এবারে বর্ষায় আউশ ধানের ফসল নষ্ট হইয়া গিয়াছিল।

 পীতম মাঝির বাড়ির পিছনে তেঁতুলগাছটার গুঁড়ি পর্যন্ত কোনােবার জল আসে না, এবার আউশ ধান পাকিবার সময় হঠাৎ এত জল বাড়িয়া গেল যে গাছের গুঁড়িটা সপ্তাহকাল ডুবিয়া রহিল প্রায় তিন হাত জলের নীচে। এ জল আগে বাড়িলে ক্ষতি ছিল না, জলের সঙ্গে ধানের গাছও বাড়িয়া চলিত। কিন্তু ফসল পাকিবার সময় জলের সঙ্গে পাল্লা দিয়া ধানগাছ কেমন করিয়া বাড়িবে?

 বড়াে বর্ষা হইয়াছিল এবার। কেতুপুরের মাইল পাঁচেক দূরে চন্নার চর নামে পদ্মার একটা নিচু চর অর্ধেক জলে ডুবিয়া গিয়াছিল, অনেকে ভয় পাইয়া চলিয়া গিয়াছিল চর ছাড়িয়া। বহুকাল আগে খেয়ালি পদ্মা যে ভূমিখণ্ডের সৃষ্টি করিয়াছিল কে জানে সহসা সে আবার তাহা গ্রাস করিয়া ফেলিবে কিনা! ডাঙার গ্রামে বর্ষার জল ঘরে উঠিলেও পূর্ববঙ্গের লােক ভয় পায় না, সে জলের স্রোত নাই। কিন্তু পদ্মার বুকে ছােটোখাটো চরে যেসব গ্রাম, পদ্মার জল নাগাল পাইলে সেসব গ্রামের ঘর বাড়ি গােরু মানুষ কুটার মতাে ভাসাইয়া লইয়া যাইবে।

 কত গ্রাম যে এবার পাঁচ-সাত দিন জলের নীচে ডুবিয়া ছিল।  মালার বাপের বাড়ির গ্রাম চরডাঙা নাকি তলাইয়া গিয়াছিল এক কোমর জলের নীচে।

 খবর পাইয়া মালা কাঁদিয়া অস্থির হইয়াছিল। বলিয়াছিল, আই গাে তােমার পাষাণ প্রাণ! আমার বাপ ভাই ডুইবা মরে, একবার নি খবর নিলা!

 গণেশকে সঙ্গে করিয়া কুবের একদিন খবর আনিতে গেল।

 খাল পুকুর মাঠ ঘাট তখন একাকার হইয়া গিয়াছে। দুমাস আগে যে খেতের আল দিয়া মানুষ চলাচল করিত, এখন সেখানে লগি থই পায় না। কোনাে গ্রাম ভাসিয়া আছে দ্বীপের মতাে, কোনাে গ্রামে মানুষের ঘরের ভিতরে একহাঁটু জল উঠিয়াছে, সকলে বাস করিতেছে মাচা বাঁধিয়া। যে পারিয়াছে গােরু বাছুরের জন্যও মাচা বাঁধিয়া দিয়াছে, যে পারে নাই তার বােবা অসহায় পশুগুলি ঠায় দাঁড়াইয়া আছে জলের মধ্যে। গাছের ডালে পাখিরা শুধু আছে সুখে, ভূচর মানুষ ও পশুর কষ্ট অবর্ণনীয়। এক বাড়িতে কান্না শুনিয়া কুবের উঠানে নৌকা লইয়া গেল, দাওয়ার খুঁটি ধরিয়া ঘরের মধ্যে চাহিয়া দেখিল বাঁশের খুঁটির উপর দুখানা তক্তপােশ একত্র করিয়া জিনিসপত্র-সহ গৃহস্থ সপরিবারে বাস করিতেছে, মাসখানেকের একটি শিশুকে বুকে করিয়া গৃহস্থের স্ত্রী কাঁদিয়া আকুল। কী হইয়াছে শিশুটির? নীচে পড়িয়া ডুবিয়া মরিয়া গিয়াছে কাল রাত্রে। কতটুকু জল মেঝেতে, এক হাতও হইবে না। ছেলেকে বুকে আঁকড়িয়া ধরিয়া জননী ঘুমাইয়াছিল, কখন কেমন করিয়া সে নীচে পড়িয়া গিয়াছিল কে জানে! এক মাসের শিশু নিজে তাে নড়িতে চড়িতে পারে না, সেই ভরসায় তক্তপােশের মাচার চারিদিকে বেড়া তাহারা দেয় নাই, দুদিকে স্বামী স্ত্রী শুইয়াছিল, মাঝখানে ছিল শিশু। ছেলেকে বুকে করিয়া ঘুমের ঘােরে জননী কি পাশ ফিরিয়াছিল? ঘুমের ঘােরে ধারে সরিয়া সেই কি সন্তানকে বিসর্জন দিয়াছিল সর্বনাশা বন্যার জলে?

 চরডাঙা পৌঁছিয়া দেখা গেল সমস্ত গ্রাম জলমগ্ন, কোথাও একহাত একটু শুকনাে জমি নাই। ঘরে ঘরে স্রোতহীন কর্দমাক্ত জলরাশি থমথম করিতেছে। কুবেরের শ্বশুরবাড়ির সকলে আশ্রয় লইয়াছে বড়াে ঘরের চালার তলে কাঠের ছােটো স্থায়ী মাচাটুকুতে।

 দুটি গােরু ও বাছুরের জন্য তিনটি সুপারিগাছের মধ্যে মােটা বাঁশের ত্রিকোণ মাচা বাঁধা হইয়াছে, বাড়ির পােষা কুকুরটিও স্থান পাইয়াছে সেখানে। মালার বুড়া বাপ বৈকুণ্ঠ মাচায় বসিয়া ভীত গােরু দুটিকে খড় দিতেছিল, ঘরের চালে বসিয়া বঁড়শি দিয়া মাছ ধরিতেছিল মালার বড়াে ভাই অধর, আর ঘরের ভিতরকার মাচায় উঠিবার মই হইতে এদিকে রান্নাঘরের চাল পর্যন্ত পাশাপাশি দুটি বাঁশ বাঁধিয়া ইহারা যে সাঁকো তৈয়ারি করিয়াছে তার উপরে পা ঝুলাইয়া বসিয়াছিল কয়েকটি উলঙ্গ ছেলেমেয়ে। কুবের আসিয়াছে শুনিয়া মালার ছােটো বােন কপিলা মই ধরিয়া নামিয়া আসিল। কুবেরের শাশুড়ি আর নামিল না, ঘরের মাচার উপর হইতেই কন্যা ও নাতিনাতনির কুশল জিজ্ঞাসা করিয়া বর্ষার দেবতাকে শাপান্ত করিতে করিতে বলিতে লাগিল যে এতখানি বয়স তাহার হইয়াছে, এমন প্রলয়ংকর কাণ্ড আর তাে সে দেখে নাই বাপের জন্মে! কুবের কি জানে কী সর্বনাশ তাহাদের হইয়া গিয়াছে, বাঁধিয়া-ছাঁদিয়া পাট পচাইতে দিয়াছিল, অর্ধেক পাট যে কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে পাত্তা নাই। ভাসিয়া আর যাইবে কোথায়, কেউ চুরি করিয়াছে নিশ্চয়। হ, গরিব গৃহস্থ তাহারা, কত আশায়

এবার ধানের জমিতে পর্যন্ত পাটের চাষ দিয়াছিল, কে তাহাদের এমন সর্বনাশ করিয়াছে গাে।

 মাচা হইতে বৈকুণ্ঠ, চালা হইতে অধর, মই হইতে কপিলা আর সাঁকো হইতে উলঙ্গ ছেলেমেয়েগুলি নৌকায় আসিয়া আরাম করিয়া বসিল। কুবের তামাক সাজিয়া দিল বৈকুণ্ঠকে।

 কপিলা বলিল, নাও নিয়া আইলা মাঝি, বইনেরে আনলা না ক্যান? কতকাল দেখি নাই বইনেরে। পােলাপানগাে তাে আইনবার পারতা?

 কুবের বলিল, আনুম ভাবছিলাম। তােমরা এহানে কিবা রইছ না জাইনা শ্যাষম্যাশ ডরাইলাম। আসনের লাইগা গােপি কাঁইন্দা সারা হইছিল। তুমি আইলা কবে, কপিলা?

 কপিলা মুখভঙ্গি করিয়া বলিল, আমার কথা থোও।

 সহজ স্বাভাবিক প্রশ্নে কপিলার বিরক্তি দেখিয়া কুবের একটু অবাক হইয়া বৈকুণ্ঠের দিকে চাহিল। একমুখ ধোঁয়া ছাড়িয়া বৈকুণ্ঠ চোখ মটকাইয়া তাকে কী যেন একটা ইশারা করিল। কিছুই বুঝিতে না পারিয়া-কুবের করিল কী, মৃদু একটু হাসিয়া বলিল, অ!

 কপিলা রূঢ়স্বরে বলিল, হাসলা যে মাঝি?

 কুবের বলিল, হাসি নাই কপিলা, হাসুম ক্যান?

 কুবেরের বিবাহের সময় বড়াে দুরন্ত ছিল কপিলা। তখন পঙ্গু মালাকে বিবাহ করিয়াছিল বলিয়াই হয়তাে কপিলার দুরন্তপনা অত বেশি চোখে পড়িয়াছিল কুবেরের, অন্ধকারে যে বাস করে মৃদু আলােতে তার চোখ ঝলসাইয়া যায়, চোখ ঝলসানাে আলােতে সে হয় অন্ধ॥ তারপর কপিলার বিবাহ হইয়াছে, একটি মেয়ে হইয়া আঁতুড়ে মরিয়া গিয়াছে বছর দুই আগে। কে জানে কত শান্তশিষ্ট হইয়া উঠিয়াছে কপিলা আজকাল, কেমন সংসারী হইয়াছে তাহার মন? আর কি কোনােদিন সে গাছের ডালে কাঁচা বেতের দোলনা বাঁধিয়া দোল খাইবে, কিশাের বয়সের অপূর্ব দেহটিকে ঘাটের উপর হইতে ছুঁড়িয়া দিবে পুকুরের জলে, ডিঙি লইয়া একা একা পালাইয়া গিয়া সকলকে দিবে বকুনি দেওয়ার শাস্তি? রাগের মাথায় এ জীবনে আর কখনও হয়তাে সে কুবেরকে চ্যালা কাঠ ছুঁড়িয়া মারিবে। না মারুক। একজন চ্যালা কাঠ ছুঁড়িয়া মারিবে না বলিয়া আপশােশ করির কী আছে? খানিক পরে পাশাপাশি দুটি বাঁশের উপর দিয়া কপিলাকে ঘরের দিকে যাইতে দেখিয়া কুবেরের দুচোখ ঝাপসা হইয়া আসিল। হ, সেই পুরানাে দিনে স্মৃতি গাঁথা হইয়া আছে কুবেরের মনে।

 জল কমিয়া যাওয়া পর্যন্ত কেতুপুরে তাহার বাড়িতে গিয়া থাকিবার জন্য কুবের সকলকে নিমন্ত্রণ করিল। এ আহ্বান তুচ্ছ করিবার মতাে নয়, কিন্তু সকলে গেলে কেমন করিয়া চলে? বাড়িঘর জিনিসপত্র সব সাময়িকভাবে তুলিয়া লইয়া যাইতে পারিলে হইত, সে তাে সম্ভব নয়। বােবা গােরু-বাছুরগুলির কী হইবে? যাইতে পারে ছেলেমেয়েগুলি—আর তাদের দেখাশােনা করিবার জন্য কপিলা যদি যায় তাে যাক, মালা তাে পারিবে না এতগুলি কাচ্চা-বাচ্চাকে সামলাইতে।

 কপিলা যাইবে? বেশ।

 কুবেরের শাশুড়ি বড়াে চেঁচায়। সে বলিল, তােমারে কমু কী কুবের, মাইয়ারে নিয়া জ্বইলা মরি—হ রে বাপ, কপিলার কথা কই—মালার লাইগা ভাবুম কেরে? সােনার জামাই তুমি, খোঁড়া মাইয়ারে আমার মাথায় কইরা থুইছ—এই পােড়াকপাইল্যার কথা কই, কই আমাগাে কপিলার কথা। অলক্ষ্মীর মরণ নাই!

 সে বড়াে দুঃখের কাহিনি। সুখে ঘরকন্না করিতেছিল কপিলা, কী যে শনি ভর করিল তাহার কপালে, শীতের গােড়ায় স্বামীর সঙ্গে কলহ করিয়া সে চলিয়া আসিল বাপের বাড়ি! রাগ করিয়া তাহার স্বামী শ্যামাদাস আবার বিবাহ করিয়াছে, কপিলাকে নেয় না।

 এ খবর কুবের জানিত না। সে সবিস্ময়ে বলিল, হ?

 তারপর কপিলাকে স্বামীর কাছে পাঠানাে হইয়াছিল—ফাল্গুন মাসে। শ্যামাদাস তাহাকে বাড়িতে উঠিতে দেয় নাই, খেদাইয়া দিয়াছে। মানুষ তাে সে নয়, পশু। তাই তাে কুবেরের সঙ্গে তুলনা করিয়া কপিলার মা দিনরাত্রি তাহাকে গাল দেয়।

 তাই বটে, পঙ্গু বলিয়া মালাকে সে কখনও অনাদর করে নাই সত্য, সেটা তবে এতখানি প্রশংসার ব্যাপার? মালার জন্য, তাহার দারিদ্র্যপূর্ণ সংসারের ওই অলস অকর্মণ্য রমণীটির জন্য, কুবের হঠাৎ নিবিড় স্নেহ অনুভব করে। সৎ গৃহস্থ ও সৎ স্বামী বলিয়া যে প্রশংসা তাহার মালার জননী গলার জোরে দিগ্‌দিগন্তে রটনা করে তাহা যেন মালারই কীর্তি।

 খাওয়া-দাওয়ার পর কপিলা ও তাহার ভাইবােনদের সঙ্গে করিয়া কুবের কেতুপুরের উদ্দেশে বাহির হইয়া পড়িল। কপিলা খুব সাজিয়াছে। চুলে চপচপে করিয়া দিয়াছে নারিকেল তেল, গায়ে হলুদ মাখিয়া করিয়াছে স্নান, পরিয়াছে তার বেগুনে রঙের শাড়িখানি। স্বামী ত্যাগ করিয়াছে বটে, বয়েস তাে তার কাঁচা। আহা, কুটুমবাড়ি যাওয়ার নামে মেয়েটা আহ্লাদে আটখানা হইয়া উঠিয়াছে।

 কেতুপুরে পৌঁছিতে বেলা কাবার হইয়া আসিল। মালা উতলা হইয়া প্রতীক্ষা করিতেছিল, কিছু পাট চুরি যাওয়া ছাড়া তাহার বাপ-ভাইয়ের আর কোনাে ক্ষতি হয় নাই শুনিয়া সে আশ্বস্ত হইল। মালা শুধু খোঁড়া হইয়া জন্মে নাই, আরও একটি পঙ্গুতা তাহার আছে; সে হাসিতে জানে না, জীবন তাহাকে অলস করিয়া বিষণ্ণ করিয়াছে। ভাইবোনদের কাছে পাইয়া কতকাল পরে যে মুখে তাহার বিষণ্ণতার ছায়ালেশহীন হাসি ফুটিল!

 এদিকে স্বস্তি রহিল না কুবেরের। তার মতাে গরিব কে আছে জগতে? এই যে এতগুলি মানুষ আসিল বাড়িতে, ইহাদের সে খাওয়াইবে কী? আউশের ফসল নষ্ট হওয়ায় এবার যে দেশে দুর্ভিক্ষ হইবে এখন হইতে তাহা টের পাওয়া যায়। জলমগ্না পৃথিবীতে আহার্যের মূল্য বাড়িয়াছে। ইলিশের মরশুম বলিয়া এখন যদি কোনােরকমে চলিয়া যায়, তারপর? দু-চার পয়সা জমাইবার আশা ঘুচিয়া গেল। অতিথি আসিয়াছে, অতিথি চলিয়া যাইবে, তারপর সপরিবারে উপবাস করিবে সে। তখন হাত পাতিলে বৈকুণ্ঠ একটি পয়সাও তাহাকে দিবে না।

 নিমন্ত্রণ করিয়া ওদের সে তবে আনিয়াছে কেন? তার দুঃখের দিনে যারা ফিরিয়া তাকায় না, কেন সে তাদের অত খাতির করিতে গেল? সে আদর করিয়া ডাকিয়া না আনিলেও বন্যার কটা দিন ওরা মাচার উপর বেশ কাটাইয়া দিতে পারিত। মনে মনে কুবের রাগিয়া যায়। মালা খুশি হইয়াছে। হাসি ফুটিয়াছে মালার মুখে? স্বামীর দুঃখ না বুঝিয়া যে স্ত্রীলোেক বাপ-ভাইয়ের জন্য কাঁদিয়া মরে, হাসিমুখে তাহার মুখে গুঁজিয়া দিতে হয় আখার তলের ছাই! মালা অমন উতলা না হইলে কে যাইত চরডাঙায়? কে আনিত তাহার ভাইবােনদের ডাকিয়া?

 প্রত্যেক দিন সন্ধ্যাবেলা কুবেরের মাছ ধরিতে যাওয়ার আগে, পিসি সকলকে ভাত বাড়িয়া দেয়। কুবের এইমাত্র খাইয়া উঠিয়াছে, তবু তাহার নিজের ছেলেমেয়ের সঙ্গে আরও কয়েকটা প্রাণীকে সারি দিয়া বসিয়া খাইতে দেখিয়া ভবিষ্যতের অনিবার্য ক্ষুধায় তার ভরা পেটের অন্ন যেন মুহূর্তে হজম হইয়া যায়। মালা বসিয়া বসিয়া সকলের খাওয়ার তদবির করে, গােপির পাতের ডালমাখা ভাতটুকু সে আদর করিয়া তাহার ভাইয়ের পাতে তুলিয়া দেয়—এ দৃশ্য কুবের আর দেখিতে পারে না। নৌকায় গিয়া সে বসিয়া থাকে। হয়তাে তখন গণেশ ও ধনঞ্জয় কেহই আসে নাই—কুবের চুপ করিয়া বসিয়া থাকে একা। নদীর ঢেউয়ে নৌকা দোল খায়। হু হু করিয়া বহে বাতাস, অন্ধকার এত গাঢ় যে মনে হয় ধোঁয়ার মতােই বুঝি বাতাসে উড়িয়া যাইবে।

 কপিলা যে পিছু পিছু আসিয়াছে তা কি কুবের জানে?

 তাহার আকস্মিক হাসির শব্দে কুবের ভয়ে আধমরা হইয়া যায়। ঠকঠক করিয়া সে কাঁপিতে থাকে। নির্জন নদীতীরে সন্ধ্যারাত্রে কে হাসিবে? মানুষ নয়, নিশ্চয় নয়!

 কপিলা বলে, তামুক ফেইলা আইছ মাঝি। কুবের নামিয়া আসিয়া তামাকের দলাটা গ্রহণ করে।

 বলে, খাটাসের মতাে হাসিস ক্যান কপিলা, আঁই?

 কপিলা বলে, ডরাইছিলা, হ? আরে পুরুষ

 তারপর বলে, আমারে নিবা মাঝি লগে?

 বলে আর কপিলা আব্দার করিয়া কুবেরের হাত ধরিয়া টানাটানি করে, চিরদিনের শান্ত নিরীহ কুবেরকে কোথায় যেন সে লইয়া যাইবে। মালার বােন না কপিলা? হ। কুবের তাহার দুই কাঁধ শক্ত করিয়া ধরিয়া অবাধ্য বাঁশের কঞ্চির মতাে তাহাকে পেছনে হেলাইয়া দেয়, বলে, বজ্জাতি করস যদি, নদীতে চুবানি দিমু কপিলা!

 কপিলা ধপ করিয়া সেইখানে কাদার উপরে বসিয়া পড়ে, হাসিতে হাসিতে বলে, আরে পুরুষ!

 তাহার নির্বিবাবে কাদায় বসা আর শয়তানি হাসি আর খোঁচা দেওয়া পরিহাস—সব বড়াে রহস্যময় ও দুর্বোধ্য। হঠাৎ কুবেরের বড়ো ভয় হয়। সে সস্নেহে বলে, পাঁক মাইখা মরস কেরে কপিলা? মাইন্‌সে কইবাে কী? যা বাড়ি যা।

 কে জানে কী আছে কপিলার মনে? সে চলিয়া গেলে কুবেরের দুটি চোখের ঔৎসুক্য অন্ধকারে গােপন হইয়া থাকে। কপিলার আনিয়া দেওয়া তামাক সাজিয়া সে টানিতে আরম্ভ করে। তামাকের ভাগিদার না থাকার আরামটুকুই কি তাহার মানসিক চাঞ্চল্য ক্রমে ক্রমে শান্ত করিয়া আনে, অথবা সে নদীর বাতাস— নায়ের দোলনে পদ্মার প্রেম? মালা যে কোনােদিন ওঠে নাই, হাঁটে নাই, ঘুরিয়া বেড়াইয়া চারিদিকে জীবনকে ছড়াইয়া মেলিয়া রাখিতে পারে নাই, তার জন্য কুবেরের কোনােদিন আপশােশ ছিল না। গতি নাই বলিয়া মালার আবদ্ধ ঘনীভূত জীবন তারই বুকে উথলিয়া উঠিয়াছে—ভাঙা চালার নীচে সংকীর্ণ শয্যায় পঙ্গু মালার তুলনা জগতে নাই। কিন্তু অন্ধকার রাত্রে তামাক পৌঁছাইয়া দিতে সে তাে কোনােদিন নদীতীরে ছুটিয়া আসিতে পারে না—বাঁশের কঞ্চির মতাে অবাধ্য ভঙ্গিতে পারে না সােজা হইয়া দাঁড়াইতে!


বেগুনি রঙের শাড়িখানি পরিয়া চুলে চপচপে তেল দিয়া শুধু লীলাখেলা করিতেই কপিলা পটু নয়, কুবেরের সেবাও সে করে—জীবনে কুবের কখনও যে সেবার পরিচয় পায় নাই। সারারাত্রি পদ্মার বুকে কাটাইয়া আসিয়া এখন সে না চাহিতে পা ধােয়ার জল পায়, পান্তাভাতের কাঁসিটির জন্য হাঁকাহাঁকি করিতে হয় না, খাইয়া উঠিবামাত্র তামাক আসে, প্রস্তুত থাকে তাহার দীন মলিন শয্যা এবং ফাঁক পাইলেই কোনােদিন গোঁফ ধরিয়া টান দিয়া, কোনােদিন একটা চিমটি কাটিয়া, হাসি চাপিয়া চোখের পলকে উধাও হইয়া—ঘুম আসিবার আগেই কপিলা তাহাকে স্বপ্নও আনিয়া দেয়।

 পরের পেট ভরাইতে ফতুর হইতে বসিয়াও গৃহে তাই কুবেরের আকর্ষণ বাড়ে।

 কমে মাঠঘাটের জল।

 ও তো মানুষের চোখের জল নয়, কমিবে বইকী। একদিন মালার বড়াে ভাই অধর খবর লইতে আসে। কুবেরকে সে সত্যসত্যই কুবের ঠাওরাইয়া রাখিয়াছে কিনা সে-ই জানে, কর্জ চাহে দুটি টাকা। টাকা না পাইয়া তাহার রাগ হয়। সকলকে সে চরডাঙায় ফিরাইয়া লইয়া যাইতে চায়। কুবের বারণ করে না, মালাও নয়, ভাইবােনকে কাছে পাওয়ার আনন্দ পুরানাে হইয়া আসিতে কতদিন আর লাগে বােনের? তা ছাড়া কপিলার চাপল্য ও হাস্যপরিহাসের জন্য ঈর্ষাও হয়তাে মালার হয়, কোনােদিন হয়তাে কুবেরের সঙ্গে কপিলার অন্যায় মাখামাখি চোখেও পড়িয়াছে তাহার—একস্থানে ঠায় বসিয়া থাকিলেও দৃষ্টি তাে সে পাতিয়া রাখে সর্বত্র।

 কিন্তু কপিলা যায় না। ঝগড়া করিয়া গাল দিয়া অধরকে সে ভাগাইয়া দেয়। কে জানে কী আছে কপিলার মনে!


ময়নাদ্বীপ হইতে রাসুর আকস্মিক আবির্ভাবের বিস্ময় গ্রামের লােকের কাছে পুরানাে হইয়া গিয়াছে, রাসুর অভিজ্ঞতার গল্প শুনিবার কৌতুহল কাহারও নাই। রাসু বলিতে চায়, সবিস্তারে বারবার আগাগােড়া সমস্ত কাহিনিটা বলিবার জন্য সে ছটফট করে, কিন্তু শ্রোতা পায় না। কত শুনিবে লােকে? শুনিয়া শুনিয়া কান ঝালাপালা হইয়া গিয়াছে সকলের।

 হােসেন মিয়া কিছু টাকা দিয়াছে রাসুকে, রাসুর ইচ্ছা টাকাটা দিয়া সে একটি বউ খরিদ করে, গােপি হইলেই ভালাে হয়। কিন্তু কুবের এ প্রস্তাব কানেও তােলে না। কত টাকা দিয়াছে হােসেন মিয়া তাহাকে? হাজার না লাখ? আর কী আছে রাসুর—ঘর-দুয়ার, জীবিকার উপায়? তা ছাড়া গােপির পাত্র একরকম ঠিক হইয়াই আছে—গণেশের শালা যুগল। যুগলের মতাে পাত্র থাকিতে যার তার হাতে কুবের মেয়ে দিবে কেন?

 গােপিকে কিন্তু বড়ােই পছন্দ হইয়াছে রাসুর।

 ময়নাদ্বীপের গল্প করিবার ছলে সে কুবেরের বাড়ি আসে, আড়চোখে আড়চোখে সারাক্ষণ সে গােপির দিকে তাকায়, পরির মতাে সুন্দরী মনে হয় গােপিকে তাহার। ভাইকে কোলে করিয়া বাঁকা হইয়া কী তাহার দাঁড়ানাের ভঙ্গিমা! হ, রুখাে রুখাে লালচে বটে চুলগুলি গােপির, কপালটা একটু উঁচুই, থ্যাবড়ানাে নাকের নীচে উত্তোলিত ওষ্ঠে ঠেকিয়া নােলকটা তাহার দুলিতে পায় না, আর হ, বড়াে নােংরা গােপি। তবু তাে রাসু চোখ ফিরাইতে পারে না! তবু তাে তার মনে পড়ে না এমন অতুলনীয় রূপ সে কোথাও দেখিয়াছে! কী রং গােপির! কী মনােহর তাহার চলাফেরা, কী চাউনি!

 বয়স রাসুর বেশি হয় নাই, যুগলের চেয়েও তার বয়স কম। নূতন করিয়া সংসার পাতিয়া জীবনটা আবার গুছাইয়া লইবার সময় তাহার পার হইয়া যায় নাই। গােপিকে পাইলে আবার সে আরম্ভ করিতে পারে—বয়স্থা বাড়ন্ত মেয়ে গােপি, বিবাহের এক বছরের মধ্যে ও স্বামীর ঘর করিতে আসিবে, পাঁচ-ছ বছরের একটা মেয়েকে বিবাহ করিয়া তার বড়াে হইবার আশায় হাঁ করিয়া বসিয়া থাকিবার ধৈর্য রাসুর আর নাই। যাদের সে বিসর্জন দিয়া আসিয়াছে ময়নাদ্বীপে, তাড়াতাড়ি আবার তাদের ফিরিয়া পাওয়া চাই। একা একা বড়াে কষ্ট হইতেছে রাসুর। পীতম মাঝির সঙ্গে রাসুর কলহ হইয়া গিয়াছে। হােসেন মিয়ার দেওয়া টাকাটা বাগাইয়া লওয়ার জন্য পীতম মাঝি বড়ােই ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল। রাসু তাই পৃথক হইয়া গিয়াছে। কে জানিত গ্রামের মধ্যে পীতমের মেয়ে যুগীই সর্বস্বান্ত পিসতুতাে ভাইটিকে এতখানি খাতির করবে। শীতলকে দিয়া বাবুদের বলিয়া নিজের ঘরের কাছে খানিকটা জমি যুগীই রাসুকে জোগাড় করিয়া দিয়াছে—রাসু একখানা ঘর তুলিয়াছে সেখানে।

 সেই ঘরে রাসু বাস করে একা, হয়তাে ধ্যান করে গােপির! বিকালে কেতুপুর গ্রামের মধ্যে সওদা আনিতে যাওয়ার সময় পথের নির্জনতম অংশে কোনােদিন গোপি রাসুকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিতে পায়।

 রাসু বলে, কই যাও গােপি? সে একটু স্নেহ-ব্যঞ্জক হাসি হাসে। গাঁট হইতে বাহির করে একটি কাচ বসানাে পিতলের আংটি আর পুঁতির মালা, বলে, নিবা?

 গােপি খুশি হইয়া উপহার গ্রহণ করে। রাসুকে ভালই লাগে তাহার, রাসুর জন্য সে একটু দুঃখ বােধ করে। কোথায় সেই ময়নাদ্বীপ কে জানে, সকলকে রাসু সেখানে হারাইয়া আসিয়াছে, বড়াে কষ্ট পাইয়াছে সে জীবনে। তাছাড়া রাসুর কথাগুলি ভারী মিষ্টি, শুনিতে বড়াে ভালাে লাগে গােপির। আর কী খাতিরটা রাসু তাহাকে করে। কত যেন সে বড়াে হইয়াছে, এগারাে বছরের মেয়ে সে নয়।

 যুগীর সঙ্গে মাঝে মাঝে রাসু পরামর্শ করে, একটা কী উপায় ঠাওরানাে যায় না কুবেরকে যাহাতে রাজি করানাে যায়? পরামর্শ অনেক হয়, উপায় হয় না। শীতলের অনুপস্থিতিতে তাহার পরিষ্কার শয্যায় আরাম করিয়া বসিয়া তাহার হুঁকায় তামাক টানিতে টানিতে পরামর্শ করিতে পারাটুকুই লাভ হয় রাসুর। আর যুগীর সমবেদনা। রাসুকে যুগী খুব খাতির-যত্ন করে, রাসুর মুখে ময়নাদ্বীপের কাহিনি বারবার শুনিয়াও সে শ্রান্ত হয় না। কত বাসিন্দা ময়নাদ্বীপে? কী কী ফসল হয়? দ্বীপের চারিদিকে বুঝি সমুদ্র? আচ্ছা, সমুদ্র কত বড়াে—পদ্মার চেয়েও বড়াে বুঝি? আজও যুগী রাসুকে এইসব প্রশ্ন করিতে ভালােবাসে। যুগীর বয়স বেশি নয়, বছর বাইশ—বড়াে শান্ত তাহার স্বভাব, বড়াে সরল তাহার মন। শীতল তাহাকে সুখে রাখিয়াছে, আড়াল করিয়া রাখিয়াছে জেলেপাড়ার দারিদ্র্য ও হীনতা হইতে। যুগীর মনে অপরিমিত সন্তোষ। এত দয়ামায়া, এমন কোমলতা জেলেপাড়ার আর কোনাে মেয়ের নাই। জেলেপাড়ার কারও ঘরে কোনােদিন যদি অন্ন না থাকে, চুপিচুপি একবার যুগীর কাছে আসিতে পারিলে আর তাহার উপবাসের ভয় থাকে না—দুঃখের কাহিনি যে যত জমজমাট করিয়া বলিতে পারে ছলছল চোখে যুগী তাহাকে চাল দেয় তত বেশি—খরচের পয়সা দান করিয়া শীতলের বকুনি শােনে। শীতল লােকটা বড়াে কৃপণ, যুগীর দান করা স্বভাবটা সে পছন্দ করে না কিন্তু এমন আশ্চর্য মন মানুষের, যুগীর এই মন্দ স্বভাবের জন্যই তাহাকে শীতল ভালােবাসে বেশি। যুগীকে সে কৃপণ হইতে বলে। কিন্তু সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরিলে যুগী যেদিন ভয়ে ভয়ে তাহাকে শােনায় না যে একজন আসিয়া তাহার ঘাড় ভাঙিয়া যা পারিয়াছে আদায় করিয়া লইয়া গিয়াছে, সেদিন মনটা যেন খুঁতখুঁত করে শীতলের।

 মাছের মূল্য বাবদ কুবের কয়েক আনা পয়সা পাইত। শীতল কখনও ঋণ পরিশােধ করে না। তাগিদ করিয়া করিয়া কুবের হয়রান হইয়া গিয়াছে। তবু, একদিন সকালে আবার সে আশা করিয়া আসিল।

 যুগী রাঁধিতেছিল, শীতল আর রাসু করিতেছিল গল্প। কুবেরকে দেখিয়া রাসু চঞ্চল হইয়া উঠিল, বসিতে দিয়া খাতির করিয়া কলিকাটা বাড়াইয়া দিয়া বলিল, তামুক খাও।

 না, কুবেরের বসিবার সময় নাই, তামাক খাওয়ার সময় নাই! শীতল তাড়াতাড়ি পয়সাটা দিয়া দিক সে তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইবে—বসিয়া তামাক টানিতে আসিয়াছে নাকি সে? হ, কুবের আজ রাগিয়াছে। আজ সে মাছের দাম আদায় করিয়া ছাড়িবে। শীতল প্রথমে অমায়িক হাসি হাসিয়া জিজ্ঞাসা করে, এত রাগ কেন কুবেরের, এই সকালবেলা? তারপর সেও রাগিয়া যায়, বলে, যা যা দিমু না পয়সা, কর গিয়া নালিশ।

 রাসু বুঝি কুবেরকে খুশি করতে চায়, সে বলিল, দ্যান শেতলবাবু, দিয়া দ্যান পয়সা।

 পয়সা দিল যুগী। কলহের মাঝখানে দশ আনা পয়সা আনিয়া কুবেরের সামনে রাখিয়া দিল, শীতলকে ধমক দিয়া বলিল, সামান্য ক-আনা পয়সার জন্য এত কাণ্ড করা কী জন্য? কত কর্তৃত্ব যুগীর! শীতল কথাটি বলিল না, কুবেরের দিকে কড়া চোখে চাহিয়া ঘরের ভিতরে চলিয়া গেল।

 পয়সা কুড়াইয়া কুবের উঠিল, সঙ্গে উঠিল রাসু। কী বিনয় রাসুর, কী সব তােষামােদে কথা! পথ চলিতে চলিতে রাসু নানা কথা বলে। এবার সে একটা ব্যাবসা আরম্ভ করিবে—ব্যাবসা ছাড়া পয়সা নাই মানুষের, একটা সে দোকান দিবে দেবীগঞ্জে। কিসের দোকান এখনও সে তা ঠিক করে নাই, ভাবিয়া চিন্তিয়া একটা কিছু ঠিক করিয়া লইবে—কুবের কী পরামর্শ দেয়? জীবনে উন্নতি করিবে রাসু, প্রাণপণ করিয়া লাগিলে কী না হয় জগতে? তা ছাড়া পুরুষের ভাগ্যের কথা কে জানে! আজ ফকির—কাল রাজা! কুবের গম্ভীর মুখে সায় দিয়া বলে, হ। ভাবে, ময়নাদ্বীপে গিয়া বড়াে বড়াে কথা বলিতে শিখিয়া আসিয়াছে রাসু, চাল দিতে শিখিয়াছে।

 মাঠের দিকে চাহিলে বােঝা যায় জল কোথায় নামিয়া গিয়াছে, ধানের ফসল কাত হইয়া পড়িয়া আছে। পদ্মা হইতে আজ জোর বাতাস বহিতেছিল, চারিদিকে অসংখ্য পাখির কলরব, শিশিরভেজা ডাঙায় ছড়াইয়া আছে সােনার রােদ, শরৎকাল আসিয়া পড়িয়াছে সন্দেহ নাই। নদীতীরে কাশের বন এবার সাদা হইয়া উঠিবে। কুবেরের সঙ্গে রাসু তাহার বাড়ি পর্যন্ত আগাইয়া যায়। না, গােপি এখন বাড়ি নাই। কপিলার সঙ্গে সে জল আনিতে গিয়াছে নদীতে। কুবের রাসুকে বসিতে বলে না, পিসির নিরিবিলি ঘরখানায় গিয়া ঢেকে ঘুমের জন্য, রাসু আস্তে আস্তে ফিরিয়া যায়। যায় সে নদীর ধারে, গাল সে খায় কপিলার, তারপর হনহন করিয়া হাঁটিতে আরম্ভ করে কেতুপুর গ্রামের দিকে। না, নদীর ধারে ওভাবে দাঁড়ানাে উচিত হয় নাই। কপিলা যদি বলিয়া দেয় কুবেরকে?