পাষাণের কথা



শ্রীরাখালদাস বন্দোপাধ্যায় প্রণীত



কলিকাতা

১৩২১

মূল্য ১৲ একটাকা

কলিকাতা
২০১, কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রীট হইতে
শ্রীগুরুদাস চট্টোপাধ্যায় কর্ত্তৃক প্রকাশিত

প্যারাগণ প্রেস
২০৩।১৷১, কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রীট, কলিকাতা
শ্রীগোপালচন্দ্র রায় কর্ত্তৃক মুদ্রিত

গ্রন্থকারের নিবেদন

 পাষাণের কথা “আর্য্যাবর্ত্তে” প্রকাশের জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত খগেন্দ্রনাথ মিত্র মহাশয়ের অনুরোধে লিখিত হইয়াছিল। তিনি সংক্ষেপে পত্রিকার নামের সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখিতে বলিয়াছিলেন কিন্তু ফলে তাহা একটা দীর্ঘ ক্রমশঃ প্রকাশ্য প্রবন্ধে পরিণত হইয়াছিল। লিখিবার সময় বিজ্ঞানাচার্য্য ডাক্তার শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য্যপদ শ্রীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও প্রবাসী সম্পাদক শ্রীযুক্ত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়দিগের নিকট নানাবিধ সাহায্য পাইয়াছি। ত্রিবেদী মহাশয় ও চট্টোপাধ্যায় মহাশয় লেখা শেষ হইলে উহা আদ্যোপ্রান্তে পাঠ করিয়া সংশোধন করিয়া দিয়াছেন। যাঁহার পদপ্রান্তে উপবেশন করিয়া প্রত্নবিদ্যার বর্ণমালা শিক্ষা করিয়াছি, সেই আচার্য্যপাদ মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয় ইহার মুখবন্ধ লিখিয়া দিয়াছেন। তাঁহার উপক্রমণিকা না থাকিলে আমার উদ্দেশ্য বোধ হয় ব্যর্থ হইত। “পাষাণের কথা” প্রাচীন পাষাণের কথা হইলেও ইতিহাসের ছায়া অবলম্বনে লিখিত আখ্যায়িকা, ইহা বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে রচিত ইতিহাস নহে।

৬৫ নং সিমলা স্ট্রীট, কলিকাতা,
২১শে বৈশাখ, ১৩২১।

শ্রীরাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।


ভূমিকা

 পুরাণ কথা কে বলে, বলিবার লোক নাই। বুড়া মানুষে না হয় ১০০।১৫০ বৎসরের কথা বলিল, ইহার অধিক হইলে বলিবার মানুষ পৃথিবীতে পাওয়া যায় না। লেখায় পড়ায় রাখিয়া গেলে সে কথা অনেক দিন থাকে সত্য, কিন্তু যে জিনিসে লেখা হয়, সে ত আর বেশী দিন টিকে না। কাগজ ৮।৯ শত বৎসর টিকে, তালপাতা ১২।১৪ শত বৎসর টিকে, ভুজ্যিপত্র ১৫।১৬ শত বৎসর টিকে, পেপিরস না হয় দুহাজার বৎসর টেঁকিল। ইহার অধিক দিনের কথা শুনিতে গেলে কাহার কাছে যাই? পাথর ভিন্ন অন্য উপায় নাই। তাও আবার সকল পাথরে হয় না। বেলে পাথর ৫৭।৬০ বৎসরে ক্ষইয়া যায়। অনেক শক্ত পাথরে চটা উঠিয়া যায়। কেবল দুই প্রকার পাথরে আঁক চিরকাল থাকে। এক রকম পাথর আগুনের তাতে গলিয়া যায়, তাকে ধাতু কহে; আর এক রকম পাথর কিছুতেই গলে না, ক্ষয় হয় না, তাহাকে পাষাণ বলে। পুরাণ কথা শুনিতে গেলে এই পাষাণকে কথা কহাতে হয়, নহিলে পুরাণ কথা শুনিবার উপায় নাই।

 অন্যদেশে বরং ৩।৪ হাজার বৎসরের খবর পাওয়া বায়, কেননা সেখানকার পণ্ডিতেরা যে সকল পুঁথি রাখিয়া গিয়াছেন, তাহা বারবার নকল হইয়া আজ পর্য্যন্ত আসিয়া পঁহুছিয়াছে। আমাদের দেশেও এরকম অনেক পুঁথি আসিয়া পঁহুছিয়াছে; তাহাতেও আছে সবই—যাগ আছে, যজ্ঞ আছে, আইন আছে, কানুন আছে, চিকিৎসা আছে, জ্যোতিষ আছে, ব্যাকরণ আছে, কাব্য আছে, অলঙ্কার আছে, বিজ্ঞান আছে—আছে সবই, নাই কেবল সেকালের পুরাণ কথা। পুরাণ কথা কহিতে আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা ভালবাসিতেন না; ঐ কথাটি কহিতে ঋষিদের মুখ বন্ধ, মুনিদের মুখ বন্ধ, কবিদের মুখ বন্ধ, দর্শনের মুখ বন্ধ, বিজ্ঞানের মুখ বন্ধ, জ্যোতিষের মুখ বন্ধ। সুতরাং আমাদের দেশে পুরাণ কথা যদি শুনিতে চাও তাহা হইলে পাথরকে কথা কহাও, নহিলে ভারতের পুরাণ কাহিনী বলিবার আর লোক নাই।

 পাষাণ বড় শক্ত জিনিস, বাহিরও শক্ত ভিতরও শক্ত; কথা কহিতে গেলে শব্দ করিতে হয়। শব্দ ফাঁপা জিনিষ ভিন্ন হয় না, অথচ পাষাণ নিরেট। ন্যায়শাস্ত্রে বলে শব্দ আকাশের গুণ; পাষাণের মধ্যে আকাশ থাকিতে পারে না, সুতরাং পাষাণকে কথা কহান বড় শক্ত ব্যাপার। আকাশ ত আকাশ! পাষাণের উপর বাটালিও চলা কঠিন। সে কালের রাজা রাজড়ারা বাটালি দিয়া কুঁদিয়া পাষাণে দুইচারিটী কথা লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন, পাষাণ তারই প্রতিধ্বনি করে মাত্র। যখন হাজার হাজার বৎসর পরে বাটালির দাগ মিলাইয়া যাইবে, তখন সে প্রতিধ্বনি বন্ধ হইবে; ইতিমধ্যে পাষাণ তোমায় দু চারিটী কথা শুনাইতে পারিবে। আমাদের দেশময় অনেক অনেক জায়গায় পাষাণে এইরূপ বাটালি কাটা লেখা আছে। সেই গুলি সংগ্রহ করিয়া আমাদের দেশের পুরাণ ইতিহাস।

 পাথরের কথা বুঝিবার ক্ষমতা সকলের থাকে না, আমাদের দেশে একেবারেই ছিল না। অনেক যত্নে অনেক পরিশ্রমে প্রায় ৮০ বৎসর পূর্ব্বে প্রিন্সেপ সাহেব পাষাণের ভাষার অক্ষর-পরিচয় আরম্ভ করেন। তারপর কীটো, কনিংহাম, বিউলার প্রভৃতি বড় বড় সাহেবরা সে ভাষা বুঝিতে শিখেন। এখন এদেশের লোক অনেকে পাষাণের কথা কহিতে পারে, পাষাণের কথা বুঝিতে পারে ও লোকজনকে বুঝাইতে পারে। কিন্তু পাষাণ ত অতি অল্প কথা কয়। একখানি শিলাপত্রে একটি মাত্র ঘটনার কথা থাকে। অনেক শিলাপত্র একত্র না করিলে ইতিহাস পাওয়া যায় না। শিলাপত্রও আবার একজায়গায় থাকে না। কোনখানি হিমালয়ে, কোন খানি বিন্ধপর্ব্বতে, কোন খানি উরুবেলায়, কোন খানি আবার সুদূর নীলগিরিতে। এসকল সংগ্রহ করা বড় পরিশ্রমের কাজ। ইংরাজের নাকি বড় রাজত্ব, প্রচুর ক্ষমতা এবং অনন্ত জ্ঞানপিপাসা; তাই তাঁহারা এই সমস্ত শিলালিপি সংগ্রহ করিয়া ভারতের ইতিহাস উদ্ধার করিতেছেন। যাহা আমাদের সাধ্যের অতীত, তাঁহারা তাহা সুসাধ্য করিয়া তুলিয়াছেন। অনেক বিষয়েই আমরা ইংরাজের ঋণ শুধিতে পারিব না, এ বিষয়ে কিন্তু ইংরাজের নিকটে আমরা অনন্তকাল ঋণী থাকিব। এ ঋণ একেবারে শোধ হইবার নয়।

 যখন বৌদ্ধধর্ম্মের বড়ই প্রভাব তখন বুদ্ধ-দেবের পরম ভক্তেরা চাঁদা করিয়া পাথর কাটিয়া আনিয়া বড় বড় স্তূপ নির্ম্মাণ করিত এবং তাহার ঠিক মাঝখানে বুদ্ধদেবের অস্থি রক্ষা করিত এবং সেই স্তূপকে বুদ্ধ, ধর্ম্ম ও সঙ্ঘের একত্র মিলন বলিয়া মহা ভক্তিভরে তাহার পূজা করিত; সেই স্তূপের চারিদিকে বড় বড় পাথরের রেল দিত। টোকা টোকা খামের উপর রেলিং, আর দুই দুইটা থাম মিলাইবার জন্য তিনটী করিয়া সূচী। এমন করিয়া পালিস করিত যে হাত দিলে হাত পিছলাইয়া পড়িত। প্রত্যেক থামে, প্রত্যেক সূচীতে ও রেলের প্রত্যেক পাথরে যে চাঁদা দিত তাহার নাম লেখা থাকিত। ভারতবর্ষে এরূপ স্তূপ অনেক ছিল, দুই চারিটী এখনও আছে। এই স্তূপে অনেক পাষাণ আছে, তাহারা সকলে মিলিয়া অনেক কথা কয়, আমাদের অনেক পুরাণ কথা শুনায়, আমাদের যে গৌরব নষ্ট হইয়া গিয়াছে, তাহা আবার মনে করাইয়া দেয়।

 বাঘেলখণ্ডে বেরুট নামক স্থানে এইরূপ একটী প্রকাণ্ড স্তূপ ছিল, কালের কুটীল গতিতে বৌদ্ধদ্বেষীদিগের উৎপীড়নে সে স্তূপের অনেক ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। রেলিংয়ের যে অংশটুকু আভাঙ্গা টাট্‌কা ছিল, কনিংহাম সাহেব তাহা তুলিয়া আনিয়া কলিকাতার বড় যাদুঘরে আবার সেইরূপে খাটাইয়া রাখিয়াছেন। এ স্তূপেরই একখানি পাথর কি কি পুরাণ কথা কহিতে পারে, আপনারা শুনুন। শ্রীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এম এ এই সকল পাষাণের কথা অনেক পরিশ্রমে, অকাতরে অর্থ ব্যয় করিয়া বুঝিতে শিখিয়াছেন, এবং আপনাদিগকে বুঝাইয়া দিতেছেন।

শ্রীহরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

সূচীপত্র

 
 

এই লেখাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক ডোমেইনে অন্তর্গত কারণ এটি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারির পূর্বে প্রকাশিত।


লেখক ১৯৩০ সালে মারা গেছেন, তাই এই লেখাটি সেই সমস্ত দেশে পাবলিক ডোমেইনে অন্তর্গত যেখানে কপিরাইট লেখকের মৃত্যুর ৮০ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকে। এই রচনাটি সেই সমস্ত দেশেও পাবলিক ডোমেইনে অন্তর্গত হতে পারে যেখানে নিজ দেশে প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রলম্বিত কপিরাইট থাকলেও বিদেশী রচনার জন্য স্বল্প সময়ের নিয়ম প্রযোজ্য হয়।