পারসীক গল্প/মৃত্যু-ভয়ে সত্য প্রকাশ
মৃত্যু ভয়ে সত্য-প্রকাশ।
কোন নগরে একজন মধ্যমাবস্থাপন্ন বণিক বাস করিতেন। তাঁহার একটা ক্রীতদাস ছিল। সেই ক্রীতদাস যখন নিতান্ত শৈশবাবস্থায় ছিল, তখন তিনি তাহাকে ক্রয় করেন, এবং লালনপালন করিয়া তাহাকে বড় করিয়া তোলেন। যে সময় ক্রীতদাস উপায়-ক্ষম হইয়া উঠিল, সেই সময় হঠাৎ একদিবস সে নিরুদ্দেশ হইল। অনেক অনুসন্ধান করিয়াও বণিক তাহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলেন না। ক্রমে দুই এক বৎসর অতিবাহিত হইয়া গেল।
এক সময় বাণিজ্য উপলক্ষে বণিক আপন নগর পরিত্যাগ করিয়া কোন একটা প্রসিদ্ধ নগরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই স্থানের রাজবর্ত্মের উপর হঠাৎ একদিবস তিনি তাঁহার পলাতক ক্রীতদাসকে দেখিতে পাইলেন। দেখিয়া তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “নিমকহারাম! শৈশব হইতে তোকে লালনপালন করিয়া এত বড় করিয়াছি, আর যেমন তুই কার্য্যের উপযুক্ত হইয়া উঠিলি, অমনি আমায় পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিলি। তোকে ক্রয় করিতে ও তোকে লালন পালন করিতে আমার বিস্তর অর্থ ব্যয়িত হইয়া গিয়াছে। সুতরাং যখন তোকে আজ দেখিতে পাইয়াছি, তখন কোন কথাই আজ আমি শুনিব না; তোকে সঙ্গে করিয়া আমি আপন দেশে লইয়া যাইব। আমার সহিত গমন করিতে যদি তুই অসম্মত হ’স্, তাহা হইলে কাজির নিকট তোকে লইয়া গিয়া, যাহাতে তুই উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হ’স্, তাহার চেষ্টা করিব।”
বণিকের কথা শুনিয়া তাহার ক্রীতদাস নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইল, এবং তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “তুই কোথাকার মিথ্যুক? আমি তোর ক্রীতদাস, না তুই আমার ক্রীতদাস? তুই আমার ক্রীতদাস হইয়া আমাকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছিস, —কেবল পলায়ন নহে, তোর পরিধানে যে কাপড় রহিয়াছে, উহা কাহার? তুই আমার ঐ সকল বস্ত্র অপহরণ করিয়া পরিধান করিয়াছিস, আমি কোনরূপেই তোকে ছাড়িব না, এই কাপড়ের সহিত ধৃত করিয়া এখনই তোকে কাজি সাহেবের নিকট লইয়া যাইব।”এই বলিয়া ক্রীতদাস সেই বণিকের কাপড় ধরিয়া সেই রাস্তার উপর ভয়ানক গোলযোগ উপস্থিত করিল। এই ব্যাপার দেখিয়া ক্রমে রাস্তায় লোক জমিয়া গেল। ক্রমে জনৈক প্রহরী আসিয়া উভয়কেই ধৃত করিয়া কাজি সাহেবের সন্নিকটে লইয়া উপস্থিত হইল।
কাজি সাহেব উহাদিগের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমাদিগের মধ্যে মনিব কে, এবং ক্রীতদাসই বা কে?” উত্তরে উভয়েই কহিল “আমি মনিব।” কোন্ ব্যক্তি যে ক্রীতদাস, তাহা কেহই স্বীকার করিল না, অথচ প্রমাণ-প্রয়োগের দ্বারা কেহই প্রতিপন্ন করিতে পারিল না যে, উহাদিগের মধ্যে প্রকৃত মনিব কে?
এই ব্যাপার দেখিয়া কাজি সাহেব বিষম বিপদে পড়িলেন, এবং প্রকৃত কথা জানিবার আশায় একটু চিন্তা করিয়া, তিনি উভয়কেই একটী গৃহের ভিতর রাখিয়া দিয়া, তাঁহার জল্লাদকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। শাণিত তরবারির সহিত জল্লাদ সেই স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র তিনি তাহাকে কহিলেন, “এই প্রকোষ্ঠ মধ্যে যে দুই ব্যক্তি রহিয়াছে, উহাদিগের প্রত্যেকের মস্তক এক সময়ে এই বাতায়ন-পথে বাহির করিতে বল। উভয়েই যখন উহাদিগের মস্তক বাহির করিবে, তখন তুমি তোমার শাণিত তরবারি দ্বারা, যে ব্যক্তি ক্রীতদাস, তাহার মস্তক কাটিয়া আমার সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত কর।”
জল্লাদ, কাজি সাহেবের আজ্ঞা প্রতিপালন করিবার নিমিত্ত, উভয়ের মস্তক সেই গবাক্ষ পথে বাহির করিয়া দিয়া, কাজি সাহেবের আদেশ তাহাদিগকে উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিল। পরে আপনার তরবারি লইয়া যেমন তাহাদিগের মস্তক দ্বিখণ্ডিত করিবার অভিপ্রায়ে উত্তোলন করিল, অমনি সেই প্রকৃত ক্রীতদাস তাহার মস্তক গৃহের ভিতর টানিয়া লইল; কিন্তু বণিক পূর্ব্ববৎ আপন মস্তক স্থিরভাবে সেই স্থানেই রাখিয়া দিলেন।
এই অবস্থা দেখিয়া কাজি সাহেব স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন,— প্রকৃত ক্রীতদাসই বা কে, আর তাহার মনিবই বা কে। তখন তিনি সেই ক্রীতদাসকে উপযুক্তরূপ দণ্ড প্রদান করিয়া উহাকে বণিকের হস্তে অর্পণ করিলেন। বণিক তাহাকে লইয়া আপন দেশে প্রস্থান করিলেন।