন গাঁও থেইকা আইলা মাঝি, যাইবা কোয়ানে?

 জবাব দিবার রীতিও চিরন্তন। তাহারা সক্রোধে বলিল, সুলপী থেইকা আইলাম, যামু মেলায়।

 রাগের কারণটা তাহাদের সহজেই বােঝা যায়। সুলপী হইতে সােজাসুজি সােনাখালির মেলায় যাওয়ার বদলে রাসুকে এখানে পৌঁছাইয়া দিতে তাহাদের পদ্মা পার হইতে হইয়াছিল। প্রতিদানে রাসু যে তাহাদের কিছুই দিতে পারে নাই তাহাও অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কিন্তু এ ক্রোধ তাহাদের ফলপ্রসু নয়—এ শুধু ক্রোধ। রাসুর মতাে দুরবস্থায় পড়িয়া আবার যখন কেহ তাহাদের পদ্মা পার করিয়া দিবার অনুরােধ জানাইবে এমনিভাবে রাগিয়া উঠিলেও সেই নিরুপায় মানুষটিকে তাহারা না বলিতে পারিবে না, বিনা প্রত্যাশায় বােঝাই নৌকা লইয়া তিন ক্রোশ অতিরিক্ত বইঠা বাহিবে। ইহা মহত্ব নয়, পরােপকার নয়—ইহা রীতি, অপরিহার্য নিয়ম। আশ্চর্য এই, এ নিয়ম পালন করিয়া ক্রুদ্ধ হইয়া উঠাও অনিয়ম নয়।

{{ফাঁক}নৌকায় পা দিয়া রাসু খানিকক্ষণ আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর কুবেরকে জড়াইয়া ধরিয়া গদগদ কণ্ঠে বলিল, আমি আলাম গাে কুবিরদা।

 কন থে আলি রাসু?

 কই কুবিরদা, কই। তােমাগাে দেইখা মুখে রাও সরে না, কতকাল পরে ফিরা আলাম!

 কুবের ও গণেশ তাহার চোখে জল দেখিতে পাইল। ধনঞ্জয় পড়িয়াছিল তাহার পিছনে, সে উপস্থিত থাকিতে রাসু যে আসিয়া পৌঁছিয়াই কুবেরকে জড়াইয়া ধরিয়া আহ্লাদে ডগমগ হইয়া উঠিল ইহাতে মনে মনে সে ঈর্ষাতুর ও অসন্তুষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। রাসুর আবির্ভাবে উত্তেজনা তাহারও কম হয় নাই। তাহা গােপন করিয়া শান্ত উদাসভাবে সে বলিল, বয় রে রাসু, বয়।

 কুবেরকে ছাড়িয়া রাসু হােগলার নীচে নৌকার আধভেজা পাটাতনের উপর বসিয়া পড়িল। হাতের উলটা পিঠে চোখ মুছিয়া পরনের জীর্ণ বসনে ঘসিয়া হাতে লাগা অশ্রু পুঁছিয়া ফেলিল। তিন জোড়া চোখ চাহিয়া রহিল তাহার শীর্ণ কঙ্কালসার দেহটির দিকে। তিন বছর আগে হােসেন মিয়ার সঙ্গে সপরিবারে সে যখন ময়নাদ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা করিয়াছিল দেহ তখন তাহার অবশ্য বিশেষ পরিপুষ্ট ছিল না। কিন্তু এমনভাবে ভাঙিয়াও সে পড়ে নাই। রাসুর মাথায় বড়াে বড়াে চুল জট বাঁধিয়া গিয়াছে, সর্বাঙ্গে অনেকগুলি ক্ষতের চিহ্ন, কয়েকটা ঘা এখনও ভালাে করিয়া শুকায় নাই। দুটি পা-ই তাহার হাঁটুর কাছ হইতে গােড়ালি পর্যন্ত ফোলা। গায়ের চামড়া যেন তাহার আলগা হইয়া শুকাইয়া শক্ত ও কালো হইয়া উঠিয়াছিল, এখন বৃষ্টির জলে ভিজিয়া ভিজা জুতার চামড়ার মতাে স্যাঁতসেঁতে দেখাইতেছে। একটু আগে বহুদুর হইতে অত জোরে হাঁক দিবার শক্তি সে কোথায় পাইয়াছিল ভাবিয়া কুবের অবাক হইয়া রহিল।

 রাসু ঝিমাইয়া পড়িতেছিল, ধনঞ্জয় জিজ্ঞাসা করিল, ময়নাদ্বীপ থেইকা আলি না রাসু?

 হ।

 পলাইয়া আইছস?

 হ, বৈশাখ মাসে।

 বৈশাখ মাসে? এতকাল কই ছিলি তুই?

 নােয়াখালি ছিলাম। বিষ্যুদবারে আইলাম সুলপী। কমুনে আজান খুড়া, সগগল কমু। অখনে ক্ষুধায় মরি।—অ কুবিরদা, কিছু নি দিবার পার?

 তখনকার মতাে কৌতূহল নিবৃত্তির সম্ভাবনা নাই দেখিয়া রাসুকে সঙ্গে করিয়া তিনজনে গ্রামে ফিরিয়া গেল। ধনঞ্জয়ের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছিবার আগেই রাসুর আবির্ভাবের বার্তা রাষ্ট্র হইয়া গেল জেলেপাড়ার সর্বত্র। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধনঞ্জয়ের উঠান জেলেপাড়ার কৌতুহলী ছেলেমেয়ে স্ত্রী পুরুষে ভরিয়া উঠিল। সকলের চোখে অপার বিস্ময়। তিন বছর আগে সকলে যাহাকে মৃত্যুমুখে সঁপিয়া দিয়াছিল, প্রায় তিন বছর যাহাকে সকলে একরকম ভুলিয়াই ছিল, হঠাৎ সে আবার আসিল কোথা হইতে? রাসুর মামা আশি বছরের বুড়া পীতম মাঝিও ন্যুব্জ দেহ লইয়া লাঠিতে ভর দিয়া আসিয়া পড়িল। রাসু দাওয়ার উপরে চাটাইয়ে বসিয়া মুহ্যমানের মতাে একদা-পরিচিত এই জনতার দিকে স্তিমিত নিস্তেজ দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিতেছিল, কাছে গিয়া ক্ষীণদৃষ্টি পীতম মাঝি তাহাকে অনেকক্ষণ ঠাহর করিয়া দেখিল। চিনিতে পারিয়া ভাবাবেগে হাত হইতে লাঠিটা খসিয়া যাওয়ায় হঠাৎ ভাগনের গায়ের উপরেই হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া সে উঠিল কাঁদিয়া। হুমড়ি খাইয়া পড়িবার আঘাতে নয়, কাঁদিয়া উঠিল সে এই বলিয়া যে রাসু একা ফিরিয়া আসিল, আর সকলে কই?

 যে অনাহারের পীড়নে রাসু একদিন সপরিবারে ঘরছাড়া হইয়াছিল, দু মুঠা চাল দিয়া পীতম তাহা লাঘব করিবার কোনাে চেষ্টাই করে নাই। তাই বলিয়া তার এই কান্না যে অশােভন হইল তা নয়। সেই দুর্দিনে মামার স্বাভাবিক উদাসীনতার স্মৃতি রাসুও মনের মধ্যে পুষিয়া রাখে নাই। শুধু সেই দুর্দিনের স্মৃতি নয়, সবই যেন সে এতক্ষণ ভুলিয়াছিল, তাহার দুঃখ বেদনার সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস। পীতমের কান্না শুনিয়া সেও হঠাৎ ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠিল: আমি একা ফির‍্যা আইলাম গাে মামা, সবকটারে গাঙের জলে ভাসাইয়া দিয়া আমি একা ফির‍্যা আইলাম।

 কান্নার মধ্যেও পীতম চমকাইয়া উঠিল। একেবারে বেখাপ্পা সুরে প্রশ্ন করিল, কস কী রাসু, সব কটা গেছে?

 রাসু সায় দিয়া বলিল, সব গেছে মামা, আমার কেউ নাই।

 কেহ নাই। এক স্ত্রী, দুই পুত্র ও এক কন্যা, একুনে এই চারজনকে সঙ্গে লইয়া সে নিরুদ্দেশ যাত্রা করিয়াছিল, হােসেন মিয়ার জঙ্গলাকীর্ণ ময়নাদ্বীপের উপনিবেশে একে একে চারজনেই মৃত্যুর দেশে নিরুদ্দেশ হইয়া গিয়াছে। এই গভীর শােকাবহ সংবাদে কেতুপুরের জেলেপাড়ানিবাসী নরনারী মূক হইয়া গেল। অথচ এই সংবাদ রাসুর আকস্মিক আবির্ভাবের মতােও বিস্ময়কর নয়। সকলেই ইহা জানিত। সমুদ্রের মধ্যে যে দ্বীপে সৃষ্টির দিন হইতে মানুষ বাস করে নাই সেখানে গিয়া কাহারও বাঁচিবার উপায় আছে? রাসুরা যখন সেখানে যায় তখনই সকলে নিশ্চিত জানিয়াছিল তাহারা মরিতে যাইতেছে। রাসু যে জীবিতাবস্থায় ফিরিয়া আসিয়াছে আশ্চর্য তাে এইটুকুই! এমনই আশ্চর্য যে রাসুকে সম্মুখে উপস্থিত দেখিয়াও যেন বিশ্বাস হইতে চাহে না যে সে সত্যসত্যই ফিরিয়া আসিয়াছে।

 ধনঞ্জয়ের বউ বুতির মা একটি কলাই-করা পাত্রে খানিকটা ঘােল আনিয়া দেয়, রাসু চোখের পলকে এক নিশ্বাসে তা গিলিয়া ফেলে। সমবেত জনতা এতক্ষণ বিশৃঙ্খল হইয়া ছিল, ক্রমে ক্রমে প্রত্যেকে এক একটি সুবিধাজনক স্থান গ্রহণ করিয়া বসিয়া পড়িলে রাসুকে ঘিরিয়া একটি সুন্দর শৃঙ্খলাবদ্ধ সভার সৃষ্টি হয়। তারপর একে একে উঠিতে থাকে প্রশ্ন। জবাবে রাসুর প্রত্যেকটি কথা সকলে সাগ্রহে গিলিতে থাকে।

 প্রীতম শিহরিয়া জিজ্ঞাসা করে, ময়নাদ্বীপে বাঘ সিঙ্গি আছে না রাসু?

 আছে না? বাঘ সিঙ্গিতে বােঝাই!

 বলিয়া সকলের মৃদু শিহরণ লক্ষ করিয়া এই অর্ধমৃত অবস্থাতেও গর্বের উত্তেজনা রাসুকে যেন নবজীবন দান করে, ভাঙিয়া পড়িবার ভঙ্গিতে বসিয়া থাকার বদলে হঠাৎ সে হইয়া যায় সিধা! বলে, বাঘ সিঙ্গি! বাঘ সিঙ্গির নামে ডরাইলা? কী নাই ময়নাদ্বীপে কও? সাপ যা আছে এক একটা, আস্তা মাইনসেরে গিলা খায়! রাইতে সুমুন্দুরের কুমির ডাঙায় উঠ্যা আইসা মাইনসেরে টাইনা নিয়া যায়—

 হ, বলিতে বলিতে মুখ খুলিয়া যায় রাসুর, আর শুনিতে শুনিতে হাঁ হইয়া যায় তাহার শ্রোতাদের মুখগুলি। হােসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপ, এমন ভীষণ স্থান সেটা?


যাহারা রথের মেলায় গিয়াছিল একে একে তাহারা ফিরিয়া আসিতে থাকে। সন্ধ্যার সময় জেলেপাড়ার ঘরে ঘরে আজিকার সন্ধ্যাটি নামে সানন্দে। বউরা হাসিমুখে লাল পাছাপাড় শাড়ি নাড়িয়া চাড়িয়া দেখে, নূতন কাচের চুড়ির বাহারে মুগ্ধ হয়, কাচ ও কাঠের পুঁতির মালা সযত্নে কুলুঙ্গিতে তুলিয়া রাখে, ছেলেমেয়েরা বাঁশি বাজায় আর মাটির পুতুল বুকে জড়াইয়া ধরে। আহ্লাদ বহন করিয়া এই তুচ্ছ উপকরণও যে কুটিরে আসে না, সেখানে যে বিষাদ জমাট বাঁধিয়া থাকে তা নয়, কোনাে না কোনাে রূপে সােনাখালির মেলার আনন্দের ঢেউ সে কুটিরেও পৌঁছিয়াছে। একটি কাঁটাল, দুটি আনারস, আধসের বাতাসা—এই দরিদ্রের উপনিবেশেও যে দরিদ্রতম পরিবার শুধু নুন আর অদৃষ্টকে ফাঁকি দিয়া ধরা পুঁটির তেলে ভাজা পুঁটিমাছ দিয়া দিনের পর দিন আধপেটা ভাত খাইয়া থাকে—খুশি হইয়া উঠিতে আর তাহাদের অধিক প্রয়ােজন কিসের? কুবেরের প্রতিবেশী বুড়া সিধু দাস একটি পয়সা সম্বল করিয়া মেলায় গিয়াছিল, পয়সাটি সে খরচ করে নাই কিন্তু মেলা হইতে সে যে বিপুল সম্পদ সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছে তাহাতে তাহার বৃহৎ পরিবারে আজ উৎসবের অন্ত নাই। ভিক্ষা সিধু করে নাই, বাগাইয়াছে। সারাদিন মেলায় ঘুরিয়া যেন-তেন-প্রকারেন সংগ্রহ করিয়াছে। সংগ্রহ করিয়াছে তিনটি দাগ-ধরা প্রকাণ্ড ফজলি আম, একটা তুলতুলে পাকা আস্ত খাজা কাঁটাল, সের তিনেক একত্র মেশানাে চাল ডাল খুদ আর খাসির একটা মাথা। গরিবের উৎসবে আর কী চাই? কুড়ানাে ফেলনা জিনিস! খাসির মাথাটা ধরিতে গেলে সে একরকম চুরিই করিয়াছে বলিতে হয়, কিন্তু তাতে কী? ভিক্ষা সিধু কারও কাছে চায় নাই, পয়সা সিধু কারও চুরি করে নাই।

 কুবেরের উঠানে দাঁড়াইয়া সিধু বলে, আমারে না নিয়া ফিরা আলি কুবির?

 দাওয়ায় ডিবরির আলােতে কুবের একটা কোঁচের লােহার শলাকাগুলি পরীক্ষা করিতেছিল, মুখ না তুলিয়াই বলে, তুমি না হীরু জ্যাঠার নায় আগেই ফির‍্যা আইলা?

 সিধু দাওয়ায় উঠিয়া যায়।

 তা আইলাম কুবির, তা আইলাম। রঙ্গ কইরা কইলাম, বােঝস না? কোঁচটা কিনা আনলি সন্দ করি। নিল কত?

 অষ্ট আনা।

 আট-দশ হাত লম্বা সরু তল্লা বাঁশের ডগায় দশ-বারােটি তীক্ষ্ণ লােহার শলাকা বসানাে মাছমারা যন্ত্রটি সিধুও গম্ভীর মুখে পরীক্ষা করিয়া দেখে। গােড়ার দিকটা ধরিয়া অন্ধকার উঠানে ছুঁড়িবার অভিনয় করিয়া বলে, ভার মন্দ না, জিতছস কুবির। কাল পরশুতক আমিও একটা কিনা লমু।

 সিধুর মতলব কুবের ঠিক বুঝিতে পারে না। কোঁচটি সে ঘরের মধ্যে কোনায় দাঁড় করাইয়া রাখিয়া আসে। বিকালে বৃষ্টি বন্ধ হইয়া গুমােট করিয়া আছে; আকাশে বিশেষ মেঘ নাই বটে কিন্তু কখন যে মেঘ ঘনাইয়া আসিয়া মুষলধারে বৃষ্টি নামিবে বলা যায় না। রাসুকে পীতম তাহার বাড়ি লইয়া গিয়াছে। এখন হয়তাে আবার তাকে ঘিরিয়া সভা বসিয়াছে সেখানে, নিজের নির্বাসনের কাহিনি বলিয়া রাসু সকলকে মুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। অত্যন্ত ক্ষুধা না পাইলে কুবেরও সেখানে গিয়া বসিত। পিসি হঁড়িতে ভাত ফুটাইতেছে, না খাইয়া রাসুর রােমাঞ্চকর গল্পের লােভেও কোথাও যাওয়ার ক্ষমতা এখন তার নাই।

 সিধু বসিয়া বসিয়া বাজে কথা বলে, শিথিল ছাড়া ছাড়া তাহার ভাষা, অনির্দিষ্ট অবান্তর বিষয়বস্তু। কুবের আনমনে সায় দিয়া যায় হ।

 পেটে ক্ষুধার জ্বালা, মনে পীতম মাঝির বাড়ি যাওয়ার তাগিদ, বুড়া সিধুর বকবক শুনিতে শুনিতে বিরক্তির তাহার সীমা থাকে না।

 শেষে সিধু যেন প্রসঙ্গক্রমেই বলে, খাসির একটা মাথা আনলাম কুবির। মস্ত মাথাখান—মইষের মতাে দুটা শিং।

 নিল কত?

 শ্যাষ বেলায় সস্তা কিনলাম কুবির। পুরা পাঁচ আনা চাইয়া শ্যাষ ম্যাশ চোদ্দ পয়হায় দিল। মাইয়াটারে ব্যানুন রাঁইধবার কইলাম, তা কয়, ত্যাল মরিচ নাই, চালও নাকি বাড়ছে।

 সিধুর কথা শুনিবার সমস্ত আগ্রহ কুবের সহসা হারাইয়া ফেলে। পিসিকে সে জিজ্ঞাসা করে, ভাত হইল পিসি? একেবারে সে পিছন ফিরিয়া বসে সিধুর দিকে।

 ক্ষণকাল অপেক্ষা করিয়া সিধু উঠিয়া যায়। বাঁশের একটা টুকরিতে খাসির কোটা মাথাটা আনিয়া কুবেরের সামনে ধরিয়া বলে, দেখ কুবির, মিছা কই নাই। ঘাড়ের কাছে খাসা খানিক মাংস ছিল, এই দেখ—টুকরির কাছে মুখ লইয়া ঠাহর করিয়া করিয়া সিধু কয়েক টুকরা মাংস বাছিয়া কুবেরকে দেখায়। করুণ নয়নে কুবেরের মুখের দিকে চাহিয়া বলে, ত্যাল মরিচ দিয়া ব্যানুন যা হইব—অমর্ত। আমিনুদ্দির ঠাঁই প্যাজ রসুন মাইগা আইনা—

 আমারে দেখাও ক্যান? রাঁধগা ব্যানুন।

 সিধু এবার স্পষ্ট করিয়াই বলে, ত্যাল মরিচ আর একমুঠা চাল দে কুবির। তরেও দিমুনে ব্যানুন।

 কুবের সন্ধিগ্ধ হইয়া বলে, দিবানি নিয্যস?

 সিধু আহত হইয়া বলে, দিমু না? কস কী কুবির! তরে না দিয়া যামু কই?

 তেল মশলা এবং চাল লইয়া সিধু উঠিল। আঁতুড় হইতে মালা বলিল, বুড়া কী বজ্জাত! মাথার ভাগ দিব না আইঠা কলা দিব, দেইখাে। কুবের উদাসভাবে বলিল, না দেয় না দিব। আজ তাে শ্যাষ না, আরেক দিন আইলে মাইরা খেদাইয়া দিমু—আমার লগে চালাকি কইরা যাইব কই?

 ভাত নামিলে ইলিশ মাছ ভাজা আর লংকা-রক্তিম তরকারি দিয়া ফেনসমেত তপ্ত অন্নে কুবের মুহূর্তের মধ্যে পেট ভরাইয়া ফেলিল। গােপিকে খানিক পরে একটা বাটি লইয়া গিয়া সিধুর কাছ হইতে খাসির মাথার ব্যঞ্জন আনিতে বলিয়া সে বাহির হইয়া গেল।

 পীতম মাঝির বাড়ি জেলেপাড়ার একেবারে উত্তর সীমান্তে। গােয়ালের ভিতর দিয়া তাহার বাড়িতে ঢুকিতে হয়; গােয়ালের একদিকে বাঁধা থাকে দুটি শীর্ণ গােরু, অন্যদিকে থাকে পীতমের প্রসিদ্ধ বেড়া-জাল, এতবড়াে জাল কেতুপুরের আর কাহারও নাই। বাড়িতে উঠানের বালাই নাই, গােয়াল পার হইয়া ঢুকিতে হয় প্রকাণ্ড একটা ঘরে। দুপাশের ছােটো দুখানা ঘরে ঢুকিবার দরজাও এই ঘরের ভিতর দিয়া। কার্পণ্য ও বেড়া-জালটির মতাে বাড়ি করার এই খাপছাড়া ঢংও পীতমের কম প্রসিদ্ধ নয়, লােকে নাম দিয়াছে কয়েদখানা। ঘরের পিছনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা, তারপরে একটা ডােবা। ডােবার ওদিকে বাঁশবনের পরে আর মানুষের বসতি নাই, বহুদুর বিস্তৃত শস্যখেত আষাঢ়ের গােড়াতেই এখন অর্ধেকের বেশি জলে ডুবিয়া গিয়াছে। বাঁশবনে জেলেপাড়ার প্রায় সকলেরই পরিচিত একজোড়া পাঁচ ফুট লম্বা গােখুরা সাপ বাস করে। ডােবায় থাকে কয়েকটি গােসাপ।

 বড়াে ঘরখানায় সভা রীতিমতােই বসিয়াছিল। ঘরে ঢুকিয়া কুবের অবাক হইয়া দেখিল, সভাপতি রাসু নয়, হােসেন মিয়া। পীতমের কাঠের সিন্দুকটার উপরে কাঁথা ভাঁজ করিয়া পাতিয়া হােসেনকে বসিতে দেওয়া হইয়াছে। রাসু মিশিয়া গিয়াছে একেবারে ভিড়ের মধ্যে। সকলের মুখেই একটা দারুণ অস্বস্তির ভাব, আড়চোখে সকলে হােসেন মিয়ার দিকে চাহিতেছে। এতগুলি লােকের নিশ্বাসে ঘরের আবদ্ধ বাতাস হইয়া উঠিয়াছে দূষিত, গরমে হােসেন মিয়ার কপালে বড়ো বড়াে ফোঁটায় জমিয়া আছে ঘাম। এদিক ওদিক চাহিয়া কুবের টুপ করিয়া সকলের পিছনে বসিয়া পড়িল। হোসেন মিয়া এখানে আসিয়া জুটিল কোথা হইতে? এত লােকের সামনে রাসুর সঙ্গে যখন তাহার মুখােমুখি হইয়া গিয়াছে, কী কাণ্ডটা আজ হয় দ্যাখাে!

 কুবের বিষাদ বােধ করে। আহা, এতবড়াে একটা কর্মঠ শক্তিশালী লােক, একগুঁয়ে সম্মানকামী লােক, কপালের ফেরে বড়াে জব্দ হইয়া গেল। রাসু তাহাকে একেবারে হাতেনাতে ধরাইয়া দিয়াছে সকলের কাছে। যে এত প্রতিপত্তি অর্জন করিয়াছিল, আজ বুঝি তার মুখ ফুটিয়া কথা বলিতেও বাধিতেছে। সােজাসুজি অপমান করিবার সাহস হয়তাে কাহারও হয় নাই কিন্তু কৌশলে নানাভাবে নানা ইঙ্গিতে কত লজ্জাই লােকটাকে সকলে না জানি এতক্ষণ দিয়াছে। কুবের এমনই মমতা বােধ করে যে সে ভাবিতে থাকে, পারিলে আজ সে হােসেন মিয়ার পক্ষই লইত। লােভ দেখাইয়া মিথ্যা আশ্বাস দিয়া হােসেন মিয়া যে রাসুর স্ত্রীপুত্রকে সুদূর ময়নাদ্বীপে লইয়া গিয়া হত্যা করিয়াছে, কোন্ যুক্তি দেখাইয়া তাহার এই কীর্তি সে সমর্থন করিত, কুবের তাহা জানে না। সে যাকে ভয় করে, এতলােকের সামনে তার মাথা হেঁট হইয়া যাওয়ায় মনে মনে সে শুধু ব্যথা পাইতেছিল। অন্ধ আবেগের সঙ্গে তার মনে হইতেছিল, যারা পঙ্গু অসহায় জীব, শক্তিকে লজ্জা দেওয়া তাদের পক্ষে ভালাে কথা নয়—মানুষের ধর্মবিরুদ্ধ এ কাজ।

 একথা কুবের জানে যে হােসেন মিয়ার বিচার করিয়া শাস্তি বিধানের কল্পনা জেলেপাড়ার এই সমবেত মাতব্বরেরা করিবে না। তবু আজ এই সমষ্টি বিচারকের ভঙ্গি গ্রহণ করিয়াছে। কী স্পষ্টভাবেই না হােসেন মিয়াকে অপমান করিতেছে সকলের বসিবার ভঙ্গি, চাহিবার ভঙ্গি, চুপ করিয়া থাকার ভঙ্গি!

 বিচলিত ও উত্তেজিত হইয়া এদিক ওদিক চাহিতে চাহিতে কুবের দেখিতে পাইল, জহর আমিনুদ্দি এবং আরও দুজন মুসলমান মাঝি অত্যন্ত গম্ভীরমুখে একদিকে বসিয়া আছে। ধরিতে গেলে এরাই কেতুপুরের মুসলমান মাঝির সমাজ, আরও দু-চারজন যারা আছে তারা একান্ত নগণ্য। এদের সংখ্যা পাঁচ-ছয় ঘরের বেশি হইবে না। জেলেপাড়ার পূর্বদিকে এদের একত্র সন্নিবেশিত বাড়িগুলিতে বেড়ার বাহুল্য দেখিয়া সহজেই চিনিতে পারা যায়। যতই জীর্ণ হইয়া আসুক, ছেঁড়া চট দিয়া সুপারি গাছের পাতা দিয়া মেরামত করিয়া বেড়াগুলিকে এরা খাড়া করিয়া রাখে। অথচ খুব যে কঠোরভাবে পর্দাপ্রথা মানিয়া চলে তা বলা যায় না। মেয়েদের বাহিরে না আসিলে চলে না। নদীতে জল আনিতে যাইতে হয়, পুরুষেরা কেহ বাড়ি না থাকিলে দোকানে সওদা আনিতে যাইতে হয়, বাড়ির আনাচেকানাচে লাউ কুমড়া ফলিলে, মুরগিতে ডিম পাড়িলে, গ্রামে গিয়া বেচিয়া আসিতে হয়। বেড়াগুলি পর্দা রাখে শুধু অন্দরের আর এমন বউ-ঝি বাড়িতে যদি কেহ থাকে যাহার বয়স খুব কাঁচা—তাহার। এরা এবং জেলেপাড়ার অ-মুসলমান অধিবাসীরা সদ্ভাবেই দিন কাটায়। ধর্ম যতই পৃথক তােক দিনযাপনের মধ্যে তাহাদের বিশেষ পার্থক্য নাই।সকলেই তাহারা সমভাবে ধর্মের চেয়ে এক বড়াে অধর্ম পালন করে—দারিদ্র‍্য! বিবাদ যদি কখনও বাধে, সে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিবাদ, মিটিয়াও যায় অল্পেই। কুবেরের সঙ্গে সিধুর যে কারণে বিবাদ হয়, আমিনুদ্দির সঙ্গে জহরের যে কারণে বিবাদ হয়, কুবের আমিনুদ্দির বিবাদও হয় সেই কারণেই। খুব খানিকটা গালাগালি ও কিছু হাতাহাতি হইয়া মীমাংসা হইয়া যায়।

 মধ্যস্থতা হয়তাে করে জহর মাঝিই।

 বলে, কুবের বাই ছাড়ান দাও। আরে হােই আমিনুদ্দি, সামাল দে। পােলাপানের পারা কাইজা করস, তগর শরম নাই?

 কুবের লক্ষ করিয়া আশ্চর্য হইল, এই আমিনুদ্দি, আজ একটি বিশিষ্ট ব্যক্তি হইয়া উঠিয়াছে। হােসেন মিয়ার দিকে সে চাহিয়া নাই, সে চাহিয়া দেখিতেছে আমিনুদ্দিকে। আমিনুদ্দির অস্বস্তিও অত্যন্ত সুস্পষ্ট। জহরের মধ্যস্থতায় অনেকবার বিবাদ মিটিলেও মনে মনে আমিনুদ্দির উপর কুবেরের রাগ ছিল। চোখে চোখে মিলিতে সে চোখ ফিরাইয়া লইল।

 কেহ কথা কহে না। কী ভাবিয়া হােসেন মিয়া হঠাৎ কুবেরকেই বিলম্বিত সম্ভাষণ জানাইয়া বসিল।

 পিছে বইলা ক্যান কুবের বাই? আগাইয়া বও। খানাপিনা হয় নাই?

 কুবের হঠাৎ বড়াে উল্লাস বােধ করিল। আগাইয়া সকলের সামনে গিয়া বসিয়া বলিল, খাইছি মিয়া বাই।

 বাঁ হাতে নিজের লালচে দাড়ি মুঠা করিয়া ধরিয়া হােসেন মিয়া বলিল, গণেশরে দেহি না? গেছে কই?

 কে জানে? ফিরতি বেলায় মেলার মদ্যি মাইজা কর্তা ডাইকা কয়, গাঁয়ে ফেরস নাকি গণেশ?—মাছগুলা বাড়ি দিয়া আসিস, লইয়া যা। কইয়া একডালা ইছামাছ দিলেন। মাছ দিবার লাইগা গণশা কর্তাগাে বাড়ি গেছে সন্দ করি।

 মেজোকর্তার নাম অনন্ত তালুকদার। কেতুপুর গ্রামখানি তাহারই। জেলেপাড়ার যাহারা দু-একবিঘা জমি রাখে, মেজোকর্তাকেই তাহারা খাজনা দিয়া থাকে। মেজোকর্তার নামােল্লেখে সকলে মন দিয়া কুবেরের কথা শুনিল। হােসেন মিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কর্তা আলেন কবে?

 আলেন আর বিষ্যুদবারে।

 হীরু মাঝি চোখ মিটমিট করিতে করিতে বলিল, মাইজা কর্তার সগল সংবাদ দেহি রাখস কুবের, ভুবন সা-র লগে মামলার কী হইল ক দেহি?

 কুবের বলিল, কর্তা হাঁসচরের দখল পাইছেন। ভুবন সা-র নায়েব নাকি কয়েদ হইছে খবর শুনি জ্যাঠা। সাঁইথির কুঞ্জ গোঁসাই সাক্ষী দিছে, স্যায় নাকি নিজের চোখে নায়েবরে কর্তাগাে কাছারি ঘরে আগুন দিতি দেখিলাে।

 পীতম বলিল, হ? তুই জানলি কিবা?

 কুবের সগর্বে বলিল, ইডা কী জিগাও মামা? আমার জাননের বাকি কী?

 শেতলবাবুর ঠাঁই জানলাম।

 শীতলের নামােল্লেখে পীতম মাঝি নিঝুম হইয়া গেল। নকুল শয়তানি করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, শেতলবাবু? তেনারে পালি কই কুবের?

 কুবের হাসিয়া বলিল, নকুলদা য্যান পােলাপান, জান না কিছু। শীতলবাবুর ঠাঁই পয়সা পামু, কাল রাইতে আমাগাের যুগীর বাড়িতে তাগিদ দিবার গেছিলাম। পয়সা দিবার মতলব ডাকাইতটার নাই, খাতির কইরা কইল, বয় রে কুবের, তামুক খা। তামুক টানি রাইজ্যের গল্প কইরা আইলাম। কইলি না পিত্যয় যাবা নকুলদা, শেতলবাবু কয় মাইজাবাবু দেনায় ডুবছে।

 বুড়া পীতম মাঝি চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, নকুল তখনও শয়তানি করিয়া বলিল, যুগীর না পােলা হইব কুবির?

 কুবের বলিল, কে জানে? মুটাইছে দেখলাম।

 কে জানে, কী আশ্চর্য ইহাদের উপভােগ্য রসিকতা। যুগী পীতম মাঝির মেয়ে, সম্প্রতি জেলেপাড়ারই একধারে একখানা ঘর বাঁধিয়া মেজোকর্তার মুহুরি শীতল ঘােষের সঙ্গে বাস করিতেছে। এত লােকের মাঝে পীতমের সামনেই তাহার মেয়ের সম্বন্ধে নকুল যেমন অনায়াসে রসিকতা করে, সকলে হাসাহাসি করিয়া তাহা উপভােগও করে বিনা বাধায় ও বিনা দ্বিধায়।

 পীতম রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলে, বাইর তুই আমার বাড়ির থেইকা নকুইলা, দূর হ!

 নকুল মুচকি হাসিয়া বলে, গােসা কর ক্যান মামা! জবাব দিবার পার না মাইঝা কর্তা কুবিররে এ খাতির করে ক্যান—তাই জিগাইয়া? কুবিরের পােলা কেমন ধলা হইছে জিগাও।

 কুবের মুষ্টি তুলিয়া বলে, মারুম কইলাম নকুইলা, মাইরা লাশ করুম তরে।

 মনে হয়, সভার চেহারা বদলাইয়া গিয়াছে। রাসু ও হােসেন মিয়াকে উপলক্ষ করিয়া সভায় যে চাপা অসন্তোষ ও প্রতিবাদের ভাব আসিয়াছিল প্রসঙ্গান্তরে এখন তাহা বিলীন হইয়া গিয়াছে। ও বিষয়ে আর কাহারও কিছু বলিবার বা ভাবিবার নাই। হােসেন মিয়া উঠিয়া দাঁড়ায়।

 বিয়ানে একবার বাড়িত্ যাইও রাসু বাই। পয়সাকড়ি পাইবা মালুম হয়, নিকাশ নিয়া খারিজ দিমু। ময়নাদ্বীপির জমিন না নিলি জঙ্গল কাটনের মজুরি দিই—খাওন পরন বাদ। কাইল খাইও। লালচে দাড়ির ফাঁকে হােসেন মিয়া মৃদু মৃদু হাসে, বলে, মন করতিছ, হােসেন মিয়া ঠক। তােমারে ঠকাইয়া হােসেন মিয়ার ফয়দা কিসির! কোন্ হালারে আমি জবরদস্তি ময়নাদ্বীপি নিছি? আপনা খুশিতে গেছিলা, ঝুট না কলি মানবা রাসু বাই। ফিরা আইবার মন ছিল, আমারে কতি পারলা না? একসাথ আইতাম?

 রাসু ঘাড় নীচু করিয়া থাকে। আমিনুদ্দি বলে, যান নাকি মিয়া?

 হ।

 শােনেন। আমি ময়নাদ্বীপি যামু না। কইয়া থুইলাম।

 হােসেন মিয়া তেমনি মৃদু মৃদু হাসে।

 তোমারে যাতি কই নাই আমিনুদ্দি। খুশ না হলি ক্যান যাবা?

 পাতলা পাঞ্জাবি ঘামে ভিজিয়া যাওয়ায় হােসেল মিয়ার বুকের নিবিড় লােমরাজি দেখা যাইতেছিল। সেইখানে হাত দিয়া সে আবার বলিল, জান দিয়া তােমাগাে দরদ করি, এ্যানে আইজ তােমরা ঘা দিলা, এই দিলের মদ্যি।—কুবের বাই, ঘর যাইবা নাকি?

কুবের সায় দিয়া উঠিয়া আসিল। দুজনে গােয়াল পার হইয়া নামিয়া গেল পথে। আকাশ নিবিড় মেঘে ঢাকিয়া গিয়াছে, দুর্ভেদ্য অন্ধকারে জেলেপাড়ার পথ পায়ের তলেও হইয়া আছে অদৃশ্য। অত্যন্ত সন্তর্পণে পা ফেলিয়া আগাইতে হয়, দীর্ঘকালের পরিচয় না থাকিলে বাড়ির আনাচকানাচ দিয়া আঁকাবাঁকা পথ তাহারা খুঁজিয়া পাইত না। কুবেরের বাড়ির কাছাকাছি আসিয়া আকাশের জমানাে মেঘ হঠাৎ গলিয়া যাওয়ায় চোখের পলকে তাহারা ভিজিয়া উঠিল। কুবেরের সঙ্গে হােসেন মিয়াও উঠিল গিয়া তাহার ভাঙা কুটিরে।

 দাওয়ায় ছাট আসিতেছিল, হােসেন মিয়াকে ঘরের মধ্যেই বসিতে দিতে হইল। কুবেরের দুই ছেলে লখা ও চণ্ডী ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, জাগিয়া ছিল গােপি। চাটাইয়ের উপর জাঁকিয়া বসিয়া হােসেন মিয়া তাহাকে আদর করিয়া কাছে ডাকিল, বলিল, পিয়াস জানায় বিবিজান, পানি দিবা না? গােপি ঘটিতে জল আনিয়া দিলে আলগােছে মুখে ঢালিয়া ঘটিটা দাওয়ার প্রান্তদেশে রাখিল। ঘরের চাল বাহিয়া যে জলের ধারা পড়িতেছিল আঁজলা ভরিয়া সেই জল ধরিয়া ঘটির গায়ে ঢালিয়া ঢালিয়া ঘটিটা গােপি করিয়া লইল শুদ্ধ।

 রাত্রি বাড়িতে থাকে, বৃষ্টি ধরিবার লক্ষণ দেখা যায় না। পিসি ঢেঁকি ঘরে গিয়া ঝাঁপ বন্ধ করিয়া শুইয়া পড়ে, ভাইদের পাশে শুইয়া গােপির দুচোখ ঘুমে জড়াইয়া আসে, শ্রান্ত কুবেরের চোয়াল ভাঙিয়া হাই উঠে, বাহিরে চলিতে থাকে অবিরাম বর্ষণ। কিছুক্ষণ বৃষ্টি হইবার পর ঘরের ফুটা কোণ দিয়া ভিতরে জল পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল, চাহিয়া দেখিয়া হােসেন মিয়া আপনা হইতে কাল সকালেই কুবেরের ঘর ছাইবার শণ দিবার কথা বলিয়াছে। কুবের একসময় উঠিয়া গিয়া মালার অবস্থা দেখিয়া আসে। বহু যত্নে কুবের তাহার আঁতুড়ের চারিদিকে বেড়ার সমস্ত ফুটা বন্ধ করিয়াছে, দাওয়ার এদিকটা ভাসিয়া গেলেও আঁতুড়ে বৃষ্টির ছাট ঢুকিবার কোনাে পথ নাই। মেঝেটাই শুধু হইয়া আছে ভিজা স্যাঁতসেঁতে যার কোনাে প্রতিকার করার সাধ্য কুবেরের নাই। আর কটা দিন পরেই মালা এখান হইতে মুক্তি পাইবে। বুকে পিঠে তাহার যে অল্প অল্প ব্যথা হইয়াছে, কদিন এখানে থাকার ফলে সেটা বাড়িয়া না গেলেই বাঁচা যায়।

 মালা ভয়ে ভয়ে বলে, আমারে দুগা মুড়ি চিড়া দিবা গাে?

 ক্যান, ভাত খাস নাই।

 খাইছি। ভাতে টান পড়ল, পেট ভইরা খাই নাই। অখন খিদায় পেট জ্বলে।

 জ্বালাইয়া মারস্ বাপু তুই। বলিয়া কুবের হাঁড়ি কলসি খুঁজিয়া পিসির নিজের জন্য লুকানাে কতকগুলি চিড়া মালাকে আনিয়া দেয়। উঠিয়া বসিয়া অন্ধকারে চিড়া মুখে দিয়া মালা বলে, হােসেন মিয়াকে খাইতে দিবা না?

 কী দিমু?

 মেলার থেইকা আম না আনছিলা? তাই দাও—করবা কী! খিদায় মানুষটা খুন হইয়া যায় না!

 কুবেরের সহসা মনে পড়িয়া যায়। ভাবে, সিধুর কাছ হইতে যে মাংসের ব্যঞ্জন পাওয়া গিয়াছে তাই দিয়া আতিথ্য করিলে মন্দ হয় না। মুসলমান মানুষ, মাংস বেশ পছন্দ করিবে। কিন্তু পরক্ষণেই এবিষয়ে কুবেরের উৎসাহ কমিয়া যায়। এমন একদিন ছিল হােসেন মিয়া যখন খাসির মাথার ব্যঞ্জন পাইলে ধন্য হইয়া যাইত, আজ যার তার রান্না ওসব কি আর সে খাইবে? শুধু না খাওয়া নয়, খাইতে বলিলে হয়তাে সে আজ অপমানই বােধ করিয়া বসিবে। তার চেয়ে আম যখন আছে, তাই দেওয়া ভালাে।

 ঘরে গিয়া কুবের একটু অবাক হয়। চাটাইয়ে চিত হইয়া শুইয়া ইতিমধ্যেই হােসেন মিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। কুবের সন্তর্পণে মৃদু স্বরে একবার বলে, মিয়া বাই? সাড়া না পাইয়া ঠেলা দিয়া ঘুম ভাঙায় গােপির।

 সিধুর ঠাঁই ব্যানুন আনছিলি গােপি?

 ঘুমে আধমরা গােপি বলে, উঁহু?

 উঁহু। আনতি কইয়া গেলাম না হারামজাদি?

 বাহুমূলে কুবেরের জোর টিপুনিতে গােপি চমকিয়া সজাগ হইয়া বসে। বলে, আনতি গেছিলাম বাবা। দিল না। কইল, বিড়ালে সব খাইয়া গেছে গা।

 বিড়ালে খাইয়া গেছে কইল, না?

 গােপি সায় দিল; কুবের রাগে আগুন হইয়া বলিল, হালা জুয়াচ্চোর! র, বিয়ানে খাওয়ামুনে বিড়ালরে। হালা বজ্জাইত।

 ছাড়া পাইবামাত্র গােপি ঢলিয়া পড়ে। ঘুম বােধ হয় আসে তাহার সঙ্গে সঙ্গেই। ঘরের যে কোণে জল পড়িতেছিল কুবের সেখানটা পরীক্ষা করিয়া দেখে। জল বাহির হইয়া যাইবার জন্য সেখানে সে একটি সরু নালি করিয়া দিয়াছিল, মাটি গলিয়া তাহা প্রায় বুজিয়া আসিয়াছে। জল জমিয়া ঘরের ভিতরের দিকে আগাইয়া আসিয়াছে অনেক দূর। হাত দিয়াই নালিটা সাফ করিয়া কুবের জল বাহির করিয়া দেয়। তারপর এক গভীর সমস্যার কথা ভাবিতে থাকে। ডিবরিতে বেশি তেল নাই। অল্পক্ষণের মধ্যেই নিভিয়া যাইবে। হােসেন মিয়াকে ডাকিয়া তুলিয়া আম খাওয়ার অনুরােধ এখন সে জানাইবে কি? বাদলা নামিয়া ঠাণ্ডা পড়িয়াছে। লােকটা আরামে গভীরভাবে ঘুমাইতেছে। ডাকিলে চটিবে না তাে?

 ঘুমের মধ্যে হােসেন মিয়া পাশ ফিরিল। দ্যাখাে, হঠাৎ কুবের কী আবিষ্কার করিয়াছে। হোসেন মিয়ার লম্বা পাঞ্জাবির পকেট হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে আনকোরা নতুন একটা পয়সা রাখিবার ব্যাগ! ব্যাগটা সে আজই মেলায় কিনিয়াছে সন্দেহ নাই। শখ করিয়া নতুন ব্যাগে কত টাকাপয়সা হােসেন মিয়া রাখিয়াছে কে জানে, ব্যাগটা ফুলিয়া মােটা হইয়া গিয়াছে।

 কুবেরের দেহে কাঁপুনি ধরিয়া যায়। একমুঠা টাকা ও রেজকি হইতে প্রথমে সে একটা আধুলি ছাড়া আর কিছু লইতে সাহস পায় না। তারপর সে ভাবিয়া দেখে যে এতগুলি খুচরা রেজকি কি আর হােসেন মিয়া হিসাব করিয়া গুনিয়া গাঁথিয়া রাখিয়াছে? আরও একটা সিকি এবং একটা আনি সে বাহির করিয়া লয়।

 ব্যাগটা হােসেন মিয়ার লম্বা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকাইয়া ফুঁ দিয়া সে ডিবরিটা নিবাইয়া দেয়। তখন একটা বড়াে ভয়ানক ব্যাপার ঘটিয়া যায়।

 গােপি রুদ্ধ নিশ্বাসে বলে, বাবা!

 কুবেরের দেহ শিরশির করে, মেরুদণ্ডটার ঠিক মাঝামাঝি।

 চুপ যা গােপি, ঘুম যা।

 আমারে কাইল পয়সা দিবা?

 দিমু—চুপ যা, ঘুম যা গােপি।

 গােপি আর কথা বলে না। অন্ধকারে দুহাত লম্বা ছােটো চাটাইটি সন্তর্পণে বিছাইয়া কুবের শুইয়া পড়ে।