[ ৩ ]

 শিল্পিগণের কার্য্য শেষ হইল। কতদিনে শেষ হইল তাহা আমি বলিতে পারি না। তোমাদিগের গণনা অনুসারে সে বোধ হয় দীর্ঘকাল। দিন আসিত, দিন যাইত; প্রতিদিন শ্রমজীবিগণ নগর হইতে আসিত, সন্ধ্যাসমাগমে আবার চলিয়া যাইত; তখন রক্ষিগণ আমাদিগের রক্ষণের ভার লইত। এইরূপ ভাবে যে কতদিন গেল তাহা যদি বলিতে পারিতাম, তাহা হইলে একটি রাজ্যের ইতিহাসের একপৃষ্ঠা বলিয়া যাইতে পারিতাম। শিল্পিগণের কার্য্য শেষ হইল। ক্রমে শ্রমজীবিগণের সংখ্যা বর্দ্ধিত হইতে লাগিল। খোদিত পাষাণ পর্ণশালা হইতে বাহির হইয়া যথাস্থানে নীত হইল। তোমরা বলিয়া থাক যে, গুরুভার পাষাণ দ্বিসহস্র বৎসর পূর্ব্বে মানবগণ কর্ত্তৃক কিরূপে ইতস্ততঃ চালিত হইত, তাহা বিস্ময়ের বিষয়। কিন্তু বস্তুতঃ তাহা নহে। পর্ণশালা সমূহ হইতে স্তূপ নির্ম্মাণের জন্য নির্ব্বাচিত ক্ষেত্র পর্য্যন্ত পঞ্চহস্ত বিস্তৃত পথ প্রস্তুত হইয়াছিল। সে পথের ইষ্টক এখনও সে প্রান্তরে পড়িয়া আছে। যেরূপ শকটে আমরা পর্ব্বতের সানুদেশ হইতে নগরে আসিয়াছিলাম, তক্ষণকার্য্য শেষ হইলে সেইরূপ শকটে আরোহণ করিয়াই আমরা স্তূপক্ষেত্রে নীত হইয়াছিলাম। শতশত শ্রমজীবীর সমবেত চেষ্টায় আমরা যথাস্থানে ন্যস্ত হইয়াছিলাম। ইহাতে বিস্ময়ের কিছুই নাই। সে কথা সকলের প্রিয় হইবে না। নির্ম্মাণকার্য্য শেষ হইলে, প্রতিখণ্ড প্রস্তর যথাস্থানে ন্যস্ত হইলে, আমরা কিরূপ আকার ধারণ করিয়াছিলাম, তাহাই বলিয়া যাই। স্থপতিগণ যখন সৌধ নির্ম্মাণ করে, তখন তাহাদিগের কার্য্যে নয়নপ্রীতিকর কিছুই থাকে না, কিন্তু সমগ্র সৌধ নির্ম্মিত হইলে, তাহা সত্য সত্যই আনন্দবর্দ্ধক হইয়া থাকে।

 ক্ষেত্রমধ্যে অর্দ্ধগোলকাকার স্তূপ নির্ম্মিত হইল; সমান্তরালে, সমভাবে, সমান আকারের প্রস্তরখণ্ড যোজনা করিয়া শতহস্ত উচ্চ স্তূপ নির্ম্মিত হইল। শেষে তাহার কয়েকখণ্ড প্রস্তরমাত্র পড়িয়া ছিল; আর অশ্মরাশি নিকটবর্ত্তী গ্রামবাসিগণ সহস্র বর্ষকাল ব্যাপিয়া আপনাদের প্রয়োজনে লইয়া গিয়াছিল; এতদিনে হয় ত সে কয়খানিও অন্তর্হিত হইয়াছে। এখন সেই রক্তবর্ণ, মসৃণ প্রস্তরে নির্ম্মিত অর্দ্ধগোলকাকার বিশাল স্তূপের পরিবর্ত্তে কি দেখিয়া আসিয়াছ? শ্রমজীবিগণের পদধূলি সঞ্চিত করিলে সেরূপ মৃৎপিণ্ড নির্ম্মিত হইতে পারিত। স্তূপের ক্ষেত্র বৃত্তাকার, সুতরাং তাহার বেষ্টনীও বৃত্তাকার। স্তূপের পার্শ্বে পঞ্চহস্ত বিস্তৃত পরিক্রমণের পথ; এই পথও পূর্ণ বৃত্তাকার ছিল। তির্য্যগ্‌ভাবে যোজিত প্রস্তরখণ্ডের সমাবেশ করিয়া এইপথ নির্ম্মিত হইয়াছিল। পরিক্রমণের পথ বলিলে সহজবোধগম্য হইবে না, কালে তীর্থযাত্রীর ভাষাও পরিবর্ত্তিত হইয়াছে; তাহারা এখনও পরিক্রমণ করিয়া থাকে, পূজ্যব্যক্তির বা বস্তুর অর্চ্চনার পূর্ব্বে বা পরে প্রদক্ষিণ করিবার প্রথা এখনও তীর্থযাত্রীদিগের মধ্যে বর্ত্তমান আছে—ইহাই পরিক্রমণ। পুণ্যার্থী পূর্ব্ব তোরণ দিয়া স্তূপবেষ্টনের মধ্যে প্রবেশ করিয়া প্রথমে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করিত; পরে পরিক্রমণের পথ তিনবার বা সাতবার অতিক্রম করিয়া পুনরায় স্তূপ অর্চ্চনা করিত। স্তূপ নির্ম্মাণের কাল হইতে মুসলমান-সমাগমকাল পর্য্যন্ত অর্চ্চনার এই প্রথাই প্রচলিত ছিল। তাহার পর আর কেহ স্তূপের অর্চ্চনা করে নাই। সে অনেক পরের কথা। স্তূপবেষ্টনীর পরে ত্রিহস্তপরিমিত স্থান ছিল, ইহার পরে বৃত্তাকার প্রথম স্তম্ভশ্রেণী। সমান্তরালে স্তম্ভশ্রেণীর মধ্যে চারিদিকে চারিটি তোরণ ছিল ও প্রতি তোরণের সম্মুখে এক একটি আবরণ স্থাপিত হইয়াছিল। এই আবরণও স্তম্ভ, সূচি ও আলম্বনসজ্জায় নির্ম্মিত। স্তূপের পূর্ব্বদিকে যে তোরণ ছিল, তাহাই প্রধান তোরণ বলিয়া গণিত হইত; কারণ, স্তূপের পূর্ব্বদিকেই নগর অবস্থিত ছিল। দুইটি স্তম্ভের উপর তোরণ স্থাপিত; প্রতি স্তম্ভ একখণ্ড প্রস্তর হইতে খোদিত অষ্টকোণ স্তম্ভচতুষ্টয়ের সমষ্টি। স্তম্ভশীর্ষে চতুষ্কোণ প্রস্তরখণ্ডের উপর পত্রপুষ্পপল্লব মধ্যে দুইটি উপবিষ্ট সিংহমূর্ত্তি। সিংহপৃষ্ঠের উপর ন্যস্ত পুষ্পমালাশোভিত চতুষ্কোণ প্রস্তরখণ্ডের উপর তোরণগুলি স্থাপিত। সমান্তরালে তিনটি তোরণ এইরূপ চতুষ্কোণ ব্যবধানের উপর স্থাপিত হইয়াছিল। সিংহচতুষ্টয়ের পৃষ্ঠস্থ চতুষ্কোণ শিলাখণ্ডের উপর প্রথম তোরণ। উহার উভয় পার্শ্ব গোলাকার; এই অংশে কুণ্ডলীকৃতপুচ্ছ এক একটি মকর মুখব্যাদান করিয়া রহিয়াছে। মকরের সম্মুখে, দক্ষিণ পার্শ্বে একটি মন্দির ও বামপার্শ্বে একটি স্তূপ। মন্দিরটি স্তম্ভশ্রেণীবেষ্টিত, চূড়ায় কেতন উড্ডীয়মান, মন্দির মধ্যে পুষ্পাবৃত বেদী ও মন্দিরদ্বার পুষ্পমাল্যপরিশোভিত। স্তূপটি দুই শ্রেণীর স্তম্ভবেষ্টনের মধ্যে অবস্থিত ও স্তম্ভ শ্রেণীদ্বয়ের ব্যবধানে পরিক্রমণের পথ। অন্তরের স্তম্ভবেষ্টনের মধ্যে স্তূপের উভয় পার্শ্বে সুদীর্ঘ কেতন উড্ডীয়মান। অর্দ্ধবৃত্তাকার স্তূপ পুষ্পমাল্যবিজড়িত। স্তূপের উভয় পার্শ্বে মকরের নাসিকাগ্রভাগে স্তম্ভবেষ্টনীর সম্মুখে প্রস্ফুটিত কমলসমূহ খোদিত। মন্দির ও স্তূপের মধ্যভাগের স্থান হস্তিযূথ দ্বারা পরিপূর্ণ, তোরণের মধ্যভাগে একটি বোধিদ্রুম ও উহার উভয় পার্শ্বে হস্তিদ্বয় অঙ্কিত। হস্তিগণ শুণ্ডে সনাল উৎপল লইয়া বোধিবৃক্ষ অর্চ্চনায় যাইতেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় তোরণের ব্যবধানে একাদশটি ক্ষুদ্র স্তম্ভ; ইহার একটি অষ্টকোণ ও পরবর্ত্তীটি চতুষ্কোণ,—চতুষ্কোণ স্তম্ভগুলির সম্মুখে যক্ষিণী ও অপ্সরোগণের মূর্ত্তি। প্রথম তোরণের উপর দুইখণ্ড চতুষ্কোণ প্রস্তর স্থাপন করিয়া তাহার উপরেই দ্বিতীয় তোরণ স্থাপিত হইয়াছিল। দ্বিতীয় তোরণের শেষাংশে পূর্ব্বের ন্যায় মকর, স্তূপ ও মন্দির খোদিত। এই তোরণের মধ্যভাগে বেদির উপর স্থাপিত কয়েকটি পল্লব ও উহার উভয় পার্শ্বে দুইটি করিয়া সিংহ। সিংহগণের ব্যবধানে প্রস্ফুটিত ও প্রস্ফুটনোন্মুখ পদ্মসমূহ অঙ্কিত। ইহার উপরে তৃতীয় তোরণ। ইহাও চতুষ্কোণ প্রস্তরদ্বয়ের উপর স্থাপিত এবং ইহার ও দ্বিতীয় তোরণের মধ্যে পূর্ব্বের ন্যায় কতকগুলি ক্ষুদ্র স্তম্ভ। এই স্তম্ভগুলির কিছু বিশেষত্ব আছে—যখন এই স্তম্ভগুলি খোদিত হয় তখন ভাস্করগণ শ্রেণীবিন্যাসে স্থান নির্দ্দেশের জন্য প্রতিস্তম্ভে বর্ণমালার এক একটি অক্ষর খোদিত করিয়াছিলেন। নাগরিকগণ যখন অসমাপ্ত ভাস্করকার্য্য দেখিতে আসিতেন, তখন তাঁহারা এই স্তম্ভগুলিতে নূতন প্রকারের অক্ষর দেখিয়া ভাস্করগণকে তাহার কথা জিজ্ঞাসা করিতেন। তদুত্তরে তাঁহারা জানাইয়াছিলেন যে, বহুকাল ভারতবর্ষে বাসহেতু তাঁহারা তদ্দেশপ্রচলিত বর্ণমালা ব্যবহারে অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছেন, তাঁহাদিগের মধ্যে যাবনিক বর্ণমালা লুপ্তপ্রায়। যে বর্ণমালা তাঁহারা ব্যবহার করিতেছেন, তাহা গান্ধার ও কপিশা প্রভৃতি দেশে প্রচলিত; উহা ভারতীয় বর্ণমালার অনুরূপ নহে। উহা দক্ষিণ দিক হইতে বামদিকে লিখিত হইয়া থাকে ও উহার লিখন-প্রণালী ভারতীয় বর্ণমালার লিখন-প্রণালী হইতে সরল। পারসিকগণ যখন ঐরাণদেশীয় রাজগণের নেতৃত্বে উত্তর পশ্চিম প্রদেশসমূহ জয় করিয়াছিলেন, তখন তাঁহাদিগের রাজকার্য্যালয়ে ব্যবহার প্রযুক্ত এই বর্ণমালাও তত্তদ্দেশবাসিগণ কর্ত্তৃক ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে। গান্ধার, কপিশা প্রভৃতি প্রদেশেও ভারতীয় বর্ণমালার প্রচলন আছে, তবে তাহা পারসিক বর্ণমালার ন্যায় বহুলভাবে প্রচলিত নহে। সর্ব্বোচ্চ তোরণের মধ্যভাগে প্রস্ফুটিত অর্দ্ধকমলের উপর নবপত্রিকা ও তদূর্দ্ধে ধর্ম্মচক্র প্রতিস্থাপিত, ইহার উভয় পার্শ্বে প্রস্ফুটিত শতদলের উপর ত্রিরত্ন! ত্রিরত্নের অন্তর্ভাগ মৎস্যপুচ্ছাকার ও তাহার পার্শ্বে সুসজ্জিত অশ্বপৃষ্ঠে শ্বেতচ্ছত্র ও চামরদ্বয়। প্রতি তোরণের দক্ষিণ পার্শ্বের স্তম্ভে রাজার বংশপরিচয় উৎকীর্ণ, “সুঙ্গরাজ্যে গার্গীপুত্ত্র বিশ্বদেবের পৌত্ত্র, গৌপ্তীপুত্ত্র অগরাজুর পুত্ত্র বাৎসীপুত্ত্র ধনভূতি এই তোরণ ও শিলাকর্ম্ম সম্পন্ন করাইলেন।”

 পূর্ব্ব তোরণের দক্ষিণ পার্শ্বের স্তম্ভে যে লিপি দেখিতে পাইতেছ, তদনুরূপ লিপি অপর তোরণত্রয়েও ছিল। দক্ষিণ তোরণের স্তম্ভদ্বয় হূণগণ অগ্নিসংযোগে বিনষ্ট করিয়াছে। সে কথাও বলিব, কিন্তু সে অনেক পরের কথা। অপর তোরণদ্বয়ের স্তম্ভগুলির ভগ্নাংশমাত্র তোমরা পাইয়াছ, কিন্তু তাহারাও এই পূর্ব্ব তোরণের ন্যায় উচ্চশীর্ষ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল; তাহারাও ভাবিয়াছিল যে, তাহাদিগের উচ্চশীর্ষ আর কখনও মেদিনী স্পর্শ করিবে না। কিন্তু মুসলমানের দণ্ডপ্রহারে, হূণের অগ্নিদাহে ও ব্রাহ্মণগণের পুনরভ্যুত্থানে তাহারাও পুনরায় ধরাশায়ী হইতে বাধ্য হইয়াছে। পূর্ব্বতোরণের পার্শ্বে যে স্তম্ভটি আছে, তাহা চাপদেবা নাম্নী বিদিশাবাসী রেবতীমিত্র নামক জনৈক শ্রেষ্ঠিপত্নীর দান। রেবতীমিত্রের পত্নী প্রতি তোরণের সান্নিধ্যে একটি স্তম্ভ স্থাপিত করিয়াছিলেন। এইরূপে জনসাধারণের সমবেত চেষ্টায় স্তূপবেষ্টনীর স্তম্ভ ও সূচিগুলি নির্ম্মিত ও যথাস্থানে স্থাপিত হইয়াছিল। প্রত্যেকের নাম তদ্দত্ত দ্রব্যে উৎকীর্ণ হইয়াছিল। আলম্বন কে দিয়াছিলেন, তাহা প্রকাশ পায় নাই, তবে নগরবাসিগণের কথোপকথন শ্রবণে জানিয়ছিলাম যে, আর্য্যাবর্ত্তবাসী জনৈক বিখ্যাত ব্যক্তি আলম্বন নির্ম্মাণের ও যথাস্থানে স্থাপনের ব্যয়ভার বহন করিয়াছিলেন; কিন্তু সুঙ্গরাজগণের ভয়ে স্বীয় নাম প্রকাশ করেন নাই। চাপদেবা-প্রদত্ত স্তম্ভের একপার্শ্বে হস্তিত্রয়ের পৃষ্ঠে স্থাপিত পাদপীঠের উপর গরুড়ধ্বজধারী একটি অশ্বারোহীর মূর্ত্তি; অপর পার্শ্বে গণযুগলবাহিত পাদপীঠের উপর তিনটি হস্তী; ইহার মধ্যে মধ্যমটি সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ। প্রত্যেক হস্তীর স্কন্ধে অঙ্কুশহস্তে হস্তিপক উপবিষ্ট। প্রত্যেক স্তম্ভের উপরিভাগে একটি অর্দ্ধবৃত্ত অঙ্কিত ও উহার মধ্যে একটি প্রস্ফুটিত পদ্মের অর্দ্ধভাগ। সাধারণতঃ তোরণের পার্শ্বে বেষ্টনের প্রথম স্তম্ভ এইরূপে চিত্রিত হইত। অপর স্তম্ভগুলিতে প্রত্যেক পার্শ্বে, ঊর্দ্ধে একটি ও নিম্নে একটি অর্দ্ধবৃত্ত এরং মধ্যভাগে একটি পূর্ণবৃত্ত অঙ্কিত হইত; ইহার মধ্যে কোনটিতে চিত্র, কোনটিতে প্রস্ফুটিত বা প্রস্ফুটনোন্মুখ পদ্ম খোদিত হইয়াছিল। ঊর্দ্ধের অর্দ্ধবৃত্ত ও মধ্যস্থলের পূর্ণবৃত্তের অন্তঃস্থ স্থানে কোনটিতে প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর নৃত্যশীলা অপ্সরা, কোনটিতে সনাল উৎপল, কোনটিতে সফল আম্রপল্লব, কোনটিতে বা পুষ্পমাল্য খোদিত হইয়াছিল। স্তম্ভযুগলের ব্যবধানে তিনটি করিয়া সূচি স্থাপিত হইয়াছিল; তিনটি সূচি প্রতি স্তম্ভযুগলকে পরস্পর সংলগ্ন করিত। স্তম্ভের পার্শ্ব সূচিবৎ বিদ্ধ করিয়া থাকিত বলিয়া বোধ হয় ভাস্করগণ পাষাণময় বেষ্টনের এই অংশের “সূচি” নামকরণ করিয়াছিলেন। প্রত্যেক সূচির পার্শ্বে এক একটি পূর্ণবৃত্ত অঙ্কিত থাকিত; সাধারণতঃ সূচিগাত্রে বৃত্তগুলিতে প্রস্ফুটিত পদ্ম খোদিত ছিল, কিন্তু অতি অল্পসংখ্যক সূচিতে নানাবিধ চিত্রও ছিল।

 তাহার পর আলম্বন। উত্তর ভারতবাসী কোন্ মহাপুরুষ যে এই আলম্বনের ব্যয় দিয়াছিলেন, তাহা জানিতে পারি নাই; কিন্তু আলম্বনটি সর্ব্বাপেক্ষা সুন্দর হইয়াছিল। স্তূপবেষ্টনীর সমুদায় স্তম্ভের ও তোরণের আবরণগুলির স্তম্ভসমূহের শীর্ষে আলম্বন স্থাপিত হইয়াছিল। আলম্বনের শীর্ষদেশ ঈষৎ গোল ও মসৃণ; প্রতি পার্শ্বে সমান্তরাল রেখাদ্বয়ের অভ্যন্তরে, উপরে একশ্রেণী চতুর্ভুজ ও নিম্নে একশ্রেণী পুষ্পমাল্যে লম্বিত ঘণ্টা; এতদ্দয়ের অভ্যন্তরে কোন স্থানে হস্তী, কোন স্থানে বা মকরমুখ হইতে নির্গত মৃণাল বক্রগতিতে চলিয়া গিয়াছে, অবশিষ্ট স্থান পত্র-পুষ্প-ফল-সিংহ-হস্তি-বানর প্রভৃতি জীব ও নানাবিধ চিত্রে সুশোভিত। আলম্বনের কোন স্থানে প্রদাতার নাম নাই বটে, কিন্তু প্রতি চিত্রের নিম্নে বা উপরে উঁহার নাম অঙ্কিত আছে ও আলম্বন যে স্থানে শেষ হইয়াছে, সেই স্থানে একটি উপবিষ্ট সিংহমূর্ত্তি অঙ্কিত আছে।

 স্তূপ বা স্তূপবেষ্টনীর নির্ম্মাণকার্য্য যতদিন চলিতেছিল, ততদিন যবন ভাস্করগণ, রাজপুরুষ, শ্রমজীবী বা নিতান্ত পরিচিত ব্যক্তি ভিন্ন অপর কাহাকেও বেষ্টনীর মধ্যে প্রবেশের অধিকার দেন নাই। নির্ম্মাণকার্য্য শেষ হইলে যবনজাতীয় দেশীয় ভাস্করগণ রাজসমীপে যাইয়া সংবাদ জ্ঞাপন করিলেন। পরদিন প্রাতে নগর হইতে দলে দলে নাগরিক ও নাগরিকাগণ আসিয়া প্রান্তর আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল, কিন্তু রক্ষিগণ রাজাদেশে কাহাকেও বেষ্টনীর মধ্যে আসিতে দিল না। তখনও মঞ্চসমূহ অপসারিত হয় নাই; গুরুভার তোরণগুলি ঊর্দ্ধে উত্তোলন করিবার জন্য যে মৃৎস্তূপগুলি নির্ম্মিত হইয়াছিল, সেগুলি তখনও দূরে নিক্ষিপ্ত করা হয় নাই; ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত সর্ব্ববিধ আকারের ভগ্ন প্রস্তরখণ্ডগুলি পরিক্রমণের পথ আচ্ছন্ন করিয়াছিল। কিন্তু প্রবল বাসনার বলে সমুদ্র তরঙ্গের ন্যায় সেই বিশাল জনসঙ্ঘ বার বার আসিয়া মুষ্টিমেয় রক্ষিগণকে গ্রাস করিয়া ফেলিবার উপক্রম করিল। হস্তিপৃষ্ঠে, রথে, উষ্ট্রে, ও অশ্বে নাগরিকগণ আসিয়া বেষ্টনীর মধ্যভাগে প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল; জনতা বর্দ্ধিত হওয়ায় কোষ্ঠপালকে সংবাদ দিয়া রক্ষিসংখ্যা বৃদ্ধি করিতে হইল। তখন হতাশ হইয়া সেই জনসংঙ্ঘ বেষ্টনীর বহির্ভাগে দণ্ডায়মান রহিল। উৎসাহে ও দুর্দ্দমনীয় বাসনায় মত্ত হইয়া তাহারা তাহাদিগের বর্ষীয়ান্ ধর্ম্মযাজকের আগমন লক্ষ্য করে নাই। আজ তিনিও যেন নূতন বলে বলীয়ান্ হইয়া নগর হইতে স্তূপবেষ্টন পর্য্যন্ত দীর্ঘ পথ এই বিশাল জনতা ভেদ করিয়া আসিয়াছেন। আজ তাঁহার জন্য জনসমুদ্রের মধ্য দিয়া পথ উন্মুক্ত হয় নাই। তাঁহার ঈষণ্ণমিত দেহ দেখিয়া যদি একজন সসম্ভ্রমে অপসৃত হইয়াছে, তখনই দশজন দশদিক্ হইতে সেই স্থান অধিকারের চেষ্টা করিয়াছে। তাঁহার ক্ষীণ দেহ জনসঙ্ঘের পেষণে বহুবার পীড়িত হইয়াছে। তাঁহাকে দেখিয়া যদি কেহ সলজ্জভাবে সরিয়া যাইবার উদ্যম করিয়াছে, তখনই সে বুঝিয়াছে, সে আশা বৃথা; কারণ, তাহার পরক্ষণেই অপরে সে স্থান অধিকার করিয়াছে। সকল বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া হস্তী ও উষ্ট্রের আস্ফালন ও রথচক্রের ঘূর্ণন উপেক্ষা করিয়া ধূলিধূসরিত দেহে তিনি রক্ষিগণের মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইলেন; আসিয়া দেখিলেন, রাজা তখনও আইসেন নাই, যবনচতুষ্টয় তাঁহার জন্য ধীরভাবে অপেক্ষা করিতেছেন। তাহা দেখিয়া তিনিও বেষ্টনীর বহির্ভাগে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। রাজাও তাঁহারই অবস্থায় পতিত হইয়াছিলেন। তাঁহার চতুরশ্বযোজিত রথ স্তূপবেষ্টনী পর্য্যন্ত আসিতে পথ পায় নাই; নগরদ্বার হইতে বাহির হইয়াই তাঁহাকে রথ হইতে অবতরণ করিতে হইয়াছে। জনতার মধ্যে অনেকেই তাঁহাকে সবিনয়ে বেষ্টনীর দ্বার উন্মুক্ত করিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছে; অনুরোধ উপরোধ অতিক্রম করিয়া, ক্ষিপ্তপ্রায় জনতাকে শান্ত করিয়া নগ্নপদে রাজা বেষ্টনীর প্রবেশপথে উপস্থিত হইলেন। তখন যবন শিল্পিগণ, বৃদ্ধ ধর্ম্মযাজক ও রাজা বেষ্টনীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। বেষ্টনীর অন্তরালে কি হইল, তাহা বলিবার বোধ হয় আবশ্যকতা নাই। বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে রাজা দেখিলেন, চারিদিকে চারিটি তোরণ প্রায় আকাশ স্পর্শ করিয়াছে; প্রতি তোরণগাত্রে তাঁহার নাম ও বংশপরিচয় খোদিত আছে; প্রতি স্তম্ভে নাগ, যক্ষ ও কিন্নর প্রভৃতি উপদেবতাগণের মূর্ত্তি; সূচিতে জাতক বা অপর কোন চিত্র। তাঁহার সে সময়ে বিশেষ বাক্যস্ফূর্ত্তি হয় নাই; তিনি বিস্ময়বিস্ফারিত লোচনে শিল্পকীর্ত্তি দেখিতে লাগিলেন। শিল্পিগণ ও ধর্ম্মযাজক নীরবে তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন। প্রায় এক প্রহর কাল রাজা স্তম্ভের পর স্তম্ভ, সূচির পর সূচি, সমুদায় স্তূপ ও বেষ্টনী পর্য্যবেক্ষণ করিলেন। পরে বাহিরে আসিয়া রাজা ধনভূতি ও ধর্ম্মযাজক বহুক্ষণ পরামর্শ করিলেন। ইতিমধ্যে জনসঙ্ঘে কোলাহল বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। সম্মুখ পংক্তির নাগরিকগণ ক্রমশঃ অধীর হইয়া উঠিল। রাজাদেশে রক্ষিগণ জনতা-মধ্যে প্রবেশ করিয়া নগরের কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে রাজসমীপে আনয়ন করিল। তখন তাঁহারা সকলে সেই সূচিবৎ তীক্ষ্ণ শিক্ষাসঙ্কুল অনাবৃত ভূমিতে উপবেশন করিয়া ভবিষ্যতের কার্য্যসম্বন্ধে পরামর্শ করিতে লাগিলেন। জনসাধারণ নাগরিকগণকে রাজসমীপে আসিতে দেখিয়া কথঞ্চিৎ শান্ত হইল; তাহারা বোধ হয় ভাবিল যে, রাজা হয়ত তাহাদিগের আশা পূর্ণ করিবার জন্য প্রধান প্রধান নাগরিকগণকে সমীপে আহ্বান করিয়াছেন। কতদিন হইতে তাহারা শুনিয়া আসিতেছে যে, উপাসক ও উপাসিকাগণের পূজার জন্য তথাগতের দেহাবশেষ আনীত হইবে! মথুরাবাসীরা সদ্ধর্ম্মীদিগের জন্য ভস্মাবশেষের এক কণা দিতে স্বীকৃত হইয়াছে। কতদিন হইতে তাহারা শুনিয়া আসিতেছে যে, নগরপ্রান্তে গর্ভচৈত্য নির্ম্মিত হইবে; চৈত্যগর্ভে তথাগতের দেহাবশেষ রক্ষিত হইবে; সুদূর পর্ব্বত হইতে নির্ম্মাণকার্য্যের জন্য রক্তবর্ণ প্রস্তর আনীত হইবে; সুদূর উদ্যান, গান্ধার ও কপিশা হইতে যবন শিল্পী আসিয়া নূতন ও পুরাতন ভাস্কর্য্যমিশ্রিত নব প্রথায় স্তূপবেষ্টনী নির্ম্মাণ করিবে। শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যময় পর্ব্বতসানু হইতে বহু বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া অশ্মরাশি সঞ্চিত হইয়াছে। উত্তর পশ্চিম প্রদেশ হইতে যবন শিল্পী এবং মগধ ও মথুরা হইতে দেশীয় ভাস্করগণ আনীত হইয়াছে; স্তূপও নির্ম্মিত হইয়াছে; তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই অর্থ প্রদান করিয়াছে বা বিনা পারিশ্রমিকে পরিশ্রম করিয়াছে, অথচ তাহারা স্তূপ দেখিতে পাইবেনা বা বেষ্টনীর অভ্যন্তরে যাইতে পারিবে না, ইহা তাহাদিগের নিকট অবিচার বলিয়া বোধ হইল। পরামর্শান্তে রাজসমীপে আহূত নাগরিকগণ জনসঙ্ঘের মধ্যে প্রবেশ করিয়া প্রচার করিতে লাগিলেন যে, সপ্তাহান্তে স্তূপগর্ভে তথাগতের শরীর নিহিত হইবে; সেই দিন নগরে অষ্টপ্রহরব্যাপী উৎসব হইবে ও সেইদিন প্রাতঃকাল হইতে সকলেই বেষ্টনীর অভ্যন্তরে প্রবেশের ও অর্চ্চনার অধিকার লাভ করিবে। তাঁহারা জানাইলেন যে, রাজা তখনও ব্রাহ্মণগণের উপদ্রবের আশঙ্কা করেন; কারণ ইতোমধ্যে তাহারা দুই একবার বিপৎপাতের চেষ্টা করিয়াছে; সুতরাং অসম্বদ্ধ জনপ্রবাহ বেষ্টনীর অভ্যন্তরে ছাড়িয়া দিলে তাহারা অবসর পাইয়া নূতন কি উৎপাত করিবে তাহা বলা যায় না। বিশেষরূপ বিবেচনা করিয়া তাঁহারা সকলকে বেষ্টনীর অভ্যন্তরে প্রবেশলাভের অনুমতি দিবার বিরোধী হইয়াছেন। তাঁহারা আরও বলিলেন যে, অপর সকলের ন্যায় তাঁহারাও স্তূপ দেখিবার আশায় নগর পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছিলেন; কিন্তু অবস্থা বিবেচনা করিয়া তাঁহারাও প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছেন। তখন সেই বিশাল জনসঙ্ঘ নগরে প্রত্যাবর্ত্তন করিল।

 শুনিলাম সপ্তাহান্তে উৎসব হইবে। তক্ষণের ক্লেশ ভুলিয়া যাইলাম, উৎসব কিরূপ তাহা জানিবার জন্য বড়ই আগ্রহ জন্মিল। মনুষ্যজাতিকে অল্পদিন দেখিতেছি, যতই দেখিতেছি বিস্ময় ততই বর্দ্ধিত হইতেছে। সেই কৃষ্ণবর্ণ জাতি কোথায় গেল, সেই উজ্জ্বল শ্বেতবর্ণ জাতি কোথায় গেল,—শ্বেতকৃষ্ণ মিশ্রিত অপেক্ষাকৃত খর্ব্বাকার জাতি কোথা হইতে আসিল? এ সকল কথার মীমাংসা বোধ হয় আজও হয় নাই, কখনও হইবে কি না সন্দেহ। তবে যদি আমার ন্যায় অতীতের সাক্ষী আরও কেহ আইসে, আমা অপেক্ষা প্রাচীন কথার অবতারণা যদি কেহ করে, অথবা মনুষ্যজাতির সৃষ্টি হইতে তৎসংশ্লিষ্ট ব্যাপার সমূহে লিপ্ত অপর কেহ যদি নিজের বাক্‌শক্তি পরিস্ফুটিত করিবার চেষ্টায় সফলকাম হয়, তবেই এই প্রশ্নের মীমাংসা হইবে। কখনও মনুষ্যজাতির উৎসব দেখি নাই। নূতন দৃশ্য দেখিবার উৎসাহ ও দৃষ্টসমৃদ্ধির স্মৃতি এরূপ প্রবল হইয়াছিল যে, সে উৎসবের চিত্র অদ্যাপি আমার পরিস্ফুট আছে। নূতন বেশে, নূতন চিত্রে শোভিত হইয়া তক্ষকের শাণিত অস্ত্রাঘাতের দুর্ব্বিসহ যন্ত্রণাও বিস্মৃত হইয়াছিলাম।