পসরা/যশের মূল্য
যশের মূল্য
ক
‘আর্ট স্কুলে’র প্রধান শিক্ষক মনোমোহনবাবুর বাড়ীতে বসিয়া, কয়েকজন ছাত্র গল্পগুজব করিতেছিল। এমন সময়ে যোগেশবাবু আসিয়া ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিলেন।
যোগেশবাবুও চিত্রশিল্পী। তবে, তিনি ছাত্রাবস্থা পার হইয়াছিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া, একজন বলিয়া উঠিল, “শুন্চেন যোগেশবাবু! রণেন্দ্র কি বলে জানেন?”
যোগেশবাবু একথানা চেয়ারের উপরে বসিয়া পড়িয়া, প্রথমে একটি সুদীর্ঘ “আঃ” উচ্চারণ করিলেন। তাহার পর কহিলেন, “কি বলে হে?”
“রণেন্দ্র বলে, বাঙ্গলা দেশে তার সমান চিত্রকর এখন আর দ্বিতীয় নেই!”
“বটে! ডেপো ছোক্রা কোথাকার! আর আমরা বুঝি এতকাল বসে বসে স্রেফ ঘাস কাট্চি?” একটা বিরক্তিব্যঞ্জক মুখের ভাব করিয়া, যোগেশবাবু একচোখ বুঁজিলেন! যখন-তখন এমনি একচোখ-বোঁজা তাঁহার একটা মুদ্রাদোষ ছিল।
যে ছাত্রটি কথা কহিতেছিল, সে বলিল, “সুধু তাই নয়, রণেন্দ্র আপনাকেও সুনজরে দ্যাখে না।”
যোগেশবাবু অবহেলাভরে বলিলেন, “ক্যান,—অপরাধ?”
“সে বলে আপনি আদর্শের জন্যে ছবি আঁকেন না।”
“তবে কিসের জন্যে আঁকি, শুনি!”
“পয়সার জন্যে!”
যোগেশবাবু একচোখ মুদিয়া কহিলেন, “নন্সেন্স!” তারপর অত্যন্ত চটিয়া কাণের পাশে এলমেল চুলগুলা সরাইয়া দিয়া অনেকক্ষণ গুম্ হইয়া বসিয়া রহিলেন। চিত্রকর র্যাফেলের লম্বা চুল ছিল বলিয়া তিনিও মাথায় বড় বড় চুল রাখিয়াছিলেন। সেই দীর্ঘকেশ তাঁহার মুখে আদোপেই মানাইত না;—কারণ, বাল্যকালে একবার বসন্তরোগে আক্রান্ত হইয়া তিনি প্রাণে বাঁচিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহার মুখের রূপ একেবারে অপরূপ হইয়া গিয়াছিল। একে ত’ রংটি তাঁর ‘ব্লুব্যাক্’-নিন্দিত, তাহার উপরে মুখময় বসন্তের দাগ থাকাতে মনে হইত, কে-যেন তাঁহার মুখে বন্দুকের একরাশ ছর্রা ছুঁড়িয়া মারিয়াছে!
ঘরের ভিতরে যে ছাত্রগুলি ছিল, তাহারা ক্রুদ্ধ যোগেশবাবুর ঘন ঘন চোখ বোঁজা দেখিয়া পরমকৌতুকভরে তাঁহার অগোচরে মুখ টিপিয়া টিপিয়া হাসিতে লাগিল।
হঠাৎ সে হাসি যোগেশবাবুর চোখে পড়িয়া গেল। ক্ষাপ্পা হইয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন, “তোমরা হাস্চ বড় যে? মজা পেয়েচ—না?”
একজন কৃত্রিম বিনয়ের সহিত তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “আজ্ঞে না—সেকি কথা, সেকি কথা! আপনি চটে গেলে আমরা কি হাস্তে পারি? তাও কি সম্ভব?”
“হু, হু—বুঝেচি বুঝেচি! আর চালাকি কর্তে হবে না—ঢের হয়েচে, থাম! তোমরা কি তবে বল্তে চাও হে বাপু, এতক্ষণ তোমরা দন্তবিকাশ করে কাঁদ্ছিলে? আমি ন্যাঁকা—না?” বলিয়াই যোগেশবাবু একচোখ মুদিলেন ৷
ছাত্রটি কোনরকমে প্রবল হাস্যবেগ দমন করিয়া বলিল, “আজ্ঞে না—কাঁদ্ব ক্যান—হাস্ছিলুম। রণেন্দ্রছোঁড়ার পাগ্লামীর কথা মনে করে হাস্ছিলুম। ঐযে—মাষ্টার মশাইএর সঙ্গে রণেন্দ্র আস্চে।”
মনোমোহনবাবুর সহিত রণেন্দ্র ঘরের ভিতর আসিয়া ঢুকিল।
যোগেশবাবু একবার বক্র কটাক্ষে রণেন্দ্রের দিকে চাহিয়া মনোমোহনবাবুকে বলিলেন, “শুন্চেন মশাই, রণেন্দ্র আমাকে কি বলে?”
মনোমোহনবাবু জানিতেন, এই দুটি লোকের ভিতরে বরাবর একটা না-একটা গোলমাল লাগিয়াই থাকে। লৌহ ও প্রস্তরবিশেষের মত এরা একসঙ্গে মিলিলেই অগ্ন্যুৎপাত অনিবার্য্য। তিনি বুঝিলেন, আজ আবার একটা নূতন-কিছু ঘটিয়াছে। মৃদু-মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “রণেন্দ্র কি বলে যোগেশবাবু?”
“রণেন্দ্র বলে আমি পয়সার জন্যে ছবি আঁকি, আমার কোন আদর্শ নেই!”
মনোমোহনবাবু বলিলেন, “হ্যা রণেন্দ্র?”
রণেন্দ্র এতক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। এখন একটু আগাইয়া আসিয়া বলিল, “হ্যাঁ বলেচি—আমার ঐ মত।”
যোগেশবাবু মুখ খিচাইয়া হাত নাড়িয়া বলিলেন, “ভারি মত দেনেওয়ালা যে! মরে যাই আর কি! সেদিনকার ছেলে তুমি— এরি মধ্যে মুখে এত লম্বা লম্বা কথা—অ্যাঁ?”
মনোমোহনবাবু বলিলেন, “যেতে দিন যোগেশবাবু, যেতে দিন! রণেন্দ্র ছেলেমানুষ—আর কথাটাও অতি তুচ্ছ, এ নিয়ে আর বকাবকি করে কাজ নেই!”
যোগেশবাবু একটুও শান্ত না হইয়া বলিলেন, “ছেলেমানুষ! রণেন্দ্র ছেলেমানুষ! মুখে যার অত বড় গোঁফ—সে যদি ছেলেমানুষ হয়, বুড়ো বলে কাকে মনোমোহনবাবু?”
একটি ছাত্র বলিল, “আজ্ঞে, একটু আগে আপনি নিজেইত’ ওকে ছেলেমানুষ বল্লেন!”
যোগেশবাবু চটিয়া লাল হইয়া কহিলেন, “কখন বল্লুম?”
“এই—একটু আগে!”
“ভুল—ভুল শুনেচ! অতবড় যার গোঁফ, আমি তাকে ছেলেমানুষ বল্ব? অসম্ভব! তোমরা কি বল্তে চাও হে বাপু, আমি চোখের মাথা একেবারে খেয়েচি?”
ছাত্রেরা সমস্বরে বলিয়া উঠিল, “আজ্ঞে না, আমরা এ কথা কখনই বল্তে চাই না।”
মনোমোহনবাবু কোনরকমে হাসি চাপিয়া বলিলেন, “চুপ—চুপ! গোলমাল করো না।”
যোগেশবাবু বলিলেন, “হ্যাঁহে রণেন্দ্র, তোমার মতে তুমিই নাকি বাঙ্গলার সব্-সে-সেরা চিত্রকর?”
রণেন্দ্র কহিল, “আমার যে এই মত কোত্থেকে জানলেন আপনি?”
“তোমার বন্ধুরাই বল্ছিল!”
“না—এ আমার কথা না! তবে এ কথা বলেচি বটে যে, বাঙ্গলা দেশে আমার মত প্রাণ দিয়ে আর কেউ ছবি আঁকে না।”
“প্রমাণ?”
রণেন্দ্র উত্তেজিত স্বরে বলিল, “প্রমাণ? প্রমাণ আবার কি? আমার এই বিশ্বাস।”
“তোমার বিশ্বাস ভাল নয় হে বাপু!”
বেশী কথা-কওয়া রণেন্দ্রের স্বভাব নয়, সে আর কোন উত্তর দিল না।
মনোমোহনবাবু এই অপ্রীতিকর চর্চ্চা ছাড়িয়া অন্য কথা তুলিয়া বলিলেন, “রণেন্দ্র, এবারকার প্রদর্শনীর জন্যে তুমি ছবি আঁক্বে ত’?”
রণেন্দ্র বলিল, “আজ্ঞে আঁক্ব বৈকি।”
“দেখ্ব তোমার ছবি কেমন হয়!”
রণেন্দ্র ভক্তিভরে শিক্ষকের পায়ের ধূলা লইয়া বলিল, “আপনি যার গুরু—তার ভাবনা কি তুমি দেখ্বেন, আমার ছবি সকলের চেয়ে ভাল হবে!”
যোগেশবাবু বলিলেন, “এ যে রাম না হতে রামায়ণ দেখ্চি! আগে ছবি আঁক, তারপরে জাঁক করো।”
রণেন্দ্র একবার মুখ ফিরাইয়া। যোগেশবাবুর দিকে চাহিল—কোন কথা কহিল না। এই নীরব অবহেলা, বাক্য অপেক্ষা যোগেশবাবুকে বেশীরকম আঘাত দিল।
মনোমোহনবাবু বলিলেন, “যোগেশবাবু, আপনি যাই বলুন, আত্মশক্তিতে রণেন্দ্রের যেমন বিশ্বাস, তেমন বড় একটা দেখা যায় না। আমি নিশ্চয় বলতে পারি ও একদিন মস্ত নাম কর্বে।”
রণেন্দ্র আস্তে আস্তে ঘরের ভিতর হইতে বাহির হইয়া গেল।
একজন ছাত্র বলিল, “কিন্তু মাষ্টার মশাই, রণেন্দ্রের বেশ একটু পাগ্লামির ছিট্ আছে।”
মনোমোহনবাবু বলিলেন, “হ্যাঁ—তা আমি জানি। ভাব-প্রবণতা বেশী হলেই লোককে পাগল বলে মনে হয়। ছবিকে ভাল করে ফোটাবার জন্যে ওর কেমন একটা অস্বাভাবিক চেষ্টা আছে। রণেন্দ্র একবার কি করেছিল জান? একদিন দেখি, রণেন্দ্রের বাঁ-হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঝর্-ঝর্ করে রক্ত পড়্চে, আর সে নিশ্চিন্ত-ভাবে বসে-বসে ছবি আঁক্চে। দেখে আমি ত’ একেবারে অবাক্! জিজ্ঞাসা করাতে বল্লে, আঙ্গুল কেটে রক্তের আসল রংটা কি-রকম, তাই সে দেখ্চে! অদ্ভুত লোক! তোমরা এটাকে পাগ্লামি বল্তে পার,—কিন্তু এই পাগ্লামির জন্যেই একদিন ও অমর হবে।”
যোগেশবাবু একচোখ মুদিয়া ভাবিতে লাগিলেন, “যেমন মাষ্টার, তেমনি ছাত্র—দুটিই একেবারে বদ্ধপাগল।”
খ
রণেন্দ্র ভাবিতে ভাবিতে বাড়ীর দিকে চলিল। রাস্তায় লোকজন, গাড়ীঘোড়া কত কি চলিতেছে, কিন্তু সেদিকে তার আদোপেই নজর ছিল না—কি যে তার ভাবনা, তা সুধু সেই-ই জানে।
ভাল চিত্রকর বলিয়া অল্পদিনেই সে বেশ নাম করিয়াছিল। এত শীঘ্র তাহার যশ চারিদিকে ব্যাপ্ত হইতে দেখিয়া তাহার সহযোগী চিত্রকরেরা যথেষ্ট ঈর্ষান্বিত হইয়া উঠিয়াছিল—তন্মধ্যে যোগেশবাবুই প্রধান। তাহার ভিতরে যে প্রতিভা আছে, এ-কথাটা যোগেশবাবু মনে-মনে বুঝিলেও, মুখে কিছুতেই মানিতে চাহিতেন না।
অল্পদিনেই রণেন্দ্রের এতটা নাম হইবার কারণও ছিল। ছবি-আঁকাকে সে একটা সখ বা পয়সা-রোজগারের উপায় বলিয়া মনে করিত না। মৃণ্ময়ী প্রতিমার ভিতরে সাধক যেমন চিন্ময়ী শক্তিকে শরীরিণী দেখে, কল্পনার মায়ালোকে সেও তেমনি আপনার জীবন-রূপিণী মানসীর লীলায়িত গতি নিরীক্ষণ করিত। সে যখন তুলি ধরিয়া ছবি আঁকিতে বসিত, চারিদিকের এই বৃহৎ পৃথিবীর সমস্ত স্মৃতি তখন তাহার মনঃপট হইতে একেবারে পুঁছিয়া যাইত—এমন কি, নিজের অস্তিত্বের কথাও তখন তাহার স্মরণ থাকিত কিনা সন্দেহ! প্রকৃত কথা বলিতে গেলে, তখন সে পাগলের মত হইয়া যাইত এবং চিত্রে প্রাণপ্রতিষ্ঠার জন্য সে-সময়ে নিজের প্রাণকেও বুঝি সে বলি দিতে পরিত! একনিষ্ঠ সাধক বলিয়াই এত শীঘ্র সে যশের মাল্য পাইয়াছে।
চরিত্রেও সে, ভিতরে বাহিরে সরল ছিল। এই সরলতা এবং আত্মশক্তির উপরে একান্ত বিশ্বাস থাকাতে, রণেন্দ্র রাখিয়া-ঢাকিয়া কিছু বলিতে পারিত না। আত্মশক্তিতে বিশ্বাস থাকা খুব ভাল কথা। নহিলে জগতে কেহ মানুষ হইতে পারে না। কিন্তু এ বিশ্বাস মনের ভিতরে চাপা রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। বাহিরে ইহা বাহির হইলে পৃথিবীর কঠিন জনসমাজ অসহিষ্ণু হইয়া উঠে।
এখানে ঠিক তাহাই হইয়াছিল। রণেন্দ্র সরলপ্রাণে যাহা বলিত, লোকে তাহা গর্ব্ব বলিয়া ধরিয়া লইত। এবং সুমুখে কিছু না বলিলেও আড়ালে তাই লইয়া কানাকানি করিত।
সকলে সর্ব্বদাই রণেন্দ্রকে আনমনা দেখিত। কাহারও কথা সে কাণ পাতিয়া শুনিত না— কেহ জিজ্ঞাসা করিত এক, উত্তর পাইত আর—সর্ব্বদাই সে কেমন-যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন হইয়া থাকিত এবং কথাবার্তাতেও তেমন গোছাল ছিল না। সে বিবাহ করিয়াছে—একটি ছেলেও হইয়াছে,—পত্নীও সুন্দরী, কিন্তু সংসার বা কোন কিছুতেই তাহার বিশেষ একটা টান্ ছিল না—অথচ তাহার হৃদয় স্নেহ-প্রেমে পরিপূর্ণ! তাহার কার্য্যে ও বাক্যে একমাত্র কামনাই প্রকাশ পাইত—তাহা চিত্র-সাধনা করিয়া অমর হওয়া! এইজন্য বন্ধুজনেরা ভাবিত, সে পাগল! কোনও ফাঁপা জিনিষকে জোর করিয়া জলের ভিতরে চুবাইয়া দিলেও যেমন ডুবাইয়া দেওয়া যায় না—তাহা উপরে ভাসিয়া উঠিবেই উঠিবে—সংসারে ভাবপ্রবণ লোকগুলিও ঠিক্ তেমনি। সংসারের গোলমালে কিছুতেই তারা ডুবিয়া থাকিতে চায় না—তাহাদের ব্যগ্র প্রাণ সংসারের উপরকার স্বাধীনতার দিকে সর্ব্বদাই উঠিয়া যাইতে চাহে।
রণেন্দ্র ভাবিতে ভাবিতে আপনার বাড়ীর সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। দেখিল, দরজার কাছে তাহার চারিবছরের খোকা, মুখের ভিতরে আঙ্গুল পূরিয়া দিয়া গম্ভীরমুখে অত্যন্ত চিন্তিতভাবে দাড়াইয়া আছে!
পিতাকে দেখিয়া খোকা ছুটিয়া আসিল। দুইহাতে রণেন্দ্রকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “বাবা, বাবা!”
“কিরে খোকা?”
খোকা বাপের হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে বলিল, “বাবা, দেখ্বে এস! একটা ব্যাঙ্কে ইট্ মেরেচি, তার পা খোঁড়া হয়ে গেছে!”
রণেন্দ্র ছেলেকে কোলে করিয়া বলিল, “তা আমি কি কর্ব রে দুষ্ট?”
খোকা বলিল, “ব্যাঙ্ যে বাড়ী যেতে পার্চে না! তার পা খোঁড়া, কি করে চল্বে বাবা? চল, ব্যাঙ্কে কোলে করে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আস্বে চল!”
ব্যাঙের বাড়ীর ঠিকানা রণেন্দ্রের একেবারেই জানা ছিল না। সুতরাং সে হাসিতে হাসিতে থোকাকে লইয়া নিজের বাড়ীর ভিতরেই ঢুকিল।
এবারকার প্রদর্শনীতে কিরূপ চিত্র দিবে, রণেন্দ্র বসিয়া বসিয়া তাহাই ভাবিতে লাগিল।
ঘরের দেওয়ালে তাহার হাতের আঁকা সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ নানারূপ চিত্র রহিয়াছে। কোনখানি প্রকৃতি-চিত্র এবং কোনখানি-বা মুর্ত্তি-চিত্র। কোথাও সমুজ্জ্বল সোণার মত সরিষা-ক্ষেতের উপর দিয়া শঙ্খশুভ্র বলাকাদল দিগন্তে দৃষ্টমান সবুজ বনভূমির পানে উড়িয়া যাইতেছে, কোথাও ছায়ালোক-বিচিত্র বিপুল-আয়ত ধরণীর নতোন্নত শ্যামল দেহের উপর দিয়া, অসংখ্য শিরা-উপশিরার মত নদনদীগুলি একিয়া-বেঁকিয়া ক্রমাতিসূক্ষ্ম হইয়া দিক্-রেখায় মিলাইয়া গিয়াছে, কোথাও ধূমের মত ধূসর অভ্রভেদী পর্ব্বতমালা প্রখর তপন-করে আপনি দগ্ধ হইয়াও, শত শত আতপতপ্তের জন্য পদতলে স্নিগ্ধ-ছায়া রচনা করিয়া অটল-ভাবে দাঁড়াইয়া আছে। এমনি নানা দৃশ্য। আর একদিকে নানা আকারের নর-নারীর মূর্ত্তি—হৃদয়ের ভাব তাহাদের সকলেরই মুখে-চোখে ফুটিয়া উঠিয়াছে। তাহাদের কেহ হাস্যে উজ্জ্বল, কেহ লাস্যে চঞ্চল, কেহ ক্রোধে বিকৃতাস্য, কেহ চিন্তায় কুঞ্চিত-ললাট, কেহ বিরহে বিক্ষুব্ধ, কেহ মিলনে নন্দিত!
ঘরের উত্তর দিকে জানালার কাছে একটি ‘চিত্রধরে’র উপরে একখানি অসমাপ্ত ছবি রহিয়াছে। তাহাতে বর্ণমঞ্জুল ল তালীকুঞ্জের চির-মৌন ছায়ার আশ্রয়ে এক মধুরযৌবনা ললনা সরসীর কৃষ্ণনীরে স্থিরবিদ্যুৎপ্রভাবৎ শোভা পাইতেছে। যুবতীর মুখে চিত্রকরের তুলিকা, আনন্দ ও জীবনের আভাস প্রস্ফুট করিয়াছে, কিন্তু তাহার গৌর ও ক্ষীণ কটিতট বেড়িয়া রূপ-পিপাসী চপল জলের মোহন নটন এখনও ফুটিয়া উঠে নাই!
এই সকল ছবির সঙ্গে চিত্রকরের কতদিনের আশা ও হতাশা মিশান আছে! আজ কিন্তু রণেন্দ্রের চিত্তকে, তাহার এত যত্নের ও শ্রমের চিত্রগুলি আগেকার মত তেমন আত্মীয়ের ন্যায় আকর্ষণ করিতে পারিল না! তাহার মনে হইতে লাগিল এতদিন সে সুধু ছেলেখেলা করিয়াছে, কেবল কতকগুলা রঙ্গের উপরে রঙ্গ চাপাইয়াছে! এতদিন ধরিয়া সে যতটুকু শক্তিসঞ্চয় করিয়াছে, আজ তার প্রাণ কেবল ততটুকু লইয়া কিছুতেই প্রীত হইতে পারিল না— কারণ, তাহার মানস-কল্পনা আজ উচ্চে—উচ্চে —আরও উচ্চে উধাও হইয়া চাতকের মুক্ত উড়িয়া যাইতে চাহিতেছে! বরষার সজল ঋতু একবার যদি আসে, তবে গিরিনদী কি আর তখন আপন পূর্ব্ব-সংকীর্ণতার মাঝে বাঁধা থাকিতে পারে? সে তখন উদ্দাম বেগে অসীমতার দিকে ছুটিয়া চলে, একবারও ফিরিয়া তাকায় না, আপনার পূর্ব্বাবস্থা লইয়া কিছুতেই তুষ্ট হইতে পারে না। রণেন্দ্রের মানস-নদেও আজ বিপুল আয়োজনে ভাবের বরষা নামিয়াছে।
রণেন্দ্র স্থির করিল, এবারে সে এমন ছবি আঁকিবে, যাহার সঙ্গে তাহার নাম চিরদিনের জন্য অমর হইয়া থাকিবে! তাহার মানসী যে শিশুর খেলার পুতলি নয়, এ-কথা সকলকে সে ভাল করিয়াই বুঝাইয়া দিবে!
টেবিলের উপরে মাথা রাখিয়া রণেন্দ্র একমনে চিন্তা করিতে লাগিল। সে কি আঁকিবে? কোন্ বিষয়? হৃদয়ের কোন্ তন্ত্রীতে আঘাত করিলে সাধারণের অনুভূতি জাগিয়া উঠে—অথচ সৌন্দর্য্য-লক্ষ্মীর মর্য্যাদা অক্ষত থাকে? অঙ্কন-যোগ্য শত শত বিষয় তাহার চোখের সামনে দিয়া বায়স্কোপের ছবির মত পরে পরে চলিয়া গেল—কিন্তু কোনটিতেই তাহার প্রাণ আজ সাড়া দিয়া উঠিল না। ভাবিতে ভাবিতে আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘরের ভিতরে ক্রমেই ঘনাইয়া আসিল—কিন্তু, চিত্রবস্তু স্থির হইল না! কুললক্ষ্মীদের মধুর ফুৎকারে পল্লীতে পল্লীতে আকুল শঙ্খ সুদূর সাগরের স্মৃতির গান গায়িয়া উঠিল এবং সেই গভীর নির্ঘোষে সচকিত হইয়া রণেন্দ্র উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার পর সেই অন্ধকারে সে ঘরের ভিতরে চিন্তাক্লিষ্ট হৃদয়ে পাগলের মত ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল—কিন্তু বৃথা! বেদনায় ও হতাশায় রণেন্দ্রের বুক যেন ভাঙ্গিয়া যাইতে চাহিল—তবু ত গোপন মানসী মুর্ত্তি ধরিল না!
অনেক রাত। অমাবস্যার আঁধারে আকাশকে যেন পরলোকের একটা গভীর রহস্যের ন্যায় বোধ হইতেছিল—রণেন্দ্র উদ্ভ্রান্তের মত সেইদিকে তাকাইয়া রহিল।
বাহির হইতে দরজায় ঘা মারিয়া পাচক ডাকিল, “বাবু!”
অত্যন্ত চমকিয়া রণেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “কে?”
“বাবু, খাবার হয়েচে, খাবেন আসুন।”
ক্রুদ্ধ রণেন্দ্র কর্কশস্বরে কহিল, “আমাকে বিরক্ত করিস্নে’—যা, আমি এখন খাবনা!”
তাহার পর রণেন্দ্র আবার চিত্তা-সাগরে আপনাকে ডুবাইয়া দিল।
পৃথিবীতে যাহারা যশের মদিরা পান করিয়াছে, হায়, তাহাদের শান্তি কোথায়?
ঘ
এক সপ্তাহ কাটিয়া গিয়াছে।
এই সপ্তাহকাল রণেন্দ্র বাড়ীর বাহিরে পা বাড়ায় নাই—ঘরে বসিয়া ক্রমাগত ভাবিয়াছে, কোন্ মন্ত্রে সাধনার দেবী সাকার হইয়া উঠিবেন?
অন্য সময় হইলে তাহার বিষয়-নির্ব্বাচন করিতে এতটা দেরী হইত না—কিন্তু এবারে সে কিছুতেই আপনার উপযোগী আদর্শ খুঁজিয়া পাইতেছিল না। অথচ যতই দিন যাইতেছে, ততই সে নিরাশ হইয়া পড়িতেছে। এমন কি, এক-একদিন গভীর শূন্যতায় সে ক্ষ্যাপার মত দুইহাতে মাথার চুল ছিঁড়িয়াছে, উচ্চস্বরে আপনাকে আপনি গালাগালি দিয়াছে, ঘরের মেঝের উপরে উপুড় হইয়া পড়িয়া বালকের মত কাঁদিয়াছে!
সেদিন সকালে রণেন্দ্র চুপ করিয়া বসিয়াছিল, এমন সময়ে মনোমোহন বাবুর দরওয়ান আসিয়া তাহার হাতে একখানা চিঠি দিয়া গেল। চিঠি খুলিয়া সে দেখিল, তাহার শিক্ষক মহাশয়ের হস্তাক্ষর। রণেন্দ্র পড়িল:—
“স্নেহাস্পদেষু,
প্রদর্শনীর আর বেশী দেরী নাই। আর এক সপ্তাহের ভিতরে ছবি না পাঠাইলে চলিবে না। তুমি কি করিতেছ? তোমার ছবির কতদূর?
যোগেশবাবু ইতিমধ্যেই ছবি পাঠাইয়া দিয়াছেন। তাঁহার ছবি আমি দেখিয়াছি। বেশ হইয়াছে।
কিন্তু তোমার কাছ হইতে আমি আরও ভাল কাজের আশা করি। তোমার মত প্রিয় ছাত্র আমার কেহ নাই। আশীর্ব্বাদ করি, তুমি গুরুর মুখ রাখিতে পারিবে।
মনে রাখিও, এই প্রদর্শনীতে যদি তোমার চিত্র সর্ব্বোৎকৃষ্ট হয়, তবে তোমার যশের পথে আর কোন বাধা থাকিবে না।
তোমার শিক্ষা সফল হউক। ইতি।”
চিঠি পড়িয়া রণেন্দ্র আরও ভাঙ্গিয়া পড়িল। আর এক সপ্তাহমাত্র সময়? এখনও যে তাহার চিত্রের পরিকল্পনা স্থির হয় নাই! তাইত, কি করিবে সে?
আত্মশক্তির উপরে এতদিন তাহার যে দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, এখন সে বিশ্বাসের মূলও যেন আল্গা হইয়া গেল! এই তুচ্ছ শক্তি নিয়া দশের মাঝে সে জাঁক করিয়া বেড়াইয়াছে! ছেলেখেলায় দিন কাটাইয়া সে ভাবিয়াছে, অমর হইবে! হায়রে কপাল! আপনার অক্ষমতার জন্য রণেন্দ্রের দুচোখ জলে ভরিয়া উঠিল।
ঙ
বিকারের রোগীর রাত যেমন তাহার অগোচরে কাটিয়া যায়, সে রাত্রিও তেমনি কখন যে পোহাইয়া গেল, রণেন্দ্র তাহার কিছুই টের্ পাইল না। সে এ-কয়দিন চিত্রশালাতেই শয়ন করিয়াছে।
মুখে-চোখে অনিদ্রার চিহ্ন লইয়া রণেন্দ্র ঘরের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইতে না দাঁড়াইতে তাহার স্ত্রী বিবর্ণমুখে ছুটিয়া আসিল। তাড়াতাড়ি তাহার হাত ধরিয়া বলিল, “ওগো, খোকার কি হয়েছে, দেখবে এস!”
রণেন্দ্র বলিল, “কি হয়েচে?”
লীলা হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “বোধ হয় — বোধ হয়— কলেরা! অমন করে দাঁড়িয়ে থেকো না-বাছা একেবারে নেতিয়ে পড়েচে।”
অত্যন্ত বিপন্নভাবে রণেন্দ্র আপনার শয়নকক্ষে প্রবেশ করিল।
খোকা তাহার বিছানার সঙ্গে মিশিয়া নিস্তেজ হইয়! পড়িয়া আছে এবং শয্যার সর্ব্বত্র একটা ভীষণ রোগের চিহ্ন জাজ্বল্যমান। অমন সোণার মত দেহের রঙ, দুদণ্ডেই যেন একেবারে ‘পাঙাস্পানা’ হইয়া গিয়াছে। হঠাৎ দেখিলে মনে হয়, খোকা বাঁচিয়া নাই! কেবল তাহার বুকের কাছটি ধুক্-ধুক্ করিতেছিল, তাহাতেই অতি ক্ষীণভাবে জীবনের লক্ষণ প্রকাশ পাইতেছিল।
খোকার মাথার উপরে ঝুঁকিয়া পড়িয়া রণেন্দ্র স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইয়া রহিল।
লীলা বলিল, “ওগো, অমন করে দাঁড়িয়ে থেকো না—যাও, যাও, শীগগীর্ ডাক্তার ডেকে আন।”
মায়ের গলা শুনিয়া খোকা চোখ মেলিল। অতি ক্ষীণস্বরে ডাকিল, “মা—মাগো!”
“বাবা আমার, ধন আমার,—কি বল্চো যাদু?” বলিতে বলিতে লীলা দুইহাতে থোকাকে জড়াইয়া ধরিল। মাতৃস্তনের উপরে মুখ রাখিয়া থোকা একেবারে এলাইয়া পড়িল।
রণেন্দ্রের চোখ জ্বলিয়া উঠিল। সে একদৃষ্টিতে মাতৃবাহু-বেষ্টিত সেই বিবর্ণপুষ্পবৎ শিশুর দিকে চাহিয়া রহিল।
লীলা ভৎর্সনার স্বরে বলিল, “এখনও ডাক্তার ডাক্তে গেলে না? তুমি কি গো!”
রণেন্দ্র অস্ফুট বাক্যে কহিল, “অ্যাঁ—ডাক্তার—হুঁ!”
স্বামীর অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বর ও অসংলগ্ন কথা শুনিয়া লীলা সচকিতে মুখ তুলিল। বলিল, “কি বল্চ?”
“কিছু না।”
“যাও, ডাক্তার ডেকে আন।”
“হুঁ—এই যাই।” রণেন্দ্র স্খলিত পদে উন্মনার মত ঘরের ভিতর হইতে বাহির হইল ৷
দুম্ করিয়া ঘরের কপাট বন্ধ হইয়া গেল। লীলা সবিস্ময়ে শুনিল, তাহার স্বামী বাহির হইতে দরজায় শিকল টানিয়া দিতেছেন! একি!
চ
রণেন্দ্র আপনার চিত্রশালার ভিতরে ঢুকিয়া একখানা চেয়ারের উপরে বসিয়া পড়িল।
দুইহাতের ভিতরে মুখ গুঁজিয়া সে কি ভাবিতে লাগিল। তাহার ভাব দেখিলে মনে হয়, সে-যেন ভীষণ একটা মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করিতেছে! চারিদিক্ অত্যন্ত নিস্তব্ধ। দেওয়ালে সুধু ব্রাকেটের উপর ঘড়ীটা অশ্রান্তভাবে টিক্-টিক্-টিক্ করিতেছিল এবং রণেন্দ্রের বুকের ভিতর হইতে তাহার হৃৎপিণ্ডটাও যেন উত্তর দিয়া তালে তালে কহিতেছিল,—দুপ—দুপ্,—দুপ্! যেন তাহার ভয়ানক সংকল্পের কথা জানিতে পারিয়া ঘড়ী আর হৃৎপিণ্ড পরস্পরের সহিত কি কানাকানি করিতেছিল! হঠাৎ রণেন্দ্র উঠিয়া দাঁড়াইল এবং হিপ্নটিজিমে অভিভূত লোক আপনার অজ্ঞাতসারে যেমনভাবে কথা কহে, তেমনিভাবে কহিল, “কি করি? এমন আদর্শ আর পাব না—কিন্তু, কিন্তু—সে যে আমার ছেলে!” বলিতে বলিতে থামিয়া গিয়া অত্যন্ত বিবর্ণ-মুখে আবার সে বসিয়া পড়িল এবং স্তব্ধভাবে আবার ভাবিতে লাগিল।
হঠাৎ বাড়ীর ভিতর হইতে তীক্ষ্ণতীরের মত একটা আর্ত্তনাদ তাহার বাণে আসিয়া বাজিল।
“ওরে খোকা - কোথা গেলি রে!”
ছিলা ছিঁড়িয়া গেলে, ধনুক যেমন সহসা সিধা হইয়া যায়, চিন্তানত রণেন্দ্র ঠিক্ তেমনিভাবে সোজা হইয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখে রক্তের লেশমাত্র নাই! একবার কাণ পাতিয়া সেই আর্ত্তনাদ শুনিল। বুঝিল, খোকা নাই।
আপনমনে বিড়-বিড়, করিয়া বলিল, “ভগবান্! ভগবান্! তুমি সাক্ষী—আমার কোন দোষ নেই!”
তাহার পর আপনার মাথার চুলগুলা ডানহাতে মুঠা করিয়া ধরিয়া, রণেন্দ্র আবার কি ভাবিতে লাগিল। একটু পরেই, অকস্মাৎ তন্দ্রা ছুটিয়া গেলে যেমন হয়, তেমনি চমকিয়া উঠিয়া তাড়াতাড়ি এককোণে গিয়া টেবিলের উপর হইতে চিত্রপট, তুলি ও রং লইয়া, সে ঘরের ভিতর হইতে ছুটিয়া বাহির হইল।
শয়ন-কক্ষের সুমুখে, ‘একটা জানালার কাছে আসিয়া রণেন্দ্র থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। কিছু শোনা যায় কি? না, সব চুপচাপ। সেই জানালা দিয়া ঘরের ভিতরটা দেখা যাইতেছিল। উঁকি মারিয়া ভয়ে-ভয়ে রণেন্দ্র যাহা দেখিল, তাতে তার সর্ব্বদেহে কাঁটা দিয়া উঠিল। সমস্ত বিছানাট। ওলট্-পালট্ হইয়া গিয়াছে— পুত্রহারা জননী নিশ্চয় সেখানে পড়িয়া ছট্ফট্ করিয়া কাঁদিয়াছে!
আর—ওখানে, ওকি! ঘরের মেঝেতে লুটাইতে লুটাইতে ছেলের মৃতদেহ দুইহাতে বুকে আঁকড়িয়া লীলা, এলোচুলে, বিস্ফারিত-নেত্রে খোকার অসাড় ওঠে, প্রাণপণে চুম্বন করিতেছে!
রণেন্দ্রের দুইচোখে কে-যেন দুটো শলা বিঁধিয়া দিল! অধরে ওষ্ঠ চাপিয়া, অনেক কষ্টে আপনাকে সামলিয়া রণেন্দ্র, পটের উপরে তুলির প্রথম রেখা টানিল! তাহার সুমুখে—ঘরের ভিতরে সেই ভয়ানক আদর্শ! জগতের আর কোন চিত্রকর বোধ হয়, এমন আদর্শের সামনে তুলি ধরেন নাই।
বাহিরে, রণেন্দ্রের দেহে কোন চাঞ্চল্য ছিল না। কিন্তু তার মনের ভিতরটা কি করিতেছিল, কে তা বুঝিবে? সে যে পিতা!
রণেন্দ্র তাড়াতাড়ি ছবি আঁকিতে লাগিল,—জীবনে এত তাড়াতাড়ি সে আর কখনও আঁকে নাই! তার আঙ্গুলে কোন অজ্ঞাত শক্তি আজ যেন কি মন্ত্র পড়িয়া দিয়াছিল! আঁকিতে আঁকিতে শুনিল, “খোকা, ও খোকা! কথা ক’ বাপ্, কথা ক’—একটিবার চোখ চা যাদু!”
রণেন্দ্র অস্ফুটম্বরে কহিল, “ওঃ! আর যে পারি না!” তাহার হাত হইতে খসিয়া তুলি মাটিতে পড়িয়া গেল।
কিন্তু তখনি তুলিটা তুলিয়া লইয়া সে আবার আঁকিতে আরম্ভ করিল। মাঝে মাঝে লীলার ক্রন্দন-স্বর তাহার শ্রবণ দিয়া মর্ম্মে পশিয়া ধমনীর রক্তপ্রবাহ যেন বন্ধ করিয়া দেয়, তাহার হস্তকে পক্ষাঘাতগ্রস্তের মত অসাড় করিয়া তুলিকার গতি থামাইয়া দেয়—কিন্তু অনতিবিলম্বেই আবার সে আত্মসংবরণ করে। এমনি করিয়া মিনিটের পর মিনিট কাটিতে লাগিল।
সদর দরজায় ততক্ষণে ভিতরে আসিবার জন্য চাকর-বামুনেরা গোলমাল সুরু করিয়াছে। কিন্তু, রণেন্দ্র তখন জগতের আর সব শব্দের দিকে যেন কালা হইয়াছিল—সে কিছুই শুনিতে পাইল না! সে তখন একবার ঘরের ভিতরে, আর একবার পটের উপরে চাহিতেছিল; একবার রঙে তুলি ডুবাইতেছিল, আর একবার পটে তুলি বুলাইতেছিল—সে যে পিতা এবং ঘরের ভিতরে পত্নীর বুকে ও যে তার মৃতপুত্র—এ স্মৃতিটুকুও বুঝি সে, ক্রমে ক্রমে, ধীরে ধীরে ভুলিয়া যাইতেছিল!
হঠাৎ লীলা তাহাকে দেখিতে পাইল। ছুটিয়া, জানালার কাছে আসিয়া সে সক্রন্দনে বলিয়া উঠিল, “ওগো, ডাক্তার ডেকেচ গো! একবার এসে দেখে যাক্ যাদু আমার বেঁচে আছে কিনা—অ্যাঁ-অ্যাঁ-ওকি! ছবি আঁক্চ, ছবি আঁক্চ!”
চকিতে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া রণেন্দ্র পাংশুমুখে লীলার দিকে চাহিল। সে পড়িয়া যাইতেছিল, তাড়াতাড়ি কোনরকমে দেয়াল ধরিয়া দাঁড়াইল।
বাহির হইতে দরজা ঠেলিয়া ও ক্রমাগত চেঁচাইয়াও যখন দরজা খুলিল না, বামুন ও চাকর তখন ভীত হইয়া উঠিল। তাহারা ঠিকা লোক,—রোজ সন্ধ্যায় কাজ সারিয়া চলিয়া যায় আর সকালে কাজে আসে। প্রত্যহ দরজা ঠেলিলেই হয় রণেন্দ্র, নয় লীলা আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিত—আর, আজ এত বেলা, এত ডাকাডাকি-ঠেলাঠেলি, তবু কপাট খুলিল না কেন? এদিকে মাঝে মাঝে তারা লীলার গুম্রাণো কান্নার শব্দও শুনিতে পাইতেছিল!
কিছুই বুঝিতে না পারিয়া, তারা পাড়ার পাঁচজনকে ডাকিল। অবশেষে, সকলে মিলিয়া অনেক পরামর্শের পর দরজা ভাঙ্গিয়া ফেলিল!
সকলে একটু সঙ্কুচিতভাবে বাড়ীর ভিতরে ঢুকিল। সিঁড়ি বহিয়া উপরে উঠিয়া, অন্দরের দিকে অগ্রসর হইয়া তাহারা দেখিল, দেয়ালে ঠেশ্ দিয়া, দুইহাতে দুইহাঁটু জড়াইয়া ধরিয়া, রণেন্দ্র, হেঁটমুখে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছে ৷
তাহাদের পদশব্দে চমকিয়া রণেন্দ্র মুখ তুলিল। তাহার চক্ষু রক্তবর্ণ—লক্ষ্যশূন্য! খানিকক্ষণ পরে হঠাৎ সে হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিয়া, সাম্নের চিত্রপটের দিকে অঙ্গুলিনির্দ্দেশ করিয়া বলিল, “ডাক্তার! ডাক্তার! আমি অমর হয়েছি!”ছ
কয়েকদিন কাটিয়া গিয়াছে। শিল্প-প্রদর্শনী খুলিয়াছে।
প্রদর্শনীতে দেখিবার জিনিষ অনেক—কিন্তু দর্শকেরা বিশেষ করিয়া একখানি ছবির দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। ছবিখানি ছোট এবং এখনও অসমাপ্ত। ছবির নাম, “শেষ চুম্বন।”—ছেলের মৃতদেহ বুকে করিয়া, জননী আপনার হৃদয়-দুলালের চাঁদমুখে জন্মের শোধ শেষবার চুম্বন-দান করিতেছেন,—ইহাই চিত্রের বিষয়।
শোকাতুরা জননীর মুখে, চোখে ও দেহে, চিত্রকরের তুলিকা এমন একটি করুণভাব ফুটাইয়া তুলিয়াছে যে, যিনিই দেখিতেছেন, তিনিই কাঁদিয়া ফেলিতেছেন। চিত্রের ভিতরে যে এতটা করুণরস থাকিতে পারে, একথা আগে কেহ কল্পনা করিতেও পারে নাই। একজন বলিলেন,
ভিড়ের ভিতরে কয়েকজন চিত্রকরও ছিলেন। “দেখুন যোগেশবাবু! আপনি কি বলেন?”
যোগেশবাবু তখন অবাক্ হইয়া ছবির দিকে চাহিয়াছিলেন। হঠাৎ প্রশ্ন শুনিয়া, একচোখ মুদিয়া বলিলেন, “আশ্চর্য্য! আগে জান্লে রণেন্দ্রকে আমার গুরু কর্তুম।”
দর্শকদের ভিতরে ধন্য ধন্য রব পড়িয়া গেল। কিন্তু কেহ জানিল না, এ যশের মূল্য কি? শুনিলেও, হয়ত’ কেহ বিশ্বাস করিত না। শিল্পী যে সোণার মত আপনি পুড়িয়া খাক্ হইয়া, শিল্প-লক্ষ্মীর কনক-চরণে নূতন ভূষণ দিয়াছে, এ খোঁজ কেহ পাইল না।