পাষাণের কথা/১২
[ ১২ ]
তাহার পরদিন মনুষ্যজাতির প্রতি ও সদ্ধর্ম্মের প্রতি আমার ঘৃণা জন্মিয়াছিল। তোমাকে পূর্ব্বে বলিয়াছি, মানবকে কত ভালবাসি, মনুষ্য-সংসর্গ কত ভালবাসিতাম, আজীবন মানবকরস্পর্শে চালিত করিয়া আসিয়াছি, আজীবন যাহা কিছু নূতন দেখিয়াছি তাহাও মানবের কৃপায়; স্মৃতিশক্তিহীন, চলচ্ছক্তিহীন জীবনে যতটুকু স্থান ও অবস্থার পরিবর্ত্তন হইয়াছে তাহাও মানবের জন্য। তাহাই নিশ্চল পাষাণের মানবের প্রতি আকর্ষণের হেতু ও তাহাই আমাদের মানবদর্শনলালসার মূল। মনুষ্যদর্শন করিবার জন্য উৎসুক চিত্তে বর্ষের পর বর্ষ অতিবাহিত করিয়াছি; যখন মনুষ্য-সংসর্গের পরিবর্ত্তে নিবিড়বনবেষ্টিত হইয়া অসংখ্য অগণিত বৎসর যাপন করিয়াছি, তখনও জীবনের একমাত্র লালসা—একমাত্র উদ্দেশ্য—মানবসমাজের সংস্পর্শলাভ ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। জীবনে মানবসংস্পর্শের প্রথম দিনে মানবের নগরোপকণ্ঠে আসিয়া যে সৌন্দর্য্য দেখিয়াছিলাম, কতদিন তোমাকে বলিয়াছি, সেরূপ সৌন্দর্য্য আর দেখি নাই, আর কখনও দেখিবার আশা নাই। কিন্তু এক দিনে সেই মানবের প্রতি ও মানবসংস্পর্শের প্রতি এরূপ দারুণ ঘৃণা জন্মিয়াছিল যে, এখনও তাহা প্রশমিত হয় নাই। মানবের প্রারম্ভ হইতে মানবকে দেখিতেছি, মানবকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখিয়াছি, মানবকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখিয়াছি, এখন ঘৃণা ও শ্রদ্ধা অতিক্রম করিয়া মানবকে দেখিতেছি; কিন্তু যশোধর্ম্মদেবের স্তূপার্চ্চনার দিন মানবের যে রূপ দেখিয়াছি সে রূপ আর কখনও আমাদিগের গোচর হয় নাই। মানবের প্রারম্ভ দেখিয়াছি, বলবীর্য্যসম্পন্ন, দীর্ঘাবয়ব, সরলচিত্ত, আর তখন দেখিয়াছি বলহীন, ক্ষীণ, ক্ষুদ্রদেহ, ক্ষুদ্রচেতা কুটিলমতি মানব। তাহাদিগকে দেখিয়া মনে স্বতঃই ঘৃণার উদ্রেক হইয়াছে। এখন দেখিতেছি, অধঃপতনের শেষ সোপানে দণ্ডায়মান হইয়া আর্য্যাবর্ত্তবাসিগণ মুহূর্ত্তের জন্য আত্মরক্ষার চিন্তা করে নাই। তখন জগতে কোন প্রকার উত্তেজনাই তাহাদিগকে উত্তেজিত করিতে পারিত না। শাক্যের ধর্ম্ম, ব্রাহ্মণের ধর্ম্ম তাহাদিগের নিকট সমান হইয়াছে; উন্নতির চেষ্টা বহুদিন শেষ হইয়াছে; তখন ধর্ম্মের নাম স্বার্থসাধন, সঙ্ঘের নাম কামাচার ও বুদ্ধের নাম বিশ্বাসঘাতকতা; তখন ব্রাহ্মণের ইজ্যার নাম অর্থশোষণ, অধ্যয়নের নাম স্বার্থসাধন ও দানের নাম পরস্বাপহরণ হইয়াছে। ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণগণের চেষ্টায় পরিবর্ত্তন হইয়াছিল, নিঃশব্দে জগতকে জানিতে না দিয়া, ধীমান ব্রাহ্মণগণ প্রাচীন সরল ধর্ম্ম দৃঢ়ভিত্তির উপর স্থাপন করিয়াছিলেন। আবার তাঁহাদিগেরই বংশধরগণ স্বার্থসাধনের জন্য দৃঢ় ভিত্তি ক্ষয় করিয়া ভবিষ্যৎ বিনাশের পথ মুক্ত করিয়া দিয়াছে। ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ কর; দেখিতে পাইবে, এ ব্যবস্থা স্থায়ী হয় নাই, ধীরে ধীরে মিথ্যার গ্রন্থি শিথিল হইয়াছে,—সত্য প্রকাশিত হইয়াছে। সদ্ধর্ম্ম আর্য্যাবর্ত্ত হইতে দূরীভূত হইয়াছে সত্য, কিন্তু তাহার সহিত আর্য্যাবর্ত্তের কি দশা হইয়াছে? সত্য আবহমানকাল সত্যই রহিয়াছে, কখনও দীর্ঘকাল মিথ্যার আবরণে আচ্ছাদিত থাকে নাই। দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ কর, সদ্ধর্ম্মের ছায়ামাত্র বর্ত্তমান আছে, শাক্যরাজকুমারের সরল বিশ্বাসের ধর্ম্ম অতীতে বর্ত্তমান নাই। যাহা আছে, তাহা কি সদ্ধর্ম্ম? তথাগতের মহাপরিনির্ব্বাণের পর যে সকল মহাস্থবির সেই সুসমাচার জগতে ঘোষণা করিয়াছিলেন তাঁহারা ফিরিয়া আসিলে কি সদ্ধর্ম্মের নামে প্রচলিত ছায়া চিনিতে পারিবেন? নিজ মনে অন্বেষণ করিয়া দেখ, যাহাকে আর্য্যাবর্ত্তে সদ্ধর্ম্ম বলিত, তাহা নাই, তাহার পরিবর্ত্তে যাহা আছে তাহা তোমরা চিনিতে পরিবে না। স্বেচ্ছাচারীর অদম্য কাম ও অসহ্য লালসা সদ্ধর্ম্মের সহিত দেশে ও বিদেশে যাহা মিশ্রিত করিয়াছে তাহাতে সদ্ধর্ম্মে সত্যের পরিবর্ত্তে অসত্য প্রবেশ করিয়াছে। যাহা সত্য, তাহা সরল ও সহজবোধগম্য, এক সত্যের সাহায্যে অপরের সাহায্য লাভ করা যায়, তাহা স্থায়ী হয়। কিন্তু একবার যদি অসত্যের আশ্রয় গ্রহণ করিতে হয়, তাহা হইলে ভবিষ্যতে তদ্ব্যতীত আর পন্থা থাকে না; একটি মিথ্যা কথা প্রমাণ করিতে হইলে যেমন শত শত মিথ্যা কথার অবতরণা করিতে হয়, সত্যের সহিত অসত্য মিশ্রিত হইলে তেমনই অসত্যেরই প্রাদুর্ভাব হয়, সত্য দূরীভূত হইয়া যায়। চাহিয়া দেখ কি হইয়াছে, উত্তরমেরুপ্রান্তে চিরতুষারমণ্ডিত সমুদ্রকুলবাসী অসভ্য বর্ব্বরগণও সদ্ধর্ম্মের আশ্রয়ে আসিয়াছে। কিন্তু তাহাদিগের সদ্ধর্ম্ম কিরূপ? তাহাদিগের শ্রমণগণ দন্তহীন মৎস্যের পূজায় দিবস অতিবাহিত করিয়া থাকে ও সুরাপানে উন্মত্ত হইয়া রজনীযাপন করে। দূরে যাও, মেরুবাসী মৎস্যভূক বামনগণও সদ্ধর্ম্মের প্রতি অনুরাগী, তাহাদিগেরও শ্রমণ আছে, তাহারা মৎস্যের আকাঙ্ক্ষায় সমুদ্রের পূজা করিয়া থাকে, বহু শতাব্দীর মধ্যে ধর্ম্ম, বুদ্ধ বা সঙ্ঘের নাম শ্রবণ করে নাই। উত্তরকুরুর সুদীর্ঘ মরুপ্রান্তে যে সুসভ্য জাতি বাস করে তাহারাও বৌদ্ধ; তাহাদের ভিক্ষু ও শ্রমণগণ কাষায় পরিধান করিয়া থাকেন, তাহাদিগের শত শত বিহার ও সঙ্ঘারাম আছে; কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া দেখিও, তাহাদিগের মধ্যে কয়জন গৌতমবুদ্ধের নাম শ্রবণ করিয়াছে। তাহাদিগের ভিক্ষুগণ দারপরিগ্রহ করিয়া সঙ্ঘারামে গৃহস্থাশ্রম স্থাপিত করিয়াছে, হলকর্ষণ বা বাণিজ্য তাহাদিগের নিকট দোষাবহ নহে। আর্য্যাবর্ত্তের নিকটে আগমন কর; চাহিয়া দেখ, আর্য্যাবর্ত্তের প্রান্তে কি হইতেছে! সদ্ধর্ম্ম আছে, বুদ্ধ আছে, কিন্তু সার বস্তুর অভাব। এক বুদ্ধের স্থানে চতুর্বিংশতি সহস্র বুদ্ধের আবির্ভাব হইয়াছে; ধ্যানীবুদ্ধ, মানসীবুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বগণপরিবৃত অন্তসারশূন্য গৌতম বুদ্ধের নাম এখনও বিদ্যমান রহিয়াছে। শত শত শক্তিপরিবেষ্টিত বোধিসত্ত্বগণ সর্ব্বদাই বলিতেছেন, ইন্দ্রিয়য়লালসাপরিতৃপ্তি ব্যতীত নির্ব্বাণলাভের উপায় নাই। বিত্তশালী সঙ্ঘারামসমূহে সুরার সহিত শক্তির উপাসনা ব্যতীত অপর কোন কথা শুনিতে পাইবে না। যে সুবর্ণভূমি হইতে ব্রাহ্মণ্যধর্ম্ম সদ্ধর্ম্ম কর্ত্তৃক বিতাড়িত হইয়াছিল, সেই সুবর্ণভূমিতে সদ্ধর্ম্মের কি অবস্থা হইয়াছে পরীক্ষা করিয়া দেখ! সুবর্ণব্রীহিমণ্ডিত কাষ্ঠনির্ম্মিত বুদ্ধমূর্ত্তির সম্মুখে প্রতি দিন বসালিপ্ত অন্নসংস্থাপন করাই বৌদ্ধের একমাত্র কর্ম্ম। প্রব্রজ্যা গ্রহণের নাম এখনও বর্ত্তমান আছে বটে, কিন্তু তাহা নামেই পর্য্যবসিত হইয়াছে। শিশুগণ প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিয়া, প্রভাতে চীরধারণ করে ও সন্ধ্যাকালে তাহা দূরে নিক্ষেপ করে, ইহার কারণ কি বুঝিতে পারিয়াছ? সদ্ধর্ম্মে যখন অবনতির সূত্রপাত হইল, তখন সমগ্র আর্য্যাবর্ত্তবাসী ভিক্ষুসঙ্ঘ উন্নতির কি উপায় উদ্ভাবন করিয়াছিলেন? তাঁহারা দেখিলেন, রাজশ্রীর আশ্রয় লাভ করিয়া ব্রাহ্মণগণ ধর্ম্মমতে কালানুযায়ী পরিবর্ত্তন করিতেছেন, তদনুকরণে তাঁহারাও তথাগতের সরল ধর্ম্ম পরিবর্ত্তনে প্রবৃত্ত হইলেন। তাহাতে শাক্যরাজকুমারের সরল ধর্ম্মের সহজাত মাধুর্য্য নষ্ট হইল। যে আকর্ষণে মুগ্ধ হইয়া জনসমাজ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের বাহ্যাড়ম্বর ও বাক্যমালা পরিত্যাগ করিয়া শান্তিলাভের আকাঙ্ক্ষায় তথাগতের আশ্রয় গ্রহণ করিতে আসিত, তাহা আর রহিল না। তখন আকর্ষণ করিবার নূতন উপায় আবশ্যক হইল, সদ্ধর্ম্মে সরল বিশ্বাসের পরিবর্ত্তে বাহ্যাড়ম্বর সার হইল। বহুদিন হইতে বাহ্যাড়ম্বরে ব্রাহ্মণগণ অভ্যস্ত, জনসমাজও ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মে আড়ম্বর দেখিতে অভ্যস্ত। অন্তঃসারশূন্য বাহ্যাড়ম্বরে বৌদ্ধসঙ্ঘ ব্রাহ্মণগণকর্ত্তৃক পরাজিত হইল। বৌদ্ধসঙ্ঘের ধৈর্য্যচ্যুতি হইল ও পদস্খলন আরদ্ধ হইল। অবনতির চরমসীমায় উপস্থিত হইয়া শান্তিময় মহাজিনের শান্তিময় ধর্ম্ম নিরীহ আর্য্যাবর্ত্তবাসিগণের রক্তস্রোতে আর্য্যাবর্ত্ত হইতে তাড়িত হইল। নিরীহ সদ্ধর্ম্মে প্রকৃতবিশ্বাসী জনসমূহের রক্তস্রোতে সদ্ধর্ম্মের নাম দাক্ষিণাত্যের প্রত্যেক উপত্যকা হইতে ধৌত হইল। যাহারা অবশিষ্ট রহিল, ধর্ম্মের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ রহিয়া, তাহারা অনন্তের শেষ পর্য্যন্ত দুর্জ্জেয় থাকিবে। কিন্তু যাহা কখনও হয় নাই তাহা তখনও হইল না। প্রসার বিহীন ক্ষুদ্র পরিসরে আবদ্ধ প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের গিরিদুর্গ জিত হইয়াছে—সংস্কার দূর হইয়াছে,—নাম বর্ত্তমান আছে; সার অপহৃত হইয়াছে, ছায়া এখনও অপসৃত হয় নাই। আমি ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমান দেখিতে পাইতেছি; দেখিতেছি, যাহা আছে তাহাও থাকিবে না; কারণ, জগতে অসত্যের স্থান নাই।
যাহা দেখিয়াছিলাম তাহা পূর্ব্বে কখনও দেখি নাই, তাহার নাম যথেচ্ছাচার ও সুশৃঙ্খলার অভাব। তাহা দেখিলে বোধ হয়, যাহারা এ অবস্থায় উপনীত হইয়াছে তাহারা শীঘ্রই পরিবর্ত্তিত বা বিলুপ্ত হইবে। দশপুর হইতে সেনা আসিয়াছে। তাহাদিগের অধিনায়কবর্গ, অস্ত্রশস্ত্র, অনুচর, পার্শ্বচর প্রভৃতি সমস্তই উপস্থিত; কিন্তু তাহাদিগের মধ্যে সুশাসন বা সুশৃঙ্খলার একান্ত অভাব। সেনা আসিবার পূর্ব্বে বহুসহস্র পটমণ্ডপ আসিয়াছে; কিন্তু শৃঙ্খলার অভাবে শিবির স্থাপনের আদেশ হয় নাই, সুতরাং শিবির স্থাপিত হয় নাই। দিবাবসানে শ্রান্ত সেনাদল আসিয়া যে স্থানে আশ্রয় দেখিল সেই স্থানেই অধিবাসিগণকে নিষ্কাশিত করিয়া তাহা অধিকার করিল। ভিক্ষু ও শ্রমণগণ আশ্রয়বিহীন হইয়া রাত্রিযাপন করিলেন, কিন্তু সৈনিকগণের প্রতি অত্যন্ত রিরক্ত হইলেও প্রকাশ্যে কোন কথা বলিতে সাহস করিলেন না। রাত্রি অতিবাহিত হইলে পটমণ্ডপ স্থাপিত হইল, সেনাদল শিবিরে চলিয়া গেল, কুটীর ও গৃহসমূহের অধিবাসিগণ স্ব স্ব স্থানে প্রত্যাবর্ত্তন করিল।
ক্রমে প্রাচীন স্তূপের বেষ্টনীর বহির্ভাগে কতকগুলি বিপণী স্থাপিত হইয়াছে, তাহাতে আহার্য্য, বস্ত্রাদি ও সুরা বিক্রীত হইয়াছে। বিপণীর চতুষ্পার্শ্বে সেনাদলের পার্শ্বচারিণীদিগের পর্ণকুটীর নির্ম্মিত হইয়াছে। বিপণী হইতে কলসের পর কলস সুরা এই কুটীরসমূহমধ্যে আনীত হইতেছে; কিন্তু বিক্রেতা সকলের নিকট মূল্য পাইতেছে না। পুরাতন পাষাণখণ্ডসমূহে নির্ম্মিত নূতন সঙ্ঘারামে ভিক্ষুগণ কাষায়ের পরিবর্ত্তে রক্তবর্ণ বস্ত্র পরিধান করিয়াছেন। সঙ্ঘারামেও ক্ষুদ্র বৃহৎ নানাবিধ আকারের মৃন্ময় কলস আনীত হইতেছে, ভিক্ষু ও শ্রমণগণ সাধনার জন্য আবশ্যকানুযায়ী বিভিন্ন প্রকারের মধু আনয়ন করিতে অনুচরবর্গকে আদেশ প্রদান করিতেছেন। বিভিন্ন আকারের ও বিভিন্ন বর্ণের কলসের মুখে পুষ্প বা ফলের আচ্ছাদন রহিয়াছে, কোন কলসের মুখে কদম্ব বা যবশীর্ষ, কোন কলসের মুখে প্রফুল্ল কমল বা মধূপপুষ্প, কাহারও মুখে আম্রশাখা এবং কাহারও মুথে বা পক্ক কদলী। রজনীসমাগমে মধুর প্রয়োজনের আধিক্য হইত, বরবর্ণিনী শক্তিগণের সাহায্যে সদ্ধর্ম্মের উদ্দেশ্যে নিবেদিত কলস কলস মধু প্রতি রজনীতে যথাস্থানে প্রেরিত ও উপস্থিত হইত। বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্বগণের নাম করিলেই হইত। সময়ে সময়ে তাহার আবশ্যকও হইত না, সঙ্ঘারামবাসী অনেকেই বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্বনামে অভিহিত হইতেন। নিশীথে সঙ্ঘারাম হইতে নৃত্য ও গীতের শব্দ উত্থিত হইয়া প্রাচীন পাষাণ সমূহের মনে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বগণের সিদ্ধি সম্বন্ধে সন্দেহ উৎপাদিত করিত। কখনও কখনও মহাশক্তিগণ বুদ্ধবোধিসত্ত্বাদির আশ্রয় পরিত্যাগ করিয়া সৈনিকগণের আশ্রয় গ্রহণ করিত। তখন শক্তির অধিকারের জন্য সৈনিকে ও ভিক্ষুতে ভীষণ কলহ হইত ও সময়ে সময়ে সঙ্ঘারামবাসী ও শিবিরবাসিগণের মধ্যে ক্ষুদ্র রণাভিনয়ও হইয়া যাইত। সেনাদলের পার্শ্বচারিণীরাও যে সময়ে সময়ে সঙ্ঘারামে আশ্রয় লাভ না করিত তাহাও নহে। সদ্ধর্ম্মের এমনই মহিমা যে, সঙ্ঘারামমধ্যে উপস্থিত হইবামাত্র তাহারাও আচারপরিবর্ত্তন করিয়া মহাশক্তিরূপ ধারণ করিত।
এইরূপে বহুকাল অতিবাহিত হইল, স্তূপ ও বর্ত্মসংস্কার, এবং মন্দিরাদিনির্ম্মাণকার্য্য শেষ হইলে শুনিলাম, সম্রাট তীর্থদর্শনে আসিবেন ও তাঁহার সহিত নানা দিগ্দেশ হইতে বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব ও স্থবিরগণ আগমন করিবেন। তাঁহাদিগের বাসস্থানসমূহ নির্ম্মিত হইতে লাগিল। এক দিন বহু দূর হইতে বহু যানবাহন নুতন বুদ্ধ, নূতন বোধিসত্ত্ব ও শক্তিরূপিণী শত শত নারী বহন করিয়া স্তূপসন্নিধানে উপস্থিত হইল। ক্রমে স্তূপের চতুষ্পার্শ্বে ক্ষুদ্র নগর স্থাপিত হইল, শত শত বিপণীতে নগরোপকণ্ঠ আচ্ছাদিত হইয়া গেল। প্রতি রজনীতে সদ্ধর্ম্মানুযায়ী সাধনার আনন্দধ্বনি বহুদূর হইতে শ্রুত হইত; কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয়, কখনও কোনও গৃহস্থ নাগরিক স্ত্রীপুত্ত্রাদি সমভিব্যাহারে তীর্থদর্শনে আসিত না। একদিন সম্রাট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার সহিত বহুসংখ্যক সৈন্য আসিল, বহুকাল পরে চীরধারী কয়েকজন ভিক্ষু সম্রাটের পার্শ্বচররূপে স্তূপসন্নিধানে উপস্থিত হইলেন। সম্রাটের সহিত যে সমস্ত সেনা আসিয়াছিল তাহারা হূণযুদ্ধে সুশিক্ষিত, সুতরাং তাহাদিগের মধ্যে নিয়ম বা শৃঙ্খলার বিশেষ অভাব ছিল না। সম্রাটের সহিত যে কয়জন চীরধারী ভিক্ষু আসিয়াছিলেন তাঁহারা সমাগত বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্বগণের সংস্পর্শে আসিতেন না, দূরে বনমধ্যে পর্ণকুটীরে দিনযাপন করিতেন। বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্বগণ ইহাঁদিগকে বিশেষ শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখিতেন না। একদিন শুনিলাম, সম্রাট পার্শ্বচরগণ পরিবৃত হইয়া উপাসনার জন্য স্তূপে আসিবেন। স্তূপ ও বেষ্টনী পরিষ্কৃত হইল; সজ্জারও অভাব হইল না। শুনিলাম, সেই দিন উপাসনার জন্য নাগরিকগণও স্তূপসন্নিধানে আসিয়া উপস্থিত হইবে, কিন্তু উৎসব দর্শনে আমাদিগের কিছুমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল না।
নূতন উৎসবে বিশেষত্ব ছিল, কিন্তু তথাপি আমরা বিশেষভাবে সন্তুষ্ট হই নাই! যে দিন সম্রাট স্তূপার্চ্চনা করিতে আসিলেন সে দিন সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্ব হইতে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বমণ্ডলী স্তূপ ও বেষ্টনী অধিকার করিয়া বসিলেন। নানা স্থানে শক্তিমণ্ডলী পরিবেষ্টিত হইয়া ভূতলে নানাবর্ণে রঞ্জিত চক্রাঙ্কন করিয়া তন্মধ্যে ঊষাকাল হইতে ইঁহারা সম্রাটের দর্শনলাভেচ্ছায় উপবেশন করিয়াছিলেন। সূর্য্যোদয়ের কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে দলে দলে পুত্ত্রকলত্র সমভিব্যাহারে নাগরিকগণ স্তূপসন্নিধানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন। রাত্রিকাল হইতে সশস্ত্র সৈনিকগণ শ্রেণীবদ্ধ হইয়া পথ রক্ষা করিতেছিল। নাগরিকগণ যথাবিধি স্তূপার্চ্চনা ও বেষ্টনী পরিক্রমণ করিয়া পরে বৃদ্ধ ও বোধিসত্ত্বগণেরও অর্চ্চনা করিতেছিলেন। স্তূপার্চ্চনাকালে মন্ত্রপাঠের পর ভিক্ষুগণ বা তাঁহাদিগের শিষ্যমণ্ডলী নাগরিকদিগের নিকট হইতে যথাসম্ভব অর্থাকর্ষণ করিতেছিলেন, জীবিত বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্বগণ অর্চ্চিত হইবার পর স্বয়ং দক্ষিণা গ্রহণ করিতেছিলেন, তাঁহাদিগের পার্শ্বচারিণী শক্তিসমূহও যথাসম্ভব উপার্জ্জনের ব্যবস্থা করিতেছিলেন। আমার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া মধুবিহ্বলা শক্তিরূপিণী জনৈকা মহিলা দারুণ তৃষ্ণা জানাইয়া জনৈক তরুণ নাগরিকের নিকট হইতে এক কলস মধুর মূল্য প্রার্থনা করিতেছিলেন; তাঁহার পার্শ্ববর্ত্তী জনৈক সৈনিক তাহাতে বিশেষ আপত্তি করিতেছিল। মহাশক্তির তৎকালীন অধিকারী চক্রমধ্যে অবস্থিত বোধিসত্ত্বপ্রবরের সহিষ্ণুতা ক্ষীণ হইয়া আসিতেছিল; তিনি ত্রিমূর্ত্তির প্রতি ঘন ঘন রোষকটাক্ষ ক্ষেপণ করিতেছিলেন। দূরে দাঁড়াইয়া কতকগুলি নাগরিক ও নাগরিকা এই ব্যাপার দর্শন করিয়া বিশেষ আনন্দ উপলব্ধি করিতেছিল। কোন স্থানে প্রত্যেক বুদ্ধ ও শিষ্যমণ্ডলীর মধ্যে প্রাপ্ত দক্ষিণার বিভাগ সম্বন্ধে বিলক্ষণ বিবাদ উপস্থিত হইয়াছিল ও কয়েকজন প্রৌঢ় নাগরিক বিবাদ ভঞ্জনের চেষ্টা করিতেছিলেন। যে সকল নাগরিকের সহিত তরুণী ও যুবতী মহিলাগণ আসিয়াছিলেন তাঁহারা সত্বর পূজা সমাপন করিয়া বেষ্টনী হইতে বহির্গত হইবার চেষ্টা করিতেছিলেন। কয়েকজন উচ্চপদস্থ রাজপুরুষ সেনাধ্যক্ষ স্তূপাভিমুখে আসিবার ও পরিক্রমণের পথ রক্ষা করিতেছিলেন। কিন্তু তাঁহাদিগের উপস্থিতি সত্ত্বেও কোন কোন সৈনিককে স্থানান্তরিত করিতে হইতেছিল। কোন কোন শক্তিরূপিনী মহিলা নাগরিকগণের আকর্ষণে তাঁহাদিগের অধিকারী বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বগণকে পরিত্যাগ করিলে তাঁহারা অধীর হইয়া উঠিতেছিলেন; কিন্তু সম্রাটের সুবর্ণখণ্ডের আশায় চক্র পরিত্যাগ করিতে পারিতেছিলেন না। বেষ্টনীর বহির্দ্দেশে সম্রাটের অনুযাত্রী কয়েকজন সৈন্য পরিবৃত হইয়া কাষায়ধারী নবাগত ভিক্ষুগণ সম্রাটের জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন। জনৈকা শক্তি আনিয়া ইঁহাদিগকে মধু পান করিতে আহ্বান করিতেছিলেন। ভিক্ষুগণ মধুভাণ্ড প্রত্যাখ্যান করিলে তিনি অতি ভদ্র ও শ্লীল ভাষায় ভিক্ষুগণের বর্ণনা করিতে করিতে তাঁহার অধিকারী বোধিসত্ত্বের নিকট গমন করিলেন। তখন বোধিসত্ত্বের আদেশে তাঁহার শিষ্য ও অনুচরমণ্ডলী বেষ্টনীর বহির্দ্দেশে আসিয়া ভিক্ষুগণের সহিত মল্লযুদ্ধের উদ্যম করিল। কোলাহল শুনিয়া রাজপুরুষগণ আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও সৈনিকগণের সাহায্যে মহিলা ও তাঁহার অনুচরদিগকে দূর করিয়া দিলেন। চক্রমধ্যে উপবিষ্ট বোধিসত্ত্ব ইহাতে বিশেষ আপত্তি প্রকাশ করিতেছিলেন, কিন্তু তাঁহার চক্ররূপ দুর্গমধ্যে কেহই প্রবেশ করিতে সাহসী হইল না ও ক্রমে শান্তি সংস্থাপিত হইল। বেষ্টনীর বহির্দ্দেশে পূর্ণ মাত্রায় উৎসব চলিতেছিল; শিষ্যমণ্ডলী ও মহাশক্তিগণ শৌণ্ডিকগণের বিপণী হইতে অনবরত মধুর কলস স্তূপমধ্যে বহন করিতেছিলেন, কখন কখনও নাগরিকগণকে সাহায্য করিবার জন্য বিপণীমধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া রন্ধন ও বিশ্রামের চেষ্টা করিতেছিলেন, তাঁহাদিগের সমভিব্যাহারী প্রতীহার ও রক্ষীদল শান্তিরক্ষা করিতেছিল; ভিক্ষু বা শক্তিগণকে তাঁহাদিগের নিকটে গমন করিতে দিতেছিল না।
প্রথম প্রহর অতীত হইলে সম্রাট স্তূপাভিমুখে অগ্রসর হইলেন; শৃঙ্গ ও তুর্য্যনিনাদে জনসঙ্ঘ বধির হইল, ক্ষণেকের জন্য উৎসবস্রোত রুদ্ধ হইল। সৈনিকগণ জনস্রোত রুদ্ধ করিয়া পথ পরিষ্কার করিল; শ্বেত কৌষেয় বস্ত্র পরিহিত সম্রাট ও যুবরাজ বেষ্টনীর দ্বারে উপনীত হইলেন, নতজানু হইয়া কাষায়পরিহিত ভিক্ষুগণকে অভিবাদন করিলেন। তখন তাঁহারা পুরোবর্ত্তী হইয়া বেষ্টনীমধ্যে প্রবেশ করিলেন। প্রাচীন রীতি অনুসারে স্তূপার্চ্চন ও পরিক্রমণ সমাপ্ত হইলে সম্রাট-বেষ্টনী হইতে বহির্গত হইয়া ভিক্ষুগণের সহিত প্রস্থান করিলেন। অর্চ্চনা শেষ হইলে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বগণ দেখিলেন যে, নবাগত ভিক্ষুগণ দক্ষিণ প্রার্থনা করিলেন না। তাঁহারা আশা করিয়াছিলেন যে, স্তূপার্চ্চনা শেষ হইলে সম্রাট নাগরিকগণের ন্যায় তাঁহাদিগেরও অর্চ্চনা করিবেন। সম্রাট বেষ্টনী পরিত্যাগ করিতেছেন শুনিয়া অনেকেই চক্র পরিত্যাগ করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন; কিন্তু ভাণ্ডাগারিক ইন্দ্রগুপ্ত কর্ত্তৃক আশ্বস্ত হইয়া পুনরায় উপবেশন করিলেন। ইন্দ্রগুপ্ত সম্রাটের নামাঙ্কিত নূতন সুবর্ণমুদ্রা বিতরণে প্রবৃত্ত হইলে ভীষণ কোলাহল উত্থিত হইল। বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বগণ চক্র পরিত্যাগ করিয়া ভাণ্ডাগরিককে বেষ্টন করিলেন। সুবর্ণের নাম শ্রবণে মধুভাণ্ড পরিত্যাগ করিয়া ভিক্ষু ও শক্তিগণ শৌণ্ডিকবীথি হইতে স্তূপাভিমুখে অগ্রসর হইলেন। নাগরিকগণ ব্যাপার দেখিয়া দূরে অপসরণ করিল। বহু কষ্টে সৈনিকগণের সাহায্যে সুবর্ণ-বণ্টন আরদ্ধ হইল। মর্য্যাদা অনুসারে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব, শক্তি, ভিক্ষু ও শিষ্যমণ্ডলীকে অর্থ প্রদত্ত হইল। তৃতীয় প্রহরে কার্য্য শেষ হইল। তখন জনৈক বুদ্ধ কোন মধুবিহ্বলা বিবস্ত্রা তরুণী শক্তিকে শৌণ্ডিকালয় হইতে বলপূর্ব্বক আনয়ন করিতেছিলেন। মধুপানের আধিক্যপ্রযুক্ত সুবর্ণের লোভ সম্বরণ করায় বুদ্ধ তাঁহাকে সাহায্য করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। ইন্দ্রগুপ্ত ইঁহার মর্য্যাদা রক্ষা করিয়াই বেষ্টনী হইতে প্রস্থান করিলেন। অপরাহ্নে জনসঙ্ঘ স্তূপাভিমুখে প্রত্যাবর্ত্তন করিল। সন্ধ্যাগমে প্রাচীন রীতি অনুসারে স্তূপ ও বেষ্টনী আলোকমালায় সজ্জিত হইল, নাগরিক ও নাগরিকাগণ ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন। বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব ও শক্তিগণ যথাসাধ্য সজ্জা করিয়া তাঁহাদিগের সহিত মিশ্রিত হইতে লাগিলেন। তখন প্রতীহার ও নগররক্ষিগণ পথ রক্ষা করিতেছিল। প্রথম প্রহর অতীত হইলে উৎসবস্রোত মন্দীভূত হইল। শ্রুত হইল, জনৈক বুদ্ধ কোন তরুণী নাগরিকার অঙ্গে হস্তক্ষেপণের জন্য তাহার স্বামী কর্ত্তৃক আহত হইয়াছেন; একজন বোধিসত্ত্ব জনৈক নাগরিকের কন্যাকে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করাইয়া রজনীর অন্ধকারে প্রস্থান করিয়াছেন, রক্ষিগণ তাঁহাদিগের অনুসন্ধানে নির্গত হইয়াছে; কয়েকজন ভিক্ষু বেষ্টনীর মধ্যে অর্থাপহরণ করায় মহাপ্রতীহার কর্ত্তৃক শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়াছে; কয়েকজন ভিক্ষু, শক্তি ও শিষ্য বিপণী হইতে বিনামূল্যে দ্রব্য গ্রহণ করায় মহাপ্রতীহার কর্ত্তৃক চৌর্য্যাপরাধে অভিযুক্ত হইয়াছে। ইহাদিগকে নগরে প্রেরণ করিতে হইবে ও দণ্ডপাশিক ও দণ্ডনায়কগণ কর্ত্তৃক ইহাদিগের বিচার হইবে। কতকগুলি মহিলা সঙ্ঘ পরিত্যাগ করিয়া নাগরিকগণের আশ্রয় গ্রহণ করায় তাহাদিগের অধিকারী বোধিসত্ত্ব ও বুদ্ধগণ মহাপ্রতীহারের নিকট বিচার প্রার্থনা করিয়াছেন। রজনীর দ্বিতীয় প্রহর অতীত হইলে বেষ্টনী জনশূন্য হইল, তখনও আসব বিক্রেতাদল পণ্যশালা বন্ধ করে নাই, ভিক্ষুগণ মধুর সাহায্যে নির্ব্বাণের অর্দ্ধপথ অতিক্রম করিয়াছেন; চলচ্ছক্তিহীন স্ত্রী ও পুরুষগণকে রক্ষিদল বহন করিয়া লইয়া যাইতেছে, কাহাকেও বা নাগরিকগণ পদাঘাত করিতেছে। রজনীর তৃতীয় প্রহর অতীত হইলে দীপসমূহ নির্ব্বাপিত হইল। তখন রক্ষিদল ব্যতীত অপর সকলে স্তূপসান্নিধ্য পরিত্যাগ করিয়াছে। প্রত্যূষে সম্রাট ও যুবরাজ, অতি অল্পসংখ্যক অনুচর লইয়া, শিবির পরিত্যাগ করিলেন। উৎসব শেষ হইল।