পাষাণের কথা/১
পাষাণের কথা
[ ১ ]
আমার সময়ের ধারণা নাই, সুতরাং আমার জন্ম-মুহূর্ত্ত হইতে কত কাল অতীত হইয়াছে তাহা আমি বলিতে পারি না। যতদূর স্মরণ আছে তাহাই বলিতেছি। শৈশবের কথা এইমাত্র মনে পড়ে যে, প্রশস্ত সমুদ্রসৈকতে আমি ও আমার ভ্রাতৃবর্গ খেলা করিয়া বেড়াইতাম—বায়ু ভরে উড়িয়া যাইতাম, ঘূর্ণবাত্যায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইতাম; কখন বা সমুদ্রের জলে পতিত হইতাম; জল সরিয়া গেলে—ভূমি শুষ্ক হইয়া গেলে পুনরায় ফিরিয়া আসিতাম। সে সমুদ্রের বিশালতা ধারণা করিবার শক্তি তোমাদিগের নাই; সে সমুদ্রসৈকতের বিস্তৃতি তোমাদিগের মহাপ্রদেশ সমূহের দৈর্ঘ্য অপেক্ষা অধিক। যে সকল জলজন্তু সেই মহাসমুদ্রে বাস করিত যৌবনের মূর্চ্ছাভঙ্গের পর তাহাদিগকে আর দেখি নাই। আমার শৈশবে আমি একবার মূর্চ্ছিত হইয়াছিলাম। মূর্চ্ছাভঙ্গে দেখি, আমি যৌবনপ্রাপ্ত হইয়াছি। শুনিয়াছি, তোমাদিগের এই সংগ্রহশালায় সেই মহাসমুদ্রের জীবজন্তুর অস্থি আছে। কিছুকাল পূর্ব্বে শ্বেতকায়, বিরলকেশ একজন সাধক পর্ব্বত ভেদ করিয়া সেই সকল জীবজন্তুর অস্থি লইয়া আসিয়াছিলেন।
কতদিন সমুদ্রসৈকতে উড়িয়া বেড়াইয়াছি, তাহা বলিতে পারি না। অবস্থান্তরপ্রাপ্তির পূর্ব্বের কথা সামান্যমাত্র আমার মনে পড়ে। একদিন মধ্যাহ্নে প্রখর সূর্য্যতপ্ত বায়ু আমাকে অপর কতকগুলি বালুকণার সহিত সমুদ্রবক্ষে নিক্ষেপ করিয়াছিল। সে দিন যত দূরে আসিয়া পড়িয়াছিলাম, জীবনে আর কোন দিন তত দূর আসিতে পারি নাই। আমার জীবনযাত্রায় সেই প্রথম পাদক্ষেপ। সে দিন বুঝিতে পারি নাই যে, পরে অতীতকালের সাক্ষিস্বরূপ বহুযুগের ইতিহাস বহন করিয়া আমাকে সংগ্রহশালায় আবদ্ধ হইয়া থাকিতে হইবে। সে দিন যে স্থানে আসিয়াছিলাম, সে স্থান হইতে সমুদ্রের জল সরে না, সুতরাং শৈশবের আবাসভূমি আর কখনও দেখি নাই।
সমুদ্রগর্ভে অপরাপর বালুকণার সহিত বহুকাল বাস করিয়াছি; কত অপরূপ জলজন্তু আমাদিগের বক্ষের উপর দিয়া চলিয়া যাইত। আমরা তাহাদিগের জন্মমৃত্যু দেখিতাম। বালুকাময় সমুদ্রগর্ভে তাহাদিগের জন্ম হইত। তাহারা আমরণ সেই বালুকাক্ষেত্রেই বাস করিত। জীবনান্তে তাহাদিগের অস্থিগুলি শুভ্র বালুকাক্ষেত্রটিকে শুভ্রতর করিয়া তুলিত। সেই সকল অস্থি তোমাদিগের অতীত জীববিদ্যার মূল। তোমরা সেই যুগের কোন জীবেরই সমগ্র কঙ্কাল সংগ্রহ করিতে পার নাই, একখানি দুইখানি অস্থি লইয়া তোমরা অতীত যুগের জীবনের চিত্র অঙ্কিত করিতে চাহ; কিন্তু তাহা হয় না। অতীতের সাক্ষী, আমি—সেই সকল জীব দেখিয়াছি। আমি তাহাদিগকে স্পর্শ করিয়াছি; তাহাদিগের জীবনের প্রারম্ভ হইতে তাহাদিগের চৈতন্যের শেষ সীমা পর্য্যন্ত তাহাদিগের গতিবিধি লক্ষ্য করিয়াছি; জীবনান্তে বহুযুগ তাহাদিগের অস্থিনিচয় বক্ষে ধারণ করিয়াছি—আমি বলিতেছি, তাহা হয় না। তোমরা অতীত যুগের জীবন সমূহের যে চিত্রাবলি রাখিয়াছ তাহা হাস্যোদ্দীপক। বালুকণার যদি উচ্চহাস্য করিবার ক্ষমতা থাকিত, তাহা হইলে আমার উচ্চহাস্যে তোমাদিগের এই গৃহ ধ্বনিত হইয়া উঠিত। আমি দেখিয়াছি, আমার স্মরণ আছে, কিন্তু আমার মনের ভাব প্রকাশ করিবার ক্ষমতা নাই, তোমাদিগের মত বলিবার বা লিখিবার ক্ষমতা নাই, সুতরাং সব জানিয়াও আমার কিছু বলা হইল না।
সমুদ্রগর্ভস্থ বালুকাক্ষেত্রে কত দিন বাস করিয়াছিলাম তাহা বলিতে পারি না; কারণ পূর্ব্বেই বলিয়াছি, আমার সময়ের ধারণা নাই। শৈশবে যে আমার মূর্চ্ছা হইয়াছিল তাহাও পূর্ব্বে বলিয়াছি। একদিন সূর্য্যাস্ত-কালে কোন দারুণ আঘাতে সমুদ্রগর্ভ বিদীর্ণ হইয়া গেল, গভীর আলোড়নে বিশাল জলরাশি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল, বহু জলজন্তুর জীবনান্ত হইল—আমি মূর্চ্ছিত হইলাম। তাহার পর কালপ্রবাহ কি ভাবে কতদূর অগ্রসর হইয়াছিল, তাহা কেমন করিয়া বলিব? অজ্ঞান অবস্থায় আমি যেন অত্যন্ত ক্লেশ অনুভব করিতাম, যেন দুর্ব্বিসহ যাতনা অনুভূত হইত, বোধ হইত যেন কেহ ভীষণ বলে আমার ক্ষুদ্র দেহখানি ক্ষুদ্রতর করিবার চেষ্টা করিতেছিল। এতদ্ব্যতীত আর কিছুরই স্মরণ নাই। মূর্চ্ছাভঙ্গে দেখি, অজ্ঞাত শক্তির প্রয়োগে বালুকাক্ষেত্রে বিষম বিপর্য্যয় ঘটিয়াছে। সেই সমুদ্রসৈকত, সেই বিশাল জলরাশি, সেই সব জীবজন্তু উদ্ভিদ্ সমস্তই অন্তর্হিত হইয়াছে। সে জগৎ আর নাই; অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে লক্ষ লক্ষ বালুকাকণা একত্র হইয়া রক্তবর্ণ প্রস্তরে পরিণত হইয়াছে, আমার শৈশবের দেহ তখন বিশাল অশ্বখণ্ডের কণিকামাত্রে পরিণত হইয়াছে,—আমার স্বাধীনতা লুপ্ত হইয়াছে।
চেতনার প্রারম্ভে দেখিলাম, নূতন জগতে তৃণশষ্প, তরুলতা, জীবজন্তু প্রভৃতি সমস্তই পরিবর্ত্তিত হইয়াছে। সে নূতন জগতের আকার অনেকটা বর্ত্তমান জগতের ন্যায়। তাহার পর স্থানে স্থানে পরিবর্ত্তন হইয়াছে মাত্র। আমি তখন যে প্রস্তরখণ্ডের দেহে লীন হইয়াছিলাম মূর্চ্ছা অবসানে দেখি, তাহার দেহ স্নিগ্ধ শ্যামদুর্ব্বাদলে আচ্ছাদিত; নূতন আকারের চতুষ্পদ জীব তাহার উপরে বিচরণ করিতেছে। সময়ে সময়ে মসীকৃষ্ণবর্ণ ছাগচর্ম্মাচ্ছাদিত তোমাদিগের স্বশ্রেণীর জীবগণ তাহাদিগকে আক্রমণ করিতে আসিত। তাহারা নখ, দন্ত, বা উপলখণ্ডের সাহায্যে চতুষ্পদ জীবগুলিকে জয় করিবার চেষ্টা করিত ও লোকবলের আধিক্যে অনেক সময় তাহাদিগকে নিধন করিতে সমর্থ হইত; কিন্তু কখনও কখনও শৃঙ্গের তাড়নায় পরাজিত হইয়া পলায়ন করিতেও বাধ্য হইত। আমার নিকটে ইহাই মানব-জীবনের ইতিহাসের সূত্রপাত। মনুষ্য আমার নিকটে তখন নবজাত জীব। আমি যখন জ্ঞানলাভ করি তখন মনুষ্যজাতি উন্নতির পথে কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়াছে, সুতরাং মনুষ্য-জীবনের প্রারম্ভের কথা বলিতে আমি অক্ষম। আমি সর্ব্বপ্রথমে মনুষ্যজাতীয় যে সকল জীব দেখিয়াছিলাম, তাহারা অত্যন্ত খর্ব্বাকৃতি ছিল এবং মৃগয়াই তাহাদিগের উপজীবিকা ছিল বলিয়া বোধ হইত। শুনিয়াছি তদ্বংশীয়েরা দক্ষিণ সমুদ্রের উপকূলে অদ্যাপি বাস করিয়া থাকে। অপেক্ষাকৃত বলবান জাতি কর্ত্তৃক তাড়িত হইয়া তাহারা এখন বৃক্ষশাখা আশ্রয় করিয়াছে; বৃহদাকার জন্তুর অভাবে তাহারা কীটপতঙ্গ প্রভৃতির দ্বারা জঠরানল নিবৃত্তি করিয়া থাকে। ইহারাই এই দেশের প্রকৃত অধিপতি, কারণ মনুষ্য-জীবনের প্রারম্ভে ইহারাই শুষ্ক ভূমির এই অংশে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছিল। পরে তোমাদিগের পূর্ব্বপুরুষ প্রভৃতি যে সকল জাতি আসিয়া এ দেশে বাস করিতেছে তাহারা সকলেই দস্যু ও অধর্ম্মচারী। যে কৃষ্ণবর্ণ খর্ব্বকায় মনুষ্যজাতির কথা বলিলাম, তাহারা সংখ্যায় অত্যন্ত অল্প ছিল—শতাধিক ব্যক্তিকে কখনও একত্র হইতে দেখি নাই। তাহারা ধাতুর ব্যবহার জানিত না, শিলাখণ্ডই তাহাদিগের একমাত্র আয়ুধ ছিল। কিছুকাল পরে সে জাতীয় মনুষ্য এ প্রদেশ হইতে অন্তর্হিত হইল। তাহারা কোথায় গেল, কেন গেল, তাহা বলিতে পারি না, কারণ তখনও আমরা ভূগর্ভনিহিত ছিলাম। তোমরা অনুমান কর, সভ্যতর জাতি আসিয়া তীক্ষ্ণধার অস্ত্রের সাহায্যে পূর্ব্বোক্ত কৃষ্ণবর্ণ খর্ব্বাকার মনুষ্যজাতির ধ্বংসসাধন করিয়াছিল। তাহার কতকটা সত্য হইতে পারে, কারণ ইহার পরবর্ত্তী মনুষ্যেরা উজ্জ্বল ধাতুময় অস্ত্রের সাহায্যে মৃগয়া করিত। একদিন একজন ঐরূপ অস্ত্রের সাহায্যে আমাদিগকে ভেদ করিবার চেষ্টা করিয়াছিল। দূরে পাটলীপুত্রবাসী ভিক্ষুদত্ত যে স্তম্ভ দেখিতেছ উহার একপ্বার্শে অদ্যাবধি সেই অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন বর্ত্তমান আছে। পরে জানিয়াছি, ঐ ধাতু তাম্র। শুনিয়াছি, যে জাতীর মনুষ্য তাম্রনির্ম্মিত্ত অস্ত্র ব্যবহার করিত, তাহাদিগের বংশধরেরা বিস্তীর্ণ দাক্ষিণাত্যে এখনও বাস করিতেছে। তোমাদের সংগ্রহশালায় তাম্রনির্ম্মিত আয়ুধের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত অল্প, কিন্তু তুমি বোধ হয় এই জাতীয় অস্ত্র অনেক দেখিয়াছ। তোমাদিগের পূর্ব্বপুরুষেরা যখন লৌহনির্ম্মিত অস্ত্রের সাহায্যে ভারতবর্ষ অধিকার করেন, তখন পূর্ব্ববাসীরা তাড়িত হইয়া বিন্ধ্য পর্ব্বতের দক্ষিণে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল। ক্রমে বিজেতারাও লৌহ ব্যবহার করিতে আরম্ভ করায় অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তাম্রের ব্যবহার রহিত হইয়া যায়। একদিন রাত্রিকালে তাম্রনির্ম্মিত অস্ত্রধারী কতকগুলি লোক আমাদিগের বক্ষের উপর আসিয়া কয়েক স্থানে অগ্নি প্রজ্বালিত করিল। বহুকাল পরে সেই দিন ঐ আলোক দর্শন করিলাম। ইহার পূর্ব্ববর্ত্তী ঘটনা যাহা বলিয়াছি তাহা পাশ্ববর্ত্তী বালুকাকণার নিকট শুনিয়াছিলাম। অগ্নির সাহায্যে ক্রমে আমাদিগের বক্ষ ও পার্শ্বস্থিত তৃণক্ষেত্র ভস্মে পরিণত হইল। দারুণ উত্তাপে আমরা বিদীর্ণ হইয়া গেলাম ও জনগণ পলায়ন করিতে বাধ্য হইল। ক্ষণকাল পরেই শ্বেতবর্ণ, দীর্ঘকায়, সুদীর্ঘ পিঙ্গলবর্ণকেশধারী কতকগুলি মনুষ্য পাশ্ববর্ত্তী বনভূমি হইতে নির্গত হইয়া আসিল। তাঁহারা আসিবামাত্র চতুর্দ্দিক হইতে কৃষ্ণবর্ণ, তাম্রনির্ম্মিত অস্ত্রধারী পুরুষ তাহাদিগকে আক্রমণ করিল। শ্বেতকায় ব্যক্তিগণ আত্মরক্ষার চেষ্টা না করিয়া মৃত্যুকালে অগ্নি ও আকাশকে লক্ষ্য করিয়া নূতন ভাষায় গম্ভীর শব্দে কি বলিয়া গেল। সেই শব্দমালার গাম্ভীর্য্য এত অধিক যে, আক্রমণকারীদের মধ্যে কয়েক জন ভীত হইয়া পলায়ন করিল। শ্বেত-কৃষ্ণ মনুষ্যের বিবাদের ফলে আমি অগ্নির আলোক দর্শন করিলাম। পরে কতবার সেরূপ আলোক দেখিয়াছি, কতবার উজ্জ্বলতর অগ্নি আমার নিকট প্রজ্বালিত হইয়াছে, কিন্তু প্রথম সে আলোকদর্শনে যে আনন্দ তাহা পরে আর অনুভব করি নাই। সূর্য্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রজতশুভ্রবর্ম্মাবৃত, সুতীক্ষ্ণ অস্ত্রধারী শ্বেতকায় সৈনিকগণ দলে দলে আসিয়া ভস্মরাশি বেষ্টন করিয়া ফেলিল—বিলাপে পর্ব্বতের সানুদেশ প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। দলে দলে সৈনিকবর্গ কাষ্ঠ অন্বেষণে চলিয়া গেল। কেবল কয়েকজন মাত্র মৃতদেহের পার্শ্বে বসিয়া রহিল।
কিয়ৎকাল মধ্যে চিতাধূম গগন স্পর্শ করিল, অরণ্যবাসী শ্বেতকায় মনুষ্যগুলির দেহ ভস্মীভূত হইয়া গেল। দগ্ধাবশিষ্ট অস্থিগুলি একটি ক্ষুদ্র মৃন্ময় পাত্রে রক্ষিত হইল, দলে দলে শ্বেতকায় মনুষ্য আসিয়া তাহাতে পুষ্পবৃষ্টি করিয়া গেল। সন্ধ্যাকালে একটি গুরুভার দণ্ডের সহিত ভস্মাধারটি ভূগর্ভে প্রোথিত হইল। ইহার পর কয়েক দিবস চারি পার্শ্বের পর্ব্বতশ্রেণী হইতে গভীর আর্ত্তনাদ উত্থিত হইত। শুনিতে পাইতাম কৃষ্ণবর্ণ মনুষ্যজাতির শোণিতে পর্ব্বতের সানুদেশ রঞ্জিত হইতেছে, ভীষণ প্রতিহিংসার প্রাবল্যে শ্বেতকায় সৈনিকগণ কৃষ্ণকায় জাতির ধ্বংসসাধন করিতেছে, বৃদ্ধ ও বালক, স্ত্রী ও পুরুষ দলে দলে নিহত হইতেছে, পর্ব্বতের উপত্যকাগুলি ক্রমশঃ জনশূন্য হইতেছে। বায়ু আসিয়া ভস্মরাশিকে উড়াইয়া লইয়া গেল, ভস্মসিঞ্চিত ভূমির উর্বরতা বর্দ্ধিত হইল, অতি অল্পকালের মধ্যে উপত্যকা আবার স্নিগ্ধশ্যাম বনরাজিতে আবৃত হইল। ইহার পর আমরা আর সর্ব্বদা মানুষের মুখ দেখিতে পাইতাম না, কৃষ্ণকায় মনুষ্যেরা অতি সাবধানে মৃগয়া করিতে আসিত, অধিক সংখ্যক কৃষ্ণকায় মনুষ্য আর কখনও দেখি নাই। কখন অরণ্যবাসী জটাশ্মশ্রূধারী পুরুষগণ সমিধপুষ্পাহরণের জন্য গভীর বনে আসিতেন, কখন বা প্রতিহিংসাপরবশ কৃষ্ণকায় অলক্ষ্যে শ্বেতকায় বনচারীর পশ্চাদ্গমন করিত। কিন্তু সে পর্ব্বতের সানুদেশে বা উপত্যকায় বহুকাল পর্য্যন্ত মনুষ্যের বাস ছিলনা।
শুনিয়াছি, ক্রমে শ্বেতকায় মনুষ্যে দেশ প্লাবিত হইয়া গেল, কৃষ্ণকায় মানবজাতি ক্রমে লুপ্ত হইতে লাগিল; যাহারা অবশিষ্ট রহিল তাহারা অধীনতা স্বীকার করিয়া নবাগত জাতির অনুকরণে প্রবৃত্ত হইল ও ক্রমে শ্বেত জনসঙ্ঘে মিশিয়া গেল। শ্বেতাঙ্গ জনগণের চরম উৎকর্ষের অবস্থা দেখি নাই। আমি যখন পুনরায় মনুষ্যসমাজের সংসর্গে আনীত হইয়াছিলাম, তখন শ্বেতকায় জাতির অবনতি সূচিত হইয়াছে। শুনিয়াছি, এই জাতির যেরূপ উন্নতি হইয়াছিল, এতদ্দেশবাসী অপর কোন জাতিরই সেরূপ হয় নাই। তাহারা বৃহৎ কাষ্ঠের দ্বারা গৃহ নির্ম্মাণ করিত, সুতীক্ষ্ণ অস্ত্রের দ্বারা হর্ম্ম্যাবলী সুদৃশ্য চিত্রশোভিত করিত; ক্রমে কাষ্ঠের পরিবর্ত্তে পর্ব্বতগাত্র ছেদন করিয়া গৃহনির্ম্মাণের জন্য পাষাণ লইয়া যাইত, অস্ত্রসাহায্যে তাহার মলিনত্ব দূর করিরা তাহার ঔজ্জ্বল্য সাধন করিত। তাহারা কাষ্ঠখণ্ডের সাহায্যে জলরাশি উত্তীর্ণ হইত, বৃহদাকার কাষ্ঠখণ্ডের নিম্নে বর্ত্তুলাকার কাষ্ঠখণ্ড সংলগ্ন করিয়া গো, মহিষ, অশ্ব প্রভৃতি বনবাসী জীব সমূহকে ভারবহনে নিযুক্ত করিত। যে ব্যক্তি বর্ত্তুলের পরিবর্ত্তে রথে চক্র যোজন করিয়াছিল তাহার নাম অদ্যাপি তোমরা করিয়া থাক। ক্রমে সূর্য্যের প্রখর উত্তাপে ও কৃষ্ণকায় জাতির সহিত মিশ্রণে তাহাদের বর্ণের পরিবর্ত্তন হইতে লাগিল। যখন মনুষ্যসমাজে নীত হইলাম তখন দেখিলাম, নবাগত জাতির বর্ণের বৈষম্য ঘটিয়াছে, আচারব্যবহারের পরিবর্ত্তন ঘটয়াছে, বলেরও লাঘব হইয়াছে।
বহুকাল পরে পার্শ্বদেশে দারুণ ক্লেশ অনুভব করিলাম। শুনিয়াছি, পাষাণ যে ক্লেশ অনুভব করে তাহা তোমরা এখন স্বীকার কর। দেখিলাম, মলিনবেশধারী জনৈক মনুষ্য আমার পার্শ্বে লৌহকীলক প্রোথিত করিবার চেষ্টা করিতেছে। অনেক চেষ্টার পর, অনেকগুলি কীলক ভগ্ন হইবার পর একটি কীলকের কিয়দংশ আমার পার্শ্বে প্রবেশ করিল। আমার যন্ত্রণা ব্যক্ত করিবার ক্ষমতা নাই, রোধ করিবার ক্ষমতা নাই, সমস্ত ঘটনা স্মরণ রাখিবার ক্ষমতা নাই, কিন্তু তথাপি বলিতে পারি, এরূপ অসহ্য যন্ত্রণা কখনও ভোগ করি নাই; এরূপ অসহনীয় যন্ত্রণা সমুদ্রগর্ভে বাসকালে মূর্চ্ছার প্রারম্ভেও বোধ হয় অনুভব করি নাই; পরবর্ত্তী জীবনে একবার মাত্র ভোগ করিতে হইয়াছিল। ক্রমে সংবাদ আসিল যে, পর্ব্বতের নানা স্থানে মনুষ্যগণ কীলক প্রোথিত করিবার চেষ্টা করিতেছে; দারুণ যন্ত্রণায় সকলেই অস্থির হইয়া পড়িয়াছে। একটি, দুইটি, তিনটি, ক্রমে দশটি কীলক সমরেখায় প্রোথিত হইল। আমাদিগের আক্রমণকারী লৌহদণ্ডধারী আরও কয়েকজন মনুষ্যকে আহ্বান করিয়া আনিল। কীলকমূলে লৌহদণ্ড প্রয়োগে ও মনুষ্যবর্গের সমবেত চেষ্টায় আমরা সশব্দে বিদীর্ণ হইয়া গেলাম। আমাদিগকে অপসারিত করিয়া আততায়ীরা পুনরায় কীলক প্রোথিত করিতে লাগিল। ক্রমে পর্ব্বতের সানুদেশে সমস্ত স্থান হইতেই এই নিষ্ঠুর বিদারণের শব্দ আসিতে লাগিল; আমরা জানিতে পারিলাম যে, উপত্যকার সর্ব্বস্থানেই পাষাণের উপর অত্যাচার হইতেছে। এইরূপে সন্ধ্যাগমের পূর্ব্বেই পর্ব্বতসানুর আকার অন্যরূপ হইয়া গেল। অন্ধকারের আগমনের সহিত চতুর্দ্দিকে অগ্নি প্রজ্বালিত হইতে লাগিল, বনভূমি বহুকাল পরে মনুষ্য কর্ত্তৃক প্রজ্বলিত অগ্নিতে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
পরে জানিয়াছিলাম, স্তূপনির্ম্মাণের জন্য নগর হইতে সহস্রাধিক ব্যক্তি পাষাণ ছেদন করিতে পর্ব্বতের নিকটে আসিয়াছিল। তাহারা সমস্ত দিন পাষাণ ছেদন করিয়া পর্ব্বতের সানুদেশে রাত্রিযাপন করিত। সূর্য্যোদয় হইতে সন্ধ্যার সমাগম পর্য্যন্ত পাষাণ ছেদনের শব্দে ও সেই শব্দের প্রতিধ্বনিতে শৈলশ্রেণী কম্পিত হইত। শ্বাপদসঙ্কুল বনাবৃত সানুদেশ জীবশূন্য হইয়া উঠিল। মানবগণ মাসদ্বয় পর্ব্বতপার্শ্ব হইতে শিলাছেদনে ব্যাপৃত ছিল। শিলাছেদন শেষ হইলে নগর হইতে শত শত গোযান আসিয়া উপস্থিত হইল; গোযান যাতায়াতের জন্য উপত্যকা হইতে নিম্নভূমি পর্য্যন্ত পথ প্রশস্ত করা হইয়াছিল। দলে দলে বৃহৎকায় হস্তিগণ পর্ব্বতনিম্নে আনীত হইল ও দিনের পর দিন হস্তিগণ বৃহৎ পাষাণখণ্ডসমূহ শুণ্ডে উঠাইয়া গোযানে স্থাপন করিতে লাগিল।
দ্বিসহস্র বৎসর পূর্ব্বে হীনবল মানবজাতি কিরূপে এই গুরুভার পাষাণরাশি পর্ব্বতশ্রেণী হইতে বহু দূরবর্ত্তী নগরের সান্নিধ্যে লইয়া গিয়াছিল, বাষ্পীয় যন্ত্রের সাহায্য ব্যতীত গুরুভার পাষাণ কিরূপে ভূমি হইতে উত্তোলিত হইয়াছিল, তাহা ভাবিয়া তোমরা বিস্মিত হও, কিন্তু আমি তখন আশ্চর্য্যজনক বিশেষ কিছুই দেখি নাই। আমি কিসে বিস্ময় বোধ করি শুনিবে? আমার বিস্ময় বোধ হইয়াছিল গোশকট দেখিয়া, গোশকটের চক্র দেখিয়া, চক্রের প্রবর্ত্তন দেখিয়া। আমি ভাবিয়াছিলাম, কাষ্ঠনির্ম্মিত ক্ষুদ্র চক্র গুরুভার পাষাণের ভার বহন করিতে সমর্থ হইবে না; ভারবহনেও যদি সমর্থ হয়, শকট চলিতে সমর্থ হইবে না, নিশ্চয়ই কোন না কোন বিপদ ঘটবে। কিন্তু সামান্য চেষ্টাতেই শকট চলিল, চক্র প্রবর্ত্তিত হইতে লাগিল, ক্রমে অতি অল্প সময়ের মধ্যে পথ অতিবাহিত হইতে লাগিল। সেরূপ গোশকট তোমরা এখন আর ব্যবহার কর না, দুই একজন মাত্র, তাহার পাষাণে খোদিত চিত্র দেখিয়া থাকিবে। তাহা বর্ত্তমান কালে প্রচলিত গোশকটের ন্যায় নহে। বর্ত্তমানের গোশকট দ্বিচক্র, কিন্তু সেগুলি চারি বা ততোধিক চক্রের উপরে স্থাপিত হইত। রথচক্র কোন স্থানে ভূমিতে প্রবেশ করিলে বা পথের কোন স্থান কর্দমাক্ত থাকিলে হস্তিবৃন্দ আসিয়া সাহায্য করিত, শুণ্ডে রথচক্র মুক্ত করিত, কখন বা ভারবাহী গোসমূহকে সাহায্য করিত। এইরূপে গোশকটে সহস্রাধিক শিলাখণ্ড নূতন পথ ধরিয়া শতাধিক যোজন পথ আনীত হইল। শিলাবাহী শকট সমূহ যেদিন নগরের প্রান্তে উপস্থিত হইয়াছিল, সে দিন নগরে মহোৎসব আরম্ভ হইয়াছিল। দলে দলে নগরবাসিগণ আসিয়া আমাদিগকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। অনেকে এরূপ দীর্ঘকায় প্রস্তর পূর্ব্বে কখনও দেখে নাই; তাহারা বিস্ময় প্রকাশ করিতে লাগিল। ক্রমে শকটশ্রেণী নগরপ্রাকার অতিক্রম করিয়া নগরে প্রবেশ করিল। ক্রমে পথরোধ করিয়া ফেলিল। মুষ্টিমেয় রাজপুরুষের চেষ্টায় পথ মুক্ত হইল না; তখন অতি বৃদ্ধ, লোলচর্ম্ম, মুণ্ডিতশীর্ষ কাষায়বস্ত্র-পরিহিত একজন মনুষ্য আসিয়া ভগবান বুদ্ধের নাম উচ্চারণ করিয়া পথ মুক্ত করিতে অনুরোধ করিলেন। বৃদ্ধের ও রাজপুরুষগণের চেষ্টায় পথ মুক্ত হইল। শকটসমূহ নগর অতিক্রম করিয়া পুনরায় নগরপ্রাকারের বাহিরে এক প্রান্তরে আসিয়া সমবেত হইল।
এই সময়ে দেখিলাম, মনুষ্যজাতির অনেক পরিবর্ত্তন হইয়াছে; অনেক উন্নতি হইয়াছে, অনেক বিষয়ে অবনতিও হইয়াছে। নূতন নাম, নূতন আচারব্যবহার, নূতন অস্ত্র ও অন্যান্য ব্যবহার্য্য সামগ্রী আসিয়া আমার পূর্ব্ব পরিচিত শ্বেতকায় জাতিতে অনেক পরিবর্ত্তন ঘটাইয়াছে। বৃদ্ধ, স্থবির, ভিক্ষু, সঙ্ঘ, সঙ্ঘারাম, চীবর, কাষায় প্রভৃতি কথা পূর্ব্বে কখনও শুনি নাই। মনুষ্যজাতির আবাসস্থল নগরসমূহ সুদৃশ্য গগনস্পর্শী আবাস ভবনে পরিপূর্ণ হইয়াছে; রাজপথ সমূহ প্রস্তরাচ্ছাদিত হইয়াছে, বিশাল নগরে জলাভাব দূর করিবার জন্য কৃত্রিম নদীসমূহ খনিত হইয়াছে; হস্তী, উষ্ট্র, অশ্ব প্রভৃতি জীবগণ নরজাতির বশীভূত হইয়া তাহাদিগকে বহন করিতেছে; উষ্ট্র ও অশ্ববাহিত শকটের শব্দে শ্রুতিরোধ হইবার উপক্রম হইয়াছে; নগরমধ্যে জলপথে বিচিত্র তরণীসমূহ ইতস্ততঃ যাতায়াত করিতেছে। আমি এরূপ নগর পূর্ব্বে কখনও দেখি নাই, ক্রমে হস্তিযূথের সাহায্যে শকট হইতে প্রস্তরসমূহ ভূমিতে নিক্ষিপ্ত হইল। সমুদায় প্রস্তর নামাইতে সন্ধ্যাকাল উপস্থিত হইল। শকটের পশ্চাতে যে বিশাল জনসঙ্ঘ প্রান্তরে আসিয়াছিল, তাহার একে একে নগরে প্রত্যাগমন করিতে লাগিল।
ক্রমে বিশাল প্রান্তর জনশূন্য হইয়া গেল। পূর্ব্বে নগর ও নাগরিক কখনও দেখি নাই। সেদিন সহস্র সহস্র নাগরিকের কথোপকথন কর্ণগোচর হইয়াছিল; তাহার কতক বুঝিতে পারিয়াছিলাম, কতক পারি নাই। তবে এইমাত্র নিশ্চয় জানিয়াছিলাম যে, মানবজাতির ভাষার অবস্থান্তর ঘটিয়াছে। পূর্ব্বে কৃষ্ণকায় বনবাসী মানবজাতির মুখে যে ভাষার প্রয়োগ শুনিয়াছিলাম, সে ভাষার অবিমিশ্র প্রয়োগ আর শুনি নাই। পূর্ব্বে নবাগত শ্বেতকায় জাতির মুখে যে ভাষা শুনিতাম, সে ভাষাও আর শুনি নাই। এখন নাগরিকগণকে যে ভাষা ব্যবহার করিতে শুনিলাম, তাহা প্রাচীন শ্বেতকায় জাতির ভাষার ন্যায়, কিন্তু সেরূপ পুরুষ নহে, তাহা অপেক্ষাকৃত কোমল ও সুশ্রাব্য।
বহুকাল পরে মনুষ্যজাতি দেখিলাম। আমি বৃদ্ধ—অতি বৃদ্ধ; আমার বয়সের পরিমাণ করিবার যদি আমার ক্ষমতা থাকিত, তাহা হইলে, আমার বয়স শুনিয়া তোমরা বিস্মিত হইতে। বৃদ্ধগণ সাধারণতঃ প্রগল্ভ হইয়া থাকে; নগরবাসী মনুষ্যজাতিকে কি প্রকার দেখিলাম তাহা বলিতেছি, তুমি চিত্ত সংযত কর, আমার প্রগল্ভতায় বিরক্ত হইও না। শকটবাহিত পাষাণ দেখিতে নানাবিধ মনুষ্য আসিয়াছিল। যাহারা রাজপথে আসিয়াছিল তাহাদের মধ্যে স্ত্রী ও পুরুষ, বৃদ্ধ ও বালক, শ্বেত ও কৃষ্ণ, সর্ব্ববিধ মনুষ্যই দেখিয়াছিলাম। যাহারা আমাদিগকে ছেদন করিতে পর্ব্বতপার্শ্বে গমন করিয়াছিল, তাহারা শ্রমজীবী, কঠোর পরিশ্রমে পটু, পরুষভাষী, বহুভাষী ও বহুভোজী। শকটে প্রস্তর আসিতেছে শুনিয়া যাহারা নগরপ্রান্তে আমাদিগকে দেখিতে গিয়াছিল, তাহারা অধিকাংশই শ্রমজীবী, তবে তাহাদিগের মধ্যে দুই একজনকে দেখিয়া বোধ হইয়াছিল, তাহারা যেন অপর কোন জগতের মনুষ্য, তাহাদিগের সুদীর্ঘ বপু ও কোমল মুখকান্তি দেখিয়া মনে হইয়াছিল, যেন তাহারা কঠোর শারীরিক শ্রমে অভ্যস্ত নহে। তাহারা সুদৃশ্য বহুমূল্য পরিচ্ছদ ব্যবহার করে; তাহারা যে স্থান দিয়া চলিয়া যায় সে স্থান সুগন্ধে পূর্ণ হইয়া উঠে; তাহাদিগের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ অথচ যেন আলস্যজড়িত। পরে শুনিয়াছিলাম, তাহারা বিলাসপ্রিয় নাগরিক। নগরপ্রাকার অতিক্রমকালে আর এক শ্রেণীর মনুষ্য দেখিয়াছিলাম; তাহারা দীর্ঘকায়, সুদর্শন, কোমল অথচ কঠোর; তাহারা পরিচ্ছদের উপর লৌহবর্ম্ম ধারণ করিয়াছিল, কোমল হস্তে শাণিত লৌহ ধারণ করিয়াছিল, তাহাদিগের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও বলদীপ্ত। পরে জানিয়াছিলাম, তাহারা যুদ্ধব্যবসায়ী। পূর্ব্বে যে শ্বেতকায় জাতি দেখিয়াছিলাম, তাহাদিগের মধ্যে যাহারা যুদ্ধ করিত, তাহারাই দেবসেবা করিত, তাহারাই হলকর্ষণ করিত; কিন্তু তাহাদিগের মধ্যে বিলাসিতা ছিলনা। বর্ত্তমানকালে এ কথা তোমাদিগের নিকট শ্রুতিকঠোর হইবে। সহস্র সহস্র বর্ষকাল ব্যাপিয়া তোমরা জাতিভেদ—জাতি অনুসারে কর্ম্মভেদে অভ্যস্ত, সুতরাং এ কথা তোমরা হয় ত বিশ্বাস করিবে না। তোমাদিগের নিকটে তোমাদিগের প্রাচীন প্রথার অবশেষ যাহা কিছু আছে, তাহা হইতে তোমরা জানিয়া আসিতেছ যে, জাতিভেদ বহুকালের। কিন্তু আমি জাতিভেদ অপেক্ষাও প্রাচীন, আমি মনুষ্য-জাতি অপেক্ষা প্রাচীন, আমি সর্ব্বজীব অপেক্ষা প্রাচীন,—আমার কথা বিশ্বাস করিও।
নগর কাহাকে বলে তাহা সেই দিন দেখিলাম। দেখিলাম তাহা মনুষ্যের অরণ্যবিশেষ। যতদিন পর্ব্বতের পদপ্রান্তে পড়িয়া ছিলাম ততদিন দেখিয়াছি, জীব দেখিলে জীব হয় তাহার নিকট আসিয়া মিলিত হয়, নহে ত দূরে পলায়ন করে, হয় আলাপে প্রবৃত্ত হয়, নহে ত পরস্পরের প্রাণহরণের চেষ্টা করে। এত অল্পপরিসর স্থানের মধ্যে এত অধিক জীব পরস্পর বিবাদ না করিয়া, হিংসা না করিয়া কিরূপে বাস করে তা আমার নিকট অতীব বিস্ময়কর বলিয়া বোধ হইয়াছিল। কিন্তু শুনিয়াছি, বিবাদ ও হিংসার প্রকারভেদ হইয়াছে; যে স্থানে জীবের অস্তিত্ত্ব আছে বিবাদ ও হিংসা এখনও সে স্থানে বিদ্যমান আছে। যখন নগরপ্রাকার অতিক্রম করিয়া নগরমধ্যে গমন করিতেছিলাম তখন দেখিতেছিলাম, জনস্রোতঃ নানাপথ হইতে আসিয়া একত্র মিলিত হইতেছে। পরস্পর অভিভাষণ না করিয়া, এমন কি পরস্পরের দিকে দৃষ্টিপাতও না করিয়া যে যাহার গন্তব্যপথে চলিয়া যাইতেছে। প্রথম দিন নগর দেখিয়া ইহা আমার নিকট একান্ত বিস্ময়কর বোধ হইয়াছিল। রাজপথের উভয় পার্শ্বে সুসজ্জিত বিপনীশ্রেণী, অসংখ্য ক্রেতা ও বিক্রেতা, বিপুল পণ্যের সমাবেশ প্রথম দেখিয়া বড়ই আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছিলাম। বিপনীর উপরে গবাক্ষপথে শকটশ্রেণী-দর্শনলোলুপা অবগুণ্ঠনশূন্যা অন্তঃপুরিকাগণকেও দেখিয়াছিলাম! ইহার পূর্ব্বে কখনও এত অধিক স্ত্রীলোকের একত্র সমাবেশ দেখি নাই। সে দিন কত অলঙ্কার, কত বস্ত্র, কত বেশবৈচিত্র দেখিয়াছি তাহা আর কি বলিব! শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিবাহিত হইয়াছে, কিন্তু মনুষ্যজাতির প্রথম নগর দেখিয়া যেরূপ আনন্দ হইয়াছিল, সেরূপ আনন্দ আর কখনও উপভোগ করিব কি না সন্দেহ। আমাদিগকে দেখিতে নগরের প্রায় সমুদায় লোকই আসিয়াছিল; রাজাও আসিয়াছিলেন, তিনি নগরের মধ্যভাগে অষ্টাশ্বযোজিত সুবর্ণনির্ম্মিত রথারোহণে আসিয়াছিলেন। অশ্বারূঢ় রাজকর্ম্মচারিগণ তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া ছিল; তাঁহাকে দেখিয়া নগরবাসিগণ আনন্দধ্বনি করিতেছিল; বাতায়নপথে নাগরিকগণ পুষ্প ও লাজ বৃষ্টি করিতেছিল। রাজসমাগম যেন একটি স্বতন্ত্র উৎসব হইয়া উঠিয়াছিল। রাজপথে দেখিয়াছিলাম, সুন্দরী রমণীগণ পুষ্পসজ্জায় সজ্জিত হইয়া নাগরিকগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছে। তাহাদিগের আকার-ইঙ্গিত, আচার-ব্যবহার তখন আমার নিকট সম্পূর্ণ নূতন। পরে শুনিয়াছি তাহারা বারাঙ্গনা।
নগর অতিক্রম করিয়া দেখিয়াছিলাম, নগরপ্রাকারের বহির্ভাগে সুসজ্জিত পুষ্পবাটিকা সমূহ নরনারীতে পরিপূর্ণ। বিবিধবর্ণে রঞ্জিত, নানা আভরণে ভূষিত সুন্দরীগণের কলহাস্যে নগরোপকণ্ঠ যেন নূতন শ্রীসম্পন্ন হইয়া উঠিয়াছে। তাহদের আসবপানে ঈষদ্রক্ত আকর্ণবিশ্রান্ত নয়ন কটাক্ষপাতে যেন ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। সেরূপ বিলাসবিহ্বল দৃষ্টি পরে আর কখনও দেখি নাই। যাহারা কাদম্ব পান করিত, তাহাদিগের কাদম্বের সহিত তাহারাও অন্তর্হিত হইয়াছে। লোকে নিত্য যাহা দেখিয়া থাকে, তাহার প্রতি লোকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় না। যাহা নূতন দেখে তাহা দেখিয়া যেন তৃপ্তি হয় না। নগর, নাগরিক, নাগরিকা, উপনগর, পুষ্পবাটিকা, উৎসব সকলই তখন আমার নিকট নূতন। সে দিন যেভাবে মনুষ্যজাতিকে দেখিয়াছিলাম, তাহার পূর্ব্বে কখনও সে ভাবে দেখি নাই, আর কখনও সে ভাবে দেখিব না। যখন পর্ব্বতের সানুদেশে ছিলাম, তখন দেখিতাম সন্ধ্যাগমে বনরাজি নিঃশব্দ হইত। যে দিন চন্দ্রোদয় হইত না, সেদিন খদ্যোতের আলোকে পর্ব্বতমালা ভীষণ বোধ হইত। নগর দেখিয়া আমার সেই কথা মনে হইত। আমরা যে প্রান্তরে পড়িয়া ছিলাম, সন্ধ্যাগমে সেই স্থান হইতে দেখিতাম, দূরে বিশাল পর্ব্বতমালার ন্যায় অন্ধকারাচ্ছন্ন সৌধশ্রেণীর অস্পষ্টমূর্ত্তি দৃষ্ট হইতেছে, পর্ব্বতগাত্রে খদ্যোতশ্রেণীর ন্যায় নগরে অসংখ্য দীপশ্রেণী প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে। দীপ কাহাকে বলে পূর্ব্বে তাহা জানিতাম না। অগ্নির আলোক দেখিয়াছি, কিন্তু পূর্ব্বে দীপালোক দেখি নাই। দূর হইতে স্নিগ্ধ দীপালোক স্নিগ্ধতর বোধ হইত। নিশাগমে নগরের নানা স্থান হইতে গীতবাদ্যের রব আসিত। ক্রমে নদীবক্ষে দুই একখানি তরণী দেখা যাইত; ক্ষুদ্র তরণীতে যুবক যুবতী একত্র নৈশ বায়ু সেবনে নির্গত হইয়াছে; যুবতী গান গাহিতেছে, যুবক ক্ষেপণি চালনা করিতেছে। কোন কোন বৃহদাকার তরণীতে বিলাসীরা আসবোন্মত্তা বারনারী পরিবৃত হইয়া কলরব করিতে করিতে চলিয়াছে। তাহাদিগের আমোদ-প্রমোদ, আশা-ভরসা, সুখ-দুঃখ লইয়া তাহারা চলিয়া গিয়াছে; কেবল সুদূর অতীতের সাক্ষিরূপেই যেন আমাকে রাখিয়া গিয়াছে।