পসরা/সোণার চুড়ী
সোণার চুড়ী
ক
অমলা যখন এতটুকু মেয়ে, তখন এক দৈবজ্ঞ ব্রাহ্মণ বলিয়াছি, “এ মেয়ে রাজরাণী হবে।” অমলার রাণীর মত রূপ দেখিয়া দৈবজ্ঞ একথা বলিয়াছিল, না তার ভাগ্যলিপি পড়িয়া এরূপ ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিল, সেটা আগে কেহ ভাবিয়া দেখে নাই। তবে কথাটা শুনিয়া অমলার বাপ হাসিয়াছিলেন, তার বিধবা পিসী অমলার মৃত মাকে স্মরণ করিয়া কাঁদিয়াছিলেন এবং “দক্ষিণায় পূর্ণহস্ত” হইয়া দৈবজ্ঞ ঠাকুর সহর্ষে গৃহে ফিরিয়াছিলেন।
কলিতেও ব্রাহ্মণ-বাক্য মিথ্যা হইবার নহে। তবে কল্পনার রাজা, খাটো হইয়া বাস্তবে রাজেন্দ্রে পরিণত হইল। বাঙ্গলা দেশে তাঁহার কন্যার করপ্রার্থী রাজামহারাজার অন্যায় এবং আশ্চর্য্যরকমের অভাব দেখিয়া অমলার পিতা শেষটা বাধ্য হইয়া রেলোয়ে অফিসের পঁয়ত্রিশটাকা মাহিনার কেরাণী রাজেন্দ্রবাবুর হাতে মেয়েকে সঁপিয়া দিলেন। কন্যাদায় হইতে উদ্ধার পাইয়া অমলার বাপ আর একবার হাসিলেন। অমলার মৃত মাকে স্মরণ করিয়া পিসীমা আর একবার কাঁদিলেন এবং লুচির কোণ্ ভাঙ্গিতে ভাঙ্গিতে পাড়ার দৈবজ্ঞঠাকুর আর একবার ভবিষ্যদ্বাণী করিলেন, “দেখেনিও, ঐ রাজেন্দ্রই পরে রাজরাজেন্দ্র হবে। আমার গণনা মিথ্যা হবার নয়!”
সে আজ আট বৎসরের কথা।
খ
সেদিন মাসকাবার।
অফিস হইতে ফিরিয়া রাজেন্দ্র মাসের খরচ দেখিতেছিল। “বাড়ীভাড়া আঠার টাকা, ঝী’য়ের মাইনে তিনটাকা, দুধ-বার্লি চারটাকা, মাসকাবারি জিনিষ-পত্রের জন্যে মুদির দোকানে কম করে ধরেও অন্তত ছয়টাকা, সকলকার জলখাবার চারটাকা। মাইনে পাই চল্লিশটাকা— হাতে রইল পাঁচটাকা। আর কি কি খরচ বাকী রইল গা?”
অমলা বলিল, “বাজার-খরচ ভুলে গেলে বুঝি?”
রাজেন্দ্র বলিল, “কিচ্ছু ভুলিনি— আমি ভুল্লেও তোমরা ভুল্বে কেন? তবে কথাটা কি জান? আর আর খরচের কথা মনে কর্ত্তেও আমার ভয় হচ্চে।”
অমলা বলিল, “এমাসে অন্তত দুজোড়া কাপড় না হলে চল্বে না, তা জান?”
মুখ বেঁকাইয়া রাজেন্দ্র বলিল, “জানি না আবার! খুব জানি! তার পর?”
“রজকের তিনমাসের পাওনা বাকী আছে। এবারে দাম চুকিয়ে না দিলে সে আর কাপড় কাচ্বে না।”
“বলে যাও—”
“খুচ্রো খরচ আছে।”
“যথা—?”
“সে কি আর হিসেব করে বলা যায়? হঠাৎ আপদ্-বিপদ্, কোথাও যাওয়া-আসা, আত্মীয়-কুটুম্বিতে (রাজেন্দ্র হতাশভাবে আড়্, হইয়া মাদুরে শুইয়া পড়িল) নাপিত-নাপ্তিনী, ছেলের স্কুলের মাহিনা—এমন আরো কত কি!”
শুইয়া-শুইয়া দুইচোখ বুঁজিয়া রাজেন্দ্র বলিল, “ওগো, একটা হিসেব ভুলেছ।”
“কি?”
“অর্দ্ধেক রাজত্ব-কেনার কথাটা। এ মাসে সেটাও ত’ অবিশ্যি করে কেনা চাই?”
অমলা স্বামীর মুখের দিকে চাহিল। তারপর হাসিয়া বলিল, “চাই বই কি! জ্যোতিষ ঠাকুর বলেছিল, তুমি নিশ্চয় রাজা হবে—মনে নেই? রাজত্ব নইলে চল্বে কেন?”
রাজেন্দ্র উঠিয়া বসিয়া মুখভার করিয়া বলিল, “তোমার হাসি আস্চে অমলা? আমার ত’ কান্না পাচ্চে!”
অমলা উচ্চহাস্য করিয়া বলিল, “এখনি কান্না? এখনো যে চাল আর কয়লার ফর্দ্দ বাকী আছে!”
রাজেন্দ্র গুম্ হইয়া বসিয়া রহিল। মাঝেমাঝে ঘরের এদিকেওদিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল। যে দিকে চায়, সেইদিকেই সে এক একটা নূতন অভাবের চিহ্ন দেখে, আর তার বুকটা ধড়াস্ করিয়া ওঠে। ঐ ও-দিকের কুলঙ্গিতে একটা চিম্নিহীন ল্যাম্প্ রহিয়াছে; চিম্নিটা কাল ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, আজ আর একটা না কিনিলে নয়। এদিক্কার দেওয়ালে একখানা ছেঁড়া কুটিকুটি গামোছা ঝুলিতেছে। এখানে একখানা ভাঙ্গাচোরা আয়না, ওখানে একটা ছেঁড়া কামিজ। সমস্ত অভাব যেন মূর্ত্তি ধরিয়া রাজেন্দ্রকে ভয় দেখাইতে লাগিল। হাতে পয়সা না থাকিলেও মাসের অন্যান্য দিনগুলা যেমন তেমন করিয়া কাটিয়া যায়; কিন্তু কেরাণীর সংসারে যেদিন টাকা আসে, সেই কাঙ্ক্ষিত মাসকাবার অতি—অতি ভয়ানক! অমলা বলিল, “কি ভাব্চ?”
তিক্তস্বরে রাজেন্দ্র বলিল, “চিতার আগুনের কথা।”
“ভাব্লে আগুন জ্বল্বে বৈ নিব্বে না।”
“জ্বলুক। সমস্ত জ্বলে-পুড়ে খাক্ হয়ে যাক্। আমি বাঁচি।”
“ছিঃ, তুমি না পুরুষ?”
“ভগবান্, আস্চে জন্মে আমি যেন স্ত্রীলোক হয়ে জন্মাই। কি বল অমলা, স্ত্রীলোক হলে আরত আপিসে কেরাণীগিরি কর্ত্তে আর কলম পিষে মর্ত্তে হবে না?”
“হ্যাঁগো, আমরা কি বড় সুখে আছি?”
“সুখে নেই? যে হাস্তে পারে, তার আবার দুঃখ কি? তুমি হাস্চ, আমি হাস্তে পার্চিনে কেন?
“ও-সব কথা আর ভেব না। এখন কি কর্ব্বে, বল?”
“কর্ব্ব আমার মাথা আর মুণ্ডু। বাকী আছে বাজারখরচ, কাপড়, ধোপার মাইনে, খুচরো খরচ, আর চাল, কয়লা। অন্য খরচ ক’রে হাতে থাকে পাঁচটাকা—সে ত সমুদ্রে শিশির। আমার অবস্থায় পড়্লে অন্য কেউ কি কর্ত্ত জান?”
“জানি।”
“কি?”
অমলা দুষ্টামির হাসি হাসিয়া বলিল, “স্ত্রীকে চুম্বন।”
“আত্মহত্যা—আত্মহত্যা কর্ত্ত! এখনো ঠাট্টা? এই রইল তোমার পাঁচটাকা—তোমার যা-খুসী কর!” বলিয়া, রাজেন্দ্র একখানা পাঁচটাকার নোট অমলার গায়ে ছুঁড়িয়া দিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
চারিদিক্ আচ্ছন্ন করিয়া সন্ধ্যা আজ শুধু পৃথিবীতে নামিয়া আসিল না;—নামিয়া আসিল অমলার অন্ধকার প্রাণের ভিতরেও। হাতের উপরে মুখ রাখিয়া স্তব্ধ হইয়া শূন্যদৃষ্টিতে অমলা সেইখানে মূর্ত্তির মত বসিয়া রহিল। তাহার মুখে তখন হাসি নাই, চোখে অশ্রু।
গ
অমলা তিন সন্তানের মা, কিন্তু তাকে দেখিলে সে-কথা বলিবার যো ছিল না। তার গড়ন ছিল পাত্লা, ছিপ্ছিপে; রং টক্টকে গৌর, মুখচোখ প্রতিমার মত। মাতৃত্বের পূর্ণগৌরব তার দেহ থেকে যৌবনকে শুক্না ফুলের মত খসাইয়া দিতে পারে নাই।
কিন্তু দরিদ্রের ঘরে সৌন্দর্যচর্চ্চার অবকাশ কোথায়? যেখানে অর্থ নাই, সেখানে রূপযৌবন সব ব্যর্থ। রাজেন্দ্র তাহাকে ভালবাসিত; কিন্তু নিত্য-নুতন গহনায়, বিলাসের উপহারে ও মিষ্টকথায় সে ভালবাসাকে জাহির করিবার সময় তার ছিল না। সংসারের টানাটানিতে তার মন সর্ব্বদাই তিক্তবিরক্ত হইয়া থাকিত;—এমন-কি, অমলাকে ভালকথা বলিতে গেলেও, তার জিভ্ ফস্কাইয়া মন্দকথা বাহির হইয়া যাইত।
এর জন্যে পরে সে নিজেই মনে-মনে দুঃখিত হইত। অমলাও মুখ বুজিয়া এই ভালবাসার অত্যাচার সহিয়া থাকিত।
মন তবু বুঝিয়াও বোঝ মানে না। আত্মীয়-কুটুম্বের বাড়ীতে একরকম খালিহাতে খালিগায়েই সে নিমন্ত্রণে যাইত। তাহার স্বভাবসুন্দর রূপ গহনা না-থাকার দরুণ বড় বেশী কমিয়া যাইত না বটে, কিন্তু যখন কোন ধনীর ঘরণী, গায়ের জড়োয়া গহনায় আলোর ঢেউ তুলিয়া চোখে অবজ্ঞার বিদ্যুৎ হানিয়া, দেমাকে ডগমগ হইয়া অমলার নিরলঙ্কার দেহের দিকে বাঁকা-চোথে চাহিয়া উপেক্ষার হাসি হাসিত, অমলার তখন মনে হইত, সে-যেন সকলকার পায়ের তলায় ধূলার মত মিশিয়া আছে।
কোন কোন মুখরা আবার আত্মীয়তা জানাইয়া বলিত, “তোমার বর কি কাজ করে ভাই?”
অমলা মৃদুস্বরে বলিত, “কেরাণীগিরি।”
“তা এমন রাঙ্গা বৌয়ের গায়ে দুখানা সোণা-দানাও দিতে পারে না গা? আহা—”
অমলা অতিকষ্টে বলিত, “আমি কখনো চাই নি-”
“ওমা, চাইতেই বা যাবে কেন? চাইলে দেবে, নইলে দেবে না, এমন কথাও ত’ কখনো শুনিনি! আমরা যে গয়না পরি, এ কি ভিক্ষে ক’রে পরা? এমন মেয়ে আমরা নই—জিভ্ কেটে ফেলব, তবু সেধে মুখফুটে কিছু চাইতে পারব না—”
অমলা ম্রিয়মাণ হইয়া উত্তর দিত, “সংসারে গয়নাই ত’ সব নয়! আর, আমার স্বামীর এমন অবস্থা নয় যে, তিনি আমাকে-”
“তাই বল বাছা, তাই বল! ওসব—”
কথা শেষ হইবার আগেই অমলা সেখান হইতে চলিয়া যাইত
ঘ
মুখে অমলা যাই বলুক, মনে-মনে সে বড় সুখী ছিল না। হাজার হোক মানুষের মন ত!
সেদিন অমলার এক আত্মীয়ের বাড়ী হইতে বিয়ের এক নিমন্ত্রণ আসিল।
রাজেন্দ্রের কাছে গিয়া অমলা বলিল, “ওগো, আইবুড়ো-ভাতের কাপড় আর মিষ্টি পাঠাতে হবে যে!”
রাজেন্দ্র বিরক্ত হইয়া বলিল, “পয়সা কোথায়?”
অমলা বলিল, “সংসার কর্ত্তে গেলে এ-রকম দু’একটা বাজে-খরচ না করলে চলবে কেন? মান বাঁচিয়ে চল্তে হবে ত!”
“চুলোয় যাক্ মান! মান কি আছে, যে রাখ্বে? লেখাপড়া শিখে যেদিন সায়েবের বুটের তলায় দাসখৎ লিখে দিয়েছি, সেইদিনই যে মানে ছাতা ধরে গেছে! তোমার পয়সা থাকে, তুমি আইবুড়ো-ভাতের তত্ত্ব পাঠাও!”
“আমি কোথায় পয়সা পাব?”
“তবে তত্ত্বের কথা ভুলে যাও।”
“তারা কি মনে কর্বে?”
“গণৎকার হলে সে কথা আগে থাক্তে তোমাকে গুণে বলে দিতে পার্ত্তাম।”
অন্তসূর্য্যের স্নিগ্ধ আলো অঙ্গে মাখিয়া দীপ্ত-নীল আকাশের তলার একঝাঁক পায়রা একছড়া উড়ন্ত যুঁইফুলের মালার মত ঘুরিয়া ঘুরিয়া উড়িয়া যাইতেছিল।
ছাদে কাপড় তুলিতে গিয়া, অমলা সেইদিকে তাকাইয়া দাঁড়াইয়াছিল।
হঠাৎ অমলার পায়ের কাছে সশব্দে কি-একটা জিনিষ আসিয়া পড়িল। অমলা, চমকিয়া দেখিল, একটা ঢিল। তার সঙ্গে খানিকটা সূতা বাঁধা। সূতার ডগায় একখানা কাগজঃ-
এর মানে কি?
অমলা হে’ট হইয়া কাগজখানা তুলিয়া লইল। তাহাতে ভুর্-ভুরে এসেন্সের গন্ধ। কাগজের ভাঁজ খুলিয়া অমলা দেখিল, ভিতরে পরিষ্কার হাতের অক্ষরে কয়ছত্র লেখাঃ-
“তোমার জন্য আমি পাগল। আমার দিকে মুখ তুলে তাকালে তুমি যা চাও তাই দেব। গরিব কেরাণী তোমার কদর বুঝ্বে না। দয়া করো। নইলে আমি বাঁচ্ব না।”
অমলা, চিঠি পড়িয়া মনে-মনে বলিল, “তোমার পক্ষে মরাই ভাল।” এ চিঠি কার? কে লিখিতেছে? পত্রে কাহারও নাম ছিল না। আমার পায়ের কাছে কাগজখানা আসিয়া পড়িল কেন? তবে কি-অমলা একপলকে সব বুঝিল।
গোধূলির আলো তার গৌরবাইকে কাঁচা সোণার মত উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছিল। অমলার চোক তার উপরে পড়িল। সে হাতদুটি কেমন নধর, কেমন নিটোল!
এ চিঠি লইয়া কি করিবে সে? ছিঁড়িয়া ফেলিবে, না স্বামীকে দেখাইবে? অমলা ভাবিতে লাগিল!
অমলাদের বাড়ীর সুমুখে একটা রাস্তা। ওপারে, ঠিক সাম্নাসাম্নি একখানা মস্ত বাড়ী। পল্লীগ্রামের কোন ধনী জমিদার মাসখানেক হইল, ওই বাড়ীখানা ভাড়া লইয়াছেন।
অমলার দৃষ্টি আচম্কা সেই বাড়ীর ছাদের উপরে পড়িল।
সেদিকে চাহিয়াই, মাথায় ঘোমটা টানিয়া অমলা তাড়াতাড়ি ছাদ হইতে নামিয়া গেল।
সে বাড়ীর ছাদের উপরে এক সুশ্রী যুবা, নিষ্পলকনেত্রে হাস্যমুখে অমলার দিকে তাকাইয়া, নিষ্পন্দভাবে দাঁড়াইয়া ছিল।
যাইবার সময়ে অমলা, চিঠিখানা রাস্তায় ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া গেল।
কিন্তু, স্বামীকে সে কোনকথা বলিল না।
ঙ
অমলা, কয়দিন আর ছাদে উঠে নাই।
সেদিন বৈকালে সে রুটি সেঁকিতেছিল আর তাহার ঠিকা ঝী রুটি বেলিয়া দিতেছিল।
বেলিতে-বেলিতে ঝী বলিল, “একটু হাত চালিয়ে নাও দিদিমণি!”
অমলা বলিল, “ক্যান্ লা, তোর এত তাড়াতাড়ি কিসের বল্তো?”
ঝী বলিল, “এই মাগ্যির বাজারে এক জায়গায় ঠিকে কাজ করে তো পেট চলেনা দিদি! কাজেই আর এক জায়গায় কাজ না কর্লে পোষায় না।”
অমলা, উনানের আঁচ, একটু কমাইয়া দিয়া বলিল, “আর কোথায় কাজ করিস্ তুই?”
“এই তোমাদের সামনের বাড়ীতে।”
অমলা চমকিয়া উঠিল। উনান হইতে চাটুখানা নামাইয়া, মনের চাঞ্চল্য মনেই চাপিয়া সহজস্বর সে বলিল, “ওখান থেকে কত মাইনে পাস্?”
“সকালে-বিকেলে যাই, পাঁচটাকা করে দেয়।”-
অমলার চম্কানি ঝীয়ের নজর এড়ায় নাই। কিন্তু, সেকথা নিয়া কিছু বলিল না— আপনমনে সে মৃদু-মৃদু হাসিলমাত্র।
অমলা খুন্তি দিয়া একখানা রুটি কড়ার উপরে উল্টাইয়া দিতে লাগিল। খানিক ইতস্তত করিয়া বলিল, “হাঁরে, ও-বাড়ীতে কে থাকে?”
“এক জমিদারের ছেলে গো!”
“আর কে?”
“বাবুর মা, বিধবা বোন আর এক খুড়তুতো ভাই।”
“বাবুর বৌ থাকে না?”
“বাবুর বিয়ে ত হয় নি।”
“অত বয়েস হয়েছে, বিয়ে হয়নি কিলো?”
“বাবুকে তুমি কি করে দেখ্লে দিদি?”
অমলার মুখ কালিপানা হইয়া গেল। তাড়াতাড়ি আপনাকে সামলাইয়া বলিল, “হ্যাঁরে, ওরা বুঝি খুব বড়মানুষ?”
ঝি চোখ ঘুরাইয়া বলিল, “ওমা, তা আবার নয় দিদি! বড়মানুষ বলে বড়মানুষ! বাসাবাড়ী, তবু লোকজন চারিদিকে যেন রৈ-রৈ করছে! গাড়ী-ঘোড়া জিনিষপত্তর দেখ্লে চোখ জুড়িয়ে যায়! শুনলে অবাক্ হবে দিদি, ওরা সব রূপোর বাসনে ‘সরে’।”
অমলা আনমনা হইয়া বলিল, “তা হবে না কেন; বড়লোকের ভিন্গোত্তর! একি আর আমরা, যে ছেঁড়া ন্যাক্ড়াতেই জীবন কেটে যাবে?”
ঝী দরদ দেখাইয়া বলিল, “তা” সত্যি দিদিমণি! তোমার অমন প্রতিমের মত রূপ, অমন নিটোল গড়ন, ওতে কি দুখানা সোণাদানা না পর্লে সাজন্ত হয়?”
“কোথায় পাব বাছা, সোণাদানা ত’ পথের ধূলো নয়!”
“কেন, দাদাবাবুকে বল্তে পার না?”
“বলে কি হবে? খেতে-পর্তেই কুলোয় না, তা আবার সোণাদানা!”
“হ্যাঁ দিদিমণি, দাদাবাবু তোমায় আদর-আয়িত্তি করে ত?”
অমলা কৌতুকভরে হাসিয়া বলিল,
“আলুনি আদর ঢ্যাঁপের খৈ-
আদরের কথা কার কাছে কই!”
বলিয়াই হঠাৎ গম্ভীর হইয়া কহিল, “নে, রুটি ব্যাল্—উনুন যে কামাই যাচ্ছে!”
কিছুক্ষণ কেহই কোন কথা কহিল না। রুটি-বেলা শেষ হইয়া গেলে পর, বেলুন ও চাকীখানা সরাইয়া ঝী অমলার মুখের ভাবখানা খানিকক্ষণ নীরবে চাহিয়া-চাহিয়া দেখিতে লাগিল। তারপর মৃদুস্বরে বলিল, “পুরুষগুলা কি-রকম বে-আক্কেল দিদিমণি!”
অমলা চাটু হইতে মুখ না তুলিয়াই বলিল, “পুরুষগুলো আবার কে?”
“এই ও-বাড়ীর জমিদারের ছেলে গো, এতক্ষণ যার কথা হচ্চিল!”
“কেন, সে কি করেচে?”
“বল্ব?”
“বল্।”
“আমরা গরীবমানুষ, গতর খাটিয়ে খাই—কারুর সাতেও থাকি না, পাঁচেও থাকি না। বল্লে শেষটা ত আমার ওপরে রাগ কর্বে না ঠাকুরু?”
অমলা চকিতে ফিরিয়া, ঝীয়ের দিকে তীক্ষ্ণনেত্রে চাহিল। বলিল, “বুঝেচি। কি বলেচে, সব খুলে বল্।”
অমলার কণ্ঠস্বর কঠোর!
ঝী থতমত খাইয়া গেল। সে যা বলিতে যাইতেছি তা আবার চাপা দিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। অমলার দৃষ্টি যেন তার মনের কথাগুলাকে হিড়্হিড়্ করিয়া টানিয়া তাহার জিভের ডগায় আনিয়া দিল। কলের পুতুলের মত সে বলিয়া গেল, “ও-বাড়ীর বাবু কাল আমাকে ডেকে বল্লে, ‘ঝী, ঐ সামনের বাড়ীর বৌ’কে তুমি যদি আমার কথা জানিয়ে আস্তে পার, আমি তোমাকে এক-শো টাকা দেব।’—আমায় বললে, আমি কি করব দিদি?”
অমলা কিছু বলিল না। উত্তেজিতভাবে ফিরিয়া, সে উনানে কড়া চড়াইয়া দিতে গেল; কিন্তু তাহার হাত ফস্কাইয়া কড়াখানা ঘিয়ের কেঁড়ের উপরে পড়িল। কেঁড়েটাও সশব্দে উল্টাইয়া গেল। সেই শব্দে উপর হইতে রাজেন্দ্র নামিয়া আসিল। মেঝেতে তখন ঘি গড়াইতেছে। রাজেন্দ্র বিরক্তস্বরে বলিল, “কাজ যত না হোক্, অকাজ কর্তে তোমরা খুব মজবুৎ! বেশ যাহোক্!”
উত্তেজিত অমলা আরও উত্তেজিত হইয়া বলিল, “পুড়ে মর্তে মর্তে বেঁচে গেলুম, আর তুমি কিনা উল্টে ক্যাঁট্ক্যাঁট্ করে কথা শুনিয়ে দিতে এলে?”
রাজেন্দ্র চটিয়া উঠিয়া বলিল, “কথা শোনাব না কেন! অতটা ঘি যে খাম্কা নষ্ট হ’ল, এই মাগ্যির বাজারে সেটা কোথা থেকে আসে শুনি?”
অমলার মন সেদিন হঠাৎ আগুন হইয়া উঠিল। স্বামীর অন্যায় ও নিষ্ঠুর কথা সে কিছুতেই মুখ বুজিয়া সহিতে পারিল না। উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “আমি কি সাধ করে তোমার লোক্সান করেছি? খেটে-খেটে দেহ ক্ষয়ে গেল, বল্তে তোমার লজ্জা হচ্চে না?”
রাজেন্দ্র তখন সবে আপীশ থেকে ফিরিয়াছে, তাহার মেজাজটাও বিলক্ষণ চড়া ছিল। সেও মহা থাপ্পা হইয়া বলিল, “বড় যে লম্বা-লম্বা কথা হচ্চে, ওসব আমার বাড়ীতে বসে হবে না—বুঝলে? এটা তোমার বাপের বাড়ী হলে, আমি তোমার গোলাম হয়ে থাক্তুম।”
“কি! তুমি আমার বাপ তুল্লে? এতবড়”-
অমলা আর কথা শেষ করিতে পারিল না। ঝড়ের মত সেখান হইতে চলিয়া গিয়া আপনার ঘরের ভিতরে ঢুকিয়া হুম্ করিয়া দরজাটা বন্ধ করিয়া দিল।
চ
অমলার চোখ সুমুখের বাড়ীর উপরে পড়িল।
সেখানে, বাড়ীর এক জানালায় দুটি ক্ষুধিত নয়নের লোলুপ দৃষ্টি অমলার ঘরের দিকে স্থির হইয় ছিল।
অমলা সে দৃষ্টি দেখিল। যাহার সে দৃষ্টি, সেও অমলাকে দেখিল ৷
অমলা ছবির মত নির্ব্বাক্ ও নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার মনে হইল, সে দৃষ্টি যেন সর্পের মত তাহার সর্ব্বাঙ্গকে বেষ্টন করিয়া ধরিতেছে! কিন্তু, তবু সে সেখান হইতে এক পা’ও নড়িতে পারিল না।
ছুটিয়া গিয়া সামনের জানালাটা বন্ধ করিয়া দিবার জন্য, তাহার মনের ভিতরে একটা ইচ্ছা জাগিয়া উঠিতেছিল; কিন্তু কেমন-একটা অন্যায় দুর্ব্বলতা তাহার হৃদয়ের মধ্যে সেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতেছিল।
জানালা খোলাই রহিল।
সে দৃষ্টি তখনও স্থির—এবং, তেমনি ক্ষুধিত, তেমনি ব্যগ্র!
সে-যেন অমলাকে গ্রাস করিতে চায়, তাহার অস্তিত্ব লোপ করিয়া দিতে চাহে!
সে দৃষ্টির কি মোহ!—চারিদিকের অন্ধকারের মধ্যে প্রদীপ্ত অগ্নির মত সে দৃষ্টি জ্বলিতেছিল, জ্বলিতেছিল জ্বলিতেছিল!
হঠাৎ পাশের ঘর হইতে অমলার মেয়ে কাঁদিয়া উঠিল। সেই কান্নায় অমলার সাড়্ হইল।
থর্থর্ করিয়া কাঁপিতে-কাঁপিতে অমলা মেঝের উপরে বসিয়া পড়িল।
সেদিন স্বামী-স্ত্রীতে আর কথাবার্ত্তা হইল না; তার পরদিন না- তার পরের দিনও না! অভাবের সংসারে ঝগড়া কিছু নূতন ব্যাপার নয়; তার আগেও অনেকবার তারা ঝগড়া করিয়াছে। কিন্তু এবারকার ঝগড়ার এই নীরবতা কিছু নূতনতর।
মুখ ফস্কাইয়া আল্টপ্কা একটা খারাপ কথা বাহির হইয়া গিয়াছে বলিয়া রাজেন্দ্র এখন মনে-মনে অনুতপ্ত। স্ত্রীর সঙ্গে আবার মিট্মাট্ হইয়া গেলে সে বর্ত্তিয়া যায়; কিন্তু আগে থাকিতে সাধিয়া কথা কহিলে পাছে তাহার স্বামিত্বগৌরব খর্ব্ব হইয়া পড়ে, সেই ভয়ে সে আপনার মৌনব্রত ভঙ্গ করিল না।
সংসারে কোন বড় ঘটনার কারণ খুঁজিতে গিয়া আমরা ছোট ঘটনাকে অবহেলা করিয়া এড়াইয়া যাই। কিন্তু সাংসারিক ক্ষুদ্র ঘটনাগুলি সাধারণের চোখে তুচ্ছ হইলেও অনেক সময়ে তাহারাই বড় ঘটনার জন্ম দেয়—বীজ যেমন ছোট হইয়াও বড় গাছের জন্ম দেয়। আমরা এটা বুঝি না বলিয়াই অনেক সময়ে অনেক বড় ঘটনার সঙ্গত কারণ খুঁজিয়া পাই না।
ছ
এ-কয়দিন অমলা রোজ ছাদে উঠিয়াছে, আর রোজ চিঠি পাইয়াছে।
চিঠিগুলা যখন সে কুড়াইয়া লইত, তখন সে স্পষ্ট বুঝিতে পারিত, অন্য বাড়ীর ছাদ হইতে আর একজনের তীক্ষ্ণদৃষ্টি তাহার উপরে স্থির হইয়া আছে। অমলার মনে হইত, সে দৃষ্টি হইতে যেন একটা অসহ্য উত্তাপ আসিয়া তাহার দেহের মাংস ভেদ করিয়া বুকের ভিতরে গিয়া স্পর্শ করিতেছে। পাছে চোখোচোখি হয় সেই ভয়ে সে আপনার দৃষ্টিকে নত করিয়া রাখিত।
কতবার সে মনে করিয়াছে, চিঠি পাইলেই ছাদের উপরে দাঁড়াইয়াই কুটিকুটি করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিবে! কিন্তু চিঠি পাইয়া তাহার মনে হইত, ভিতরে না-জানি কত রহস্যই আছে; একবার না পড়িয়া কি ফেলিয়া দেওয়া যায়?
তাহার রূপ নিয়া যতটা অত্যুক্তিপ্রকাশ করা যাইতে পারিত, পত্রলেখক তাহা করিত। সে-সব পড়িয়া অমলা খুসী হইত এবং মনে-মনে গর্ব্ব অনুভব করিত। পত্রে আরও কত কথা ছিল,—প্রেমের কথা, নিরাশার কথা, মিলন ও বিরহের কথা!
কথাগুলা অমলার মন্দ লাগিত কি? বোধ হয়, না। কারণ, সেইটেই স্বাভাবিক। অমলা দরিদ্র-ঘরণী, সংসারের অভাব ও জ্বালাঝঞ্ঝাটের ভিতরে তাহার রূপ বনফুলের মত অনাদৃত হইয়া থাকিত, একথা আগেই বলা হইয়াছে। আপনার যৌবন-বসন্তে ভাল করিয়া কোকিলের সাড়া সে কখনও শুনিতে পায় নাই—তাহার জীবনের একটা মধুর অংশ অনেকটা অপূরন্ত হইয়া ছিল। আজ এক ধনীর নন্দন তাহার চরণ-পূজা করিতে চাহিতেছে, ইহাতেও অবিচল থাকা অমলার পক্ষে বড় শক্ত কথা। হয়ত তেমনধারা মনের বলও তাহার নাই। আর এই সঙ্গীন মুহূর্ত্তে তাহাকে সৎপরামর্শে সাবধান করিবার লোকও সংসারে স্বামী ছাড়া আর কেহ ছিল না। কিন্তু, স্বামীর সঙ্গেও তাহার কথা বন্ধ!
আরসিতে অমলা মুখ দেখিতেছিল,—হাঁ, তাহার চোখের কোণ্ হইতে অটুট যৌবনের চঞ্চল বিদ্যুৎ এখনও সরিয়া যায় নাই; কপোলের গোলাপী রং অযতনে একটু মলিন হইলেও এখনও বিবর্ণ হইয়া যায় নাই। ঝী-মুখপুড়ী ঠিক বলিয়াছে,—প্রতিমার মত রূপই বটে! এ রূপ দু’খানা সোণাদানা না হইলে কি মানায়?
আপনার হাতদু’খানি সে ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া দেখিল। ক-গাছা কালোরংয়ের ‘জলতরঙ্গ’ চুড়ী রিণিরিণি করিয়া তাহাকে যেন উপহাস করিতেছিল। চুড়ীগুলাকে আছড়াইয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিবার জন্য তাহার মনে একটা দুর্দ্দম বাসনা প্রবল হইয়া উঠিল। কিন্তু এ চুড়ী ভাঙ্গিলে ফের কাচের চুড়ী কেনাও যে তার পক্ষে শক্ত কথা!—ভ্রুসঙ্কোচ করিয়া অমলা বিরক্তভাবে হাতনাড়া দিল,— কাচের চুড়ীগুলা কৌতুকহাস্যে কলধ্বনি করিয়া উঠিল, রিণিঝিনি রিণিঝিনি রিণিঝিনি!
পরণের কাপড়খানা ছেঁড়া-খোঁড়া, রান্নাঘরের ধোঁয়ামাখানো। ছেঁড়া মেঘে চাঁদের আলোর মত, ছিন্নবস্ত্রমধ্য দিয়া তাহার শুভ্র দেহের লাবণ্য স্থানে স্থানে বাহির হইয়া পড়িয়াছে।
তাহার স্বামীর সকল ব্যবহারের ভিতরে আজ সে একটা গভীর অবহেলা অনুভব করিল। সকলেই কিছু বড়লোক হয় না, মুখের দুটি মিষ্টি কথাতে ত’ আর পয়সা লাগে না! তার স্বামী যে তাতেও নারাজ!
তিক্তবিরক্ত চিত্তে অমলা জানালার ধারে গিয়া দাঁড়াইল।
ঘোরঘটা করিয়া সেদিন অবিরাম বাদল নামিয়াছে! শূন্যপথে ধূর্জ্জটী যেন আজ মহা তাণ্ডবে মাতিয়া আছেন,—ঐ নিকষ কালো মেঘপুঞ্জ যেন তাঁহারই নৃত্যোৎক্ষিপ্ত জটাজূটের রুদ্রলীলা প্রকাশ করিতেছে এবং বিদ্যুতে-বিদ্যুতে যেন তাঁহারই নেত্রবহ্নি রহিয়া রহিয়া জ্বলিয়া উঠিতেছে! পথ প্রায় জনশূন্য, কেবল মাঝেমাঝে এক-একজন পথিক ছাতিতে কোনরকমে কাঁধ পর্য্যন্ত বাঁচাইয়া নির্জীবের মত আস্তে-আস্তে চলিয়া যাইতেছে। দূরের বাড়ীগুলা অস্পষ্ট, তাহাদের পিছন হইতে দুই তিনটি তালগাছের ঝাপসা-সবুজ মাথা ঝোড়ো-বাতাসে হেলিয়া-হেলিয়া পড়িতেছিল। কতকগুলা কাক উড়িয়া-উড়িয়া তালগাছের উপরে বসিতেছিল, আবার উড়িতেছিল,—অমলা উদাসচোখে তাহাই দেখিতে লাগিল।
হঠাৎ পিছনে দরজা-খোলার শব্দ হইল। অমলা ফিরিয়া দেখিল, ঝী।
একটু আশ্চর্য্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এই বৃষ্টিতে তুই কোথা থেকে এলি?”
মুখ টিপিয়া একটু রহস্যের হাসি হাসিয়া ঝী বলিল, “আকাশ থেকে খসে পড়্লুম দিদিমণি!
অমলা বেশ বুঝিতে পারিল, ঝীয়ের এই হঠাৎ আবির্ভাব ও ধরণধারণে একটা-কিছু ব্যাপার লুকোনো আছে। সন্দিগ্ধস্বরে সে বলিল, “তোর কি দরকার রে?”
“একজন পাঠিয়েচে।”
অমলার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। আস্তে আস্তে সে বসিয়া পড়িল।
ঝী বলিল, “আমি কি করব বল দিদিমণি! আমরা চাকরি করি, যা বলে তা দাঁতে কুটো নিয়ে তখনি কর্তে হয়।”
অমলা চুপ করিয়া রহিল।
ঝী ভরসা পাইয়া বলিল, “আর তাও বল্তে হবে দিদি, মানুষটা তোমাকে দেখে পাগলের মত হয়ে গেছে।”—কথাটা শুনিয়া অমলার মুখ কি-রকমধারা হয়, তাহা দেখিবার জন্য সে সুমুখে ঝুঁকিয়া পড়িল।
কিন্তু অমলার মুখ একেবারে ভাবশূন্য, সে একেবারে চুপচাপ।
“সুধুকি তাই দিদি? আবার দেখনা কি সব পাঠিয়েচে!” বলিয়া ঝী তাহার কাপড়ের ভিতর হইতে একটি মখ্মলের বাক্স বাহির করিল। বাক্সের ডালা খুলিয়া আবার বলিল, “দেখ্চ দিদি, কেমন সব ভারি ভারি গয়না! এই দেখ চন্দ্রহার, এই দেখ তাগা, বালা,—আর এগুলো কি দেখ্চ? পালিসপাতার চুড়ী! আরো কত গয়না গড়্তে দিয়েচে,— ভাল সাঁচ্চা সল্মা-চুম্কীর কাপড়ের ফর্মাজ দিয়েছে! কিগো! অমন ক’রে বসে রইলে যে? একবার তবুও জিনিষগুলো নেড়েচেড়ে দেখ!”
অমলা নড়িল না। সে গহনার বাক্সের দিকে স্থিরনেত্রে তাকাইয়া কাঠের মত বসিয়া রহিল।
জ
ঝী যখন অমলাকে ঘরের ভিতরে একলা রাখিয়া চলিয়া গেল, তখনও সে তেমনি আড়ষ্ট হইয়া রহিল।
তাহার সাম্নে সেই গহনার বাক্স। বাক্সের ডালা খোলা; ভিতর হইতে গহনাগুলা বর্ষার ম্লান আলোতেও ঝক্মক্ করিয়া উঠিতেছিল। অমলা নিষ্পলকনেত্রে সেইদিকে তাকাইয়া রহিল।
এ গহনা তাহার! অমলার সর্ব্বশরীর শিহরিয়া উঠিল। কিন্তু কে দান করিতেছে, আর—আর, কেন এ দান? সে-কথা ভাবিবামাত্র তাহার বুক ধড়াস্ করিয়া উঠিল।
আস্তে-আস্তে সে হারছড়া কম্পিত হস্তে তুলিয়া নিল। এ হার কত ভরির, কত দামের?—কে জানে! হারছড়া গলায় পরিলে কেমন-মানায় একবার সেটা পরখ্ করিয়া দেখিবার সাধ হইল,—কিন্তু সাহসে কুলাইল না। যদি কেহ দেখিতে পায়!
বাক্সের ভিতরে ওটা কি? চিঠি বুঝি?—হুঁ, তাই বটে!
অমলা চিঠিখানা খুলিয়া পড়িলঃ-
“সামান্য উপহার পাঠালুম, না নিলে আমার কষ্ট হবে। পরে আরও পাঠাব, আমার কাছে এলে তুমি যা চাও তাই দেব। এখনও কি তুমি আমায় দয়া করবে না? স্বপ্নে আমি তোমাকে দেখি, তোমা বই আমি আর কিছু জানি না। আর চুপ করে থেকো না, চিঠির উত্তর দিও। উত্তর না পেলে আমি আত্মহত্যা কর্ব।”
আবার উত্তর চায়! উত্তর? হাঁ, উত্তর না পেলে আত্মহত্যা কর্বে!
আচ্ছা, মানুষটা যদি উত্তর পেলেই তুষ্ট হয়, তাহলে দু-লাইন লিখ্তে দোষ কি? তাতে কি পাপ হবে? অমলা আপনাকে আপনি প্রবোধ দিয়া বলিল, না, পাপ আর কি? সেত অন্য কিছু করিতেছে না—সুধু দু-লাইন উত্তর দিতেছে। কিন্তু না,—সে পরস্ত্রী হইয়া পরপুরুষকে কি কথা লিখিবে? তাহার লিখিবার কথা কি আছে?
হালভাঙ্গা নৌকার মত অমলার মন, তাহার বুকের ভিতর দোলা খাইতে লাগিল। কি যে করিবে, কিছুই সে ঠিক করিতে পারিল না। নৌকা যখন এমনি লক্ষ্যহীন, তখন সে সহজেই ডুবুডুবু হয়।
গহনাগুলা যেন অমলাকে আপনাদের মৌন ভাষায় ডাক্ দিয়া বলিতেছিল, “ওগো রাণি, আমাদের প্রতি বিমুখ হয়োনা—তোমার দেহখানিকে সুন্দর কর্তে পারলেই আমাদের জীবন সার্থক হবে! তোমার ঐ পেলব শুভ্র কণ্ঠ, বাহু ও হস্তের স্পর্শ পেলে আমরা ধন্য হয়ে যাব!”
কি করিব? চিঠি লিখিব, না গহনা ফিরাইয়া দিব?—এতগুলা গহনা!
অমলার মাথা ঘুরিতে লাগিল; সে আর ভাবিতে পারিল না। হঠাৎ সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হইল। অমলার মুখ মড়ার মত শাদা হইয়া গেল। এ পদশব্দ তাহার স্বামীর!
অমলা হুম্ড়ি খাইয়া বাক্সের উপরে পড়িল। তাড়াতাড়ি ডালা বন্ধ করিয়া বাক্সটা আপনার কোলের ভিতর টানিয়া নিয়া, তাহার উপরে আঁচল চাপা দিল।
ঝ
রাজেন্দ্র, একেবারে ঘরের ভিতর ঢুকিল। তাহার মুখ আজ প্রসন্ন।
অমলা তাহার দিকে পিছন ফিরিয়া বসিয়াছিল। রাজেন্দ্র অমলার প্রতি চাহিয়া আপনমনে মৃদুহাস্য করিল। তারপর ‘আল্নার সুমুখে দাড়াইয়া আপিসের জামাকাপড় খুলিতে লাগিল।
জামাকাপড় ছাড়িয়া রাজেন্দ্র আস্তে-আস্তে অমলার পাশে গিয়া বসিল।
অমলার বুক দুরু-দুরু করিতে লাগিল। তাহার প্রাণ যেন কণ্ঠের কাছে উঠিয়া আসিল।
স্ত্রীর মুখের দিকে কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া রাজেন্দ্র কহিল, “ইস্, আর কতদিনে এ দুর্জ্জয় মান ভাঙ্গ্বে গো?”
অমলা মাটির দিকে চাহিয়া রহিল। রাজেন্দ্র যে হঠাৎ কেন তাহার সহিত সাধিয়া কথা কহিতে আসিল, সেটা সে আদোপেই বুঝিতে পারিল না।
রাজেন্দ্র, অমলার এই স্তব্ধভাব দেখিয়া বোধহয় ব্যথিত হইল। ক্ষুণ্ণকণ্ঠে সে ধীরে-ধীরে বলিল, “দেখ অমলা, আমাদের মত গরীব কেরাণীর সংসারে দুজনেই দুজনার মন বুঝে চলা উচিত। দেখ্চ ত, গাধার মত খেটেখেটেও সায়েবের মন পাই না, সর্ব্বদাই বকুনি খাই। সংসারের টানাটানিতে বাড়ী এসেও মনে কোন সুখ নেই। এ খাটুনি, এ কষ্ট একলা হ’লে কি এতদিন সহ্য করতাম? খালি তোমাদের মুখ চেয়ে এত অপমান আর কষ্ট সয়ে আছি বইত নয়! সময়ে-অসময়ে মুখ দিয়ে যে দুটো অকথা-কুকথা বেরিয়ে যায়, একি আর আমি ইচ্ছে করে করি, অমল?”
অমলার মাথা ক্রমেই নীচু হইয়া পড়িতেছিল।
রাজেন্দ্র বলিতে লাগিল, “তোমাকে যে আমি ভালবাসি, এটা আমি মুখের কথায় বা কাজে প্রকাশ করতে পারি না বলে আমাকে তুমি সন্দেহ কোর না। দেখ, আপিস থেকে আসি তোমারই মুখ ভাবতেভাবতে, রাস্তায় আস্তে-আস্তে এই ভেবে শান্তি পাই যে, বাড়ীতে আমার অপেক্ষায় একজন যত্ন করবার লোক পথচেয়ে বসে আছে! তোমাকে তুমি যত্ন করতে পারি না, এজন্যে আমিও মনে-মনে কষ্ট পাই; কিন্তু, কি করব, উপায় নেই— উপায় নেই।” —একটু থামিয়া আবার বলিতে লাগিল, “আজ চার বছর আমি আমার জল খাবারের চারটি করে পয়সা জমিয়ে আস্চি। এ-কথা তুমি জান না। আজ ক’দিন হ’ল, আমার মাইনে বেড়েচে, এ-কথা শুন্লে তুমিও বোধ করি সুখী হবে; তাই সাহস করে সেই জমানো টাকার ওপরে আরও কিছু টাকা ধার করেচি। কেন জানো? এই জন্যে।”—বলিয়া, রাজেন্দ্র কাপড়ের ভিতর হইতে একটি বেগুনি রংয়ের কাগজের মোড়ক বাহির করিল। মোড়কটি খুলিলে দেখা গেল, তাহার ভিতরে ক’গাছা নূতন সোণার চুড়ই রহিয়াছে।
অমলার মনে হইল, কে-যেন তাহাকে খুব-একটা উঁচু জায়গা হইতে ধাক্কা মারিয়া নীচে ফেলিয়া দিল। যে স্বামীর ভালবাসাকে এতদিন সে সন্দেহ করিয়াছে, সেই স্বামী যে তাহাকে মৌখিক ভালবাসা জানাইতে না পারিলেও, তাহাব জন্য নিজের সামান্য জলখাবারের পয়সা-কয়টিও বাঁচাইয়া আসিতেছেন, এই অজ্ঞাত সত্যকথাটা আজ অমলার সারা জীবনটাই যেন মিথ্যা করিয়া দিল। স্বামীর উপরে মিছা অভিমানে ও সয়তানের প্রলোভনে এখনি সে হয়ত কি করিতে কি করিয়া বসিত! তাহার মন যে এত সহজে বেঁকিয়া যাইতে পারে, এটা সে আদোপেই জানিত না;—ভাগ্যে এখনও এই মুহূর্ত্তের ভূলকে শোধ্রাইবার উপায় আছে! অমলা আপনার রূপকে ধিক্কার দিল, আপনার মনকে ধিক্কার দিল, আপনার অভিমান ও সন্দেহকে ধিক্কার দিল! সোণার চুড়ী পাইয়া অমলার প্রাণে আজ কোন আনন্দই হইল না, তাহার নারী-হৃদয়ে: তাহার গোপন দুর্ব্বলতা এমনভাবে ধরা পড়িয়া যাওয়াতে, সে আর আপনাকে সালাইতে পারিল না, নিজের কোলের ভিতরে মুখ লুকাইয়া অমলা একেবারে শিশুর মত ডাক্ ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল।
রাজেন্দ্র অবাক্ হইয়া গেল। ভাবিল, সেদিনকার কটু কথা অমলা বুঝি এখনও ভুলিতে পারে নাই। অত্যন্ত দুঃখিতম্বরে সে বলিল, “মুখ দিয়ে একটা কথা হঠাৎ বেরিয়ে গেছে বলে কতদিন আর এমন করে থাক্বে অমল?”
অমলা প্রায়-রুদ্ধ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “ওগো আমার বুকটা দু-পায়ে দলে-পিষে দিয়ে যাও—তোমার পায়ের তলায় পড়ে আমি ধূলোর মত গুঁড়ো হয়ে মরে যাই।”
রাজেন্দ্র অমলার কথার আসল মানে আদোপেই বুঝিতে পারিল না। বোকা বনিয়া, মাথা চুল্কাইতে চুল্কাইতে বলিল, “অমল, তুমি কি বল্চ?’
অমলা বুঝিল, সে যদি আপনার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতে চায়, তাহা হইলে আর লুকাচুরি করিলে চলিবে না। এটা বুঝিয়া সে শক্ত হইয়া উঠিয়া বসিল। তারপর চোখের জল মুছিয়া স্বামীর দিকে মুখ তুলিয়া বলিল, “আমার আর চুড়ী চাই না।”
“অ্যাঁ—সে কি?”
“হ্যাঁ,—আমার গয়না আছে।”
“কি?—কি?”—
“আমার গয়না আছে। এই দেখ।”—বলিয়াই অমলা তাহার কাপড়ের ভিতর হইতে গয়নার বাক্সটা বাহির করিয়া দুম্ করিয়া মেঝের উপরে ছুঁড়িয়া ফলিয়া দিল। গহনাগুলা চারিদিকে ছিট্কাইয়া পড়িল।
রাজেন্দ্র প্রথমটা হতভম্বের মত গহনাগুলার দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর জড়িতস্বরে কহিল, “এ সব কি অমলা? গয়না তুমি কোথা থেকে পেলে?”
অমলা সহজস্বরে বলিল, “একজন দিয়েচে।”
“দিয়েচে!—কে?”
“ঐ চিঠিখানা পড়ে দেখ।”
গহনাদাতার পত্রখানা তুলিয়া নিয়া রাজেন্দ্র বিস্ফারিত নেত্রে তাহা পাঠ করিল। তারপর জিজ্ঞাসা করিল, “এ চিঠি লিখ্লে কে?”
অমলা নিজেই বুঝিতে পারিল না, তার এত জোর, এত সাহস কি করিয়া আসিল? সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া স্পষ্টস্বরে বলিল, “যে চিঠি লিখেচে, তাকে দেখ্বে?”
বিবর্ণ ও চিন্তিত মুখে রাজেন্দ্র বলিল, “হুঁ।”
জানালার কাছে আগাইয়া গিয়া অমলা বলিল, “এদিকে এস।”
সুমুখের বাড়ীর জানালায় সেই হিংস্র চক্ষুদুটো জ্বলন্ত অগ্নির মত তেমনি সজাগ হইয়া ছিল। অমলাকে দেখিবামাত্র সে চোখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিতেছিল, কিন্তু অমলার পাশে রাজেন্দ্রকে দেখিয়াই হঠাৎ আবার কুঞ্চিতফণা সর্পের মতই নত হইয়া পড়িল।
রাজেন্দ্র এতক্ষণে সব ব্যাপারটা আন্দাজ করিতে পারিল! সে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
অমলা ঘরের মেঝে হইতে একে-একে গহনাগুলা কুড়াইয়া আনিয়া, জানালা গলাইয়া অবজ্ঞাভরে রাস্তার উপরে ফেলিয়া দিল। সয়তানের চোখ দেখিয়া আজ সে একটুও ভয় পাইল না ৷
তাহার অশান্ত বুকটা যেন এতক্ষণ ভারি পাথর হইয়া ছিল; এখন সে শান্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল,—তাহার মনের সকল ময়লা একেবারে যেন পরিষ্কার হইয়া গেল। * * *
গৃহতলে হাঁটু গাড়িয়া, সে স্বামীর দেওয়া সোণার চুড়ী পরিতে বসিল।
ইতি