পুনশ্চ/প্রথম পূজা
প্রথম পূজা
ত্রিলোকেশ্বরের মন্দির।
লোকে বলে স্বয়ং বিশ্বকর্ম্মা তার ভিৎপত্তন করেছিলেন
কোন্ মান্ধাতার আমলে,—
স্বয়ং হনুমান এনেছিলেন তার পাথর বহন করে।
ইতিহাসের পণ্ডিত বলেন, এ মন্দির কিরাত জাতের গড়া,
এ দেবতা কিরাতের।
একদা যখন ক্ষত্রিয় রাজা জয় করলেন দেশ,—
দেউলের আঙিনা পূজারীদের রক্তে গেল ভেসে,
দেবতা রক্ষা পেলেন নতুন নামে, নতুন পূজাবিধির আড়ালে,—
হাজার বৎসরের প্রাচীন ভক্তি-ধারার স্রোত গেল ফিরে।
কিরাত আজ অস্পৃশ্য, এ মন্দিরে তার প্রবেশ-পথ লুপ্ত।
কিরাত থাকে সমাজের বাইরে,
নদীর পূর্ব্বপারে তার পাড়া।
সে ভক্ত, আজ তার মন্দির নেই, তার গান আছে।
নিপুণ তার হাত, অভ্রান্ত তার দৃষ্টি।
সে জানে কী করে পাথরের উপর পাথর বাঁধে,
কী করে পিতলের উপর রূপোর ফুল তোলা যায়,—
কৃষ্ণশিলায় মূর্ত্তি গড়বার ছন্দটা কী।
রাজশাসন তার নয়, অস্ত্র তার নিয়েচে কেড়ে,
বেশে বাসে ব্যবহারে সম্মানের চিহ্ণ হতে সে বৰ্জ্জিত,
বঞ্চিত সে পুঁথির বিদ্যায়।
ত্রিলোকেশ্বর মন্দিরের স্বর্ণচূড়া পশ্চিম দিগন্তে যায় দেখা,
চিনতে পারে নিজেদেরই মনের আকল্প,
বহু দূরের থেকে প্রণাম করে।
কার্ত্তিক পূর্ণিমা, পূজার উৎসব।
মঞ্চের উপরে বাজচে বাঁশি মৃদঙ্গ করতাল,
মাঠ জুড়ে কানাতের পর কানাত,
মাঝে মাঝে উঠেচে ধ্বজা।
পথের দুইধারে ব্যাপারীদের পসরা,—
তামার পাত্র, রূপোর অলঙ্কার, দেবমূর্ত্তির পট, রেশমের কাপড়,
ছেলেদের খেলার জন্যে কাঠের ডমরু, মাটির পুতুল, পাতার বাঁশি;
অর্ঘ্যের উপকরণ, ফল মালা ধূপ বাতি, ঘড়া ঘড়া তীর্থবারি।
বাজিকর তারস্বরে প্রলাপবাক্যে দেখাচ্চে বাজি,
কথক পড়চে রামায়ণ কথা।
উজ্জ্বলবেশে সশস্ত্র প্রহরী ঘুরে বেড়ায় ঘোড়ায় চড়ে;
রাজ-অমাত্য হাতীর উপর হাওদায়,
সম্মুখে বেজে চলেচে শিঙা।
কিংখাবে ঢাক। পাল্কীতে ধনীঘরের গৃহিণী,
আগে পিছে কিঙ্করের দল।
সন্ন্যাসীর ভিড় পঞ্চবটের তলায়,
নগ্ন, জটাধারী, ছাইমাখা,
মেয়েরা পায়ের কাছে ভোগ রেখে যায়।
ফল দুধ মিষ্টান্ন, ঘি, আতপ তণ্ডুল।
থেকে থেকে আকাশে উঠচে চীৎকারধ্বনি,
জয় ত্রিলোকেশ্বরের জয়।
কাল আসবে শুভলগ্নে রাজার প্রথম পূজা,
স্বয়ং আসবেন মহারাজা রাজহস্তীতে চড়ে।
তাঁর আগমন-পথের দুইধারে
সারি সারি কলার গাছে ফুলের মালা,
মঙ্গলঘটে আম্রপল্লব।
আর ক্ষণে ক্ষণে পথের ধূলায় সেচন করচে গন্ধবারি।
শুক্ল ত্রয়োদশীর রাত।
মন্দিরে প্রথম প্রহরের শঙ্খ ঘণ্টা ভেরী পটহ থেমেচে।
আজ চাঁদের উপরে একটা ঘোলা আবরণ,
জ্যোৎস্না আজ ঝাপসা,—
যেন মূর্চ্ছার ঘোর লাগল।
বাতাস রুদ্ধ,—
ধোঁয়া জমে আছে আকাশে,
গাছপালাগুলো যেন শঙ্কায় আড়ষ্ট।
কুকুর অকারণে আর্ত্তনাদ করচে,
ঘোড়াগুলো কান খাড়া করে উঠচে ডেকে
কোন অলক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে।
হঠাৎ গম্ভীর ভীষণ শব্দ শোনা গেল মাটির নীচে-
পাতালে দানবেরা যেন রণদামামা বাজিয়ে দিলে—
গুরু গুরু গুরু গুরু।
মন্দিরে শঙ্খ ঘণ্টা বাজতে লাগল প্রবল শব্দে।
হাতী বাঁধা ছিল
তারা বন্ধন ছিড়ে গর্জ্জন করতে করতে
ছুটল চারদিকে
যেন ঘূর্ণি-ঝড়ের মেঘ;
তুফান উঠল মাটিতে,
ছুটল উট মহিষ গোরু ছাগল ভেড়া
ঊর্দ্ধশ্বাসে, পালে পালে।
হাজার হাজার দিশাহারা লোক
আর্ত্তস্বরে ছুটে বেড়ায়,
চোখে তাদের ধাঁধা লাগে,
আত্ম-পরের ভেদ হারিয়ে কে কাকে দেয় দ'লে।
মাটি ফেটে ফেটে ওঠে ধোঁওয়া, ওঠে গরমজল,—
ভীম সরোবরের দিঘি বালির নীচে গেল শুষে।
মন্দিরের চূড়ায় বাঁধা বড়ো ঘণ্টা দুলতে দুলতে
বাজতে লাগল ঢং ঢং।
আচম্কা ধ্বনি থামল একটা ভেঙে পড়ার শব্দে।
পৃথিবী যখন স্তব্ধ হোলো
পূর্ণপ্রায় চাঁদ তখন হেলেচে পশ্চিমের দিকে।
আকাশে উঠচে জ্বলে-ওঠা কানাতগুলোর ধোঁয়ার কুণ্ডলী,
জ্যোৎস্নাকে যেন অজগর সাপে জড়িয়েচে।
পরদিন আত্মীয়দের বিলাপে দিগ্বিদিক যখন শোকার্ত্ত,—
তখন রাজসৈনিকদল মন্দির ঘিরে দাঁড়ালো,
পাছে অশুচিতার কারণ ঘটে।
রাজমন্ত্রী এল, দৈবজ্ঞ এল, স্মার্ত্তপণ্ডিত এল।
দেখলে, বাহিরের প্রাচীর ধূলিসাৎ।
দেবতার বেদীর উপরের ছাদ পড়েচে ভেঙে।
পণ্ডিত বল্লে, সংস্কার করা চাই আগামী পূর্ণিমার পূর্ব্বেই
নইলে দেবতা পরিহার করবেন তাঁর মূর্ত্তিকে।
রাজা বললেন, “সংস্কার করো।”
মন্ত্রী বলেন, “ঐ কিরাতরা ছাড়া কে করবে পাথরের কাজ।
ওদের দৃষ্টি-কলুষ থেকে দেবতাকে রক্ষা করব কী উপায়ে,
কী হবে মন্দির-সংস্কারে যদি মলিন হয় দেবতার অঙ্গ-মহিমা।”
কিরাত-দলপতি মাধবকে রাজা আন্লেন ডেকে।
বৃদ্ধ মাধব, শুক্লকেশের উপর নির্ম্মল সাদা চাদর জড়ানো,—
পরিধানে পীতধড়া, তাম্রবর্ণ দেহ কটি-পর্য্যন্ত অনাবৃত,—
দুই চক্ষু সকরুণ নম্রতায় পূর্ণ,
সাবধানে রাজার পায়ের কাছে রাখলে একমুঠো কুন্দ ফুল,
প্রণাম করলে, স্পর্শ বাঁচিয়ে।
রাজা বললেন, “তোমরা না হলে দেবালয় সংস্কার হয় না।”
“আমাদের পরে দেবতার ঐ কৃপা,”
এই বলে দেবতার উদ্দেশে মাধব প্রণাম জানালে।
নৃপতি নৃসিংহরায় বললেন, “চোখ বেঁধে কাজ করা চাই,
দেবমূর্ত্তির উপর দৃষ্টি না পড়ে। পারবে?”
মাধব বলে, “অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে কাজ করিয়ে নেবেন অন্তর্য্যামী।
যতক্ষণ কাজ চল্বে, চোখ খুলব না।”
বাহিরে কাজ করে কিরাতের দল,
মন্দিরের ভিতরে কাজ করে মাধব,
তার দুই চক্ষু পাকে পাকে কালো কাপড়ে বাঁধা।
দিনরাত সে মন্দিরের বাহিরে যায় না,
ধ্যান করে, গান গায়, আর তার আঙুল চল্তে থাকে।
মন্ত্রী এসে বলে, “ত্বরা করো, ত্বরা করো,
তিথির পরে তিথি যায়, কবে লগ্ন হবে উত্তীর্ণ।”
মাধব জোড়হাতে বলে, “যার কাজ তাঁরই নিজের আছে ত্বরা,
আমি তো উপলক্ষ্য।”
অমাবস্যা পার হয়ে শুক্লপক্ষ এল আবার।
অন্ধ মাধব আঙুলের স্পর্শ দিয়ে পাথরের সঙ্গে কথা কয়,
পাথর তার সাড়া দিতে থাকে।
কাছে দাঁড়িয়ে থাকে প্রহরী
পাছে মাধব চোখের বাঁধন খোলে।
পণ্ডিত এসে বল্লে, “একাদশীর রাত্রে প্রথম পূজার শুভক্ষণ।
কাজ কি শেষ হবে তার পূর্ব্বে।”
মাধব-প্রণাম করে বল্লে, “আমি কে, যে, উত্তর দেব;
কৃপা যখন হবে সংবাদ পাঠাব যথাসময়ে,
তার আগে এলে ব্যাঘাত হবে, বিলম্ব ঘটবে।”
ষষ্ঠী গেল, সপ্তমী পেরোলো,
মন্দিরের দ্বার দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ে
মাধবের শুক্লকেশে।
সূর্য অস্ত গেল, পাণ্ডুর আকাশে একাদশীর চাঁদ।
মাধব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে,
“যাও প্রহরী, সংবাদ দিয়ে এসে গে
মাধবের কাজ শেষ হোলো আজ।
লগ্ন যেন বয়ে না যায়।”
প্রহরী গেল।
মাধব খুলে ফেললে চোখের বন্ধন।
মুক্ত দ্বার দিয়ে পড়েচে একাদশী চাঁদের পূর্ণ আলো
দেবমূর্ত্তির উপরে।
মাধব হাঁটু গেড়ে বসল দুই হাত জোড় করে,
একদৃষ্টে চেয়ে রইল দেবতার মুখে,
দুই চোখে বইল জলের ধারা।
আজ হাজার বছরের ক্ষুধিত দেখা দেবতার সঙ্গে ভক্তের।
রাজা প্রবেশ করলেন মন্দিরে।
তখন মাধবের মাথা নত বেদীমূলে।
রাজার তলোয়ারে মুহূর্ত্তে ছিন্ন হোলো সেই মাথা।
দেবতার পায়ে এই প্রথম পুজা, এই শেষ প্রণাম॥
২৮ শ্রাবণ, ১৩৩৯