[ ৯ ]

 বলীবর্দ্দদ্বয়বাহিত রথে বৃদ্ধ সম্রাট্ স্তূপসন্নিধান হইতে পাটলিপুত্রে নীত হইতেছেন। স্কন্ধাবার অন্তর্হিত হইয়াছে, কয়েকজন অশ্বারোহী ধীরে ধীরে শকটের পশ্চাতে চলিতেছে। মহিষী জীর্ণবস্ত্রের ন্যায় বৃদ্ধ পতিকে পরিত্যাগ করিয়া পাটলিপুত্রে রাজদণ্ড অধিকার করিতে গিয়াছেন। কনিষ্কনির্ম্মত পাষাণাচ্ছাদিত পথে ঘর্ঘর শব্দে বন মুখরিত করিয়া ধীর মন্থর গতিতে সম্রাটের রথ চলিয়াছে। তখন সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল পাটলিপুত্রে মহোৎসবের আয়োজন হইয়াছে; আর কান্যকুব্জে, প্রতিষ্ঠানে ও সুদূর মহাসমুদ্রের তীরবর্ত্তী আনর্ত্তে অসহায় নরনারীর মর্ম্মভেদী আর্ত্তনাদে গগন বিদীর্ণ হইতেছে। শতবর্ষ পরেও সে কথা শ্রবণ করিয়া মাতৃক্রোড়ে ক্রীড়ামত্ত শিশু নিশ্চল হইত। হূণপ্লাবন ত্রিবেণী হইতে সুদূর প্রতীচ্যে রোমক নগরীর তোরণ পর্য্যন্ত উপস্থিত হইয়াছিল। তোরমাণ যখন কান্যকুব্জ ধ্বংস করিতেছেন, তখন হূণবিপ্লবে প্রবীণপ্রতীচ্য জ্ঞানালোক পৃথিবী হইতে লুপ্ত হইবার উপক্রম হইয়াছে। পঙ্গপাল আসিলে যেরূপ শ্যামল তৃণক্ষেত্রে দুর্ব্বাদল পর্য্যন্ত দেখা যায় না, সেইরূপ যে পথে হূণগণ চলিয়া যাইত, সে পথে জীবের চিহ্ণ পর্য্যন্ত লোপ পাইত। উচ্চভূমি হইতে দেখিলে দীর্ঘ কৃষ্ণসর্পের ন্যায় ভস্মীভূত গ্রাম ও নগরশ্রেণী হূণপ্লাবনের পথ নির্দ্দেশ করিয়া দিত। ক্ষুদ্রাকার, বৃহৎশীর্ষ, ক্ষুদ্রনাসিক, মলিন, শ্বেতবর্ণ হূণ অশ্বারোহীকে দেখিবা মাত্র উত্তরাপথবাসিগণ গৃহ পরিত্যাগ করিয়া অরণ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিত, কালান্তকস্বরূপ হূণগণ অরণ্য বেষ্টন করিয়া তাহাতে অগ্নিসংযোগ করিত ও পলায়নপর নরনারীগণকে দূর হইতে বর্শা বা শরবিদ্ধ করিত। নগরাক্রমণ করিলেই ঝটিকাহত সমুদ্রতরঙ্গের ন্যায় হূণগণ দুর্গপ্রাকার বা দুর্গপ্রাচীর অতিক্রম করিয়া অসহায় নাগরিকগণের উপর পতিত হইত, এক সময়ে নগরের নানা স্থানে অগ্নিসংযোগ করিত; তৈলসিক্ত বস্ত্রে জড়িত জীবিত শিশুর গাত্রে অগ্নিসংযোগ করিয়া রাত্রিকালে আলোকের কার্য্য নির্ব্বাহ করিত; মাতার সম্মুখে শিশুকে ঊর্দ্ধে নিক্ষেপ করিয়া শাণিত তরবারির উপরে ধারণ করিত, হতভাগ্য শিশুর দ্বিখণ্ডিতদেহ ধূলিতে লুণ্ঠিত হইত। বৃদ্ধ সম্রাট্ অত্যন্ত পীড়িত। গোবিন্দগুপ্ত বহু কষ্টে মগধের সীমান্ত রক্ষা করিতেছেন। সাম্রাজ্যের অন্যান্য প্রদেশ সংরক্ষণ অসম্ভব। এই সময়ে পুরগুপ্তের নামে তরুণী মহাদেবী সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করিলেন; বৃদ্ধ সচিব দামোদর শর্ম্মার সকল আশার অবসান হইল।

 সম্রাটের শিবির স্তূপসান্নিধ্য পরিত্যাগ করিলে ক্রমশঃ দুই একজন ভিক্ষু সঙ্ঘারামে আসিয়া বাস করিল। ইহারা সকলেই নিরক্ষর, বুদ্ধ অপেক্ষা উদরের প্রতি অধিক ভক্তিপরায়ণ, নির্ব্বাণ লাভাপেক্ষা তরুণী লাভের জন্য অধিক লোলুপ। ইহারা অর্থের জন্য নিরীহ তীর্থযাত্রিগণকে উৎপীড়িত করিত। ক্রমে ইহাদিগের ভয়ে তীর্থবাত্রিগণ আর স্তূপসান্নিধ্যে আসিতে চাহিত না। বেষ্টনী পরিক্রমণের পথ ও প্রাচীন গর্ভগৃহের দ্বার বনময় হইয়া উঠিল। একদিন নিশীথে দূরে বহু অশ্বপদশব্দ শ্রুত হইল। শব্দ ক্রমশঃ নিকটবর্ত্তী হইলে দৃষ্ট হইল, হূণসৈন্য দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ হইতে সাম্রাজ্যের সৈনিকদিগকে ধীরে ধীরে স্তূপাভিমুখে তাড়িত করিয়া আনিতেছে। পরদিন প্রভাতে সম্রাটের সৈনিকগণ ভিক্ষুগণকে সঙ্ঘারাম হইতে দূর করিয়া দিয়া বেষ্টনী সুরক্ষিত করিল। বুঝিলাম, পুণ্যক্ষেত্রে রক্তস্রোত প্রবাহিত হইবে। সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বে দূর হইতে হূণ অশ্বারোহিগণ অবিরাম বাণবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। সুতীক্ষ্ণ ফলাযুক্ত শরাঘাতে বেষ্টনীর স্থানে স্থানে আমাদিগের গাত্র ক্ষত হইতে লাগিল, বহু পরিশ্রমলব্ধ চিত্রগুলি বিনষ্ট হইবার উপক্রম হইল; কিন্তু হূণ বা আর্য্য কোন জাতীয় সৈন্যই সে দিকে লক্ষ্য করিল না। প্রথম প্রহর অতীত হইলে হূণগণ অশ্বপৃষ্ঠে প্রথম বেষ্টনী পার হইবার চেষ্টা করিল, তখন বেষ্টনীর মধ্য হইতে সাম্রাজ্যের সৈনিকের নানাবিধ অস্ত্রবর্ষণ করিয়া তাহাদিগকে নিবারিত করিল। এইরূপে সমস্ত চেষ্টা বিফল হইলে হূণ অশ্বারোহিগণ স্তূপ হইতে কিঞ্চিৎ দূরে গমন পূর্ব্বক বিশ্রামের উদ্যোগ করিতে লাগিল। তখন দীর্ঘকায় আপাদমস্তকবর্ম্মমণ্ডিত জনৈক যুবা সৈনিক দক্ষিণ তোরণের বাহিরে আসিয়া শত্রুসৈন্যের গতিবিধি লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। বেষ্টনীর মধ্যে হতাবশিষ্ট সৈন্যগণ বিশ্রামের আয়োজন করিতে লাগিল। তখনও দ্বিসহস্রের অধিক সৈনিক বেষ্টনীর মধ্যে বর্ত্তমান ছিল। সেনাধ্যক্ষগণ হূণগণের গতিবিধি পর্য্যবেক্ষণ করিয়া অনুমান করিলেন যে, কিৎক্ষণের জন্য যুদ্ধ স্থগিত থাকিবে। সশাখা বৃক্ষসমূহ কর্ত্তৃক তোরণদ্বার চতুষ্টয় সুদৃঢ়ভাবে রুদ্ধ করিয়া সেনাধ্যক্ষ ও সৈনিকগণ বিশ্রামার্থ স্তূপের উপরিভাগে ও পরিক্রমণের পথে শয়ন করিলেন। ক্রমে কেবল কতিপয় পদাতিক ও কয়েকটি কীরদেশীয় সারমেয় জাগিয়া রহিল। ক্রমে হূণস্কন্ধাবারে রন্ধনের অগ্নি নির্ব্বাপিত হইল, উভয়পক্ষের সেনাই সুষুপ্তিমগ্ন হইল। নিশা দ্বিপ্রহর অতীত হইল। কৃষ্ণাচতুর্দ্দশীর ঘোর অন্ধকার ভেদ করিয়া পিপীলিকার ন্যায় ধীরে ধীরে কয়েকটি নিশাচর জন্তু যেন বেষ্টনী অভিমুখে অগ্রসর হইতেছে। নিকটে আসিলে দেখিতে পাইলাম যে, তাহারা মনুষ্য, পশু নহে। ধীরে ধীরে একে একে নিঃশব্দ পদবিক্ষেপে পঞ্চবিংশতি জন হূণসৈনিক বেষ্টনী অভিমুখে অগ্রসর হইতেছে। তখন প্রহরীদলও নিদ্রিত, ক্ষীণদেহ দীর্ঘাকার কুক্কুরগুলি বেষ্টনী রক্ষা করিতেছে। পূর্ব্ব তোরণের নিকটে আসিয়া হূণগণ নিমেষের জন্য দণ্ডায়মান হইল ও বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে কর্পূর চূর্ণ চতুর্দ্দিকে নিক্ষেপ করিতে করিতে তোরণ অভিমুখে অগ্রসর হইল। কিন্তু কর্পূরের তীব্রগন্ধ সারমেয়গণের তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তিকে অভিভূত করিতে পারিল না, কুক্কুরগুলি তারস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল। রক্ষিগণ নয়ন উন্মীলন করিয়া দেখিল যে, দুইজন হূণ আলম্বনের উপর উঠিয়াছে। তাহারা তৎক্ষণাৎ তাহাদিগকে শরাঘাতে নিহত করিল। অকস্মাৎ বাধা প্রাপ্ত হইয়া হূণসৈনিকগণ শৃঙ্গনিনাদ করিল। দূর হইতে শৃঙ্গরবে তাহার উত্তর আসিল। দুরে হূণশিবিরে শত শত উল্কা প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তখন সাম্রাজ্যের সৈনিকগণ চেতনা লাভ করে মাই। বজ্রের ন্যায় অবশিষ্ট হূণবাহিনী আসিয়া বেষ্টনী আক্রমণ করিল ও পরক্ষণেই বাধা প্রাপ্ত হইয়া শত হস্ত পিছাইয়া গেল। এইরূপে বার বার আক্রান্ত হইয়াও সাম্রাজ্যের সৈনিকগণ অত্মসমর্পণ করিল না। যুদ্ধ শেষ হইবার পূর্ব্বে পূর্ব্বদিকে আলোক দৃষ্ট হইল, সাম্রাজ্যের সৈনিকগণ জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল। হূণগণ পুনরায় বেষ্টনী আক্রমণ করিল। যখন আলম্বনের উপরিভাগে যুদ্ধ চলিতেছিল, তখন কতিপয় হূণসৈনিক তৈলসিক্ত বস্ত্রখণ্ডের সাহায্যে বৃক্ষকাণ্ডগুলিতে অগ্নিসংযোগ করিবার চেষ্টা করিতেছিল। এইরূপে প্রভাতের আক্রমণ শেষ হইবার পূর্ব্বেই বেষ্টনীর চতুর্দ্দিকে ভীষণ অগ্নি প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তখন বেষ্টনীর মধ্যে অবস্থান করা মনুষ্যের সাধ্যাতীত। উল্লাসে কৃতান্তসদৃশ হূণ অশ্বারোহিগণ চীৎকার করিতে লাগিল ও বৃত্তাকারে পাষাণবেষ্টনীর চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিল। তাহারা জীবিত অবস্থায় একজনকেও বেষ্টনী হইতে বহির্গত হইতে দিবে না। সিংহের ন্যায় গর্জ্জন করিয়া পূর্ব্বোক্ত বর্ম্মাবৃত যুবক তোরণ পথে অগ্রসর হইলেন। জনৈক হূণ পদাতিক তাঁহারা শিরস্ত্রণের প্রতি লক্ষ্য করিয়া পরশু নিক্ষেপ করিল। ফলে শিরস্ত্রাণের ঊর্দ্ধদেশ ভূমিতে পতিত হইল, সঙ্গে সঙ্গে সহস্রকণ্ঠে সমস্বরে উল্লাসে স্কন্দগুপ্তের জয়ধ্বনি ধ্বনিত হইল। বাহিরে হূণগণ প্রমাদ গণিল। বহুদিন পরে স্কন্দগুপ্তকে দেখিয়া সৈনিকগণের উৎসাহ দ্বিগুণিত হইল, স্কন্ধগুপ্তের নেতৃত্বে পঞ্চশত সৈনিক অবলীলাক্রমে হূণব্যুহ ভেদ করিয়া অরণ্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইল, পঞ্চাশৎসহস্র হূণসৈনিক চিত্রের ন্যায় দণ্ডায়মান হইয়া দেখিল, সেই পঞ্চশতের গতিরোধ তাহাদিগের সাধ্যাতীত। কেহ কেহ অরণ্যমধ্যে তাহাদিগের অনুসন্ধান করিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু সেই পঞ্চাশতের পশ্চাতে যাহারা অরণ্যে প্রবেশ করিয়াছিল তাহাদিগকে আর কেহ দেখিতে পাইল না। অর্দ্ধশতাব্দী পরে জালন্ধরে বা উজ্জয়িনীতে হূণবৃদ্ধগণ বালকগণের নিকট স্কন্দগুপ্তের কোশলযুদ্ধের কাহিনী বলিত ও শিশুদিগকে মন্ত্রমুগ্ধ করিয়া রাখিত। শতবর্ষ পরে আর্য্যাবর্ত্তের মহিলাগণ প্রভাতে হূণরাক্ষসগণের কবল হইতে দেবতা, রমণী ও শস্যক্ষেত্রের ত্রাণকর্ত্তৃস্বরূপ স্কন্দগুপ্তের নাম স্মরণ করিতেন; সুদূর বঙ্গদেশে ধীবর জ্যেষ্ঠগণ মহাবিপত্ত্রাতা স্কন্দগুপ্তের নাম গান করিত ও ভক্তিজনিত অশ্রুজলে তাহাদিগের বক্ষ প্লাবিত হইত।

 দহনের অসহ্য যন্ত্রণা যে কখনও অনুভব করে নাই তাহার পক্ষে আমাদিগের বর্ণনাতীত যন্ত্রণা বোধগম্য নহে। আলম্বন, স্তম্ভ ও সূচীর অভ্যন্তরস্থ স্থান ও তোরণগুলি বৃক্ষকাণ্ডে আচ্ছাদিত হইয়াছিল। তাহাতে অগ্নি প্রযুক্ত হইলে সরস তরুগুলি ধীরে ধীরে শুষ্ক হইতে লাগিল ও অগ্নি একবার প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলে তাহার শিখা গগন স্পর্শ করিল। তখন বুঝিলাম, প্রাচীন স্তূপের বিনাশের দিন আসিয়াছে। আর্ত্তিমিদর কর্ত্তৃক স্বহস্তে বহুযত্নে নির্ম্মিত দক্ষিণ তোরণের শীর্ষস্থিত ধর্ম্মচক্র সশব্দে ভূমিতলে পতিত হইল, উত্তর তোরণের অষ্টকোণ স্তম্ভ সশব্দে বিদীর্ণ হইয়া গেল, নানাস্থানে বেষ্টনীর স্তম্ভগুলি ধরাশায়ী হইল, লেলিহান অগ্নিশিখা আকাশ স্পর্শ করিল। ক্রমে বেষ্টনীর পার্শ্ববর্ত্তী বৃক্ষসমূহ প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। বেষ্টনীর চতুষ্পার্শ্ব হইতে বিদীর্ণ পাষাণের আর্ত্তনাদ উত্থিত হইল, উত্তাপ অতি ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিল। বর্ত্তুলাকৃতি স্তূপ কম্পিত হইতে লাগিল, সহস্র সহস্র বজ্রনির্ঘোষের মিলিত ধ্বনির ন্যায় শব্দ পৃথিবী হইতে উত্থিত হইতে লাগিল। ধনভূতির বহুযত্ননির্ম্মিত স্তূপ, মহাস্থবিরের ভিক্ষালব্ধ অর্থে নির্ম্মিত স্তূপ, সিংহদত্তের প্রাণাপেক্ষা প্রিয় তথাগতের শরীর, একত্র সমাহিত হইতে চলিয়াছে। মহাশব্দে গর্ভগৃহ শরীরনিধানের আধারের উপরে পতিত হইল। তদপেক্ষা ভীষণ শব্দে পাষাণনির্ম্মিত অর্দ্ধবর্ত্তুল দ্বিধা হইয়া গেল। গুরুভার পাষাণ পতনের ও বিদারণের শব্দ সর্ব্বগ্রাসী অগ্নির ধ্বংসসূচক শব্দকে ক্ষণেকের জন্য পরাস্ত করিল, ধূলি ও ধূমের স্তম্ভ নীল আকাশ স্পর্শ করিল। যন্ত্রণার লাঘব হইবার পূর্ব্বেই চিন্তা করিতে লাগিলাম, স্তূপ ধ্বংস হইল, কিন্তু সিংহদত্তের বহু আয়াসসঞ্চিত তথাগতের শরীর তক্ষশিলায় প্রেরিত হইল না। শুনিয়াছিলাম তক্ষশিলায় মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষের উপরিস্থিত শ্যামল তৃণক্ষেত্রে বক্রনাশা দরদ মেষপাল মেষচরণ ও বংশীবাদন করে। পঞ্চাশবর্ষ পূর্ব্বে তক্ষশিলার আবালবৃদ্ধবনিতা হূণগণ কর্ত্তৃক নিহত হইয়াছে। আকুল হইয়া সিংহদত্তকে ডাকিলাম। স্তূপ ধ্বংস করিয়া অগ্নিরাশি অরণ্যের চতুষ্পার্শ্বে ধাবিত হইয়াছে, মণ্ডলাকার ধূমরাশি মেঘরাজ্যে উত্থিত হইতেছে; দেখিলাম, যেন তেজঃস্নাত দিব্যদেহ সিংহদত্ত সহাস্য বদনে দিবাকরের রাজ্য হইতে অবতরণ করিতেছেন। সিংহদত্তের ছায়া স্তূপের ধ্বংসাবশেষের চতুষ্পার্শ্বে ভ্রমণ করিতে লাগিল, দারুণ যন্ত্রণায় আকুল পাষাণকণাগুলিকে যেন বলিতে লাগিল “যাহার অস্থির উপরে এই স্তূপ নির্ম্মিত হইয়াছিল, তিনি যে স্থানে আসিয়াছেন আমিও সেই স্থানে আসিয়াছি। পাটলিপুত্রবাসী মহাস্থবির, ধনভূতি, অপূর্ব্বশিল্পদক্ষ যবনশিল্পিগণও সেইস্থানে আসিয়াছেন। তথায় ধর্ম্ম, কর্ম্ম, ব্রাহ্মণ, শ্রমণ, যতি বা ভিক্ষু, স্তূপ বা মন্দির কাহারও আবশ্যকতা নাই। তক্ষশিলার নাগরিকগণ চিরদিনের জন্য তক্ষশিলা পরিত্যাগ করিয়াছে। ধনভূতির নগরবাসিগণ তাহার শত শত বর্ষ পূর্ব্বে তাহাদিগের নগর পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে। আমি দর্প করিয়া বলিয়াছিলাম যে, নগরবাসিগণ তথাগতের ধর্ম্মে যদি কখনও বীতশ্রদ্ধ হয় তাহা হইলে তথাগতের শরীরনিধান যেন তক্ষশিলার মহাবিহারের অধ্যক্ষকে প্রত্যর্পণ করা হয়। আমার দর্প চূর্ণ হইয়াছে। ধনভূতির নগর তক্ষশিলার পূর্ব্বে ধ্বংস হইয়াছে বটে, কিন্তু তথাগতের শরীরনিধান সমভাবে পূজিত হইয়া আসিয়াছে। স্তূপ যে দিন ধ্বংস হইল, সে দিন কিন্তু আর ভক্ষশিলায় তথাগতের শরীরনিধান গ্রহণ করিতে জনমাত্রও নাই। অশরীরী সিংহদত্ত ধূম, ধূলি ও সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলাইয়া গেলেন। তখন দূরে পর্ব্বতের সানুদেশে প্রজ্বলিত বনরাজি অমানিশার ঘোর-অন্ধকার নষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেছিল।

 পঞ্চশত সৈনিক লইয়া স্কন্দগুপ্ত কোন্ স্থানে গমন করিয়াছিলেন তাহা তোমাদিগের পিতৃপুরুষেরা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। কীটদষ্ট জীর্ণগ্রন্থ উদ্ধার কর, তাহার সন্ধান পাইবে। চাহিয়া দেখ, কিঞ্চিন্ন্যূন পঞ্চশত সৈনিক গঙ্গাযমুনাসঙ্গমে উপস্থিত হইয়াছে, ত্রস্ত নগরবাসিগণ অস্ত্রধারী পুরুষ দেখিয়া পলায়নের চেষ্টা করিতেছে। একজন সৈনিক উচ্চৈঃস্বরে কি বলিল। চাহিয়া দেখ, পলায়নপর নগরবাসিগণ ফিরিতেছে, দলে দলে নাগরিক ও নাগরিকাগণ নগ্নপদ শিরস্ত্রাণবিহীন, যুবকের সম্মুথে নতজানু হইতেছে। আগন্তুকগণের আগমন-সংবাদ বিদ্যুতের ন্যায় দ্রুত দগ্ধাবশিষ্ট নগরীর চতুর্দ্দিকে ধাবিত হইল। নগরের প্রধান দণ্ডনায়ক স্থাণুদত্ত আসিতেছেন। যে জনতা, পথশ্রমে ক্লান্ত, মলিনবেশধারী, বুভুক্ষু সৈনিকগণের গতিরোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল, তাহারা সসম্ভ্রমে পথ ছাড়িয়া দিল। কম্পিতপদে হস্তী ও অশ্ব পরিত্যাগ করিয়া পলিতকেশ স্থাণুদত্ত নগ্নশীর্ষ যুবকের দিকে অগ্রসর হইতেছেন, সৈনিকগণ প্রত্যেকে শিরস্ত্রাণ স্পর্শ করিয়া অভিবাদন করিতেছে। প্রতিষ্ঠানের দণ্ডনায়ক হইবার পূর্ব্বে স্থানুদত্ত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের বিশাল সাম্রাজ্যের মহাবলাধিকৃত ছিলেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পার্শ্বে তাঁহার অশ্ব প্রতি যুদ্ধে দৃষ্ট হইত। তিনি কুমারগুপ্ত ও গোবিন্দগুপ্তের শিক্ষাগুরু, স্কন্দগুপ্তের পিতামহকল্প। তাঁহার দক্ষিণপার্শ্বে জ্যেষ্ঠপুত্ত্র তনুদত্ত। তিনি স্পর্দ্ধা করিয়াছিলেন যে, রাজশক্তির সহায়তা পাইলে বৃদ্ধ পিতার অনুজ্ঞাক্রমে তিনি হূণবাহিণী মরুপারে রাখিয়া আসিবেন। সেই জন্য হূণরাজ তোরমাণের আদেশে তাঁহার দক্ষিণ হস্ত ছিন্ন হইয়াছে। তাঁহার পুত্ত্র হরিদত্ত প্রতিষ্ঠান নগরীর রক্ষাকল্পে আত্মোৎসর্গ করিয়াছেন। স্থাণুদত্তের বামপার্শ্বে তাহার কনিষ্ঠ পুত্ত্র প্রতিষ্ঠান নগরীর অধিষ্ঠানাধিকরণ বিচারপতি নাগদত্ত। অপুত্ত্রক নাগদত্ত বৃদ্ধ পিতার ক্লেশ, জ্যেষ্ঠের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা দেখিয়া আকুল, হরি দত্তের বিয়োগজনিত অশ্রু তখনও শুষ্ক হয় নাই। লৌহনির্ম্মিত ত্রিশূলে ভর দিয়া স্থাণুদত্ত অগ্রসর হইলেন। শিরস্ত্রাণবিহীন যুবককে দেখিয়া তাঁহার মুখমণ্ডল উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। তিনি “মহারাজ” মাত্র উচ্চারণ করিয়া নির্ব্বাক হইলেন। এই সম্বোধনে স্কন্দগুপ্ত চমকিত হইয়া উঠিলেন।

 ধীরে ধীরে তনুদত্ত সকল কথা বিবৃত করিলেন, কুমারগুপ্ত ইহধাম পরিত্যাগ করিয়াছেন, বালক পুরগুপ্ত নামে মাত্র সম্রাট; যুবতী বিধবা মজ্জনোন্মুখ তরণীর কর্ণধার, কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অলৌকিক শিক্ষার ফলে দামোদরশর্ম্মা ও গোবিন্দগুপ্ত নতশিরে আজ্ঞানুপালন করিতেছেন। বৃদ্ধ দামোদরশর্ম্মা দুশ্চরিত্রা মহিষীর বিলাস ব্যসনের ব্যয় বহন করিবার জন্য প্রজাপীড়ন করিতেছেন, অর্দ্ধভুক্ত অস্ত্রবিহীন সেনাদল লইয়া গোবিন্দগুপ্ত মগধরক্ষায় নিযুক্ত আছেন। নতজানু হইয়া তিন পিতাপুত্ত্র ভিখারীকে সম্রাট বলিয়া অভিবাদন করিলেন, ভগ্নস্বরে স্থাণুদত্ত কহিলেন, “সমুদ্রগুপ্তের নীতি অনুসারে সম্রাজ্যের যাহা অবশিষ্ঠ আছে আপনি তাহার অধীশ্বর। বংশ লোপ হইয়াছে, তথাপিও জীবনের শেষ মুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত সাম্রাজ্যের কার্য্য করিতে প্রস্তুত আছি। নাগদত্ত প্রতিষ্ঠান রক্ষা করিবে, একহস্ত পুত্ত্র ও অশীতিপর পিতা ছায়ার ন্যায় সম্রাটের অনুসরণ করিবে। মহারাজ, এই শীর্ণ দুর্ব্বল হস্তে মহাভার গরুড়ধ্বজ সিপ্রাতীর হইতে পশ্চিম সমুদ্রের তটে আনয়ন করিয়াছিলাম। সম্রাজ্যের কল্যাণের জন্য এখনও তাহা পুনরায় সিন্ধুতীরে স্থাপিত করিতে পারি।” নগ্নশীর্ষ, নগ্নপদ, ছিন্নবস্ত্র পরিহিত, ভগ্নবর্ম্মাবৃত দীন হীন ভিক্ষুক সম্রাট পিতামহের পার্শ্বচরকে আলিঙ্গন করিলেন। চাহিয়া দেখ, নবীনবলে বৃদ্ধ স্থানুদত্ত হস্তিপৃষ্ঠে গুরুভার গরুড়ধ্বজ ধারণ করিয়াছেন, সাম্রাজ্যের সেনাদল হূণযুদ্ধে পশ্চিমাভিমুখে চলিয়াছে। জাহ্নবীতীরে, ব্রহ্মাবর্ত্তে, তোরমাণ পরাজিত হইলেন; বুঝিলেন, গুপ্ত সাম্রাজ্য নুতন বলে বলীয়ান্ হইয়াছে। আর্য্যাবর্ত্তে এই তাঁহার প্রথম পরাজয়। দুর্ল্লঙ্ঘ্য গোপাদ্রিশিখরে হূণরাজ আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। রেবা হইতে জাহ্ণবীতীর পর্য্যন্ত আটবিক প্রদেশসমূহ হূণগণের গ্রাস হইতে মুক্ত হইয়াছে। জাহ্ণবীর উত্তর তীর হইতে হিমাদ্রির চরণপ্রান্ত পর্য্যন্ত সাম্রাজ্যের অধিকার বিস্তৃত হইয়াছে; উত্তর মরু হইতে নূতন সেনাদল না আসিলে তোরমাণের আর রক্ষা নাই, গোপাদ্রির পতন অবশ্যম্ভাবী। বিধাতার ইচ্ছা অন্যরূপ। দূত আসিয়া সংবাদ দিল, চরণাদ্রিশিখরে গোবিন্দগুপ্ত মৃত্যুশয্যায় শয়ান, স্কন্দগুপ্তের প্রত্যাবর্ত্তনের কথা পাটলিপুত্রে জ্ঞাপিত হইয়াছে, বৃদ্ধ খুল্লতাত ভ্রাতুষ্পুত্রের দর্শনবাঞ্ছা করিয়াছেন। সম্রাটের গোপাদ্রি অধিকার করা হইল না, নতশির ক্ষুব্ধ স্কন্দ্রগুপ্ত তোরমাণের নিকট সন্ধি প্রার্থনা করিলেন; সন্ধিসূত্রে স্কন্দ্রগুপ্ত গোপাদ্রিদুর্গ প্রাপ্ত হইলেন, কিন্তু তাহাই তাঁহার সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমা রহিল। শুভ্রকেশ স্থাণুদত্তকে গোপাদ্রি-রক্ষণে নিযুক্ত রাখিয়া স্কন্দগুপ্ত অশ্বারোহী সেনা সমভিব্যহারে দ্রুতবেগে চরণাদ্রি অভিমুখে আসিতেছেন। চাহিয়া দেখ, চরণাদ্রিশিখরে গিরিদুর্গের অভ্যন্তরে কক্ষমধ্যে মুমূর্ষু গোবিন্দগুপ্ত সম্রাটকে শেষ উপদেশ প্রদান করিতেছেন। শ্রবণ কর, কক্ষমধ্যে গুরু গম্ভীর স্বর এখনও ধ্বনিত হইতেছে “স্কন্দ, সমুদ্রগুপ্তের গরুড়ধ্বজের সম্মান রক্ষা করিও, দেখিও তোরমাণের বংশজাত কেহ যেন কখনও পাটলিপুত্রের সিংহাসনে না আরোহণ করে। দেবতা ও ব্রাহ্মণ, রমণী ও শিশুকে সর্ব্বদা রক্ষা করিও। আর দেখিও, স্কন্দ, যদি পার, যাহার জন্য সমুদ্রগুপ্তের বিশাল সাম্রাজ্য ধ্বংস হইল তাহার যথোচিত শাস্তিবিধান করিও। বিমাতা বলিয়া ভীত হইও না। সে তোমার পিতার পরিণীতা পত্নী নহে। চাহিয়া দেখ, মগধ, তীরভূক্তি, কাশী ও কোশলের প্রজাসমূহ রাজস্ব দিতে অস্বীকার করিয়াছে। তাহারা বলে, রাজা শস্যরক্ষা করিলে ষষ্ঠভাগ পাইবেন, নতুবা নহে। সমুদ্রগুপ্তের বিখ্যাত নীতি অনুসারে গুপ্তবংশের জ্যেষ্ঠপুত্ত্র সিংহাসনের অধিকারী; সাম্রাজ্য স্কন্দগুপ্তের পুরগুপ্তের নহে। চাহিয়া দেখ, উদ্দণ্ডপুরদুর্গে মহাদেবী ও পুরগুপ্ত আবদ্ধ রহিয়াছেন। বিশ্বাসঘাতক তোরমাণ পুনরায় গোপাদ্রি আক্রমণ করিয়াছে, দূতপ্রেরণ না করিয়া সন্ধিভঙ্গ করিয়াছে, পুনরায় হূণযুদ্ধ আরদ্ধ হইয়াছে। দ্বিতীয় হূণযুদ্ধে মৈত্রকসেনাপতি ভট্টারক কেন রাজপদে বৃত হইয়াছিলেন, স্কন্দগুপ্ত কেন স্বহস্তে সমুদ্রগুপ্তের মুকুট লইয়া ভট্টারকের শিরে স্থাপিত করিয়াছিলেন তাহার ইতিহাস এখনও লুপ্ত হয় নাই। স্তূপধ্বংসের সহিত আমাদিগের মনুষ্যদর্শনের আশা দূর হইয়াছে, বহির্জগতের সংবাদ পাইবার আশাও দূর হইয়াছে।