[ ১৩ ]


 যশোধর্ম্মদেবের বিশাল সাম্রাজ্য জলবুদ্‌বুদের ন্যায় অনন্তে বিলীন হইয়া গিয়াছে, উত্তরাপথে তাহার চিহ্নমাত্রও নাই; রেবাকণ্ঠ হইতে লৌহিত্য পর্য্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডের অধীশ্বর স্বীয় অনুজকে স্বপদে সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে পারেন নাই। যশোধর্ম্মের মৃত্যুর সহিত আর্য্যাবর্ত্তে দশপুরের রাজবংশের ক্ষমতা বিলুপ্ত হইয়াছিল। প্রাচীন গুপ্তবংশের ধ্বংসাবশেষ লইয়া নিত্যই নূতন রাজ্য গঠিত ও অচিরে বিলুপ্ত হইতেছিল। যশোধর্ম্মের মৃত্যুর সহিত ক্ষুদ্র সঙ্ঘারামের সৌভাগ্যসূর্য্যও অস্তমিত হইয়াছিল। যতদিন সম্রাট জীবিত ছিলেন ততদিন ত্রাণকর্ত্তা বৃদ্ধ স্থবিরকে স্মরণ করিয়া স্তূপ ও সঙ্ঘারামের জন্য অজস্র অর্থব্যয় করিতেন, ততদিন সঙ্ঘারামের অধিবাসীর অভাব হয় নাই। অর্থলোলুপ, সঙ্কীর্ণচেতা, পশুবৃত্তি অনুসরণকারী বোধিসত্ত্ব ও শক্তিগণের আবির্ভাবে ক্ষুদ্র সঙ্ঘারাম সর্ব্বদাই পরিপূর্ণ থাকিত। কিন্তু সম্রাটের মৃত্যুর পরে যখন আর্দ্র বালুকানির্ম্মিত কন্দুকের ন্যায় সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলি বন্ধনহীন হইয়া বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িল তখন বোধিসত্ত্ব ও শক্তিমণ্ডলী সুখের দিন অতীত দেখিয়া স্তূপসান্নিধ্য পরিত্যাগ করিল। আটবিক প্রদেশ তখন জনাকীর্ণ হইয়া পড়িতেছিল। দূরে আভীরগণ একখানি গ্রাম স্থাপন করিয়াছিল; নির্ভয়হৃদয়ে অসিতবরণী আভীরবালিকাগণ ধনভূতির নগরশিরে মহিষচারণ করিত। সঙ্ঘারাম জনশূন্য হইলে গ্রাম হইতে আভীর রমণীগণ সন্ধ্যার প্রাক্কালে আসিয়া স্তূপ ও সঙ্ঘারাম মার্জ্জনা করিত, বনজাত পুষ্পমালায় আমাদিগকে সজ্জিত করিত এবং রজনীতে অসংখ্য ঘৃতপ্রদীপদানে আমাদিগের নিকট হইতে অন্ধকারকে দূরে রাখিবার চেষ্টা করিত, আভীর যুবকগণ আসিয়া আমাদিগকে অরণ্যের অত্যাচার হইতে রক্ষা করিত, বংশদণ্ড ও কাষ্ঠখণ্ডের সাহায্যে জীর্ণ সঙ্ঘারামের সংস্কার করিত এবং সময়ে সময়ে সঙ্ঘারামের প্রাঙ্গণে বৃক্ষচ্ছায়ায় বসিয়া গ্রামবৃদ্ধগণের নিকটে বোধিসত্ত্বগণের অসীম প্রভাব এবং যাদুবিদ্যায় তাহাদিগের অসাধারণ পারদর্শিতা সম্বন্ধে অত্যদ্ভুত কাহিনী শ্রবণ করিয়া ভয়ে সঙ্কুচিত হইত। কথন কখন দুই একজন কাষায়পরিহিত ভিক্ষু দূরদেশ হইতে তীর্থভ্রমণে আসিতেন, বহু পরিশ্রমে বনপথ অতিক্রম করিয়া আমাদিগের ধ্বংসাবশেষ দেখিয়া অশ্রুবিসর্জ্জন করিতেন। আভীর রমণীগণ যথাসাধ্য তাঁহাদিগের পরিচর্য্যা করিত। তাঁহারা গৌতম বুদ্ধ কর্ত্তৃক প্রচলিত প্রাচীন প্রথানুসারে স্তূপ অর্চ্চন, পরিক্রমণ ইত্যাদি ক্রিয়া সমাপন করিয়া পুনরায় বনমধ্যে প্রবিষ্ট হইতেন। এইরূপে কত দিন কাটিয়াছিল তাহা যদি নির্দ্দেশ করিতে পারিতাম তাহা হইলে আর্য্যাবর্ত্তের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকিত না। দীর্ঘ দিবস, মাস, বর্ষ আমরা বনচারী আভীরগণের উপাস্য দেবতা হইয়াছিলাম, সঙ্ঘারাম ক্রমে মৃৎস্তূপে পরিণত হইল, পরিক্রমণের পথ শ্যামল দুর্ব্বাদলে আচ্ছন্ন হইল, হরিদ্বর্ণ শৈবালে আমার লোহিত দেহ আবৃত হইয়া গেল, আর্য্যাবর্ত্ত হইতে কেহ আর আমাদিগকে সন্ধান করিতে আসিল না।

 এক দিন আভীর পল্লীতে নূতন সম্প্রদায়ভুক্ত জনৈক ভিক্ষু আসিয়াছিল। তাহার পরিচ্ছদ গৈরিকবর্ণরঞ্জিত, কেশপাশ দীর্ঘ জটায় পরিণত, সমগ্র দেহ ভস্মলিপ্ত এবং তাহার হস্তে ত্রিশূল। পল্লীর বালকবালিকাগণ তাহাকে দেখিলে দূরে পলায়ন করিত; কিন্তু আভীর বৃদ্ধগণ তাহাকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিত। এই নূতন ভিক্ষু মাসাধিককাল আভীর গ্রামে বাস করিয়াছিল। সে প্রতিদিন বনমধ্যে প্রবেশ করিয়া বহুদূর পর্য্যটন করিত। সে বনভ্রমণকালে একে একে প্রাচীন আটবিকদেশের সমস্ত ধ্বংসাবশেষই লক্ষ্য করিয়া দেখিল। সে ধনভূতির নগর, স্তূপ ও সঙ্ঘারামের ধ্বংসাবশেষ বিশেষভাবে পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছিল। ইহার পর কিছুকাল নূতন ভিক্ষু স্থানান্তরে চলিয়া গেল। তখন মধ্যাহ্নে আভীর রমণীগণ আমার ছায়ায় বসিয়া বলিত, “সন্ন্যাসী আপনার দল আনয়ন করিতে মধ্যদেশে গমন করিয়াছে, শীঘ্রই প্রত্যাবর্ত্তন করিবে।”

 বস্তুতঃ শৈব সন্ন্যাসী প্রায় তিন মাসকাল পরে অন্যূন পঞ্চাশৎজন অল্পবয়স্ক সন্ন্যাসী লইয়া পুনরাগমন করিল। নবাগত ভিক্ষু সম্প্রদায় ধনভূতির নগরের ধ্বংসাবশেষের সর্ব্বোচ্চস্থানে গৃহ নির্ম্মাণ করিয়া বাস করিতে লাগিল। প্রথম যে সন্ন্যাসী আভীর-গ্রামে আসিয়াছিল সেই ব্যক্তিই নূতন সঙ্ঘারামের মহাস্থবির হইয়াছিল। ইহারা সঙ্ঘারামকে মঠ বলিত, মহাস্থবিরকে মঠাধীশ বা মঠাধিপ বলিত এবং রাজার ন্যায় সম্মান করিত। বৌদ্ধসঙ্ঘের ভিক্ষুগণের ন্যায় স্বাধীনতা বা স্বেচ্ছাচারিতা এই নূতন সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিলক্ষিত হইত না। ইহারা সর্ব্বদাই অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও উপাসনায় মগ্ন থাকিত, কঠোর আত্মসংযমে জীবন অতিবাহিত করিত, জ্যেষ্ঠ ও স্থবিরগণকে পিতৃতুল্য বোধে সম্মান করিত এবং স্ত্রীজাতিকে কালব্যাল জ্ঞানে দূর হইতে পরিহার করিত।

 আভীরগণের সাহায্যে স্তূপ ও সঙ্ঘারামের ধ্বংসাবশেষ হইতে পাষাণ সংগ্রহ করিয়া স্তূপের দক্ষিণদ্বারের সম্মুখে সন্ন্যাসিগণ কয়েকটি ক্ষুদ্র গৃহ নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। বহুকাল পরে প্রাচীন স্তূপের ধ্বংসাবশিষ্টের অনুসন্ধান করিতে যাইয়া তোমরা তাহার ভিত্তি দেখিতে পাইয়াছিলে। সন্ন্যাসিগণ সেই গৃহে পূজা করিতেন। পল্লীবাসী আভীরগণের উপহার ও বনজাত ফলমূল তাঁহাদিগের জীবন ধারণের উপায় হইয়াছিল। সন্ন্যাসিগণ অবসরমত বনপর্য্যটন করিতেন। তখন আটবিক প্রদেশে সহস্র সহস্র বর্ষব্যাপী শত শত বিপ্লবে আর্য্য উপনিবেশ বিধ্বস্ত হইয়া গিয়াছিল, জনসঙ্কুল প্রদেশসমূহ অরণাসঙ্কুল হইয়াছিল, শত শত প্রাচীন নগরের ধবংসাবশেষ উত্তরাপথ ও দক্ষিণাপথের মধ্যবর্ত্তী প্রদেশ আচ্ছন্ন করিয়াছিল। কালক্রমে অনার্য্যবংশসম্ভূত বর্ব্বর জাতিসমূহ এই বনময় রাজ্য অধিকার করিয়াছিল। সন্ন্যাসিগণ ভীষণ অরণ্যমধ্যে নির্ভয়হৃদয়ে ভ্রমণ করিতেন, আভীরগ্রাম হইতে গ্রামান্তরে গমন করিয়া বর্ব্বরগণকে শিক্ষা প্রদানের চেষ্টা করিতেন। তাঁহাদিগের পবিত্রতা, সংযম, নিষ্ঠা ও শিক্ষা সর্ব্বত্রই তাঁহাদিগকে ভক্তিভাজন ও আদরণীয় করিয়া রাখিয়াছিল। মৃগয়াজীবী গোখাদক আভীর পশুহত্যা পরিত্যাগ করিয়া গোপালের সাহায্যে ভূমিকর্ষণে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, পশুচর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া কার্পাসনির্ম্মিত বস্ত্র পরিধান করিতে শিথিয়াছিল, সচ্ছলতার সময়ে অস্বাভাবিক পানাহার ও অভাবের সময়ে অনশন পরিত্যাগ করিয়া ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করিতে শিথিয়াছিল। সন্ন্যাসিগণের উদ্যমে আটবিক প্রদেশে মুদ্রার প্রচলন, বিপণী স্থাপন প্রভৃতি কার্য্য অনুষ্ঠিত হইতেছিল, আটবিক প্রদেশে ক্রমশঃ সুশাসন প্রবর্ত্তিত হইতেছিল। উত্তরাপথের রাজগণের সমবেত চেষ্টায় যাহা সফল হয় নাই মুষ্টিমেয় সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর চেষ্টায় তাহা সিদ্ধ হইয়াছিল। আটবিক প্রদেশের অধিবাসিগণের বর্ব্বর নামও এই সন্ন্যাসিগণ কর্ত্তৃক দূরীভূত হইয়াছিল। পূর্ব্বে উত্তর বা দক্ষিণ হইতে তীর্থযাত্রিগণ প্রাণভয়ে প্রাচীন স্তূপে আসিত না; সুদীর্ঘ বনপথ অতিক্রমকালে বর্ব্বরগণ যাত্রিগণের ধনলুণ্ঠন ও জীবননাশ করিয়া পথচারণ অতি বিপজ্জনক করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু যেমন সময় অতিবাহিত হইতেছিল তেমনই বর্ব্বরগণ প্রাচীন আর্য্য সভ্যতায় দীক্ষিত হইতেছিল। যাহারা বন্য মৃগ হনন করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করিত, তাহাদিগের প্রজা সন্ন্যাসিগণের নিকট শিক্ষিত হইয়া হলকর্ষণ ও বাণিজ্যে মনঃসংযোগ করিয়াছিল। সুতরাং তাহাদিগকে আর নরহত্যা বা লুণ্ঠনে প্রবৃত্ত হইতে হয় নাই। আটবিক প্রদেশ ক্রমে পুনরায় জনাকীর্ণ হইয়া উঠিল; উত্তরাপথ ও দক্ষিণাপথ হইতে নির্ভয়ে স্বার্থবাহগণ অশ্ব, উষ্ট্র ও খরপৃষ্ঠে পণ্যভার ন্যস্ত করিয়া আটবিক প্রদেশ অতিক্রম করিত। মগধ হইতে, মধ্যদেশ হইতে, পঞ্চনদ হইতে বণিক্‌গণ বনজাত পণ্যের লোভে বনময় প্রদেশে আগমন করিত। ক্রমে আটবিক প্রদেশ নামমাত্র থাকিয়া গেল। বিন্ধ্যশিখর ব্যতীত দেশের কোন স্থানে অরণ্যানী পরিলক্ষিত হইত না। সন্ন্যাসিগণ চীর ধারণ করিয়া ও ভগ্ন উপলথণ্ডনির্ম্মিত গৃহে বাস করিয়া এই বিস্তৃত রাজত্ব শাসন করিতেন। আটবিক প্রদেশে রাজা প্রজা ছিল না, কিন্তু রাজশক্তির অভাবে কখনও দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয় নাই। ছিন্ন গৈরিক বসন পরিহিত সন্ন্যাসিগণের অঙ্গুলি-হেলনে বিশাল জনসঙ্ঘ পরিচালিত হইত। মঠে অধ্যক্ষের পর অধ্যক্ষ আটবিক প্রদেশের সেবায় জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন। তাঁহাদিগের দেহান্তে মঠবাসিগণ আমাদিগের প্রাচীন স্তূপের পরিক্রমণের পথে আচ্ছাদনীয় পাষাণগুলি উত্তোলিত করিয়া তাঁহাদিগের দেহ সমাহিত করিত। কোন মঠাধীশের পরমায়ু শেষ হইলে বিন্ধ্যাদ্রি হইতে সহ্যাদ্রি পর্য্যন্ত রোদনশব্দ শ্রুত হইত; দেশে সমস্ত কার্য্য স্থগিত হইত, জনসঙ্ঘ শোকে মগ্ন হইত।

 ভাগ্যচক্রের পরিবর্ত্তনে আর্য্যাবর্ত্ত ও দক্ষিণাত্যে যে সমস্ত রাজবংশ গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ অপহরণ করিয়া সম্পন্ন হইয়াছিল তাহাদিগের অধঃপতন আরব্ধ হইল। বহুদূরে প্রাচীন পুণ্যক্ষেত্রে স্থানীশ্বরের গৌরবরবি উদিত হইতেছিল। তখনও সম্রাট নাম গ্রহণ করিয়া গুপ্তবংশীয় একজন রাজা মগধ শাসন করিতেছিলেন। প্রভাকরবর্দ্ধন পঞ্চনদে হূণপ্রভাব ধ্বংস করিয়াছিলেন; গুপ্তবংশের কন্যা বিবাহ করিয়া জয়বর্দ্ধন ধন্য হইয়াছিলেন; রাজ্যবর্দ্ধনের প্রতাপে পর্ব্বতরাজের হিমানীমণ্ডিত শিখরে বসিয়া কাম্বোজরাজ ভয়ে কম্পিত হইতেন; পুরুষপুর হইতে কামরূপনগর পর্য্যন্ত, হিমবানের পাদমূল হইতে নর্ম্মদাতীর পর্য্যন্ত হর্ষবর্দ্ধনের অধিকার বিস্তৃত হইয়াছিল; পর্ব্বতরক্ষিত আটবিক প্রদেশ তথনও উত্তরাপথ রাজ্যের অধীনতা স্বীকার করে নাই। কান্যকুব্জ হইতে সম্রাট দূত প্রেরণ করিয়াছেন, তাঁহার উদেশ্য দক্ষিণকোশলে তীর্থযাত্রায় নির্গত হইবেন। সম্রাটের দূত ভগ্নগৃহে দর্ভশয্যায় আসনগ্রহণ করিয়া আটবিক প্রদেশের মুকুটবিহীন সম্রাটের সম্মুখীন হইয়াছেন। সুবর্ণগৌরকান্তি শুভ্রজটামণ্ডিতশীর্ষ ছিন্ন গৈরিকপরিহিত মঠাধ্যক্ষ কুশাসনে বসিয়া রাজদূতের সহিত কথোপকথন করিতেছেন। মঠবাসিগণকে দেখিয়া রাষ্ট্রনীতিকূটকুশল রাজকর্ম্মচারী বিস্মিত হইয়াছেন, তাঁহার মনে সন্দেহের পরিবর্ত্তে ভক্তির উদ্রেক হইয়াছে। প্রভাতে আমার পার্শ্বে দণ্ডায়মান হইয়া আমার শীর্ষে হস্তস্থাপন করিয়া স্থবির মঠাধ্যক্ষ বলিতেছেন, “মহাত্মন্, আমাদিগের সহিত ছলনার আবশ্যকতা নাই, আর্য্যাবর্ত্ত-রাজের বিজিগীষা পরিতৃপ্ত হয় নাই, বিস্তৃত উত্তরাপথ তাঁহার রাজ্যলাভেচ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হয় নাই। ভিক্ষোপজীবী সন্ন্যাসীর সহিত ছলনার প্রয়োজন নাই। আটবিক প্রদেশ ও দক্ষিণাপথের প্রতি হর্ষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে, তাহা আমরা পূর্ব্বেই অনুভব করিয়াছি। দেবাদিদেবের পরিচর্য্যায় গুরুপরম্পরায় শতাধিক বর্ষ এই বনমধ্যে অতিবাহিত হইয়াছে, মহেশ্বরের অনুকম্পায় বর্ব্বরগণ শান্ত ও শিক্ষিত হইয়াছে। প্রাচীন কোশল রাজ্যের উর্ব্বর ভূমি বহুরত্নপ্রসবিনী, উত্তরাপথ ও দক্ষিণাপথ রাজগণের লোলুপ দৃষ্টি বহুকাল হইতে ইহার উপর নিবদ্ধ হইয়াছে। আমার পূর্ব্ববর্ত্তিগণ তাহা অনুভব করিয়া শঙ্কিতচিত্তে জীবন অতিবাহিত করিয়াছেন। আমরা বর্ব্বর শাসন করিয়াছি বটে, কিন্তু দেশ রক্ষা করিবার উপযুক্ত পাত্র নহি। ত্রিশূল লইয়া চালুক্য ও বর্দ্ধন রাজগণের বিজয়বাহিনীর সম্মুখীন হইতে যাইব না, ইহা নিশ্চয়। আপনি কান্যকুব্জে প্রত্যাবর্ত্তন করুন, দেবাদিদেবের শিরস্পর্শ করিয়া বলিতেছি, নীরবে, নিঃশব্দে, বিনা রক্তপাতে বিশাল কোশলরাজ্য আর্য্যাবর্ত্তরাজের পদানত হইবে, একজন মঠবাসীও বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইবে না। গ্রামে গ্রামে মাণ্ডলিকগণ স্বাধীনতা হারাইয়া উত্তেজিত হইবে বটে, কিন্তু তাহারা আমাদিগের অবাধ্য হইবে না, আমার আজ্ঞার বিরুদ্ধে কেহই হস্তোত্তোলন করিবে না। হর্ষবর্দ্ধন নির্ব্বিঘ্নে আটবিক প্রদেশ অধিকার করিবেন; কিন্তু দক্ষিণাপথে চালুক্য তাহা সহিবে না। কোশল হইতে বাতাপিপুর বহু যোজন পথ। হর্ষবর্দ্ধন কোশলে পদার্পণ করিলে সত্যাশ্রয় পুলকেশীর সিংহাসন কম্পিত হইবে। দূতরাজ! পূর্ব্বকালে বহু আর্য্যাবর্ত্তরাজগণ দক্ষিণাপথ জয় করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু দাক্ষিণাত্য বিজয়ের পথ এখন আর তত সুগম নাই। দক্ষিণাপথে নূতন বল সঞ্চারিত হইয়াছে, মঙ্গলেশের বংশধরগণ দুর্ব্বল হস্তে অসি ধারণ করে না। মহাত্মন্, কান্যকুব্জরাজপদে নিবেদন করিও, বিপদ আটবিক কোশলে নাই। বাতাপিপুরে ও নর্ম্মদা তীরে তাঁহাকে সাবধান হইতে বলিও। দেবাদিদেবের আদেশে আমরা নতশিরে হর্ষবর্দ্ধনের আদেশ পালন করিব; কিন্তু জানিয়া রাখিও, আর্য্যাবর্ত্তে সমুদ্রগুপ্তের বিজয়গাথার সমতুল কাহিনী আর কখনও শ্রুত হইবে না।”

 নতমস্তকে স্থাণ্বীশ্বররাজের দূত মঠসান্নিধ্য পরিত্যাগ করিল। বলিতে বিস্মৃত হইয়াছিলাম, মঠবাসিগণ প্রথমেই আমার দেহমার্জ্জনা করিয়া আমাকে শিবলিঙ্গের আকার প্রদান করিয়াছিল এবং প্রতিদিন মহাসমারোহে আমার অর্চ্চনা করিত। কিন্তু যিনি মানবজাতির হিতসুখার্থ রাজ্যসম্পদ ও সংসারসুখ পরিত্যাগ করিয়া উত্তরাপথবাসিগণের দ্বারে দ্বারে নগ্নপদে সুসংবাদ বিতরণ করিয়াছিলেন তাঁহার দেহাবশেষ অদূরে শিলাস্তূপের মধ্যে সমাহিত ছিল; তাহার প্রতি কেহ ফিরিয়াও চাহিত না। ইহাই মানব প্রকৃতি।

 উত্তরাপথের লক্ষ লক্ষ সেনা আটবিক কোশলে প্রবেশ করিল। চিরস্বাধীন বর্ব্বরগণ বুঝিয়াছিল যে, ইহা দেবযাত্রা বা তীর্থযাত্রা নহে, হর্ষবর্দ্ধনের দক্ষিণাপথবিজয়যাত্রা। গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে নগ্নপদে বিচরণ করিয়া সন্ন্যাসিগণ উদ্ধতস্বভাব বর্ব্বর মাণ্ডলিকগণকে শান্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন। মঠাধ্যক্ষের কথা সত্য হইল, এক বিন্দু রক্ত ব্যয় না করিয়াও বিশাল সমৃদ্ধিশালী প্রদেশ হর্ষবদ্ধনের সাম্রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল। সম্রাট যাঁহাকে দুত স্বরূপ কোশলে প্রেরণ করিয়াছিলেন তিনি রাজসকাশে উচ্চপদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। কোশল বিজিত হইল; দক্ষিণাপথের দ্বার অধিকৃত হইল। সংবাদ বিদ্যুৎ গতিতে কোশল হইতে বিদিশা, বিদিশা হইতে প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান হইতে বাতাপিনগরে উপস্থিত হইল। চালুক্য-রাজ বিপদ বুঝিয়া আত্মরক্ষায় প্রবৃত্ত হইলেন। নর্ম্মদাতীরে বৃহৎ সেনানিবাস স্থাপিত হইল। আর্য্যাবর্ত্ত হইতে দলে দলে অশ্বারোহী ও পদাতিক সেনা আটবিক কোশলের নানাস্থানে স্কন্ধাবার স্থাপন করিতেছিল। সৈন্যগণ কর্তৃক উৎপীড়িত হইয়া বর্ব্বর গ্রামবাসী ও মাণ্ডলিকগণ সময়ে সময়ে উত্তেজিত হইয়া উঠিত, কিন্তু সন্ন্যাসিগণের ঐকান্তিক চেষ্টায় কোন স্থানেই বিবাদবহ্নি প্রজ্জ্বলিত হইতে পারে নাই। ধীরে ধীরে নর্ম্মদাতীরে নানাস্থানে সৈন্য সমাবিষ্ট হইল, তখন সম্রাট স্বয়ং কান্যকুব্জ পরিত্যাগ করিয়া কোশলে প্রবেশ করিলেন। দুর্গপ্রাকারস্বরূপ ধবলশিলামণ্ডিত নর্ম্মদার উচ্চ তীরের পার্শ্বে থাকিয়া বাতাপিনগরের সেনা ঘট্ট রক্ষা করিতেছিল। সামান্য সেনা লইয়া চালুক্য সেনাপতি সীমান্ত রক্ষা করিতেছিলেন। কিন্তু বর্ষাজলপ্লাবিত নর্ম্মদা শিলাসঙ্কুল উপকূলের জন্য উত্তরাপথের সেনাধ্যক্ষগণের নিকট দুস্তর হইয়া উঠিয়াছিল।

 তীর্থযাত্রার ছলে প্রচ্ছন্নভাবে দক্ষিণাপথবিজয়যাত্রায় নির্গত হইয়া হর্ষবর্দ্ধন তীর্থের কথা বিস্মৃত হয়েন নাই। আটবিক কোশলে আসিয়া সম্রাট মঠ ও স্তূপ দর্শনের অভিপ্রায় জানাইয়া মঠস্বামীর নিকট দূত প্রেরণ করিয়াছিলেন। যথাসময়ে হর্ষবর্দ্ধন আত্মীয় স্বজন ও প্রধান প্রধান সেনাধ্যক্ষগণ সমভিব্যাহারে মঠদর্শনে আসিলেন। মঠস্বামী সম্রাটের অভ্যর্থনার জন্য যথাসাধ্য আয়োজন করিয়াছিলেন। সম্রাট কিয়ৎক্ষণের জন্য স্তূপের ধ্বংসাবশেষমধ্যে আসিয়া ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করিয়াছিলেন ও একবার মহাদেব আকারধারী আমার নিকট মস্তক অবনত করিয়াছিলেন। সম্রাট সত্বর তীর্থযাত্রা সমাপন করিয়া নর্ম্মদাতীরে প্রত্যাবর্তন করিলে সকলেই বুঝতে পারিয়াছিল যে, তিনি ভক্তিপ্রণোদিত হইয়া স্তূপে আইসেন নাই।

 বর্ষা অতীত হইলে হর্ষবর্দ্ধনের সেনা নানাস্থানে নর্ম্মদা পার হইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সর্ব্বত্র পাষাণের অন্তরালে থাকিয়া চালুক্য সেনা তাহাদিগের গতিরোধ করিল। নৌকা বা নৌসেতু কোনও উপায়ে যখন নর্ম্মদার দক্ষিণ কূল অধিকৃত হইল না, তখন হর্ষবর্দ্ধন নানাস্থান হইতে সৈন্য একত্র করিয়া স্বয়ং সৈন্যচালনায় প্রবৃত্ত হইলেন। দাক্ষিণাত্য অভিযানের ফল তোমাদিগের ইতিহাসে বর্ণিত হইয়াছে। ষে চরণযুগল আর্য্যাবর্ত্তের অশেষ রাজমণ্ডলীর মুকুটমণির প্রভায় আলোকিত হইয়াছিল, তাহা কখনও নর্ম্মদার দক্ষিণতীর স্পর্শ করে নাই। বার বার পরাজিত হইয়া হর্ষবর্দ্ধন অবশেষে নর্ম্মদাতীর হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। ত্রয়োদশ বর্ষকাল চালুক্যরাজ আত্মরক্ষার্থ নর্ম্মদাতটরক্ষা করিয়াছিলেন। হর্ষবর্দ্ধন যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন নদীর উভয় কূলে বৃহৎ সেনানিবাস স্থাপিত ছিল। হর্ষের দাক্ষিণাত্য বিজয়ের আশা উন্মূলিত হইল, পুলকেশী দক্ষিণাপথের শত শত স্থানে স্বীয় বিজয়কাহিনী ও উত্তরাপথ সম্রাটের পরাজয় লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। দাক্ষিণাত্য অভিযানের ফলে আটবিক কোশলে ঘোরতর অশান্তির সূত্রপাত হইয়াছিল। হর্ষবর্দ্ধনের মৃত্যুসংবাদ শ্রবণমাত্র উৎপীড়িত বর্ব্বরজাতি এক মাসের মধ্যে উত্তরাপথের সেনা ভাগীরথীর পরপারে রাথিয়া আসিয়াছিল।