পসরা/অন্ধ
অন্ধ
ক
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!
কি বল্চেন?—হাস্চি কেন?হুঃ-হাস্চি কেন!-কে জানে! হয়ত’ কাঁদ্তে পার্চি না বলেই হাস্চি! আমার বুকের ভিতরে বালির চড়া পড়ে গেছে কিনা! সব জল শুকিয়ে গেছে গো, শুকিয়ে গেছে। আসে না। আমি কান্নার বদলে তাই শুধু চোখ দিয়ে তাই আর জল হাচি আর হাসচি!
— হ্যাঁ, যা বল্ছিলুম। বাবা ত’ কিছুতেই আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন না। আমার হয়ে বল্তে গিয়ে উল্টে মা তাঁর কাছে ধমক খেলেন।
বাবা বল্লেন, “পঞ্চাশ হাজার টাকা আমি কখনো চোখেও দেখেনি। মেয়ে অন্ধ, তা হয়েচে কি! এতগুলো টাকা কি ছাড়া যায়?”
মেয়ে চোখে দেখ্তে পায় না, বাবাও পঞ্চাশ হাজার টাকা কখনো চোখে দেখেন নি। বিয়ে হলে মেয়ে যদিও চোখে দেখ্তে পাবে না, কিন্তু বাবাত, এতগুলো টাকা চোখে দেখ্তে পাবেন!—ব্যস, তাহলেই হল, তাহলেই হল! তাঁকে টাকা দ্যাখাবার জন্যে আমাকে বিয়ে কর্ত্তে হবে।
মা বড় অবুঝ। স্ত্রীলোক কিনা! বল্লেন, “তবু ছেলেটার দিকেও ত’ একবার তাকাতে হয়!”
বাবা রেগে বল্লেন, “ভগবান্ যাকে মেরেচেন, আগে তার দিকে তাকানে। উচিত! জান সে অন্ধ!”
হাঃ হাঃ—বাবার কি ধর্ম্মজ্ঞান! কিন্তু বাবা আমার এ সহজ কথাটা ইচ্ছে করেই বুঝলেন না যে, ভগবান্ যাকে মেরেচেন, দুনিয়ায় আমি ছাড়া তার দিকে তাকাবার জন্যে আরও ঢের লোক আছে। এ বাঙ্গলা যে দয়ায় ভরা! পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে পারলে এখানে অন্ধ হলেও বিয়ে বন্ধ থাকে না; বাঙ্গালী বরের বাপ টাকা পেলে চিতা থেকেও মরা মেয়েকে ছাঁদ্নাতলায় টেনে নিয়ে যেতে পারে!
বাবা আবার বল্লেন, “আমার যদি বয়স থাক্তো, এ মেয়েকে তাহলে আমিই বিয়ে—”
মা তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বল্লেন, “চুপ কর, চুপ কর! বল্চ তুমি!”
বাবা ঠিক্ই বল্চেন। দুবেলা সন্ধ্যাহ্নিক করেন, মাথায় টিকি, গলায় পৈতে রাখেন, ভগবান্ যাকে মেরেচেন তার দিকে তিনি তাকাবেন না?
হাঃ হাঃ?—
আমারও, —তাতে আপত্তি ছিল না।
খ
দুঃখের কথা, পঞ্চাশ হাজার টাকা চোখে দ্যাখ্বার অবকাশ বাবা বেশীদিন পেলেন না। মৃত্যু এসে আমার এই অন্ধবধূর মত বাবাকেও অন্ধ করে অন্ধকারে নিয়ে গেল। জানি না, ইহলোকের এই পঞ্চাশ হাজার টাকার আওয়াজ তিনি তাঁর বৈতরণীর পরপার থেকে শুনতে পাচ্ছেন কিনা।
হাঃ হাঃ!—আর, আর—আমার এই হাসির শব্দ! এও কি তাঁর কাণে যাচ্ছে? এ হাসির শব্দ কি তাঁর বুকের হাড়ে হাড়ে, তাঁর পাঁজরে-পাঁজরে গিয়ে ঘা মার্চে, মার্চে, মার্চে? আমি এটা জান্তে চাই। কেউ বল্তে পার?
বেণু শুধু অন্ধ নয়। ভগবান্ তাকে অন্ধকারের মত কালো করে, আমার মুখের সামনে বিষের পাত্র পূর্ণ করে রেখেছেন।
কিন্তু তার নাম রাখ্লে কে? নামের এমন সার্থকতা আমি আর কখনো দেখিনি! আশ্চর্য্য! তার সমস্ত রূপের অভাব, চোখের অভাব যেন এই মধুর, কোমল অথচ বিষাদমাখা স্বরের ভিতরে পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল।
কিন্তু, সে অন্ধ। সে কালো। তার দিকে চাইতে আমার ঘৃণা হোত, আমার রাগ হোত। আপনার চির-অন্ধকারের মধ্যে ডুবিয়ে কেন সে আমার জীবনকেও অন্ধকার করে দিলে? কেন দিলে— কেন?
সে, বাড়ীর অন্য-অন্য সকলকার পায়ের শব্দের ভিতর থেকে আমার পায়ের শব্দ ঠিক চিনে নিতে পারত। এটা আমি লক্ষ্য করে দেখেচি। আমার পদশব্দ শুন্লেই সে মুখ তুলে উৎকর্ণ হয়ে থাক্ত। কিন্তু, আমি যে তাকে ঘৃণা করি, এটা সে বুঝ্তে পার্ত। কারণ, আমি তার কাছে গেলে সে সরে যেত। নয়ত কেমন-যেন জড়সড় হয়ে দোষীর মত বসে থাক্ত। আর এক আশ্চর্য্যের কথা, আমার সঙ্গে এতদিন সে একটাও কথা বলে নি। এক অন্ধ, অন্ধকার মৌনের মত, সে আমার প্রাণমনের উপরে চেপে বসেছিল।
তাকে কথা কওয়াবার জন্যে আমিও কিছু ব্যস্ত ছিলাম না। আমিও তার সঙ্গে কথা কই নি।
এমনিভাবে একবছর গেল। এই একবছর আমরা কেউ কারুর সঙ্গে একটাও কথা কই নি। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে এমন নীরবতা যে থাক্তে পারে, আগে আমার এ জ্ঞান ছিল না। ওঃ! তোমরা এ কল্পনা কর্তে কর্তে না। এ নীরবতা অসহ্য— অসহ্য—অসহ্য!—হ্যাঁ, অসহ্য বটে,—তবু এ নীরবতা ভঙ্গ কর্বার সাহস আমাদের কারুর ছিল না।
গ
আমি জীবনটাকে উপভোগ কর্ছিলাম।
আমার যৌবনের ভিতরে অনেকখানি ফাঁক্ থেকে গিয়েছিল। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যার পূর্ণ যৌবনের তপ্ত রক্তধারা অপব্যয় হয়, তার কণ্ঠ সকলে বুঝ্তে পার্বেন না।
বন্ধুরা পরামর্শ দিলেন, ক্ষতিপূরণ কর। লোহার সিন্ধুকে পঞ্চাশ হাজার টাকার কোম্পানীর কাগজ মজুৎ রেখে, বাবা (অনিচ্ছাসত্বে কিনা, জানি না! পরলোকে প্রস্থান করেছিলেন। —কিন্তু দুঃখের বিষয়, সিন্ধুকের চাবীটি তিনি ট্যাঁকে করে নিয়ে যেতে পারেন নি।
সেই পঞ্চাশ হাজার টাকায় আমি আমার জীবনের ফাঁক্টুকু ভরিয়ে তোল্বার চেষ্টা কর্লাম। প্রায়ই আমার বৈঠকখানায় বাইজীর “হিলি-মিলি-পানিয়া”র সঙ্গে মদের পিয়ালায় ঠিনি-ঠিনি সুর বেজে উঠ্তে সুরু হোল। ফলে, আমার জীবনের ফাঁক্টুকু যতই ভরে উঠ্তে লাগ্ল, বাবার লোহার সিন্ধুকও ক্রমে ততই খালি হয়ে আস্তে লাগ্ল।
বেণুর চোখ ছিল না, কিন্তু কাণ ছিল। সে কিছু দেখ্তে না পেলেও শুন্তে পেত সব। আমাকে মুখ ফুটে কিছু না বল্লেও, তার মনে যে ঝড় উঠেচে, এটা আমি তার মুখ দেখে বেশ স্পষ্টই বুঝ্তে পারতাম। কিন্তু, বুঝেও আমার প্রাণে দয়া হোত না,— বরং একটা নিষ্ঠুর আনন্দের ভাব জেগে উঠ্ত।
রাত্রে আমি প্রায়ই বাড়ীতে থাক্তাম না। বাড়ীতে থাক্লেও বেণুর কাছে যেতাম না। তার প্রতি আমার ঘৃণা ও রাগ ক্রমেই বেড়ে উঠ্ছিল।
সেদিন হঠাৎ আমার জ্বর হোল। বাইরের ঘরে জ্বরে কাঁপ্তে কাঁপ্তে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। তারপর, কখন-যে আমার প্রাণের ইয়ারেরা আমার কাছে থাকাটা অনাবশ্যক মনে করে আস্তে আস্তে সরে পড়েছিল, আর কখন-যে চাকরেরা আমাকে ধরাধরি করে অন্দরে শুইয়ে দিয়ে এসেছিল, সে খেয়াল আমার আদোপেই ছিল না।
স্তব্ধ রাত্রে, ঘরের ঘড়ীটা হঠাৎ বেজে উঠল। সেই শব্দে আমার জ্ঞান হোল। আমি গুণ্লাম একটা, দুটো, তিনটে, চারটে! শেষরা তের থম্থমে নিস্তব্ধতাকে অকস্মাৎ জাগ্রৎ করে দিয়ে ঘড়ীটা আবার থেমে গেল। কেবল, রজনীর হৃৎপিণ্ডের শব্দের মত, সেই চির-জাগন্ত ঘড়ীটা ক্রমাগত মৃদুস্বরে করতে লাগল, টিক্-টিক্-টিক্!
মনে হোল, কে-যেন আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,—খুব আল্তভাবে। আমার মাথার ভিতরটা তখন জ্বলে-পুড়ে যেন খাক্ হয়ে যাচ্ছিল, —কে আমার সেবা কর্চে সে কথা আমি বুঝতেও পার্লাম না, বুঝবার চেষ্টাও কর্লাম না।
“বড় তেষ্টা—একটু জল।”
আমার মুখের কাছে কে জলের গেলাস ধর্লে।
জলপান করে আমি অনেকক্ষণ শুয়ে রৈলাম। অন্ধকারে দেখতে পেলাম না,—কিন্তু, কে আমাকে পাখার বাতাস কর্ছিল।
হঠাৎ আমার কপালে দু-ফোঁটা জল পড়্ল। এ কিসের জল? আবার, -এক, দুই, তিন ফোঁটা! একফোঁটা আমার ঠোটে পড়্ল, —বুঝলাম, সে চোখের জল! এই রাতে আমার শিয়রে বসে কাঁদে কে?
তখন, একজনকে মনে হোল। হ্যাঁ,—একজনকে! কিন্তু কিন্তু, কেন কাঁদে সে?
পীড়ায় বোধ করি, মানুষের মনকে পল্কা করে ফেলে। নইলে, ক-ফোঁটা অশ্রুজলে আমার অমন পাথরের মত মন ভিজে নরম হয়ে গেল কেন?
আস্তে আস্তে ডাক্লাম, “বেণু?”
উত্তর পেলাম না।
“বেণু?”
পাখার হাওয়া থেমে গেল।
“বেণু কথা কও!”
অতি মৃদু—কম্পিত স্বরে উত্তর পেলাম, “কি বল্চ?”
“তুমি কাঁদ্চ কেন?”
“কাঁদি নি।”
“মিছে কথা বোল না।”
ভয়ে-ভয়ে বাধো-বাধো গলায় বেণু বল্লে, “আর,— আর কাঁদ্ব না।”
আমি চুপ করে রৈলাম। তখন কি ভাবছিলাম, তা আর আমার মনে নেই।
অনেকক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করলাম, “এত রাত পর্য্যন্ত তুমি জেগে আছ কেন?”
“তোমার যে জ্বর হয়েচে!”
“আমার জ্বর, তাতে তোমার কি?”
উত্তর পেলাম না। তার বদলে আমার কপালে দু-ফোঁটা জল পড়্ল। যে চোখে দৃষ্টি নেই, সে চোখেও ব্যথার অশ্রু থাকে! ভগবান! দু-বিন্দু অশ্রু মনের কথা এমন করে খুলে বল্তে পারে?
আমার মনটা কি-রকম হয়ে গেল,—আমি দুহাত বাড়িয়ে বেণুকে আমার বুকের উপরে টেনে নিলাম। তার মুখে আমার মুখ রেখে চুম্বন করলাম। বেণু অস্ফুটস্বরে কি বল্লে। তার সারা দেহ থর্থর্ করে একবার কেঁপে উঠল। তার মাথাটি আমার কাঁধের উপরে এলিয়ে পড়্ল। তারপর, প্রাণপণে আমার বুক দুহাতে জড়িয়ে ধরে সে থির হয়ে পড়ে রৈল।
প্রতঃসন্ধ্যার স্তব্ধ চিতা যখন পূর্ব্বমেঘে জ্বলে উঠল, তখন তার আলো বেণুর অন্ধনেত্রে, কৃষ্ণদেহের উপরে এসে পড়্ল।
অন্ধ বেণু—কালো বেণু!
তখনও সে আমার বুকের উপরে তেমনি নিসাড় হয়ে পড়েছিল। ভোরের আধা আলোয়, আধা ছায়ায় বেণুর অন্ধ চোখ ও কালো দেহের দিকে একবার চেয়ে দেখ্লাম। তেমন করে আগে কখন’ তাকে দেখি-নি, পরেও কখন’ দেখ্বার সময় পাইনি।
তাব চোখের পাতাদুটির উপরে আস্তে-আস্তে হাত বুলিয়ে দিলাম। পদ্মপুটে বন্দী বৃষ্টিবিন্দু নাড়া পেলে যেমন ঝরে পড়ে, বেণুর চোখ থেকেও তেমনি ঝর-ঝর করে আবার অশ্রু ঝরে পড়্ল।
“বেণু!”
“ওগো নাগো না, আর অমন কর্ব না!”
“কি কর্বে না?”
“আর কাঁদ্ব না!”
আমার অবরুদ্ধ কণ্ঠ ভেদ করে বলে উঠলুম—“না,—কাঁদ তুমি। আমিও কাঁদি।”
ঘ
তারপর? তারপর আমার জ্বর, বসন্তরোগে দাঁড়াল। বসন্ত আমাকে প্রাণে মার্লে না, কিন্তু আমার চোখদুটো উপড়ে নিয়ে গেল।
বেণুর মত আমিও অন্ধ!
বেণুকে জীবনে সেই একবারমাত্র দেখেছিলুম। তাকে দেখার আশা মিট্ল কৈ? এই ঘন অন্ধকার ঠেলে তার একটা ছায়ামূর্ত্তি বিদ্যুতের মত এক-একবার চম্কে ওঠে বটে, কিন্তু তাতে যে তৃপ্তি হয় না গো, তৃপ্তি হয় না।