পসরা/স্মৃতির শ্মশানে

স্মৃতির শ্মশানে

 সুখেন্দুর সঙ্গে ডাক্তার বরেন্দ্রনাথের আলাপ হইয়াছিল, তাহার সাহিত্য-চর্চ্চার ফলে।

 গল্প লিখিয়া সুখেন্দু অল্প নাম করে নাই। সত্য বলিতে কি, তাহাকে লইয়া বাঙ্গলা মাসিকের সম্পাদকগণের ভিতরে দস্তুরমত · ‘টাগ্ অফ্‌ ওয়ার’ বাঁধিয়া গিয়াছিল। এর কারণ আর কিছুই নয়, আজকাল বাঙ্গলা সাহিত্যে ভাল ছোটগল্প “ডুমুরের ফুলের” মত দুষ্প্রাপ্য হইয়া পড়িয়াছে; অথচ মাসিকের পাঠক চায় খালি গল্প আর গল্প!

 অতএব হঠাৎ যদি কোন ‘একজন ভাল গল্পলিখিয়ের খোঁজ পাওয়া যায়, সম্পাদকদের ভিতরে তবে ‘দেহি দেহি’ রব উঠিতেও দেরি হয় না। এবং নিলামে যেমন নানাদিক্ হইতে দর-হাঁকাহাঁকি হইতে থাকে, এখানেও তেমনি একপক্ষ হাঁকেন যত টাকা, অন্য পক্ষ হাঁকেন তার দ্বিগুণ, আর এক পক্ষ ত্রিগুণ। দর যাঁর বেশী, মাল পান তিনি।

 এই দুর্ভিক্ষের বাজারে, সুখেন্দু বেশ অল্পদিনের ভিতরেই নাম জাহির করিতে পারিয়াছিল এবং সুখেন্দুর সাহিত্য-কুঞ্জের ভিতরে বাণীর বীণাগুঞ্জনের তালে তালে কমলার রজত-চক্রের মধুর শিঞ্জিনী উঠিয়া তাহার প্রাণ-মন তৃপ্ত করিয়া দিত।

 নাম হইলে লেখক সমাজে দুর্মুখ শত্রু বাড়ে বঢ়ে, কিন্তু সুখের কথা এই যে, পাঠক-সমাজে সেই সঙ্গে মিষ্টমুখ মিত্রের সংখ্যাও বর্দ্ধিত হয়। সুখেন্দুর অনেকগুলি ভক্ত পাঠকের মধ্যে ডাক্তার বরেন্দ্রনাথও একজন।

 বরেন্দ্রনাথের সঙ্গে সুখেন্দুর আলাপ বেশীদিন হয় নাই। কিন্তু পৃথিবীতে দেখা যায়, একজনের সঙ্গে জন্মাবধি একত্র বাস করিয়াও প্রকৃত বন্ধুত্বের মধুর সম্বন্ধ হইল না, কিন্তু তিনটি দিনের আলাপে আর একজনের সঙ্গে হয়ত, প্রাণের বিনিময় হইয়া গেল। আসল কথা, মনের মিল, বন্ধুত্বের প্রথম সোপান। আর এইজন্যই, দুইদিনের পরিচয়েই সুখেন্দু ও বরেন্দ্রনাথের ভিতর হইতে ব্যবধানের যবনিকা সরিয়া গিয়াছি ল।

 টেবিলের উপরে ব্যালজ্যাকের পাষাণময়ী মূর্ত্তির নিষ্পলক দৃষ্টির সামনে বসিয়া সে দিন প্রভাতে সুখেন্দু গল্পরচনায় নিবিষ্টচিত্ত ছিল।

 ঘরের দেওয়ালের চারিদিকে স্বদেশী-বিদেশী সাহিত্যিকগণের মূর্ত্তিচিত্র বিলম্বিত। একদিকে সারি সারি কতকগুলি আল্‌মারি সাজান, তাহাদের ভিতর হইতে সোনার-জলে-লেখা পুস্তকের নামগুলি ঝক্‌মকিয়া উঠিতেছে। সুখেন্দুর ঠিক সামনেই একটি খোলা জানালা। তাহার ভিতর দিয়া চাহিলে বাহিরের বাগানের সজীব সবুজ রংএর মাঝে মাঝে বাতাসে-দোদুল গোলাপ ফুলের রাঙ্গা রাঙ্গ। মুখগুলি নজরে পড়িয়া যায়। লিখিতে লিখিতে সুখেন্দুর মস্তিষ্ক যখন ক্লান্ত হইয়া পড়ে, তখন সে মুখ তুলিয়া উদ্যানের দিকে দৃষ্টিপাত করে। এবং নবীন শ্যামলতার সেই অভিরাম লীলা দেখিয়া তাহার মস্তিষ্ক আবার সতেজ হয়, তাহার প্রাণে আবার নূতন উদ্যম আসে।

 সুখেন্দু একমলে-লিখিতেছে, এমন সময়ে ভৃত্য আসিয়া তাহার হাতে একখানি ‘কার্ড’ দিল।

 ‘কার্ড’খানা হাতে করিয়া লইয়া সুখেন্দু পড়িল, ‘ডাক্তার বরেন্দ্রনাথ মজুমদার।'

 ভৃত্যের দিকে চাহিয়া বলিল, “বাবুকে এখানে নিয়ে আয়।”

 ভৃত্য চলিয়া গেলে পর সুখেন্দু আস্তে আস্তে লিখিবার খাতাখানি মুড়িয়া একপাশে রাখিয়া দিল। তাহার পর একটি সিগারেট বাহির করিয়া তাহাতে অগ্নিসংযোগ করিল।

 ইতিমধ্যে বরেন্দ্রনাথ সহাস্যমুখে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিলেন।

 সুখেন্দু দাঁড়াইয়া উঠিয়া, তাঁহার দিকে একখানা চেয়ার ঠেলিয়া দিয়া বলি; “বসুন। কেমন আছেন?”

 বরেন্দ্রনাথ বসিয়া বলিলেন, “ভাল। আপনি?”

 “আমিও তাই।”

 বরেন্দ্রনাথের বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ হইবে।” খুব সুপুরুষ না হইলেও দেখিতে তাঁহাকে মন্দ নয়। বেশ দীর্ঘ দেহ, শ্যামবর্ণ স্বাস্থ্যপূর্ণ সবল আকৃতি। মুখখানি হাসি-হাসি, চোখ দুইটিতে সরলতা যেন উছলিয়া পড়িতেছে।

 বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “একটা সুখবর সুখেন্দুবাবু! দিনরাত সেধে সেধে যাঁর মন পাইনে, আপনি এক মুহূর্ত্তে তাঁর প্রাণ হরণ করেছেন।”

 সুখেন্দু হাসিয়া কহিল, “যৌবরাজ্য থেকেত’ অনেক দিন নির্ব্বাসিত হয়েচি, কিন্তু আজ পর্য্যন্ত কারুর প্রাণ ত কৈ হরণ কর্‌তে পারলুমই না! তা, সেজন্যে আমার বিশেষ কোন দুঃখ নেই, কারণ সকলে সব কাজ পারে না। কিন্তু ব্যাপার কি বলুন দেখি!”

 বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনার ‘প্রেমের পরখ’ নামে গল্পটি পড়ে আমার স্ত্রী একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেছেন। তাঁর মতে উদীয়মান গল্পলেখকদের ভেতরে আপনি শ্রেষ্ঠ আসন পাবার অধিকারী।”

 সুখেন্দু এই প্রশংসায় কিঞ্চিৎ সঙ্কুচিত হইয়া বলিল, “তাঁকে আমার ধন্যবাদ জানিয়ে বলবেন যে, তিনি কখনও ভাল সমালোচক হতে পার্ব্বেন না, কারণ তিনি অত্যুক্তি করেচেন।”

 বরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় নি—আমারও ঐ মত।”

 সুখেন্দু বলিল, “তাহলে আমি নাচার।”

 বরেন্দ্রনাথ চেয়ারখানা সামনের দিকে আর একটু সরাইয়া আনিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, ও কথা এখন থাক্‌—আপনার সঙ্গে আমার আর একটা কথা আছে।”

 সুখেন্দু সিগারেটে একটি টান দিয়া বলিল, “আমিও শোন্‌বার জন্যে প্রস্তুত আছি।”

 বরেন্দ্রনাথ . বলিলেন, “আপনার হাতে কি আজকাল বেশী কিছু কাজ আছে?”

 সুখেন্দু বলিল, “একটা লেখা শেষ কর্ত্তে বাকী আছে বটে। তা সেটা বোধ হয় আজ্‌কেই শেষ হয়ে যাবে— তারপর কিছুদিন বিশ্রাম কর্ব্ব।”

 বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তাহলে চলুন না—কিছুদিন বাইরে বেড়িয়ে আসি।”

 সুখেন্দু বলিল, “বাইরে! কোথায়?”

 “মধুপুরে। এ অনুরোধ শুধুই যে আমার একার, তা মনে করবেন না, আমার স্ত্রীরও এতে বিশেষ ইচ্ছে আছে বলে জানবেন। আপনি যদি আমাদের সঙ্গে যান, তাহলে আমাদের প্রবাসের দিনগুলো বড় সুখেই কেটে যাবে। কি বলেন?”

 সুখেন্দু কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল, “আপনাদের এই অযাচিত অনুরোধ ঠেল্‌তে পারি, এমন সাধ্য আমার নেই। বেশ, তাহলে কবে যাচ্ছেন?”

 “কাল সকালেই।”

 “কাল সকালেই! তাহলে দুদিনের জন্যে আমাকে মাপ কর্ত্তে হবে বরেনবাবু! আপনারা আগেই যান, দুদিন পরে আমি যাব! আপনাদের ঠিকানা কি?”

 ঠিকানা বলিয়া বরেন্দ্রনাথ উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তারপর বলিলেন, “আজ তবে আসি!”

 “আসুন” বলিয়া সুখেন্দুও উঠিয়া দাঁড়াইল।

 বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তাহলে এই কথাই রৈল—দেখ বেন, ভুল্‌বেন না!”

 একটি নমস্কার করিয়া বরেন্দ্রনাথ চলিয়া গেলেন।

 সুখেন্দু জানালার কাছে গিয়া, অন্যমনস্ক ভাবে অনেকক্ষণ বাগানের দিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর আপনমনে বলিল, “বরেন্দ্রবাবু সর্ব্বদাই তাঁর স্ত্রীর কথা বলেন। বোধ হয় তাঁর পারিবারিক জীবন খুব সুখের। কেন হবে না! আমার মত একলা আর কে আছে? তবু সাহিত্য আছে বলে বেঁচে আছি—নইলে আমার জীবনটা কি হত!—ওঃ!”

 তিনদিন পরে সুখেন্দু মধুপুরে আসিয়া ট্রেন হইতে নামিয়া পড়িল।

 বরেন্দ্রনাথ তাহার জন্য ষ্টেশনেই দাঁড়াইয়াছিলেন। তাড়াতাড়ি একটা কুলি ডাকিয়া, তাহার মাথায় সুখেন্দুর ট্রাঙ্কটি তুলিয়া দিয়া ষ্টেশন হইতে বাহির হইলেন।

 বাহিরে আসিয়া সুখেন্দু জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার বাংলো কত দূরে?”

 বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “পাঁচ মিনিটের পথ। আপনি আস্‌বেন শুনে আমার স্ত্রী যে কতটা সুখী হয়েচেন, তা আর বলা যায় না। আপনারা কবিমানুষ, তাই আপনার জন্যে তিনি পাহাড়ের দিক্‌কার একটা ঘর সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছেন; সে ঘরের জান্‌লা খুলে দিলেই সামনে পাহাড় দেখা যায়।”

 সুখেন্দু মনে মনে বরেন্দ্রনাথের স্ত্রীর এই সূক্ষ্মদৃষ্টির প্রশংসা করিয়া প্রকাশ্যে বলিল, “আপনারা ব্রাহ্ম—স্ত্রীলোককে যথেষ্ট সুশিক্ষা দেন, তাই তাঁরাও শিক্ষিত পুরুষের মনের গতি কি রকম, সেটা ভালরকমেই আন্দাজ করতে পারেন। দেখুন, আপনার স্ত্রী যদি অশিক্ষিতা হতেন, তাহলে তিনি আমাকে দেখ্‌বার আগে কি এতটা বুঝেসুঝে কাজ করতে পার্ত্তেন! আমার ত মনে হয় না। আমরা সকলে এই সত্যটা বুঝতে পারি না। আমাদের অনেকে মনে করেন, স্ত্রীলোককে লেখাপড়া শেখালে তাঁরা গৃহস্থালীর দিকে আর ফিরে চাইবেন না—খালি নবেলই পড়বেন, নবেলই পড়বেন! তাই এদেশের বেশীর ভাগ স্ত্রীলোকই স্বামীর শয্যা-সঙ্গিনী মাত্র—সহধর্ম্মিণী নন্। স্ত্রীলোককে আমরা শুধু অশিক্ষিতা রাখি না—বাইরের পৃথিবী থেকে একরকম নির্ব্বাসিত করে রাখি। আর বাড়ীর ভেতরেও কি তাঁদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে! অন্তঃপুরেও ঘোমটা দিয়ে তাঁদের মুখবন্ধ! শ্বশুরকে তাঁরা পিতা বলেন, অথচ মুখে ঘোমটা! এ যে কি রকম লজ্জা, আমি ত তা বুঝতেই পারি না।”

 বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এ ভাবটা এখন ঢের কমে এসেচে।”

 সুখেন্দু কহিল, “হ্যাঁ, সে কথা ঠিক; কিন্তু কমান’ হয়েচে বলে সমাজপতিদের মুখও যথেষ্ট রক্তবর্ণ হয়ে উঠেচে!”

 এইরূপ কথা হইতে হইতে দু’জনে অনেকখানি পথ অগ্রসর হইয়া পড়িলেন। বরেন্দ্রনাথ কিছু তফাতে একখানা বাড়ী দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “আর এসে পড়েচি,—ঐ আমার বাংলো।”

 সুখেন্দু কহিল, ‘‘জায়গাটি বেশ নিরিবিলি ত?”

 বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “হ্যাঁ, নিরিবিলি দেখেই ত এখানে বাংলো তৈরি করিয়েচি। কল্‌কাতায় সারা বছর লোকের গোলমালে আর গাড়ী-ঘোড়ার ঘড়্‌ঘড়ানিতে কাণ ঝালাফালা হয়ে ওঠে, মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ি একটু -শান্তি পাবার জন্যে। তা এখানে এসেও যদি সেই হৈ-চৈ সইতে হয়, তা’হলে সহর ছেড়ে আর এখানে আস্‌বার দরকার কি? ওদিকে নয়,— আমাদের ঢোকবার পথ এই দিকে।”

 মেদিপাতার বেড়ার মাঝখানে একটি ছোট্ট গেট্। গেটের পরেই লাল কাঁকর ছড়ান একটি সরু পথ। পথের দু’ধারে ক্রোটনের সারি, তারপরে যত্ন-কর্ত্তিত দূর্ধ্বায় ভরা দুইখণ্ড সমতল ভূমি। ভূমির ঠিক মধ্যস্থলে দুটি মর্ম্মররচিত বিবসনা রমণীমূর্ত্তি সলজ্জ ভঙ্গীতে নতদৃষ্টিতে যেন আপনাদের বসনমুক্ত অঙ্গ নিরীক্ষণ করিতেছে! চারিদিকে কত ফুলের গাছ! গাছে গাছে কত ফুল!—কোনটি রক্তরাঙ্গা, কোনটি ফিকে লাল, কোনটি গাঢ় নীল, কোনটি ধব্‌ধবে সাদা, আবার কোনটি বা বেগুনী! চলিবার পথটি কিছুদুর অগ্রসর হইয়া একটি কৃত্রিম নির্ঝরকে বেষ্টন করিয়া দ্বিধাবিভক্ত হইয়া গিয়াছে। নির্ঝরের বারিরাশি ঊর্দ্ধে উৎক্ষিপ্ত হইয়া সূর্য্যকর মাখিয়া নিম্নের কতগুলি প্রস্তরগঠিত নৃত্যশীল শিশুর উপরে ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। তার সম্মুখেই বাংলো! এই বাগানঘেরা বাংলোথানির দিকে চাহিলেই বুঝা যায়, ইহার অধিকারীর সথ আছে, রুচি আছে, পয়সা আছে।

 সুখেন্দুকে লইয়া বরেন্দ্রনাথ বাহিরের বসিবার ঘরে প্রবেশ করিলেন। সুখেন্দুর সুমুখে একখানা চেয়ার টানিয়া দিয়া বলিলেন, “বসুন। ততক্ষণে আমি ভেতরে গিয়ে আমার স্ত্রীকে ডেকে আনি। আগে তাঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় হওয়াটা দরকার।”

 সুখেন্দু বসিয়া বসিয়া ঘরখানি দেখিতে লাগিল। দেয়ালে খানকতক ছবি, একটি মার্ব্বেলের টেবিল ঘিরিয়া কয়খানা বেণ্টউড, এককোণে ইজি চেয়ার ও তার পাশে একটি টেবিল-হার্‌মোনিয়াম ছাড়া ঘরের ভিতরে ঘরে আর কোন সরঞ্জাম ছিল না। কিন্তু সাজাইতে জানিলে সরঞ্জাম অল্প বলিয়া গৃহসজ্জার কোনই ত্রুটি ঘটে না। সুখেন্দুও সেই কথা ভাবিতেছিল; কারণ, এই ঘরখানির সরল সজ্জাকৌশলের ভিতরে সে দুইখানি সুনিপুণ হস্তের সন্ধান পাইয়াছিল।

 এমন সময়ে পিছনে পদশব্দ শুনিয়া তাড়াতাড়ি সে উঠিয়া দাঁড়াইল। ফিরিয়া দেখিল, একটি রমণীর হাত ধরিয়া বরেন্দ্রনাথ হাসিতে হাসিতে আসিতেছেন। দেখিয়া, সুখেন্দু একটু সঙ্কুচিত ভাবে মাথা নীচু করিল।

 তাহার সাম্‌নে আসিয়া বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সুখেন্দুবাবু, ইনিই আমার গৃহিণী—আর ইনি হচ্ছেন সুখেন্দুবাবু!”

 সুখেন্দু নমস্কার করিয়া মুখ তুলিল; কিন্তু রমণীর দিকে চাহিয়াই তাহার দৃষ্টি স্থির হইয়া গেল। সে মুখ যে বড়-চেনা! আজ অনেক বছর সে মুখ দেখে নাই বটে, এবং আর যে কখনও দেখিবে এ আশাও তার ছিল না বটে, কিন্তু এই অদর্শন ও হতাশা সেই প্রিয় মুখের স্মৃতি কিছুমাত্র মলিন করিতে পারে নাই—ও মুখের প্রতি রেখাটি, প্রতি তিলটি পর্য্যন্ত তার কাছে সুপরিচিত! সুখেন্দু বিমূঢ়ের মত অবাক্ হইয়া চাহিয়া রহিল।

 মিসেস্ মজুমদারেরও সেই অবস্থা।

 জড়িতস্বরে সুখেন্দু কহিল, “সরযু!”

 স্বপ্নাবিষ্টার মত মিসেস্ মজুমদার বলিলেন, “সুখেন্দু!”

 বরেন্দ্রনাথ খানিকক্ষণ নির্ব্বাক্‌ভাবে একবার নিজের স্ত্রীর দিকে, আর একবার সুখেন্দুর দিকে ঘন ঘন চাহিতে লাগিলেন। তিনি একেবারে হতভম্ব হইয়া গিয়াছিলেন। বিস্ময়ের প্রথম মুহূর্ত্ত কাটিয়া গেলে পর তিনি বলিলেন, “ব্যাপার কি! দুজনের ভেতরে ‘মেণ্ট্যাল্‌ টেলিপ্যাথি’তে আগে থাক্‌তেই চেনাশুনো হয়ে গেছে না কি? এযে অবাক্ কাণ্ড—অ্যাঁ!”

 ততক্ষণে সুখেন্দু আত্মসংবরণ করিয়াছে। ধীরে ধীরে সে বলিল, “বরেন্দ্রবাবু, সরযূ যে আপনার স্ত্রী আগে তা জানতুম্ না। সরযুর সঙ্গে ছেলেবেলাই আমার আলাপ হয়েছিল, সরযূর পিতা তখন আমাদের দেশ—শান্তিপুরেই থাক্‌তেন। তারপর আজ আট বছর সরযূর কোন খবর জানি না।”

 বরেন্দ্রনাথ মস্তক আন্দোলন করিয়া কৌতুকভরে বলিলেন, “বটে, বটে, বটে!”

 একটু বিশ্রামের জন্য সুখেন্দু, তাহার জন্য নির্দ্দিষ্ট ঘরে প্রবেশ করিল।

 ঘরটি ছোট। জানালার ধারে একটি টেবিল, দুখানি চেয়ার ও একটি ছোট ‘বুক্‌কেশ’ সাজান রহিয়াছে। আর একদিকে একখানি ‘ক্যাম্প্‌’ খাটে পালকের মত সাদা বিছানা পাতা।,

 সুখেন্দু একেবারে শয্যায় গিয়া আশ্রয়গ্রহণ করিল। এবং শুইয়া শুইয়া ভাবিতে লাগিল ৷

 সেই পুরাতন কথা!

 সরযূর পিতা দেবেন্দ্রবাবু সরকারি কাজ লইয়া তাহাদের দেশে বদ্ল হইয়াছিলেন। দেবেন্দ্রবাবুর বাড়ী ছিল তাহাদের বাড়ীর পাশে।

 সরযূ তখন ছোট,—আট বছরের মেয়ে। সে তখন বালক। দুইজনে সে যে কি ভাব ছিল! সরযূ দিনরাত তাহাদেরই বাড়ীতে থাকিত। সরযুকে ছাড়িয়া সে থাকিত পারিত না, তাহাকে ছাড়িয়া সরযূ থাকিতে পারিত না। একজন খাবার পাইলে অন্যকে ভাগ না দিয়া একা খাইত না।

 বাদলে সেই অকারণে মাঠে মাঠে দুজনের জলে ভেজা! নালার জলে সেই কাগজের নৌকা-ভাসান, তরপর কার নৌকা কতদূরে গেল বলিয়া সেই তর্ক করা! সন্ধ্যাবেলায় ঠাকুরমার কোলে শুইয়া সেই সুয়ো-রাণীর দুয়োরাণীর গল্প শোনা! তারপর দুজনে দুজনকে জড়াইয়া ধরিয়া সেই একশয্যায় ঘুমাইয়া পড়া।

 সেদিন গিয়াছে।

 তারা দু জনে দুজনকে ভালবাসে, এর বেশী আর কিছু জানিত না। জানিবার দরকারও ছিল না। এখন জানিয়াছে, সে ছিল ভাই-বোনের ভালবাসা।

 তারপর, সরযূও বড় হইল, সেও বড় হইল। লেখাপড়া শিখিবার জন্য সে কলিকাতায় গেল। ছুটির সময় দেশে আসিলে, সরযূর সঙ্গে দেখা হইত। কিন্তু তখন আর তারা খেলা করিত না— সে সময় তখন গিয়াছে। তখনও তারা কথা কহিত— কিন্তু সে শিশুর কথা নয়, পুস্তকের কথা, জ্ঞানের কথা, নানা দেশের কথা!

 দেবেন্দ্রবাবু ছিলেন ব্রাহ্ম। মেয়েকে যত্ন করিয়া তিনি লেখা-পড়া শিখাইয়াছিলেন। তাই সরযূও তার কথা বুঝিতে পারিত, তার মন বুঝিতে পারিত, বোকার মত তার মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকিত না।

 দুজনের এই ভালবাসা উভয়পক্ষের অভিভাবকগণ সস্নেহে লক্ষ্য করিয়াছিলেন। তাহার পিতামাতার ইচ্ছা ছিল সরযূকে পুত্রবধূ করেন। ইহাতে দেবেন্দ্রবাবুরও অমত ছিল না। কিন্তু উভয় পক্ষের ধর্ম্মভেদ এই ইচ্ছা সফল হইতে দিল না।

 এমন সময়ে দেবেন্দ্রবাবু অন্যত্র বদ্‌লি হইলেন। যাইবার দিন সে, সরযূর হাতে হাত রাখিয়া পূর্ণদৃষ্টিতে সরযূর মুখের দিকে চাহিয়াছিল। তাহারা কেহ কোন কথা কহিল না—কেবল বিষাদম্লান দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে চাহিয়া রহিল। বাক্য তাঁহাদের মনের ব্যথা প্রকাশ করিতে পারিল না—কিন্তু সেই মৌন দৃষ্টি তাহাদের কাতর হৃদয়কে প্রকাশ করিয়া দিল। নীরব সন্ধ্যার সেই আসন্ন অন্ধকারে চিরদিনের জন্য সে সরযূর কম্পিত স্কন্ধের উপরে আপনার ভারাক্রান্ত মস্তক রাখিয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিয়াছিল এবং আর একজনের তপ্ত অশ্রু অলক্ষিতে তাহার আনত কণ্ঠকে সিক্ত করিয়া দিয়াছিল!

 তারপর স্বপ্নের ছবি মিলাইয়া গেল। হায় রে, সে যে বোবার স্বপন! সে স্বপ্নকাহিনী অদ্যাবধি অন্য কেহ শুনে নাই—জানে নাই।

 তারপর নয়বৎসর কাটিয়া গিয়াছে; সংসারের কর্ম্ম-প্রবাহে সরযূ-ফুল কোথায় ভাসিয়া গেল— তাহার ঠিক-ঠিকানা সে পাইল না।

 সে আর বিবাহ করিল না। কেন করিল না, কেহ তার কারণ জানিত না। জিজ্ঞাসা করিলে, সে শুধু বলিত, “ইচ্ছা নাই।”

 আজ দীর্ঘকাল পরে একান্ত আকস্মিকভাবে সেই বিস্মৃত স্বপ্ন আবার স্মৃতিপথে ফুটিয়া উঠিয়াছে। তাহার প্রাণের নিভৃত নিকেতন হইতে কে যেন আজ ব্যথিত স্বরে গায়িতেছে—

“সে পুরাণ দিনের কথা ভুলব কি রে হায়,

* * * *
ভোরের বেলায় ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়,

বাজিয়ে বাঁশী গান গেয়েছি বকুল তলায়,
মাঝে হলো ছাড়াছাড়ি গেলাম কে কোথায়,
আবার যদি দেখা হলো প্রাণের মাঝে আয়!”

 আয়, আয়, আয়—প্রাণের মাঝে আয় রে আয়! কে আসিবে? কেন আসিবে?

 সন্ধ্যার সময়ে, সকলে বাহিরের ঘরে বসিয়াছিলেন। চাকর আসিয়া সকলের জন্য চা রাখিয়া গেল।

 সরযূ চাকরকে ডাকিয়া বলিল, “লতাকে ডেকে দিয়ে যা।”

 লতা সরযূর মেয়ের নাম,—তাহার এই একমাত্র সন্তান। অল্পক্ষণ পরেই লতা আসিয়া উপস্থিত হইল। সে এতক্ষণ একটা কাঠের ঘোড়ার পিঠে চড়িয়া বসিয়া তাহাকে চালাইবার জন্য হরেক্‌রকমের চেষ্টা করিতে ছিল,—কিন্তু সেই কাঠের ঘোড়াট। এমনি অবাধ্য যে, তাহার হাজার ছিপ্‌টি খাইয়াও সে এক পা নড়িতে রাজি হইল না। কাজেই লতা চটিয়া গিয়া আসিবার সময়ে লাগাম ধরিয়া তাহাকে হিড়্‌হিড়্‌ করিয়া টানিতে টানিতে লইয়া আসিল। এবং ঘরের ভিতরে ঢুকিয়া ঘোড়াটাকে দুই হাতে তুলিয়া হুম্ করিয়া মাটিতে আছড়াইয়া রাগত স্বরে বলিল, “ছাই ঘোড়া, দুষ্টু ঘোড়৷—চল্‌তে জানে না, কিচ্ছু জানে না!”

 বরেন্দ্রনাথ অট্টহাস্য করিয়া ঘরখানা কাঁপাইয়া তুলিয়া বলিলেন, “বটে, বটে, বটে!”

 সুখেন্দু লতাকে টানিয়া আনিয়া আপনার কোলে তুলিয়া নিল। তারপরে দুইহাতে তার নরম নরম গালদুখানি চাপিয়া ধরিয়া তাহার কোঁকড়া-চুলে-ঘেরা মুখখানি সস্নেহে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, “সরযূ, ছেলেবেলায় তুমি যেমনটি ছিলে, তোমার মেয়েটী যে ঠিক্ তেমনি দেখতে হয়েচে!”

 সরযূ একবার মেয়ের দিকে, আর একবার সুখেন্দুর দিকে ক্ষণিক দৃষ্টিতে চাহিয়া, আনত, সলজ্জমুখে চামচে করিয়া চায়ের পিয়ালায় চিনি মিশাইতে লাগিল।

 বরেন্দ্রনাথ কৌতুকভরে বলিলেন, “বলুন ত সুখেন্দুবাবু! আমার ইনি ছেলেবেলায় কেমনটি ছিলেন—খুব শান্ত, না দুষ্টু?”

 সরযূ চায়ের পিয়ালার দিকে আরও বেশীরকম মনোযোগ দিল।

 সুখেন্দু একবার সরযূর দিকে চাহিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল, “বেজায় দুষ্ট! একটি উদাহরণ দিচ্ছি, শুনুন।”

 সরযূর রক্তারক্ত মুখ টেবিলের উপরে একেবারে ঝুঁকিয়া পড়িল।

 সুখেন্দু সে দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া বলিল, “হ্যাঁ— শুনুন। একবার আমার মা, সরযূ আর আমাকে একএকটি রসগোল্লা দেন। আমি বুদ্ধিমানের মত রসগোল্লাটী টপ্ করে মুখের ভেতরে ফেলে দিলাম। কিন্তু একটি রসগোল্লায় সরযূর মন কিছুতেই উঠল না। রসগোল্লাটী অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে উনি সেটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বল্লেন, ‘আমি এক্‌তা খাবুন না—হতো খাবুন!’ খাবুনটা কি বুঝেচেন? উনি তখন ‘খাব’ বল্‌তেন না—‘খাবুন্’ বল্‌তেন। ছেলেবেলা থেকেই মৌলিকতার প্রতি ওঁর এতটা ঝোঁক ছিল!”

 সরলপ্রাণ বরেন্দ্রনাথ ততক্ষণে দুইহাতে পেট চাপিয়া হাসিয়া হাসিয়া প্রায় মারা পড়িবার যোগ হইয়াছেন। অনেক কষ্টে শেষটা হাসি থামাইয়া তিনি চেয়ারের উপরে সোজা হইয়া বসিয়া বলিলেন, “বটে, বটে বটে!”

 সরযু সকোপকটাক্ষে সুখেন্দুর দিকে চাহিয়া তাড়াতাড়ি সে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইল।

 বরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “ওগো, যেও না, রেও না! তুমি গেলে আমরাও তোমার পশ্চাতে ধাবমান হব।”

 সরযূ অভিমানের সুরে বলিল, “আমাকে একলা পেয়ে এমন করে জব্দ করা হবে, আর আমি বুঝি চুপটি করে বসে বসে তাই সইব?”  বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “কেন, তুমিও তোমার পক্ষসমর্থন কর্‌তে পার।”

 সরযু ভুরু বাঁকাইয়া বলিল, “যাও, যাও, অত রসিকতায় আর কাজ নেই! ভালমানুষের মত চা খাবে ত’ খাও, নইলে আমি কখ্খনো এখানে থাক্‌বোনা, কখ্খনো না! আগে থাক্‌তে এ কথা বলে রাখলুম কিন্তু!” বলিয়া, সরযূ আবার আস্তে আস্তে আসনে আসিয়া বসিল।

 চা-পান করিতে করিতে বরেন্দ্রনাথ ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলিলেন। বলিলেন, “আচ্ছা সুখেন্দুবাবু, আমি লক্ষ্য করে দেখেচি, আপনার অধিকাংশ লেখার ভেতরে কেমন একটা চাপা বেদনার সুর আছে। অথচ, লোকের সঙ্গে কথাবর্ত্তায় আপনি ত’ বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি কর্‌তে পারেন! এর কারণ কি?”

 প্রশ্ন শুনিয়া সুখেন্দুর মুখ মলিন হইয়া গেল। অনেকক্ষণ সে চুপ করিয়া রহিল। তারপর চায়ের পিয়ালাটি টেবিলের উপরে নামাইয়া রাখিয়া নিম্নস্বরে বলিল, “আপনি যে আমার লেখার ভেতরে এতটা লক্ষ্য করচেন, তা আমি জানতাম না। দেখুন বরেনবাবু, লোকে বাইরের কথাবার্তায় আপনাকে ভুলতে চায়, কিন্তু লেখায় যে যথার্থ প্রাণটী আপনি প্রকাশ হয়ে যায়! হয় ত’ আমার প্রাণের সুর - বেদনার সুর। তাই লেখাতেও সেটা বেজে ওঠে। কৃত্রিমতা নিয়ে আপনাকে ঢাকা দিয়ে ত’ সাহিত্য সৃষ্টি হয় না বরেনবাবু! যে লেখায় লেখক নিজে হাসেন, সে লেখায় পাঠকও না হেসে পারে না। যে লেখায় লেখক নিজে কাঁদেন, সে লেখা পড়ে পাঠককেও কাঁদ্‌তে হয়। আর পাঠকদলকে নিয়েই যখন আমাদের কারবার, তখন প্রাণের আসল রূপটিকে আমরা লেখাতে ফোটাতে বাধ্য।”  বরেন্দ্রবাবু বলিলেন, “তাহলে আপনার লেখা পড়ে বলতে হয়, আপনার প্রাণের ভেতরে যাতনা আছে।”

 সুখেন্দু অস্ফুট স্বরে বলিল, “যা মনে করেন।”

 বরেন্দ্রবাবু চায়ের পিয়ালায় চুমুক্‌ দিয়া কহিলেন, “সুখেন্দুবাবু, রকম প্রাণ নিয়েত’ সংসার করা চলে না।”

 সুখেন্দু চা পান শেষ করিয়া পিয়ালাটি সরাইয়া রাখিয়া বলিল, “তা আমি জানি। তাই বিবাহ করাও আর হয়ে উঠ্‌ল না। সংসারের সঙ্গে আমার জীবনের সম্পর্ক কি?”

 সুখেন্দু যে বিবাহ করে নাই, সরযূ একথা জানিত না। আজ সুখেন্দুর মুখে এই কথা ও তাহার অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বর শুনিয়া সে চমকিয়া উঠিল। পাছে তাহার মুখের ভাব সুখেন্দুর নজরে পড়ে, সেই ভয়ে সে তাড়াতাড়ি আলোর দিকে পিছন ফিরিয়া বসিল।

 বরেন্দ্রনাথেরও চা-পান শেষ হইল। তিনি টেবিলের ধার হইতে উঠিয়া ইজিচেয়ারের উপরে গিয়া পা ছড়াইয়া দিয়া শুইয়া পড়িলেন। খানিকক্ষণ সকলেই নীরব হইয়া রহিলেন। লতাও অনেকক্ষণ আগে একটা কাচের পুতুলকে বুকের উপরে দুই হাতে চাপিয়া ধরিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল।

 এরকম চুপচাপ বসিয়া থাকা বরেন্দ্রনাথের স্বভাব নয়। সকলের আগে তিনিই কথা কহিলেন। বলিলেন, “একি, সব যে থেমেথুমে পড়্‌ল! এখনো রাত হয়নি, খাবার হতে অনেক দেরি। এতটা সময় কি করা যায়? আচ্ছা, তুমি একটা গান গাও গো,—ওঠ!”

 কথাটা সরযূকে লক্ষ্য করিয়া বলা হইয়াছিল। সরযূ ম্লানভাবে বলিল, “আমার আজ গলা ভাল নেই,— আমি গাইতে পার্ব্ব না।”  বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “গলার জন্যে কিছু এসে যাবে না। এখানে ত’ বাইরের কোন লোক আর উপস্থিত নেই! নাও,—উঠে পড়।”

 সরযূ ঘাড় নাড়িয়া দৃঢ়ভাবে অপত্তি জানাইয়া বলিল, “না, আমি কিছুতেই গাইতে পার্ব্ব না।”

 বরেন্দ্রনাথ তখন হতাশভাবে সুখেন্দুর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “সুখেন্দু বাবু, তবে আপনি উঠুন।”

 সুখেন্দু বলিল, “আমি? আমার ত’ তেমন গলা নেই।”

 বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “না, সে হবে না; আপনাকে গাইতেই হবে।”

 সুখেন্দু আরও দুচারবার আপত্তি জানাইল, কিন্তু বরেন্দ্রনাথ যখন কিছুতেই ছাড়িলেন না, তখন অগত্যা তাহাকে উঠিতে হইল।

 হার্‌মোনিয়ামের চাবিগুলির উপরে একবার হাত চালাইয়া একটা নির্দ্দিষ্ট সুরে গিয়া থামিয়া সুখেন্দু জিজ্ঞাসা করিল, “কি গাইব?”

 হারমোনিয়ামের সুর শুনিয়াই বরেন্দ্রবাবুর তন্দ্রার উপক্রম হইয়াছিল। তিনি জড়িতস্বরে বলিলেন, “রবিবাবুর একটা গান।”

 বরেন্দ্রবাবুর তন্দ্রা আসিয়াছে, সরযূ এটা বুঝিতে পারিয়াছিল। এই অদ্ভুত সঙ্গীতরসজ্ঞ অপূর্ব্ব শ্রোতাটির স্বভাব তাহার পূর্ব্ব হইতেই জানা ছিল। সে জানিত, গান সুরু করিতে না করিতেই তাহার স্বামী স্বপ্ন দেখিতে সুরু করিবেন।

 সুখেন্দু গায়িল—

যদি বারণ কর তবে গাহিব না—
যদি সরম লাগে তবে চাহিব না।

যদি তোমার ও নদীকূলে
ভুলিয়া ঢেউ তুলে
আমার এ ভাঙ্গা তরী
বাহিব না—

 সুখেন্দু গায়িতে লাগিল,,—এ গান তার প্রথম যৌবনের প্রিয় গান! সে একদিন ছিল—যেদিন তাহারই মুখে এ গান সরযূ কতবার শুনিয়াছে! আজ আবার কতদিন— কতদিন পরে সেই শ্রোতার সামনেই এই যৌবনের গীতি তাহার কণ্ঠে ফুটিয়। উঠিল— তাই সুখেন্দুও প্রাণের সমস্ত আবেগ, সমস্ত ভাব দিয়| হৃদয়কে সুরে পরিণত করিয়া, স্থানকালপাত্র সমস্ত ভুলিয়া গায়িতে লাগিল। তাহার অতীত জীবনের শেষের দিক্‌টা যেন তাহার স্মৃতিপট হইতে একবারে মুছিয়া গিয়া জাগিয়া উঠিল,—সেদিনকার স্বপ্নচ্ছবি—যেদিন তাহার চিত্ত-মুরলীতে যৌবনের প্রথম উদ্বোধনসঙ্গ ত ধ্বনিয়। উঠিয়াছিল, যেদিন ঐ মুক্ত-উদার বিপুল নীলিমার তলায় তাদের একান্ত-আপন ছোট্ট মানস-লোকে সে আর সরযূ—সরযূ আর সে ছাড়া তৃতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিল না! হায় রে, সেদিন কি ভুলিবার?

 সুখেন্দু আলোকের দিকে পিছন করিয়া একাগ্রমনে গান গায়িতেছিল। হঠাৎ হার্‌মোনিয়ামের উপরে পিছন হইতে কাহার ছায়া পড়িল! সেইসঙ্গে সে আপনার মস্তকে যেন কাহার তপ্ত শ্বাস অনুভব করিল! অত্যন্ত চমকিয়া মুখ ফিরিয়া সে দেখিল, শবের মত রক্তহীন মুখ লইয়া ঠিক্ তাহার পশ্চাতে দাঁড়াইয়া, সরযূ!

 তাহার গান ও হার্‌মোনিয়ামের সুর একসঙ্গে সহসা থামিয়া গেল।

 অতি অস্ফুট, কম্পিত, কাতর স্বরে সরযূ বলিল, “পায়ে পড়ি—পায়ে পড়ি—এ গান আর গেয়ো না।”

 সুখেন্দু পাথরের মূর্ত্তির মত আড়ষ্ট হইয়া বসিয়া রহিল। যখন ফিরিয়া চাহিল,—দেখিল, ঘরের ভিতরে সরযূ নাই এবং বরেন্দ্রবাবু ‘অঘোরে’ ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন।

 সুখেন্দু অনুতপ্ত চিত্তে যখন শয্যায় আশ্রয়গ্রহণ করিল, তখন অনেক রাত।

 তাহার প্রাণ তখন যাতনায় যেন ভাঙ্গিয়া পড়িতে চাহিতেছিল। আপনাকে সে আপনি প্রবোধ দিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। বেশ বুঝিয়াছিল যে, আপনার অজ্ঞাতসারে সে একটা অমার্জ্জনীয় অপরাধ করিয়া বসিয়াছে। অপরাধ? কি অপরাধ? কি যে সে অপরাধ, সেটা সে ভাল করিয়া আন্দাজ করিতে পারিল ন!—সেটাকে সে একটা নির্দ্দিষ্ট সীমানার ভিতরে ধরিতে পারিল না।

 তবে এটা ঠিক্, সেই গানটা গাওয়া তার পক্ষে উচিত হয় নাই। একটা সামান্য গান যে এতটা অপকার করিতে পারে, সংসারের পনেরোআনা দৃষ্টিহীন লোক এ কথা মানিবে না। কিন্তু তার মত লোকের পক্ষে বোঝা উচিত ছিল যে, অবস্থাবিশেষে পূর্ব্ব-স্মৃতি-উদ্দীপক একটা সঙ্গীত বা একটা সামান্য ভঙ্গী পর্য্যন্ত মানুষের দুর্ব্বল চিত্তের ভিতর কত বড় ছেদী করিয়া দিতে পারে। খড়ের বোঝার ভিতরে একটা মস্ত মশাল ফেলিয়া দিলে যে কার্য্যসাধন করে, একটুখানি আগুনের ফিন্‌কিও তার চেয়ে কিছুমাত্র কম কাজ করে না।

 তার চোখের সামনে আজ আর একটা সত্য আত্মপ্রকাশ করিয়াছে! সরযূ এখনও তাকে ভুলিতে পারে নাই—সে এখনও তাকে ভালবাসে! হাঁ, নিশ্চয়ই। নহিলে পূর্ব্বকালের গান শুনিয়া সে অমনভাবে বিচলিত হইল কেন? যে মাটি নরম, সেই মাটিতেই পায়ের দাগ বসে, শক্ত মাটিতে বসে না। তাহার প্রতি সরযূর যদি একটুও টান না থাকিত, তবে গান শুনিয়া তাহার মনে কোনরূপ বিকৃতি হইত না। আচ্ছা, সরযূ আমাকে গান গায়িতে মানা করিল কেন? বোধ হয় তাহার দুর্ব্বল মন আমার দিকে অন্যায়রূপে আকৃষ্ট হইয়া পাছে তাহাকে কর্ত্তব্যপথ হইতে সরাইয়া লইয়া যায়, সেই ভয়ে!

 ছি ছি মনের আবেগে কি ভয়ানক ভুল করিতে বসিয়াছিলাম!

 সে তাকে ভালবাসে! কিন্তু এ ভালবাসায় আজ আর তাহার কোন দাবী-দাওয়া নাই। সে যে পর-স্ত্রী! সরযুর কথা ভাবাও আজ তার পক্ষে অন্যায়।

 সুখেন্দু এই ভয়ানক সত্যটা প্রাণপণে ভুলিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। অন্ধকারের ভিতরে জড়সড় হইয়া শুইয়া মনে মনে সে বারংবার উচ্চারণ করিতে লাগিল, ইহা মিথ্যা, ইহা মিথ্যা! ঈশ্বর! আমাকে দয়া কর, আমার বুকে বল দাও, ইহা মিথ্যা করিয়া দাও! আমি ক্ষীণবল, হীনপ্রাণ—আমাকে এমন করিয়া পথে ফেলিয়া দিও না— আমাকে বাঁচাও প্রভু, বাঁচাও! ইহা মিথ্যা!

 কিন্তু, সত্য কি কঠোর! সে যত অন্য কথা ভাবিয়া সেই ভীষণ কথাকে চাপা দিবার চেষ্টা করিতে লাগিল, কথাটা ততই যেন বড় হইয়া, স্পষ্ট হইয়া তাহার মনের দরজা খুলিয়া বাহিরে আসিবার জন্য জোর করিতে লাগিল। সত্যটা ভয়ানক—কিন্তু, কিন্তু—কি মধুর! মনের ভিতর হইতে কে যেন তাহাকে ডাকিয়া ডাকিয়া, আর কোন মানা না মানিয়া ক্রমাগত তাহাকে বলিতে লাগিল, সরযূ তাকে ভালবাসে, সরযূ তাকে ভালবাসে, সরযূ তাকে ভালবাসে!

 মনের সঙ্গে যুঝিয়া যুঝিয়া আর সে পারিল না। পাগলের মত তাড়াতাড়ি বিছানা হইতে উঠিয়া, ছুটিয়া গিয়া সে একটা জানালা খুলিয়া দিল। অমনি বাহির হইতে উদ্দাম বাতাস আসিয়া তাহার উন্মুক্ত বক্ষকে চারিদিক্ হইতে আলিঙ্গন করিয়া ধরিল— আঃ! কি স্নিগ্ধ, কি মধুর সে বাতাস!

 অতি অস্পষ্ট চন্দ্রলেখায় সুদূরের শৈলমালা একটা ঘনীভূত বিরাট্ ছায়ার মত দেখাইতেছিল। সে যেন তার অন্ধকার হৃদয়ের বহির্বিকশিত প্রতিবিম্ব! চেয়ারের উপরে বসিয়া, জানালার কাঠের উপরে মাথা রাখিয়া সেইদিকে সে নিষ্পলকনেত্রে চাহিয়া রহিল! আকাশে, কোথায় তখন একটা চাতক পাখী থামিয়া থামিয়া কাতরে ডাকিতেছিল—‘ফটিক জল!’ সেই তৃষিত কণ্ঠের করুণ কামনা শুনিতে শুনিতে তাহার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে বিরামদায়িনী নিদ্রা আসিয়া কখন যে তার চোখের পাতা বন্ধ করিয়া দিল, তাহা সে জানিতেও পারিল না।

 ডাক্তার মানুষের কপালে ঈশ্বর শান্তি লিখেন নাই। বরেন্দ্রবাবু মধুপুরে আসিয়াছিলেন বিশ্রাম করিতে, কিন্তু কার্য্যগতিকে সেটা আর ঘটিয়া উঠিল না। এমনি প্রতিবারই হয়। লোকে ঠিক্ খোঁজ করিয়া আসিয়া তাঁহাকে ধরিয়া লইয়া যায়। বিশেষ, মধুপুরে রোগীরও অভাব নাই। সুতরাং বরেন্দ্রনাথের বিশ্রাম করা আর হয় না।

 পরদিন একটু বেলায় সুখেন্দুর নিদ্রাভঙ্গ হইয়াছিল। সে বাহিরে আসিয়া দেখিল, বরেন্দ্রবাবু রোগী দেখিতে গিয়াছেন। চাকর আসিয়া তাহাকে চা ও খাবার দিয়া গেল—কিন্তু সরযূকে দেখা গেল না।

 সুখেন্দু চাকরকে সরযূর কথা জিজ্ঞাসা করিতে যাইতেছিল, কিন্তু হঠাৎ কি ভাবিয়া থামিয়া গেল।

 খানিক পরে বরেন্দ্রনাথ ফিরিলেন। সুখেন্দুকে একলা দেখিয়া তিনি একটু সঙ্কুচিত ভাবে বলিলেন, “মাপ কর্ব্বেন সুখেন্দুবাবু! আপনাকে এক্‌লা রেখে ভারি কষ্ট দিয়েচি! ওর অসুখ করেচে, নৈলে এমনটা হত না।”

 খবরের কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া সুখেন্দু কহিল, “অসুখ! কি অসুখ?”

 বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “না, এমন কিছু নয়! ভারি মাথা ধরেচে, তাই বিছানা থেকে উঠতে পারচে না—বৈকালে একটু বেড়িয়ে এলেই সেরে যাবে অখন।”

 সুখেন্দু বুঝিল অন্যরকম। আসল রোগটা যে মাথায় নয়, অন্য জায়গায় এ কথা সে মনে মনে অনেকটা আন্দাজ করিতে পারিল। আরও বুঝিল, সরযূ ইচ্ছা করিয়াই তাহার সুমুখে আসিতেছে না। পাছে আসিতে হয়, সেই ভয়েই সে অসুখের অছিলা করিয়াছে। এই কথা চিন্তা করিয়া এবং এই অন্যায় ব্যবহার স্মরণ করিয়া সরযূর উপরে সে বড়ই বিরক্ত হইয়া উঠিল! কিন্তু একবারও তলাইয়া বুঝিল না যে, যাহার উপরে রাগ করিয়া দোষ দিতেছে, তাহার উপরে তার আর কোন দাবি-দাওয়া নাই! সে তার পরিচিত বটে, কিন্তু সে আজ অপরের ধর্ম্মপত্নী।

 বৈকালে বরেন্দ্রনাথ, সুখেন্দু ও সরযূকে সঙ্গে করিয়া নদীর দিকে চলিলেন। সরযূ সহজে বেড়াইতে যাইতে রাজি হয় নাই। বরেন্দ্রনাথ তাহাকে একরূপ জোর করিয়াই বাহিরে টানিয়া আনিলেন।

 কিন্তু বাড়ীর বাহিরে পা দিতে না দিতেই একজন লোক আসিয়া হাজির। তাহার ভায়ের অসুখ বড় বাড়িয়াছে, ডাক্তারবাবুকে একবার যাইতেই হইবে।

 বরেন্দ্রনাথ হতাশভাবে বলিলেন, “বটে, বটে, বটে! তা, তোমরা আমাকে জ্বালালে বাপু! আমাকে কি একটু হাঁফ ছাড়তেও দেবে না? দম আট্‌কে মরে যাব যে বাবা!”

 লোকটা লম্বা সেলাম ঠুকিয়া নিবেদন করিল যে, রোগীর ধারণা হইয়াছে, বরেন্দ্রবাবু ‘ডাগ ডর্’ তাহাকে ‘দাওয়াই’ না দিলে তাহার ‘জান,’ কিছুতেই বাঁচিবে না।

 মনে মনে খুসী হইয়া বরেন্দ্রবাবু বলিলেন, “রোগীদের বুদ্ধি-সুদ্ধি এতটা তীক্ষ্ণ হলে আমাকেও জান্‌ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হতে হবে দেখচি। চল বাবা চল—ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েঞ্জ ধান্‌ ভানে, কল্‌কাতা ছাড়লেও রোগী ছাড়ে না!—সুখন্দু বাবু, আপনি ওকে নিয়ে নদীর ধারে যান! শীগ্‌গীর ছাড়ান্‌ পাই যদি, তাহলে আমিও একটু পরে গিয়ে সঙ্গে যোগ দেব!”

 সরযূ কহিল, “আজ তবে গিয়ে কাজ নেই।”

 সুখেন্দুও বলিল, “সেই ভাল।”

 কিন্তু বরেন্দ্রনাথ প্রবলভাবে মস্তকান্দোলন করিয়া বলিলেন, “স্ত্রী-বুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী সুখেন্দুবাবু! বেড়িয়ে এলে মাথার যাতনা সেরে যাবে! কিচ্ছু বোঝেন না, আবার বলা হচ্চে গিয়ে কাজ নেই! হুঃ—শেষটা ঘরে রোগী, বাইরে রোগী নিয়ে আমার হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা হোক্ আর কি!”

 সরযূ কহিল, “আমার ব্যথা সেরে গেছে!”

 বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “ভ্রম, মনের ভ্রম! ব্যথা ঠিক্ আছে, ঘরে গেলেই বাড়বে। আর, সেরেও গিয়ে থাকে যদি—সাবধানের মার নেই। যাও বেড়িয়ে এস।”

 সরযূ আর কিছু বলিতে সাহস করিল না।

 সুখেন্দু বুঝিল, তাহার সঙ্গে পাছে বেড়াইতে যাইতে হয়, সেই ভয়ই সরযুর এই অনিচ্ছার কারণ। এ কথাটা বোঝা অত্যন্ত সহজ; এবং বুঝিয়া অবধি তাহার বুকের মাঝে একটা যাতনা জাগিয়া তাহার সকল শান্তি নষ্ট করিয়া দিল। একদিন যে সরযূ একলহমা তাহাকে না দেখিলে কাঁদিয়া সারা হইত, একি সেই সরযূ! আশ্চর্য্য!

 তখন দূরের পাহাড়ের আড়ালে সূর্য্য ধীরে ধীরে নামিয়া যাইতেছিল।

 নীলিমার পেলব পটে কোন্‌ অদৃশ্য চিত্রকর রঙিন্‌ আলোর রং দিয়া বিচিত্র চিত্র আঁকিতেছিল, তাহার ছটায় সুদূরের বন-ভূমির নবীন শ্যামলতা সমুজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। মাঝে মাঝে সাদা বকের ঝাঁক্ উড়িয়া যাইতেছে, হঠাৎ দেখিলে মনে হয়, কানন-রাণীর গলায় যেন বিনি-সূতায় গাঁথা বেল্‌ ফুলের মালা দুলিতেছে।

 দুধারের ধূধূ, অসমতল ময়দানের মাঝখানে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ দিয়া সুখেন্দু মুগ্ধনেত্রে চারিদিক্ দেখিতে দেখিতে যাইতেছিল। একবার সরযূর মুখের দিকে তাকাইয়া সে কহিল, “আমরা সহরের ভেতরে প্রকৃতির এই আশীর্ব্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকি। এ সব দৃশ্য কি সুধু দেখার জন্যে দেখা? তা ত নয়! এ সব দেখ্‌লে প্রাণের ভেতরে শান্তি আসে, মনের সঙ্কীর্ণতা দূর হয়ে যায়, মানুষ বুঝ্‌তে পারে যে এই সুন্দর বিশ্বে সে শুধু টাকা-আনা পয়সার হিসেব করতে জন্মায়নি। বাস্তবিক, প্রকৃতির সৌন্দর্য্য আমাদের যে শিক্ষা দিতে পারে, হাজার হাজার পুঁথি তা পারে না।”

 সুখেন্দু আপন মনে গড়্‌গড়্‌ করিয়া বলিয়া যাইতেছিল, সরযূ শুনিতেছে কি শুনিতেছে না, সে খেয়াল্ তাহার মোটেই ছিল না বলিতে বলিতে হঠাৎ সে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিল, মাথা হেঁট করিয়া সরযু নীরবে চলিয়া যাইতেছে, তাহার মুখ সম্পূর্ণ ভাবহীন। সুখেন্দুর একটা কথাও সে শুনিতে পাইয়াছিল কি না সন্দেহ!

 সুখেন্দু জিজ্ঞাসা করিল, “সরযূ, তোমার কি ভাল লাগচে না?

 “না।”

 “তোমার কি অসুখ করেচে?”

 “না।”

 “তবে?”

 “জানি না।”

 তাহার এই একান্ত সংক্ষিপ্ত উত্তরে ও প্রচ্ছন্ন বিরক্তির ভাবে সুখেন্দু আপনাকে অত্যন্ত অপমানিত জ্ঞান করিল। কেন, তাহার কি দোষ? সুখেন্দু স্বভাবতঃ অভিমানী ও ভাবপ্রবণ প্রকৃতির লোক। এই প্রকৃতির লোকেরা, কোমলপ্রাণ হইলেও অতি তুচ্ছ একটা কথাতেও অত্যন্ত বেশীরকম আঘাত পায়। তাহাদের কোমলতাই, তাহাদের দুর্ব্বলতা। সুখেন্দু, সরযূকে কি একটা অপ্রিয় কথা বলিতে যাইতেছিল-কিন্তু অনেক কষ্টে সে আত্মসংবরণ করিল।

 ততক্ষণে তাহারা নদীর ধারে আসিয়া পড়িয়াছে। বৎসরের অন্য সময়ে এই নদীর দুধারে মানব এবং নানা পশু-পক্ষীর পদচিহ্ন বক্ষে লইয়া, যে দীর্ঘ বালুকাধবল তট, শীর্ণ কঙ্কালের মত পড়িয়া থাকে, আজ বর্ষাকালে অজস্র বৃষ্টি জলধারায় পরিপুষ্ট হইয়া সে কঙ্কাল একেবারে ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে ৷

 সরযূ বলিল, “বেড়ান ত’ হ’ল—এখন চল।”

 সরযূ অত্যন্ত নীরস স্বরে কথাগুলি বলিল; যেন সুখেন্দুই তাহার অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাহাকে জোর করিয়া এখানে ধরিয়া আনিয়াছে! একান্ত ক্রোধে সুখেন্দুর মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল সে আর সহ্য করিতে পারিল না। ডাকিল,—

 “সরযূ!”

 তাহার কণ্ঠস্বরে চমকিয়া সরযূ চোখ তুলিয়া চাহিল; চাহিয়াই আবার দৃষ্টি নত করিল।

 সুখেন্দু তিক্তস্বরে বলিল, “সরযূ, তোমার কাছে আমি কি দোষ করেচি যে, তুমি কথায় কথায় আমাকে এতটা উপেক্ষা কর্‌চ?”

 সরযূর দেহ একবার কাঁপিয়া উঠিল, কিন্তু সে কোন কথা কহিতে পারিল না।

 সুখেন্দু তীব্রস্বরে বলিল, “আমি এসে পর্য্যন্ত দেখচি, তুমি আমার সঙ্গে ভাল করে কথা কইচ না, আমার সামনে থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্চ, আমার সঙ্গে যে আগে তোমার পরিচয় ছিল, — সেটা বলতেও যেন তুমি লজ্জা পাও—আমি যেন একটা আপদের মত তোমাদের ঘাড়ে এসে পড়েচি—যেন আমি চলে গেলেই তুমি বাঁচ—”

 হঠাৎ বাধা দিরা সরযূ বলিয়া উঠিল “হ্যাঁ— হ্যাঁ— তুমি চলে যাও-তুমি চলে যাও! তাহলে আমি বাঁচি!”

 সহসা একটা উচ্চস্থান হইতে কোন মানুষকে ধাক্কা মারিলে তাহার মুখ মুহূর্ত্তে যেমন বিবর্ণ হইয়া যায়, সুখেন্দুর মুখের ভাবটাও ঠিক তেমনি হইল। সে নির্ব্বাক্ হইয়া দুইহস্তে আপনার অপমান ও বেদন-কাতর বক্ষ চাপিয়া ধরিয়া অনেকক্ষণ তটিনীর উপলাহত চঞ্চল স্রোতের দিকে পলক-হারা চোখে চাহিয়া রহিল। সরযূও একটা ক্ষুদ্র শৈলের উপরে একান্ত অবসন্নের মত বসিয়া পড়িল। তাহার শ্বাস যেন তখন বন্ধ হইয়া আসিতেছে! সুখেন্দুকে এত বড় একটা কঠিন কথা বলা তাহার উদ্দেশ্য ছিল না—ক্ষণিক দুর্ব্বলতায় এমন একটা কথা তাহার মুখ দিয়া বাহির হইয়া যাওয়াতে অনুতাপে এখন তাহার অন্তর যেন পুড়িয়া যাইতে লাগিল। বিশেষ, সুখেন্দু যদি তাহার অপরিচিত হইত, তবে তাহার মুখ হইতে হয়ত এমন কথা বাহির হইতে পারিত না। সুখেন্দুকে বাল্যকালে সে এমন কর্কশ কথা কতবার বলিয়াছে,—কিন্তু সুখেন্দু, তখন তাহার ক্রোধ বা বিরক্তি, গ্রাহ্যের ভিতরেই আনিত না! কিন্তু, আজত’ আর সেদিন নাই!

 বহুক্ষণ পরে প্রথমেই সুখেন্দু কথা কহিল। ধীরে ধীরে বলিল, “চোখের আড়াল হলেই মানুষ মানুষকে ভুলে যায় —দুনিয়ার গতিক এই। কিন্তু অকারণে, বিনাদোষে মানুষ যে মানুষকে এমনভাবে অপমান করতে পারে, এ জ্ঞান আমার ছিল না। আমি ত’ তোমার কথা ভুলে গিয়েছিলাম সরযু! তবে, কেন তুমি আমাকে ডেকে এনে আমার সুমুখে এসে দাঁড়ালে? আপনাকে নিয়ে আমি আপনিত’ বেশ ছিলাম, তুমি না ডাক্‌লে আমিত’ আস্‌তাম না—ডেকে এনে একি ব্যবহার? সরষু, সরযূ, এ কোন্ দেশের অতিথি-সৎকার?”

 সরযূ কাঁপিতে কাঁপিতে সুখেন্দুর সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার পর ভূতলে জানু পাতিয়া বসিয়া পড়িয়া অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে থামিয়া থামিয়া কহিল, “মাপ কর! আমার অবস্থা যদি বুঝ্‌তে!—”

 চারিদিক্ হইতে কিসের একটা শব্দ উঠিল। দুইজনেই অত্যন্ত চমকিত হইয়া মুখ তুলিয়া দেখিল, আকাশ মেঘে মেঘে মেঘময় এবং সেই নিকষ-কালো জলদ-পটে রহিয়া রহিয়া বিজলী, আগুনের ক্ষণিক আখর লিখিয়া দিতেছে! নিবিড় ধূলারাশির ভিতরে উচ্চ তরু-শিরগুলা দুলিয়া দুলিয়া মাতালের মত নত হইয়া পড়িতেছে—এবং ঝোড়ো বাতাস গর্জ্জিয়া উঠিয়া হু-হু-হু-হু ছুটিয়া আসিতেছে!

 আপনাদের মনের আবেগে সুখেন্দু ও সরযূ এমনি বাহ্যজ্ঞানহীন হইয়াছিল যে, প্রকৃতির এই আকস্মিক পরিবর্ত্তন লক্ষ্য বা অনুভব করিবার অবকাশ তাহাদের মোটেই হয় নাই!

 সুখেন্দু তাড়াতাড়ি, “সরযু—ওঠ— ওঠ! ঝড় এল বলে! শীঘ্র চল!” সরযু উঠিয়া দাড়াইল।

 কিন্তু ততক্ষণে ঝড় আসিয়া পড়িয়াছে—তেমন ঝড় তারা বহুকাল দেখে নাই। বালুকণাপূর্ণ ধূলায় ধূলায় তাহাদের চোখ-কাণ ভরিয়া গেল, হাওয়ার দাপটে তাহাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হইয়া আসিল! মুক্ত প্রান্তরে ঝড়ের মুখে পড়িলে অবস্থা যে কিরূপ ভয়ানক হইয়া উঠে, তাহা যিনি জানেন না, তিনি বুঝিবেনও না। চারিদিকে কি অন্ধকার! আর সেই আঁধারের ভিতর হইতে রাশি রাশি কাঠকুটা আসিয়া তাহাদের গায়ে তীক্ষ্ণ সূচের মত বিধিতে লাগিল।

 সুখেন্দু চীৎকার করিয়া ডাকিল, “সরযু!”

 কিন্তু তাহার চীৎকার ঝড়ের চীৎকারে মিশিয়া গেল, সরযূ শুনিতে পাইল না।

 সুখেন্দু অন্ধের মত হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া সরযূর একখানা হাত চাপিয়া ধরিল—বিদ্যুৎ-বিভায় কোনক্রমে পথ দেখিয়া দেখিয়া এবং কতবার পড়িতে পড়িতে বাঁচিয়া অনেক কষ্টে অগ্রসর হইয়া তাহারা একটি আশ্রয় পাইল। সেখানে একটি অতিক্ষুদ্র পাহাড় বা পাষাণীভূতা ভূমি ঝটিকার ভিতরে অটলভাবে দাঁড়াইয়া আছে। সুখেন্দু ও সরযূ তাহার নীচে গিয়া দাঁড়াইল। পাহাড়ের শীর্ষভাগটা সামনের দিকে বেঁকিয়া অনেকটা ঝুঁকিয়া পড়াতে, তাহাদের মাথার উপরে বেশ একট। আচ্ছাদানের মত হইল।

 তাহারই তলায় শ্রান্তভাবে বসিয়া বসিয়া তাহারা দুজনে হাঁফাইতে লাগিল।

 যে যায়গাটায় তাহারা আসিয়াছিল, সে যায়গাটাও অন্যস্থান হইতে অনেকটা উন্নত। সেইখান হইতে তাহারা নীরবে—বিস্মিত নেত্রে দেখিতে লাগিল, অবিরত বিদ্যুৎ-বিকাশে সুমুখের বিশাল প্রান্তর, বুকের উপরে কল্লোলিনী তটিনীর শুভ্র-রেখা এবং টলটল বৃক্ষমালার রুদ্র নটনলীলা লইয়া রহিয়া রহিয়া মায়া-দৃশ্যের মত উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছে! ক্ষুব্ধ ঝটিকা তখনও একটা বিশ্বব্যাপী হাহাকারের মত ফাটিয়া ফাটিয়া মরিতেছিল এবং তাহারই মূর্ত্তিমান্ গতির মত দূরে একখানা ‘মেলট্রেণ’ আপনার অগ্নিময় রক্তচক্ষু মেলিয়া কোনদিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র না করিয়া, কাম্মুর্কমুক্ত শরবৎ হু-হু-বেগে ছুটিয়া চলিয়া গেল।

 সুখেন্দু কহিল, “এখন বাড়ী যাওয়ার কি হবে?”

 সরযূ কহিল, “তিনি কি ভাবচেন, জানিনা!”

 এই আকস্মিক প্রাকৃতিক বিপ্লবে, তাহারা আপনাদের মানসিক বিপ্লব ভুলিয়া গিয়াছিল; এখন সুখেন্দুর মনে আবার সেই কথার উদয় হইল। সরযূর সেই রুক্ষ ও কঠিন ভাষা এবং ক্ষণপরেই তাহার সেই কাতর ক্ষমাপ্রার্থনা, এ সকলই তাহার মনে পড়িল। এখন অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া সে বেশ বুঝিতে পারিল যে, এই অসহায়া রমণীর প্রাণের ভিতরে কিরূপ বিপরীত দুই ভাবের ধারা পাশাপাশি বহিয়া যাইতেছে! একদিক্ হইতে তাহার বিবেক-বুদ্ধি উপায়ান্তর অভাবে তাহাকে যেমন কঠিন ও সাবধান করিয়া তুলিতেছে,— অন্যদিকে তেমনই তাহার হৃদয়ের দুর্ব্বল ও কোমল বৃত্তিগুলি তাহাকে অভিভূত করিয়া, তাহার মাথা নত করিয়া দিতে চাহিতেছে। সে সাধারণ স্ত্রীলোক নয় বলিয়াই, যেমনভাবে সমুদ্র-তরঙ্গের রুদ্র নৃত্য-রঙ্গের মুখে অচল শৈল সমান দাঁড়াইয়া থাকে, তেমন ভাবেই এখনও বৃত্তির এই প্রভুত্বকে অবহেলা করিয়া নিজে শক্ত হইয়া আছে। শক্ত না হইলেত’ তার আর কোন উপায় নাই! সুখেন্দু আপন মনে যতই এই কথাগুলি আলোচনা করিতে লাগিল, পাশের সেই স্বল্পভাষিণী সঙ্গিনীটির উদ্দেশে তাহার প্রাণমন ততই ভক্তি ও সম্মানে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতে লাগিল।

 অকস্মাৎ অতি নিকটেই একটি বৃক্ষ-চূড়া বজ্রের ভৈরব হৃদয়-স্তম্ভন হুঙ্কারের সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল— এবং সেই তীব্র শিখার অসহ উত্তাপ যেন সরযূর সর্ব্বাঙ্গ দগ্ধ করিয়া দিয়া গেল; ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে অস্ফুট আর্ত্তনাদের সহিত সরযূ দুই চক্ষু মুদিয়া দুইহাতে প্রাণপণে সুখেন্দুর বাহুমূল আকড়িয়া ধরিল এবং তাহার মস্তক, সুখেন্দুর স্কন্ধের উপরে বলহীন হইয়া লুটাইয়া পড়িল।

 বজ্রপাতে সুখেন্দুর প্রাণও অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু যখন বুঝিতে পারিল যে, সরযূ ভয় পাইয়াছে, তখন নিজের কথা সে ভুলিয়া গেল। তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করিল, “সরযু, ভয় কর্‌চে?”

 কিন্তু সরযূ কোন কথা কহিতে পারিল না। বজ্ররোলে তাহার সর্ব্বশরীরে কেমন একটা মূঢ়তা আসিয়াছিল। সুখেন্দুর কণ্ঠস্বরে সে আরও জোরে তাহার বাহু চাপিয়া ধরিল। সেই গভীর আত্মসমর্পণের ভারে সুখেন্দুর মন কেমন একটা অজ্ঞাত পুলকে ভরিয়া গেল এবং স্কন্ধের উপরে সরযূর এক একটি তপ্তশ্বাস অনুভব করিয়া তাহার মনে হইল, যেন জীবনের উপর দিয়া বসন্তের এক একটি উত্তপ্ত সমীরোচ্ছ্বাস বহিয়া যাইতেছে!

 তখন ঝড় অনেকটা থামিয়া আসিয়াছে এবং বৃষ্টি পড়িতে সুরু হইয়াছে।

 সুখেন্দুর স্মরণ হইল, ছেলেবেলায় সে ও সরযূ যখন এক বিছানায় দুজনে শুইয়া থাকিত, তখন এমনি দুর্য্যোগময়ী রজনীতে, বজ্রনিনাদে সরযূ এমনি করিয়াই চমকিয়া সভয়ে তাহাকে জড়াইয়া ধরিত।

 সুখেন্দু ধীরে ধীরে বলিল “সরযূ, আবার কি আমাদের ছেলেবেলা ফিরে এসেচে?”

 সরযূ নীরব। কিন্তু সুখেন্দু বুঝিতে পারিল, তাহার দেহ তখন থর্ থর্ করিয়া কাঁপিতেছে! বাতাসে সরযূর মাথার ‘এলমেল’ চুলগুলি সুখেন্দুর কণ্ঠে ও গণ্ডে উড়িয়া আসিয়া পড়িতে লাগিল।

 সুখেন্দু অস্ফুটকণ্ঠে বলিল, “বাল্যের স্মৃতি কি মধুর!”

 সরযূ এবারও কথা কহিল না! হঠাৎ সুখেন্দুর কণ্ঠে একফোঁটা জল পড়িল। প্রথমে সে ভাবিল, তাহা বৃষ্টির জল। কিন্তু তারা যেখানে বসিয়াছিল, সেখানেত’ বৃষ্টি পড়িতেছিল না! আর বৃষ্টির জল কি এত উষ্ণ? আবার, আর এক বিন্দু!

 সুখেন্দু সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিল, “সরযূ! তুমি কাঁদ্‌চ!”

 সরযূ এবার আস্তে আস্তে মাথা তুলিল। সুখেন্দুর বাহু ছাড়িয়া দিয়া কাতর, মৃদুস্বরে বলিল, “ভাই, আমাকে দয়া কর!”

 সুখেন্দু আরও বিস্মিত হইয়া কহিল, “কি বল্‌চ, সরযূ?”

 সরযূ তেমনি সকাতরে বলিল, “আমাকে দয়া কর ভাই, আমাকে দয়া কর! আমার সংসার উচ্ছন্ন হয়ে যাবে, তুমি দয়া না কর্‌লে আমি মর্‌ব।”

 এইবার সুখেন্দু বুঝিল। তাহার মাথা বুকের উপরে ঝুঁকিয়া পড়িল।

 সরযুও অনেকক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল। বাহির হইতে তখন মাঝে মাঝে দম্কা বাতাস জলের ছাট্ মাখিয়া ভিতরে আসিয়া ঢুকিতেছিল।

 সরযূ হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “আমার অবস্থা একবার ভেবে দেখ। আমি তোমাকে ইচ্ছে করে অবহেলা করি নি, আমি তোমাকে আগে ভালবাস্‌তুম—এখন ভয় করি। তোমার কোন দোষ নেই, তুমি বিদ্বান, তুমি চরিত্রবান্! কিন্তু আমার মনকে ত’ বিশ্বাস করা যায় না সুখেন্দু! আমি সামান্য স্ত্রীলোক, অন্যের পত্নী—আমি যদি সাবধান না হই ভাই, তাহলে ঈশ্বরের কাছে কি বলে জবাব দেব? তাই জোর ক’রে আমি তোমার ওপরে কঠোর হয়েচি! কিন্তু, তুমি আমার সাম্‌নে থাকলে আমি সমস্তকথা ভুলে যাই, আমি আপনাকে আর সাম্‌লে রাখতে পারি না! এই দেখ, একটু আগে আমার যে অবস্থা হয়েছিল, আমি যে-রকম নির্লজ্জের মত তোমার কাঁধে মাথা রেখে পড়েছিলুম,—তাতে—তাতে—” বলিতে বলিতে সরযূ আর কথা শেষ করিতে পারিল না—উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিল—তাহার পর সেই অন্ধকারে দুই হাতে হঠাৎ সুখেন্দুর পা চাপিয়া ধরিয়া তেমনি কাঁদিতে কাঁদিতে অনুতপ্ত কণ্ঠে কহিল, “আমাকে দয়া কর—ওগো, আমাকে দয়া কর!”

 সুখেন্দু পা সরাইয়া লইতে পারিল না—কাঠ হইয়া স্তব্ধভাবে বসিয়া রহিল! তাহার দুই পদ সরযূর অশ্রুপাতে সিক্ত হইয়া গেল। তাহার মনে হইতে লাগিল, সেই অশ্রুর প্রতি বিন্দু যেন দ্রবীভূত অগ্নিপিণ্ডের একএকটি জ্বলন্ত ফোঁটা!

 সহসা দূরে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনা গেল—যেন কাহারা গোলমাল করিতে করিতে আসিতেছে! `চমকিত হইয়া সুখেন্দু সেইদিকে প্রেতভয়গ্রস্তের মত চাহিয়া দেখিল—তাইত! গাছের পাতার ফাঁক দিয়া অনেক গুলা জ্বলন্ত আলো দেখা যাইতেছে!

 আলো ক্রমে নিকটে আসিল। পরিচিত কণ্ঠে একজন চীৎকার করিয়া ডাকিল, “সুখেন্দুবাবু! সুখেন্দুবাবু! সুখেন্দুবাবু!”

 সুখেন্দু একলাফে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, “সরযূ, প্রকৃতিস্থ হও! তোমার স্বামী আমাদের খোঁজে বেরিয়েচেন। চোখের জল মোছ, — তিনি যেন কিছু দেখতে না পান! আর—আর, তোমার কথার উত্তর কাল পাবে! জেন, আমি পাপিষ্ঠ নই।”

 বরেন্দ্রবাবু আবার ডাকিলেন। এবার সুখেন্দু বাহিরে আসিয়া সাড়া দিল।

 বরেন্দ্রনাথের রাত জাগিয়া পড়ার বাতিক ছিল। নহিলে তাঁহার ঘুম হইত না।

 ঝড়ের রাতে ফিরিয়া আসিয়া সরযূ বিছানায় গিয়া শুইয়া পড়িয়াছে, বরেন্দ্রনাথ প্রত্যহ যেমন বই পড়িয়া থাকেন, সেদিনও তেমনি টেবিলের ধারে বসিয়া অনেক রাত পর্যন্ত একখানা ইংরাজী নভেল পাঠ করিলেন। ঘড়িতে টং করিয়া একটা বাজিল, তিনিও বই মুড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

 তিনি শয়ন করিবার আগেই সরযূ প্রতিদিন ঘুমাইয়া পড়িত। কিন্তু সেদিন খাটের কাছে আসিয়া তিনি দেখিলেন, সরযু তখনও ঘুমায় নাই— কড়িকাঠের দিকে চাহিয়া বিছানার উপরে আড়ষ্ট হইয়া পড়িয়া আছে।

 বরেন্দ্রনাথ সবিস্ময়ে কহিলেন, “একি’ আশ্চয্যি ব্যাপার—অ্যাঁ! বিছানা ছুঁতে না ছুঁতে যে মানুষ ঘুমিয়ে কাদা—তাঁর চোখে আজ ঘুম নেই, এও কি সম্ভব?”

 সরযূ ম্লানভাবে বরেন্দ্রনাথের দিকে চাহিল। তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বরেন্দ্রনাথ চমকিয়া উঠিলেন। “তোমার মাথার অসুখটা বুঝি বেড়েচে? তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করিলেন, ওষুধ দেব?”

 “না!”

 সরযূর কণ্ঠস্বর শুনিয়া বরেন্দ্রনাথের উদ্বেগ বাড়িল বৈ কমিল না। বলিলেন, “তোমার গলা এমন ধরা-ধরা কেন? জলে ভিজে ঠাণ্ডা লেগেচে বুঝি? কি মুস্কিল! জ্বর-টর্ হয়নি ত? দেখি, হাত দেখি!”

 সরযূ বলিল, “আমার কিচ্ছু হয়নি।”

 কিন্তু বরেন্দ্রনাথ সে কথা শুনিলেন না, একান্ত অবিশ্বাসের সহিত ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, “ওকথা বাজে কথা—একটা কিছু হয়েচে!”

 সরযূ সহসা উঠিয়া বসিয়া তাঁহার বুকে ঝাঁপাইয়া পড়িল এবং দুইহাত দিয়া তাঁহার গলা জড়াইয়া ধরিল।

 সরযূর ব্যবহারে বরেন্দ্রনাথ আজ বিব্রত হইয়া পড়িলেন। সে ত’ এমনধারা কখন করে না! তিনি সরযূর মাথায় সপ্রেমে হাত বুলাইয়া দিতে দিতে বলিলেন, “সরযূ, তোমার কি হয়েচে আমাকে বলবে না?”

 সরযূ কোন উত্তর দিল না। হঠাৎ বরেন্দ্রনাথের মনে হইল, তাঁহার বুকের ভিতরে মুখ লুকাইয়া সরযূ ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতেছে। তাড়াতাড়ি তিনি দুইহাতে তাহার মুখখানি তুলিয়া ধরিলেন! সত্যই ত’! সরযূর চোখে জল!

 বরেন্দ্রনাথ একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। দুইহাতে তেমনি করিয়া সরযূর মুখখানি ধরিয়া থাকিয়া তিনি আড়ষ্টভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। সরযূকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসিতেন। বিবাহ হইয়া অবধি তাহার চোখে তিনি কখনও জল দেখেন নাই। আজ এই প্রথম সরযূকে কাঁদিতে দেখিয়া তাঁহারও মুখ কাঁদ-কাঁদ হইয়া আসিল!

 অনেক কষ্টে আত্মসংবরণ করিয়া তিনি বলিলেন, “তোমাকে কি কেউ কিছু বলেচে?”

 “না।”

 “তবে?”

 “বল্‌ব?”

 “বল—বল! তোমার এমন কি হয়েচে যে, তুমি একেবারে কেঁদে ফেল্লে?”

 “বল্‌চি। বল্‌ব বলেই এতক্ষণ জেগে আছি। তোমাকে সব না খুলে বল্‌তে পার্‌লে প্রাণে আমার শান্তি হবে না। কিন্তু বলি-বলি করে আর বল্‌তে পার্‌চি না, বড় ভয় কর্‌চে!”

 “ভয়? আমাকে ভয়? বলকি সরযূ?”

 “হ্যাঁ। পাছে শুনে তুমি আমাকে কি মনে কর, আমাকে পায়ে ঠেল।”

 বরেন্দ্রনাথ অতি করুণভাবে মাথা নাড়িতে লাগিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া যে সরযূর ভয় হইতে পারে, এ কথাটা তিনি যতই ভাবেন, ততই আশ্চর্য্য হইয়া যাইতে লাগিলেন।

 সরযূ ভয়ে-ভয়ে স্বামীর একখানা হাত ধরিয়া বলিল, “বল, আমাকে বক্‌বে না?”

 “ও সব বকা-টকা আমার কুষ্টিতে লেখে না। যা বল্‌তে চাও বল, না বল্‌তে চাও বোলো না। ব্যাস্—ফুরিয়া গেল। এর ভেতরে আবার কিন্তু কি?”—বলিয়া, বরেন্দ্রনাথ অর্দ্ধস্বগতভাবে আবার অস্ফুট স্বরে কহিলেন, “অ্যাঁ! স্বামীর কাছে ভয়— অ্যাঁ! এযে অবাক্ কাণ্ড!”

 সরযূ তখন বুক বাঁধিয়া স্বামীর দৃষ্টিতে আপনার দৃষ্টি মিলাইয়া তাঁহার সামনে সোজা হইয়া বসিল। তারপর পরিষ্কার, সতেজ কণ্ঠে, এখানে সুখেন্দুর আগমন হইতে আরম্ভ করিয়া অদ্যকার ঘটনা পর্য্যন্ত সমস্ত বলিয়া গেল,—একটা সামান্য কথা ভুলিয়া গেল না, লজ্জাবশত কিছু রাখিয়া-ঢাকিয়া বলিল না।

 এই কথাগুলা বলিবার জন্য তাহার প্রাণ বুকের ভিতরে ব্যাকুল ও উন্মুখ হইরা ছিল—কে-যেন তার কাণে কাণে ক্রমাগত বলিতেছিল, ‘তোমার মন চঞ্চল হইয়াছে, তুমি স্বামীর সঙ্গে লুকাচুরি করিতেছ, তুমি অবিশ্বাসিনী!’ তাই যতক্ষণ সমস্ত ঘটনা, সমস্ত হৃদয়-বিপ্লব, আপনার সমস্ত চাঞ্চল্য ও গুপ্তকথা স্বামীর কাছে প্রকাশ করিয়া বলিয়া তাঁহার ক্ষমাভিক্ষা না চাহিবে, ততক্ষণ যে তাহার অশান্ত প্রাণ শান্ত হইবে না, এটা সে স্থির বুঝিয়াছিল।

 তাহার কথা শুনিতে শুনিতে বরেন্দ্রনাথ একবার মাথা চুল্‌কাইতে সুরু করেন, একবার কাঁচুমাচু মুখ করিয়া কড়িকাঠ বা দেওয়াল বা মেঝের দিকে চাহিয়া থাকেন, তাঁহার ভাবখানা দেখিলে মনে হয়,—সরযূর এই গোপনীয় আত্মকাহিনী শোনা,—তিনি যেন অত্যন্ত অন্যায় বলিয়া বোধ করিতেছেন।

 সরযূ তাহার কথা শেষ করিল। বরেন্দ্রনাথ স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।

 সরযূ কাতরভাবে বলিল, “বল, আমার সব দোষ মাপ কর্‌লে?”

 বরেন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে সরযূর দুই স্কন্ধের উপরে আপনার দুই হাত রাখিলেন। তাহার পর পূর্ণদৃষ্টিতে তাহার সজল চোখের দিকে চাহিয়া স্থিরস্বরে কহিলেন, “সরযূ! কোন স্ত্রীলোক যদি এমনভাবে আপনার দুর্ব্বলতাকে দমন করতে পারে, তাহলে তাকে দোষী মনে করা উচিত, না তার প্রশংসা করা উচিত, এ কথাটা তুমিই বল!”

 সরযূ মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল—তাহার বুকের উপর হইতে যেন একটা মস্ত বোঝা নামিয়া গেল।

 পরদিন ভোরবেলা বরেন্দ্রনাথ শুনিলেন, সুখেন্দুবাবু আজ কলিকাতায় ফিরিবেন।

 তিনি তখনই সুখেন্দুর কাছে ছুটিয়া গেলেন। বলিলেন, “হাঁ সুখেন্দু বাবু, আপনি নাকি কল্‌কাতায় পালাতে চান?”

 সুখেন্দু বলিল, “পালাতে চাইনা, যেতে চাই।”

 “উহু—সেটি হবে না! আমরা ছেড়ে দিলে তবে ত যাবেন? আমি আপনার হাত ধরে থাক্‌বো, আর লতাকে শিখিয়ে দেব—সে আপনার গোঁফ ধরে থাক্‌বে, দেখি, কেমন করে যান আপনি!”

 সুখেন্দু ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, “আমাকে মাপ কর্ব্বেন বরেন্দ্রবাবু! আমি আর কোনমতেই থাক্‌তে পার্ব্ব না। আপনি হাত ধরলেও না, লতা গোঁফ ধর্‌লেও না! ভাববেন না, আপনার এখানে আমার কিছু কষ্ট হয়েচে বলে আমি চলে যাচ্ছি! সত্যিকথা বল্‌চি, আপনাদের কাছে রাজার হালে ছিলুম। কিন্তু না গেলে নয়, তাই যেতে হলো।”

 সুখেন্দু এমন দৃঢ়স্বরে কথাগুলি বলিল যে, বরেন্দ্রনাথ নেহাৎ হতাশ হইয়। ঘাড়নাড়া ভিন্ন আর কি করিবেন, খুঁজিয়া পাইলেন না। বরেন্দ্রনাথ যখন চলিয়া গেলেন, সুখেন্দু শুনিল, তিনি চিন্তিতভাবে আপনা-আপনি বলিতে বলিতে যাইতেছেন, “বটে, বটে, বটে! এরা সব দেবতা!”

 বরেন্দ্রনাথের এ কথাগুলির মানে কি? সুখেন্দু অনেকক্ষণ ভাবিল, কিছুই ঠিক করিয়া উঠিতে পারিল না।

* * * * *

 সেদিন সুখেন্দু লক্ষ্য করিল, সরযূর দৃষ্টি একটু লজ্জিত বটে, কিন্তু তাহার ভাব-ভঙ্গীতে আগেকার মত সঙ্কোচ বা জড়সড় ভাব আর নাই। সুখেন্দু ভাবিল, সে বিদায় হইতেছে, সেই আনন্দে সরযূর সঙ্কোচও দূর হইয়াছে। মনে-মনে সে একটু দুঃখিত ও মর্ম্মাহত হইল।

 কিন্তু, সুখেন্দু ভুল বুঝিয়াছে। সরযূর যত সঙ্কোচ, যত ভয় কাল রাত্রিতেই দূর হইয়াছে। পতির সুমুখে যখন সে মনের দরজা খুলিয়া দিতে পারিয়াছে, তখন হইতেই সে আবার একজন নূতন মানুষ।

 যাইবার সময়ে সে বাংলোর সামনের বাগানে সরযূকে দেখিতে পাইল। সরযূ তখন গোলাপের গাছ হইতে ফুল তুলিতেছিল।

 সুখেন্দু বলিল, “তোমার পথ থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় হলাম সরযূ! তুমি সুখে থাক—আর আমি আস্‌ব না। কাল তোমার কথার উত্তর দেব বলেছিলাম, এই আমার উত্তর।”

 সকলের চেয়ে বড় গোলাপটি সরযূ এইমাত্র তুলিয়াছিল। সুখেন্দুর কথা শুনিবামাত্র তাহার হাত হইতে খসিয়া, ফুলটি নীচের নরম ঘাসের উপরে পড়িয়া গেল। সে কি বলিতে গেল, পারিল না। অত্যন্ত বিবর্ণ, মুখে শূন্যদৃষ্টিতে সে মেঘের মত ধূসর সুদূর শৈলের দিকে তাকাইয়া রহিল।

 সুখেন্দু চলিয়া গেল। বহুদূর গিয়া আর একবার সে পিছন ফিরিয়া চাহিল। দেখিল, সরযূ ঠিক তেমনি করিয়াই পাহাড়ের দিকে তাকাইয়। নিশ্চল প্রতিমার মত সেইখানে দাঁড়াইয়া আছে। তারপরে পথের বাঁক্ আসিয়া সে দৃশ্যের উপরে চিরদিনের জন্য যবনিকা টানিয়া দিল।

 অনেকক্ষণ পরে সরযূ প্রকৃতিস্থ হইল। যে বড় ফুলটি তাহার হাত হইতে পড়িয়া গিয়াছিল, সেটিকে ফের্ কুড়াইয়া লইবার জন্য সে নীচের দিকে চাহিল; কিন্তু ফুল নাই।

 সরযূ অনেক খুঁজিল, পাইল না!