পাখীর কথা/দ্বিতীয় ভাগ/রাষ্ট্রসমস্যা ও পক্ষিতত্ত্ব
রাষ্ট্রসমস্যা ও পক্ষিতত্ত্ব
সমস্ত জগৎ জুড়িয়া একটা মহাকুরুক্ষেত্রের অভিনয় হইতেছে। সভ্য জগতের সমগ্র রাষ্ট্রীয় শক্তি কায়মনোবাক্যে এই সমরানলে আহুতি দিতেছে। রাষ্ট্রনীতি ও সমাজনীতি-তত্ত্ববিদের মুখর কোলাহলে আমাদের সকলের কর্ণ প্রায় বধির হইবার উপক্রম হইয়া উঠিয়াছে,—এ সময়ে পক্ষিতত্ত্ববিৎ সংসারের সমস্ত কথা ক্ষণেকের জন্য বিস্মৃত হইয়া জগৎ ভুলিয়া, জয়পরাজয় ভুলিয়া, যদি তাঁহার স্বরচিত বিহঙ্গনিকুঞ্জে স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে আপনাকে নিমজ্জিত করিয়া রাখেন, তাহা হইলে অনেকে হয় ’ত মনে করিবেন, এমন খাপছাড়া সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার শুধু ভারতবর্ষেই সম্ভব—শুধু ভারতবর্ষে কেন—শুধু বাঙ্লা দেশেই সম্ভব। হয় ’ত যে বাঙ্লার বুধমণ্ডলী, রাষ্ট্রনীতি-সাগর মন্থন করিয়া অমৃত ও গরল তুলিতে ভালবাসেন, তাঁহারা সেই নিরীহ পক্ষিপালকের ব্যূহমধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিবেন, “তুমি কি চিরকালই স্বপ্ন দেখিবে, বাস্তব জগতের প্রচণ্ড মানবসমস্যা হইতে নিজেকে দূরে রাখিয়া পাখী লইয়া জীবন কাটাইবে?” বিস্মিত পক্ষিপালক হয়’ত বলিবেন, “কেন, আমার কি করা উচিত?” রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ হয়’ত উত্তর দিবেন—“কি করা উচিত! দেখিতেছ না, এই মহাকুরুক্ষেত্র ব্যাপারের শেষ অঙ্কের যবনিকা উত্তোলিত হইয়াছে। সকলেরই মুখে মানবসমাজের, য়ুরোপীয় বিধ্বস্ত রাষ্ট্রের ও নগরীর পুনর্গঠনের আলোচনা শুনা যাইতেছে। রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম্মনীতি, অর্থনীতি—সমস্ত শাস্ত্র লইয়া নূতন করিয়া নাড়াচাড়া পড়িয়াছে। হায় পক্ষিতত্ত্ববিৎ, তোমারই কিছু বলিবার নাই! মুটে, মজুর, চাষা, নাবিক, অশ্বারোহী, পদাতিক, সেনা, স্কুলমাষ্টার, উকীল, ডাক্তার, সকলেরই মুখে ঐ একই শব্দ শুনা যাইতেছে—“Reconstruction”। ইংরাজ সাহিত্যিকদিগের মুখপত্র ‘এথিনিয়ম্’ মাসে মাসে Reconstruction প্রবন্ধে নিজের কলেবর পূর্ণ করিতেছে। মার্কিন যুক্ত রাজ্যের প্রেসিডেণ্ট্ উইলসন্ সাহেব, যুদ্ধাবসানে মানবসমাজের পুনর্গঠন কেমন করিয়া ন্যায় ও ধর্ম্মের উপর প্রতিষ্ঠিত হইবে, সে সম্বন্ধে সে দিন মার্কিন ধনকুবেরদিগের নিকট যে মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন সে রকম সুন্দর কথা এই বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে কোন বলদৃপ্ত শ্বেতাঙ্গজাতির মুখ হইতে নির্গত হইতে পারে, এমন কল্পনা বোধ হয় কোন ভারতবাসী কখন করেন নাই। এ সকল খবর বোধ হয় তুমি রাখ না। যে বেলজিয়মকে লইয়া প্রধানতঃ জর্ম্মানের সহিত ইংরাজের বিরোধ বাধিয়া গেল, সেই বিধ্বস্ত দেশটার কেমন করিয়া পুনর্গঠন হইতে পারে, তাহার সদুত্তর কি তুমি দিতে পার?”
পক্ষিতত্ত্ববিৎ—রাজনীতির দিক্ হইতে তোমাদের কি বলিবার আছে?
রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ—আমাদের ’ত অনেক বলিবার আছে। কূট রাজনীতি-চক্রপেষণে যে দেশ নষ্ট হইয়াছে, সে দেশ ’ত আবার রাজনীতিজ্ঞই গড়িয়া তুলিবেন।
পক্ষিতত্ত্বরিৎ—কেমন করিয়া গড়িয়া তুলিবেন?
রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ—দেশের রাষ্ট্রীয় সীমারেখা টানিয়া, শত্রুর নিকট হইতে indemnity লইয়া, আবার গ্রাম, নগর, ঘর, বাড়ী, বাগান, পার্ক, রেল, টেলিগ্রাফ ইত্যাদি নির্ম্মিত হইবে।
পক্ষিতত্ত্ববিৎ—পুনর্গঠন প্রসঙ্গে তোমাদের মত রাষ্ট্রনীতিজ্ঞের ’ত ঐ পর্যন্ত দৌড়? তোমরা Physics, Chemistry, অর্থনীতি, Town Planning ইত্যাদির সাহায্যে বেলজিয়মের পুনর্গঠন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস পাইতেছ। ঐ যে Indemnity কথাটীর উল্লেখ করিলে, ইহার ভিতর হইতে আমাকে কিছু তোমাদের দিতে হইবে। আমিও তোমাদের সঙ্গে ঐ রসায়নতত্ত্ববিৎ ও অর্থনীতিজ্ঞের পশ্চাতে বেলজিয়মে প্রবেশ করিব।
রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ—ঠাট্টা রাখ। বাস্তবিক বিষয়টা খুব গুরুতর।
পক্ষিতত্ত্ববিৎ—আমি কি ঠাট্টা করিতেছি? তোমরা Libraryর পুস্তক-কীট। কেমন করিয়া বুঝিবে যে, বেলজিয়মের মত একটা দেশের পুনঃ-প্রতিষ্ঠায় পক্ষিতত্ত্ববিৎ ও পক্ষিপালকের সাহায্য একান্ত আবশ্যক? ভাবিতেছ, এই নিভৃত পক্ষিগৃহে আমার আলস্যমন্থর দিনগুলি বিচিত্র বর্ণচ্ছটাসমন্বিত পতত্রের উপর লঘুভর দিয়া, এক প্রকার জাগ্রত স্বপ্নাবস্থায় চলিয়া যাইতেছে। তোমাদের যেমন স্বভাব, রাজনীতি বল, ধর্ম্ম-নীতি বল, সমাজনীতিই বল—সকল বিষয়ের কেবলমাত্র উপরকার ভাসা-ভাসা খবরটুকু রাখিয়া নিজেকে ও অপরকে অস্থির করিয়া তোল; ভিতরকার গুরু তত্ত্বটুকু লইয়া দেখিবার অবসর তোমাদের হয় না—তোমরা যে আমাদের জীবনের উপরকার খোলসটুকু দেখিয়া আমাদিগকে মানব-সমাজ-বিচ্ছিন্ন বিলাসী বলিয়া মনে করিবে, ইহা বিচিত্র নহে। মানবের সামাজিক জীবনের সহিত পাখীর যে কত দূর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, তাহার খবর ’ত তোমরা রাখ না। এই দেবাসুরের সমুদ্রমন্থন হইতে যে দিন বেলজিয়মের রাজলক্ষ্মী সমুত্থিতা হইবেন, সে দিন হয় ’ত সমগ্র সভ্য জগৎ সসম্ভ্রমে ও নতমস্তকে তাঁহার ঐশ্বর্য্যে ও দীপ্তিতে বিমোহিত হইবেন। কিন্তু যে পক্ষীটী তাঁহার বাহন, তাহার প্রতি কাহারও দৃষ্টি আকৃষ্ট হইবে কি? আমি সেই দেশলক্ষ্মীর বাহনটীকে অত্যন্ত বাস্তব symbol বলিয়া মনে করি। বাণিজ্যে লক্ষ্মী বাস করেন সত্য, কিন্তু দেশের সৌভাগ্য-শ্রীর অর্দ্ধেকটা ’ত কৃষিকর্মে নিহিত রহিয়াছে। সেই কৃষিকর্ম্মে পেচক প্রভৃতি পক্ষীর সাহায্য যে কতটুকু আবশ্যক, সেই জ্ঞানটুকু লাভ করিবার জন্য ঐ indemnityর কিয়দংশ আমার মত পক্ষিতত্ত্ববিদের অথবা পক্ষিপালকের পাওয়া উচিত। আচ্ছা, indemnityর কথা না হয় আর নাই তুলিলাম, ও সব তোমাদের politicsএর বুলি। তোমরা হয় ’ত শুনিলে বিস্মিত হইবে যে, বিধ্বস্ত বেলজিয়মের পক্ষ হইতে কি প্রকার আবেদন-পত্র ইংরাজ পক্ষিতত্ত্ববিদের নিকট উপস্থিত হইয়াছে। সম্প্রতি বেলজিয়মের জনৈক রাজকর্ম্মচারী Conseil Economique Du Gouvernement Belge ম্যানচেষ্টারের Avicultural Magazineএর সম্পাদককে লিখিয়াছেন যে, তাঁহার মাসিক পত্র বেলজিয়মের পুনর্গঠনে (industrial reconstruction) যথেষ্ট সাহায্য করিবে—“With a view to making a thorough investigation of the possibilities regarding the industrial reconstruction of Belgium, we solicit the regular service of your Periodical”[১]। পত্রান্তরে তিনি সম্পাদককে পুনরায় লিখিয়াছেন,—“Allow me to point out to you that a special agricultural and avicultural section has been formed among the Belgians temporarily living in England, for the sake of investigating the problems relating to the relief of these industries”[২]। সম্পাদকের সম্মতি পত্রিকায় এই মর্ম্মে প্রকাশিত হইল—“Poultry, pigeons, and canaries being outside the scope of the society, the assistance we can render the Belgian Committees will obviously lie in the study of the food of birds, in relation to their harmfulness or otherwise to crops”[৩]।
এখন কেন একটা দেশের পুনর্গঠনে পাখী এতটা আবশ্যক বলিয়া বিবেচিত হইতেছে, সে সম্বন্ধে যদি তোমার কৌতূহল জন্মিয়া থাকে, তবে অল্প কথায় সমস্ত বিষয়ের কতকটা বুঝাইতে চেষ্টা করিতে পারি।
কথায় কথায় যে প্রসঙ্গে আমরা উপনীত হইলাম, তাহাকে পাশ্চাত্য বুধমণ্ডলী Economic Ornithology আখ্যা প্রদান করিয়াছেন। বিশ্বপ্রকৃতির বিধিব্যবস্থায় পাখী যে কত কাজে লাগে, তাহার খোঁজ আমরা সচরাচর রাখি না। আদিম মানব যে দিন মত বসুন্ধরাকে ধনধান্য-পুষ্পভরা করিতে চেষ্টা করিয়াছিল, যে দিন হইতে নবাবিষ্কৃত লৌহযন্ত্রের সাহায্যে বসুন্ধরার বুক চিরিয়া কৃষিকার্য্যে সাফল্য লাভ করিবার প্রয়াস পাইল, সেই দূর অতীতে তামসঘন দিনে পাখী তাহাকে অযাচিতভাবে কতটা সাহায্য করিয়া আসিয়াছে, মাঝে মাঝে এক একবার স্থিরচিত্তে তাহার হিসাব নিকাশ লইতে পারিলে, তোমার মত রাষ্ট্রনীতিজ্ঞেরও মনে একটা নূতন আনন্দ সঞ্চারিত হইতে পারে। পাখী যে শুধু আমাদের বিলাসের সামগ্রী নয়, তাহাকে যে শুধু স্বরচিত পিঞ্জরে আবদ্ধ করিয়া, নীলাভ মণিমণ্ডিত দণ্ডে বসাইয়া, তাহার রূপে ও সঙ্গীতে মুগ্ধ হইয়া মানুষ দিন কাটাইবে, মানবের দৈনন্দিন জীবনে আর তাহার কোন আবশ্যকতা নাই, সে যে অনেকগুলি অনাবশ্যক দ্রব্যের মধ্যে একটা অকেজো জিনিষ মাত্র, ইহা মনে করিলে তাহার প্রতি, অথবা যদি কোন বিশ্বনিয়ন্তা থাকেন, তাঁহার প্রতি মূঢ়ভাবে অত্যন্ত অবিচার করা হয়। কৃষিকর্ম্মে পাখীর উপযোগীতার কথা অবতারণা করিবার পূর্ব্বে প্রাগৈতিহাসিক যুগে যাযাবর মানব যখন গোধন লইয়া দলে দলে দেশ-দেশান্তরে বিচরণ করিত, আদিম মানব যখন কৃষিবিদ্যার রহস্য উদ্ঘাটিত করিতে সমর্থ হয় নাই, যখন তাহাদের কেবলমাত্র সম্পত্তি ছিল—কয়েকটি পালিত পশু, সেই pastoral যুগে উত্তরকুরু-প্রদেশস্থ আমু নদীর তীর হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত মধ্য-এসিয়ার মধ্য দিয়া বিচরণ করিয়া ঋতু-পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর হইতে দক্ষিণে এবং দক্ষিণ হইতে উত্তর-দিকে গমনাগমনে কেমন করিয়া তাহারা তাহাদিগের পালিত পশুগুলিকে রক্ষা করিতে সমর্থ হইত তাহার সন্তোষজনক উত্তর যদি চাও, তাহা হইলে শুধু Meteorologistএর কাছে গেলে চলিবে না, তোমাকে Ornithologistএর শরণাপন্ন হইতে হইবে। দেখিতে পাইবে যে, যুগযুগান্তর ধরিয়া সমস্ত মানবের ইতিহাস সাক্ষ্য দিতেছে যে, মানব-সমাজের প্রতিষ্ঠা ও রক্ষাকার্য্যে বিহঙ্গজাতি তাহার প্রধান সহায়। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বনামধন্য Imperialist সার্ হ্যারি জনষ্টন্ এই পশুরক্ষা-প্রসঙ্গে লিখিয়াছেন,—“Birds are the greatest allies that man has possessed in his agelong warfare against insects and the more harmful forms of ticks, fresh-water crustacean, centipede, trematode, worm, and leech[৪]”। মানবপালিত পশুজীবনের সহিত এই চিরন্তন কীট-বিহঙ্গ-বিরোধের সম্পর্ক কি তাহা বোধ হয় আরও একটু খোলসা করিয়া বলা আবশ্যক।
সমাজবদ্ধ মানবের অর্থনীতি বা বার্ত্তাশাস্ত্রের সহিত বিহঙ্গজীবনের একটা নিগূঢ় ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে, এ বিষয়ে পক্ষিতত্ত্ববিদ্গণের মধ্যে মতদ্বৈধ নাই। সর্ব্বত্রই কৃষিজীবিগণের ভূয়োদর্শন বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞের অনেক সাহায্য করিতেছে। তাহার ফলে Economic Ornithology নামে একটা নূতন শাস্ত্র গড়িয়া উঠিয়াছে। সর্ব্বত্র প্রকৃতির সহিত দ্বন্দ্ব করিয়া মানুষকে জীবিকা অর্জ্জন করিতে হয়। যুগযুগান্তর ধরিয়া এই দ্বন্দ্ব চলিয়া আসিতেছে; প্রকৃতির অন্তর্গূঢ় অন্ধ-শক্তির নিকটে পরাভব স্বীকার করিতে সে কখনই রাজী হয় নাই। প্রতিদ্বন্দ্বী কখনও কীট, কখনও পতঙ্গ, কখনও সরীসৃপ আকারে দেখা দেয়; মানুষ অযাচিতভাবে পাখীর সাহায্য পাইয়া তাহাদিগের উপর জয়ী হয়। সর্প ও মূষিক পরস্পর জাতশত্রু, আবার উভয়েই কৃষিজীবী মানুষের পরম শত্রু; উহাদিগকেও নষ্ট করিতে পাখীর সাহায্য আবশ্যক হয়। অনেক সময়ে বনজ উদ্ভিদ চাষের বিষম অন্তরায় হইবার উপক্রম করে; চেষ্টা করিয়াও সেগুলির সম্পূর্ণ উচ্ছেদসাধন করা অনেক সময়ে সম্ভবপর হয় না; সহসা কয়েকটি পাখী আসিয়া সে কার্য্য সুসম্পন্ন করিয়া দেয়। কৃষকের পালিত পশুকে কীটাদির আক্রমণ জনিত অনিষ্ট হইতে পাখী যে কতটা রক্ষা করে, তাহা বোধ হয় অনেকে অবগত নহেন। পুষ্পের পরাগ লইয়া পুষ্পান্তরে সঞ্চারিত করিয়া, ফলের বীজ দেশ হইতে দেশান্তরে ছড়াইয়া দিয়া, অনুর্ব্বরা ভূমিকে উর্ব্বরা করিয়া, পাখীরা আমাদের অজ্ঞাতসারে মানবসমাজের কত উপকার করে, তাহা চিন্তা করিলে বিস্মিত হইতে হয়।
অতএব দেখা যাইতেছে যে, পক্ষিবিজ্ঞানের এমন একটা দিক্ আছে, যেখানে পাখী মানুষের কেবলমাত্র নয়নরঞ্জনের বা চিত্তবিনোদনের সামগ্রী নহে; আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সে অনেক সময়ে আমাদের উপকারী বন্ধুর কাজ করে। যদি তাহার সেই উপকারের কথা স্মরণ করিয়া আমরা তাহার যথাযোগ্য পরিচর্য্যার ব্যবস্থা করিতে না পারি, তাহা হইলে আমাদিগকে বিষম ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হইবে।
ইদানীং সমস্ত সভ্য দেশের পণ্ডিতমণ্ডলীর মধ্যে এ সম্বন্ধে মতের ঐক্য দৃষ্ট হয়। বিশেষতঃ আজকাল যদিও পৃথিবীতে মহাকুরুক্ষেত্রাগ্নি নির্ব্বাপিত হইয়াছে, তথাপি ভস্মস্তূপের মধ্য হইতে বিধ্বস্ত দেশগুলিকে পুনর্গঠিত করিয়া তুলিবার জন্য এখনও সভ্য জগতে সমবেত মানবসমাজের সচেষ্ট উদ্যম দেখিতে পাইতেছি না; সকলেই কেবল মাত্র বড় বড় রাষ্ট্রীয় প্রশ্ন লইয়া ব্যস্ত। কোন্ দেশের সীমান্তরেখা প্রসারিত বা সঙ্কুচিত হইবে, কাহার কতগুলা জাহাজ বা সৈন্য থাকিবে, কাহার সঙ্গে বাণিজ্যব্যবসায়ে অবাধ আদানপ্রদান চলিতে দেওয়া যাইতে পারে—এই সকল বিষয় লইয়া এত দিন ধরিয়া নানা তর্ক বিতর্ক চলিতেছে। বেলজিয়মের পুনর্গঠন ও তাহার লুপ্ত শ্রীর উদ্ধার একান্ত আবশ্যক—এ কথা সকলেই বলিতেছেন বটে; কিন্তু সকলেরই মনে মনে এই প্রকার একটা বিশ্বাস আছে, যেন পরাজিত শত্রুর নিকট হইতে কিছু বেশী টাকা খেসারত-স্বরূপ আদায় করিয়া লইতে পারিলেই মজুর ও মিস্ত্রী লাগাইয়া আবার যেমনটি ছিল, সেইরূপ গড়িয়া তুলিতে পারা যাইবে। যেন শুধু মানুষ, টাকা ও কতকগুলা মানুষের আবিষ্কৃত কল হইলেই, সর্ব্বতোভাবে দেশলক্ষ্মীকে ফিরাইয়া আনিতে পারা যায়। এই প্রকার স্বদেশহিতচেষ্টার পশ্চাতে আমাদের প্রচণ্ড আত্মাভিমান প্রকাশ পাইতে পারে, কিন্তু বুদ্ধির প্রখরতা সম্বন্ধে বোধ হয় কিঞ্চিৎ সন্দেহ থাকিয়া যায়।
কৃষির উন্নতি করিতে হইবে? রসায়ন-বিদ্যার সাহায্য লইলেই বোধ হয় কার্য্যটি সুসম্পন্ন করা যাইতে পারে—এই ধারণার বশবর্ত্তী হইয়া নানা উপায়ে Intensive Cultivationএর ব্যবস্থা করিবার জন্য Nitrogen প্রভৃতি রাসায়নিক পদার্থ যোগাইতে পারিলেই আমরা সাধারণতঃ মনে করি যে, বৈজ্ঞানিক উপায়ে যত দূর সম্ভব কার্য্যনির্ব্বাহের চেষ্টা করা গেল। কিন্তু রসায়নবিদ্যার পার্শ্বে যে এ ক্ষেত্রে বিহঙ্গতত্ত্বকে আসন দিতে হইবে, তাহা মনে রাখিয়া কার্য্যারম্ভ করিলে অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে অধিকতর সুফল পাওয়া যাইতে পারে। জমিতে সার দিতে হইলে রাসায়নিক পণ্ডিতের সাহায্য যদি সকল সময়ে লইতে হয়, তাহা হইলে পয়সা খরচের অন্ত থাকে না। Economic হিসাবে অন্য ভাল উপায় থাকিলে, যদি তাহাতে বাস্তবিক অপেক্ষাকৃত কম খরচে ভাল ফল পাওয়া যায়, তবে কোনও কৃষিজীবী সেই অল্পব্যয়সাপেক্ষ উপায়টিকে উপেক্ষা করিয়া বহু ব্যয়সাধ্য রাসায়নিক প্রক্রিয়ার পন্থা অবলম্বন করিবে কেন? কি উপায়ে সহজে জমিতে সার দেওয়া যায়, কেমন করিয়া উপ্ত বীজকে রক্ষা করিতে পারা যায়, অঙ্কুরোদ্গমের পরেও কেমন করিয়া নানা নৈসর্গিক শত্রুর কবল হইতে উদ্ধার করিয়া কৃষক তাহাকে বর্দ্ধিত করিয়া তুলে, এই সমস্ত বিষয়ের পর্য্যালোচনা করিতে গেলে পক্ষীকে বাদ দেওয়া চলে না। যদি রাজপুরুষেরা বৈজ্ঞানিক হিসাবে পাখী লইয়া কৃষককে কর্ম্মক্ষেত্রে নামাইয়া দেন, তাহা হইলে অপেক্ষাকৃত সহজ উপায়ে ও অল্প সময়ের মধ্যে একটা বড় রাষ্ট্রীয় সমস্যার সমাধান হইয়া যায়। মাটির মধ্যে কীটপতঙ্গ শস্যের বীজ নষ্ট করিতে প্রবৃত্ত হইলে বাছিয়া বাছিয়া এমন কতকগুলি পাখীকে সেইখানে ছাড়িয়া দিতে হইবে, যাহারা স্বভাবতঃ সেই সমস্ত কীটপতঙ্গের জাতশত্রু। বাছিয়া বাছিয়া পাখী ছাড়িয়া দেওয়ার কথায় যেন না মনে করেন যে, যেখানে কীটের উৎপাত অত্যন্ত অধিক, সেখানে খাঁচা হইতে পাখী বাহির করিয়া দিয়া সেগুলিকে নষ্ট করার পর আবার তাহাকে খাঁচায় পুরিয়া ফেলিতে হইবে। এ প্রকার ছেলেমানুষী ব্যবস্থা নিতান্তই হাস্যজনক। কথাটা এই যে, কতকটা প্রাকৃতিক নিয়মের বশে কতকটা বা মানুষের নিষ্ঠুরতার ফলে স্থানবিশেষে কোনও কোনও পাখী ধ্বংস প্রাপ্ত হয়, তখন কৃষিকার্য্যের বাধা জন্মাইবার জন্য যে সকল কীটের প্রাদুর্ভাব হয়, তাহাদিগকে সহজে নষ্ট করা এক প্রকায় দুঃসাধ্য হইয়া উঠে। পাশ্চত্য সমাজ অনেক স্থলে ঠেকিয়া শিখিয়াছে যে, পতত্রের লোভে অথবা খেলার ছলে অথবা আহার্য্যে পরিণত করিবার জন্য পাখীর প্রাণসংহার করিয়া মানুষকে economic হিসাবে এত ঠকিতে হইয়াছে যে, রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থা ব্যতীত তাহা সাম্লাইবার উপায় থাকে না। নিউ সাউথ্ ওয়েল্স্এর ভূতপূর্ব্ব প্রধান সচিব স্যর যোসেফ্ ক্যারুথস্ পাখীর উপকারিতা সম্বন্ধে অষ্ট্রেলিয়ার একখানি পত্রিকায়[৫] (১৯১৭ খৃঃ অব্দের অক্টোবর মাসে) মার্কিণ দেশের অভিজ্ঞতার বিষয় এইরূপে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন,—মার্কিণের যুক্ত রাষ্ট্রে সরকারি বিশেষজ্ঞেরা হিসাব করিয়া দেখিয়াছেন যে, কীট এবং মূষিকের উৎপাতে বৎসরে তিন শত কোটি টাকার লোকসান হয়; সেই সকল কীট ও মূষিক কিন্তু পাখীর কাছে সাধারণতঃ জব্দ থাকে। কোনও কারণে একবার মার্কিণের ইণ্ডিয়ানা ও ওহাইয়ো প্রদেশে কীটবৈরী কয়েকটি পাখীর উচ্ছেদসাধন করা হয়; সেই বৎসরেই প্রায় ষাট লক্ষ বিঘা জমির সমস্ত গম কীটেরা নষ্ট করিয়া ফেলে। অবশ্যই ইহার ফল দাঁড়াইল এই যে, লক্ষ লক্ষ মণ গম নষ্ট হইল এবং সঙ্গে সঙ্গে আটা ময়দারও দাম চড়িয়া গেল। পেন্সিল্ভ্যানিয়া (Pennsylvania) প্রদেশে আইনের দ্বারা পেচক ও শ্যেনের প্রাণসংহারের ব্যবস্থা করা হইল। কয়েক বৎসরের মধ্যে প্রায় দুই লক্ষ প্যাঁচা ও বাজ মারা হইল; এ দিকে ইঁদুরের সংখ্যা এত বাড়িয়া গেল যে, বহু লক্ষ টাকার শস্য তাহারা নষ্ট করিয়া ফেলিল। তখন নূতন আইন করিয়া ঐ সকল পাখী মারা বন্ধ করিতে হইল। পানামা খালের কাছে এত বিষাক্ত কীট আছে যে, প্রেসিডেণ্ট উইল্সন্ হুকুম জারি করিয়াছেন, সেখানে কোনও বন্য বিহঙ্গের প্রাণসংহার করা যেন না হয়। লর্ড কিচ্নার যখন মিশরদেশ শাসন করিতেছিলেন, তখন খেদিভ্কে দিয়া একটা আদেশ প্রচার করান যে, কোনও কীটভুক্ পাখীকে ধরিলে বা মারিলে কিম্বা তাহার ডিম্ব নষ্ট করিলে, শাস্তি পাইতে হইবে। এইখানে বলা আবশ্যক যে, বকজাতীয় পক্ষী তুলার পোকা (cotton worm) খাইয়া ফেলে; অথচ এই বকের পতত্রের লোভে মিশরের লোকে ইহার প্রাণসংহার করিত। আমাদের দেশে বড় বড় নদীর বাঁধ অনেক সময়ে শঙ্খশম্বুকাদির দ্বারা জখম হইবার সম্ভাবনা থাকে। এস্থলেও ঐ বকজাতীয় পাখী সেই সকল বাঁধগুলিকে শম্বুকাদির কবল হইতে রক্ষা করিয়া থাকে।
কৃষিবিভাগের কিম্বা পূর্ত্তবিভাগের দিক্ দিয়া দেখিলে, পাখীর আবশ্যকতা যে কত বেশী, তাহা বোধ হয় কতকটা বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু পক্ষী সম্বন্ধে ষ্টেটের দায়িত্ব যে এইখানেই পর্য্যবসিত হইল, তাহা মনে করিলে ভুল হইবে। বন জঙ্গল ভাল করিয়া রক্ষা করা ষ্টেটের প্রধান কর্ত্তব্যের মধ্যে গণ্য। নানা কারণে বৈজ্ঞানিকগণ স্থির করিয়াছেন যে, দেশের শুভাশুভ অনেকটা বনস্পতির উপর নির্ভর করে। অতএব ষ্টেটের দেখা উচিত যে, কোন রকমে দেশের বড় বড় বনগুলির অনিষ্ট না হয়। সেই জন্য বন জঙ্গলের রক্ষণাবেক্ষণের ভার সরকারি কর্ত্তৃপক্ষকে লইতে হইয়াছে; দেশের শাসনতন্ত্রের মধ্যে Forestry নিতান্ত নগণ্য বিভাগ নহে। ভূয়োদর্শনের ফলে ইহা প্রতিপন্ন হইয়াছে যে, অযাচিতভাবে পাখীর সাহায্য পাইয়া বনগুলিকে বিলাশের হাত হইতে রক্ষা করা হইয়াছে। যখনই কোনও কারণে বিশেষ বিশেষ উপকারী পাখীর অভাব ঘটে, তখনই দেখা গিয়াছে যে, অন্যান্য অনর্থের মধ্যে বনস্পতির ক্ষয় বিষম মারাত্মক হইয়া উঠে। পাখীর সহিত বনস্পতির এই সম্পর্কের মূলে কতকগুলা দুষ্ট কীট রহিয়াছে; সেই কীটগুলাই অলক্ষ্যে গাছপালার শনি হইয়া দাঁড়ায়। এমন কি, গাছের গুঁড়ি ফুটা করিয়া বৃহৎ কাণ্ডটাকে ফোঁপ্রা করিয়া ফেলে। আমাদের কথাসাহিত্যে সেই সমস্ত তরুকোটরে বিচিত্র কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। কেমন করিয়া কখন এই তরুকোটর দেখা দিল, তাহার কোনও ইতিহাস সেই সাহিত্যের মধ্যে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। সে যাহা হউক, প্রকাণ্ড গাছের গুঁড়ি ফাঁপা হইয়া গেলে, গাছটাই অসার হইয়া পড়িল; তাহার বার্ত্তাশাস্ত্রের ভাষায় বলিতে গেলে economic utility অনেক কমিয়া গেল। প্রকৃতির বিচিত্র বিধানে কীটভুক্ কাঠঠোক্রা পাখী গাছের গুঁড়ি হইতে চঞ্চুপুট সাহায্যে দুষ্ট কীটগুলিকে নষ্ট করিয়া দিয়া গাছটিকে রক্ষা করে। যে পেচককে লোকে সাধারণতঃ এত ঘৃণা করে, সেই নিশাচর পাখীটি মূষিকাদির প্রাণসংহার করিয়া দেশের প্রভূত কল্যাণ সাধন করে। কৃষিবিভাগে এবং জঙ্গলবিভাগে এই মূষিকের উৎপাত এত বেশী যে, সংস্কৃতশাস্ত্রে ইহাকে ছয়টা প্রধান উৎপাতের মধ্যে অন্যতম বলিয়া পরিগণিত করা হইয়াছে,—
অতিবৃষ্টিরনাবৃষ্টিঃ মূষিকাঃ শলভাঃ শুকাঃ।
অত্যাসন্নাশ্চ রাজানঃ ষড়েতা ঈতয়ঃ স্মৃতাঃ॥
এই মূষিকধ্বংসকারী পেচক অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে থাকিয়া মানুষের অজ্ঞাতসারে মানবসমাজের উপকার সাধন করে বটে, কিন্তু আমরা মূঢ়তাবশতঃ আমাদের উপকারী বন্ধুগুলিকেই অনেক সময়ে বিনষ্ট করিয়া ফেলি। আর যে শুক পাখীকে আমাদের দেশে একটা ভয়ঙ্কর ঈতি বলিয়া বিশেষিত করা হইয়াছে, যাহাকে বিদেশীয় পক্ষিতত্ত্ববিদ্গণ ‘the greatest bird-pest we have in India’ বলিয়া অভিহিত করিয়া থাকেন, সে আমাদের অত্যন্ত প্রিয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সকল প্রকার শস্য ও ফলমূল নষ্ট করিতে শুকের সমকক্ষ কেহ নাই। অথচ সেই শুক আমাদের গানে ও গল্পে, ঘরে ও বাহিরে, সমাজের সহিত প্রীতিবন্ধনে গ্রথিত হইয়া আছে।
দেশের আপামর সাধারণের খাদ্যের ব্যবস্থা করা ষ্টেটের প্রধান কর্ত্তব্য। একটু ভাবিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারা যাইবে যে, খাদ্য হিসাবে পক্ষিপালন করা ষ্টেটের কর্ত্তব্য। অন্ততঃ পাশ্চাত্য ভূখণ্ডে ও চীন, জাপান, মিশর প্রভৃতি দেশে মানুষের খাদ্যের জন্য পক্ষিপালনের ব্যবস্থা আছে; ষ্টেট যে সর্ব্বত্রই প্রত্যক্ষভাবে পাখী লইয়া farming আরম্ভ করিয়া দেয়, এমন কথা আমি বলিতেছি না; তবে অনেক প্রকারে ইহার সাহায্য করিয়া থাকে।
এ পর্য্যন্ত যতটুকু আলোচনা করিলাম, তাহাতে সহজেই অনুমান করা যাইতে পারিবে যে, কোনও বিধ্বস্ত দেশের পুনরুদ্ধারকল্পে সেই দেশবাসীর সমগ্র শক্তি নিয়োজিত করিতে হইলে, যদি সম্পূর্ণরূপে সুফললাভের প্রত্যাশা করিতে হয়, তাহা হইলে মানবেতর বিহঙ্গকে বাদ দিলে চলিবে না। যদি স্বদেশের মাটি, স্বদেশের জল, স্বদেশের ফুল, স্বদেশের ফলকে ধন্য করিতে চান, তাহা হইলে মানুষকে নিজের সমাজবদ্ধ সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর বাহিরে আসিয়া পাখীর সহিত অনেক স্থলে মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ হইতে হইবে, আবার কোনও কোনও স্থলে বৈরিভাব স্থাপন করিতে হইবে। বেল্জিয়মের মত দলিত ভূখণ্ডকে সুজল, সুফল, শস্যশ্যামল করিতে হইলে, কেমন করিয়া সেই কার্য্যে ব্রতী হইতে হইবে, তাহার সম্যক্ আলোচনার স্থান ও সময় আমাদের এখন নাই; তবে পক্ষিতত্ত্বের দিক্ হইতে কতকটা পথনির্দ্দেশের চেষ্টা করিলে, তাহা বোধ হয়, ধৃষ্টতার পরিচায়ক হইবে না। তাই আজ যখন চারিদিকে Reconstruction ও Reparationএর কথা শুনিতে পাই, তখন স্বতঃই এই প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে জাগিয়া উঠে ষে, সাড়ে চার বৎসর ধরিয়া লক্ষ লক্ষ গুলি-গোল ও বোমায় যে সকল মানবসহায় পাখী বিনষ্ট ও দেশ হইতে বিতাড়িত হইয়া গেল, তাহার কোনও reparation হইবে কি?