পাষাণের কথা/১০
[ ১০ ]
স্কন্দগুপ্ত যখন সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের উপর সিংহাসন স্থাপন করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, তখন ধীরে ধীরে আমাদিগের ধ্বংসাবশেষের উপর নবীন তৃণরাজি অধিকার বিস্তার করিতেছিল। বর্ষার প্রারম্ভ হইতে নব দুর্ব্বাদল আমাদিগের ধ্বংসাবশেষের উপরিভাগ আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল, স্থানে স্থানে অশ্বত্থ, বট প্রভৃতি বৃক্ষ জন্মিতেছে, দেখিতে পাইলাম; কারণ, সুবৃহৎ স্তূপ ধ্বস্ত হইলেও আমি তখনও উচ্চশীর্ষ ছিলাম। বর্ষা অতীত হইলে দেখিলাম, স্তূপ ও বেষ্টনী নবদূর্ব্বাদলে আচ্ছাদিত হইয়াছে; বিশাল স্তূপের অস্তিত্বের সামান্য চিহ্ণমাত্র বর্ত্তমান, স্থানে স্থানে কেবল মাংসবিহীন কঙ্কালের ন্যায় বেষ্টনীর স্তম্ভগুলি দণ্ডায়মান। যত দূর দৃষ্ট হয়, তত দূর শ্যামল তৃণক্ষেত্র ব্যতীত আর কিছুই নয়নগোচর হইতেছিল না; বোধ হইল, আটবিক প্রদেশ পুনরায় জনশূন্য হইয়াছে। দূরে উচ্চ মৃৎপিণ্ড লক্ষিত হইতেছিল; অনুমানে বুঝিলাম, তাহাই ধনভূতির নগরের ধ্বংসাবশেষ। সম্মুখে মৃৎপিণ্ডের উপর দুইটি ক্ষুদ্রতর মৃৎপিণ্ড প্রাচীন নগর তোরণের অবস্থানের পরিচয় দিতেছিল। হেমন্তের মধ্যভাগে একদিন প্রভাতে আমাদিগের উত্তরে মনুষ্যপদশব্দ শ্রুত হইল, যেন কে ধীরে ধীরে স্তূপের দিকে অগ্রসর হইতেছে। স্তূপের দিকেই বলিলাম। তুমি হয়ত বলিবে, স্তূপের অস্তিত্বলোপ হইয়াছে, কিন্তু সে কথা স্বীকার করিতে আমি অত্যন্ত বেদনা অনুভব করি। আমি বলিব, স্তূপ এখনও বর্ত্তমান আছে—অশোকের ন্যায় বা কনিষ্কের ন্যায় সদ্ধর্ম্মানুরাগী কোন সম্রাট আসিয়া ধ্বংসাবশেষের মধ্য হইতে প্রাচীন স্তূপের সংস্কার করিবেন। সহস্র বৎসর আমি সেই ভরসায় দণ্ডায়মান ছিলাম। আমি দেখিতাম, ধ্বংসাবশেষের মধ্য হইতে নূতন স্তূপ উত্থিত হইয়াছে, পুরাতন সংস্কৃত হইয়াছে, জীর্ণ পাযাণের পরিবর্ত্তে নূতন পাষাণ আনীত হইয়াছে, পত্রপুষ্পমাল্যচন্দনে স্তূপ আবার সুশোভিত হইয়াছে। সূর্য্যাস্ত হইতে সূর্য্যোদয় পর্য্যন্ত দেখিতাম, সায়ংকালীন স্নান ও প্রসাধন সম্পন্ন করিয়া প্রজ্বলিত মধুজবর্ত্তিকা হস্তে নাগরিক ও নাগরিকাগণ তোরণপথে বেষ্টনীর মধ্যে প্রবেশ করিতেছেন, দলে দলে ভিক্ষুগণ স্তূপ প্রদক্ষিণ করিয়া তথাগতের পূজা করিতেছেন, সশব্দে গর্ভগৃহের পাষাণময় দ্বার উদ্ঘাটিত হইতেছে, শিলানির্ম্মিত আধারে রক্ষিত তথাগতের শরীর দীপালোকে অর্চ্চিত হইতেছে, গন্ধে ও পুষ্পে গর্ভগৃহের পথ আচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে। ঊষাকালে পক্ষিগণের শব্দে সে সমস্ত চিন্তা দূর হইয়া যাইত, অল্পক্ষণ পরেই নিষ্ঠুর আলোক আসিয়া আমাদিগের বর্ত্তমান অবস্থার কথা স্মরণ করাইয়া দিত; দেখিতাম, স্তূপের পরিবর্ত্তে শিশিরসিক্ত তৃণদল বন্ধুর মৃৎপিণ্ডকে আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছে। কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে মাংসবিহীন নরদেহপঞ্জরের দ্যায় কয়েকখণ্ড পাষাণ মস্তক উত্থিত করিয়া আছে।
মনে হইল, দূরে কে যেন বহুকষ্টে পাদচারণা করিতেছে, তাহার চরণদ্বয় আর যেন তাহাকে বহন করিতে অক্ষম;—দেহভারক্লিষ্ট হইয়া সে ব্যক্তি পুনঃ পুনঃ বিশ্রাম করিতেছে, ও পরক্ষণেই আবার যেন কোন আশায় অনুপ্রাণিত হইয়া পথ অতিক্রম করিবার চেষ্টা করিতেছে। সে নিকটে আসিলে দেখিলাম জীর্ণবাস পরিহিত দশনহীন, শুক্ল কেশ লোলচর্ম্ম জনৈক মনুষ্য স্তূপাভিমুখে অগ্রসর হইতেছে। স্তূপের মৃৎপিণ্ডের সন্নিধানে আসিয়া সে সর্ব্বপ্রথমেই আমাকে দেখিতে পাইল; কারণ, আমার মস্তক সর্ব্বাপেক্ষা উচ্চ ছিল। আমার নিকটে আসিয়া বৃদ্ধ যেন যন্ত্রণা হইতে মুক্তি পাইল, সে পাষাণে পৃষ্ঠ সংলগ্ন করিয়া বহুক্ষণ বিশ্রাম করিল। তাহার পর ধীরে ধীরে স্তূপ ও বেষ্টনী পরিক্রমণের পথ প্রভৃতি পরীক্ষা করিয়া দেখিল ও আমার নিকট প্রত্যাগমন করিয়া উপবেশন করিল। সমস্ত দিন বৃদ্ধ ধ্বংসাবশেষ পর্য্যবেক্ষণ করিল। কোন স্থানে স্থানচ্যুত স্তম্ভ অর্দ্ধপ্রোথিত অবস্থায় দৃষ্ট হইতেছে, কোন স্থানে ভগ্ন সূচীর আশ্রয়ে মণ্ডূককুল আশ্রয়লাভ করিয়াছে; ভগ্নশীর্ষ তোরণস্তম্ভের শীর্ষদেশে বিহঙ্গম নীড় রচনা করিয়াছে; যে স্তম্ভগুলি দণ্ডায়মান আছে তাহাদিগের বিকল অঙ্গ অগ্নির প্রচণ্ড উত্তাপ ও দাহিকাশক্তির পরিচয় জ্ঞাপন করিতেছে, সূচীতে ও স্তম্ভে খোদিত চিত্রগুলি হূণের অস্ত্র ও অগ্নির আক্রমণে বীভৎস আকার ধারণ করিয়াছে; আলেখ্যগুলিতে ভগ্নশির বা ছিন্ননাসা মনুষ্যমূর্ত্তি নিচয় স্তূপের ও বেষ্টনীর বর্ত্তমান অবস্থা জ্ঞাপন করিতেছে। অর্দ্ধভগ্ন কোন স্তম্ভদ্বয়ের শীর্ষদেশে বৃক্ষশাখা স্থাপিত করিয়া, ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত পাষাণখণ্ডের সাহায্যে ও বন হইতে কুশ সংগ্রহ করিয়া সন্ধ্যার প্রাক্কালে বৃদ্ধ এক অপূর্ব্ব কুটীর রচনা করিল এবং সূর্য্যালোক বিলুপ্ত হইবার পূর্ব্বে তন্মধ্যে শুষ্ক দর্ভের শয্যা রচনা করিয়া বিশ্রামলাভ করিল। তদবধি বৃদ্ধ আমাদিগের নিত্যসহচর হইল। সে প্রভাতে উঠিয়া প্রাচীন নগরের প্রান্তস্থিত ক্ষুদ্র নদীতে স্নান করিয়া আসিত ও বন্য পুষ্প সংগ্রহ করিয়া মৃৎপিণ্ডের অর্চ্চনা করিত, তাহার পর দিবা দ্বিপ্রহর অবধি আমার ছায়ায় বসিয়া আপন মনে কি বলিত, প্রতিদিন “বিমলাকীর্ত্তি ভট্টারিকানিষ্পাদিতা” এই কথা বলিয়া মৃৎপণ্ডিকে নমস্কার করিত, এতদ্ব্যতীত তাহার আর কোন কথাই বুঝিতাম না। অপরাহ্ণে বৃদ্ধ আহার্য্য সংগ্রহের চেষ্টায় বন মধ্যে প্রবেশ করিত, বনজাত ফলেই তাহার আহার নিষ্পন্ন হইত, কিন্তু কখনও কখনও সে পত্রনির্ম্মিত আধারে দুগ্ধবৎ শ্বেতবর্ণ পদার্থ সংগ্রহ করিয়া আনিত। বোধ হয়, দুগ্ধ সংগ্রহের জন্য সে বন পথ অতিক্রম করিয়া দূরবর্ত্তী গ্রামমধ্যে প্রবেশ করিত। এইরূপে শীতের পর গ্রীষ্ম, গ্রীষ্মের পর বর্ষা অতীত হইয়া গেলে, ক্রমে ক্ষুদ্র বট ও পিপ্পল বৃক্ষ গুলি নাতিবৃহৎ ছায়াপ্রদ তরু হইয়া উঠিল। বৃদ্ধ আমাদিগের সহিত শান্তিতে কালাতিপাত করিতে লাগিল।
তোরমাণের পুত্ত্র মিহিরকুলের অধীনে হূণগণ দ্বিতীয়বার যুদ্ধযাত্রায় নির্গত হইতেছিল। গঙ্গাপ্রবাহের ন্যায় অবিরাম গতিতে হূণগণ জার্য্যাবর্ত্তে প্রবেশ করিতেছিল, তোরমাণের মৃত্যুর পর হইতে হূণ জাউলগুলি উপযুক্ত নেতার অভাবে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িতেছিল। মিহিরকুলের চেষ্টায় তাহার অধিকাংশ পুনরায় একত্রিত হইল। হূণবাহিনী মগধাভিমুখে অগ্রসর হইল। দ্বিতীয় বাহিনী মিহিরকুলের কনিষ্ঠ খিঙ্গিলের অধীনে জনহীন মরু অতিক্রম করিয়া সৌরাষ্ট্রাভিমুখে ধাবিত হইল; বাত্যাহত কদলীবৃক্ষের ন্যায় নগরশীর্ষের গরুড়ধ্বজ ধরাশায়ী হইল। কালিন্দী অতিক্রম করিয়া মিহিরকুল ব্রক্ষাবর্ত্তে শিবির স্থাপন করিলেন। বৃদ্ধ সম্রাট দ্রুতবেগে অগ্রসর হইয়াও বারাণসী অতিক্রম করিতে পারেন নাই। ব্রহ্মাবর্ত্তে তনুদত্ত ও প্রতিষ্ঠানে নাগদত্ত সীমান্তরক্ষায় ব্যাপৃত ছিলেন। সিংহবিক্রম স্থাণুদত্তের পুত্ত্র ভাগীরথীর তীর্থ রক্ষা করিতেছিলেন; জলধিতুল্য হূণ সৈন্যের পরপারে পদার্পণ করিবার সাহস হইতেছিল না। আর প্রতিষ্ঠানে নাগদত্ত নৌবাটক লইয়া বেণীত্রয় রক্ষা করিতেছিলেন। সম্রাট্ চরণাদ্রিদুর্গে সৌরাষ্ট্রের পতনসংবাদ প্রাপ্ত হইলেন; আরও শুনিলেন, আনর্ত্তের সহিত মালবও সাম্রাজ্যের দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে। শুনিয়া বৃদ্ধের শির নত হইল। চরণাদ্রিশিখরে দণ্ডায়মান হইয়া জাহ্নবীকে সাক্ষী করিয়া, তরবারি স্পর্শ করিয়া, বৃদ্ধ শপথ করিলেন, মালব ও আনর্ত্ত, মৎস্য ও মরু পুনরধিকার না করিয়া পাটলিপুত্রে প্রত্যাগমন করিবেন না। শপথশ্রবণে বিজ্ঞ সেনানীগণেরও হৃদয় কম্পিত হইল। স্কন্দগুপ্ত আর একবার প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন। চরণাদ্রিদুর্গে, খুল্লতাত গোবিন্দগুপ্তের মৃতদেহ স্পর্শ করিয়া যুবক সম্রাট্ শপথ করিয়াছিলেন যে, তাঁহার বংশে কেহ কখনও মগধের সিংহাসন রক্ষার জন্য বিবাদ করিবে না। শান্তনুপুত্রের ন্যায় ভীষণ প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য সম্রাট দারপরিগ্রহ করেন নাই। উদ্দণ্ডপুরদুর্গে অবরুদ্ধ হৃতসিংহাসন পুরগুপ্ত মগধসিংহাসনের ভাবী উত্তরাধিকারী। চরণাদ্রি হইতে সৌরাষ্ট্র বহুদিনের পথ, মগধে যাহারা স্ত্রীপুত্ত্র রাখিয়া আসিয়াছিল তাহারা প্রত্যাবর্ত্তনের আশা পরিত্যাগ করিল। সম্রাট্ চরণাদ্রি হইতে প্রতিষ্ঠানাভিমুখে অগ্রসর হইলেন।
মিহিরকুলের আহ্বানে প্রতিদিন শত শত হূণ আর্য্যাবর্ত্তে প্রবেশ করিতেছিল। তাহাদিগের আক্রমণে গান্ধারে শত শত বর্ষব্যাপী কুষাণাধিকার লুপ্ত হইল, কণিষ্কের সাম্রাজ্যের শেষ চিহ্ণও আর্য্যাবর্ত্ত হইতে লুপ্ত হইয়া গেল। গঙ্গাতীরে প্রতিদিন হূণগণের বলবৃদ্ধি পাইতে লাগিল, সৈন্য সংখ্যার উপর নির্ভর করিয়া মিহিরকুল পুনরায় নদী পার হইবার আদেশ দিলেন; বহুচেষ্টা সত্ত্বেও তনুদত্ত সে ভীষণ আক্রমণ রোধ করিতে পারিলেন না, ধীরে ধীরে পশ্চাৎপদ হইয়া ত্রিবেণীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সম্রাট প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হইয়া ব্রহ্মাবর্ত্তের দ্বিতীয় যুদ্ধে তনুদত্তের পরাভব বার্ত্তা জ্ঞাত হইলেন। প্রতিষ্ঠানের ভীষণ দুর্গ তুমি বোধ হয় দেখিয়াছ, সেরূপ সুদৃঢ় দুর্গ তৎকালে মধ্যদেশে আর ছিল না বলিলেও অত্যুক্তি হয় না; গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থলে দুর্গটি অবস্থিত ছিল ও উহা অধিকার না করিয়া পূর্ব্বে বারাণসী বা পশ্চিমে অন্তর্ব্বেদী অধিকার করা অসম্ভব ছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্য অতীত হইবার শত শত বর্ষ পরেও প্রতিষ্ঠান আর্য্যাবর্ত্তে রাজশক্তির একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল; বহু শতাব্দী পরে প্রতীহার ও রাষ্ট্রকূট সৈনিকগণ ছায়ায় বসিয়া প্রতিষ্ঠানের ভীষণ দুর্গের বর্ণনা করিত। ধীরে ধীরে স্থাণুদত্তের পুত্ত্র মিহিরকুলকে সম্মুখে রাখিয়া বেণীতীরে উপস্থিত হইলেন। তখন তনুদত্ত ও নাগদত্ত দুর্গরক্ষার চেষ্টায় ব্যাপৃত হইলেন; দেখিতে দেখিতে পবিত্র প্রতিষ্ঠানপুর অস্পৃশ্য হূণগণ কর্ত্তৃক অধিকৃত হইল। বৃদ্ধ সম্রাট দুর্গমধ্যে অবরুদ্ধ থাকিয়া সাম্রাজ্যের কার্য্যনির্ব্বাহ করিতেছিলেন, সৌরাষ্ট্রে পর্ণদত্ত তখনও গুপ্তাধিকার পুনঃপ্রবর্ত্তন করিবার চেষ্টায় ব্যাপৃত ছিলেন। প্রতিষ্ঠানদুর্গ অবরোধকালেও মিহিরকুলের বলবৃদ্ধি হইতেছিল; সুতরাং স্বীয় বলবৃদ্ধির জন্য স্কন্দগুপ্তকেও বিশেষ চেষ্টা করিতে হইয়াছিল। অবসর পাইলেই সম্রাট দুর্গ হইতে বহির্গত হইয়া নিকটবর্ত্তী নগরগুলি হইতে সৈন্যদল পুষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেন; এইরূপে প্রতিষ্ঠান অবরোধে হূণরাজের বর্ষত্রয় অতিবাহিত হইল। উভয়পক্ষেই সৈন্য সংগ্রহ হওয়ায় কোন পক্ষেরই আশু জয়লাভের আশা রহিল না। তরুণবয়স্ক মিহিরকুল বিলম্বে বিচলিত হইলেন ও সে সংবাদ স্কন্দগুপ্তের কর্ণগোচর হইল। প্রাচীন গুপ্ত সাম্রাজ্যের তখন অন্তিম দশা, স্কন্দগুপ্তের বহু চেষ্টা সত্বেও প্রতিষ্ঠানের উদ্ধার হইল না, অর্দ্ধসৈন্য অবরুদ্ধ দুর্গের পরিখাপার্শ্বে রাখিয়া মিহিরকুল অবশিষ্ট সৈন্য লইয়া লুণ্ঠনে ব্যাপৃত হইতেন ও বর্ষাসমাগমে পুনরায় পরিখাপার্শ্বে উপস্থিত হইতেন। এইরূপে বারাণসী হইতে কান্যকুব্জ পর্য্যন্ত গঙ্গার উত্তর তীরস্থিত ভূখণ্ড জনমানব শূন্য হইল। ক্রমে প্রতিষ্ঠান দুর্গে আহার্য্যের অভাব অনুভূত হইল। সম্রাট বুঝিলেন, আর অধিকদিন দুর্গরক্ষা সম্ভব হইবে না।
সেই সময় হইতে সম্রাট প্রতিদিন যথাসাধ্য নাগরিকগণকে নগর হইতে দূরে প্রেরণ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তিনি সুস্থ, সবলকায়, অস্ত্রধারণক্ষম ব্যক্তিগণকে দুর্গমধ্যে আনয়ন করিতে লাগিলেন। ক্রমশঃ নগর জনশূন্য হইল ও গ্রীষ্মের প্রারম্ভে দুর্গবাসিগণ কর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া শত্রুসৈন্যের অধিকারে আসিল। লোকে বলিত, প্রতিষ্ঠান অবরোধের শেষবর্ষের ন্যায় গ্রীষ্মাধিক্য বহুকালযাবত আর্য্যাবর্ত্তে অনুভূত হয় নাই। বহু কষ্টে, বহু অর্থব্যয়ে বুভুক্ষিত পাষাণরাশির মধ্যে রচিত প্রতিষ্ঠানদুর্গের কূপগুলিতে অধিক জল থাকিত না ও গ্রীষ্মকাল অতীত হইবার পূর্ব্বেই সেগুলি প্রায় শুষ্ক হইয়া যাইত। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বহু অর্থব্যয়ে গঙ্গাজল আনয়ন করিবার জন্য যে পয়ঃপ্রণালী খনন করিয়াছিলেন, প্রতিষ্ঠানযুদ্ধের প্রারম্ভে তাহা হূণগণ কর্ত্তৃক রুদ্ধ হইয়াছিল। পূর্ব্বে গ্রীষ্মকালে দুর্গমধ্যে নদীর জলই ব্যবহৃত হইত, কিন্তু অবরোধের প্রারম্ভে পয়ঃপ্রণালী বদ্ধ হওয়ায় উষ্ট্রবাহনে যমুনা-সঙ্গম হইতে জল আসিত ও যথাসম্ভব কূপোদক ব্যবহৃত হইত। নগর হূণসৈন্য কর্ত্তৃক অধিকৃত হইলে জল আনয়নের পথ রুদ্ধ হইল। তখন কূপোদকই অবরুদ্ধ সৈনিকমণ্ডলীর একমাত্র ভরসাস্থল হইল। নগর পরিত্যাগকালে সম্রাট অনুমান করিয়াছিলেন যে, দুর্গ নগর অপেক্ষাও সামান্য লোকবলে রক্ষিত হইতে পারে; সুতরাং, নগর পরিত্যাগ করিয়া দুর্গরক্ষার চেষ্টা করিলে আহার্য্যদ্রব্য অল্পলোকে অধিক দিন ব্যবহার করিতে পারিবে। তিনি জানিতেন যে, নগর পরিত্যাগ করিলে দুর্গমধ্যে জলের অভাব হইবে; কিন্তু তিনি অনুমান করিয়াছিলেন যে, অল্পসংখ্যক সৈন্য কূপোদক পানে জীবনরক্ষা করিয়া বর্ষাগম পর্য্যন্ত জীবিত থাকিতে পারিবে এবং তাঁহার ভরসা ছিল যে, ততদিন কোনও না কোন প্রদেশ হইতে সাহায্য আসিবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পতন সময় সে বৎসর যে গ্রীষ্মাধিক্য হেতু বৈশাখের প্রারম্ভে দুর্গমধ্যে জলাভাব হইবে তাহা তিনি কখনও অনুমান করেন নাই। বৈশাখী পূর্ণিমার দিন প্রভাতে সম্রাট সংবাদ পাইলেন যে, কূপগুলিতে দুই দিনের অধিক সময়ের উপযোগী পানীয় জল নাই। তখন তিনি দুর্গ প্রাকারে আরোহণ করিয়া যমুনা-সঙ্গমের শুষ্ক বালুকারাশির উপর শক্র শিবির পর্য্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। সেই দিন দ্বিপ্রহরে মন্ত্রণাগৃহে সাম্রাজ্যের প্রধান অমাত্য ও সেনাপতিগণ স্থির করিলেন যে, তৃতীয় দিবসের পর দুর্গরক্ষা সম্ভবপর নহে। অর্দ্ধাহারে বা অনশনে সৈনিকগণ যুদ্ধ করিতে পারে, কিন্তু জলাভাব হইলে অবরুদ্ধ সেনাদলকে শান্ত করা কঠিন। মন্ত্রণায় স্থির হইল, রাত্রিকালে সম্রাট স্বয়ং কালিন্দী হইতে জল সংগ্রহের চেষ্টা করিবেন; কিন্তু যে দিন জল সংগৃহীত না হইবে তাহার পরদিন দুর্গ পরিত্যাগ করিতে হইবে। দুর্গ পরিত্যাগের কথা শুনিয়া বৃদ্ধ সম্রাট ঈষৎ হাস্য করিলেন। যাহারা প্রথম হূণযুদ্ধে স্কন্দগুপ্তকে দেখিয়াছিল তাহারা সে হাস্যের অর্থবোধ করিয়া শিহরিল। রাত্রিকালে চন্দ্রালোকে যমুনাসৈকত উভয় পক্ষীয় সৈন্যের রক্তে রঞ্জিত হইয়াছিল। জলবাহী উষ্ট্রসমূহ কালিন্দীতীর হইতে দুর্গমধ্যে প্রত্যাগমনকালে হূণগণ কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইল, বহু চেষ্টাসত্ত্বেও সম্রাটের সৈনিকগণ উষ্ট্রগুলির উদ্ধার করিতে পারিল না। সম্রাট স্বয়ং যুদ্ধ করিয়াও কিছু করিতে পারিলেন না। হূণগণ তখন দুর্গ ও কালিন্দীতীরের মধ্যভাগে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া যুদ্ধ করিতেছে। সম্রাট কিছুতেই শত্রুদল ভেদ করিতে পারিলেন না। বহুশ্রমে ও অনাহারে ক্লিষ্ট সৈনিকগণ বৃথাযুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল। অবশেষে হতাশ হইয়া বৃদ্ধ সম্রাট দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার পশ্চাতে স্বয়ং মিহিরকুল দুর্গপ্রবেশের চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু রামগুপ্ত কর্ত্তৃক নির্ম্মিত লৌহদ্বার অনায়াসে তাঁহার গতিরোধ করিল। সম্রাটের সেনাদল নির্ব্বিঘ্নে দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিল। বৈশাখী কৃষ্ণ প্রতিপদের প্রত্যূষে বৃদ্ধ সম্রাট দুর্গপ্রাঙ্গণে অবশিষ্ট সেনা সমবেত করিয়া তাহাদিগকে কহিলেন যে, জলাভাবে দুর্গরক্ষা অসম্ভব, কিন্তু তিনিও প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করিয়া পশ্চাৎপদ হইতে অসন্মত, প্রতিষ্ঠান হস্তচ্যুত হইলে রেবা হইতে জাহ্ণবী পর্য্যন্ত ও জাহ্নবী হইতে হিমবান পর্য্যন্ত সমস্ত ভূখণ্ড হূণগণের করতলগত হইবে, পুণ্যক্ষেত্র বারাণসী লুণ্ঠিত হইবে ও পাটলিপুত্র ব্যতীত সংরক্ষণের দ্বিতীয় স্থান থাকিবে না। বৃদ্ধ কহিলেন, পঞ্চবিংশ বর্ষ পূর্ব্বে আটবিক প্রদেশে বনদুর্গ অবরোধকারী হূণমণ্ডল ভেদ করিয়া পঞ্চশত সৈনিক প্রতিষ্ঠান পর্য্যন্ত আসিতে পারিয়াছিল; সুতরাং পঞ্চ সহস্রের পক্ষে শক্রব্যুহ ভেদ করিয়া চরণাদ্রি দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করা আশ্চর্য্য ব্যাপার নহে। কিন্তু যদি প্রত্যাগমন করিতে হয় তাহা হইলে কালিন্দীর মলিন জলপান করিয়া যাইতে হইবে, নতুবা আর্য্যাবর্ত্তের বিশাল বক্ষে তাহাদিগের আর স্থান হইবে না। সেনাপতি ও সৈন্যগণ নীরবে এ কথা শ্রবণ করিলেন। অবশিষ্ট কূপোদক স্নানে ও পানে ব্যয়িত হইল। সন্ধ্যার প্রাক্কালে দুর্গের সিংহদ্বার উন্মুক্ত হইল, বিস্ময়স্তিমিত নেত্রে হূণগণ দেখিল, উৎসব সজ্জায় সজ্জিত হইয়া মুষ্টিমেয় সৈন্য কালিন্দী-সৈকতে আত্মবিসর্জ্জন করিতে চলিয়াছে। ধীরে ধীরে খুম্মান ও মিহিরকুলের অধীনে লক্ষ লক্ষ হূণসৈন্য পঞ্চসহস্রের সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য অগ্রসর হইল। হস্তিপৃষ্ঠ হইতে তোরমাণ দেখিলেন, শুভ্রকেশ শুভ্রবসনপরিহিত বৃদ্ধ সম্রাট স্বহস্তে হৈম গরুড়ধ্বজ ধারণ করিয়া শ্বেতাশ্বারোহণে তির্য্যকব্যুহের পুরোদেশে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতেছেন। হূণসৈন্যের অধিকাংশ দুর্গ মধ্যে প্রবেশ করিয়া লুণ্ঠনে মনোযোগ দিয়াছে, কেহ কেহ শত্রুসৈন্যের সহিত যুদ্ধ করিতেছে। স্কন্দগুপ্তের রণকৌশলের কথা তিনি বহুদিন হইতে শ্রবণ করিয়া আসিতেছিলেন। শত শত হূণ ব্রহ্মাবর্ত্তের প্রথম যুদ্ধের বিবরণ দেশে দেশে প্রচারিত করিয়াছিল। তরুণ হূণরাজ ভাবিলেন, ভয়ে বৃদ্ধের বুদ্ধিভ্রংশ হইয়াছে। সম্মুথে যমুনা, উত্তর পার্শ্বে অপরিমিত শক্রসৈন্য, পশ্চাতে শত্রু হস্তগত ভীষণ দুর্গ, এইরূপ যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পৃথিবীতে কয়জন সৈনিক প্রত্যাগমনের আশা করিয়া থাকে? ধীরে ধীরে হূণসৈন্য মুষ্টিমেয় বিপক্ষদলকে পেষণ করিবার চেষ্টা করিল; কিন্তু দেখিল, সংখ্যায় হীন হইলেও সে তির্য্যক্ব্যুহ যেন বজ্র নির্ম্মিত। ব্যুহের পূর্ব্বকোণে স্কন্দগুপ্ত স্বয়ং সৈন্য পরিচালনা করিতেছেন; ক্রমে ক্রমে ব্যুহের পূর্ব্ব কোণ কালিন্দীর দিকে অগ্রসর হইতেছে। মিহিরকুল ভাবিলেন, শত্রু স্বেচ্ছায় কালিনীর জলে আত্মবিসর্জ্জন করিতে যাইতেছে। তখন তিনি হূণসৈন্যের গতি পরিবর্ত্তন করিলেন। নদীতীর পরিত্যাগ করিয়া হূণগণ শত্রুব্যুহের উভয় পার্শ্বে ও দুর্গের সম্মুখে আক্রমণ করিল, ব্যুহ দ্রুতবেগে নদীর জল স্পর্শ করিতে ধাবিত হইল। সর্ব্বাগ্রে রক্তাক্ত অশ্বে রক্তার্দ্রপরিচ্ছদ বৃদ্ধ স্কন্ধগুপ্ত। যমুনাগর্ভে দণ্ডায়মান হইয়া অল্প সংখ্যক সৈন্য হূণগণকে বাধা প্রদান করিতে লাগিল, কিন্তু দ্বিসহস্রের অধিক সৈন্য অবলীলাক্রমে সন্তরণে নদী পার হইয়া গেল। মিহিরকুল ভাবেন নাই যে, অবশিষ্ট শত্রুসৈন্য তাঁহার গ্রাস অতিক্রম করিবে। রোষে উন্মত্ত হইয়া তিনি স্বয়ং অবশিষ্ট সৈন্যগণের প্রতি সৈন্যচালনা করিতে লাগিলেন। তখন মরণোন্মুখ অশ্ব পরিত্যাগ করিয়া পরশু হস্তে স্কন্দগুপ্ত যমুনার আর্দ্রসৈকতে হূণরাজের সম্মুখীন হইলেন। দুর্গপ্রাকার হইতে ত্রিহস্ত পরিমিতি শর আসিয়া বৃদ্ধের দক্ষিণ চক্ষু ভেদ করিয়া মস্তিষ্ক স্পর্শ করিল। তাঁহার দক্ষিণ হস্তে উত্তোলিত দীর্ঘপরশু সেই সময়ে হূণরাজের অশ্বের মস্তক ছেদন করিল। অশ্বহীন মিহিরকুল ও সম্রাট স্কন্দগুপ্তের প্রাণহীন দেহ একত্র বালুকাময় ভূমিতে লুণ্ঠিত হইল। সম্রাটের অবশিষ্ট সৈনিকগণ ভট্টারকের দেহ রক্ষার্থ একত্রিত হইল, তখন অবশিষ্ট সেনাদল পরপারে উপস্থিত হইয়াছে। হূণগণ প্রচণ্ড বিক্রমে মিহিরকুলকে উদ্ধার করিবার জন্য শত্রুসেনা আক্রমণ করিল। দেখিতে দেখিতে প্রভুভক্ত সৈন্যদল সম্রাটের দেহ আচ্ছন্ন করিয়া ভূপতিত হইল, দূরে দাঁড়াইয়া স্তব্ধ নেত্রে তোরমাণের পুত্ত্র প্রতিষ্ঠানের শেষ যুদ্ধ অবলোকন করিলেন। সম্রাটের একজন মাত্র সৈনিক অবশেষে মৃত সম্রাটের হস্ত হইতে সুবর্ণনির্ম্মিত গরুড়ধ্বজ গ্রহণ করিয়া জলে ঝম্প প্রদান করিল। হস্তোত্তোলন করিয়া হূণরাজ তাহার প্রতি শর নিক্ষেপ করিতে নিষেধ করিলেন। আর্য্যাবর্ত্তের ইতিহাসে তাহার নাম সুপরিচিত। সেই ব্যক্তি আর্য্যাবর্ত্তের ত্রাণকর্ত্তা—যশোধর্ম্মদেব।
বৃদ্ধ প্রভাতে বনমধ্যে পুষ্পচয়ন করিতে গিয়াছিলেন; দেখিলেন, ক্ষতবিক্ষত দেহে মলিনবেশপরিহিত দীর্ঘাকার এক যোদ্ধা বৃক্ষতলে অচেতন অবস্থায় পতিত। তাহার পার্শ্বে বৃহৎ লৌহনির্ম্মিত শূল, কিন্তু তাহার দক্ষিণহস্তে গরুড়শীর্ষ সুবর্ণদণ্ড দৃঢ়মুষ্টিনিবদ্ধ রহিয়াছে, চেতনা অপহৃত<!— দাঁড়ি বসাবেন না। —> হইলেও যোদ্ধৃবর দণ্ড পরিত্যাগ করেন নাই। জলসেচনে বৃদ্ধ সৈনিকের মূর্চ্ছা অপনোদনের চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোন ফলোদয় হইল না। তখন ধীরে ধীরে বিচক্ষণ চিকিৎসকের ন্যায় বৃদ্ধ অস্ত্রক্ষতগুলি ধৌত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। পরীক্ষা কালে বৃদ্ধ দেখিলেন যে, যোদ্ধার বক্ষোদেশে গভীর ক্ষত হইতে তখনও সামান্য শোণিতস্রাব হইতেছে। জলসেচনে ও রক্তনির্গম স্থগিত হইল না। বৃদ্ধ ঔষধ সংগ্রহার্থ নিবিড় বন মধ্যে প্রবেশ করিলেন ও অল্পক্ষণ পরেই চর্ব্বিত পত্রের সাহায্যে রক্তস্রাব স্থগিত করিলেন। বৃদ্ধের পুষ্পচয়ন স্তগিত রহিল; বিমলাকীর্ত্তি সূত্র বিস্মৃত হইয়া বৃদ্ধ নবাগতের পরিচর্য্যায় নিযুক্ত হইলেন। সদ্ধর্ম্মীর ধর্ম্মই এইরূপ।