পাষাণের কথা/৮
কণিষ্ক চলিয়া যাইবার পরে কিছু কাল নানাদিগ্দেশ হইতে শরীর গর্ভস্তূপ-দর্শন-মানসে বহুযাত্রী আমাদিগের নিকটে আসিত। শুনিয়াছি, কণিষ্কের দ্বিতীয়পুত্র হুবিষ্কের রাজত্বকালে সদ্ধর্ম্মের বিশেষ উন্নতি সাধিত হইয়াছিল; ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের অধিকার আর্য্যাবর্ত্তে প্রায় লুপ্ত হইয়াছিল। এই সময়ে স্তূপবেষ্টনীর চতুষ্পার্শ্বে বিত্তশালী তীর্থযাত্রীগণ কর্ত্তৃক অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মন্দির নির্ম্মিত হইয়াছিল। তোমরা প্রাচীন স্তূপের বহির্দ্দেশে এখনও যে সমস্ত মূর্ত্তির ভগ্নাংশ দেখিতে পাও, তাহা এই ক্ষুদ্র মন্দির গুলিতে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। হুবিষ্কের মৃত্যুর পর পুনরায় সদ্ধর্ম্মের অবনতি আরব্ধ হইল; কারণ, নূতন সম্রাট বাসুদেব ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁহার রাজাভিষেকের অব্যবহিত পরেই আর্য্যাবর্ত্তের সমুদায় বিহারে ও সঙ্ঘারামে বিলাপধ্বনি শ্রুত হইল; কোনও স্থানে বৃত্তির অভাবে, কোনও স্থানে বা রাজশক্তির সাহায্যের অভাবে ও ব্রাহ্মণগণের প্রতিকূলাচরণে সঙ্ঘারামগুলি ভিক্ষুশূন্য হইয়া উঠিল। বাসুদেবের অব্যবহিত পরে যে সকল কুষাণবংশীয় রাজা সিংহাসনারোহণ করিয়াছিলেন তাঁহারা নামেমাত্র সম্রাট ছিলেন। তাঁহাদের অধিকার পঞ্চনদ ব্যতীত অপর কোনও দেশে বিস্তৃত হয় নাই। ক্রমে বিশাল কুযাণ সাম্রাজ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত হইয়া গেল। প্রকৃত কুষাণবংশীয়দিগের হস্তে পঞ্চনদ ব্যতীত অপর কোনও দেশের অধিকার রহিল না। ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্যধর্ম্ম শক্তি সঞ্চয় করিতেছিল; এবং পৃষ্ঠপোষণের অভাবে সদ্ধর্ম্মের তদনুরূপ ক্ষতি হইতেছিল। ক্রমে স্তূপের সন্নিহিত ক্ষুদ্র সঙ্ঘারামে স্থবিরগণের দেহাবসানের পর নূতন ভিক্ষুর অভাব ঘটিতে লাগিল ও ধীরে ধীরে সঙ্ঘারামবাসিদিগের সংখ্যার হ্রাস হইতে লাগিল। যে কয়েকজন অবশিষ্ট ছিলেন তাঁহাদেরই মুখে শুনিতাম যে, পাটলিপুত্রে নূতন সাম্রাজ্যের বীজ উপ্ত হইয়াছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় নূতন রাজবংশ স্পষ্টভাবে সদ্ধর্ম্মের বিরোধী না হইলেও তৎপ্রতি বিশেষ অনুরাগী নহেন।
প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সহিত লিচ্ছবিকন্যা কুমারদেবীর পরিণয় সম্পন্ন হইবার পর হইতেই নূতন রাজ্যের আকার বৃদ্ধি পাইতে লাগিল; একে একে ক্ষুদ্র শকরাজ্যগুলি নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্যভুক্ত হইয়া গেল; পশ্চিমসাগরতীরে সৌরাষ্ট্রমাত্র আর্য্যাবর্ত্তে সদ্ধর্ম্মের একমাত্র আশ্রয় স্থল হইয়া রহিল। ক্রমে তীর্থর্যাত্রিগণেরও সংখ্যার অত্যন্ত হ্রাস হইল। পাটলিপুত্রে লিচ্ছবি-দৌহিত্র সমুদ্রগুপ্ত যখন আসমুদ্র-ক্ষিতিজয়ের পর অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতেছিলেন, তখন আর্য্যাবর্ত্তে সদ্ধর্ম্মের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়; যে কয়েকজন ভিক্ষু ভিক্ষোপজীবিকা অবলম্বন করিয়া বনমধ্যস্থ সঙ্ঘারামে বাস করিতেছিলেন, তাঁহাদিগের এক মুষ্টি অন্নের সংস্থানও অসম্ভব-প্রায় হইয়া উঠিল। সমুদ্রগুপ্তের পর চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করিয়াই আনর্ত্তে ও সৌরাষ্ট্রে শকাধিকার লোপ করিলেন, ভারতে শকাধিকারের শেষচিহ্ন পর্য্যন্ত বিলুপ্ত হইল, কামরূপ হইতে সিন্ধুতীর পর্য্যন্ত সমগ্র আর্য্যাবর্ত্ত তাঁহার পদানত হইল এবং দক্ষিণে নীলগিরি পর্য্যন্ত দক্ষিণাপথবাসী রাজগণ তাঁহার চক্রবর্ত্তিত্ব স্বীকার করিলেন। মৌর্য্য সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পর উত্তরাপথে এরূপ বিশাল সাম্রাজ্য আর দেখা যায় নাই। কিন্তু গুপ্ত সম্রাটগণের অধীনে তথাগতের ধর্ম্ম দিন দিন ক্ষীণতর হইতেছিল।
বহুকাল যাবৎ ভারতবর্ষে বিজাতীয় শত্রু প্রবেশলাভ করে নাই। সুদূর অতীতে শকজাতির আক্রমণ সকলে বিস্মৃত হইয়া গিয়াছিল। শকগণও আর্য্যাবর্ত্তের আচার ব্যবহার, ধর্ম্ম ও ভাষা অবলম্বন করিয়া, আর্য্যজাতির সহিত মিশ্রিত হইয়া গিয়াছিল। কেহই ভাবে নাই যে, প্রবল পরাক্রান্ত গুপ্ত সম্রাটগণের শাসনাধীন আর্য্যাবর্ত্ত কোনও বিদেশীয় জাতি কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইবে। মরুপ্রান্তে তুষারময় উত্তরে বর্ব্বরজাতির অশ্বপদশব্দ শ্রুত হইল। সহস্র সহস্র—লক্ষ লক্ষ হূণ অশ্বারোহী মরুভূমি হইতে বহির্গত হইয়া বাহ্লীক ও কপিশা আক্রমণ করিল, ধূলিমুষ্টির ন্যায় সেই প্রবল ঝটিকার সম্মুখে গান্ধারের কুষাণরাজ্য উড়িয়া গেল, গান্ধারের ও উদ্যানে শকজাতীয় সামন্তরাজগণ হূণ আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টাও করিল না। এই সময়ে পাটলিপুত্রে চন্দ্রগুপ্তের দেহাবসান হইল। প্রৌঢ় কুমারগুপ্তের উপরে এই বিশাল সাম্রাজ্যের শাসনভার অর্পিত হইল। মগধে যখন অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন হইতেছে, তখন হূণগণ ধীরে ধীরে, পঞ্চনদ, কাশ্মীর, দরদ ও খসদেশ শ্মশানে পরিণত করিতেছে। হূণগণের নাম তোমরা অতি অল্পদিন শুনিয়াছ, কিন্তু কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে হূণগণের নাম করিলে ভীতি-বিহ্বলা-গর্ভিণীর গর্ভপাত হইত, স্কন্দগুপ্তের শাসন-কালে তাহাদিগের নাম শুনিলে দেশবিখ্যাত বীরগণ প্রহরণ পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়নপর হইতেন। খর্ব্বাকার, স্থূলদেহ, গুম্ফশ্মশ্রু-বিহীন, পেচকের ন্যায় চক্ষু বিশিষ্ট পশুচর্ম্মাচ্ছাদিত হূণগণকে দেখিলে মনে অত্যন্ত ভয় হইত। সে সময়ে হূণগণের নাম শুনিয়া প্রাচ্য ও প্রতীচ্য উভয় জগতের সকল জাতিকেই শঙ্কিত হইতে হইয়াছিল। শুনিয়াছি, হূণদর্শনে প্রাচীন রোমক সাম্রাজ্যের জনৈক বিখ্যাত ধর্ম্মযাজক বলিয়াছিলেন যে, তাহারা তাতারবাসী নহে—নরকবাসী।
হূণগণ যখন গুপ্তসাম্রাজ্যের পশ্চিমপ্রান্ত আক্রমণ করিল, তখন কুমারগুপ্ত পাটলিপুত্রের প্রাসাদে সুষুপ্তিমগ্ন; কুমার স্কন্দগুপ্ত মথুরার শাসনকর্ত্তা। স্কন্দগুপ্ত সিন্ধুতীরে যথাসাধ্য হূণগণের গতিরোধ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন; চন্দ্রগুপ্তের সুশিক্ষিত সৈন্যবৃন্দও যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিল। ইরাবতী, বিতস্তা ও শতদ্রুতীরে উত্তরাপখবাসী সহস্র সহস্র সৈনিক স্বদেশরক্ষার্থ জীবন উৎসর্গ করিয়াছিল, কিন্তু বাত্যাতাড়িত সাগরোর্ম্মিরাশির ন্যায় হূণ অশ্বারোহিগণ স্কন্দগুপ্তের সৈন্যবল ভাসাইয়া লইয়া গেল। শতদ্রুপারে আসিয়া কুমার বিশ্রাম করিবার অবকাশ পাইলেন। বিতস্তাতীর হইতে ষে দূত সাহায্য প্রার্থনার জন্য মগধে গিয়াছিল, সে ফিরিয়া আসিয়া শতদ্রুতীরের স্কন্ধাবারে যুবরাজকে বিষমসংবাদ জ্ঞাপন করিল,—বৃদ্ধ কুমারগুপ্ত তরুণীর রূপজমোহে আবদ্ধ হইয়াছেন, পঞ্চাশৎবর্ষীয় বৃদ্ধ চতুর্দশবর্ষীয়া বালিকার পাণিগ্রহণ করিয়া উন্মত্ত হইয়াছেন, এবং স্কন্দগুপ্তের মাতা ক্রোধে ও ক্ষোভে উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন। দারুণ সংবাদ শুনিয়া স্কন্দগুপ্ত স্তম্ভিত হইলেন, অসম দ্বন্দ্বে তাঁহার বিলক্ষণ বলক্ষয় হইয়াছিল। তিনি মগধ হইতে বহু সৈন্যের আশা করিয়াছিলেন; কিন্তু দূত আসিয়া সংবাদ দিল যে, সম্রাট্ তখন নূতন মহিষীর আবাসে; মাসাধিক কাল কেহ তাঁহার দর্শন পায় নাই। হতাশ হইয়া স্কন্দগুপ্ত মথুরায় প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন ও তথার তদীয় খুল্লতাত মহারাজ-পুত্র গোবিন্দগুপ্তের প্রেরিত দূতমুখে সংবাদ পাইলেন যে, গোবিন্দগুপ্ত স্বয়ং বলসংগ্রহ করিতেছেন; তিনি সম্রাটের আদেশের জন্য অপেক্ষা করেন নাই; কারণ, তখনও পর্য্যন্ত কেহই সম্রাটের সাক্ষাংলাভে সমর্থ হয় নাই। সুখের বিষয় শতদ্রুতীর হইতে হূণগণ উত্তরাভিমুখে ধাবিত হইয়াছিল, সুতরং স্কন্দগুপ্ত মথুরায় আসিয়া নগর রক্ষা করিবার উপায় উদ্ভাবন করিতে লাগিলেন। গোবিন্দগুপ্ত অল্পসংখ্যক সৈন্য লইয়া মথুরায় আসিয়া স্কন্দগুপ্তের সহিত মিলিত হইলেন। খুল্লতাত ভ্রাতুষ্পুত্র একত্র হইয়া হূণগণের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।
নব-পরিণীতা বালিকা মহিষীকে লইয়া কুমারগুপ্ত পাটলিপুত্র হইতে মহোদয়ে আসিলেন। পাটলিপুত্রের প্রাসাদবাসিগণের বাক্যযন্ত্রণা তাঁহার মহিষীর পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিয়াছিল; গঙ্গাতীরবর্ত্তী কান্যকুব্জের প্রাচীন প্রাসাদে আসিয়া বর্ষীয়ান সম্রাট শান্তি লাভ করিলেন। হূণগণ ধীরে ধীরে মথুরার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। স্কন্দগুপ্ত ও গোবিন্দগুপ্তকে সাহায্য করিবার জন্য আর কেহই চেষ্টা করিল না। শকপ্লাবনের ন্যায় হূণপ্লাবন আসিয়া প্রাচীন সৌরসেন রাজ্য ভাসাইয়া লইয়া গেল, নানাবিধ প্রাচীন কারুকার্য্যশোভিত রক্তবর্ণ প্রস্তরনির্ম্মিত মথুরার নগর প্রাকার হূণগণের আক্রমণ রোধ করিতে সমর্থ হইল না। গোবিন্দগুপ্ত ও স্কন্দগুপ্ত সন্তরণে যমুনা পার হইয়া প্রাণরক্ষা করিলেন। ভিখারীর ন্যায় চীর পরিধান করিয়া কুমার ও মহারাজপুত্ত্র, মহোদয়নগরীর তোরণে উপস্থিত হইলেন। দৌবারিকগণ তাঁহাদিগকে দেখিয়া চিনিতে পারিল না বা সম্ভ্রম প্রদর্শন করিল না। তাঁহারা নগ্নপদে সুদীর্ঘ রাজবর্ত্মগুলি অতিক্রম করিয়া জাহ্ণবীতীরে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হইলেন। সামান্য ভিক্ষুক জ্ঞানে প্রতীহারিগণ তাঁহাদিগকে দূর করিয়া দিতেছিল; রোষে গোবিন্দগুপ্ত অসিমুক্ত করিলেন। সমুদ্রগুপ্তের নামাঙ্কিত তরবারি দেখিবামাত্র প্রতীহারগণ নতশির হইল, তাহারা সিপ্রা ও ভাগীরথীতীরে গোবিন্দগুপ্তের ক্ষিপ্রহস্তে সেই অসিচালনা দেখিয়াছিল। কোষমুক্ত অসিহস্তে নিবারণোন্মুখ মহল্লিকাবর্গপরিবৃত হইয়া মেঘমুক্ত ভাস্করের ন্যায় উভয়ে সম্রাটের শয়নকক্ষে প্রবেশ করিলেন; দেখিলেন, বর্ষীয়ান্ সম্রাট্ মহিষীর জন্য মাল্য রচনায় নিযুক্ত আছেন। পুত্রকে ও কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে দেখিয়া বৃদ্ধ অতি লজ্জিত হইলেন। কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া গোবিন্দগুপ্তের ধৈর্য্যচুতি হইল। তিনি জ্যেষ্ঠকে সম্বোধন করিয়া পূর্ব্বজীবনের কথা বলিতে লাগিলেন। উন্মত্তের জ্ঞানোদয় হইল না; বৃদ্ধ সম্রাট্ অপরাধ স্বীকার করিয়া কুমার ও মহারাজপুত্ত্রের হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করিতে চাহিলেন, কিন্তু তরুণী মহিষীর ভ্রূভঙ্গী দেখিয়া তাহাও করিতে পারিলেন না। অনেক অনুরোধের পর স্কন্দগুপ্ত ও গোবিন্দগুপ্ত মহিষীসমভিব্যাহারে বৃদ্ধ সম্রাট্কে মন্ত্রণাগৃহে আনয়ন করিতে সমর্থ হইলেন। মহিষীর অনুজ্ঞাক্রমে রাজশ্যালক হূণযুদ্ধে সেনাপতি নির্দ্দিষ্ট হইলেন। ইহার অতি অল্পদিন পরেই নিশীথকালে অল্পসংখ্যক হূণ অশ্বারোহী নগর আক্রমণ করিল, হূণনাম শ্রবণমাত্র বৃদ্ধ সম্রাট্ মহিষী ও শিশুপুত্ত্রকে লইয়া হস্তিপৃষ্ঠে নগর ত্যাগ করিলেন। মুষ্টিমেয় হূণ অশ্বারোহী রাত্রিকালে প্রাচীন মহোদয় নগরীকে শ্রীহীন করিয়া গেল, স্তম্ভিত নগরবাসিগণ আত্মরক্ষা করিতেও সমর্থ হইল না।
শরৎকালে একদিন প্রত্যূষে সঙ্ঘারামবাসী ভিক্ষুগণ পরিক্রমণের পথ করিতেছেন, এমন সময়ে কনিষ্কনির্ম্মিত পাষাণাচ্ছাদিত পথে বহুরথচক্রের নিঘোর্ষ শ্রুত হইল। অর্থলোলুপ ভিক্ষুগণ ভাবিলেন যে, নিশ্চয়ই কোন আঢ্য শ্রেষ্ঠী তীর্থযাত্রায় আসিতেছেন। কিন্তু সমাগত ব্যক্তিগণকে দেখিবামাত্র তাঁহাদিগের অর্থলালসা দূর হইয়া গেল, তাঁহারা সভয়ে দেখিলেন যে, অসংখ্য রাজপুরুষসমাবৃত হইয়া সিন্ধুদেশীয় অশ্বচতুষ্টয়বাহিত রথে আর্য্যাবর্ত্তের অধীশ্বর কুমারগুপ্ত মহিষী ও পুত্ত্র সমভিব্যাহারে ধীরে ধীরে স্তূপাভিমুখে আসিতেছেন। সৈনিকগণ শীঘ্রই ভিক্ষুগণকে স্তূপসন্নিধান হইতে দূর করিয়া দিল, সম্রাট্ পাষাণনির্ম্মিত প্রাচীন সঙ্ঘারামে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। চতুর্দ্দিকে বহু বস্ত্রাবাস স্থাপিত হইল। তখন সাম্রাজ্যের অবস্থা পরিবর্ত্তিত হইয়াছে, হূণগণ প্রায় সমগ্র আর্য্যাবর্ত্ত অধিকার করিয়াছে। পূর্ব্বে পাটলিপুত্রে গোবিন্দগুপ্ত ও দক্ষিণে সৌরাষ্ট্রে স্কন্দগুপ্ত বহু কষ্টে সাম্রাজ্যের মর্য্যাদা রক্ষা করিতেছিলেন। বৃদ্ধ রাজমহিষীর অনুরোধে যুদ্ধবিগ্রহ হইতে দূরে থাকিবার জন্য বিন্ধ্যাটবীতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন।
একদিন বনপথ অতিক্রম করিয়া অশ্বপৃষ্ঠে গোবিন্দ্রগুপ্ত ও স্কন্দগুপ্ত আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা আসিয়া দেখিলেন, বৃদ্ধ সম্রাট্ পাষাণের উপর উপবেশন করিয়া মহিষীর কেশদামের পরিচর্য্যা করিতেছেন ও স্তূপবেষ্টনীর মধ্যে দাঁড়াইয়া ত্রয়োদশবর্ষীয় বালক পুরগুপ্ত প্রাচীন জাতকের চিত্রগুলির প্রতি শরসন্ধান করিতেছে। দক্ষিণ-তোরণের নিম্নে দণ্ডায়মান হইয়া জ্যেষ্ঠকে সম্বোধন করিয়া গোবিন্দগুপ্ত বলিতে লাগিলেন, “মহারাজ, মহাদেবী ধ্রুবস্বামিনী আপনাকে ভ্রমক্রমে পালন করিয়াছিলেন। যে স্তন্যপানে আমার দেহ বর্দ্ধিত হইয়াছে, সেই স্তন্যপানে আপনারও দেহ পুষ্ট হইয়াছে; সে কথা স্মরণ করিয়া আপনার কি লজ্জাবোধ হইতেছে না? যাঁহার বাহুবলে একদিন বাহ্লীক হইতে বঙ্গ পর্য্যন্ত সমগ্র আর্য্যাবর্ত্ত মহারাজাধিরাজ চন্দ্রগুপ্তের পদানত হহয়ছিল, সেই ব্যক্তির বাহুবল অদ্য রমণী আর্দ্র কুন্তল শুষ্ক করিবার জন্য প্রযুক্ত হইতেছে, ইহাও আমাকে দেখিতে হইল? যাঁহার বাহুবলে শকগণ সৌরাষ্ট্র পরিত্যাগ করিয়া চিরকালের জন্য মরুমধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে, সে ব্যক্তিকে ভগবান্ কি পাপের জন্য বৃদ্ধবয়সে রমণীর পরিচর্য্যায় নিযুক্ত করিয়াছেন? উঠ, মহারাজ, ভূমিশয্যা পরিত্যাগ কর। চল, উভয় ভ্রাতায় পিতামহ-প্রদত্ত দিগ্বিজয়ী তরবারি গ্রহণ করিয়া বিজাতীয় হূণগণকে সিন্ধুর পরপরে রাখিয়া আসি। মহারাজ, পাটলিপুত্র, মহোদয়, মথুরা, অবন্তী ও জালন্ধর পরিত্যাগ করিয়া কেন বিন্ধ্য পর্ব্বতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে? শৈশবের আবাসভূমি পাটলিপুত্র, কান্যকুব্জ, মথুরা, অবন্তী ও সুন্দর জালন্ধর পরিত্যাগ করিয়া আসিতে তুমি কি কষ্ট বোধ কর নাই? উঠ, প্রহরণ গ্রহণ কর, তরুণীর রূপে মুদ্ধ হইয়া জড়ের ন্যায় বহুকাল বাস করিয়াছ; তোমার জড়তা দূর করিবার সময় আসিয়াছে।” নির্ব্বাক্ নিষ্পন্দ হইয়া বর্ষীয়ান্ সম্রাট মহিষীর কৃষ্ণবর্ণ কেশগুচ্ছের প্রান্তে উপবিষ্ট রহিলেন। মহিষী রাজপুত্ত্রের প্রতি বক্রদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া হাস্য করিয়া উঠিলেন; রোষে গোবিন্দগুপ্তের মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল ও স্কন্দগুপ্তের চক্ষুর্দ্বয় অশ্রুভারাক্রান্ত হইল। উভয়ে ধীরে ধীরে স্তূপবেষ্টনীর বহির্দ্দেশে গমন করিলেন।
বেষ্টনীর বহির্দ্দেশে শ্বেতবস্ত্র-পরিহিত কয়েকজন বৃদ্ধ দণ্ডায়মান ছিলেন। গোবিন্দগুপ্ত ও স্কন্দগুপ্তকে বহির্গত হইতে দেখিয়া তাঁহাদিগের মধ্য হইতে একজন অগ্রসর হইলেন; তিনি বিশাল গুপ্ত-সাম্রাজ্যের একমাত্র মন্ত্রী যুবরাজভট্টারকপাদীয়কুমারামাত্যাধিকরণ দামোদর শর্ম্মা। তাঁহাদের শুষ্কমুখ ও রক্তবর্ণ চক্ষু দেখিয়াই বহুদর্শী মন্ত্রী তাঁহাদিগের সাধনার ফল অবগত হইলেন। খুল্লতাতের বা ভ্রাতুষ্পুত্রের বাক্য নিঃসৃত হইবার পূর্ব্বেই তিনি তাঁহাদিগকে আশ্বাস দিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি বলিলেন যে, অধঃপতনের সময় হইলেই এইরূপ ঘটনা ঘটিয়া থাকে, ইহা নিবারণ করা মনুষ্যের সাধ্যায়ত্ত নহে; তবে তিনি স্বয়ং রাজসদনে উপস্থিত হইয়া রাজবংশীয় কোন ব্যক্তির যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা জ্ঞাপন করিবেন। প্রধান সেনাপতি মহাবলাধিকৃত অগ্নিগুপ্ত ও প্রধান বিচারপতি মহাদণ্ডনায়ক রামগুপ্ত মন্ত্রীর বাক্য সমর্থন করিলেন। পরক্ষণেই পলিতকেশ সচিব তোরণ মধ্যে প্রবেশ করিলেন। কুমারগুপ্ত তখনও সেই ভাবে বসিয়া আছেন, মহিষী নিদ্রিতা; বালক পুরগুপ্ত আলম্বনের উপরে আরোহণের চেষ্টা করিতেছে। বৃদ্ধ সচিব ও বৃদ্ধ সম্রাটে প্রায় একদণ্ডের অধিক কাল কথোপকথন হইল। বহু বাক্য ব্যয় করিয়া রাজনীতিকুশল দামোদরশর্ম্মা বৃদ্ধ সম্রাট্কে কুমার স্কন্দগুপ্তের প্রতিনিধিত্বে সম্মত করাইলেন, কিন্তু সপত্নীপুত্ত্রের নাম শ্রবণ মাত্র মহিষীর নিদ্রাভঙ্গ হইল। বর্ষীয়ান্ সম্রাট্ সভয়ে বলিয়া উঠিলেন যে, গুরুতর রাজকার্য্যে মহাদেবীর পরামর্শ আবশ্যক। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ রোষে কম্পিত হইয়া উঠিলেন। মহাদেবীর আদেশ হইল, ত্রয়োদশবর্ষীয় কুমার পুরগুপ্ত হূণযুদ্ধে সম্রাট্ কুমারগুপ্তের প্রতিনিধিস্বরূপ মহাবলাধিকৃতের সঙ্গী হইবে। দামোদর শর্ম্মা অপেক্ষাকৃত গুরুতর বিপৎপাতের আশঙ্কা করিয়া বেষ্টনী হইতে বহির্গত হইলেন। শুষ্ককণ্ঠে যুবরাজপাদ দামোদর শর্ম্মা যখন সর্ব্বসমক্ষে মহাদেবীর আদেশ প্রচার করিলেন, তখন সকলেই বুঝিতে পারিলেন যে, সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বের শেষ দশা আগতপ্রায়। বিষণ্ণ বদনে সকলে স্তূপসন্নিধান হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন, ও এক প্রহর সময়ের মধ্যেই গোবিন্দ গুপ্ত অশ্বারোহণে পাটলিপুত্রাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। প্রভাতে সকলে সবিস্ময়ে শুনিল যে, ব্রাত্রিকালে স্কন্দগুপ্ত অজ্ঞাতসারে স্কন্ধাবার পরিত্যাগ করিয়াছেন। তখন হইতেই বিচক্ষণ সেনানীগণের মুখ ভাবী বিপৎপাতের আশঙ্কায় গম্ভীর হইয়া উঠিল।