ভােরে আগে ঘুম ভাঙিল হােসেনের। কুবেরকে সে-ই ডাকিয়া তুলিল, চোখ মেলিয়াই কুবেরের কেন যেন হঠাৎ এক অকারণ ত্রাসে মন ভরিয়া গেল। কী হইয়াছে? বিপদ কিসের? হ, কাল রাত্রে সে হােসেন মিয়ার পয়সা চুরি করিয়াছিল। একদফা চোখ মিটমিট করিয়া কুবের আশ্বস্ত হইল। হােসেন মিয়াকে খাতির করিয়া বলিল, যান নাকি মিয়া বাই? খিদায় কাতর হইছেন সন্দ করি—রাইতে কিছু খান তাে নাই। এক কাম করেন, দুইগােটা আম খাইয়া যান।

 প্রত্যুষে ঘুম ভাঙা মুখেও হােসেন মিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে পারে।

 খাওনের কথা থাও কুবির বাই! বাড়িত্ গিয়া খামু।

 একটা প্রকাণ্ড হাই তুলিয়া বিড়ি ধরাইয়া হােসেন উঠিল। ঘুমন্ত গােপির দিকে এক নজর চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মাইয়ার বয়স কত, কুবির বাই?

 নয় সন্দ কইরা থুইছি।

 বিয়া দিবা না মাইয়ার?

 হ। দিমু, কেরমে কেরমে দিমু।

 পকেট হইতে হােসেন ব্যাগটা বাহির করিয়া খুলিল। দেখিয়া পাংশু হইয়া গেল কুবেরের মুখ। কিন্তু না, টাকাপয়সা গুনিয়া দেখিবার জন্য হােসেন ব্যাগ বাহির করে নাই। একটা সিকি বাছিয়া লইয়া সে কুবেরের হাতে দিল, বলিল, বাচ্চাগাে খাবার কিনা দিও কুবির বাই। বলিয়া ব্যাগটা আবার পকেটে রাখিয়া দিল। কুবের আত্মসম্বরণ তৎক্ষণাৎ। যে বিপদ ঘটিল না তার জন্য আর কেন বুক কাঁপিবে, মুখ শুকনো দেখাইবে? খুশিতে বেসামাল হইয়া সে জিজ্ঞাসাই করিয়া বসিল, ব্যাগটা নতুন দেখি? মেলায় কিনছেন বুঝি কাইল?

 হােসেন বলিল, হ।

 কথা কহিতে কহিতে দুজনে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। এখন বৃষ্টি নাই কিন্তু মেঘে মেঘে প্রভাতের রূপ অস্বাভাবিক থমথমে। হােসেন একবার মুখ তুলিয়া আকাশের দিকে তাকাইল। ইয়া আল্লা, নামানাে আকাশের তলে কী দীনা এই পৃথিবী! ভিজিয়া চুপসিয়া চারিদিক সকাতর হইয়া আছে। হােসেনের মনের কোণে একটু স্বাভাবিক কবিত্ব ছিল, জীবনে ভিন্ন অবস্থায় পড়িলে হয়তাে সে কয়েকটি গীতিকা রচনা করিত, তার মধ্যে দুটি-একটি মুখে মুখে প্রচার হইয়া স্থান পাইত শতাব্দীর সঞ্চিত গ্রাম্যগীতিকার অমর অলিখিত কাব্যে—মাঠেঘাটে, মশালের আলােয় আলােকিত উঠানে গীত হইয়া হইয়া ভণিতায় হােসেনের নাম দূর-দূরান্তরে ছড়াইয়া পড়িত, লােকে বলিত হােসেন ফকির, চল কেতুপুরে দেওয়ান ফকির হােসেন ছাহাবের দরগায় চেরাগ জ্বালি। হােসেন বুঝি কুবেরকে একেবারে ভুলিয়া যায়। অনেকদিন আগে, কুবেরের মতাে ছেঁড়া কাপড় পরিয়া আধপেটা খাইয়া জলে কাদায় সে যখন দিন কাটাইত, সকাল সন্ধ্যায় তখন মনে তাহার ভাসিয়া আসিত গানের চরণ। ফুটা চালার নীচে ময়লা চাটাইয়ের বিছানায় উদরে উপবাস লইয়া তেমনিভাবে কাল রাতটা কাটাইয়া আজ আবার হােসেনের মনে গান ভাসিয়া আসিতেছে।

 কুবের, গাহান বাইন্ধবার পার?

 আমি পারতাম না। আমাগাের যুগইলা পারে। মুখে মুখে ছড়া বাইন্ধ্যা দেয়।

 আমি বাইন্ধবার পারি।

 কন কী মিয়া বাই?

 হােসেন এখন লাজুক। সে এদিক ওদিক তাকায়। ঘন ঘন দাড়িতে হাত বুলাইয়া কুবেরের কাছেই অপরাধীর মত হাসে। লােকটার আদি-অন্ত পাওয়া ভার।

 তারপর হােসেন বলে, বাঁধুম, শুনবা?

 কুবের বলে, কন মিয়া বাই, কন।

 একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হােসেন সুর করিয়া বলিতে আরম্ভ করে

 আঁধার রাইতে আশমান জমিন ফারাক কইরা থােও
 বােনধু, কত ঘুমাইবা।
 বাঁয়ে বিবি ডাইনে পােলা আকাল ফসল রােও
 মিয়া, কত ঘুমাইবা।
 মানের পাতে রাইতের পানি হইল রুপার কুপি,
 উঠ্যা দেখবা না।
 আলা করেন ঘরের চালা কেডা চুপি চুপি,
 দিশা রাখবা না।
 তােমার লাইগা হাওর দিয়া বাইয়া চেরাগ-নাও
 দিল-জাগানি আলেন যিনি, মিয়া,
 চিরা-মেঘের বাদাম তুইলা বন্ধু কনে যাও?
 জিগায় তারে খাঁচার চিড়িয়া।
 নিদ্ ভাঙ্গে না, দিল জাগে না, বিবির বুকের শির,
 পাড়ি দিবার সময় গেল, মাঝি তবু থির—
 মাঝি কত ঘুমাইবা।

 কুবের অভিভূত হইয়া বলিল, মুখে মুখে বানাইলেন মিয়া বাই?

 খুশ হলি না পারি কী? হােসেন মিয়া আর দাঁড়াইল না। দুপুরবেলা ঘরের চালের জন্য শণ আনিতে গিয়া কুবের শুনিল, সে বিদেশ গিয়াছে। কোথায় গিয়াছে কেহ জানে না। কিন্তু হােসেন মিয়ার কথা কখনও বেঠিক হয় না। কুবেরের জন্য শণ সে রাখিয়া গিয়াছে।

 গােপির বয়স এগারাে, কুবের মেয়ের বয়স এক বছর ভাঁড়ায় আর এক বছর হাতে রাখিয়া বলে, নয়। ন বছর বয়সে যে মেয়ের এগারাে বছরের বাড়, বিয়ের বাজারে তার দাম আছে। গণেশের শালা যুগল সম্প্রতি পাশের গ্রাম হইতে বােনের তত্ত্ব লইবার ছলে আসা যাওয়া শুরু করিয়াছে। সােজাসুজি কথা সে এখনও পাড়ে নাই, আলাপ আলােচনার মাঝখানে বাঁকা বাঁকা প্রশ্ন করিয়া কুবের কী রকম দর হাঁকিবে জানিবার চেষ্টা করিয়াছে। স্পষ্ট করিয়া কুবেরও এখন পর্যন্ত কিছু বলে নাই। কথা উঠিলে বহুক্ষণ ধরিয়া মেয়ের প্রশংসা কীর্তন করিয়া শুধু একটু আভাস দিয়াছে দুকুড়ি তিনকুড়ি টাকার। বুদ্ধি থাকে যুগল আন্দাজ করিয়া নিক। গণেশের আত্মীয় বলিয়া টাকার বিষয়ে কুবের তাহাকে খাতির করিবে না। যুগল সম্ভবত তাহা টের পাইয়াছে, তাই ইলিশ মাছের মরশুমটা শেষ হইবার প্রতীক্ষায় আছে। হাতে তখন কী রকম টাকা জমে দেখিয়া কথা পাড়িবে। কুবের বােঝে না কী! সকলের গােপন মতলব সে চোখের পলকে আঁচ করিয়া ফেলে।

 মানুষ মন্দ নয় যুগল। এতকাল অবস্থা খুব খারাপ ছিল, তাই বত্রিশ বছর বয়স অবধি বিবাহ করিতে পারে নাই; নিজের চেষ্টায় এখন সে অবস্থা ভালাে করিয়াছে। উন্নতির জন্য তাহার প্রশংসনীয় প্রয়াসের কথা কাহারও অবিদিত নয়। দুটি একটি করিয়া কতকাল ধরিয়া কত কষ্টে সে কিছু টাকা জমাইয়াছিল, তারপর গণেশের কাছে বােনের বিবাহ দিয়া পাইয়াছিল তেইশ টাকা! সকলে ভাবিয়াছিল, এবার যুগল বিবাহ করিবে, বিবাহের জন্য ছাড়া অত কষ্টে টাকা জমায় কে? কিন্তু যুগল করে নাই। সমস্ত জমানাে টাকা দিয়া একটা বড়াে নৌকা কিনিয়া সকলকে সে অবাক করিয়া দিয়াছিল। দুশাে টাকা সে নৌকার দাম, সুতরাং টাকা সে কম জমায় নাই। ইচ্ছা করিলে ওই টাকায় সে তিন-তিনটা বিবাহ করিতে পারিত। অন্তত একটা বিবাহ করিয়া বাকি টাকায় একটা ছােটোখাটো নৌকা কিনিতে কোনাে বাধাই ছিল না। তার বদলে উপার্জনের এই স্থায়ী উপায়ের জন্য সমস্ত পুঁজি ভাঙিয়া সে যে সুবুদ্ধি ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়াছিল তার তারিফ করিতেই হয়। দ্যাখাে, এক বছরে যুগলের ভাঙা ঘর নূতন হইয়াছে, শীর্ণ দেহে মাংস লাগিয়াছে, বিবাহের জন্য টাকাও সে আবার জমাইয়া ফেলিতে পারিয়াছে কিনা কে জানে! জাহাজঘাটে অত বড়ো নৌকার না চাহিতে ভাড়া হয়। রেলে ও জাহাজঘাটে আসিয়া কত মানুষ ও মাল কত গ্রামে যায়, এক একটি বাণিজ্য দ্রব্যের মরসুমের সময় কত মহাজন গ্রামে দাদন দেওয়া মাল সংগ্রহের জন্য চড়া দরে অসংখ্য নৌকা ভাড়া নেয়। আর শুধু ভাড়া তাে নয়। উপরি আয়ও কী কম! ধানের বােঝাই লইয়া একদিনের পথ পাড়ি দিবার সময় দশ-বিশ সের ধান নৌকার গােপন ফাঁকে ফোকরে লুকাইয়া ফেলিবার সুযােগ মেলে ঢের। কেবল ধান নয়, কলাই, মটর, হলুদ, লংকা প্রভৃতি কত কী জিনিস বছর ভরিয়া যুগল অমন কত আনিয়াছে। উন্নতি সে আরও করিবে। কারণ, অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে কোনাে বিষয়ে তাহার এতটুকু শিথিলতা আসে নাই। এখনও সে আগের মতােই কৃপণ। আকুরটাকুরের মাঝিসমাজে আজ সে একজন মাতব্বর লােক। একদিন সে-ই যে গ্রামের মােড়ল হইয়া দাঁড়াইবে কেই তাহাতে সন্দেহ করে না।

 মালার ইচ্ছা বিবাহটা তাড়াতাড়ি চুকিয়া যায় গােপির। এত বয়স হইল আর কতকাল বয়স ভাঁড়াইয়া মেয়েকে কুবের ঘরে রাখিবে? লােকে যে ইতিমধ্যেই নিন্দা আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। স্বামীকে মালা তাগিদ দিয়া বলে, আগাে, যুগইলা নি কিছু কয়? কুবের তাহাকে চোখ ঠারিয়া বলে, কয় না?

 কী কয়?

 তা শুইনা তর কাম কী? মাইয়ালােক চুপ মাইরা থাক। পােলা বিয়ানের লাইগা পিরথিমিতে আইছস, বিয়া পােলা যত পারস—রাও করস কে রে?

 মালা রাগে বইকি!

 গাও জ্বালাইনা কথা দেহি খইর পারা ফোটে, মায় নি মুখে মধু দিছিল আঁতুড়ে?

 গােসা-হইলে মারুম গােপির মা।

 মারবা নাকি? আগাে মার, মার—না যদি মার লখার মাথা খাইবা।

 কুবের ঝিমাইতে ঝিমাইতে নিদ্রাকাতর চোখে স্ত্রীর দিকে তাকায়। হ, ছেলে কোলে রােগা বউটিকে তাহার রাজরানির মতাে দেখাইতেছে বটে। কে জানে রাজরানি দেখিতে কেমন? ছেলেটাও যেন ফরসাই হইয়াছে মনে হয়, এমনি বয়সে লখা আর চণ্ডী যেমন তামাটে লাল রংঙের ছিল সেরকম নয়। আঁতুড়ে যতদিন ছিল কুবের বিশ্বাস করে নাই, এখন তাহার মনে সন্দেহ আসিয়াছে যে ছেলেটা সত্যসত্যই খুব ফরসা হইবে। মালার রং তো কালো নয়, তামাটে—মাঝে মাঝে তাহাকে বাবুদের বাড়ির মেয়েদের মতাে ফরসাই দেখিয়া বসে। জেলেপাড়ার কোনও স্ত্রীলােকের গায়ে এমন চামড়া নাই। একটা পা যদি ওর হাঁটুর কাছ হইতে দুমড়াইয়া বাঁকিয়া না যাইত, কুবেরের ঘরে ও পায়ের ধূলা ঝাড়িতেও আসিত না। কিন্তু মালার চেয়েও ছেলেটার রং যেন ঢের বেশি ফরসা হইয়াছে। আরও কিছু বড়াে হইলে বিবর্ণ হইয়া আসিয়া শেষ পর্যন্ত রং হয়তাে ওর মালার মতােই দাঁড়াইবে। তাই যেন দাঁড়ায়। কুবের তাই চায়। যতই সে শান্ত ও সুবিবেচক হােক, মাঝে মাঝে লােকের বিশ্রী ইঙ্গিতে গা জ্বালা করে বইকী, মালার দিকে চাহিয়া কখনও কখনও মনে ঘনাইয়া আসে বইকী একটা বিতৃষ্ণা মেশানাে ব্যথিত ক্রোধ। কুবেরের দৃষ্টি আরও ঘােলাটে হইয়া আসে। এখন, শ্রাবণের এই প্রথম সপ্তাহে আকাশে মেঘের এক মুহূর্তের বিশ্রাম নাই। পরপর কয় রাত্রি অবিরত জলে ভিজিয়া কুবের আবার জ্বর বােধ করিতেছে।

 অনেকক্ষণ নীরবে কাটিয়া গিয়াছে, তবু থামিয়া যাওয়া আলােচনাটা আবার আরম্ভ করিতে কোনােরকম ভূমিকার দরকার হয় না। এইমাত্র রাগারাগি হইয়া গিয়াছে? কে বলিল! কত শান্ত ও মােলায়েম কুবেরের গলার স্বর।

 স্পষ্ট কইরা যুগল কিছু কয় না গােপির মা।

 মালার গলাতেও এতটুকু ঝাঁঝ নাই।

 কয় না? ক্যান? গােপিরে নিব না?

 গণশা কয় নিব, যুগইলা কিছু কয় না। উদিন আমারে জিগায় খোঁড়ার মাইয়া নি খোঁড়া হয়।

 তুমি কী কইলা?

 আমি কইলাম, তুই বলদ যুগইলা, খোঁড়া নি ব্যারাম যে মার থাকলি মাইয়া পাইবাে? আমাগাের গােপির চলন পরীর পারা। জানাে নি গােপির মা, গণশা মােরে এক বিষম বিত্তান্ত কয়। নকুইলা গিয়া গিয়া যুগইলার নাকি মন ভাঙে, বাকা বাকা মাইয়ার খবর দিয়া আহে। যুগইলা য্যান দুই-দশটা মাইয়ার খবর না নিয়া গােপিরে নিব না সন্দ করি গােপির মা!

 বলিয়া কুবের যেন ঘুমাইয়া পড়ে। কিন্তু মালা তাহাকে চেনে। সে প্রত্যাশা করিয়া থাকে।

 জানাে নি গােপির মা আরেক বিত্তান্ত? রাসু গােপিরে নিব কয়।

 মালা বিস্মিত হয় না। শুধু বলে, চালচুলা নাই।

 সায় দিয়া কুবের বােধ হয় এবার সত্যই ঘুমাইয়া পড়ে। কারণ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়াও মালা আর তাহার কোনাে মন্তব্য শুনতে পায় না। বসিয়া বসিয়া ছেলেকে সে স্তন দেয়। রােয়াকের ওদিকে রান্নার জায়গায় বসিয়া পিসি গােপির মাথার উকুন বাছিতেছে, সারারাত উকুনের কামড়ে মেয়েটা মাথা চুলকাইয়া সারা হয়। লখা ও চণ্ডী হয় ডাংগুলি খেলিতে গিয়াছে, আর না হয় কোথাও বঁড়শি ফেলিয়া ধরিতেছে পুঁটিমাছ। যেখানেই ওরা থাক আর যাই করুক, জলে ভিজিয়া জ্বরে পড়িবে না, জলে ডুবিয়া মরিবেও না। সে ভয় মালার নাই। সে কেবল ভাবিয়া মরে, মারামারি করিয়া ছেলে দুটা কোনােদিন না খুন হইয়া আসে। পঙ্গু বলিয়া বাহিরের জগতের সঙ্গে মালার পরিচয় কম। কেতুপুরের দশমাইল উত্তরে চরডাঙা গ্রামের এমনই এক ভাঙা কুটিরে তার মায়ের এক বামুন ঠাকুরের নামে কানাকানি করা পাপের প্রমাণস্বরূপ এই ভাঙা পা-টি লইয়া সে জন্মিয়াছিল, বড়াে হইয়াছিল বাড়ির মধ্যে লাঠিতে ভর দিয়া খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে। বাড়ির অদূরে রাম গােয়ালার গােয়ালঘরের কাছে কদম গাছটি পর্যন্ত ছিল তাহার কষ্টকর গতিবিধির সীমা। পাড়ার ছেলেমেয়েরা ওই কদম গাছটির তলে খেলা করিত, আর করিত মারামারি। বড়াে ছেলেরা ছােটো ছােটো ছেলেমেয়েগুলিকে মারিয়া আর কিছু রাখিত না। অনেক সময় এইসব মারামারির শেষ ফলটা গড়াইত বয়স্কদের মধ্যে, পাড়ায় মহামারি কাণ্ড বাধিয়া যাইত। দূরে দাঁড়াইয়া চোখ বড়াে বড়াে করিয়া মালা মজা দেখিত, বড়ো ভয় করিত তাহার। অন্য ছেলে মার খাইলে সে কিছুই করিত না, কিন্তু যেদিন সকলে মিলিয়া তাহার ছােটো ভাই দুটিকে পিটাইতে আরম্ভ করিত সেদিন সে খুলিত মুখ—তাহার বাঁশির মতাে সরু গলা শােনা যাইত পাড়ার সর্বত্র, সকলে ছুটিয়া আসিত। তার আগেই মালাকে কিন্তু দিতে হইত ভ্রাতৃপ্রেমের মূল্য। ভাইয়ের বদলে ছেঁচা খাইত সে। একজন একটা ধাক্কা দিলেই সে মাটিতে পড়িয়া যাইত। তখন চার-পাঁচজন মিলিয়া ধরাধরি করিয়া তুলিয়া তাহাকে ফেলিয়া দিত রাম গােয়ালার গােয়ালঘরের পিছনে গােবরগাদায়।

 সেই হইতে ছেলেদের মারামারিকে বড়াে ভয় করে মালা। নিজের ছেলে দুটিকে সে ঘরে আটকাইয়া রাখিতে চায়। কিন্তু খাতির তাহাকে কেহ করে না। বসিয়া বসিয়া যাহার দিন কাটে কে তাহার মুখ চাহিবে, কথা শুনিবে? হাজার বারণ করুক মালা, লখা ও চণ্ডী চোখের পলকে উধাও হইয়া যায়। ফাঁকি দিয়া কাছে ডাকিয়া জোর করিয়া ধরিয়া রাখিতে গেলে আঁচড়াইয়া কামড়াইয়া একেবারে রক্তপাত করিয়া ছাড়ে। তবু প্রতিদিন মালা তাহাদের নানা ছলে কাছে রাখিবার চেষ্টার কামাই দেয় না। সন্তানস্নেহের হিসাবে জেলেপাড়ার জননীদের মধ্যে মালার মৌলিকতা আছে। ছেলের বয়স আট-দশ বছর পার হইয়া গেলে তার সম্বন্ধে চিন্তা করা জেলেপাড়ার মেয়েদের রীতি নয়। চিন্তা করিবার অপরাপর বিষয়ের তাদের অভাব নাই। কচি ছেলে ছাড়া মায়ের কোল খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন। নিষ্ঠুর ছাড়া স্বামীও বড়াে একটা হয় না। দুটি কুঁড়েঘরের কুটিরে যে সংকীর্ণ সংসার, তারও কাজ থাকে অফুরন্ত। পুরুষেরা মাছ ধরিয়া আনে, পাইকারি কেনাবেচা করে, চুপড়ি মাথায় করিয়া বাড়ি বাড়ি মাছ যােগান দেওয়া তাদের কাজ নয়। ও কাজটা জেলেপাড়ার মেয়েরা সন্তান প্রসবের আগে-পিছে দু-একটা মাস ছাড়া বছর ভরিয়া করিয়া যায়। অপােগণ্ড শিশু ছাড়া আর কোনাে সন্তানের ছােটো ছােটো বিপদ-আপদের কথা ভাবিবারও যেমন তাহাদের সময় নাই, ওদের স্নেহ করিবার মতাে মানসিক কোমলতাও নাই। নবজাত সন্তানকে তাহারা যেমন পাশবিক তীব্রতার সঙ্গে মমতা করে, বয়স্ক সন্তানের জন্য তাহাদের তেমনি আসে অসভ্য উদাসীনতা। ছেলে মরিয়া গেলেও শােক তাহারা করে না, শুধু সুর করিয়া মড়াকান্না কাদে। মালা পঙ্গু, অলস। ঘরের কোনায় সে স্বতন্ত্র জীবনযাপন করে, জেলেপাড়ার রূঢ় বাস্তবতা তাই তাকে অনেকটা রেহাই দিয়াছে। ছেলেমেয়েগুলিকে ভালােবাসিবার মতাে মনও তাহার আছে, সময়ও সে পায়।

 ছেলেদের সে ফিরিয়া পায় সন্ধ্যার পর। সারাদিন পরে পাখির ছানার মতাে অবসন্ন ছেলে দুটি ফিরিয়া আসে ঘরের কোনায়, খোঁড়া মাকে তখন তাদের প্রয়ােজন হয়। জেলেপাড়ার প্রত্যেকটি কুটিরে যে অভিনয় অজানা, প্রতি দিনান্তে কুবেরের ঘরে তাহার অভিনয় হয়। বাহিরে সবটুকু শয়তানি অপচয় করিয়া লখা ও চণ্ডী শান্ত হইয়া থাকে, ভদ্র ও বাধ্য ছেলের মতাে ঘেঁষিয়া আসে মায়ের কাছে। সারাদিন মালার যে একতরফা অবহেলিত স্নেহ খাপছাড়া লাগিতেছিল, অপর পক্ষ গ্রহণ করামাত্র তাহা মধুর ও অপূর্ব হইয়া উঠে। মালার কাছে বসিয়া তাহারা ভাত খায়, এক ছেলের মুখে স্তন গুঁজিয়া রাখিয়া আর দুজনকে ভাত মাখিয়া গ্রাস মুখে তুলিয়া খাওয়ানাের শখ মালার একার নয়, এমনিভাবে খাওয়াইয়া না দিলে ওরা খাইতে চায় না। আর হ, মালা রূপকথা বলে। মালার মাথায় উকুন, গায়ে মাটি, পরনে ছেঁড়া দুর্গন্ধ কাপড়, তাই এ সময়টা সে যে কত বড়াে নিখুঁত ভদ্রমহিলা, অসামঞ্জস্য তাহা স্পষ্ট করিয়া দেয়। লখা ও চণ্ডী উলঙ্গ, চকচকে ভিজা ভিজা গায়ের চামড়া। ডিবরির শিখাটি ঊর্ধ্বগ ধোঁয়ার ফোয়ারা, মাথার উপরে চাল পচা শণের, চারিপাশের দেয়াল চেরা বাঁশের, স্যাঁতসেতে ঢেউ তােলা মাটির মেঝে। আদিম অসভ্যতার আবেষ্টনী। অভিনয় সুমার্জিত সভ্যতার।

 ইলিশের মরসুমে কুবের এসময় বাড়ি থাকে কদাচিৎ। যেদিন থাকে সেদিন বড়ােলােকের বাড়ির পােষা কুকুরের মতাে উদাস চোখে এসব সে চাহিয়া দেখে, স্নেহমমতার এইসব খাপছাড়া কাণ্ডকারখানা। দেখিতে দেখিতে সে হাই তােলে, বড়ােলােকের পােষা কুকুরের মতােই চাটাইয়ে একটা গড়ান দিয়া উঠিয়া বসে, মুখখানা করিয়া রাখে গম্ভীর। লখা ও চণ্ডীর মতাে মন দিয়া সেও যে রূপকথা শুনিতেছে মালার তাহা টের পাইতে বাকি থাকে না। ছেলেরা ঘুমাইয়া পড়িলেও সে তাই থামে না, হাত নাড়িয়া মুখভঙ্গি করিয়া রস দিয়া ঘুমন্ত ছেলেদের গল্প বলিতে থাকে। গল্প বলিতে সে ওস্তাদ। একই গল্প বারবার বলিয়া শ্রোতাদের সে সমান মুগ্ধ করিতে পারে। গােপি সরিতে সরিতে মার গা ঘেঁষিয়া আসে। পিসি ঠায় বসিয়া থাকে দুয়ারের কাছে। মালার গল্প শুনিতে আরও কে কে আসিয়া পড়িয়াছে দ্যাখাে। গণেশের বউ উলুপী, ছেলে মনাই আর মেয়ে কুকী। আর আসিয়াছে সিধুর তােতলা হাবা মেয়ে বগলী। কথা বলিয়া কেহ মালার রূপকথা বলায় বাধা দেয় না, চুপচাপ শুনিয়া যায়। গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে মালাই সকলের সঙ্গে আলাপ করে।

 আ লাে উলুপী, পাক করছিলি কী?

 আখায় দুগা বাইগন দিছিলাম। আর ইলশার ঝােল।

 কুকী! গায় কাপড় তুইলা বয় হারামজাদি! মাইয়া য্যান সং।

 বলিয়া আড়চোখে চাহিয়া কুবেরকে লজ্জা দিয়া মালা আবার রূপকথা বলিতে থাকে।