পসরা/কেরাণী
পসরা
কেরাণী
ক
“ভাত বাড়ে।, ভাত বাড়ো!”
“রোসো, রোসো,—আর একটু সবুর করো।”
“সবুর! ঘড়ীতে ন’টা বেজ়ে এক কোয়াটার, সেটা দেখেচ কি?”
“দাঁড়াও না, ডালটা নাবিয়ে একটা বাটা মাছ ভেজে দি’ না হয়! অমন কল্লে শরীর টেক্বে কেমন করে গা! প্রাণটা আগে, না ছেয়ের চাক্রী আগে?”
“চাক্রি আগে সুরো, চাক্রি আগে! কেরাণীর আবার প্রাণ! কেরাণীর আবার শরীর! সায়েব যদি তোমার এ কথা শুন্ত সুরো, তা’হলে ভয়ানক আশ্চর্য্য হয়ে যেত। নাও, কথায় কথায় বেলা বেড়ে যাচ্ছে, ছাইভস্ম যা আছে শীগ্গির দাও, কোনরকমে নাকে-মুখে দুটো গুঁজে এখন আপিসে গিয়ে পৌঁছতে পাল্লে বাঁচি।” প্রিয়নাথ ধুপ করিয়া পিড়ির উপরে বসিয়া পড়িল।
সুরবালা, একটি নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “কিছু যে হয়নি, খাবে কি দিয়ে?”
“তবে অদেষ্টে আজ নিরেট্ উপোস! ভাতও হয়নি নাকি?”
“হ্যাঁ, ভাত হয়েচে বৈকি! ডালও হ'ল,—আলু ভাতে, কাঁচকলা ভা-”
“ব্যস্, ব্যস্-এ যে একটা যজ্ঞির ব্যাপার! আবার কি চাই? কেরাণী আবার কি খাবে? দাও, দাও—চট্পট্ দাও।”
পাঁচ মিনিটে খাওয়া শেষ করিয়া, এক এক লাফে তিন-তিনটা সিঁড়ি ডিঙ্গাইয়া প্রিয়নাথ উপরে উঠিল। তাড়াতাড়ি এদিক্-সেদিক্ চাহিয়া সে ননা চড়াইয়া ডাকিল, “ওগো—জল্দি।”
সুরবালা ত্রস্তপদে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি গা?”
“কাপড়, কাপড়, আমার কাপড়!”
সুরবালা জিভ্ কাটিয়া বলিল, “ঐ যাঃ! তোমায় বল্তে ভুলে গেচি তোমার কাপড়ে যে খোকা মুতে দিয়েছে, এখনো শুকোয় নি।”
প্রিয়নাথ কর্কশকণ্ঠে কহিল, “আমার চাক্রিটি তোমরা খাবার ফিকিরে আছ? তার চেয়ে আমায় খাওনা কেন, একদম সব ন্যাটা চুকে যাক্।”
সেই সময়ে ক্ষুদে আসামীটি সুমুখ দিয়া যাইতে ছিল। প্রিয়নাথ হুঙ্কার দিয়া বলিল, “এই হারামজাদা, এদিকে আয়ত দেখি।”
খোকা ভয়ে নীলবর্ণ হইয়া আস্তে আস্তে অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। প্রিয়নাথ খোকার গালে এক বিরাশি শিক্কা ওজনের চড় বসাইয়া দিয়া সক্রোধে কহিল, “পাজী ছুঁচো!” চড় খাইয়া খোকা মহা চীৎকার শুরু করিয়া দিল।
প্রিয়নাথ, রাগে গশ্-গশ্ করিতে করিতে যে ময়লা কাপড়খানা পরিয়াছিল, তারই উপরে একটা আধফর্শা টুইলের সার্ট চড়াইয়া দিল। সার্টের গায়ে তিনরকমের চারিটা বোতাম—একটা রূপার, একটা হাড়ের, দুটা কাঁচের। এক হাতায় বোতাম আছে, অন্যটা সূতা-দিয়া-বাঁধা। একখানি পাকানো ও কোচানো চাদর কাঁধে ফেলিল। পায়ে একযোড়া সাদা ক্যাম্বিসের গম্প জুতা পরিল— তার উপরে কালো বার্ণিশ চামড়ার তিন-চারিটা ছোট বড় অপারেশনের চিহ্ন। প্রিয়নাথ লোকটার সখ আছে —নাই শুধু পয়সা।
খোকা তখনও কাদিতেছিল। প্রিয়নাথ তাড়াতাড়ি তাহাকে কোলে তুলিয়া লইয়া, তাহার দুই গালে দুটি চুমো খাইয়া বলিল, “ছি বাবা, কেঁদ না, কাঁদতে নেই।”
সুরবালা স্বামীর কাছে অন্যায় ধমক্ খাইয়া একটু মনঃক্ষুণ্ন হইয়াছিল। সে জানালার গরাদে ধরিয়া স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া ধারাবর্ষী মেঘমেদুর আকাশের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়াছিল। তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া প্রিয়নাথ সব বুঝিল। অনুতপ্ত কণ্ঠে ডাকিল, “সুরো!”
সুরবালা, চমকিয়া মুখ ফিরাইল।
“সুরো, রাগ করেচ?”
“না।”
প্রিয়ানাথ সুরবালার কাছে গিয়া তাহাকে আলিঙ্গন করিয়া বলিল, “সুরো, তুমিও যদি আমার কথায় বাগ কর্ব্বে তা’ হলে কার মুখ চেয়ে আমি বাঁচব বল? আমাতে কি আর আমি আছি? আমার কথায় রাগ? বল, রাগ করনি?”
স্বামীর স্নেহ ও প্রেমে সুরবালার চোখ ছল্ছল্ করিতে লাগিল। “না, আমি রাগ করিনি” বলিয়া, স্বামীর বুকে মুখ লুকাইল।
প্রিয়নাথ, স্ত্রীকে চুম্বন করিবার জন্য মুখ বাড়াইল। হঠাৎ ঘড়ীতে টং করিয়া সাড়ে নয়টা বাজিল। চুম্বন ভুলিয়া প্রিয়নাথ স্ত্রীকে ছাড়িয়া এক লাফে ঘরের দরজার কাছে গেল। তাড়াতাড়ি ছাতিটা লইয়া ছুটিল।
খ
এই কেরাণী-জীবন, এই বাঙ্গালী-জীবন —ক্ষণে সুখ, ক্ষণে দুঃখ, তুচ্ছ প্রেম—তুচ্ছ বিরহ—জীবনটা শুধু তাড়াতাড়ি আর দীর্ঘশ্বাস, আর কিছু না! বাঙ্গলার ঘরে ঘরে এই ছবি!
প্রিয়নাথ সদর দোরের কাছে আসিয়া দেখিল, রাস্তা জলে জলময়, যেখানে জল নাই, সেখানে হাঁটুভোর কাদা। সে শীঘ্র খানিকটা ছেঁড়া খবরের কাগজ যোগাড় করিয়া জুতায়োড়া পা হইতে খুলিয়া সন্তর্পণে মুড়িয়া ফেলিল এবং তাহা বগলদাবা করিয়া জল-কাদা ভাঙ্গিতে ভাঙ্গিতে কেরাণীর দেবালয়—যেখানে সাহেব দেবতা, বড়বাবু পূজারী ও তাহারা পাণ্ডা—তাহার উদ্দেশ্যে চলিল।
প্রিয়নাথ সুশিক্ষিত যুবক। বাপ-মা এবং প্রতিবেশীরা তাহার বিদ্যাবুদ্ধির তীক্ষ্ণতা দেখিয়া স্থির করিয়াছিলেন, কালে সে বংশের মুখোজ্জ্বল করিবে। এণ্ট্রান্সে সে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়াছিল— ফলে তাহার জননীর মনে অকস্মাৎ একটি রাঙ্গা টুক্টুকে বধূর মুখদর্শন করিবার সাধ একান্ত প্রবল হইয়া উঠিল। তারপর কিরূপে একে একে বর্ষে বর্ষে তাহার ঘরে মা-ষষ্ঠীর দূতেরা আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিল, তার মাতা, তারপর তার পিতার মৃত্যু হইল এবং অর্থাভাবে তাহার বি, এ পরীক্ষা দেওয়া হইল না, এখানে আমরা সে সমস্ত ইতিহাস সবিস্তারে বর্ণন করিতে চাহি না।
প্রিয়নাথ চলিয়াছে, দুই হাঁটুর উপরে কাপড় তুলিয়া চলিয়াছে, আকাশ পাতাল ভাবিতে ভাবিতে চলিয়াছে। কেরাণীর ভাবনা! সবটা শুনিয়া কাজ নাই; কারণ, তাহার আদি নাই, অন্ত নাই!
তাহার কত উচ্চ আশা ছিল-কোন্ মানুষের না থাকে? ধীরে ধীরে তাহার জীবনের সামনে একটা মহান্ আদর্শ ভবিষ্যের পটে আত্মসম্পূর্ণ হইয়া উঠিতেছিল, হয় ত কালে তাহা পূর্ণগঠন হইত; ধীরে ধীরে আপনাকে সে সংসার-সমরের জন্য উপযোগী করিয়া তুলিতেছিল, হয়ত, পরিণামে সে বিজয়ী হইত! কিন্তু ইতিমধ্যে প্রবাদবাক্য আপনার কঠোর সত্যতা সপ্রমাণ করিল— “মানুষ গড়ে, বিধাতা ভাঙ্গে!” প্রিয়নাথ গডিতেছিল! বিধাতা ভাঙ্গিল।
জীবনের প্রভাতে, উপার্জ্জনক্ষম পিতার মৃত্যুতে, প্রিয়নাথ অকস্মাৎ একদা আপনার থেদ-করুণ ভাগ্যলিপির প্রথম পরিচ্ছেদ পাঠ করিবার সুযোগ লাভ করিল। সে কি কঠোর আঘাত! দেখিল, অনন্ত সংসারপাথারে সে নিরাশ্রয়— একাকী! বড় একাকী! তাহার বন্ধু নাই, সহায় নাই, অর্থ নাই,—আছে শুধু স্ত্রী, চারিটী সন্তান, আর শূন্য লৌহমঞ্জুষা! আর একানি জীর্ণভগ্ন দ্বিতল বাড়ী!
মা সরস্বতীর দিকে পিছন ফিরিয়া সে অতি কষ্টে কোন সওদাগরী আফিসে একটি ২০ টাকা মাহিনার চাকুরী যোগাড় করিল। পাড়ার বিজ্ঞেরা আসিয়া বলিয়া গেলেন, “চাকরীর বাজার বড় মাগ্যি! তোমার অতি সৌভাগ্য!”
তারপর এই ‘সৌভাগ্যের’ ভিতর দিয়া একে একে ছয়টি দীর্ঘ বৎসর কাটিয়া গিয়াছে এবং কুড়িটি টাকার উপর আরও পাঁচটি টাকা আজ কয়েক মাস ঘরে আসিতেছে। কি ‘সৌভাগ্য’ রে!
হতভাগিনী সুরবাল।! পরণে ছেঁড়াখোড়া কাপড়, যত্নাভাবে অমন মেঘের মত কেশরাশি রুক্ষ, অমন সোনার বরণ দেহে কে যেন কালি মাড়িয়া দিয়াছে! গায়ে একখানি গয়না নাই, প্রাণে এতটুকু সুখ নাই মুখে সদাই হাসি, কিন্তু তার পিছনে যে কি হাহাকার লুকানো আছে— দরদী ভিন্ন কে তাহা বুঝিবে?
তিনটি মেয়ে, একটি ছেলে বড় মেয়েটির বয়স আট বৎসর,—দুদিন বাদে তাহাকে পার করিতে হইবে।
শত্রুর মুখে ছাই দিয়া এত গুলিকে লইয়া একটি সংসার, —চাল, ডাল, ঘি, তেল, নিত্য বাজার আছে, লজ্জা-নিবারণের ন্যাক্ড়া আছে, ছেলেপিলের দুধ আছে, সমাজের কুটুম্বিতা আছে, নিত্য রোগের ডাক্তারের ভিজিট, ঔষধ-পথ্য আছে—নাই কি? বলিতে পার মাসে পঁচিশটি টাকায় কোন্ ইন্দ্রজালে এই ভদ্র গৃহস্থের মান এবং প্রাণ রক্ষা হয়?
এখন আর কি জিজ্ঞাসা করিবে, প্রিয়নাথ কি ভাবিতেছিল?
হঠাৎ একখানা দু’ঘোড়ার মস্ত চক্চকে গাড়ী বাতাসের আগে ছুটিয়া আসিল। প্রিয়নাথ, সন্ত্রস্ত হইয়া পথ ছাড়িয়া সরিয়া দাঁড়াইল, গাড়ীর ভিতরে মোটা নরম গদির উপরে পরম আলস্যভরে সুসজ্জিত দেহ এলাইয়া দিয়া এক যুবক বসিয়া আছে। তাহার চক্ষু অর্দ্ধ-নিমীলিত, তাহার ভাবভঙ্গী নির্ব্বিকার, যেন সহরের যত দুঃখ, যত দৈন্য, যত হাহাকারের ভিতরে অটল-মহিমায় বধির শ্রবণে বসিয়া, সে আপনাকে আপনি দেখিতেছে।
গাড়ীর চাকা হইতে কাদার ধারা উৎক্ষিপ্ত হইয়া প্রিয়নাথের যত্নরক্ষিত সামান্য পরিচ্ছদ সুবিচিত্র করিয়া দিল। সে বিরস বদনে আপন মনে কহিল, “কেন এই বিভেদ? কেন আমি রাস্তায় কুকুরের মত এই জল-কাদায় হাঁটিয়া চলিয়াছি, আর ঐবা কেন আরামে লোকের গায়ে কাদা ছিটাইয়া, সকলকে অবজ্ঞা করিয়া চলিয়াছে? কেন আমি হাড়; ভাঙ্গা খাটুনি খাটিয়াও, বিদ্যায়, রূপে, গুণে শ্রেষ্ঠ হইয়াও অর্থহীন ব্যর্থ জীবনে অর্দ্ধাহারে ছিন্নবেশে দিনের পর দিন গণিতেছি, আর ঐ মূর্খ, কদাকার পশু কেন দিব্য বেশে, বিনা শ্রমে, বিনা চিন্তায় ধূলির মত টাকা উড়াইয়া দিবার অধিকার লাভ করিল? কেন এই প্রভেদ? ভগবান, তুমি কি আছ? যে তোমায়, ভগবান, সমদৃষ্টি বলিয়া প্রচার করে, প্রতারক সে—মূর্খ সে! ‘তুমি’ নাই— তুমি’ নাই!”
সাম্নে আফিস,— প্রকাণ্ড অট্টালিকা, চক্চকে দামী পাথরের থাম, বড় বড় জান্লা-দরজাগুলি উজ্জ্বল রং করা। বাহির হইতে মাথা তুলিয়া তাহার দিকে হাঁ করিয়া চাহিতে চাহিতে পথিকেরা রাস্তা দিয়া চলিয়া যাইতেছে; ভাবিতেছে, কি চমৎকার বাড়ী! যেন স্বর্গপুরী! হায়, তারা ভুলিয়া গিয়াছে, মাকালের রাঙ্গা রূপের আড়ালে কি মালিন্য!
প্রিয়নাথ ভিতরে ঢুকিল। কার্পেটমোড়া সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিল। মধ্যে মস্ত একটা হল, বার্নিশকরা কাঠের ছোট ছোট দেওয়ালে তাহা বহুভাগে বিভক্ত। স্প্রিংয়ের দরজা ঠেলিয়া সে আপনাদের বিভাগে ঢুকিল।
সারি সারি টেবিল। প্রতি টেবিলের দুদিকে দুখানা করিয়া চেয়ার। একদিকে বড়বাবুর নিজস্ব একটা মেজ্। চারিদিকে কাঠের ‘তাক্’— তাহাতে বড় বড় বাঁধানো খাতা। মাথার উপরে বৈদ্যুতিক পাখা, ‘বিজ্লীর আলো’। আয়োজনের কোন ত্রুটি নাই। ঠিক যেন বন্দী পাখীর জন্য সোনার ‘পিঁজরা’!
এখনও দশটা বাজে নাই। কেরাণীরা, কেহ টেবিলের উপরে বসিয়া, কেহ দাঁড়াইয়া, দলে দলে গল্প করিতেছে, হাসিতেছে!
হঠাৎ জুতার মশ্মশ শব্দ হইল।
“ওহে সায়েব, সায়েব!”
পলকে কি পরিবর্ত্তন! সবাই যে যার আসনে আসীন, সামনে খাতা খোলা, চোখে জ্বলন্ত মনোযোগ, আর হাতে চলন্ত কলম! সাহেব কি একটা কাজে আসিয়াছিল; কাজ সারিয়া তখনই চলিয়া গেল। অমনি সকলের হাত হইতে কলন খসিল, দৃষ্টি অপাঙ্গে ফিরিল, একজন অর্দ্ধোচ্চ কণ্ঠে কহিল, “গেছে?”
আর একজন দরজার ফাঁক্ দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিয়া বলিল, “হুঁ।”
অমনি যতীনচন্দ্র একটি গান ধরিয়া দিল। আর একজন ঘাড় নাড়িয়া তবলা অভাবে টেবিল চাপ্ড়াইয়া তাল দিতে লাগিল।
এবার বড়বাবু আসিতেছেন। আবার সব চুপ্চাপ।
কেরাণীদের অসম্পূর্ণ ছবি এইরূপ। মানুষ যে কত হীন কত কপট হইতে পারে, বুকে তুষানল জ্বালিয়া মুখে কত যে হাসিতে পারে, তা যদি দেখিতে চাও, সওদাগরী আফিসের কেরাণীদের দেখ। এমন ফটো আর কোথাও পাইবে না। বুকে তুষানল, মুখে হাসির কথা শুনিয়া আশ্চর্য্য হইও না। খাঁচার পাখী কি গান গায় না??
প্রিয়নাথ আপনার টেবিলের সুমুখে গিরা, চাদরখানা গলা হইতে খুলিয়া আগে চেয়ারের হাতায় বাঁধিল। তারপর একখানা কাগজে লাল কালি দিয়া কয়েক লাইন “শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়” লিখিল। এই না সে বলিতেছিল, বিশ্বে ঈশ্বর নাই? হা, মানুষের স্বভাব ত’ এই!
দুর্গানাম-লেখা কাগজখানি চোখ বুজিয়া বারকয়েক কপালে ছুঁয়াইয়া, সে একেবারে কাজ শুরু কবিয়া দিল।
প্রিয়নাথ আফিসের কাহারও সঙ্গে সাধ্যমত মিশ্রিত না। সে শিক্ষিত, তাহার সহকর্ম্মীদের মনের সঙ্গে তাহার উচ্চাভিলাষী মন ঠিক খাপ্ খাইত না।
তিনদিন পরেই পূজা। আফিসে কাজের বড় ভিড়। প্রিয়নাথ যখন চেয়ার ছাড়িয়া উঠিল, ঘড়ীতে তখন সন্ধ্যা আট্টা প্রায় বাজে।
সে তাড়াতাড়ি বড়বাজারের ভিতর দিয়া বাড়ীর দিকে চলিল। রাস্তার জনতায় প্রতিপদেই বাধাপ্রাপ্ত হইয়া তার মন যথেষ্ট ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিতেছিল। লোকগুলার কি অন্যায়! ইচ্ছা করিয়াই আমার পথে আসিয়া দাড়াইতেছে! একটু চট্পট্ বাড়ীতে গিয়া যে হাত-পা ছড়াইয়া বিশ্রাম করিব, তারও যো নাই। আর এই গরুর গাভী—এগুলা কলিকাতা হইতে দূর শুইলে সব আপদ্ চুকিয়া যায়, এমনি নানা উদ্ভট কথা ভাবিতে ভাবিতে প্রিয়নাথ শেষে বাড়ীতে আসিয়া পৌছিল। ধীরে ধীরে উপরে উঠিয়া, ঘরে ঢুকিতে ঢুকিতে সে ডাকিল, “সুরো!”
থোকাকে কোলে করিয়া, সুরবালা মাদুরের উপরে বসিয়াছিল। প্রিয়নাথের সাড়া পাইয়া মুখ তুলিয়া চাপা আওয়াজে বলিল, “চুপ! চুপ! খোকার ভারি জ্বর!”
প্রিয়নাথ উদ্বেগের সহিত বলিল, “জ্বর!”
“হ্যাঁ। গা যেন পুড়ে যাচ্ছে। এখন একটু ঘুমিয়েচে, অত জোরে কথা কোয়ো না, এখনি জেগে উঠবে”
প্রিয়নাথ, — শুষ্কমুখে খোকার গায়ে হাত দিয়া দেখিল,—গা যেন আগুন! তার সারাদিনের কম্মক্লান্ত মস্তিষ্ক তখন উত্তপ্ত। বাড়ীতে আসিয়া কোথায় একটু বসিয়া জিরাইবে, দুটা কথা কহিবে, না, আবার এই হাঙ্গাম! সে আর সহ্য করিতে পারিল না, বিরক্তিপূর্ণ-কণ্ঠে কহিল, “না, আর অসহ্য হয়ে উঠেছে, রোজ় একটা না একটা লেগে আছেই, তার চেয়ে একেবারে মরুক্ না কেন, হাড়ে বাতাস লাগে!”
সুরবালা তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “সাঠ ষাঠ, অমন সর্ব্বনেশে কথা কি করে তোমার মুখ দিয়ে বেরুল গা?”
প্রিয়নাথ বুঝিল, রাগের মাথায় সে একটা ভারি অন্যায় কথা বলিয়া ফেলিয়াছে। অনুতপ্ত হইয়া তখনই সে খোকাকে কোলে করিয়া স্তব্ধভাবে বসিয়া পড়িল।
ঘ
রাত্রে খোকার জ্বর ভয়ানক বাড়িয়া উঠিল। জ্বরের ‘ধমকে’ সারারাত সে প্রলাপ বকিতে লাগিল। “বাবা, আমায় জামা দিলে না? জামা প’রে আমি ঠাকুর দেখ্তে যাব।”
প্রিয়নাথ তার মাথা চাপড়াইতে চাপড়াইতে বলিল, “দেবো বৈকি বাবা! আগে সকাল হোক।”
ভোর হইল। থোকার জ্বর কমিল না, বরং তার উপরে ফিটের লক্ষণ প্রকাশ পাইল।
সুরবালা ভয়ে বিবর্ণ হইয়া বলিল, “ওগো, ডাক্তার ডাকো।”
প্রিয়নাথ বলিল, “হুঁ—ডাক্তার! সুরো, কাল মাস-কাবার, সেটা মনে আছে কি? ডাক্তার ডাকো! পয়সা কোথায়?”
সুরবালা বলিল, “তা বলে ত বিনে চিকিচ্ছায় ছেলেটাকে মেরে ফেল্তে পারি না, কোথাও কেউ ধার্-টার্ দেবে না?”
“দেখি।” প্রিয়নাথ চটিপায়ে দিয়া নীচে নামিয়া গেল।
ধার মিলিল,—বহু কষ্টে। ডাক্তার আসিল, ছেলের নাড়ী টিপিল, বুক দেখিল, নাক মুখ বিকৃত করিয়া কহিল, “ব্যামো শক্ত, দেখি, কতদূর কি কর্ত্তে পারি।”
পরদিন যথাসময়ে প্রিয়নাথ, আফিসে গিয়া হাজিরা-বইয়ে নামসই করিল। তখনও বড়বাবু আসেন নাই। অথচ, প্রত্যেক মিনিট তার কাছে এক যুগ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। শেষে আর সে থাকিতে পারিল না,— তাড়াতাড়ি সাহেবের ঘরে ঢুকিয়া, সাহেবকে সেলাম করিয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কাঁপিতে লাগিল। সাহেব কি লিখিতেছিল, কাগজ হইতে চোখ না তুলিয়াই ঘাড়টি একটু হেঁট করিল মাত্র।
প্রিয়নাথ বলিল, “স্যর, আমার ছেলের বড় অসুখ, দুদিন ছুটি।”
সাহেব তেমনিভাবেই বলিল, “বাবুকে বল।”
‘বাবু’ মানে বড়বাবু! প্রিয়নাথ আর কোন কথা বলিতে সাহস করিল না, আস্তে আস্তে ফিরিয়া আসিল। দেখিল, বড়বাবু আসিয়াছেন। বড়বাবুর গোঁফ-দাড়ী কামানো,—কিন্তু খুরের সঙ্গে বহুদিনেব দেখা-সাক্ষাৎ না হওয়ায়, ছোট ছোট কর্কশ পাকা চুলে মুখের নীচের দিক্টা বেজায় বন্ধুর! ঠোঁটের দুপাশ দিয়া পানের পিচের ক্ষুদ্র স্রোত সদা প্রবাহিত। দেহখানি ভয়ানক মোটা, তার উপরে টান্ চাপকান। একটা সচল তাকিয়ার কল্পনা যদি সম্ভব হয়, তাহা হইলে বড়বার চাপকান-চাপা স্থুল দেহের কতক আঁচ, পাইতে পারা যায়। তাঁর আকৃতির আর একটা কথা বলিতে ভুলিয়াছি। সেটি তাঁর মাথা যোড়া অতি চক্চকে বার্ণিশকরা টাক্,—দিনের আলো পড়ায় তাহা ইস্পাতের মত উজ্জ্বল দেখাইতে ছিল। টাকের মাঝখানে ঠিক তিনগাছি চুল; কোন রসিক তাহা দেখিয়া বলিয়াছিলেন, ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলো!
বড়বাবু চেয়ারে বসিয়া অর্দ্ধমুদিত নেত্রে মুখ বিকৃত করিয়া কি ভাবিতেছিল, এমন সময় ছুটির দরখাস্ত হাতে প্রিয়নাথ আসিয়া হাজির হইল।
কোনরূপ ভূমিকা করিয়া কথা পাড়ে, প্রিয়নাথের মনের অবস্থা তখন তেমন ছিল না। সে বড়বাবুর সুমুখে গিয়া সোজাসুজি বলিল, “মশাই, আমার ছেলে বাঁচে কি না বাঁচে, আমাকে দুদিনের ছুটি দিতে হবে।” বড়বাবু তাম্বুল চর্ব্বণ করিতে করিতে অবহেলাভরে বলিলেন, “ও সব ছুটিটুটি, বুঝ্লে কিনা— এখন হবে-টবে না। কাল্কে ‘মেল্ ডে,’ তার ওপর বুঝলে কি না, সামনে পূজো, এখন কাউকে ছাড়্তে টাড়্তে পার্ব্ব না!”
প্রিয়নাথ শুল্কমুখে কহিল, “আজ্ঞে, ছেলেটার ব্যামো, একটিবার দয়া করুন।”
বড়বাবু একটা আল্পিন দিয়া দাঁত খুটিতে খুটিতে বলিলেন, “হেঁঃ, দয়া! ছেলের ব্যামো বল্লে, বুঝ্লে কি না, সায়েব মানে না।”
প্রিয়নাথ টেবিলের উপর হইতে একটা কাগজচাপা উঠাইয়া লইয়া সেটা নাড়িতে নাড়িতে নিম্নমুখে বলিল, “আজ্ঞে, সায়েবের কাছে গিয়েছিলুম; তিনি বল্লেন আপনার কাছে আস্তে।”
বড়বাবু কঠোর ব্যঙ্গের স্বরে বলিলেন, “সায়েবের কাছে এরি মধ্যেঘুরে আসা হয়েচে! ভ্যালা মোর বাপ্ রে! তবে আর কি, তুমি যখন ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে,—বুঝলে কি না, ঘাস খেতে শিখেচ, তখন আর আমার কাছে কেন?”
প্রিয়নাথ কহিল, “আজ্ঞে, আমার ছেলে মারা যায়।”
বড়বাবু ঠোঁট বাঁকাইয়া বলিলেন, “যাওহে ছোক্রা যাও! ন্যাকামির আর যায়গ! পাওনি, আমার কাছে এসেচ,— বুঝলে কি না—চালাকি কর্ত্তে! ছেলের ব্যামো!”
প্রিয়নাথ কোনরূপে রাগ সামলাইয়া বলিল, “আমাকে ছুটি দিতে হবে।”
বড়াবাবু রুল্টা তুলিয়া লইয়া সজোরে টেবিলের উপর আছড়াইয়া মহা খাপ্পা হইয়া বলিলেন, “দিতেই হবে? আমি তোমার বাবার চাকর? ইউ স্কাউন্ড্রেল, আমার ওপর হুকুম— অ্যাঁ?”
প্রিয়নাথের মাথায় রক্ত চড়িয়া গেল। তাহার মনে দুর্দ্দমনীয় ইচ্ছা হইতে লাগিল, এই হৃদয়হীন পশুটাকে আচ্ছা করিয়া ঘাদুই দিয়া, এই ঘৃণ্য, তুচ্ছ গোলামীকে পায়ে থ্যাৎলাইয়া সেই মুহূর্ত্তেই সে চলিয়া যায়। কিন্তু তখনই মনে পড়িল, ঘরে তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা! ছেলের জ্বর, ঔষধ-পথ্য, ডাক্তার চাই। মেয়ে বড়, আজ বাদে কাল সেটিকে পার করিতে হইবে। ঘরের বাক্স খালি, রাত পোহাইলে পোড়া পেটের ভাবনা ভাবিতে হইবে।
এক পলকের ভিতরে, প্রিয়নাথের মস্তিষ্কে বিদ্যুতের মত এমনি নানা চিন্তা খেলিয়া গেল এবং তখনই যেন কাহার অপূর্ব্ব সম্মোহিনীতে তাহার সর্ব্বোদ্ধত শির আবার নুইয়া পড়িল, তাহার মুষ্টিবদ্ধ হস্ত আবার শিথিল হইয়া পড়িল। কেরাণীর আবার রাগ! সে বড় ক্ষণিক!
বড়বাবুর রাসভ-নিন্দিত স্বর, বোধ হয় সাহেবের কাণে গিয়াছিল। কারণ হঠাৎ সাহেব আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন। একবার প্রিয়নাথের দিকে চাহিয়া বড়বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ব্যাপার কি বাবু?”
বড়বাবু সব কথা খুলিয়া বলিলেন। অবশ্য, তার উপর কালোপযোগী টীকা-টিপ্পনি করিতে ভুলিলেন না। সাহেব সমস্ত শুনিয়া প্রিয়নাথের দিকে ফিরিয়া বলিল, “তুমি বাবুর উপর হুকুম চালিয়েছ?”
প্রিয়নাথ নিম্নস্বরে বলিল, “না, স্যর!”
সাহেব অধীরভাবে ওষ্ঠ দংশন করিয়া বলিল, “তুমি কি বল্তে চাও, আমার বাবু মিথ্যাবাদী?”
প্রিয়নাথ কহিল, “না স্যর! আমি তা বল্তে চাই না, তবে উনি কথাটা একটু বাড়িয়ে বলেছেন।”
বড়বাবু ভ্রূকুটি করিয়া কহিলেন, “তবে রে ছুঁচো! আমার সাম্নে তুই আমারি নামে লাগাস। এত বড় বুকের পাটা তোর! সার! স্যর্! ওকে ডিশ্চার্জ্জ করুন, এখনি ডিশ্চার্জ্জ করুন।”
সাহেব মুখ টিপিয়া একটু হাসিল। তারপর শিষ্ দিতে দিতে দরজার কাছে গিয়া হঠাৎ থামিয়া বলিল, “তোমার ছেলের অসুখ?”
“হ্যাঁ সার।”
সাহেব একান্ত সহজ স্বরে বলিল, “আচ্ছা বাবু, আজ তোমার ছুটি। কিন্তু কাল ‘মেল-ডে’, তুমি অবশ্য আস্বে। আমি তোমার পুত্রের মঙ্গল প্রার্থনা করি।” বলিয়া আবার শিষ্ দিতে দিতে চলিয়া গেল।
সাহেবের এই আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত ভাবপরিবর্ত্তনে বড়বাবু রামে ফুলিতে ফুলিতে হতাশভাবে চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। তারপর অত্যধিক মনোযোগিতার সহিত একখানা কাগজ দেখিতে দেখিতে আপন মনে অস্ফুট কণ্ঠে বলিলেন, “জলে বাস ক’রে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ? আচ্ছা, দেখা যাবে। এক পোষে শীত পালায় না।”
ঝড়ের আগে শুক্না পাতা যেমন করিয়া উড়িয়া যায়, প্রিয়নাথের প্রাণখানা দেহের আগে তেমনি ছুটিয়া চলিয়াছিল। তাহার মনে হইতেছিল, পাখীর মত যদি আমার দুখানা ডানা থাকিত!
বাড়ী পৌছিয়া সে ভাবিল, এই ত বাড়ী আসিলাম। এইবার খোকাকে দেখিব। তার জন্যে জামা কিনিয়া আনিয়াছি; জামা পাইয়া তাহার কত আহ্লাদ হইবে!
“সুরো, সুরো!”
কাহারও সাড়া নাই! এ কি,—কে যেন কাঁদিতেছে না? কাঁদে? কে? কে? প্রিয়নাথ দু হাতে বুক চাপিয়া, কাণ পাতিয়া শুনিতে লাগিল। শুনিতে সাহস হইতেছিল না, তবু — সে শুনিতে লাগিল।
“খোকারে, ওরে আমার থোকারে,”- কে কাঁদে? সুরো? প্রিয়নাথের দেহ হিম হইয়া গেল। আর তবেত’ সন্দেহ নাই! থর থর্ করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে সেইখানে সে বসিয়া পড়িল,—তাহার চোখের সামনে,—আলোকাম্বরা ধরণীর উপর কে যেন একটা অন্ধকারের পদ্দা ফেলিয়া দিল। এবং সেই কঠোর-কালো আঁধারের গভীর মৌনব্রত ভঙ্গ করিয়া, এক শোকার্ত্ত মাতৃ-হৃদয় ভেদ করিয়া কি করুণ ক্রন্দন তাহার অভিভূত শ্রবণে বারবার ধ্বনিত হইতে লাগিল, “ও খোকা, খোকারে!”
শুনিতে শুনিতে সহসা তীব্র আঘাতে চেতনা প্রাপ্ত আহতের মত সে আবার দাঁড়াইয়া উঠিল এবং দীপ্তনেত্রে রক্তহীন মুখে উর্দ্ধে অনন্ত নীলিমার দিকে চাহিয়া ক্ষিপ্তের মত বলিল, “নিয়েছ? আর দু’দণ্ড তর্ সৈল না? ভগবান্? ভগবান্? এখন যদি একবার তোমার নাগাল পাই, তাহলে জেনো, তোমার ওই নির্দ্দর প্রাণকে এই দুই হাতের চাপে পিষে, থেঁতলে গুঁড়িয়ে,—ছুঁড়ে ফেলে দি।”
প্রিয়নাথ উপরে উঠিল, এই ভীষণ অভিশাপ-বাণী উচ্চারণ করিতে করিতে একটা দম্কা বাতাসের মত ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিল। তাহাকে দেখিবামাত্র, সুরবালা বিদীর্ণকণ্ঠে একটা আর্ত্তনাদ করিয়া অচেতন হইয়া পড়িয়া গেল।
প্রিয়নাথ চোখে এক ফোঁটা জল নাই—আপনার পাষাণ-চক্ষু মেলিয়া প্রাণপণে সে চাহিয়া রহিল। বিছানার উপর খোকার পুষ্প-পেলব দেহ পড়িয়া আছে,—মৃত্যুর কঙ্কাল-করের কাঠিন্য এখনও তাকে ছুঁইতে পারে নাই। তার ছোট হাতদুটি মুঠা করা, কচি-কচি ঠোঁট-দুইখানির ফাঁকে মুক্তার মত দাঁতগুলি দেখা যাইতেছে। চোখদুটি মুদিয়া আছে, পাতার পাশে রাঙ্গা গালের উপর অশ্রুর শুষ্ক চিহ্ন।
‘তুই কেঁদেচিস্, ঘুমোবার আগে কেঁদেচিস্ যাদু? আবদার ভুল্তে পারিস্ নি? এই যে বাবা, জামা কিনে এনেচি। নে, পর্— জামা পর্।”
প্রিয়নাথ সন্তর্পণে কাগজের ভিতর হইতে জামাটি আস্তে আস্তে বাহির করিল। তারপর থোকাকে জামা পরাইয়া তার মৃতদেহ বুকে চাপিয়া, তার অসাড় মুখে মুখ দিয়া সেইখানে স্তম্ভিতের মত বসিয়া রহিল।
টং।—
পরদিনের বেলা সাড়ে নয়টা।
টুইলের জামা-গায়ে, কাঁধে চাদর দিয়া, হাতে ছাতা লইয়া প্রিয়নাথ বাড়ী হইতে বাহির হইল।
খোকার চিতার ধোঁয়া তখনও বুঝি মিলায় নাই,—কিন্তু কি করিবে সে? আজ যে সওদাগরের “মেলডে”—সে কেরাণী। দিনের বেলা কলম ধরিবে, রাত্রে কান্নার ছুটি মিলিবে। এখন কাঁদিবার অবকাশ নাই। আজ যে সদাগরের “মেলডে,”—সে যে কেরাণী!