পারসীক গল্প/জুয়াচোর জব্দ
জুয়াচোর জব্দ।
কোন রাজধানীতে একজন হাকিম বাস করিতেন। চিকিৎসাই তাঁহার ব্যবসা ছিল। রাজচিকিৎসক ব্যতীত গ্রামের ভিতর অপর কোন চিকিৎসক না থাকায়, সেই স্থানের সকলেই তাঁহাকে বিশেষরূপ খাতির করিতেন ও তাঁহার কথায় সকলেই বিশ্বাস করিতেন।
রাজধানীর দূরবর্ত্তী কোন একটা ক্ষুদ্রপল্লীতে জনৈক মৌলবি বাস করিতেন। আরবীয় ভাষায় তাঁহার বিশেষ পাণ্ডিত্য ছিল; কিন্তু সংসারে তাঁহার দারা পুত্র প্রভৃতি কেহই না থাকায়, তীর্থ পর্য্যটন করিয়া, জীবনের অবশিষ্টাংশ অতিবাহিত করিতে মনস্থ করিলেন। তাঁহার বাড়ী ঘর ও অপরাপর যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহা বিক্রয় করিয়া যে কিছু অর্থের সংগ্রহ করিতে পারিলেন, তাহা হইতে সহস্রমুদ্রা পূর্ব্ব-কথিত হাকিম সাহেবের নিকট জমা রাখিয়া, অবশিষ্ট অর্থ সঙ্গে লইয়া তীর্থ পর্যটনে বহির্গত হইতে মনস্থ করিলেন। তাঁহার ইচ্ছা যে, পুনরায় অর্থের প্রয়োজন হইলে, হাকিম সাহেবের নিকট হইতে তাঁহার অর্থ গ্রহণ করিবেন ও পুনরায় তীর্থ পর্য্যটনে গমন করিবেন। হাকিম সাহেবও তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া তাঁহার নিকট হইতে সহস্রমুদ্রা গ্রহণ করিলেন, ও বিশেষ যত্নের সহিত তাঁহাকে হুই এক দিবস আপনার বাড়ীতে রাখিয়া দিলেন।
মৌলবি সাহেব হাকিম সাহেবের ব্যবহারে বিশেষরূপ সন্তুষ্ট হইলেন ও হুই এক দিবস পরেই হাকিম সাহেবের বাড়ী পরিত্যাগ পুর্ব্বক তীর্থ পর্যাটনে বহির্গত হইয়া গেলেন।
কয়েক বৎসর তীর্থে তীর্থে পর্য্যটন করিয়া, মৌলবি সাহেব পুনরায় রাজধানীতে প্রত্যাগমন করিলেন; এবং যে হাকিম সাহেবের নিকট আপনার সঞ্চিত অর্থ রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাঁহার নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন। হাকিম সাহেব এবার মৌলবি সাহেবকে দেখিয়া আর চিনিতে পারিলেন না। তিনি যে প্রকৃতই তাঁহাকে চিনিতে পারিলেন না, তাহা নহে। পাছে তাঁহার গচ্ছিত অর্থ প্রত্যর্পণ করিতে হয়, এই ভয়ে ইচ্ছা করিয়াই তাঁহাকে চিনিয়া উঠিতে পারিলেন না।
মৌলবি সাহেব অনন্যোপায় হইয়া তখন হাকিম সাহেবের নিকট হইতে আপনার বহুদিবসের গচ্ছিত অর্থের পুনঃপ্রাপ্তির ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। হাকিম সাহেব তাঁহার কথা শুনিয়া যেন একবারে স্তম্ভিত হইলেন ও কহিলেন, “তুমি কে, তাহাই আমি জানি না। তুমি আমার নিকট এত অর্থ গচ্ছিত করিয়া রাখিবে কেন? তোমার ভ্রম হইয়াছে, অপর আর কাহার নিকট অর্থ গচ্ছিত রাখিয়া থাকিবে, আমার নিকট রাথ নাই। যাঁহার নিকট রাখিয়াছ, তাঁহার নিকট গমন করিলেই, তিনি তোমার অর্থ প্রদান করিবেন।”
উত্তরে মৌলবী সাহেব কহিলেন, “না মহাশয়! আমার ভ্রম হইবে কেন, আমি আপনার নিকট আমার অর্থ রাখিয়া গিয়াছি, ও এখন উহা আবশ্যক হওয়াতেই আমি আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।”
মৌলবি সাহেবের এই কথা শুনিয়া হাকিম সাহেব হাসিয়া উঠিলেন। কহিলেন, “ইহার কথা শুনিয়া এখন বেশ বুঝিতে পারা যাইতেছে যে, এ ব্যক্তির মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়ায় নিশ্চয় এ পাগল হইয়া গিয়াছে।”
যে সকল ব্যক্তি সেই সময় হাকিম সাহেবের নিকট বসিয়াছিলেন, তাহাদিগের সকলেই হাকিম সাহেবের পক্ষসমর্থন করিলেন ও কহিলেন, “তুমি নিশ্চয়ই পাগল। নতুবা হাকিম সাহেবের নিকট সহস্র মুদ্রা গচ্ছিত করিয়া রাখিয়াছ, এ কথা বলিবে কেন? যদি অপর কাহারও নাম করিতে, তাহা হইলে তোমার কথা কিয়ৎপরিমাণে বিশ্বাস করিলেও করিতে পারিতাম; কিন্তু হাকিম সাহেবের নাম করাতে তোমার কথায় আমাদিগের সম্পূর্ণরূপ অবিশ্বাস হইতেছে। কারণ হাকিম সাহেবের তুল্য বিশ্বাসী ও সত্যবাদী ব্যক্তি এই রাজধানীর ভিতর আর কেহ আছে কি না সন্দেহ।” তাঁহারা আরও কহিলেন “এরূপ ভাল হাকিম সাহেবের উপর মিথ্যা দোষারোপ করিলে, রাজদ্বারে দণ্ডিত হইতে হইবে।”
মৌলবি সাহেব অনন্যোপায় হইয়া দুঃখিত অন্তঃকরণে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন ও সুযোগ মতে এক দিবস রাজ-দরবারে উপস্থিত হইয়া নিজের সমস্ত অবস্থা রাজ-সকাশে বিবৃত করিলেন। মৌলবি সাহেবের কথায় রাজা বিশ্বাস করিলেন, ও কহিলেন “আপনি হাকিম সাহেবের নিকট অর্থ যে গচ্ছিত করিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহাতে আমি কিছুমাত্র সন্দেহ করি না; কিন্তু আপনি যেরূপ বলিতেছেন, তাহাতে কোন প্রকারে এমন প্রমাণ করিবার উপায় নাই যে, আপনাদের কথা প্রকৃত। এরূপ অবস্থায় আমার দ্বারা আপনি কোন রূপেই সুবিচারের প্রত্যাশা করিতে পারেন না।”
মৌলবি সাহেবের হৃদয়ে যে একটু সামান্য আশা ছিল, রাজার কথা শুনিয়া তাঁহার সে আশাও দূরে পলায়ন করিল। তিনি আর কোন রূপে স্থির থাকিতে পারিলেন না, বালকের ন্যায় উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিয়া ফেলিলেন।
তাঁহার অবস্থা দৃষ্টি করিয়া রাজার মনে একটু দয়ার সঞ্চার হইল। তিনি কহিলেন, “প্রমাণ প্রয়োগের উপর নির্ভর করিয়া আমি তোমার কিছুমাত্র উপকার করিতে পারিব না; তবে তোমার নিমিত্ত আমি নিজে একটু চেষ্টা করিয়া দেখিব, হয়ত তাহাতে তোমার কোনরূপ উপকার হইলেও হইতে পারিবে। তুমি হাকিম সাহেবের বাড়ীর সম্মুখে গিয়া ক্রমাগত তিন দিবস কাল বলিয়া থাক। চতুর্থ দিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমি সেই স্থান দিয়া গমন করিব, ও তোমাকে দেখিলেই আমি পত্রে তোমাকে সেলাম করিব। তুমি আমার সেলাম ফিরাইয়া দিবে মাত্র; কিন্তু আমি যাহা জিজ্ঞাসা করিব, তাহার উত্তর ভিন্ন অপর কোন কথা কহিবে না। আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে, তুমি হাকিম সাহেবের নিকট গমন করিয়া তোমার গচ্ছিত অর্থ প্রত্যর্পণ করিবার নিমিত্ত পুনরায় তাহাকে বলিবে। পরে তোমার কথার উত্তরে তিনি যাহা কহেন, তাহা আমার নিকট আসিয়া বলিবে।”
রাজার কথায় মৌলবি সম্মত হইয়া তৎক্ষণাৎ হাকিম সাহেবের বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইলেন, ও ক্রমাগত তিন দিবস কাল তাঁহার বাড়ীর সম্মুখে উপবেশন করিয়া রহিলেন। কিন্তু হাকিম সাহেবকে কোন কথা বলিলেন না। হাকিম সাহেবও তাঁহাকে বার বার দেখিতে লাগিলেন, কিন্তু তিনিও তাঁহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না।
চতুর্থ দিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বেই রাজা রীতমত সাঙ্গসজ্জা ও লোক জন সমভিব্যাহারে অশ্বারোহণে রাজধানী পরিভ্রমণ করিবার নিমিত্ত বহির্গত হইলেন। ক্রমে তিনি হাকিম সাহেবের বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই স্থানে আসিবামাত্র পূর্ব্ব-কথিত মৌলবির দিকে তাঁহার দৃষ্টি পতিত হইল। তাঁহাকে দেখিবামাত্র তিনি আপন অশ্ব-বল্গা সংযত করিয়া, সেই মৌলবি সাহেবকে বিশেষরূপ নত ভাবে এক সেলাম করিলেন ও কহিলেন “আপনি কত দিবস এই সহরে প্রত্যাগমন করিয়াছেন ও কোথায় বা অবস্থিতি করিতেছেন? এ পর্যন্ত আমার নিকট গমন করেন নাই কেন? আপনার অবস্থা দেখিয়া অনুমান হইতেছে যে, আপনি সবিশেষ কষ্টে আছেন। আপনি অদ্যই আমার নিকট গমন করিবেন, ও যে কয়দিবস এই স্থানে থাকিতে ইচ্ছা করেন, সেই কয়দিবস আমার বাড়ীতেই অবস্থান করিবেন।” মৌলবি সাহেব রাজার সেলাম প্রত্যর্পণ করিয়া কেবল এই মাত্র কহিলেন, “সময় মত আমি গিয়া তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিব।”
এই কথা শুনিয়া রাজা তাহাকে পুনরায় সেলাম করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। রাজাকে সেলাম করিতে দেখিয়া তাহার পারিষদ সমস্তই একে একে তাঁহাকে সেলাম করিয়া সেই স্থান হইতে চলিয়া গেল।হাকিম সাহেব এই সকল অবস্থা স্বচক্ষে দর্শন করিয়া মনে মনে অতিশয় ভীত হইলেন। ভাবিলেন— যাঁহাকে রাজা স্বয়ং এইরূপ ভাবে মান্য করেন, তিনি নিশ্চয়ই কখন সামান্য ব্যক্তি নহেন। এরূপ অবস্থায় এই ব্যক্তি রাজার নিকট গমন করিয়া যদি সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া দেন, তাহা হইলে আমার ভয়ানক বিপদ উপস্থিত হইবে। হয়ত আমাকে কারারুদ্ধ হইতে হইবে, না হয়, এই রাজধানী পরিত্যাগ করিয়া আমাকে প্রস্থান করিতে হইবে।
হাকিম সাহেব, যখন দেখিলেন যে, দলবলের সহিত রাজা সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছেন, তখন তিনি মৌলবি সাহেবের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন, ও তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “সেই দিবস আপনি বলিতেছিলেন যে, আমার নিকট আপনি সহস্র মুদ্রা গচ্ছিত করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। আমার নিকট অনেকেই টাকা জমা রাখিয়া থাকেন, সুতরাং আপনি কোন্ সময়ে যে টাকা জমা রাখিয়াছেন, তাহা আমি ঠিক মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। কোন্ সময়ে ও কি অবস্থায় আপনি আমার নিকট টাকা রাখিয়াছিলেন, তাহা আমাকে বেশ করিয়া বুঝাইয়া দিন দেখি। তাহা হইলে সমস্ত কথা আমার মনে হইতে পারে।”
হাকিম সাহেবের কথা শুনিয়া মৌলবি সাহেব এখন যাহা কহিলেন, তাহাতে হাকিম সাহেব একটু চিন্তা করিয়াই কহিলেন, “হাঁ! এখন আমার মনে পড়িতেছে যে, আপনি প্রকৃতই জামার নিকট সহস্র মুদ্রা রাখিয়া গিয়াছিলেন। অনেক দিবসের কথা বলিয়া আমি সহজে মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না। এখন আপনি আমার বাড়ীতে আসুন; আমি আপনার সমস্ত অর্থ এখনই প্রদান করিতেছি।” এই বলিয়া হাকিম সাহেব বিশেষ যত্নের সহিত তাঁহাকে আপন বাড়ীতে লইয়া গেলেন, ও তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে তাঁহার গচ্ছিত সহস্র মুদ্রা প্রদান করিলেন। মৌলবি সাহেব সহস্র মুদ্রা সহ তখনই গিয়া রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন, ও যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহা ভাঁহার নিকট বর্ণন করিয়া তাঁহাকে শত সহস্র ধন্যবাদ প্রদান করিতে করিতে সেই স্থান পরিত্যাগ করিলেন।