কপোতী

 আলিসার তলায়, একটি কুলুঙ্গীর ভিতরে দুটি পায়রা বাসা বাঁধিয়াছিল। তারা কোথা হইতে আসিয়াছিল,—তা জানি না। আমরা যাহাদিগকে ‘গোলা পায়রা’ বলি, এ দুটি সেই জাতের। তাদের গায়ের রং নিকষের মত, গলার রং রামধনুর মত, পায়ের রং লাল দোপাটি ফুলের মত!

 তাহাদের ঠিক সাম্‌নে আমার পড়িবার ঘর। যখন বই পড়িতাম, তখন তাহাদের মৃদুগুঞ্জন কাণে আসিয়া বাজিত। বই হইতে মুখ তুলিলেই দেখিতাম, তাহারা দুটিতে পাশাপাশি বসিয়া আছে।

 আমি তাদের ভালবাসিতাম;— তারাও আমাকে ভালবাসিত। তাদের জন্য রোজ আমি একটি চুব্‌ড়ী ভরিয়া খাবার রাখিতাম। মাঝে মাঝে খাবারগুলি ছড়াইয়া দিতাম; আর তারা উড়িয়া আসিয়া আমার সামনে বসিয়া থাবারগুলি খুঁটিয়া-খুঁটিয়া খাইত। একদিন খাবার দিতে ভুলিয়া গিয়াছি। দরজা ভেজাইয়া দিয়া ঘরের ভিতরে বসিয়া আছি,— হঠাৎ বাহির হইতে দরজার উপরে আঘাত হইতে লাগিল— অতি মৃদু-মৃদু আঘাত। দরজা খুলিয়া দেখি,— আমার পায়রা! আমাকে দেখিয়াই তাদের একটি মাথা নাড়িয়া ঘুরিতে ঘুরিতে ‘বক্-বক্-বকম্’ করিয়া আমাকে বকিতে সুরু করিয়া দিল এবং অন্যটি ঘাড় কাঁপাইতে কাঁপাইতে আমার দিকে চাহিয়া রহিল। তাহারা যেন বলিতে চায়, “বেড়ে লোক ত’ হে! আমরা এখানে না খেয়ে উপোস ক’রে মর্‌ছি, আর তুমি কিনা দিব্যি নিশ্চিন্ত হ’য়ে ব’সে আছ! বেশ মানুষ যা হোক!”

 সেইদিন হইতে আমি তাদের ঠিক নিয়মমত খাবার দিতাম।

 তারা কিন্তু আমার চেয়ে আমার স্ত্রীকে বেশী ভালবাসিত। বিকালে, হাতে যখন কোন কাজ থাকিত না— তাদের সঙ্গে আমার স্ত্রী খেলা করিত। সে হাততালি দিয়া তাহাদিগকে ডাকিত,— করতালির তালে তালে আহত কঙ্কণ-বলয় রিণি-রিণি কাঁদিয়া উঠিত এবং সেইসঙ্গে পায়রা দুটি স্ত্রীর কাঁধে বা বাহুর উপরে আসিয়া বসিত। প্রিয়া আস্তে আস্তে আপনার নরম আঙ্গুলের গোলাপী নখ দিয়া তাদের ছোট ছোট মাথা চুলকাইয়া দিত, তাদের কোমল বুকে, কোমল পিঠে আদরমাথা চুম দিত,, আর সেই পুষ্পপেলব অধরের মায়াস্পর্শে কপোতদুটির অবশ দেহ আরামে এলাইয়া পড়িত,— তাদের রাঙ্গা-রাঙ্গা চোখদুটি আলসে ঢুলিয়া পড়িত।

 জানালায় মুখ বাড়াইয়া আমি বলিতাম, “প্রিয়ে, আমার পাওনা অন্যকে দিও না,—তোমার চুম্বনের মালিক আমি!”

 চকিত গ্রীবা-ভঙ্গীতে আমার দিকে ফিরিয়া সে একটি লজ্জাললিত মধুর কটাক্ষ করিত।

 পায়রাদুটি পরস্পরকে বড় ভালবাসিত। অমন ভালবাসা বুঝি মানুষের ভিতরেও দেখা যায় না। তাদের দিকে চাহিলেই দেখিতাম, তারা দুজনে দুজনকে আদর করিতেছে। কখনও কপোতী, কপোতের রঙ্গিণ বুকে আপনার ছোট মাথাটি বুলাইয়া দেয়; আবার কখনও কপোত সপ্রেমে ঊর্দ্ধমুখী কপোতীর চঞ্চুচুম্বন করে। চঞ্চুচুম্বনের অবকাশে মাঝে মাঝে তারা চতি দৃষ্টিতে মাথা ঘুরাইয়া চারিদিক্‌টা এক-একবার দেখিয়া লইত। তারা যেন ঠিক দুটি নবীন প্রেমিক-প্রেমিকা—অন্যে দেখিতে পাইলে বড় লজ্জা! তাহাদের একটি বাহিরে গেলে অন্যটি ব্যাকুলভাবে পথ চাহিয়া বসিয়া থাকিত।

 এক-একদিন কপোত বাহিরে গেলে, অন্য কোন কপোত আসিয়া হাজির হইত। আসিয়া, সগর্ব্বে পা ফেলিয়া, চক্র দিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া গলা ফুলাইয়া কূজন করিতে করিতে কপোতীকে বুঝাইবার চেষ্টা পাইত যে,—সে চলিতে জানে, নাচিতে জানে, গায়িতে জানে! কপোতী কিছু বলিত না,—আপনার বাসার সামনেটিতে বুকে ভর্ দিয়া বসিয়া বসিয়া, নীরবে ত্রস্ত চোখে আগন্তুকের ‘রকম-সকম’ নিরীক্ষণ করিত।

 কপোতীর দিক্ হইতে সাড়া না পাইয়া আগন্তুক হঠাৎ নাচ বন্ধ করিয়া বাসার ভিতরে গিয়া বসিত। কপোতী ভয় পাইয়া আরও ভিতরে সরিয়া যাইত—আগন্তুককে ঠুক্‌রাইয়া দিত। এমন অভ্যর্থনা যুৎসই নয় ভাবিয়া কোনদিন আগন্তুক আপনিই সরিয়া পড়িত, আবার কোনও দিন-বা আমার স্ত্রী “হতভাগা পায়রা, রোস্ ত” বলিয়া, ছুটিয়া গিয়া তাহাকে তাড়াইয়া দিত।

 যেখানে মেঘ-মেদুর আকাশের কোলে শ্যামলঘন বনভূমির উপরে বিজলীর হীরক-হার দুলিতেছিল, সেইদিকে নিরাশনেত্রে চাহিয়া কপোতী স্তব্ধভাবে বসিয়াছিল।

 আজ তিনদিন হইল কপোত বাহির হইয়া গিয়াছে, আর ফিরে নাই।

 মাঝে মাঝে কপোতী বাহির হইয়া আসিতেছে, একবার এদিকে, একবার ওদিকে উড়িয়া যাইতেছে, কিন্তু কপোতের দেখা নাই। আকাশে আগুন ধরাইয়া হঠাৎ বাজ্‌ ডাকিয়া ওঠে, আর ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে কপোতী বাসায় ফিরিয়া আসে। এমনিভাবে তিনদিন কাটিয়াছে।

 আমি কপোতীকে কতবার ডাকিয়াছি, কতবার থাবার ছড়াইয়া দিয়াছি,—কিন্তু সে আমার কথা কাণে তোলে নাই, খাবারের দিকে ফিরিয়াও চাহে নাই। হয়ত ক্ষুধায় তাহার দেহ জ্বরজ্বর,—কিন্তু শোকে সে ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলিয়াছে।

* * * *

 গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। তখন মাঝে মাঝে দম্‌কা হাওয়া বাহির হইতে দরজা-জানালায় ধাক্কা মারিতেছিল। এবং ঝুপঝাপ করিয়া অঝোরে বৃষ্টি ঝরিতেছিল।

 চাহিয়া দেখি, আমার স্ত্রীও উঠিয়া বসিয়াছে। সে যেন বসিয়া বসিয়া একমনে কি শুনিতেছিল। আমাকে জাগিতে দেখিয়া সে, মৃদু কাতর স্বরে বলিল, “আহা, শোন!”

 “কি, বৃষ্টি পড়্‌ছে—?”

 “না। আর কিছু শুন্‌তে পাচ্ছ না?” .

 আমি কাণ পাতিয়া শুনিতে লাগিলাম। তাইত! বৃষ্টি ও বাতাসের শব্দ মাঝে মাঝে থামিয়া পড়িতেছে, আর সেইসঙ্গে কোন আর্ত্ত কপোতের অতি করুণ, অতি অস্ফুট ক্রন্দন রহিয়া রহিয়া ফুটিয়া উঠিতেছে। বুঝিলাম, বরষা-রাতে, বজ্রের এই কঠোর অট্টহাস্যে, বৃষ্টির এই হিম-শীতল ঝাপটায়, ঝড়ের এই বিষম দাপটে, নীড়ের ভিতরে দোসর-হারা হইয়া বিনিদ্র কপোতী আপন প্রিয়ের বিরহে কাঁদিয়া-কাঁদিয়া মরিতেছে! আজ আর প্রিয়ের প্রেমতপ্ত পক্ষপুট-নাই, আজ আর তাহার ভয়কম্পিত তনুকে ঢাকিয়া রাখিবার কোন আবরণ নাই,—আজ সে একাকী! আহা, বড় একাকী! কেন জানি না, তাহার শোকে আমারও প্রাণের ভিতরে কেমন একটা হাহাকার জাগিয়া উঠিতে লাগিল। আস্তে আস্তে জানালা খুলিয়া দিলাম। অমনি বৃষ্টির সঙ্গে ভিজে ঝোড়ো হাওয়া হু-হু হু-হু করিয়া ঘরের ভিতর ঢুকিয়া পড়িল। কপোতীর বাসার দিকে চাহিলাম। কিছু দেখিতে পাইলাম না—চারিদিকে রজনী আপনার আঁধার-বেণী এলাইয়া দিয়াছে। সে অন্ধকারের ভিতর হইতে ঝড়ের দীর্ঘশ্বাসের সহিত কেবল কপোতীর বুকভাঙ্গা কান্না অস্পষ্টভাবে শুনিতে পাইলাম। আমার মনে হইল, সে কান্না যেন পাখীর নয়— মানুষের!

 ভোরবেলায় উঠিয়া কপোতীকে দেখিতে পাইলাম না। ভাবিলাম, সে কপোতের খোঁজে গিয়াছে। সারাদিন গেল, সাঁঝের আঁধার নামিয়া আসিল,—কিন্তু কপোতী আসিল না। স্ত্রী বলিল, “ওগো, তুমি একখানা মৈ নিয়ে এসে বাসার ভিতরে কিছু থাবার আর জল রেখে দাও না! হয়ত এখনি এসে ধুঁকে পড়্‌বে — আহা, আজ ক’দিন কিছু মুখে দেয়নি, হাজার হোক্ ‘কেষ্টের জীব’ ত!”

 মৈ বহিয়া উপরে উঠিলাম। বাসার কাছে মুখ নিয়া যাইবামাত্র দেখিলাম, কপোতী কোথাও যায় নাই—বাসার ভিতরেই খড়্‌কুটার উপরে দু’ডানা বিছাইয়া, বুকে মুখ গুঁজিয়া নিসাড় হইয়া পড়িয়া আছে। ডাকিলাম,—সে নড়িল না। তার গায়ে হাত দিলাম—মাথাটি একদিকে লুটাইয়া পড়িল। সে মরিয়া গিয়াছে।

 পাখীর শোকে আর কারুর চোখে জল আসে কি না জানি না, আমি কিন্তু না কাঁদিয়া থাকিতে পারিলাম না।