পাখীর কথা/দ্বিতীয় ভাগ/পাখীর খাঁচা না পাখীর আশ্রম?
পাখীর খাঁচা না পাখীর আশ্রম?
বিধ্বস্ত বেল্জিয়মের পুনর্গঠন প্রসঙ্গে যে সকল মানব-সহায় বিহঙ্গের আভাস আমরা পূর্ব্বে দিয়াছি, তাহাদের সহিত বাস্তব জীবনের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপন করা যে শুধু বিলাসবিভ্রমের অঙ্গ বলিয়া মনে করা উচিত, তাহা নহে। আমাদের সুখের সময় হয় ’ত তাহারা ভোগের নানা বিচিত্র সামগ্রীর মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাত্র একটা উপকরণরূপে পরিগণিত হয়;—মানবাবাসে পিঞ্জরস্থ বিহঙ্গে অভ্যস্ত হইয়া আমাদের চিত্তবৃত্তি হয় ’ত কতকটা বিকৃত হইয়া গিয়াছে, কিন্তু তাহাদিগকে যদি আমরা ভাল করিয়া জানিতে ও চিনিতে চেষ্টা করি, তাহা হইলে অনেক সময়ে আমাদের দেশের ও মানবসভ্যতার ইতিহাসের ধারা বিপথগামী হইতে পারে না। এত বড় কথা যদি কোনও Ornithologist জোর করিয়া বলেন, তাহা হইলে ইতিহাসজ্ঞ পণ্ডিতমণ্ডলী বিদ্রোহী হইয়া মাথা নাড়িতে পারিবেন না। পক্ষী সম্বন্ধে আমি কোনও প্রাচ্য অথবা পাশ্চাত্য পৌরাণিক কাহিনীর উল্লেখ করিতেছি না। সুদূর অতীতে কেমন করিয়া দুটি ভাই দুইটি গিরিশৃঙ্গে উপবেশন করিয়া, উড্ডীয়মান পাখীর গতি দেখিয়া একটা ক্ষুদ্র নদীর তীরে রোম নগরীর প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল; কেমন করিয়া পরে রোমের পুরোহিতমণ্ডলী বিহঙ্গদেহের অংশ বিশেষ পরীক্ষা করিয়া স্বদেশের ভাবী শুভাশুভ গণনা করিয়া বলিয়া দিতেন[১]; এই সমস্ত পৌরাণিক তথ্য আমাদের বৈজ্ঞানিক আলোচনার বিষয়ীভূত নহে; অথচ এই সমস্ত পৌরাণিক কাহিনী হইতে ইহা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, অতি প্রাচীন কালে রোমক সভ্যতার অভ্যুদয়ের পূর্ব্বে পাশ্চাত্য ভূখণ্ডে মানুষের সঙ্গে পাখীর নিবিড় সম্পর্ক দাঁড়াইয়া গিয়াছিল। পাখী যে মানবের সখা হইতে পারে তাহা ধরিয়া লওয়া হইয়াছিল। যে পাখীকে বলি দেওয়া হইত, তাহার অন্ত্র পরীক্ষা করিয়া পুরোহিত stateকে কোনও কার্য্যে ব্রতী হওয়া উচিত কি না—বলিয়া দিতে পারিতেন; অথবা আকাশমার্গে স্বাধীন পাখীর বিচরণ ও গতিভঙ্গি লক্ষ্য করিয়া মানুষের ভবিষ্যৎ ভালমন্দ বিচার করিতে বসিতেন। সমগ্র রোমক সমাজ বহু দিন ইহা মানিয়া চলিয়াছিল; কিন্তু ইহার পশ্চাতে কোনও নিগূঢ় রহস্য আছে কি না—বিহঙ্গতত্ত্বের দিক্ হইতে তাহার আলোচনা আপাততঃ নিষ্প্রয়োজন।
সে কথা যা’ক্। য়ুরোপে মধ্যযুগে অভিজাত-সমাজের যুবকগণ অশ্বপৃষ্ঠে শিকার করিবার জন্য বাম বাহু-প্রকোষ্ঠের উপরে যে শ্যেন পক্ষী লইয়া বাহির হইত, তাহা তৎকালীন পাশ্চাত্য অভিজাত-সমাজের ইতিহাসের সামগ্রী হইয়া গিয়াছে; সে প্রসঙ্গেরও উত্থাপন করিতে চাহি না।
কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যাঁহার প্রতিভায় ও সমরনৈপুণ্যে জগৎ চমকিত হইয়া গিয়াছিল, সেই বীরশ্রেষ্ঠ নেপোলিয়ানের জীবনের ইতিহাস বিবৃত করিতে বসিয়া ফরাসী ইতিহাস-রচয়িতা আক্ষেপ করিয়া বলিয়াছেন,—হায়! যদি ১৮১১ খৃঃ অব্দের সেপ্টেম্বর মাসে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট পাখীর গতিবিধি লক্ষ্য করিতেন! সারস জাতীয় পাখীগুলি দলে দলে য়ুরোপ-ভূখণ্ডে উত্তর হইতে দক্ষিণ দিকে প্রয়াণ করিতেছিল; তবুও তাঁহার চোখ ফুটিল না; তারা যে দারুণ শীতের আগমন বার্ত্তা ঘোষণা করিল—তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন না; সম্রাটের নিকটে এই যাযাবর খেচরের দৌত্য ব্যর্থ হইয়া গেল। তাহারা অপেক্ষাকৃত উষ্ণ দক্ষিণে আশ্রয়লাভ করিয়া বাঁচিল;—আর নেপোলিয়ন রহিলেন—মস্কো নগরীতে! * * * নেপোলিয়নের জীবনের করুণতম tragedy সম্ভাবিত হইত না, যদি তিনি একবার চোখ মেলিয়া পাখীর গতিবিধি পর্য্যবেক্ষণ করিতেন।
নেপোলিয়নকে দোষ দিলে চলিবে না। পাখীর গতিবিধি ভাল কবিয়া পর্য্যবেক্ষণ করা আবশ্যক এ কথা মানব-সমাজে কয়জন স্বীকার করিয়া থাকেন? এই বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানগৌরবের দিনে যাঁহারা এ কথা স্বীকার কবেন, তাঁহাদের মধ্যে কয়জন পর্য্যবেক্ষণের উৎকৃষ্ট রীতি অবগত আছেন? তবে একটু সুলক্ষণ এই যে, নানা কারণে স্বার্থপর মানবসমাজের মধ্যে অনেকে অনেক প্রকারে পাখীর জীবন-লীলা যথাসম্ভব আগাগোড়া দেখিবার চেষ্টা করিতেছেন। প্রধানতঃ আমরা এ স্থলে দুই শ্রেণীর পর্য্যবেক্ষক দেখিতে পাই;—একদল লোক আছেন যাঁহারা বাড়ীতে পাখী পুষিয়া পিঞ্জরমধ্যে অথবা কৃত্রিম পক্ষিভবনে পক্ষিজীবনের ইতিহাস আলোচনা করিবার সুযোগ পাইতে চেষ্টা করেন। আর এক শ্রেণীর তত্ত্বজিজ্ঞাসু নিজের গৃহে বনবিহঙ্গকে না আনিয়া নিজ গৃহ ছাড়িয়া বনে জঙ্গলে মুক্ত আকাশতলে স্বাধীন বিহঙ্গজীবন নিরীক্ষণ করিবার উপায় উদ্ভাবন করিতেছেন। আমাদের মধ্যে অনেকেই গোড়া হইতে প্রথম শ্রেণীভুক্ত হইয়া পড়ি। অনেকের মধ্যে এইরূপ ধারণা দাঁড়াইয়া গিয়াছে যে, এই প্রকারে পাখীকে আমাদের অত্যন্ত নিকটে টানিয়া আনিতে পারিলে এবং যথারীতি পরিচর্য্যা করিয়া তাহাকে কিছুদিন বাঁচাইয়া রাখিতে পারিলে তাহার সম্বন্ধে সমস্ত জ্ঞাতব্য বিষয় সম্যক্রূপে জানিবার যত সুবিধা হয়, তত আর কিছুতেই হয় না। এই শ্রেণীর পণ্ডিতগণের মধ্যে যাঁহারা অগ্রণী তাঁহাদের এ ধারণা এখনও অনেকটা অটল রহিয়াছে।
কিন্তু ইহাকে টলাইবার চেষ্টা সুরু হইয়াছে। পুরাতন সংস্কারের ভিত্তি পাকা নহে, এই কথাই নব্যতন্ত্রের পর্য্যবেক্ষকসম্প্রদায় জোর করিয়া ঘোষণা করিতেছেন। এমন ভাবে করিতেছেন যে, তাঁহারা যেন বলিতে চাহেন যে, প্রাচীন মতাবলম্বী কুসংস্কারাপন্ন aviculturist তাঁহাদের করুণার পাত্র; অনেক খরচ পত্র করিয়াও তাঁহারা এতদিন বিহঙ্গ-তত্ত্ব-জিজ্ঞাসায় অধিক দূর অগ্রসর হইতে পারেন নাই; তাঁহাদের অবলম্বিত উপায় তাঁহাদিগকে অধিক দূর লইয়া যাইতে পারে না। তাঁহারা নিজেদের কিংবা পালিত পাখীদের ইষ্টসাধন করিতে কতদূর সমর্থ হইয়াছেন, তাহা বিচার করিতে বসিলে তাঁহাদের বিচক্ষণতার বেশী প্রশংসা করা যায় কি না সন্দেহ। তাঁহারা কি অস্বীকার করিতে পারেন যে, অনুকূল পরিবেষ্টনীর মধ্যেও তাঁহাদের সাধের খাঁচার পাখী অপেক্ষাকৃত অল্পায়ু হইয়া যায়? রুগ্ন হইয়া পড়ে? বিবর্ণ অথবা হীনবর্ণ হইবার সম্ভাবনা তাহাদের থাকে? তবে কেন আমরা সেই পাখীকে উড়াইয়া দিয়া কাননে-কান্তারে তাহার অনুসরণ করিয়া, আসল পাখীটির স্বরূপ পরিচয় পাইবার চেষ্টা করি না? তবে অবশ্যই স্বীকার করিতেই হবে যে, বনে জঙ্গলে স্বাধীন পাখীর গতিবিধি, উড়িবার ভঙ্গী ও নীড়রচনার পদ্ধতি ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিবার ব্যবস্থা না করিলে, কেবল পাখীটিকে জঙ্গল হইতে ধরাইয়া আনিয়া মানবাবাসে নানা উপায়ে পোষ মানাইবার চেষ্টা করিয়া, তাহার গতিবিধি ও উড়িবার ভঙ্গী পর্য্যবেক্ষণ করিবার চেষ্টা করায়, বৈজ্ঞানিক হিসাবে সুফল লাভের প্রত্যাশা থাকিতে পারে না। নীড়রচনার কথা’ত আমাদের পক্ষিগৃহমধ্যে তত্ত্বজিজ্ঞাসুর পক্ষে না তুলিলেই ভাল; কারণ, মানবরচিত নীড়গুলি যে সকল রকমে কৃত্রিম দাঁড়াইয়া যায়—ইহা মানিয়া লইতেই হইবে। যথাসম্ভব হিসাব করিয়া আমরা যে বাসাটি পাখীর উপযোগী বিবেচনা করিয়া সযত্নে নির্ম্মাণ করিলাম (এবং তাহা না করিলে নয়) তাহা যে ঠিক বনে-জঙ্গলে গাছের পাতার অন্তরালে অথবা ঝোপের মধ্যে, তরুকোটরে, গুহাভ্যন্তরে অথবা গৃহবলভিতে বিভিন্ন শ্রেণীস্থ পক্ষীর স্বরচিত কুলায়ের অনুরূপ সর্ব্বতোভাবে হয়, এরূপ মনে করা চলে না। তবে যে আমাদের রচিত বাসাগুলির ভিতর পাখীয়া অল্প সময়ের মধ্যে জীবন যাপন করিতে অভ্যস্ত হইয়া যায়, এই adaptability অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক অনুকূল অবস্থার সহিত অনায়াসে অথবা অল্প আয়াসে মিলাইয়া চলিবার ক্ষমতা না থাকিলে তাহারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হইত। কিন্তু তাই বলিয়া বিহঙ্গতত্ত্বজিজ্ঞাসু, এই প্রকার পক্ষিপালন-প্রথার ভিতর দিয়া বিহঙ্গতত্ত্বের অনুশীলন করা যে একমাত্র প্রকৃষ্ট উপায়—তাহা কেমন করিয়া বলিবেন? অতএব কি উপায়ে পাখীকে স্বাধীন অবস্থায় সম্যক্ভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আমাদের আলোচনার বিষয়ীভূত করা যাইতে পারে, তাহার উদ্ভাবন করা আবশ্যক। নব্য সম্প্রদায়ের বিহঙ্গবিৎ বলেন যে, সে উপায় উদ্ভাবিত হইয়াছে;—aviary পরিত্যাগ করিয়া sanctuaryর প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। এই sanctuary শব্দে সহজেই অনুমিত হইবে, পাখীর জন্য যে স্থানটি বিশেষ ভাবে রক্ষিত হইবে, তাহা অত্যন্ত পবিত্র বলিয়া মনে করা চাই। প্রাচীন গ্রীস্ দেশে যেমন কোনও ব্যক্তি মন্দির-মধ্যে আশ্রয় লইলে কেহ তাহার উপর বলপ্রয়োগ করিতে পারিত না, সেই sanctuary তাহাকে রক্ষা করিত; সেইরূপ এই অত্যন্ত আধুনিক bird-sanctuaryর মধ্যে যে কোনও পাখী আসে, কেহ তাহার হিংসা করিতে পাইবে না। একটা প্রকাণ্ড বাগান, নানা বৃক্ষলতাসমাচ্ছন্ন; বাগানের অধিকাংশ গাছের ফল পাখীর আহারের উপযোগী; সবুজ বৃক্ষপত্রান্তরালে তাহারা যথেচ্ছ বিচরণ অথবা বিশ্রাম লাভ করিতে পারে; যেখানে সুবিধা হয় সেখানে নিজ নিজ উপযোগী বাসা নির্ম্মাণ করে; সেই বাগানের মধ্যে জলজ উদ্ভিদশোভিত সরোবর জলচর অথবা উভয় পাখীর জন্য বিরাজ করে। পাখীকে আট্কাইয়া রাখিবার জন্য কোনও ব্যবস্থা করা হয় না; সে আসে, যায়, থাকে, গৃহস্থালী করে;—কোনও বাধা দেওয়া হয় না, কিন্তু তাহার আসা যাওয়া, থাকা ও ঘরকন্না করা, আগাগোড়া ভাল করিয়া দেখিবার জন্য সমস্ত আয়োজন করা হইয়া থাকে। পাখী যে যে খাদ্য খাইতে ভালবাসে তাহা বাগানের এমন স্থানে এমন ভাবে রাখা হয় যে তাহা অদূরবর্ত্তী বাতায়ন হইতে সহজেই মানুষের চোখে পড়িতে পারে। দূরবীক্ষণযন্ত্র-সাহায্যে সমস্ত খুঁটিনাটি লক্ষ্য করিয়া প্রত্যহ বিহঙ্গ-জীবনের ইতিহাস লিখিলে অনেক রহস্যের সদুত্তর পাওয়া যায়। দূরদেশ হইতে পাখী আসিয়া ইচ্ছামত যাহাতে বাসা করিতে পারে, তজ্জন্য ঝোপের মধ্যে অথবা বৃক্ষশাখায় কৃত্রিম মানবরচিত নীড়াধার বিলম্বিত অথবা সংলগ্ন করিয়া রাখা হয়। কোন্ যাযাবর পাখী বৎসরের কোন্ ঋতুতে বাগানে আসে, কিরূপে কতদিন সেখানে জীবন যাপন করিয়া কবে সেখান হইতে চলিয়া যায়; পরবৎসরে আবার সেই ঋতুতে সেই সময়ে বাগানে সে ফিরিয়া আসে কি না; পুরাতন অভ্যস্ত নীড়াধারের মধ্যে আবার নূতন করিয়া গৃহস্থালী পাতে কি না এবং ঋতুপরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় সে দেশান্তরিত হয় কি না;—পক্ষিজীবনের এই সমস্ত ছোট ছোট রহস্যময় ঘটনা এ ক্ষেত্রে এমন ভাবে দেখিবার যত সুযোগ হয়, তত আর কিছুতেই হয় না। প্রতিবৎসর এই সব বাগানে উড়িয়া আসিবার ও কিছুদিন অবস্থান করিবার অভ্যাস জন্মাইয়া গেলে কোনও কোনও যাযাবর পাখী হয় ’ত ঋতুপরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে আর তাহার পুরাতন বাসস্থানে প্রত্যাবর্ত্তন করে না, কালক্রমে তাহার যাযাবরত্ব অনেকটা কমিয়া যায় এবং স্বেচ্ছায় এই সব নূতন জায়গায় শাবক উৎপাদনে সে সঙ্কোচ বোধ করে না।
নব্যতন্ত্রদিগের এই বিহঙ্গাশ্রম ব্যাপারটি তুচ্ছ মনে করিলে তাহাদের সমস্ত উদ্যমের উপর অবিচার করা হইবে। বিশেষতঃ আমি পূর্ব্বে বলিয়াছি যে, এখন জগতের মধ্যে সর্ব্বত্রই মানবজীবনকে নূতন করিয়া গড়িয়া তুলিবার জন্য প্রবল চেষ্টা হইতেছে। এ অবস্থায় মানবসহায় বিহঙ্গকে যে-উপায়ে ভাল করিয়া চিনিতে পারা যায় এবং আমাদের উপকারে লাগাইবার জন্য তাহাকে আপদ্ বিপদ্ হইতে রক্ষা করিতে পারা যায়, তাহা যত্ন সহকারে আলোচিত হওয়া উচিত। এই যে আশ্রমের কথা উঠিয়াছে, ইহা বিশেষভাবে মার্কিন দেশে সুন্দররূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। পাখীকে মুক্ত করিয়া দেওয়া হউক, বিহঙ্গজাতি সম্বন্ধে এই Declaration of Independence মার্কিন দেশেই শোভা পায়। মার্কিন দেশের ভূতপূর্ব্ব প্রেসিডেণ্ট্ মিঃ রুজ্ভেল্ট হিংস্র জন্তু শিকার করিতে ভালবাসিতেন; তাঁহার মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব্বেও তিনি আফ্রিকায় মৃগয়া করিতে গিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি আজীবন পাখীর পরিচর্য্যা যে ভাবে করিয়াছিলেন এবং তাঁহার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া তাঁহার স্বদেশবাসী অনেক বালক ও প্রৌঢ় যেমন করিয়া পক্ষিরক্ষার চেষ্টা করিয়া আসিতেছে, তাহা ভাবিয়া দেখিলে অবাক্ হইতে হয়। মার্কিন দেশ ’ত য়ুরোপের মত এই মহাসমরে বিধ্বস্ত হয় নাই; তাহার Reconstruction সমস্যা উৎকটভাবে রাষ্ট্রনীতিজ্ঞের সমক্ষে উপস্থাপিত করা হয় নাই; কিন্তু তবুও তথায় স্বদেশের কল্যাণের জন্য পাখীর সেবায় মানুষকে রত থাকিতে দেখিয়া বিস্মিত হইবার কিছুই নাই। যে দেশ এই মহাসমরান্তে ক্ষুধিত মধ্য-য়ুরোপকে প্রায় শতকোটি মণ আহার্য্য সামগ্রী যোগাইয়াছে, তাহাকে উপযুক্ত পরিমাণে শস্যাদি উৎপন্ন করিবার জন্য সমস্ত প্রকৃষ্ট উপায় অবলম্বন করিতে হইয়াছে; এবং সেই শস্যাদিকে রক্ষা করিবার জন্য বিশেষভাবে যে পাখীর সাহায্য লইতে হইয়াছে তাহার সহিত নানা প্রকারে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রাখিতে হইয়াছে। তাই দেখিতে পাইতেছি যে, রুজ্ভেল্টের মৃত্যুর পরে যখন তাঁহার স্মৃতিরক্ষার আয়োজন করিবার চেষ্টা হইল, তখন অন্যান্য কথার মধ্যে তাঁহার এই পক্ষিপরিচর্য্যার কথাটার উল্লেখ করা হইয়াছে। তাঁহার সম্বন্ধে স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে যে, তিনি যৌবনে বৈজ্ঞানিকের মত পক্ষিসংগ্রহে ব্যাপৃত ছিলেন; প্রেসিডেণ্ট-পদ প্রাপ্ত হইয়া তিনি প্রতিপন্ন করিয়াছিলেন যে, পক্ষিরক্ষা করা রাষ্ট্রীয় কর্ত্তব্য; এবং স্বাধীন বন্য বিহঙ্গের জন্য একান্নটি বিহঙ্গাশ্রম রচনা করিয়াছিলেন[২]। যে দেশের কর্ত্তৃপক্ষেরা পক্ষিপরিচর্য্যাকে এরূপভাবে রাষ্ট্রীয় কর্ত্তব্য বলিয়া মনে করেন, সে দেশের ছেলেমেয়েদের জন্য বিদ্যালয়ে অথবা বিশিষ্ট সমিতিতে যে, পাখীর সহিত মানবশিশুর প্রীতির সম্বন্ধস্থাপনের চেষ্টা করা হইবে তাহা বিচিত্র নহে! এক একটা ক্লবে সভ্যসংখ্যা ২০/২২ হাজার। ওহিয়ো (Ohio) প্রদেশের অন্তবর্ত্তী একস্থানের কর্ত্তৃপক্ষেরা সম্প্রতি এই আদেশ প্রচার করিয়াছেন যে, সে স্থানের সমস্ত কোম্পানীর বাগান চিরকালের জন্য পাখীর আশ্রম বলিয়া বিবেচিত হইবে; এবং পাখীদের রক্ষণাবেক্ষণের ভার পল্লীবাসী বালক-বালিকার উপর ন্যস্ত করা হইল[৩]। শুধু যে ছোটখাট বিদ্যালয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের লইয়া পাখীর চর্চ্চা করা হয় তাহা নহে; কোনও কোনও Universityতে বিহঙ্গতত্ত্ব অধ্যাপনার জন্য বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত করা হইয়াছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠনের দিনে একথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, যদিও আমাদের দেশ কৃষিজীবীর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে, তথাপি কৃষকের সঙ্গে পাখীর সম্বন্ধ কত ঘনিষ্ঠ তাহা আমাদের কোনও রাষ্ট্রীয় অমাত্য অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বুঝিবার অথবা বুঝাইবার চেষ্টা করেন নাই। মার্কিনদেশে এই যে বালকবালিকাগণকে লইয়া পাখীর আলোচনা করা হয়, ইহা কেবল museumরক্ষিত পাখীর শব লইয়া নাড়াচাড়া করা নহে;—খাঁচার পাখীকে লইয়াও তাঁহাদের কাজ চলে না; একেবারে স্বাধীন মুক্ত বিহঙ্গকে বৈজ্ঞানিকভাবে দেখিতে ও দেখাইতে হইবে—এই উদ্দেশ্যে শিক্ষাব্যাপারে দেশের রাষ্ট্রীয় শক্তি নিয়োজিত হইয়াছে। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্যই বলুন আর দুর্ভাগ্যই বলুন, সে দিন শিমলা শৈলে, বড়লাট বাহাদুর আমাদের University Commission Report আলোচনা করিয়া বলিলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির সঙ্গে শিল্পের উন্নতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, অতএব নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দেশের ভাবী industryর উন্নতির কথা চিন্তা করিতে হইবে, কারণ এ যুগ industryর যুগ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির সঙ্গে মুখ্যভাবে কৃষিবিদ্যার সম্বন্ধ স্পষ্টতঃ উল্লেখ করেন নাই; সুতরাং কৃষিবিদ্যার উন্নতিকল্পে যে যে উপায় অবলম্বিত হওয়া উচিত, অন্ততঃ আধুনিক পাশ্চাত্য জগতে ঐ উদ্দেশ্যে যে যে উপায় অবলম্বিত হইয়াছে ও হইতেছে, সে সমস্ত প্রসঙ্গ আদৌ উত্থাপিত হইল না। শিল্পজীবী মার্কিন যখন কৃষিবিদ্যার উন্নতির কথা ভাবিতেছে, কৃষিজীবী ভারতবর্ষ কৃষিবিদ্যায় কোনও প্রকার উন্নতি সাধনের চেষ্টা না করিয়া শিল্পোন্নতির স্বপ্ন দেখিতেছে।
কিন্তু আমরা বিহঙ্গাশ্রমের কথা বলিতেছিলাম। State পাখীর জন্য স্বতন্ত্র বাগানের ব্যবস্থা করিয়া দিলেন; দেশের লোক নানাজাতীয় পাখীর আনাগোনা, চলাফেরা, স্নান, আহার, নিদ্রা প্রভৃতি নিরীক্ষণ করিবার সুযোগ করিয়া লইল; দেশের ছেলেমেয়েরা পাখীদের জন্য নীড়াধার রচনা করিয়া গাছের ডালে অথবা ঝোপের মধ্যে উহা রাখিয়া অসে; পাখীর আহারসামগ্রী রাখিবার জন্য স্বহস্তে টেবিল তৈয়ারি করিয়া বাগানের মধ্যে লইয়া গিয়া তাহার উপরে বন্য ফল ও শস্যাদি ছড়াইয়া দিয়া এমন স্থানে রাখিয়া আসে যে, অতি সহজেই এই খাদ্য-ব্যাপারের আগাগোড়া তাহাদের চোখে পড়ে।
নব্যতন্ত্রের অনুষ্ঠিত এই সকল ব্যাপারের উপকারিতা যথোচিত স্বীকার করিয়াও পুরাতন পক্ষিপালকগণ যে যে বিষয়ে তাঁহাদের চেষ্টার সার্থকতা এবং ইঁহাদের ত্রুটি ও বিচ্যুতি দেখা যায় তাহা খুব স্পষ্টভাবে প্রচার করিতে এখনও কুণ্ঠিত বোধ করেন না।
পাখীর আশ্রমের উপকারিতা সম্বন্ধে সাধারণতঃ যে সকল কথা বলা হয়, তাহা অবশ্যই এখনও বিচার করিয়া দেখা হয় নাই, কেবল সেই কথাগুলিই পাঠকবর্গকে সংক্ষেপে শুনাইবার চেষ্টা করিয়াছি। কেহ যেন মনে না করেন যে, আশ্রম কিংবা খাঁচার দলের মধ্যে একটা বিরোধ অথবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। উভয়েরই লক্ষ্য এক,—পাখীর সম্বন্ধে মানবের জ্ঞান যথাসাধ্য প্রসারিত করা। আদিম যুগে মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের প্রথম অবস্থায়, বনে, জঙ্গলে, মাঠে, ঘাটে পাখীর সঙ্গে মানুষের কি সম্বন্ধ ছিল, তাহা আমাদের এখন আলোচ্য বিষয় নহে। তবে সমাজবদ্ধ মানবের পৌর ভবনে সেই সকল পূর্ব্বপরিচিত বন্য বিহঙ্গের অনেকগুলি আশ্রয়লাভ করিয়া নানা প্রকারে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে লাগিল। তখন হইতে মানবাবাসে পাখীর জন্য খাঁচা ও বাসযষ্টির আবশ্যকতা অনুভূত হইয়াছিল। যে বন্য বিহঙ্গের সহিত মানুষ পূর্ব্বে সম্যক্রূপে পরিচিত হইতে পারে নাই, খাঁচায় রাখিয়া তাহার রীতিনীতি, গতিবিধি, আহার, উৎপতনভঙ্গী প্রভৃতি দেখিবার যথেষ্ট সুযোগ করিয়া লইয়াছে। তাহারই ফলে এতদিনে খাঁচার পাখী লইয়া aviculture বিজ্ঞানশাস্ত্রের অঙ্গীভূত হইয়া মানবের আনন্দ ও জ্ঞানবৃদ্ধির সহায়তা করিতে পারিয়াছে। ইহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। নবীন আশ্রমপন্থীরা ঠিক যে অস্বীকার করেন তাহা নহে; তাঁহারা বলিতে চাহেন যে, আবার খাঁচার পাখীকে বনের পাখী করিয়া দিলে, আমাদের অধিকতর জ্ঞানলাভ হইতে পারে এবং পাখীদেরও পক্ষে অধিকতর হিতকর হইতে পারে।
এখন বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে যে, বহু যুগ ধরিয়া মানবাবাসে পিঞ্জরস্থ বিহঙ্গকে চিনিয়া লইবার সুযোগ যদি আমাদের না হইত, তাহা হইলে আজ সেই বনের পাখীকে বনে উড়াইয়া দিয়া তাহার সম্বন্ধে কি কি বিষয়ে scientific observation হওয়া উচিত (যাহা আবদ্ধ অবস্থায় হয়ত ঠিক হইতে পারিত না) তাহা কি কেহ হিসাব করিয়া বলিতে পারিতেন? পিঞ্জর-মধ্যে কৃত্রিম পরিবেষ্টনীর ভিতরে পাখীর বর্ণ, কণ্ঠস্বর ও সাধারণতঃ জীবনের ইতিহাস—পুরুষানুক্রমে পর্য্যবেক্ষণ করিয়া আমাদের মনের মধ্যে হয়’ত এ প্রশ্ন উঠিতে পারে,—স্বাধীন বন্য অবস্থায় প্রকৃতির ক্রোড়ে লালিত হইয়া ইহার বর্ণ, কণ্ঠস্বর প্রভৃতির কোনও তারতম্য হয় কি না? কোনও পক্ষিতত্ত্ববিৎ এই প্রশ্ন এড়াইয়া যাইতে চেষ্টা করেন না। তাহা যদি করিতেন, তাহা হইলে তাঁহাদিগের উপর অবৈজ্ঞানিকতার দোষারোপ করা হইত। তাঁহারা বলেন যে, তাঁহাদের বহুযুগব্যাপী সাধনার ফলে পক্ষী সম্বন্ধে যে জ্ঞান সঞ্চিত হইয়াছে, তাহারই উপর নির্ভর করিয়া যদি কেহ কিছু নূতন কথা বলেন, তাহা বৈজ্ঞানিকভাবে যাচাই করিয়া লওয়া আবশ্যক; দেখিতে হইবে যে নূতন কিছু জোর করিয়া বলিলে টিকিবে কি না। এই সে একটা রব উঠিয়াছে,—খাঁচার পাখীকে স্বাধীনতা দেওয়া হউক, তাহা হইলেই তাহার যথার্থ স্বরূপ জানিতে পারা যাইবে,—ইহার মূলে কতটা সত্য নিহিত আছে ভাবিয়া দেখিলে এমন অনেক কথা আসিয়া পড়ে, যে সম্বন্ধে পাকাপাকি কোনও মন্তব্য করা কঠিন। কয়েকটি প্রশ্ন তুলিয়া যদি পাঠকের উপরে বিচারের ভার দেওয়া যায়, তাহা হইলে বিষয়টির গুরুত্ব সহজেই উপলব্ধি করা যাইবে:—(১) মানবাবাসে খাঁচার মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় থাকিয়া কোনও কোনও পাখী কি প্রকৃতিদত্ত স্বীয় বর্ণ হারাইয়া একটা সম্পূর্ণ নূতন বা নূতনে পুরাতনে মিশ্রিত কোনও বিচিত্র বর্ণ প্রাপ্ত হয়? (২) যদি কোনও কোনও ক্ষেত্রে অনুকূল অবস্থা বশতঃ এইরূপ হইতে দেখা গিয়া থাকে, তাহা হইলে বিশেষ অনুসন্ধানের বিষয় এই যে প্রকৃতির মুক্ত প্রাঙ্গণে এরূপ বর্ণবিপর্য্যয় সঙ্ঘটিত হয় কি না? (৩) Melanism অথবা অসিত-বরণ-প্রাপ্তিপ্রবণতা এবং albinism অথবা সিতবরণ-প্রাপ্তিপ্রবণতা যে বন্য অবস্থায় পক্ষিজাতির মধ্যে আদৌ অপ্রতুল নহে, একথা কেহ অস্বীকার করিতে পারেন কি? (৪) Hybridism বা বর্ণসাঙ্কর্য্য যে খাঁচার পাখীর একচেটিয়া নহে, তাহা পক্ষিতত্ত্বজ্ঞ মাত্রেই অবগত আছেন কি? (৫) খাঁচার পাখী অনেক সময়ে মানুষের গীতবাদ্য অথবা অন্য পক্ষীর কণ্ঠস্বর যেমন অনুকরণ করিয়া থাকে, স্বাধীন অবস্থায়ও সেইরূপ করিতে দেখা যায় না কি?
এখন যদি বিচার করিয়া দেখা যায় তাহা হইলে ইহা সহজেই বুঝিতে পারা যায় যে, খাঁচার সাহায্যে মানবালয়ে পক্ষিপালন-প্রথা যুগ-যুগান্তর ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে বলিয়া তাহার বর্ণ, স্বর, বর্ণসাঙ্কর্য্য প্রভৃতি সম্বন্ধে আমাদের যে জ্ঞান সঞ্চিত হইয়াছে, তাহারই সাহায্যে আমরা অবস্থান্তরে স্বাধীন বন্য বিহঙ্গের বর্ণ, স্বর ও বর্ণসাঙ্কর্য্যের বিষয়ে সম্যক্ আলোচনা করিতে সমর্থ হইয়াছি। পক্ষিবিজ্ঞান-শাস্ত্রে এইরূপ সাধনার ফলে সুধীগণ অনেকগুলি data লইয়া নানা দিক্ হইতে পাখীর জীবনরহস্য-যবনিকা উদ্ঘাটিত করিবার প্রয়াস পাইতেছেন। সেই সমস্ত dataর যাথার্থ্য বৈজ্ঞানিক কষ্টিপাথরে পরীক্ষা করিবার জন্য যদি একদল নবীন তত্ত্বজিজ্ঞাসু “আশ্রমের” কথা তুলিয়া থাকেন, তাহাতে avicultureএর—পিঞ্জরস্থ-পক্ষিপালনের—অগৌরব কিছুই নাই। কারণ, পিঞ্জরে পাখী পোষার ব্যবস্থা না থাকিলে মানুষের পক্ষে পাখীকে ভাল করিয়া পর্য্যবেক্ষণ করা সম্ভবপর হইত না। পাখীকে মানুষের আলয়ে রাখায় শুধু যে সে একটা আনন্দের উপাদান হইয়া আছে তাহা নহে; সে আমাদের অনেক অজ্ঞতা ও ভ্রান্ত বিশ্বাস দূর করিয়া আমাদের জ্ঞানের পথ এমন ভাবে প্রসারিত করিয়া দিয়াছে যে, মানব-সভ্যতা-বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পক্ষিপালন-প্রথা অথবা avicultureএর ক্রমোন্নতি হইয়া আসিতেছে। এখন যদি এমন অবস্থা দাঁড়াইয়া থাকে যে পিঞ্জরের মধ্যে অথবা গৃহবলভিতে আশ্রিত পক্ষী সম্বন্ধে যত কিছু জানা সম্ভবপর তাহা জানা হইয়াছে, যুগ-যুগান্তর ধরিয়া যে ভাবে aviculture করিয়া আসা হইতেছে তাহার চরম পরিণতিতে আর কিছু নূতন তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইবার সম্ভাবনা নাই, তাহা হইলে তত্ত্বজিজ্ঞাসা অবশ্যই একেবারে প্রতিহত হইয়া যে স্তব্ধ হইয়া পড়িবে এমন নহে;—নিশ্চয়ই কোনও নূতন পথ অবলম্বনে পক্ষিজীবনের বিচিত্র ইতিহাস অভিনব উপায়ে পর্য্যালোচনা করিবার চেষ্টা হওয়া বিস্ময়ের বিষয় নহে। এরূপ না হইলেই অন্যায় হইত; বিজ্ঞান-শাস্ত্রের ইতিহাসে সর্ব্বত্রই এই ভাবে ধারাবাহিকতা রক্ষিত হইয়া আসিতেছে; কেহ কোথাও কখনও নিশ্চল হইয়া দাঁড়ায় না; সমস্যা যতই জটিল হউক না কেন, নানা দিক্ হইতে তাহার উপর রশ্মিপাত করিতে পারিলে খাঁটি সত্য পাওয়া যাইতে পারে। এখন দেখিতে হইবে যে, বিহঙ্গতত্ত্ব-জিজ্ঞাসা যে রেখা ধরিয়া এতদিন চলিয়া আসিয়াছে, আজ কি তাহার এমন চরম সফলতা হইয়াছে, অথবা অত্যন্ত করুণ নিষ্ফলতা প্রকাশ পাইয়াছে যে, সেই সফলতা অথবা ব্যর্থতার জন্য মানুষের চিন্তার ধারা অথবা পর্য্যবেক্ষণের রীতি রেখান্তরে বিন্যস্ত হইবে? এক কথায় ইহার সদুত্তর দেওয়া কঠিন; অবশ্যই গোঁড়ামীর পক্ষে আদৌ কঠিন নহে, কারণ তখন জোর করিয়া হাঁ অথবা না বলা যাইতে পারে। কিন্তু বাস্তবিক এখন পর্য্যন্ত সফলতা ও ব্যর্থতা সম্বন্ধে খোলসা ভাবে শুধু হাঁ কিম্বা না বলা চলিবে না। কে বলিবে যে, অতীতের সমস্ত চেষ্টার পরিপূর্ণ পরিণতি হইয়াছে অথবা সবটাই ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত হইয়াছে? হয়’ত পক্ষী সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ আছে, তাই বলিয়া তাহার যতটা পরিচয় আমরা পাইয়াছি তাহাতে aviculturistএর চেষ্টা ব্যর্থ হয় নাই—ইহা নিশ্চয়। তাহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন, তাহার বর্ণ, তাহার কণ্ঠস্বর, নীড়নির্ম্মাণে নিপুণতা অথবা অক্ষমতা, ঋতুবিশেষে পক্ষিদম্পতির গৃহস্থালী, বাসাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখিবার চেষ্টা, আহার, নিদ্রা প্রভৃতি যত কিছু খুঁটিনাটি সমস্তই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখিবার সুযোগ খাঁচার ব্যবস্থা না থাকিলে কি পাওয়া যাইত? তাই অনেকের কাছে পাখীর জীবন-কাহিনীতে অনাবিষ্কৃত বিশেষ কোনও রহস্য নাই বলিয়া প্রতীয়মান হইতে পারে। তবে এই যে “আশ্রমের” কথা উঠিয়াছে, ইহার বিরুদ্ধে আমাদের বিশেষ কিছু বলিবার আবশ্যকতা নাই বটে, কিন্তু খাঁচায় পোষা পাখী সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা না থাকিলে বনের পাখীকে আবার বনে ছাড়িয়া দেওয়া হউক একথা উঠিতে পারিত না; অর্থাৎ তাহার সম্বন্ধে আবদ্ধাবস্থায় আমাদের সঞ্চিত জ্ঞান অভ্রান্ত সত্য কি না—তাহা পরীক্ষা করিতে হইলে তাহাকে মুক্তি দিয়া তাহার অবয়ব, বর্ণ-বৈচিত্র্য, কণ্ঠস্বর, নীড়রচনা, গৃহস্থালী প্রভৃতি বৈজ্ঞানিকভাবে দেখিবার চেষ্টা করা উচিত।
বেশ কথা। ইহাতে আপত্তি করিবার কিছুই নাই। সুব্যবস্থা করিতে পারিলে ইহাতে সুফলের প্রত্যাশা করা যাইতে পারে। কিন্তু এতদিনকার aviculture এর কাছে শুধু এই নবীন সম্প্রদায় কেন, সমস্ত মানবসভ্যতা কি অন্য কোনও প্রকারে ঋণী নহে? যে পাখী লইয়া এতদিন আমরা নাড়াচাড়া করিয়া আসিতেছি, তাহা সাধারণ Biology অথবা জীবতত্ত্ব বিষয়ে আমাদের জ্ঞান কতটা প্রস্ফুট করিয়া সভ্যজগতের চিন্তার ধারাকে বহুধা প্রসারিত করিয়া দিয়াছে, সে কথা না হয় এখন নাই তুলিলাম; কিন্তু মানব-সভ্যতার ইতিহাস হইতে তাহা যদি বাদ পড়িয়া যায়, তাহা হইলে সে কাহিনী অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে। আর এক কথা এই যে, বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাপ্রশাখার সঙ্গে বিহঙ্গতত্ত্ব ঘনিষ্টভাবে সম্বদ্ধ। সম্প্রতি এক জন পাশ্চাত্য লেখক একখানি পক্ষিতত্ত্ববিষয়ক পত্রিকায়[৪] এইরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন:—Our science is capable of indefinite expansion, and by no means limited to the mere keeping of live birds. The study of living creatures is of the greatest service not only to the arts ancillary to zoology (such as taxidermy) but also to remoter pursuits, such as agriculture and medicine.—পাঠক লক্ষ্য করিয়া দেখিবেন যে, এই সম্পাদকীয় মন্তব্যে Science শব্দটা পরিষ্কার ব্যবহৃত হইয়াছে; এবং লেখক মহাশয় বলিতে চাহেন যে, অন্যান্য exact scienceএর সহিত aviculture সম্পর্ক পাতাইয়া বসিয়াছে; এমন ভাবে বসিয়াছে যে, পাখীকে ভাল করিয়া না জানিলে আরও কয়েকটী বিদ্যা অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়। কথাটা খুব বড়, কিন্তু বৈজ্ঞানিক পক্ষিতত্ত্ববিৎ অকুণ্ঠিতভাবে ইহা প্রচার করিতেছেন। মনে রাখিতে হইবে যে রীতিমত খাঁচায় পুরিয়া পক্ষিপালন প্রথা ধারাবাহিকভাবে এতদিন ধরিয়া উন্নতির সোপান হইতে সোপানান্তরে অগ্রসর হইয়া না চলিলে তিনি এত জোর করিয়া এ কথা বলিতে পারিতেন না। বর্ণসাঙ্কর্য্যের ভিতর দিয়া পক্ষিপালক যে নূতন নূতন তথ্যে উপনীত হইতেছেন, তাহা দেখিলে ধারণা করিতে পারা যায় কেমন করিয়া art সময়ে সময়ে natureকে ছাড়াইয়া নব নব সৌন্দর্য্যে প্রকটিত হইতে পারে। কতকটা কৃত্রিম বলিয়া ইহাকে উড়াইয়া দিলে চলিবে না। ভাবিয়া দেখিতে হইবে যে, মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে তাহার জীবনের বহুযুগব্যাপী ইতিহাসে এইরূপ কত পরিবর্ত্তনের মধ্য দিয়া পাখীকে চলিয়া আসিতে হইয়াছে; পক্ষিজাতির উদ্ভবের প্রথম অবস্থায় যখন সবে মাত্র তাহার অবয়বে পতত্রের সূচনা হইয়াছিল, তখন হইতে সেই পতত্রের ও তাহার বর্ণের নব নব উন্মেষ যে হইয়া আসিয়াছে সে সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ হইতে পারে না; এমন কি কোনও কোনও পণ্ডিত এ বিষয়ে স্থির নিশ্চয় করিয়া বসিয়াছেন যে, পতত্রের গঠন ও বর্ণের বৈচিত্র্য ও পরিবর্ত্তন পরে পরে যুগযুগান্তরব্যাপী বিবর্ত্তনের ফলে কি ভাবে হইয়া আসিয়াছে, তাহা অনেকটা ঠিক বলা যাইতে পারে। তাঁহাদের সেই সকল উক্তির মধ্যে যাহা কিছু ইতরবিশেষ আছে, তাহা লইয়া তাঁহারা বাগ্বিতণ্ডা করুন; যতদিন না পণ্ডিত সমাজ এ বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে একমত হইতে পারেন, ততদিন এই কূট তর্ক চলিতে থাকুক; একদিন আমরা অবশ্যই অবিসংবাদী সত্যে উপনীত হইব। তবে এক বিষয়ে সকলেই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন;—সেটি এই যে, যে কোনও কারণেই হউক বিহঙ্গজাতির ক্রমবিকাশে বহুল পরিমাণে বর্ণের ও অবয়বের variation হইয়া আসিয়াছে। আপাততঃ এইটুকু মাত্র স্বীকার করিয়া লইলে আমরা এই নবীন আশ্রমবাদীদিগের একটা সন্দেহ নিরাকরণ করিতে পারি। ইহাদের অনেকের বিশ্বাস যে, কেবল আবদ্ধ অবস্থায় পাখীর বর্ণবিপর্য্যয় ঘটিয়া থাকে; প্রকৃতির মুক্তপ্রাঙ্গণে বনে জঙ্গলে, স্বাধীন অবস্থায় এরূপ হওয়া সম্ভবপর নহে। আধুনিকতম পক্ষিবিজ্ঞান তারস্বরে ইহার প্রতিবাদ করিয়া বলিতেছে যে, এরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়া তাঁহারা সংঙ্কীর্ণতার ও একদেশদর্শিতার পরিচয় দিতেছেন। এ’ত গেল একটা কথা। আবার কখনও বলা হয় যে, মানুষ জবরদস্তি করিয়া খাঁচার মধ্যে বিভিন্নজাতীয় পোষা পাখীর যৌনসম্মিলন ঘটাইয়া যে বর্ণসাঙ্কর্য্যের প্রশ্রয় দেয়, তাহা অপ্রাকৃত, অস্বাভাবিক এবং অত্যন্ত কৃত্রিম। কিন্তু যে পক্ষিপালকদিগের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনয়ন করা হয়, তাঁহারই এই নবীন আশ্রমপন্থীদিগের বহু পূর্ব্বে মুক্ত অবস্থায় স্বাধীন পাখীর আহার বিহার ইত্যাদি লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছেন যে, সেখানেও বিভিন্নজাতীয় পাখীদের মধ্যে অবাধ যৌনসম্মিলনের ফলে বর্ণসঙ্করের উদ্ভব হইতেছে। বরং এক্ষেত্রে পক্ষিপালক স্পর্দ্ধা করিয়া বলিতে পারেন যে, তিনি সাবধান হইয়া যে যে উপায় অবলম্বন করিয়া খাঁচার মধ্যে বর্ণসঙ্কর সৃষ্টির সহায়তা করেন, তাহা অনেক সময়ে অন্ধ instinct-প্রণোদিত হইয়া বনে জঙ্গলে যে সকল বর্ণসঙ্কর প্রসূত হয়, তাহাদের অপেক্ষা অনেকাংশে অধিকতর উন্নত। শুধু তাহাই নহে, এই প্রকার খাঁচার সাহায্যে hybrid culture বা বর্ণশাঙ্কর্য্যানুশীলন করিলে আমরা পাখীর আদিম প্রকৃতিগত দেহাবয়ব সম্বন্ধে অনেক বিষয় জানিতে পারি; প্রথমে তাহার কি প্রকার রং ছিল? সে রংটা একেবারে বিলুপ্ত হইল অথবা রূপান্তরিত হইল? নানা প্রকার পরীক্ষা করিয়া আবার কোনরূপে পুং স্ত্রী পক্ষিযুগলকে অনুকূল অবস্থার মধ্যে সংস্থাপিত করিয়া আমরা সেই সমস্ত অতীত ইতিহাসের লুপ্ত কাহিনী পুনরুদ্ধার করিয়া দিতে পারি, এ কথায় পণ্ডিতগণ দ্বিধা করিতেছেন না। অতএব এই hybrid culture লইয়া কেহ যদি তাঁহাদিগকে দোষ দিতে চেষ্টা করেন, তাহাতে পাণ্ডিত্যের অথবা সূক্ষ্মদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায় না।
খাঁচায় পুষিয়া পক্ষিপালন করার বিরুদ্ধে আর একটা অভিযোগ আনা হয়;—কৃত্রিম পিঞ্জর মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় না কি পাখীর পরমায়ু কমিয়া যায়। এরূপ মন্তব্য যে অনেকটা ভ্রমাত্মক—সে বিষয়ে পক্ষিপালকদিগের কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। সাধারণতঃ পাখীর সুস্থতা ও অসুস্থতার পরিমাপ করা সহজ নহে; তবে অন্যান্য জীবজন্তুর মত অপেক্ষাকৃত দুর্ব্বল বিহঙ্গ প্রতিকূল পরিবেষ্টনীর মধ্যে রোগে ভুগিয়া থাকে; শুধু আবদ্ধ অবস্থায় নহে অবাধ স্বাধীনতার মধ্যেও তাহারা রোগের হাত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করে না। জঙ্গলের মধ্যে যক্ষ্মারোগগ্রস্ত মুমূর্ষু পাখী দেখা যায়। একজন বিশেষজ্ঞ বলেন[৫] যে পাখীর ব্যায়রামের বিষয় আলোচনা করিতে বসিয়া খাঁচার উপর দোষ দিলে চলিবে না; বরং খাঁচার মধ্যে মানবাবাসে পাখীর রোগ হইলে নানা উপায়ে তাহাকে রোগমুক্ত করিবার চেষ্টা করা হইয়া থাকে, অনেক সময়ে সে চেষ্টা সফল হয়। কিন্তু বনের মধ্যে রুগ্ন পাখীর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। খাঁচায় পুরিবার চেষ্টায় প্রথম প্রথম যে পাখীর প্রাণসংশয় হয় না—এ কথা বলিতেছি না। গ্রীষ্মপ্রধান দেশের পাখীকে হিমপ্রধান দেশের মধ্যে পোষ মানাইরার চেষ্টা য়ুরোপে কিছুদিন হইতে চলিতেছে। ভারতবর্ষের এবং আফ্রিকার দুর্গা-টুনটুনি (Sunbird) কয়েক বৎসরের চেষ্টায় স্বনামখ্যাত মিঃ আলফেড্ এজ্রার বুদ্ধিকৌশলে ইংলণ্ডে নিরাময় হইয়া পিঞ্জরমধ্যে বাস করিতেছে। অন্যান্য পাখীর সম্বন্ধেও এই প্রকার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত দিতে পারা যায়।
আর একটা বড় কথা এই যে, পক্ষিপালক আছেন বলিয়া এমন কোনও কোনও পাখী রক্ষা পাইয়াছে, যাহা নানা নৈসর্গিক কারণে হয়’ ত লুপ্ত হইয়া যাইত। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমরা Ostrichএর উল্লেখ করিলেই বোধ হয় যথেষ্ট হইবে।
এখন আমাদের গোড়ার প্রশ্নে আসিয়া যদি সদুত্তরের জন্য অপেক্ষা করিতে হয়—পাখীর খাঁচা না পাখীর আশ্রম?—তাহা হইলে আমরা এইটুকু বলিয়াই ক্ষান্ত হইব যে, পাখীর খাঁচা’ত বটেই অশ্রমের পন্থা অবলম্বন করিলেও ক্ষতি নাই;—কারণ খাঁচায় যে বিদ্যালাভ করিয়াছি, আশ্রমে তার পরিণতি পাওয়া যাইবে কি না—কে বলিতে পারে?
- ↑ শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র নাথ লাহা, পি, আর, এস, মহাশয়ের The Religious Aspects of Ancient Hindu Polity নামক সুলিখিত প্রবন্ধে ইহা বিশেষরূপে আলোচিত হইয়াছে। (Modern Review, January 1918).
- ↑ He was a scientific collector of birds in his youth and in manhood sought the fiercest animals of the jungle and brought his trophies to museums where the public might look upon them and learn. As President he established the principle of Government bird-reservation and created fifty-one of those national bird-life sanctuaries”
—Bird-Lore, march-April 1919, p. 139.
- ↑ “Toledo’s parks and boulevards are hereby declared to be permanent bird sanctuaries...... I hereby appoint the boys and girls of Toledo as guardians of the birds, to work with the city adminstration for their protection”—Extract from the Mayor of Toledo (Ohio)’s proclamation on April 2, 1919.
- ↑ Dr. Graham Renshaw in Avicultural Magazine vol. ix. No. 4 (Feb. 1918), p 136.
- ↑ “It must not be imagined that because birds are kept in cages or aviaries that that is the cause of disease attacking them at times. Oh dear no! Birds in their wild state are also attacked. I have picked up occasionally birds suffering from “going light”, too weak to fly off the ground * * * and this in the months of May and June, when their natural food was abundant.”—P. F. M. Galloway in the Avicultural Magazine, vol. ix, No. 6, p. 136.