[ ৬ ]

 পরদিন প্রভাতে অধিকাংশ নগরবাসী অর্চ্চনা করিবার জন্য স্তূপে আসিল। হিমকণ-ধৌতহেমন্ত প্রভাতে নবজাত সূর্য্যকরস্নাত হইয়া দলে দলে কৌষেয় বস্ত্র পরিহিত নগরবাসী স্তূপ দর্শন, প্রদক্ষিণ ও অর্চ্চন করিয়া গেল। দিনের পর দিন যাইতে লাগিল, নবনির্ম্মিত স্তূপের সৌন্দর্য্যের খ্যাতি চতুর্দ্দিকে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল; নানাদেশ হইতে জনসঙ্ঘ স্তূপ দর্শন করিতে আসিল। এইরূপে নবাগতের কোলাহলে কিছুকাল কাটিয়া গেল। কাল-নিরূপণ করিবার ক্ষমতা আমার যদি থাকিত, তাহা হইলে সমস্ত স্তূপের ইতিবৃত্ত বলিয়া যাইতে পারতাম, কিন্তু পূর্ব্বেই বলিয়াছি, সে ক্ষমতা আমার নাই। আমার জন্মের প্রথম দিবস হইতে, চিত্রশালায় আগমন পর্য্যন্ত সমস্ত কথা বলিতে পারি, কিন্তু কোনও ঘটনার সময় নির্দ্দেশ করিবার ক্ষমতা আমার নাই। কিছুকাল গত হইলে যখন স্তূপ পুরাতন হইল, তখন দর্শকের সংখ্যা ক্রমে কমিয়া আসিল। প্রতিদিন প্রাতে নিয়মিত সংখ্যক স্থবির ও স্থবিরা স্তূপদর্শন করিতে আসিতেন। ক্বচিৎ কখনও দূরদেশাগত তীর্থযাত্রী তথাগতের শরীর দর্শন মানসে নগরে আসিতেন। সেই দিন বৃদ্ধ মহাস্থবির মহোল্লাসে গর্ভগৃহের দ্বারোন্মোচন করিতে আসিতেন। তিনি স্তূপবেষ্টনীর বহির্ভাগে কাঠনির্ম্মিত সঙ্ঘারামে বাস করিতেন। একদিন দেখিলাম, পুষ্পচন্দনশোভিত মহাবৃদ্ধ মহাস্থবিরের শবদেহ ভিক্ষুসঙ্ঘ নগরাভিমুখে লইয়া গেল। নগরে আর্ত্তনাদ উত্থিত হইল। প্রান্তরমধ্যস্থিত ক্ষুদ্র নদীতীরে প্রাচীন মহাস্থবিরের দেহ ভস্মীভূত হইল। একদিন শুনিলাম, সঙ্গারামবাসী ভিক্ষুগণ রাজপ্রাসাদে আহূত হইয়াছেন, রাজা ধনভূতির অন্তিমকাল উপস্থিত। ধনভূতির মৃত্যু হইল। তাহার শিশুপুত্ত্রকে সিংহাসনে স্থাপিত করিয়া বিশ্বস্ত রাজকর্ম্মচারিগণ রাজ্যরক্ষা করিতে লাগিলেন। এইরূপে কিছুদিন কাটিয়া গেল, তক্ষশিলা হইতে সিংহদত্তের নির্ব্বাণলাভের সংবাদ আসিল। তাহার পরই প্রলয় ঝটিকা উত্থিত হইল।

 পতনোন্মুখ যবনজাতিকে, বোধ হয়, সিংহদত্তই দণ্ডায়মান রাখিয়া ছিলেন। স্বদেশ, স্বধর্ম্ম, স্বভাষাচ্যুত যবনজাতির মধ্যে একতার অত্যন্ত অভাব হইয়াছিল। সিংহদত্তই বন্ধনরজ্জুর ন্যায় কাষ্ঠখণ্ডগুলি একত্র রাখিয়াছিলেন। সেই রজ্জুর প্রভাবেই যবনগণ শকজাতির প্রথম আক্রমণ রোধ করিতে সমর্থ হইয়াছিল। শকদ্বীপ ত্যাগ করিয়া পঙ্গপালের ন্যায় শকজাতি দলে দলে মহানদী পার হইতেছে, মহানদী আর শকযবনাধিকারের সীমা নাই। কপিশায় শকরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। গান্ধার, উদ্যান, উরস ও টক্কদেশে যবনরাজগণ আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছেন বটে, কিন্তু তাহাও সিংহদত্তের জন্য—সিংহদত্তের প্রভাবে। সিংহদত্তের অবর্ত্তমানে আর্য্যাবর্ত্তের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রক্ষার কি ব্যবস্থা হইবে, সে চিন্তা মধ্যদেশের রাজগণের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে নাই। প্রাচীন পৌরবরাজ্যের অধঃপতনে তাঁহারা আনন্দিত হইয়াছিলেন, স্বধর্ম্মত্যাগী সিংহদত্তের প্রভাববৃদ্ধিতে তাঁহারা ঈর্ষ্যান্বিত হইয়াছিলেন। কিন্তু সিংহদত্ত তাঁহাদিগের জন্য কি করিতেছেন, সিংহদত্তের অভাবে তাঁহাদিগের কি উপায় হইবে, কুরুক্ষেত্র হইতে পাটলিপুত্র পর্য্যন্ত কোন রাজাই সে বিষয়ে মনোযোগ করেন নাই। সিংহদত্তের অভাব হইলে মথুরার অধিকারবঞ্চিত হইয়া রামদত্ত সক্ষোভে বলিয়াছিলেন, আজ বর্ষীয়ান্ পৌরবমহাস্থবির জীবিত থাকিলে শকগণকে সুবস্তু নদী পার করিয়া রাখিয়া আসিতাম।

 প্রতিদিন পূর্ব্বতোরণের নিম্নে বসিয়া স্তূপসংলগ্ন সঙ্ঘারামবাসী ভিক্ষুগণ আর্য্যাবর্ত্তের বর্ত্তমান অবস্থার কথার আলোচনা করিতেন। তাঁহাদিগের নিকটই শুনিতাম যে, মহাসমুদ্রের উর্ম্মিরাশির ন্যায় শকজাতি আর্য্যাবর্ত্ত আচ্ছন্ন করিতে আসিতেছে, সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরে আর আর্য্যাধিকার নাই। বাহ্লীকের যবনরাজ্য ধ্বংস হইলে পারদরাজগণ শকপ্লাবনস্রোত রোধ করিতে বৃথা চেষ্টা করিয়াছিলেন। সুদূর যোনদ্বীপে ও মিজ্রাইমে আন্তীয়োক ও তুরময় বংশীয় রাজগণ শকজাতির আক্রমণভয়ে কম্পিত হইতেছেন, শকজাতির গতিরোধের চেষ্টায় চারিজন পারদরাজ জীবন-বিসর্জ্জন করিয়াছেন, পঞ্চমের জীবন সঙ্কটাপন্ন। শকস্রোত ক্রমশঃ নিকটবর্ত্তী হইল। উপনগরবাসী জনৈক ব্যক্তি জালন্ধরে শকসৈন্য দেখিয়া আসিয়াছে। তাহার নিকট হইতে শকজাতির বিবরণ শুনিবার জন্য কৌশাম্বী হইতে রাজদূত আসিয়ছে। ক্রমশঃ শ্রুত হইল, মথুরায় রামদত্ত ও ত্রিগর্ত্তে উত্তমদত্তের অধঃপতন হইয়াছে; অতি প্রাচীন চেদি রাজবংশ মৎস্যদেশের অধিকার হইতে বিচ্যুত হইয়াছেন। একদিন সংবাদ আসিল যে, শকসৈন্য নগর অধিকার করিতে আসিতেছে। নগরের কথা বলি নাই। ধনভূতির শিশু পুত্ত্র যথাসময়ে বয়ঃপ্রাপ্ত, জরাগ্রস্ত ও কালকবলিত হইয়াছেন। তাঁহার পর তদ্বংশের অপর রাজদ্বয় সিংহাসন অধিরোহণ করিয়াছিলেন। শক আক্রমণকালে যিনি নগরাধিপতি ছিলেন তাঁহার সদ্ধর্ম্মের প্রতি তাদৃশ অনুরাগ ছিল না। তখন আর্য্যাবর্ত্তে দাক্ষিণাত্যবাসী অন্ধ্র জাতির অধিকার, সদ্ধর্ম্মদ্বেষী সুঙ্গবংশের অধঃপতন হইয়াছে। তৎপদানুবর্ত্তী অহিচ্ছত্রবাসী বিশ্বাসঘাতক কাণ্ববংশীয় ব্রাহ্মণগণও নির্ম্মূল হইয়াছে; আর্যাবর্ত্তের রাজচক্রে শিথিলতা প্রবেশ করিয়াছে। পাটলিপুত্রে অন্ধ্ররাজের জনৈক কর্ম্মচারী বাস করেন, কিন্তু তাঁহার ক্ষমতা মগধের বহির্দ্দেশে লক্ষ্য হয় না। যে দিন সংবাদ আসিল, শকরাজের বিপুল বাহিনী নগর হইতে পঞ্চদশ ক্রোশ দূরে শিবির স্থাপন করিয়াছে, সেদিন নগরাধিপতির সত্য সত্যই ঘোর দুর্দ্দিন। মৌর্য্য সাম্রাজ্যের অধঃপতনের পরে সুঙ্গরাজগণ কিয়ৎ পরিমাণে করদরাজগণকে সম্রাটের প্রভাব অনুভব করাইতে পারিতেন; কিন্তু পরবর্ত্তী রাজগণ এককালীন ক্ষমতাহীন ছিলেন, নামে মাত্র আর্য্যাবর্ত্ত অন্ধ্রসাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। অধিকাংশ আর্য্যাবর্ত্তবাসী অন্ধ্র কি তাহা জানিত না; কেহ কেহ বলিত তাহারা ক্ষত্রিয়জাতীয়, কেহ বা বলিত, তাহারা দস্যু। দাক্ষিণাত্যের কোন নিভৃত উপত্যকার অন্ধ্ররাজের রাজধানী অবস্থিত ছিল, আর্য্যাবর্ত্তে, বিশেষতঃ নগরে, তাহা অনেকেই অবগত ছিলেন না। যে দিন শ্রুত হইল যে, পঞ্চাশৎ সহস্র শক অশ্বারোহী নগরাভিমুখে ধাবমান হইয়াছে, সেদিন নগরাধিপতিকে সাহায্য করে এমন ব্যক্তি কেহই ছিল না। আসন্ন বিপৎ শঙ্কায় ব্যাকুল নরনারী দলে দলে নগর পরিত্যাগ করিয়া পর্ব্বতাভিমুখে পলায়ন করিল, সঙ্ঘারাম ত্যাগ করিয়া ভিক্ষুগণ উজ্জয়িনীর পথে প্রস্থান করিলেন, নগরে এমন লোক রহিল না যে, নগর প্রাকার রক্ষা করে। শকসৈন্যের আগমন সংবাদ শুনিয়া শুক্লবসনপরিহিতা রাজমাতা বুদ্ধের শরীরনিধান সম্মুখে ভূমিশয্যা গ্রহণ করিলেন; মুষ্টিমেয় শরীররক্ষী লইয়া তরুণ রাজা শকসৈন্যের আক্রমণ প্রতিরোধ করিতে প্রস্তুত হইলেন। যাহারা নগর ত্যাগ করিয়া যায় নাই তাহাদিগের মধ্যে অধিকাংশই সুশিক্ষিত রণদক্ষ সৈন্য, কিন্তু তাহাদিগের সংখ্যা এত সামান্য যে, পঞ্চাশৎ-সহস্র অশ্বারোহীর বিরুদ্ধে তাহারা একপদ তিষ্ঠিতে পারিত কিনা সন্দেহ।

 পরদিন প্রভাতে নগর নিস্তব্ধ, জনশূন্য। প্রান্তরে কৃষক হলকর্ষণ করিতে বা মেষপাল চারণ করিতে আসে নাই। প্রতিদিন প্রত্যূষে সঙ্ঘারামবাসী ভিক্ষুগণ তথাগতের শরীর অর্চ্চনা করিতে আসিতেন, কিন্তু সেদিন বেষ্টনী, স্তূপ ও গর্ভগৃহ জনশূন্য, গর্ভগৃহ মধ্যে মৃতপ্রায়া রাজমাতা শরীর-নিধানের সম্মুখে ধূলিতে লুটাইতেছেন। বহুদূরে বহু অশ্বপদ শব্দ শ্রুত হইল, ক্রমে উত্তরে ঘন কৃষ্ণবর্ণ মেঘের ন্যায় শকসৈন্যের পুরোভাগ দৃষ্ট হইল, দেখিতে দেখিতে তাহারা প্রান্তরস্থিত নদীতীরে আসিয়া উপনীত হইল। তখন নবেদিত সূর্য্যের কিরণমালা আসিয়া স্তূপের উচ্চচূড়া কেবল স্পর্শ করিয়াছে। রক্তবর্ণ প্রস্তরনির্ম্মিত সুগঠিত স্তূপ ও বেষ্টনী দেখিয়া একবার যেন তাহারা থমকিয়া দাঁড়াইল, তাহার পর সুশিক্ষিত বলবান অশ্বগণ এক এক লম্ফে ক্ষীণকায়া নদী পার হইয়া আসিল। তাহাদিগের উজ্জ্বল লৌহনির্ম্মিত বর্ম্ম শিরস্ত্রাণ প্রভাতসূর্য্যের কিরণে উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিল। সেই কৃষ্ণবর্ণ মেষচর্ম্মনির্ম্মিত পরিচ্ছদ, অদৃষ্টপূর্ব্ব আয়ুধসমূহ ও ঘোর রক্ত বর্ণ মুখমণ্ডল অত্যন্ত ভয়াবহ। সমান্তরালে পংক্তির পর পংক্তি অশ্বারোহী প্রান্তর অতিক্রম করিয়া নগরাভিমুখে চলিয়া গেল, দ্বিলক্ষ অশ্বখুরোত্থিত ধূলিতে প্রান্তর অন্ধকার হইয়া গেল, সর্ব্বশেষ পংক্তি শত্রুর সন্ধানে স্তূপবেষ্টনী অভিমুখে আসিল। বেষ্টনী ও সঙ্ঘারাম তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিয়া কয়েকজন অশ্বারোহী তোরণপথে প্রদক্ষিণের মধ্যে প্রবেশ করিল, অশ্বপদশব্দে ত্রস্তা রাজমাতা যেমন গর্ভগৃহ হইতে বহির্গতা হইতে যাইবেন, অমনই জনৈক অশ্বারোহীনিক্ষিপ্ত অষ্টহস্ত পরিমিত শূল তাঁহার বক্ষোদেশ বিদীর্ণ করিল। তাঁহার মৃতদেহ গর্ভগৃহ মধ্যে পতিত হইল। স্তূপ খননকালে সুবর্ণখচিত বহুমূল্য কৌষেয় বস্ত্রজড়িত রাজমাতার অস্থিনিচয় তোমরা পাইয়াছিলে; অবজ্ঞা করিয়া তাহা সংগ্রহশালায় উঠাইয়া আন নাই, পলিতকেশ শ্বেতাঙ্গ পণ্ডিতের উপদেশ অবহেলা করিয়াছিলে। তখন যদি উহার কাহিনী জানিতে তাহা হইলে নিশ্চয়ই উহা সাদরে সংগ্রহ করিয়া লইয়া আসিতে। শকসৈনিক নিক্ষিপ্ত শূল রাজ্ঞীর বক্ষবিদীর্ণ করিয়া মেরুদণ্ডে প্রোথিত হইয়া গিয়াছিল, শূলের ফলক ও তৎসংলগ্ন অস্থিখণ্ড এখন বর্ব্বরগ্রামে উপাসনার সামগ্রী হইয়াছে, অবশিষ্ট অস্থিখণ্ড ও বহুমূল্য বস্ত্রের অবশেষ ধূলায় মিশাইয়া গিয়াছে। নগরধ্বংসের পরদিন সংঙ্ঘারামের জনৈক প্রাচীন পরিচারক অতি সন্তর্পণে আসিয়া স্তূপ বেষ্টনী ও সঙ্ঘারাম সন্ধান করিতে লাগিল; গর্ভগৃহের দ্বারে আসিয়া দেখিল যে, শূলের কাষ্ঠদণ্ডের অর্দ্ধভাগ দ্বারের বাহিরে রহিয়াছে, দ্বারদেশে ধূল্যবলুণ্ঠিত প্রাণশূন্য দেহ পতিত রহিয়াছে। বহু যত্নেও সে দেহ হইতে শূল মোচন করিতে পারিল না; তাহার জীর্ণ দেহে ক্ষীণ হস্তে এমন বল ছিল না যে, মেরুদণ্ডে দৃঢ় ভাবে প্রোথিত বৃহৎ শূল টানিয়া বাহির করে। সে ধীরে ধীরে মৃতদেহ উঠাইয়া গর্ভগৃহের এক কোণে স্থাপন করিল ও সঙ্ঘারাম হইতে কয়েক খণ্ড কাষ্ঠ আনিয়া মৃতদেহের জন্য আধার নির্ম্মাণে প্রবৃত্ত হইল। আধার প্রায় নির্ম্মিত হইয়াছে, এমন সময় দূরে অশ্বপদশব্দ শ্রুত হইল; কাষ্ঠ ও অস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া পরিচারক পলায়নোন্মুখ হইল, স্তূপের বাহিরে আসিয়া দেখিল যে, একজন মাত্র অশ্বারোহী স্তূপাভিমুখে আসিতেছে ও তাহার উষ্ণীষ ভারতবাসীর ন্যায়। তখন সে আশ্বস্ত হইয়া প্রতীক্ষায় তোরণদ্বারে দণ্ডায়মান হইল; অশ্বারোহী নিকটে আসিলে পরিচারক তাহাকে চিনিতে পারিল, সে নগররক্ষী জনৈক সৈনিক, তাহার সহিত নগরের পতন সম্বন্ধে অনেক কথা হইল। অবশেষে তাহার সাহায্যে রাজ্ঞীর দেহ বৃহৎ কাষ্ঠাধারে আবৃত্ত করিয়া উভয়ে কাষ্ঠাধার গর্ভগৃহের এক কোণে স্থাপন করিয়া দক্ষিণাভিমুখে প্রস্থান করিল। গর্ভগৃহের দ্বার কিয়ৎকালের জন্য রুদ্ধ হইল। সৈনিক কহিয়াছিল, ঘূর্ণাবর্ত্তের ন্যায় শকসৈন্য নগর প্রাচীরের উপর পতিত হইয়া ছিল, অবলীলাক্রমে পরিখা ও প্রাচীর উত্তীর্ণ হইয়া নগর মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল ও এক মুহূর্ত্তের মধ্যে সব শেষ হইয়া গিয়াছিল। নগররক্ষীরা কেহই জীবিত নাই, একজন চলচ্ছক্তিবিহীন বৃদ্ধ ভিক্ষু দক্ষিণ নগরতোরণের আকাশকক্ষে লুক্কায়িত থাকিয়া সমস্ত ঘটনা দেখিয়াছেন। কয়েকজন নগরবাসী নগরধ্বংসের পর আসিয়া মৃতদেহের সৎকার করিয়া গিয়াছে। তাহারা সকলেই পার্ব্বত্যভূমিতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। শকগণের অত্যাচারের আশঙ্কায় কেহই সমতল ভূমিতে আসিতে চাহে না।

 দিনের পর দিন যায়, আমাদিগের নিকটে আর মানব সমাগম হয় না। ক্রমে প্রদক্ষিণের পথ তৃণসঙ্কুল হইয়া উঠিল, বেষ্টনীর মধ্যে ও প্রান্তরে নির্ভয়ে মৃগযূথ বিচরণ করিতে আসিত, কিছুকাল পরে দৃষ্ট হইল, নগরে ও নগর-প্রাকারে মহাকায় বৃক্ষ সকল জন্মিয়াছে, পাষাণনির্ম্মিত প্রাচীর বেষ্টিত নগর দেখিলে বোধ হইত যেন উহা কোন শ্রেষ্ঠির সুরক্ষিত উদ্যান। ক্রমে প্রান্তরেও বৃক্ষ জন্মিতে লাগিল। কিয়ৎকাল পরে নগর আর নয়নগোচর হইত না। আমার পার্শ্বে একটি লতা জন্মিয়াছিল, দারুণ নিদাঘ উত্তাপেও আমার ছায়া পাইয়া সে জীবিতা ছিল, সে অনেক কথা কহিত, কিন্তু তাহার ক্ষীণস্বর আমার কর্ণ পর্য্যন্ত আসিত না। সেই জন্যই বোধ হয় সে বেষ্টনীর স্তম্ভ অবলম্বন করিয়া আমার নিকটে উঠিয়া আসিল। সে আসিয়া আমার পরুষ দেহ বেষ্টন করিয়া রহিল। সে যতদিন ছিল ততদিন তাহাকে অতীতের কথা বলিতাম, সে শুনিয়া বিস্মিতা হইত। তাহার জীবনে সে কখন মনুষ্য দেখে নাই, সুতরাং শ্বেত, কৃষ্ণ ও মিশ্রবর্ণের কথা শুনিয়া সে বড়ই বিস্মিত হইত। একটি ক্ষুদ্র অশ্বত্থবৃক্ষ স্তূপশীর্ষস্থ ছত্রের উপরে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। ক্রমে সেই ক্ষুদ্র বৃক্ষ মহাকায় মহীরুহে পরিণত হইল। তাহার ভারে এক বর্ষা রজনীতে সশব্দে সপ্তছত্র সমন্বিত স্তূপশীর্ষ ভাঙ্গিয়া পড়িল। একদিন মৃগযূথ আসিয়া আমার সঙ্গিনী লতিকার অধোদেশ ভক্ষণ করিয়া গেল, সে দারুণ মৃত্যু যাতনায় কাঁদিয়া উঠিল। মৃগযূথ নিঃশব্দে তৃণবংশধ্বংস করিয়া যাইতে লাগিল, তাহার ভাষা কেহই বুঝিতে পারিল না। ধরাশায়ী অশ্বত্থের শাখাপ্রশাখাগুলি কম্পিত হইয়া সমবেদনা জানাইল ও কহিল, আমরাও অনুরূপ যন্ত্রণা ভোগ করিতেছি। দুই তিন দিন সূর্য্যতাপে লতিকাও শুকাইয়া গেল, পরে সংস্কারকালে মহারাজাধিরাজ কণিষ্কের পরিচারক আসিয়া তাহার অবশেষ দূরে নিক্ষেপ করিল।

 একদিন মধ্যাহ্ণে বহুদূরে হস্তিপদশব্দ শ্রুত হইল। অতীতকালে যে দিকে নগরোপকণ্ঠ ছিল সেই দিক হইতে ক্রমাগত মহাবৃক্ষ সমূহের পতনশব্দ, শুষ্ক পত্রসমূহের মর্ম্মরধ্বনি ও বেতসলতার উৎপাটন শব্দ আসিতে লাগিল। ভয়ে বনবাসী জীবজন্তুসমূহ স্তূপসান্নিধ্য পরিত্যাগ করিল। বেলা তৃতীয় প্রহরে বনমধ্য হইতে চারিটি হস্তী কতিপয় মনুষ্যকে বহন করিয়া লইয়া আসিল। ক্রমে হস্তিচতুষ্টয় আসিয়া তোরণদ্বারে উপস্থিত হইলে সকলে অবতরণ করিলেন, দেখাগেল তাঁহাদিগের মধ্যে দুইজন মেষচর্ম্মাচ্ছাদিত, দুই জন মলিনকাষায় পরিহিত ভিক্ষু ও একজন উজ্জ্বল বর্ম্মাবৃত যোদ্ধা, এতদ্ব্যতীত প্রত্যেক হস্তীর স্কন্ধদেশে এক একজন হস্তিপক উপবিষ্ট ছিল। বেষ্টনীর মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাঁহারা অধিকদূর আসিতে পারিলেন না, কারণ পদে পদে বেতসলতা তাঁহাদিগের গতিরোধ করিতে লাগিল। অল্পকাল মধ্যে তাঁহারা ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হইলেন। ইহার মধ্যে তাঁহাদিগের কথোপকথনে বুঝিলাম, মেষচর্ম্মপরিহিত ব্যক্তিগণের পূর্ব্বপুরুষগণ নগরে বাস করিতেন, শক আক্রমণে তাঁহারা পর্ব্বতসঙ্কুল প্রদেশে আশ্রয়গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, অদ্যাবধি তাঁহাদিগের বংশধরেরা কেহই উপত্যকাভূমি পরিত্যাগ করিতে সাহসী হয়েন নাই। শকজাতি আর ভ্রমণশীল নাই, তাহারা আর্য্যাবর্ত্তে বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করিয়াছে, নবাগত কুষণ বা গুষণ বংশ সমস্ত শকজাতিকে একত্র করিয়া অত্যন্ত পরাক্রমশালী হইয়া উঠিয়াছে। কণিষ্ক কুরুবর্ষ হইতে দাক্ষিণাত্যের উত্তরসীমা পর্য্যন্ত সমস্ত ভূখণ্ডের অধিকারী। আরও বিস্ময়কর পরিবর্ত্তন হইয়াছে। দুর্দ্ধর্ষ শকজাতি সদ্ধর্ম্মে অনুরাগী হইয়াছে। দেবতাদিগের প্রিয় মহারাজ অশোক প্রিয়দর্শীর ন্যায় কণিষ্ক সদ্ধর্ম্মের পোষণকর্ত্তা হইয়াছেন। আবার জম্বুদ্বীপ হইতে চীন, কিরাত, মরু, ঐরাণ প্রভৃতি দেশে ভিক্ষুগণ সদ্ধর্ম্ম প্রচার করিয়া গিয়াছেন। সদ্ধর্ম্মের প্রাচীন তীর্থগুলির উদ্ধার করিবার চেষ্টা হইতেছে। কপিলবাস্তুতে, মহাবোধিতে, বারাণসীতে, কুশীনারে, শ্রাবস্তীতে, বৈশালীতে, কৌশাম্বীতে, সঙ্কাশ্যে, বিদিশায়, মথুরায়, জালন্ধরে, তক্ষশিলায়, নগরহারে, পুরুষপুরে, কপিশায় ও বাহ্লীকে সদ্ধর্ম্মের সংস্কার আরব্ধ হইয়াছে। কত পুরাতন কথা মনে পড়িয়া গেল! উৎসবের দিন কপিলবাস্তু হইতে লুম্বিনী গ্রামের মৃত্তিকা লইয়া একজন ভিক্ষু আসিয়াছিলেন, পাটলিপুত্রবাসী কোন মহাপুরুষ স্তূপনির্ম্মাণকালে বিশেষ সাহায্য করিয়া ছিলেন, মহাবোধি হইতে একজন বর্ষীয়ান ভিক্ষু বোধিদ্রুমবংশজ ক্ষুদ্র অশ্বত্থবৃক্ষ আনিয়া স্তূপবেষ্টনীর বহির্ভাগে রোপণ করিয়াছিলেন। বিদিশানগর হইতে বহুদূর নহে, যাঁহারা বিদিশায় সারিপুত্ত্র ও মৌদ্গল্যায়নের শরীরনিধান-বিহারে রক্ষা করিতেছিলেন তাঁহাদিগের মধ্যে দুই এক জন উৎসবের দিন আসিয়াছিলেন। মথুরায় ধনভূতির পিতা স্তূপবেষ্টনীর স্তম্ভ ও সূচীদানে নিজের নাম চিরস্মরণীয় করিয়া গিয়াছিলেন। তক্ষশিলা হইতে সিংহদত্ত আসিয়াছিলেন। সিংহদত্ত ও মহাস্থবিরের কথা মনে পড়িয়াগেল। তক্ষশিলার মহাবিহারের তখন কি অবস্থা জানিবার জন্য ব্যাকুল হইলাম। আমার ভাষা বুঝিবার শক্তি থাকিলে তাহারা নিশ্চয়ই উত্তর দিত, কারণ আমি এখন যে ভাবে কথা বলিতেছি চিরকালই সে ভাবে বলিয়া আসিয়াছি, আমার কথা কখনও ইহা অপেক্ষা স্পষ্টতর হয় নাই।

 শুনিলাম স্তূপের ও বেষ্টনীর সংস্কার হইবে, তীর্থযাত্রিগণের সুবিধার জন্য মহাবনের মধ্যে পথ প্রস্তুত হইবে, সেই পথে রাজাধিরাজ দেবপুত্র বাহিকণিষ্ক স্তূপ দর্শনে আসিবেন। ক্রমে দিবাবসান সময় আগত দেখিয়া আগন্তুকগণ প্রস্থান করিলেন। মলিন কাষায় পরিহিত ভিক্ষুগণ এখন উপত্যকাবাসী জনপদের পুরোহিতের কার্য্য করিয়া থাকেন, মেষচর্ম্মপরিহিত ব্যক্তিদ্বয় নগরবাসিগণের বংশজাত, কিন্তু বর্ম্মাবৃত পুরুষ বিদেশীয়; তিনি শকসাম্রাজ্যের একজন সম্ভ্রান্ত রাজপুরুষ, রাজাদেশে তথাগতের শরীর গর্ভস্তূপের অন্বেষণে আসিয়াছিলেন। পরদিবস প্রাতে বনের মধ্যে মহাকায় প্রাচীন বৃক্ষসমূহ উৎপাটিত হইতে লাগিল, সে পথ তোমরা দেখিয়াছ। বর্ব্বর রমণীগণ এখনও শুষ্ক করিবার জন্য সেই সকল পাষাণে গোময় লেপন করিয়া থাকে। পথ নির্ম্মিত হইলে স্তূপ ও বেষ্টনী পরিষ্কৃত হইল, ক্রমে বনের একাংশে শ্রমজীবিগণের একটি গ্রাম বসিয়া গেল; স্তূপ-সংস্কার আরম্ভ হইল। অশ্বাচ্ছাদিত নবনির্ম্মিত পথে একদিন মধ্যাহ্ণে চক্রের ঘর্ঘরধ্বনি শ্রুত হইল। আমরা শকটের আগমন প্রতীক্ষায় উৎকণ্ঠিত হইয়া রহিলাম; ভাবিলাম, বোধ হয় রাজা আসিতেছেন। কিন্তু দুই প্রহর কাল অতীত হইলে দৃষ্ট হইল বৃহদাকার শকটে স্থাপিত রক্তবৃর্ণ প্রস্তর স্তূপাভিমুখে আসিতেছে, হস্তিদ্বয় প্রত্যেক শকট লইয়া আসিতেছে। দেখিবমাত্র চিনিতে পারিলাম, দূর হইতে তাহাদিগের ভাষা বুঝিতে পারিলাম; তাহরাও আমাদিগের ন্যায় রক্তবর্ণ পাষাণ। সমুদ্রগর্ভে একদিনে এক সময়ে উৎপন্ন, বহুকাল একত্র পর্ব্বতের সানুদেশে বাস করিয়াছি, তাহারা আমদিগেরই, নূতন নহে। তাহারা বলিল যে, আমরা চলিয়া আসিবার পর বিদীর্ণবক্ষ অল্প সময়ের মধ্যেই বনরাজীতে আচ্ছাদিত হইয়া গিয়াছিল, বহুকাল আর কেহ তাহাদিগের অঙ্গে আঘাত করে নাই। কখনও কখনও দুই চারিজন মনুষ্য আসিয়া তাহাদিগের অঙ্গভেদ করিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহারা অধিক আঘাত করে নাই। কেহ কেহ আঘাত করিয়া পাষাণ লাভে সফলকাম হইত। কেহ বা হতাশমনে গৃহে প্রত্যাগমন করিত। অল্পদিন পূর্ব্বে মেষচর্ম্মাবৃত কয়েকজন মনুষ্য পর্ব্বতশিখর হইতে অবরোহণ করিয়া পাষাণের অবস্থা নির্ণয় করিয়া গিয়াছিল, ইহার কয়েক দিবস পরে মনুষ্যগণ আসিয়া তাহাদিগকে লইয়া আসিয়াছে। মনুষ্যগণ আমাদিগকে যে ভাবে ছেদন করিয়াছিল, যে নগরে আনয়ন করিয়াছিল ও যে ভাবে রক্ষণ করিয়াছিল, ইহাদিগকেও তদ্রূপ করিয়াছিল, তবে ইহারা ব্রাহ্মণগণ বা সদ্ধর্ম্মের অপর কোনও শত্রুর নিকট হইতে কোনরূপে বাধাপ্রাপ্ত বা ক্ষতি গ্রস্ত হয় নাই। আমরা অনুমান করিলাম, সদ্ধর্ম্মের চিরশত্রু ব্রাহ্মণগণ মহাকোশল হইতে দূরীভূত হইয়াছে। নূতন পাষাণে স্তূপের ও বেষ্টনীর সংস্কার আরদ্ধ হইল, সপ্তচ্ছত্র-মণ্ডিত স্তূপশীর্ষ আবার গগন স্পর্শ করিল, ভগ্ন বা বিদীর্ণ প্রস্তর খণ্ডের পরিবর্ত্তে নূতন প্রস্তর যোজিত হইল, স্বস্থানচ্যুত পাষাণ যথাস্থানে প্রতিস্থাপিত হইল, স্তূপের ও বেষ্টনীর শোভা আবার যেন ফিরিয়া আসিল। জীর্ণসংস্কার কার্য্য কতদূর অগ্রসর হইল তাহা জানিবার জন্য সুদূর মথুরা হইতে শকসম্রাট চর প্রেরণ করিতেন, উজ্জ্বল বর্ম্মাবৃত সকোণ শিরস্ত্রাণ পরিহিত স্বল্পশ্মশ্রু শকজাতীয় অশ্বারোহিগণ ক্ষুদ্রকায় পার্ব্বত্য অশ্বে আরোহণ করিয়া সংস্কারকার্য্য দেখিতে আসিত। অশ্ব পদশব্দ শ্রবণমাত্রই আমরা বুঝিতে পারিতাম যে, শকরাজার দূত আসিতেছে।

 স্তূপ, বেষ্টনী, প্রদক্ষিনের পথ ও সঙ্ঘারাম সংস্কৃত হইল। ক্রমে সঙ্ঘারামে ভিক্ষুসংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, নানাদেশ হইতে ভিক্ষুগণ রাজানুগ্রহ লাভেচ্ছায় বনমধ্যে সঙ্ঘারামে আসিয়া বাস করিতে লাগিলেন। বনমধ্যস্থ ক্ষুদ্রগ্রাম ক্রমে বৃহৎ গ্রামে পরিণত হইল। অপরাহ্ণে ভিক্ষুগণ আসিয়া স্তূপের ছায়ায় বসিয়া কথোপকথন করিতেন, তাহাদিগের কথাবর্ত্তায় পৃথিবীর সংবাদ পাইতাম। শুনিলাম, হুবিস্ক যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াছেন, কারণ সম্রাট চীন দেশে যুদ্ধযাত্রা করিবেন। সম্রাট চীনরাজের কন্যার পাণিপ্রার্থী হইয়াছিলেন, বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী চীনরাজ অবজ্ঞা ভরে তাঁহার দূতের অবমাননা করিয়াছেন। প্রতিশোধ গ্রহণ মানসে কনিষ্ক চীনসাম্রাজ্য আক্রমণ করিবেন, আর্য্যাবর্ত্তে হুবিষ্ক পিতার জীবিতকালে রাজোপাধি ধারণ করিবেন।

 বহু অর্থ ব্যয়ে স্তূপ ও বেষ্টনী সংস্কৃত হইয়াছে কিন্তু শরীরগর্ভ স্তূপে তথ্যগতের শরীর আবিষ্কৃত হয় নাই, গর্ভগৃহের দ্বার কোথায় অবস্থিত ছিল তাহা কেহই অবগত নহে। যক্ষগণ ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছে যে, রাজা না আসিলে গর্ভগৃহের দ্বার উন্মুক্ত হইবে না ও তথাগতের শরীর মনুষ্যের নয়নগোচর হইবে না। যক্ষগণের কথা সম্রাট শুনিয়াছেন, চীনযুদ্ধের আয়োজনে বিশেষ ব্যস্ত থাকিলেও তিনি আসিবেন। তিনি তথাগতের শরীর দর্শন করিয়া চীনযুদ্ধে যাত্রা করিবেন, ক্ষুদ্র ভিক্ষুসঙ্ঘে এই কথাই বার বার আলোচিত হইত।

 সম্রাট আসিতেছেন। আবার উৎসব আসিতেছে, কিন্তু জীবনের প্রথমে মানবজাতির যে উৎসব দেখিয়াছিলাম, তেমন উৎসব আর কখনও দেখিব না। বলিয়াছি, পরে কত শত উৎসব দেখিয়াছি, কিন্তু সেরূপ আনন্দ আর কখনও অনুভব করিনাই। প্রত্যেক উৎসবেই কিছু না কিছু নূতনত্ব ছিল, নূতনত্ব দেখিয়া আনন্দ হইত বটে, কিন্তু সে ক্ষণস্থায়ী; আরম্ভ হইতে শেষ পর্য্যন্ত আনন্দভোগ আর কখনও করি নাই। কারণ বুঝিয়াছ কি? প্রথম উৎসবে মানব জাতি নূতন ছিল। এখন মানবের নূতনত্ব কাটিয়া গিয়াছে, মানবসংশ্লিষ্ট সমস্ত নূতনত্বের জ্যোতিঃ হীনপ্রভ হইয়া পড়িয়াছে। প্রথম উৎসব যেন পুষ্পোৎসব, আটবিক রাজ্যের সমস্ত পুষ্পভার বহিয়া আনিয়া আটবিক নগরবাসী আমাদিগের চরণ প্রান্তে উপস্থিত করিয়াছিল। দ্বিতীয় উৎসব সাজ সজ্জা ও বাহ্যাড়ম্বরের উৎসব, সে উৎসব আমাদিগের জন্য বটে, কিন্তু তথাপি যেন আমাদিগের নহে। তখনও মনে হইত, অতীত কালের পরপারে বসিয়া এখনও মনে হয় সে উৎসব আমাদিগের নহে, সে উৎসব কণিষ্কের। তথ্যগতের শরীর গর্ভস্তূপের সম্মাননার জন্য উৎসব আরব্ধ হয় নাই, সেই উৎসব কুরুবর্ষ হইতে দাক্ষিণাত্য পর্য্যন্ত বিস্তৃত, সে উৎসব বিশাল শকসাম্রাজ্যের অধীশ্বর কণিষ্কের। মহারাজরাজাধিরাজ দেবপুত্ত্র ষাহি কণিষ্ক তীর্থযাত্রায় আসিতেছেন, তাঁহার অভ্যর্থনার জন্য উৎসবের আয়োজন। মেষচর্ম্মপরিহিত পর্ব্বতবাসীর পক্ষে সেরূপ উৎসবের আয়োজন করা অসম্ভব। সাম্রাজ্যের অধীশ্বরের নিমিত্ত সাম্রাজ্যের সমস্ত শক্তি নিযুক্ত করিয়া উৎসবের আয়োজন হইয়াছে। ইহা আটবিক জাতির উৎসব নহে, পর্ব্বতের সানুদেশবাসী বর্ব্বর জাতির উৎসব নহে, সপ্তদ্বীপবাসী প্রাচীন সভ্যজগতের সমগ্র মানব জাতির সমবেত চেষ্টার ফল। ইহাতে নগরবাসিগণ বন হইতে পত্রপুষ্প সংগ্রহ করিয়া আনে নাই, পর্ব্বতবাসী বর্ব্বরজাতি সৃষ্টিকর্ত্তার উদ্যানজাত অনায়াসলভ্য পুষ্পরাশি ভারে ভারে আনিতে পারে নাই। প্রাচীন আটবিক নগরবাসিগণের বংশধরেরা দূরে পর্ব্বতশিখরে দণ্ডায়মান হইয়া উৎসব দর্শন করিয়াছিল। তাহারা উৎসবক্ষেত্রের যোজনের মধ্যেও আসিতে সাহসী হয় নাই। এমন কি মেষচর্ম্ম পরিহিত যে পথপ্রদর্শক গভীর বন ভেদ করিয়া শকরাজপুরুষকে আমাদের সমীপে আনয়ন করিয়া ছিল, তাহাকে পর্য্যন্ত আসিতে দেওয়া হয় নাই। ক্ষুদ্র ভিক্ষুসঙ্ঘে শুনিতাম যে, চীনযুদ্ধের জন্য সমবেত বিশাল বাহিনী লইয়া সম্রাট তীর্থযাত্রায় আসিতেছেন, পঞ্চলক্ষ পদাতিক ও অশ্বারোহী সেনা সমভিব্যাহারে তিনি মথুরা হইতে যাত্রা করিয়াছেন। এই পঞ্চ লক্ষের সহিত সাম্রাজ্যের প্রধান প্রাধান রাজপুরুষ ও সর্ব্বধর্ম্মাবলম্বী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ আসিতেছেন, তাঁহাদিগের যাত্রার ব্যবস্থা ও শুশ্রূষার জন্য সমগ্র আর্য্যাবর্ত্তে আয়োজন হইয়াছে। সেই পঞ্চলক্ষের মধ্যে শকদ্বীপ, বাহ্লীক, কপিশা, গান্ধার, উরস, কাশ্মীর, টক্ক, ত্রিগর্ত্ত, উদ্যান, মরু, জালন্ধর, মায়াপুর, সুরসেন, মৎস্য, অহিচ্ছত্র, কান্যকুব্জ, বারানসী, করুষ, কীকট, তীরভূক্তি, এমন কি রাঢ় পর্য্যন্ত সর্ব্বদেশবাসী সৈনিক আছে। এতদ্ব্যতীত সকোণ শিরস্ত্রাণধারী দুর্দ্ধর্ষ শকসৈন্য আছে; কুষাণবংশের অভ্যুত্থানের সহিত দলে দলে আর্য্যাবর্ত্তবাসী যবন আত্মাভিমান বিসর্জ্জন দিয়া শকসম্রাটের বেতনভোগী হইয়াছে, চর্ম্মপরিহিত শক অশ্বারোহিগণের আক্রমনের তীব্রবেগ সহ্য করিতে না পারিয়া কাশ্মীরের উত্তর সীমান্তবাসী তুষারধবল দরদজাতি শকসম্রাটের বশীভূত হইয়াছে, দলে দলে তাহারাও সৈন্যশ্রেণীভুক্ত হইয়াছে। দরদগণের ন্যায় কষ্টসহিষ্ণু জাতি আর নাই, সারমেয়ের ন্যায় তাহাদিগের দৃষ্টিশক্তি ও ঘ্রাণশক্তি অতি প্রবলা, তাহারা ঘ্রাণে অনুভব করিতে পারে, নিকটে শত্রু আছে কিনা; তৃণমণ্ডিত পথে মনুষ্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া তাহারা বহুদুরে চলিয়া যাইতে পারে। শকসৈন্যের মধ্যে দরদজাতি ব্যতীত অপর কোনও জাতি চরের কার্য্য করিতে পারে না। ক্ষুদ্র ভিক্ষুসঙ্ঘে এইরূপ কত কথাই হইত, আমরা শুনিয়া যাইতাম ও প্রথম উৎসবের কথা ভাবিতাম।

 পঙ্গপালের ন্যায় শ্রমজীবিগণ আসিয়া বিশাল অরণ্যের বৃক্ষসমূহ নির্ম্মূল করিল। একদিন দূরে উচ্চ মৃৎপিণ্ড দৃষ্ট হইল, কে যেন আমাদিগকে বলিয়া দিল, সেই নগর—যে নগরের অধিবাসী আমাদিগকে পর্ব্বতের সানুদেশের শয্যা হইতে উঠাইয়া লইয়া আসিয়াছিল। যে নগরবাসীরা তথাগতের শরীর স্তূপগর্ভে স্থাপন করিয়াছিল, তাহাদিগের বহুযত্নের, বহুশ্রমের নগর মৃৎপিণ্ডে পরিণত হইয়াছে! যে ভীষণ দর্শন বিশালতোরণ পথে আমরা নগরমধ্য হইতে প্রান্তরে আনীত হইয়াছিলাম, সে তোরণের চিহ্ণ মাত্র নাই, বৃহৎ মৃৎপিণ্ডের উপরে কে যেন দুইটি ক্ষুদ্র মৃৎপিণ্ড স্থাপন করিয়াছে, কে যেন আমাদিগকে বলিয়া দিল, উহাই বিশাল তোরণের ধ্বংশাবশেষ। ভুলি নাই, বিশাল আয়োজনের কলরবের মধ্যেও দেখিতে পাইলাম তোরণ হইতে যেন দেবযাত্রা নির্গত হইতেছে; মনে পড়িল, কালভারাবনত দেহ মহাস্থবির, চিরস্মরণীয় পৌরববংশজ সিংহদত্ত, আর ধনভূতি। সিংহদত্তের ভবিষ্যৎবাণী সফল হইয়াছে, বর্ষাগমে সিন্ধুনদের প্লাবনে তৃণমুষ্টির ন্যায় আর্য্যাবর্ত্তের দেশীয় ও বিদেশীয় রাজগণ শকজাতির সম্মুখে ভাসিয়া গিয়াছে; আর্য্যাবর্ত্তের পূর্ব্বসীমান্তে জলপথাবৃত সমতটেও শকসম্রাটের শক্তি অনুভূত হইয়াছে। সুদীর্ঘহস্তে কণিষ্ক রাজদণ্ড ধারণ করিয়াছেন। চিরতুষারাবৃত কুরুবর্ষের উত্তর মরু হইতে বাবিরুষ ও মিজ্রাইমের পণ্যবাহী ভৃগুকচ্ছ পর্য্যন্ত রাজার অঙ্গুলী হেলনে কম্পিত হইতেছে। দূরদর্শী পৌরর সত্য বলিয়াছিলেন, সদ্ধর্ম্মেরও দিন ফিরিয়াছে, নতুবা এই শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য ভেদ করিয়া পার্ব্বত্য প্রদেশ হইতে পথ প্রদর্শক আনিয়া শকরাজপুরুষ তথাগতের শরীর গর্ভের অনুসন্ধানে আসিবে কেন?

 যাহারা সম্রাটের অভ্যর্থনার উদ্যোগ করিতেছিল, তাহারা অরণ্যের বৃক্ষরাজি নির্ম্মূল করিয়া সেই কাষ্ঠে নগর নির্ম্মাণ করিয়াছিল; সেই দারুনির্ম্মিত নগরের কয়েক খণ্ড পাইয়া স্থির করিয়া রাখিয়াছ যে, প্রাচীনকালে প্রস্তর শিল্প ছিল না। সকলেই চিরক্ষুণ্ণমার্গ অনুসরণ করিয়া চলিয়াছে; জানিয়া রাখিয়াছ, এই একমাত্র পথ। পথিপার্শ্বে বনান্তরালে যে উদ্দিষ্ট শত্রু লুক্কায়িত থাকিতে পারে, তাহা ভাব নাই। স্তূপের পার্শ্বে কারুকার্য্যশোভিত কাষ্ঠখণ্ড পাইয়া স্থির করিয়াছ, পাষাণনির্ম্মিত স্তূপের পূর্ব্বে এই স্থানে দারুনির্ম্মিত স্তূপ ছিল, কিন্তু এ কথা কেহ কখনও কোথাও স্বপ্নেও ভাব নাই যে, স্তূপে আগত তীর্থযাত্রীর জন্য দারুনির্ম্মিত প্রাসাদ নির্ম্মিত হইতে পারে, তোমাদিগের জন্য অতীতকাল স্তরে স্তরে ধ্বংসাবশেষ সাজাইয়া রাখে নাই, প্রকৃতির আলোড়নে ঊর্দ্ধের স্তর নিম্নে গিয়াছে, নিম্নের স্তর ঊর্দ্ধে আসিয়াছে, মধ্যের স্তরগুলি অপর দেশে চলিয়া গিয়াছে। অতীতের গতি নিরূপণ করিবার জন্য যে বিশ্লেষণ শক্তির আবশ্যক তাহা সকলের থাকে না, তাহা বহুশিক্ষার ফল, গুরুপরম্পরায় শিক্ষার ফল, একদিনে তাহার লাভ হয় না। শ্বেতাঙ্গ রাজপুরুষ স্তূপের দক্ষিণ-তোরণের সান্নিধ্যে কূপ খননকালে কারুকার্য্য শোভিত যে কাষ্ঠখণ্ড পাইয়াছিলেন, তাহ প্রস্তর শিল্পের পূর্ববর্ত্তী যুগের নহে, তাহা শকাধিকার কালের। ইহা শুনিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইওনা। আমি অতীত যুগের সাক্ষী, আমার কথা মানিয়া লইও। আমার যদি সময় নিরূপণ করিবার ক্ষমতা থাকিত তাহা হইলে আমি তোমাদিগের ন্যায় বর্ষ, মাস, দিবস সম্বলিত মান গণনা করিয়া দিতাম। তোমরা প্রত্যক্ষবাদী, প্রত্যক্ষ প্রমাণ না দেখিয়া কোন কথা বিশ্বাস করিতে চাহ না; আমার যদি চক্ষু থাকিত তাহা হইলে আমি বলিতাম, আমি প্রত্যক্ষ দেখিয়াছি। তোমাদিগের ভাষায় কি বলিব জানি না, ইন্দ্রিয়বিহীন পাষাণের কি অনুভব-শক্তি আছে? সহস্র সহস্র বর্ষব্যাপী অনুসন্ধানের ফলস্বরূপ তাহার কণামাত্র তোমরা জানিয়াছ, সৃষ্টিকর্ত্তার শিল্পকলার আভাসমাত্র পাইয়াছ, সেই আভাস প্রত্যক্ষ জানিয়া আমার কথা বিশ্বাস করিয়া লও। শকাধিকার কালে কণিষ্কের রাজত্বকালে স্তূপসন্নিধানে যে দারুময় নগর নির্ম্মিত হইয়াছিল, তোমাদিগের আবিষ্কৃত কাষ্ঠথণ্ডগুলি সেই দারুময় নগরের অংশমাত্র, মানবজাতির সভ্যতার প্রারম্ভের নহে।

 নগরনির্ম্মিত হইল। বিশাল শক সাম্রাজ্যে যাহা কিছু দুর্ম্ম্যুল্য ও দুষ্প্রাপ্য ছিল রাজপুরুষগণ তাহাই আনিয়া দারুময় নগর শোভিত করিল। প্রাচীন আটবিক নগরবাসীরা কেহ কখনও এত দ্রব্যসম্ভার একত্র হইতে দেখে নাই। তাহারা বহু যত্নে—বহু পরিশ্রমে অশ্মরাশি সঞ্চয় করিয়া সমগ্র আর্য্যাবর্ত্তের অর্থসাহায্যে শরীরগর্ভস্তূপ নির্ম্মাণ করিয়াছিল; রাজপুরুষগণের আদেশে আমাদিগের প্রাচীন বাসস্থান, সেই পর্ব্বতের সানুদেশ হইতে, রাশি রাশি পাষাণ দারুময় নগরের পথ নির্ম্মাণের জন্য আনীত হইল। পথের আচ্ছাদনের পাষাণে সিন্দূর লেপন করিয়া বর্ব্বর গ্রামবাসিগণ তাহাদিগের সম্মুখে শূকর, কুক্কুট বলি দিয়া থাকে। পথ আলোকিত করিবার জন্য ষে দীপস্তম্ভ নির্ম্মিত হইয়াছিল, তাহা দেখিলে তোমরা আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া যাইতে; ভূমিশয্যায় শয়ান বর্ত্তুলোদরগণের বক্ষে দাঁড়াইয়া বনদেবী চম্পক বৃক্ষ হইতে পুষ্প আহরণ করিতেছেন, দেবীর মস্তকোপরি চম্পক বৃক্ষের শাখায় দোদুল্যমান কাচমণ্ডিত দীপাধার, তোমরা মথুরার স্তূপবেষ্টনীর স্তম্ভে এইরূপ মূর্ত্তি নিশ্চয়ই দেখিয়া থাকিবে। দারুময় নগরে প্রতি রাত্রিতে এইরূপ লক্ষ লক্ষ দীপধার ব্যবহৃত হইয়াছিল। কল্পনা করিয়া রাখ কত অর্থব্যয়ে, কত পরিশ্রমে তীর্থযাত্রিগণের আবাস নির্ম্মিত হইয়াছিল। সে স্বপ্নের কথা, স্বপ্নের ন্যায় চলিয়া গিয়াছে। আমি এখন যেরূপ ভাবিতেছি, নগর-তোরণের ধ্বংসাবশিষ্ট পাষাণগুলিও বোধ হয় সেইরূপই ভাবিয়ছিল।

 সম্রাট আসিতেছেন। উত্তরে উপত্যকার প্রান্তে মেঘের ন্যায় অশ্বারোহীর শ্রেণী দেখা দিয়াছে, মেঘের পর মেঘ উত্তর প্রান্তে দৃষ্ট হইয়াছে, ক্রমে নিকটে আসিয়া শ্রেণীবদ্ধ অশ্বারোহী সৈন্যে পরিণত হইয়াছে। সূর্য্যালোকে প্রতিভাসিত হইয়া তাহাদিগের উজ্জ্বল শিরস্ত্রাণগুলি দূরে তারকামালার ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছিল, কিন্তু নিকটে আসিয়া মধ্যাহ্ন সূর্য্যের ন্যায় দেখাইতেছে। ইহারা শকজাতীয় অশ্বারোহী। যে অনুন্নতনাসা মেষচর্ম্মাচ্ছাদিত অশ্বারোহিগণ নগর ধ্বংস করিয়াছিল, ইহারা সেরূপ নহে। ইহাদিগের বর্ণ অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল ও অবয়বসমূহ সুগঠিত। সমস্ত অশ্বারোহীই রজতশুভ্র বর্ম্মাচ্ছাদিত। তাহাদিগের এক হস্তে ভল্ল ও অপর হস্তে বল্গা, কটিদেশে ক্ষুদ্র অসি, এতদ্ব্যতীত কাহারও কোন রূপ অস্ত্র ছিল না। শুনিয়াছি, সুদূর প্রতীচ্যে রোমক সৈনিকগণ এইরূপে সজ্জিত হইত। সর্পের ন্যায় অশ্বারোহিশ্রেণী আসিয়া স্তূপ বেষ্টন করিল। প্রভাত হইতে অনুমান দ্বিপ্রহরকাল পর্য্যন্ত কেবল অশ্বারোহী সৈন্যই আসিয়াছিল। তাহাদিগের অস্ত্রশস্ত্রের বা বেশভূষার কোনই পার্থক্য ছিল না। অশ্বারোহিশ্রেণীর পর বন্যার স্রোতের ন্যায় পদাতিক সৈন্য আসিতে আরম্ভ করিল। নানা দেশ হইতে নানারূপ পরিচ্ছদধারী সৈনিক, পদাতিক সৈন্যের মধ্যে দৃষ্ট হইল,—স্বল্পপরিচ্ছদপ্রিয় মগধরাসী, উষ্ণীষধারী কান্যকুব্জবাসী, নানাবর্ণেরঞ্জিত পরিচ্ছদপ্রিয় সৌরসেন, উষ্ণীষে লৌহচক্রধারী জালন্ধরবাসী, দীর্ঘকায় বস্ত্রমণ্ডিত টক্ক, মলিনবেশধারী শ্বেতবর্ণ কাশ্মীর ও গান্ধারবাসী ও অল্প সংখ্যক চর্ম্মাবৃত শক সৈন্য শ্রেণীর মধ্যে পরিদৃষ্ট হইল। যতক্ষণ সূর্য্যালোক ছিল ততক্ষণ পদাতিক সৈন্যই দেখিতে পাইয়াছিলাম, সন্ধ্যাসমাগমে স্তূপের চতুষ্পার্শ্বস্থ ভূভাগ সহস্র সহস্র উল্কার আলোকে দিবসের ন্যায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তখন দূর হইতে শকটচক্রের ঘর্ঘর ধ্বনি শ্রুত হইল, বহুসংখ্যক দ্বিচক্র ও চতুশ্চক্র অশ্ববাহিত রথ আসিতে আরম্ভ হইল, শক সাম্রাজ্যের প্রধান অমাত্যগণ এই সকল রথারোহণে আসিলেন; সেই শব্দই শ্রুত হইল। শ্বেতবর্ণ ষোড়শঅশ্বযোজিতরথে কান্যকুব্জের মহাক্ষত্রপ বনস্পর আসিলেন; তাঁহার সহিত শতাধিক রথে তাঁহার পরিজনমণ্ডলী আসিয়া কাষ্ঠনির্ম্মিত নগরে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। উষ্ট্রচতুষ্টয়যোজিত রথে মগধ-বিজয়ী মহাক্ষত্রপ খরপল্লান আসিলেন। অশ্বারোহণে স্ত্রীমণ্ডলীপরিবৃত হইয়া তক্ষশিলার মহাক্ষত্রপ মহাদণ্ডনায়ক লল্ল আসিলেন, সমবেত জনসঙ্ঘ বিস্ময়স্তিমিতনেত্রে কোমলাঙ্গী কাশ্মীর ও গান্ধার ললনাগণের নিপুণ অশ্বচালনা দেখিতে লাগিল; কারণ ইহার পূর্ব্বে মহাকোশলে অশ্বপৃষ্ঠে স্ত্রীমূর্ত্তি দৃষ্ট হয় নাই। হস্তিপৃষ্ঠস্থাপিত দারুনির্ম্মিত সিংহাসনে উপবিষ্ট কপিশার মহাক্ষত্রপ বেষ্পশি আসিলেন, তাঁহার সহিত মহাকায় গজসমূহের পৃষ্ঠে স্থাপিত বৃহৎ সিংহাসনে মহল্লিকা পরিবৃত কপিশা ও বাহ্লিক-মহিলামণ্ডলী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এইরূপে রজনী দ্বিপ্রহরকাল পর্য্যন্ত সাম্রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত হইতে সমুপস্থিত অমাত্য ও সভাসদ্‌মণ্ডলী উপস্থিত হইলেন। দ্বিপ্রহর অতীত হইলে বোধ হইল, যেন দূরে পর্ব্বতের সানুদেশে অগ্নি প্রজ্বলিত হইয়াছে; ক্ষণেকের মধ্যেই বোধ হইল, প্রজ্বলিত অগ্নি দ্রুতবেগে স্তূপাভিমুখে অগ্রসর হইতেছে। দুই দণ্ড পরে স্তূপের চতুষ্পার্শ্বে ও কাষ্ঠনির্ম্মিত নগরে তুমুল কোলাহল উত্থিত হইল। চতুর্দ্দিক হইতে, “সম্রাট আসিতেছেন”—কেবল এই শব্দই শ্রুত হইতে লাগিল। অগ্নি নিকটবর্ত্তী হইলে দৃষ্ট হইল, পাষাণাচ্ছাদিত পথের পার্শ্বে উল্কা হস্তে সহস্রাধিক অশ্বারোহী দ্রুতবেগে স্তূপাভিমুখে ধাবিত হইতেছে, তাহাদিগের বাহন ক্ষীণকায় দীর্ঘাকার সিন্ধুদেশীয় অশ্ব, পরিচ্ছদ শ্বেতবর্ণ ও দক্ষিণ হস্তে সপ্তহস্ত পরিমিত উল্কা, দ্বিসহস্র উল্কার আলোকে যে পথ আলোকিত হইতেছিল সেই পথে দুইজন অশ্বারোহী দ্রুতবেগে স্তূপাভিমুখে অগ্রসর হইতেছিলেন, একজন মহারাজ রাজাধিরাজ দেবপুত্র কণিষ্ক ও অপর জন তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্ত্র মহারাজ হুবিষ্ক। সম্রাটের আকার দীর্ঘ, মুখ শ্মশ্রুমণ্ডিত, নাসিকায় ও দক্ষিণ গণ্ডে দীর্ঘ আঘাত চিহ্ন, দেখিলেই বোধ হয়, তাঁহার জীবনের অধিকাংশই যুদ্ধযাত্রায় অতিবাহিত হইয়াছে। তাঁহার কটিদেশে সার্দ্ধদ্ধিহস্ত পরিমিত খড়্গ। তাঁহার পার্শ্বে তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্ত্র হুবিষ্ক—দীর্ঘকায়, কোমলাঙ্গ, শ্মশ্রুবিরহিত, নবীন যুবক; আজীবন সুখানুসন্ধানের চিহ্ন যেন তাঁহার মুখে অঙ্কিত রহিয়াছে। অশ্বারোহিশ্রেণীর পশ্চাদ্ভাগে বিংশতি বা ততোঽধিক পরিচারক দ্রুতগামী অশ্বারোহণে আসিতেছিল।

 সম্রাট আসিতেছেন, শুনিয়া কাষ্ঠময় নগরবাসী আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই পাষাণাচ্ছাদিত পথাভিমুখে ধাবিত হইল। জনতার পেষণে বনস্পরের রত্নখচিত উষ্ণীষ ধূলিতে লুণ্ঠিত হইল; দণ্ডনায়ক লল্লের শিরস্ত্রাণ পাদপেষণে চূর্ণ হইয়া গেল। বেষ্পশির মহাদেবী জনতার তাড়নায় স্তূপের অপর প্রান্তে উপস্থিত হইলেন, তাঁহার আর সম্রাটের আগমন দর্শন ঘটিল না। অত্যন্ত পীড়িত হইয়া খরপল্লান খড়্গে হস্তক্ষেপ করিয়া দেখেন, তাহা নিষ্কাশনের উপায় নাই। প্রধান অমাত্য, সভাসদ্ ও পরিচারক, দৌবারিক ও ভিক্ষু, অশ্বারোহী ও পদাতিক, স্ত্রী ও পুরুষ সেই বিশাল জনসঙ্ঘে একত্র মিলিত হইয়া গেল, পদমর্য্যাদা অন্তর্হিত হইল। সম্রাট উপস্থিত হইলে তাঁহার বাহিনীর জন্য পথ মুক্ত হইল বটে; কিন্তু জয়ধ্বনি ব্যতীত তাঁহার আর কোনও অভ্যর্থনা হইল না। তিনি আসিয়া কাষ্ঠনির্ম্মিত নগর হইতে দূরে পটমণ্ডপে প্রবিষ্ট হইলেন। জনসঙ্ঘ যথাস্থানে প্রত্যাবর্ত্তন করিতে করিতে পূর্ব্বদিকের অন্ধকার দূর হইতে লাগিল, শিশিরসিক্ত প্রভাতে উৎসবের দিনে দৌবারিক ও প্রহরী ব্যতীত সমস্ত নগর সুষুপ্তিমগ্ন অবস্থায় দৃষ্ট হইল। প্রভাতে উৎসব আরব্ধ হইল। সাম্রাজ্যের উৎসব আটবিক নগরের উৎসবের ন্যায় নহে, তাহাতে উচ্ছৃঙ্খলতা, বিশৃঙ্খলতার লেশমাত্র দেখা যায় নাই। ধীরে ধীরে কাষ্ঠনির্ম্মিত নগরের চতুষ্পার্শ্ব হইতে সমবেত ভিক্ষুমণ্ডলী স্তূপবেষ্টনীর মধ্যে আসিয়া সমাগত হইলেন। প্রাচীন স্তূপ নবসংস্কারের জন্য নূতন বলিয়া বোধ হইতেছিল। মহাস্থবির পার্শ্ব স্তূপের আর কোনও সাজসজ্জার আবশ্যক বোধ করেন নাই; তবে রাজপুরুষগণ বেষ্টনীর বাহিরে ও পরিক্রমণের পথে যথাযোগ্য সজ্জা প্রস্তুত রাখিয়াছিলেন। সূর্য্যোদয়ের অল্পক্ষণ পরেই উৎসব আরব্ধ হইল। রাজস্কন্ধাবার হইতে বেষ্টনীর পূর্ব্বতোরণ পর্য্যন্ত পাষাণ নির্ম্মিত পথ বহুমূল্য বস্ত্রে আচ্ছাদিত হইল, সমান্তরালে প্রোথিত হৈমদণ্ডশ্রেণীর উপরে মণিমুক্তাখচিত বহুমূল্য পট্টবাস স্থাপিত হইল, বিবিধ সুদৃশ্য বর্ণরঞ্জিত কৌষেয় বস্ত্রে সুবর্ণ দণ্ডগুলি মণ্ডিত হইল, পথের আচ্ছাদনে বহু দূরদেশ হইতে আনীত বহুযত্নে সংগৃহীত পুষ্পরাশি বিক্ষিপ্ত হইল, পথের উভয় পার্শ্বে স্থানে স্থানে গন্ধবারির কৃত্রিম প্রস্রবণ নির্ম্মিত হইল। সূর্য্যোদয়ের অল্পক্ষণ পরে পথের উভয় পার্শ্বে একশ্রেণী পদাতিক ও একশ্রেণী অশ্বারোহী সৈন্য সুসজ্জিত হইয়া দণ্ডায়মান হইল। ইহারা শোভাবর্দ্ধন করিল বটে, কিন্তু ভীত দর্শকগণের দৃষ্টি ও গতি উভয়ই রোধ করিল। অল্পক্ষণ পরে নানাদিগ্দেশ হইতে সমাগত ভিক্ষুগণ স্তূপাভিমুখে আসিতে আরম্ভ করিলেন। ইঁহারা বহু কষ্টে যোদ্ধৃগণের পংক্তি চতুষ্টয় ভেদ করিয়া, ভীতিচকিত পাদক্ষেপে, মহার্য বস্ত্রদলন হেতু স্খলিত চরণে, বহুকষ্টে বেষ্টনীর তোরণ-দ্বার প্রাপ্ত হইলেন। সৈনিকগণ ভিক্ষুদিগকে দেখিয়া যেন অনিচ্ছাপূর্ব্বক সম্ভ্রম প্রদর্শন করিয়াছিল, কাষায় বা গৈরিকধারী সম্প্রদায় যেন তাহাদিগের অনুগ্রহের পাত্র, তাঁহাদিগের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করিবার কোনই কারণ নাই। তখন মনে হইল যে, আর্য্যাবর্ত্তে নূতন বিপ্লবে সঙ্ঘের ও সদ্ধর্ম্মের স্থানবিপর্য্যয় ঘটিয়াছে, পাশব বলে বলীয়ান্ শকজাতি সদ্ধর্ম্মের ছায়া মাত্র স্পর্শ করিয়াছে বটে, কিন্তু সদ্ধর্ম্মের প্রকৃত মর্য্যাদা উপলব্ধি করিতে সক্ষম হয় নাই। সম্রাট ভিক্ষুসঙ্ঘের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিয়া থাকেন, সেই জন্যই সাধারণে সঙ্ঘের প্রতি যৎকিঞ্চিৎ সম্মান দেখাইয়া থাকে; তদতিরিক্ত নহে। সম্রাট বৌদ্ধ সঙ্ঘের প্রতি যেরূপ শ্রদ্ধা প্রকাশ করিয়া থাকেন, বাবিরুষ বা ইরানীয় ধর্ম্মের প্রতিও তদনুরূপ শ্রদ্ধা প্রকাশ করিয়া থাকেন, সুতরাং সৈনিকগণের সদ্ধর্ম্মের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হইবার কোন কারণই ছিল না। কিয়ৎকাল পরে সম্রাট স্বয়ং ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তের মহাক্ষত্রপগণ পরিবৃত হইয়া স্তূপের সান্নিধ্যে আসিলেন। তাঁহার অগ্রে ও পশ্চাতে পরিচারকগণ আতপত্র ও ব্যজনী লইয়া আসিতেছিল, পশ্চাতে মহারাজ হুবিষ্ক ও শকজাতীয় ক্ষত্রপগণ আসিতেছিলেন। তিমি প্রথম তোরণে উপস্থিত হইলে ভিক্ষুগণ ও দ্বিতীয় তোরণে উপস্থিত হইলে মহাস্থবিরগণ তাঁহার অভ্যর্থনা করিলেন এবং মহাস্থবির পার্শ্বকে অগ্রণী করিয়া অপরাপর সঙ্ঘস্থবিরগণ তাঁহাকে স্তূপ অর্চ্চন ও প্রদক্ষিণ করিতে অনুরোধ করিলেন। সুবর্ণগৌরকান্তি নবীন যুবক হুবিষ্ককে পার্শ্বে লইয়া, সম্রাট ভিক্ষুসঙ্ঘের অনুগমন করিয়া স্তূপ প্রদক্ষিণ করিলেন ও অর্চ্চনার জন্য পূর্ব্ব তোরণের সম্মুখীন হইলেন। ফিরিবার সময় সম্রাটের কটিবন্ধ অসি অর্দ্ধবর্ত্তুলাকার স্তূপগাত্রে লাগিয়া গভীর শব্দ উৎপাদন করিল। সম্রাট শব্দ শুনিয়া চিন্তান্বিত হইলেন ও অর্চ্চনার সময় অন্যমনস্ক ছিলেন। অর্চ্চনান্তে কোষনিবদ্ধ অসি কটিবন্ধ হইতে মুক্ত করিয়া সম্রাট ধীরে ধীরে স্তূপগাত্রে আঘাত করিতে লাগিলেন। বিস্মিত হইয়া প্রধান অমাত্যগণ তাঁহাকে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ আঘাত করিবার পর বিশাল প্রস্তরখণ্ডে খড়্গের অগ্রভাগ লাগিয়া ধাতু পাত্রদ্বয়ে সংঘর্ষণের ন্যায় শব্দ হইল। শব্দ শুনিয়া সম্রাট কণিষ্ক ও মহাস্থবির পার্শ্ব চমকিত হইলেন। সম্রাটের আদেশে দীর্ঘকায় কপিশাবাসী সৈনিক চতুষ্টয় স্কন্ধ প্রয়োগে গুরুভার পাষাণ স্থানচ্যুত করিয়া স্তূপের পার্শ্বে প্রবিষ্ট করাইল। শতাব্দীদ্বয় পরিমিত কালের পর গর্ভগৃহের দ্বার উন্মুক্ত হইল, সমবেত জনমণ্ডলীর মধ্য হইতে সমুদ্র গর্জ্জনের ন্যায় জয়ধ্বনি উত্থিত হইল। সম্রাট আসিয়াছেন, যক্ষগণের ভবিষ্যৎবাণী সফল হইয়াছে; কনিষ্কের স্পর্শমাত্রে গর্ভগৃহের লুক্কায়িত দ্বার আবিষ্কৃত হইয়াছে। চতুর্দ্দিকে এইরূপ শব্দই ঘোষিত হইতে লাগিল। পার্শ্ব শরীরনিধানের অনুসন্ধানে গর্ভগৃহে প্রবেশ করিতেছিলেন কিন্তু সম্রাট কর্তৃক নিষিদ্ধ হইয়া পূর্ব্ববৎ দণ্ডায়মান রহিলেন। ইতিমধ্যে গর্ভগৃহের দ্বারের সম্মুখে অগ্নি প্রজ্বলিত হইল ও কয়েকখণ্ড প্রজ্বলিত কাষ্ঠ গর্ভগৃহের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইল; পরে বর্ম্মাবৃত পদাতিকগণ প্রজ্বলিত কাষ্ঠখণ্ড লইয়া গর্ভগৃহের মধ্যে প্রবেশ করিল ও সমস্ত গৃহটি পর্য্যটন করিয়া আসিল। মহাস্থবিরগণের পশ্চাতে সম্রাট ও হুবিষ্ক গর্ভগৃহের মধ্যে প্রবেশ করিয়া পাষাণনির্ম্মিত আধারের অর্চ্চনা করিলেন। কম্পিত হস্তে বর্ষীয়ান স্থবিরগণ গুরুভার আধার উন্মোচন করিয়া প্রথমে সুবর্ণনির্ম্মিত ও পরে তন্মধ্যস্থ স্ফাটিক শরীরনিধান উত্তোলন করিলেন। সেই সময় কে যেন আসিয়া শত শত যুদ্ধের রক্তপিপাসু সম্রাটের জানুদ্বয় ভগ্ন করিল, স্ফাটিকাধার উন্মুক্ত হইবামাত্র ভীষণদর্শন নিষ্ঠুর শকসম্রাট ভূমিতে অবলুণ্ঠিত হইলেন। কে জানে সুদূর অতীতে শাক্যরাজকুমারের কি প্রতিভা ছিল, কি মোহিনী শক্তি ছিল, যাহার বলে নির্ম্মম—কঠোর নরঘাতকের হৃদয় দ্রবীভূত হইয়াছিল। সম্রাটের সহিত গর্ভগৃহস্থ ব্যক্তিমাত্রেই শরীরনিধানের সম্মুখে নতশীর্ষ হইলেন; সংক্রামতা ক্রমে গর্ভগৃহের বহির্দ্দেশে ও পরে বেষ্টনীর বহির্দ্দেশে ব্যাপ্ত হইল; আনন্দে ও গর্ব্বে পার্শ্বের মুখ উৎফুল্প হইয়া উঠিল, তিনি তখনও ধনভূতির প্রদত্ত স্ফাটিকাধার হস্তে দণ্ডায়মান ছিলেন। তখন বুঝিলাম, শরীরনিধান রক্ষাকালে বর্ষীয়ান মহাস্থবির কি বলিয়াছিলেন। শকপ্লাবন আসিয়াছে, কপিশা হইতে কামরূপ পর্য্যন্ত বিস্তৃত আর্য্যাবর্ত্তের অধিকাংশ শকজাতির হস্তগত হইয়াছে, প্রাচীন আর্য্যসভ্যতা প্রায় ভাসিয়া গিয়াছিল, কিন্তু যাহা অবশিষ্ট ছিল, তাহারই ফলে আর্য্যাবর্ত্তের পুনরুদ্ধার হইয়াছে। সত্য সত্যই প্রাচীন সভ্যতার সংস্পর্শে আসিয়া মরুবাসী বর্ব্বর শকজাতির মহৎ পরিবর্ত্তন সাধিত হইয়াছে। শকজাতির শকত্ব প্রায় লুপ্ত হইয়াছে। বিশাল শকসাম্রাজ্যের অধীশ্বর সেই জন্যই অঙ্গুলি পরিমিত স্ফাটিকাধারে নিবদ্ধ অস্থিখণ্ডের সম্মুখে নতশির হইয়াছেন। বর্ষীয়ান মহাস্থবিরের ভবিষ্যদ্বাণী সফল হইয়াছে, শকজাতি ত্রিরত্নের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে, সদ্ধর্ম্মের উন্নতির দিন আসিয়াছে, নবীন গৌরব মৌর্য্যাধিকার কালের অতীত গৌরবের স্মৃতি পর্য্যন্ত লোপ করিয়াছে। শরীরনিধান হস্তে লইয়া পার্শ্ব ও অপরাপর সকলে গর্ভগৃহের বাহিরে আসিলেন। সাম্রাজ্যের প্রধান অমাত্য ও তাঁহাদিগের মহিলাগণ অস্থিখণ্ড স্পর্শ করিয়া পরিতৃপ্ত হইলেন। সম্রাটের আদেশে স্ফাটিক, সুবর্ণ ও পাষাণ নির্ম্মিত আধার যথাস্থানে স্থাপিত হইল, সশব্দে গর্ভগৃহের দ্বার রুদ্ধ হইয়া গেল; যাহারা দ্বার রুদ্ধ করিল তাহারা জানিত না যে, তাহারা চিরকালের নিমিত্ত তথাগতের শরীরনিধান মানবের দৃষ্টির বহির্ভূত করিতেছে। সম্রাটের যাত্রা সফল হইয়াছে, গর্ভগৃহের দ্বারের সম্মুখে গান্ধার হইতে আনীত নবোৎকর্ষ প্রাপ্ত যবনশিল্পের নিদর্শন, কৃষ্ণবর্ণ প্রস্তরনির্ম্মিত সুন্দর বুদ্ধমূর্ত্তি স্থাপিত হইল, যেন গর্ভগৃহের দ্বার আর কেহ স্পর্শ না করিতে পারে। ইহার পূর্ব্বে কখনও মূর্ত্তি দেখি নাই। আমাদিগের গাত্রে চিত্র আছে বটে কিন্তু মূর্ত্তি নাই। সদ্ধর্ম্মে মূর্ত্তিপূজা এই সময়ে আরব্ধ হয়। ইহার পূর্ব্বে চিত্রে চরণদ্বয় তথাগতের উপস্থিতি জ্ঞাপন করিত। সম্রাটের আদেশে স্থাপিত মূর্ত্তিটি অতি সুন্দর, অত্যন্ত প্রিয়দর্শন; তখন ভাবিতাম ইহার অপেক্ষা সুন্দর আর কিছুই নাই, হইতে পারে না, কিন্তু পরবর্ত্তী কালে মূর্ত্তিনির্ম্মাণের প্রভূত উৎকর্ষ সাধিত হইয়াছিল। যবনশিল্পী কর্ত্তৃক শিক্ষিত ভারতবাসী মূর্ত্তি-তক্ষণে অপেক্ষাকৃত পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিল। সে সমস্ত মূর্ত্তি দেখিয়া বোধ হইত গান্ধারের মূর্ত্তিগুলি যবনের মূর্ত্তি ও মধ্য দেশের মূর্ত্তিগুলি আর্য্যাবর্ত্তবাসীর মূর্ত্তি। সন্ধ্যা সমাগমে পূর্ব্বের ন্যায় উল্কাবাহী অশ্বারোহী পরিবৃত হইয়া সম্রাট যুদ্ধযাত্রা করিলেন; দেখিতে দেখিতে স্বপ্নের ন্যায় কাষ্ঠ নির্ম্মিত শিবির ভাঙ্গিয়া গেল। অরণি সংগ্রহ করিতে আসিয়া পার্ব্বত্য উপত্যকবাসিগণ মহাবনের কাষ্ঠ মহাবনে লইয়া গেল। আমাদিগের পূর্ব্ব সহচর ভিক্ষুগণ অতি সন্তর্পণে আসিয়া ক্ষুদ্র সঙ্ঘারাম অধিকার করিলেন। কণিষ্কের বিশালবাহিনী সমুদ্র তরঙ্গের ন্যায় চীনপ্রান্ত আক্রমণ করিল, শিলাসঙ্কুলতটবিক্ষিপ্ত ঊর্ম্মিরাশির ন্যায় পরাজিত সৈন্য কাশ্মীরে আশ্রয় লাভ করিল। কুরুবর্ষ চীনসৈন্য কর্ত্তৃক অধিকৃত হইল, পারদগণ কপিশা অধিকার করিল, বিংশতিবর্ষব্যাপী চেষ্টায় বর্ষীয়ান সম্রাট-সৈন্য মরুপ্রান্তে উপস্থিত হইলেন। তখন চীনসৈন্যের অধিনায়ক পাঞ্চাও দেহত্যাগ করিয়াছেন, জিঘাংসাবৃত্তি সফলা হইল, কিন্তু কণিষ্ক আর আর্য্যাবর্ত্তে ফিরিয়া আইসেন নাই। বাহ্লীকে তাঁহার সমাধি বহু দিন পর্য্যন্ত হূণগণের অর্চ্চনার স্থান ছিল। ক্ষুদ্র সঙ্ঘের ভিক্ষুগণের কথোপকথনে যাহা জানিয়াছি তাহাই বলিলাম।